যথার্থ আপন
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কুষ্মাণ্ডের মনে মনে বড়ো অভিমান, বাঁশের মাচাটি তার পুষ্পক বিমান। ভুলেও মাটির পানে তাকায় না তাই, চন্দ্রসূর্যতারকারে করে ‘ভাই ভাই’। নভশ্চর ব’লে তাঁর মনের বিশ্বাস, শূন্য-পানে চেয়ে তাই ছাড়ে সে নিশ্বাস। ভাবে, ‘শুধু মোটা এই বোঁটাখানা মোরে বেঁধেছে ধরার সাথে কুটুম্বিতাডোরে; বোঁটা যদি কাটা পড়ে তখনি পলকে উড়ে যাব আপনার জ্যোতির্ময় লোকে।’ বোঁটা যবে কাটা গেল, বুঝিল সে খাঁটি— সূর্য তার কেহ নয়, সবই তার মাটি।
হাতে-কলমে
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
বোলতা কহিল, এ যে ক্ষুদ্র মউচাক, এরই তরে মধুকর এত করে জাঁক! মধুকর কহে তারে, তুমি এসো ভাই, আরো ক্ষুদ্র মউচাক রচো দেখে যাই॥
গৃহভেদ
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
আম্র কহে, একদিন, হে মাকাল ভাই, আছিনু বনের মাঝে সমান সবাই; মানুষ লইয়া এল আপনার রুচি— মূল্যভেদ শুরু হল, সাম্য গেল ঘুচি॥
গরজের আত্মীয়তা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কহিল ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলিরে, আমরা কুটুম্ব দোঁহে ভুলে গেলি কি রে? থলি বলে, কুটুম্বিতা তুমিও ভুলিতে আমার যা আছে গেলে তোমার ঝুলিতে॥
কুটুম্বিতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই ব’লে ডাকো যদি দেব গলা টিপে। হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা; কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা॥
উদারচরিতানাম্
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
প্রাচীরের ছিদ্রে এক নামগোত্রহীন ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন। ধিক্-ধিক্ করে তারে কাননে সবাই; সূর্য উঠি বলে তারে, ভালো আছ ভাই?।
অসম্ভব ভালো
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
যথাসাধ্য-ভালো বলে, ওগো আরো-ভালো, কোন্ স্বর্গপুরী তুমি করে থাকো আলো? আরো-ভালো কেঁদে কহে, আমি থাকি হায় অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়॥
প্রত্যক্ষ প্রমাণ
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
বজ্র কহে, দূরে আমি থাকি যতক্ষণ আমর গর্জনে বলে মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের জ্যোতি বলি মোর জ্যোতি রটে, মাথায় পড়িলে তবে বলে— ‘বজ্র বটে!’
ভক্তিভাজন
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম— ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম। পথ ভাবে ‘আমি দেব’, রথ ভাবে ‘আমি’, মূর্তি ভাবে ‘আমি দেব’— হাসে অন্তর্যামী॥
উপকারদম্ভ
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির, লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির॥
সন্দেহের কারণ
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
‘কত বড়ো আমি’ কহে নকল হীরাটি। তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি॥
অকৃতজ্ঞ
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে, ধ্বনি-কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে॥
নিজের ও সাধারণের
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
চন্দ্র কহে, বিশ্বে আলো দিয়েছি ছড়ায়ে, কলঙ্ক যা আছে তাহা আছে মোর গায়ে॥
মাঝারির সতর্কতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে॥
নতিস্বীকার
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
তপন-উদয়ে হবে মহিমার ক্ষয়, তবু প্রভাতের চাঁদ শান্তমুখে কয়, অপেক্ষা করিয়া আছি অস্তসিন্ধুতীরে প্রণাম করিয়া যাব উদিত রবিরে॥
কর্তব্যগ্রহণ
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি— শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি। মাটির প্রদীপ ছিল; সে কহিল, স্বামী, আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি॥
ধ্রুবাণি তস্য নশ্যন্তি
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা॥
মোহ
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ও পারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। নদীর ও পার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে— কহে, যাহা কিছু সুখ সকলই ও পারে॥
ফুল ও ফল
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
ফুল কহে ফুকারিয়া, ফল, ওরে ফল, কত দূরে রয়েছিস বল্ মোরে বল্! ফল কহে মহাশয়, কেন হাঁকাহাঁকি— তোমারই অন্তরে আমি নিরন্তর থাকি॥
প্রশ্নের অতীত
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
হে সমুদ্র, চিরকাল কী তোমার ভাষা? সমুদ্র কহিল, মোর অনন্ত জিজ্ঞাসা। কিসের স্তব্ধতা তব ওগো গিরিবর? হিমাদ্রি কহিল, মোর চিরনিরুত্তর॥
মোহের আশঙ্কা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
শিশু পুষ্প আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা— শ্যামল, সুন্দর, স্নিগ্ধ, গীতগন্ধ-ভরা; বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়, আমি যতকাল থাকি তুমিও থাকিয়ো॥
চালক
কণিকা / সঞ্চয়িতা
কণিকা / সঞ্চয়িতা
অদৃষ্টেরে শুধালেম, চিরদিন পিছে অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে? সে কহিল, ফিরে দেখো। দেখিলেম থামি, সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি॥