কত কী যে আসে কত কী যে যায়
কথা ও কাহিনী
কথা ও কাহিনী
কত কী যে আসে কত কী যে যায় বাহিয়া চেতনাবাহিনী! আঁধারে আড়ালে গোপনে নিয়ত হেথা হোথা তারি পড়ে থাকে কত— ছিন্নসূত্র বাছি শত শত তুমি গাঁথ বসে কাহিনী। ওগো একমনা, ওগো অগোচরা, ওগো স্মৃতি-অবগাহিনী! তব ঘরে কিছু ফেলা নাহি যায় ওগো হৃদয়ের গেহিনী! কত সুখ দুখ আসে প্রতিদিন, কত ভুলি কত হয়ে আসে ক্ষীণ— তুমি তাই লয়ে বিরামবিহীন রচিছ জীবনকাহিনী। আঁধারে বসিয়া কী যে কর কাজ ওগো স্মৃতি-অবগাহিনী। কত যুগ ধরে এমনি গাঁথিছ হৃদিশতদলশায়িনী! গভীর নিভৃতে মোর মাঝখানে কী যে আছে কী যে নাই কে বা জানে, কী জানি রচিলে আমার পরানে কত-না যুগের কাহিনী— কত জনমের কত বিস্মৃতি ওগো স্মৃতি-অবগাহিনী।
গানভঙ্গ
কথা ও কাহিনী
কথা ও কাহিনী
গাহিছে কাশীনাথ নবীন যুবা, ধ্বনিতে সভাগৃহ ঢাকি, কণ্ঠে খেলিতেছে সাতটি সুর সাতটি যেন পোষা পাখি; শানিত তরবারি গলাটি যেন নাচিয়া ফিরে দশ দিকে— কখন কোথা যায় না পাই দিশা, বিজুলি-হেন ঝিকিমিকে। আপনি গড়ি তোলে বিপদজাল, আপনি কাটি দেয় তাহা; সভার লোকে শুনে অবাক মানে, সঘনে বলে ‘বাহা বাহা’। কেবল বুড়া রাজা প্রতাপরায় কাঠের মতো বসি আছে; বরজলাল ছাড়া কাহারো গান ভালো না লাগে তার কাছে। বালক-বেলা হতে তাহারি গীতে দিল সে এতকাল যাপি— বাদল-দিনে কত মেঘের গান, হোলির দিনে কত কাফি। গেয়েছে আগমনী শরৎপ্রাতে, গেয়েছে বিজয়ার গান— হৃদয় উছসিয়া অশ্রুজলে ভাসিয়া গিয়াছে দুনয়ান। যখনি মিলিয়াছে বন্ধুজনে সভার গৃহ গেছে পূরে, গেয়েছে গোকুলের গোয়াল-গাথা ভূপালি মূলতানি সুরে। ঘরেতে বারবার এসেছে কত বিবাহ-উৎসব-রাতি— পরেছে দাসদাসী লোহিত বাস, জ্বলেছে শত শত বাতি, বসেছে নব বর সলাজ মুখে পরিয়া মণি-আভরণ, করিছে পরিহাস কানের কাছে সমবয়সী প্রিয়জন, সামনে বসি তার বরজলাল ধরেছে সাহানার সুর— সে-সব দিন আর সে-সব গান হৃদয়ে আছে পরিপূর। সে ছাড়া কারো গান শুনিলেই তাই মর্মে গিয়ে নাহি লাগে অতীত প্রাণ যেন মন্ত্রবলে নিমেষে প্রাণে নাহি জাগে। প্রতাপরায় তাই দেখিছে শুধু কাশীর বৃথা মাথা-নাড়া— সুরের পরে সুর ফিরিয়া যায়, হৃদয়ে নাহি পায় সাড়া। থামিল গান যবে ক্ষণেক-তরে বিরাম মাগে কাশীনাথ; বরজলাল-পানে প্রতাপ রায় হাসিয়া করে আঁখিপাত। কানের কাছে তার রাখিয়া মুখ কহিল, “ওস্তাদজি, গানের মতো গান শুনায়ে দাও, এরে কি গান বলে, ছি! এ যেন পাখি লয়ে বিবিধ ছলে, শিকারী বিড়ালের খেলা। সেকালে গান ছিল, একালে হায় গানের বড়ো অবহেলা।” বরজলাল বুড়া শুক্লকেশ, শুভ্র উষ্ণীষ শিরে, বিনতি করি সবে সভার মাঝে আসন নিল ধীরে ধীরে। শিরা-বাহির-করা শীর্ণ করে তুলিয়া নিল তানপুর, ধরিল নতশিরে নয়ন মুদি ইমনকল্যাণ সুর। কাঁপিয়া ক্ষীণ স্বর মরিয়া যায় বৃহৎ সভাগৃহকোণে, ক্ষুদ্র পাখি যথা ঝড়ের মাঝে উড়িতে নারে প্রাণপণে। বসিয়া বাম পাশে প্রতাপরায়, দিতেছে শত উৎসাহ— “আহাহা, বাহা বাহা” কহিছে কানে, “গলা ছাড়িয়া গান গাহ।” সভার লোকে সবে অন্যমনা, কেহ বা কানাকানি করে। কেহ বা তোলে হাই, কেহ বা ঢোলে, কেহ বা চ’লে যায় ঘরে। “ওরে রে আয় লয়ে তামাকু পান” ভৃত্যে ডাকি কেহ কয়। সঘনে পাখা নাড়ি কেহ বা বলে, “গরম আজি অতিশয়।” করিছে আনাগোনা ব্যস্ত লোক, ক্ষণেক নাহি রহে চুপ। নীরব ছিল সভা, ক্রমশ সেথা শব্দ ওঠে শতরূপ। বুড়ার গান তাহে ডুবিয়া যায়, তুফান-মাঝে ক্ষীণ তরী— কেবল দেখা যায় তানপুরায় আঙুল কাঁপে থরথরি। হৃদয়ে যেথা হতে গানের সুর উছসি উঠে নিজসুখে হেলার কলরব শিলার মতো চাপে সে উৎসের মুখে— কোথায় গান আর কোথায় প্রাণ দু দিকে ধায় দুই জনে, তবুও রাখিবারে প্রভুর মান বরজ গায় প্রাণপণে। গানের এক পদ মনের ভ্রমে হারায়ে গেল কী করিয়া, আবার তাড়াতাড়ি ফিরিয়া গাহে— লইতে চাহে শুধরিয়া। আবার ভুলে যায় পড়ে না মনে, শরমে মস্তক নাড়ি আবার শুরু হতে ধরিল গান— আবার ভুলি দিল ছাড়ি। দ্বিগুণ থরথরি কাঁপিছে হাত, স্মরণ করে গুরুদেবে। কণ্ঠ কাঁপিতেছে কাতরে, যেন বাতাসে দীপ নেবে-নেবে। গানের পদ তবে ছাড়িয়া দিয়া রাখিল সুরটুকু ধরি, সহসা হাহারবে উঠিল কাঁদি গাহিতে গিয়া হা-হা করি। কোথায় দূরে গেল সুরের খেলা, কোথায় তাল গেল ভাসি, গানের সুতা ছিঁড়ি পড়িল খসি, অশ্রু-মুকুতার রাশি। কোলের সখী তানপুরার ’পরে রাখিল লজ্জিত মাথা— ভুলিল শেখা গান, পড়িল মনে বাল্যক্রন্দনগাথা। নয়ন ছলছল, প্রতাপরায় কর বুলায় তার দেহে— “আইস হেথা হতে আমরা যাই” কহিল সকরুণ স্নেহে। শতেক-দীপ-জ্বালা নয়ন-ভরা ছাড়ি সে উৎসবঘর বাহিরে গেল দুটি প্রাচীন সখা ধরিয়া দুঁহু দোঁহা-কর। বরজ করজোড়ে কহিল, “প্রভু, মোদের সভা হল ভঙ্গ। এখন আসিয়াছে নূতন লোক, ধরায় নব নব রঙ্গ! জগতে আমাদের বিজন সভা কেবল তুমি আর আমি— সেথায় আনিয়ো না নূতন শ্রোতা, মিনতি তব পদে স্বামী! একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুই জনে— গাহিবে একজন খুলিয়া গলা, আরেক জন গাবে মনে। তটের বুকে লাগে জলের ঢেউ তবে সে কলতান উঠে— বাতাসে বনসভা শিহরি কাঁপে, তবে সে মর্মর ফুটে। জগতে যেথা যত রয়েছে ধ্বনি যুগল মিলিয়াছে আগে— যেখানে প্রেম নাই, বোবার সভা, সেখানে গান নাহি জাগে।”
পুরাতন ভৃত্য
কথা ও কাহিনী
কথা ও কাহিনী
ভূতের মতন চেহারা যেমন, নির্বোধ অতি ঘোর— যা-কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, “কেষ্টা বেটাই চোর।” উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত, শুনেও শোনে না কানে। যত পায় বেত না পায় বেতন, তবু না চেতন মানে। বড়ো প্রয়োজন, ডাকি প্রাণপণ চীৎকার করি “কেষ্টা”— যত করি তাড়া নাহি পাই সাড়া, খুঁজে ফিরি সারা দেশটা। তিনখানা দিলে একখানা রাখে, বাকি কোথা নাহি জানে; একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে তিনখানা করে আনে। যেখানে সেখানে দিবসে দুপুরে নিদ্রাটি আছে সাধা; মহাকলরবে গালি দেই যবে “পাজি হতভাগা গাধা”— দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে হাসে, দেখে জ্বলে যায় পিত্ত। তবু মায়া তার ত্যাগ করা ভার— বড়ো পুরাতন ভৃত্য। ঘরের কর্ত্রী রুক্ষমূর্তি বলে, “আর পারি নাকো, রহিল তোমার এ ঘর-দুয়ার, কেষ্টারে লয়ে থাকো। না মানে শাসন বসন বাসন অশন আসন যত কোথায় কী গেল, শুধু টাকাগুলো যেতেছে জলের মতো। গেলে সে বাজার সারা দিনে আর দেখা পাওয়া তার ভার— করিলে চেষ্টা কেষ্টা ছাড়া কি ভৃত্য মেলে না আর!” শুনে মহা রেগে ছুটে যাই বেগে, আনি তার টিকি ধরে; বলি তারে, “পাজি, বেরো তুই আজই, দূর করে দিনু তোরে।” ধীরে চলে যায়, ভাবি গেল দায়; পরদিনে উঠে দেখি, হুঁকাটি বাড়ায়ে রয়েছে দাঁড়ায়ে বেটা বুদ্ধির ঢেঁকি— প্রসন্ন মুখ, নাহি কোনো দুখ, অতি অকাতর চিত্ত! ছাড়ালে না ছাড়ে, কী করিব তারে— মোর পুরাতন ভৃত্য! সে বছরে ফাঁকা পেনু কিছু টাকা করিয়া দালালগিরি। করিলাম মন শ্রীবৃন্দাবন বারেক আসিব ফিরি। পরিবার তায় সাথে যেতে চায়, বুঝায়ে বলিনু তারে— পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য, নহিলে খরচ বাড়ে। লয়ে রশারশি করি কষাকষি পোঁটলাপুঁটলি বাঁধি বলয় বাজায়ে বাক্স সাজায়ে গৃহিণী কহিল কাঁদি, “পরদেশে গিয়ে কেষ্টারে নিয়ে কষ্ট অনেক পাবে।” আমি কহিলাম, “আরে রাম রাম! নিবারণ সাথে যাবে।” রেলগাড়ি ধায়; হেরিলাম হায় নামিয়া বর্ধমানে— কৃষ্ণকান্ত অতি প্রশান্ত, তামাক সাজিয়া আনে! স্পর্ধা তাহার হেনমতে আর কত বা সহিব নিত্য! যত তারে দুষি তবু হনু খুশি হেরি পুরাতন ভৃত্য! নামিনু শ্রীধামে— দক্ষিণে বামে পিছনে সমুখে যত লাগিল পাণ্ডা, নিমেষে প্রাণটা করিল কণ্ঠাগত। জন-ছয়-সাতে মিলি এক-সাথে পরমবন্ধুভাবে করিলাম বাসা; মনে হল আশা, আরামে দিবস যাবে। কোথা ব্রজবালা কোথা বনমালা, কোথা বনমালী হরি! কোথা হা হন্ত, চিরবসন্ত! আমি বসন্তে মরি। বন্ধু যে যত স্বপ্নের মতো বাসা ছেড়ে দিল ভঙ্গ; আমি একা ঘরে ব্যাধি-খরশরে ভরিল সকল অঙ্গ। ডাকি নিশিদিন সকরুণ ক্ষীণ, “কেষ্ট আয় রে কাছে। এত দিনে শেষে আসিয়া বিদেষে প্রাণ বুঝি নাহি বাঁচে।” হেরি তার মুখ ভরে ওঠে বুক, সে যেন পরম বিত্ত— নিশিদিন ধরে দাঁড়ায়ে শিয়রে মোর পুরতন ভৃত্য। মুখে দেয় জল, শুধায় কুশল, শিরে দেয় মোর হাত; দাঁড়ায়ে নিঝুম, চোখে নাই ঘুম, মুখে নাই তার ভাত। বলে বার বার, “কর্তা, তোমার কোনো ভয় নাই, শুন— যাবে দেশে ফিরে, মাঠাকুরানীরে দেখিতে পাইবে পুন।” লভিয়া আরাম আমি উঠিলাম; তাহারে ধরিল জ্বরে; নিল সে আমার কালব্যাধিভার আপনার দেহ-’পরে। হয়ে জ্ঞানহীন কাটিল দু দিন, বন্ধ হইল নাড়ী; এতবার তারে গেনু ছাড়াবারে, এতদিনে গেল ছাড়ি। বহুদিন পরে আপনার ঘরে ফিরিনু সারিয়া তীর্থ; আজ সাথে নেই চিরসাথি সেই মোর পুরাতন ভৃত্য।
দুই বিঘা জমি
কথা ও কাহিনী
কথা ও কাহিনী
শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে। বাবু বলিলেন, “বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।” কহিলাম আমি, “তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই। চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো-জোর মরিবার মতো ঠাঁই।” শুনি রাজা কহে, “বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা, পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দীঘে সমান হইবে টানা— ওটা দিতে হবে।” কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি সজলচক্ষে, “করুণ রক্ষে গরিবের ভিটেখানি! সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া! দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!” আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে; কহিলেন শেষে ক্রূর হাসি হেসে, “আচ্ছা, সে দেখা যাবে।” পরে মাস-দেড়ে ভিটেমাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে— করিল ডিক্রি সকলি বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে। এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি! রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি। মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে, তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে। সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য— কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য! ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি, তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি। হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো, একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল। নমোনমো নমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি— গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি। অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি— ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি। পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ— স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল, নিশীথশীতল স্নেহ। বুকভরা মধু, বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে— “মা” বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে। দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে, কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি রথতলা করি বামে— রাখি হাটখোলা, নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে। ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে, নিলাজ কুলটা ভূমি, যখনি যাহার তখনি তাহার— এই কি জননী তুমি! সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা! আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ— পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ! আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন, তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন! ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন— কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোনো চিহ্ন! কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ি, ক্ষুধাহরা সুধারাশি। যত হাসো আজ যত করো সাজ ছিলে দেবী— হলে দাসী। বিদীর্ণ-হিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি; প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে, সেই আমগাছ, একি! বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা, একে একে মনে উদিল স্মরণে বালক-কালের কথা। সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিক ঘুম— অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম; সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন— ভাবিলাম, হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন! সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে; দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে। ভাবিলাম মনে বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা— স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা! হেনকালে হায় যমদূত-প্রায় কোথা হতে এল মালী, ঝুঁটি-বাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি! কহিলাম তবে, “আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব— দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব!” চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ; বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ। শুনি বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, “মারিয়া করিব খুন!” বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ। আমি কহিলাম, “শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!” বাবু কহে হেসে, “বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়।” আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে! তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!
দেবতার গ্রাস
কথা ও কাহিনী
কথা ও কাহিনী
গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে মৈত্রমহাশয় যাবেন সাগরসঙ্গমে তীর্থস্নান লাগি। সঙ্গীদল গেল জুটি কত বালবৃদ্ধ নরনারী; নৌকা দুটি প্রস্তুত হইল ঘাটে। পুণ্য লোভাতুর মোক্ষদা কহিল আসি, “হে দাদাঠাকুর, আমি তব হব সাথি।” বিধবা যুবতী— দুখানি করুণ আঁখি মানে না যুকতি, কেবল মিনতি করে— অনুরোধ তার এড়ানো কঠিন বড়ো। “স্থান কোথা আর” মৈত্র কহিলেন তারে। “পায়ে ধরি তব” বিধবা কহিল কাঁদি, “স্থান করি লব কোনোমতে এক ধারে।” ভিজে গেল মন, তবু দ্বিধাভরে তারে শুধালো ব্রাহ্মণ, “নাবালক ছেলেটির কী করিবে তবে?” উত্তর করিল নারী, “রাখাল? সে রবে আপন মাসির কাছে। তার জন্মপরে বহুদিন ভুগেছিনু সূতিকার জ্বরে, বাঁচিব ছিল না আশা; অন্নদা তখন আপন শিশুর সাথে দিয়ে তারে স্তন মানুষ করেছে যত্নে— সেই হতে ছেলে মাসির আদরে আছে মার কোল ফেলে। দুরন্ত মানে না কারে, করিলে শাসন মাসি আসি অশ্রুজলে ভরিয়া নয়ন কোলে তারে টেনে লয়। সে থাকিবে সুখে মার চেয়ে আপনার মাসিমার বুকে।” সম্মত হইল বিপ্র। মোক্ষদা সত্বর প্রস্তুত হইল বাঁধি জিনিস-পত্তর, প্রণমিয়া গুরুজনে, সখীদলবলে ভাসাইয়া বিদায়ের শোক-অশ্রুজলে। ঘাটে আসি দেখে— সেথা আগে-ভাগে ছুটি রাখাল বসিয়া আছে তরী-’পরে উঠি নিশ্চিন্ত নীরবে। “তুই হেথা কেন ওরে” মা শুধালো; সে কহিল, “যাইব সাগরে।” “যাইবি সাগরে! আরে, ওরে দস্যু ছেলে, নেমে আয়।” পুনরায় দৃঢ় চক্ষু মেলে সে কহিল দুটি কথা, “যাইব সাগরে।” যত তার বাহু ধরি টানাটানি করে রহিল সে তরণী আঁকড়ি। অবশেষে ব্রাহ্মণ করুণ স্নেহে কহিলেন হেসে, “থাক্ থাক্, সঙ্গে যাক।” মা রাগিয়া বলে, “চল্, তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে।” যেমনি সে কথা গেল আপনার কানে অমনি মায়ের বক্ষ অনুতাপবাণে বিঁধিয়া কাঁদিয়া উঠে। মুদিয়া নয়ন “নারায়ণ নারায়ণ” করিল স্মরণ— পুত্রে নিল কোলে তুলি, তার সর্বদেহে করুণ কল্যাণহস্ত বুলাইল স্নেহে। মৈত্র তারে ডাকি ধীরে চুপি চুপি কয়, “ছি ছি ছি, এমন কথা বলিবার নয়।” রাখাল যাইবে সাথে স্থির হল কথা— অন্নদা লোকের মুখে শুনি সে বারতা ছুটে আসি বলে, “বাছা, কোথা যাবি ওরে!” রাখাল কহিল হাসি, “চলিনু সাগরে, আবার ফিরিব মাসি!” পাগলের প্রায় অন্নদা কহিল ডাকি, “ঠাকুরমশায়, বড়ো যে দুরন্ত ছেলে রাখাল আমার, কে তাহারে সামালিবে! জন্ম হতে তার মাসি ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকে নি কোথাও; কোথা এরে নিয়ে যাবে, ফিরে দিয়ে যাও।” রাখাল কহিল, “মাসি, যাইব সাগরে, আবার ফিরিব আমি।” বিপ্র স্নেহভরে কহিলেন, “যতক্ষণ আমি আছি ভাই, তোমার রাখাল লাগি কোনো ভয় নাই। এখন শীতের দিন শান্ত নদীনদ, অনেক যাত্রীর মেলা, পথের বিপদ কিছু নাই; যাতায়াত মাস-দুই কাল, তোমারে ফিরায়ে দিব তোমার রাখাল।” শুভক্ষণে দুর্গা স্মরি নৌকা দিল ছাড়ি, দাঁড়ায়ে রহিল ঘাটে যত কুলনারী অশ্রুচোখে। হেমন্তের প্রভাতশিশিরে ছলছল করে গ্রাম চূর্ণীনদীতীরে। যাত্রীদল ফিরে আসে, সাঙ্গ হল মেলা। তরণী তীরেতে বাঁধা অপরাহ্ণবেলা জোয়ারের আশে। কৌতূহল-অবসান, কাঁদিতেছে রাখালের গৃহগত প্রাণ মাসির কোলের লাগি। জল শুধু জল, দেখে দেখে চিত্ত তার হয়েছে বিকল। মসৃণ চিক্কণ কৃষ্ণ কুটিল নিষ্ঠুর, লোলুপ লেলিহজিহ্ব সর্পসম ক্রূর খল জল ছল-ভরা, তুলি লক্ষ ফণা ফুঁসিছে গর্জিছে নিত্য করিছে কামনা মৃত্তিকার শিশুদের, লালায়িত মুখ। হে মাটি, হে স্নেহময়ী, অয়ি মৌনমূক, অয়ি স্থির, অয়ি ধ্রুব, অয়ি পুরাতন, সর্ব-উপদ্রবসহা আনন্দভবন শ্যামলকোমলা, যেথা যে-কেহই থাকে অদৃশ্য দু বাহু মেলি টানিছ তাহাকে অহরহ, অয়ি মুগ্ধে, কী বিপুল টানে দিগন্তবিস্তৃত তব শান্ত বক্ষ-পানে! চঞ্চল বালক আসি প্রতি ক্ষণে ক্ষণে অধীর উৎসুক কণ্ঠে শুধায় ব্রাহ্মণে, “ঠাকুর, কখন আজি আসিবে জোয়ার?” সহসা স্তিমিত জলে আবেগসঞ্চার দুই কূল চেতাইল আশার সংবাদে। ফিরিল তরীর মুখ, মৃদু আর্তনাদে কাছিতে পড়িল টান, কলশব্দগীতে সিন্ধুর বিজয়রথ পশিল নদীতে— আসিল জোয়ার। মাঝি দেবতারে স্মরি ত্বরিত উত্তর-মুখে খুলে দিল তরী। রাখাল শুধায় আসি ব্রাহ্মণের কাছে, “দেশে পঁহুছিতে আর কত দিন আছে?” সূর্য অস্ত না যাইতে, ক্রোশ দুই ছেড়ে উত্তর-বায়ুর বেগ ক্রমে ওঠে বেড়ে! রূপনারানের মুখে পড়ি বালুচর সংকীর্ণ নদীর পথে বাধিল সমর জোয়ারের স্রোতে আর উত্তরসমীরে উত্তাল উদ্দাম। “তরণী ভিড়াও তীরে” উচ্চকণ্ঠে বারম্বার কহে যাত্রীদল। কোথা তীর! চারি দিকে ক্ষিপ্তোন্মত্ত জল আপনার রুদ্র নৃত্যে দেয় করতালি লক্ষ লক্ষ হাতে, আকাশেরে দেয় গালি ফেনিল আক্রোশে। এক দিকে যায় দেখা অতিদূর তীরপ্রান্তে নীল বনরেখা, অন্য দিকে লুব্ধ ক্ষুব্ধ হিংস্র বারিরাশি প্রশান্ত সূর্যাস্ত-পানে উঠিছে উচ্ছ্বাসি উদ্ধতবিদ্রোহভরে। নাহি মানে হাল, ঘুরে টলমল তরী অশান্ত মাতাল মূঢ়সম। তীব্রশীতপবনের সনে মিশিয়া ত্রাসের হিম নরনারীগণে কাঁপাইছে থরহরি। কেহ হতবাক্, কেহ বা ক্রন্দন করে ছাড়ে ঊর্ধ্বডাক ডাকি আত্মজনে। মৈত্র শুষ্ক পাংশুমুখে চক্ষু মুদি করে জপ। জননীর বুকে রাখাল লুকায়ে মুখ কাঁপিছে নীরবে। তখন বিপন্ন মাঝি ডাকি কহে সবে, “বাবারে দিয়েছে ফাঁকি তোমাদের কেউ, যা মেনেছে দেয় নাই, তাই এত ঢেউ— অসময়ে এ তুফান। শুন এই বেলা— করহ মানত রক্ষা, করিয়ো না খেলা ক্রুদ্ধ দেবতার সনে।” যার যত ছিল অর্থ বস্ত্র যাহা-কিছু জলে ফেলি দিল না করি বিচার। তবু, তখনি পলকে তরীতে উঠিল জল দারুণ ঝলকে। মাঝি কহে পুনর্বার, “দেবতার ধন কে যায় ফিরায়ে লয়ে এই বেলা শোন্।” ব্রাহ্মণ সহসা উঠি কহিলা তখনি মোক্ষদারে লক্ষ্য করি, “এই সে রমণী দেবতারে সঁপি দিয়া আপনার ছেলে চুরি করে নিয়ে যায়।” “দাও তারে ফেলে” এক বাক্যে গর্জি উঠে তরাসে নিষ্ঠুর যাত্রী সবে। কহে নারী, “হে দাদাঠাকুর, রক্ষা করো, রক্ষা করো!” দুই দৃঢ় করে রাখালেরে প্রাণপণে বক্ষে চাপি ধরে। ভর্ৎসিয়া গর্জিয়া উঠি কহিলা ব্রাহ্মণ, “আমি তোর রক্ষাকর্তা! রোষে নিশ্চেতন মা হয়ে আপন পুত্র দিলি দেবতারে— শেষকালে আমি রক্ষা করিব তাহারে! শোধ্ দেবতার ঋণ; সত্য ভঙ্গ ক’রে এতগুলি প্রাণী তুই ডুবাবি সাগরে!” মোক্ষদা কহিল, “অতি মূর্খ নারী আমি, কী বলেছি রোষবশে— ওগো অন্তর্যামী, সেই সত্য হল! সে যে মিথ্যা কত দূর তখনি শুনে কি তুমি বোঝ নি ঠাকুর? শুধু কি মুখের বাক্য শুনেছ দেবতা, শোন নি কি জননীর অন্তরের কথা?” বলিতে বলিতে যত মিলি মাঝি-দাঁড়ি বল করি রাখালেরে নিল ছিঁড়ি কাড়ি মার বক্ষ হতে। মৈত্র মুদি দুই আঁখি ফিরায়ে রহিল মুখ কানে হাত ঢাকি দন্তে দন্তে চাপি বলে। কে তাঁরে সহসা মর্মে মর্মে আঘাতিল বিদ্যুতের কশা— দংশিল বৃশ্চিকদংশ। “মাসি! মাসি! মাসি!” বিন্ধিল বহ্নির শলা রুদ্ধ কর্ণে আসি নিরুপায় অনাথের অন্তিমের ডাক। চীৎকারি উঠিল বিপ্র, “রাখ্ রাখ্ রাখ্।” চকিতে হেরিল চাহি মূর্ছি আছে পড়ে মোক্ষদা চরণে তাঁর, মুহূর্তের তরে ফুটন্ত তরঙ্গ-মাঝে মেলি আর্ত চোখ “মাসি” বলি ফুকারিয়া মিলালো বালক অনন্ততিমিরতলে; শুধু ক্ষীণ মুঠি বারেক ব্যাকুল বলে ঊর্ধ্ব-পানে উঠি আকাশে আশ্রয় খুঁজি ডুবিল হতাশে। “ফিরায়ে আনিব তোরে” কহি ঊর্ধ্বশ্বাসে ব্রাহ্মণ মুহূর্তমাঝে ঝাঁপ দিল জলে— আর উঠিল না। সূর্য গেল অস্তাচলে।
নিষ্ফল উপহার
কথা ও কাহিনী
কথা ও কাহিনী
নিম্নে আবর্তিয়া ছুটে যমুনার জল— দুই তীরে গিরিতট, উচ্চ শিলাতল! সংকীর্ণ গুহার পথে মূর্ছি জলধার উন্মত্ত প্রলাপে ওঠে গর্জি অনিবার। এলায়ে জটিল বক্র নির্ঝরের বেণী নীলাভ দিগন্তে ধায় নীল গিরিশ্রেণী। স্থির তাহা, নিশিদিন তবু যেন চলে— চলা যেন বাঁধা আছে অচল শিকলে। মাঝে মাঝে শাল তাল রয়েছে দাঁড়ায়ে, মেঘেরে ডাকিছে গিরি ইঙ্গিত বাড়ায়ে। তৃণহীন সুকঠিন শতদীর্ণ ধরা, রৌদ্রবর্ণ বনফুলে কাঁটাগাছ ভরা। দিবসের তাপ ভূমি দিতেছে ফিরায়ে, দাঁড়ায়ে রয়েছে গিরি আপনার ছায়ে— পথশূন্য, জনশূন্য, সাড়া-শব্দ-হীন। ডুবে রবি, যেমন সে ডুবে প্রতিদিন। রঘুনাথ হেথা আসি যবে উত্তরিলা শিখগুরু পড়িছেন ভগবৎ-লীলা। রঘু কহিলেন নমি চরণে তাঁহার, “দীন আনিয়াছে, প্রভু, হীন উপহার।” বাহু বাড়াইয়া গুরু শুধায়ে কুশল আশিসিলা মাথায় পরশি করতল। কনকে মাণিক্যে গাঁথা বলয় দুখানি গুরুপদে দিলা রঘু জুড়ি দুই পাণি। ভূমিতল হইতে বালা লইলেন তুলে, দেখিতে লাগিলা প্রভু ঘুরায়ে অঙ্গুলে। হীরকের সূচীমুখ শতবার ঘুরি হানিতে লাগিল শত আলোকের ছুরি। ঈষৎ হাসিয়া গুরু পাশে দিলা রাখি, আবার সে পুঁথি-’পরে নিবেশিলা আঁখি। সহসা একটি বালা শিলাতল হতে গড়ায়ে পড়িয়া গেল যমুনার স্রোতে। “আহা আহা’‘ চীৎকার করি রঘুনাথ ঝাঁপায়ে পড়িল জলে বাড়ায়ে দু হাত। আগ্রহে সমস্ত তার প্রাণমন কায় একখানি বাহু হয়ে ধরিবারে যায়। বারেকের তরে গুরু না তুলিলা মুখ, নিভৃত অন্তরে তাঁর জাগে পাঠসুখ। কালো জল কটাক্ষিয়া চলে ঘুরি ঘুরি, যেন সে ছলনা-ভরা সুগভীর চুরি। দিবালোক চলে গেল দিবসের পিছু, যমুনা উতলা করি না মিলিল কিছু। সিক্তবস্ত্রে রিক্তহাতে, শ্রান্ত নতশিরে রঘুনাথ গুরু-কাছে আসিলেন ফিরে। “এখনো উঠাতে পারি” করজোড়ে যাচে, “যদি দেখাইয়া দাও কোনখানে আছে।” দ্বিতীয় কঙ্কণখানি ছুঁড়ি দিয়া জলে গুরু কহিলেন, “আছে ঐ নদীতলে।”
দীন দান
কথা ও কাহিনী
কথা ও কাহিনী
নিবেদিল রাজভৃত্য, “মহারাজ, বহু অনুনয়ে সাধুশ্রেষ্ঠ নরোত্তম তোমার সোনার দেবালয়ে না লয়ে আশ্রয় আজি পথপ্রান্তে তরুচ্ছায়াতলে করিছেন নামসংকীর্তন। ভক্তবৃন্দ দলে দলে ঘেরি তাঁরে দরদর-উদ্বেলিত আনন্দধারায় ধৌত ধন্য করিছেন ধরণীর ধূলি। শূন্যপ্রায় দেবাঙ্গন; ভৃঙ্গ যথা স্বর্ণময় মধুভাণ্ড ফেলি সহসা কমলগন্ধে মত্ত হয়ে দ্রুত পক্ষ মেলি ছুটে যায় গুঞ্জরিয়া উন্মীলিত পদ্ম-উপবনে উন্মুখ পিপাসাভরে, সেইমতো নরনারীগণে সোনার দেউল-পানে না তাকায়ে চলিয়াছে ছুটি যেথায় পথের প্রান্তে ভক্তের হৃদয়পদ্ম ফুটি বিতরিছে স্বর্গের সৌরভ। রত্নবেদিকার ’পরে একা দেব রিক্ত দেবালয়ে।” শুনি রাজা ক্ষোভভরে সিংহাসন হতে নামি গেলা চলি যেথা তরুচ্ছায়ে সাধু বসি তৃণাসনে; কহিলেন নমি তাঁর পায়ে, “হেরো, প্রভু, স্বর্ণ-শীর্ষ নৃপতিনির্মিত নিকেতন অভ্রভেদী দেবালয়— তারে কেন করিয়া বর্জন দেবতার স্তবগান গাহিতেছ পথপ্রান্তে বসে?” “সে মন্দিরে দেব নাই” কহে সাধু। রাজা কহে রোষে, “দেব নাই! হে সন্ন্যাসী, নাস্তিকের মতো কথা কহ। রত্নসিংহাসন-’পরে দীপিতেছে রতনবিগ্রহ— শূন্য তাহা?” “শূন্য নয়, রাজদম্ভে পূর্ণ” সাধু কহে— “আপনায় স্থাপিয়াছ, জগতের দেবতারে নহে।” ভ্রূ কুঞ্চিয়া কহে রাজা, “বিংশ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দিয়া রচিয়াছি অনিন্দিত যে মন্দির অম্বর ভেদিয়া, পূজামন্ত্রে নিবেদিয়া দেবতারে করিয়াছি দান, তুমি কহ সে মন্দিরে দেবতার নাহি কোনো স্থান!” শান্তমুখে কহে সাধু, “যে বৎসর বহ্নিদাহে দীন বিংশতি সহস্র প্রজা গৃহহীন অন্নবস্ত্রহীন দাঁড়াইল দ্বারে তব, কেঁদে গেল ব্যর্থ প্রার্থনায় অরণ্যে, গুহার গর্ভে, পথপ্রান্তে তরুর ছায়ায়, অশ্বত্থবিদীর্ণ জীর্ণ মন্দিরপ্রাঙ্গণে, সে বৎসর বিংশ লক্ষ মুদ্রা দিয়া রচি তব স্বর্ণদৃপ্ত ঘর দেবতারে সমর্পিলে! সে দিন কহিলা ভগবান, “আমার অনাদি ঘরে অগণ্য আলোক দীপ্যমান অনন্তনীলিমামাঝে; মোর ঘরে ভিত্তি চিরন্তন সত্য, শান্তি, দয়া, প্রেম। দীনশক্তি যে ক্ষুদ্র কৃপণ নাহি পারে গৃহ দিতে গৃহহীন নিজ প্রজাগণে সে আমারে গৃহ করে দান!’ চলি গেলা সেই ক্ষণে পথপ্রান্তে তরুতলে দীনসাথে দীনের আশ্রয়। অগাধ সমুদ্র-মাঝে স্ফীত ফেন যথা শূন্যময় তেমনি পরম শূন্য তোমার মন্দির বিশ্বতলে স্বর্ণ আর দর্পের বুদ্বুদ।’ রাজা জ্বলি রোষানলে কহিলেন, “রে ভণ্ড পামর, মোর রাজ্য ত্যাগ ক’রে এ মুহূর্তে চলি যাও।” সন্ন্যাসী কহিলা শান্ত স্বরে, “ভক্তবৎসলেরে তুমি যেথায় পাঠালে নির্বাসনে সেইখানে, মহারাজ, নির্বাসিত করো ভক্তজনে।”
বিসর্জন
কথা ও কাহিনী
কথা ও কাহিনী
দুইটি কোলের ছেলে গেছে পর পর বয়স না হতে হতে পুরা দু বছর। এবার ছেলেটি তার জন্মিল যখন স্বামীরেও হারালো মল্লিকা। বন্ধুজন বুঝাইল— পূর্বজন্মে ছিল বহু পাপ, এ জনমে তাই হেন দারুণ সন্তাপ। শোকানলদগ্ধ নারী একান্ত বিনয়ে অজ্ঞাত জন্মের পাপ শিরে বহি লয়ে প্রায়শ্চিত্তে দিল মন। মন্দিরে মন্দিরে যেথা সেথা গ্রামে গ্রামে পূজা দিয়া ফিরে। ব্রতধ্যান-উপবাসে আহ্নিকে তর্পণে কাটে দিন ধূপে দীপে নৈবেদ্যে চন্দনে, পূজাগৃহে; কেশে বাঁধি রাখিল মাদুলি কুড়াইয়া শত ব্রাহ্মণের পদধূলি; শুনে রামায়ণকথা; সন্ন্যাসী-সাধুরে ঘরে আনি আশীর্বাদ করায় শিশুরে। বিশ্বমাঝে আপনারে রাখি সর্ব-নীচে সবার প্রসন্ন দৃষ্টি অভাগী মাগিছে আপন সন্তান-লাগি; সূর্য চন্দ্র হতে পশুপক্ষী পতঙ্গ অবধি— কোনোমতে কেহ পাছে কোনো অপরাধ লয় মনে, পাছে কেহ করে ক্ষোভ, অজানা কারণে পাছে কারো লাগে ব্যথা, সকলের কাছে আকুল বেদনা-ভরে দীন হয়ে আছে। যখন বছর-দেড় বয়স শিশুর— যকৃতের ঘটিল বিকার; জ্বরাতুর দেহখানি শীর্ণ হয়ে আসে। দেবালয়ে মানিল মানত মাতা, পদামৃত লয়ে করাইল পান, হরিসংকীর্তন-গানে কাঁপিল প্রাঙ্গণ। ব্যাধি শান্তি নাহি মানে। কাঁদিয়া শুধালো নারী, “ব্রাহ্মণঠাকুর, এত দুঃখে তবু পাপ নাহি হল দূর! দিনরাত্রি দেবতার মেনেছি দোহাই, দিয়েছি এত যে পূজা তবু রক্ষা নাই! তবু কি নেবেন তাঁরা আমার বাছারে! এত ক্ষুধা দেবতার! এত ভারে ভারে নৈবেদ্য দিলাম খেতে বেচিয়া গহনা, সর্বস্ব খাওয়ানু তবু ক্ষুধা মিটিল না!’ ব্রাহ্মণ কহিল, “বাছা, এ যে ঘোর কলি। অনেক করেছ বটে তবু এও বলি— আজকাল তেমন কি ভক্তি আছে কারো? সত্যযুগে যা পারিত তা কি আজ পারো? দানবীর কর্ণ-কাছে ধর্ম যবে এসে পুত্রেরে চাহিল খেতে ব্রাহ্মণের বেশে, নিজ হস্তে সন্তানে কাটিল; তখনি সে শিশুরে ফিরিয়া পেল চক্ষের নিমেষে। শিবিরাজা শ্যেনরূপী ইন্দ্রের মুখেতে আপন বুকের মাংস কাটি দিল খেতে— পাইল অক্ষয় দেহ। নিষ্ঠা এরে বলে। তেমন কি এ কালেতে আছে ভূমণ্ডলে? মনে আছে ছেলেবেলা গল্প শুনিয়াছি মার কাছে— তাঁদের গ্রামের কাছাকাছি ছিল এক বন্ধ্যা নারী, না পাইয়া পথ প্রথম গর্ভের ছেলে করিল মানত মা-গঙ্গার কাছে। শেষে পুত্রজন্ম-পরে, অভাগী বিধবা হল; গেল সে সাগরে, কহিল সে নিষ্ঠাভরে মা-গঙ্গারে ডেকে, ‘মা, তোমারি কোলে আমি দিলাম ছেলেকে— এ মোর প্রথম পুত্র, শেষ পুত্র এই, এ জন্মের তরে আর পুত্র-আশা নেই।’ যেমনি জলেতে ফেলা, মাতা ভাগীরথী মকরবাহিনী-রূপে হয়ে মূর্তিমতী শিশু লয়ে আপনার পদ্মকরতলে মার কোলে সমর্পিল।— নিষ্ঠা এরে বলে।” মল্লিকা ফিরিয়া এল নতশির ক’রে, আপনারে ধিক্কারিল— “এত দিন ধরে বৃথা ব্রত করিলাম, বৃথা দেবার্চনা— নিষ্ঠাহীনা পাপিষ্ঠারে ফল মিলিল না।” ঘরে ফিরে এসে দেখে শিশু অচেতন জ্বরাবেশে; অঙ্গ যেন অগ্নির মতন। ঔষধ গিলাতে যায় যত বার বার পড়ে যায়— কণ্ঠ দিয়া নামিল না আর। দন্তে দন্তে গেল আঁটি। বৈদ্য শির নাড়ি ধীরে ধীরে চলি গেল রোগীগৃহ ছাড়ি। সন্ধ্যার আঁধারে শূন্য বিধবার ঘরে একটি মলিন দীপ শয়নশিয়রে, একা শোকাতুরা নারী। শিশু একবার জ্যোতিহীন আঁখি মেলি যেন চারি ধার খুঁজিল কাহারে। নারী কাঁদিল কাতর— “ও মানিক, ওরে সোনা, এই-যে মা তোর, এই-যে মায়ের কোল, ভয় কী রে বাপ।” বক্ষে তারে চাপি ধরি তার জ্বরতাপ চাহিল কাড়িয়া নিতে অঙ্গে আপনার প্রাণপণে। সহসা বাতাসে গৃহদ্বার খুলে গেল; ক্ষীণ দীপ নিবিল তখনি; সহসা বাহির হতে কলকলধ্বনি পশিল গৃহের মাঝে। চমকিল নারী, দাঁড়ায়ে উঠিল বেগে শয্য়াতল ছাড়ি; কহিল, “মায়ের ডাক ঐ শোনা যায়— ও মোর দুখীর ধন, পেয়েছি উপায়— তোর মার কোল চেয়ে সুশীতল কোল আছে ওরে বাছা।” জাগিয়াছে কলরোল অদূরে জাহ্নবীজলে, এসেছে জোয়ার পূর্ণিমায়। শিশুর তাপিত দেহভার বক্ষে লয়ে মাতা, গেল শূন্য ঘাট-পানে। কহিল, “মা, মার ব্যথা যদি বাজে প্রাণে তবে এ শিশুর তাপ দে গো মা, জুড়ায়ে। একমাত্র ধন মোর দিনু তোর পায়ে একমনে।” এত বলি সমর্পিল জলে অচেতন শিশুটিরে লয়ে করতলে চক্ষু মুদি। বহুক্ষণ আঁখি মেলিল না। ধ্যানে নিরখিল বসি, মকরবাহনা জ্যোতির্ময়ী মাতৃমূর্তি ক্ষুদ্র শিশুটিরে কোলে করে এসেছেন, রাখি তার শিরে একটি পদ্মের দল। হাসিমুখে ছেলে অনিন্দিত কান্তি ধরি দেবী-কোল ফেলে মার কোলে আসিবারে বাড়ায়েছে কর। কহে দেবী, “রে দুঃখিনী, এই তুই ধর্, তোর ধন তোরে দিনু।” রোমাঞ্চিতকায় নয়ন মেলিয়া কহে, “কই মা... কোথায়!”... পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকে বিহ্বলা রজনী; গঙ্গা বহি চলি যায় করি কলধ্বনি। চীৎকারি উঠিল নারী, “দিবি নে ফিরায়ে!” মর্মরিল বনভূমি দক্ষিণের বায়ে।
জুতা-আবিষ্কার
কথা ও কাহিনী
কথা ও কাহিনী
কহিলা হবু, “শুন গো গোবুরায়, কালিকে আমি ভেবেছি সারা রাত্র— মলিন ধূলা লাগিবে কেন পায় ধরণী-মাঝে চরণ-ফেলা মাত্র। তোমরা শুধু বেতন লহ বাঁটি, রাজার কাজে কিছুই নাহি দৃষ্টি। আমার মাটি লাগায় মোরে মাটি, রাজ্যে মোর একি এ অনাসৃষ্টি। শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার, নহিলে কারো রক্ষা নাহি আর।” শুনিয়া গোবু ভাবিয়া হল খুন, দারুণ ত্রাসে ঘর্ম বহে গাত্রে। পণ্ডিতের হইল মুখ চুন, পাত্রদের নিদ্রা নাহি রাত্রে। রান্নাঘরে নাহিকো চড়ে হাঁড়ি, কান্নাকাটি পড়িল বাড়ি-মধ্যে, অশ্রুজলে ভাসায়ে পাকা দাড়ি কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে— “যদি না ধুলা লাগিবে তব পায়ে, পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে।” শুনিয়া রাজা ভাবিল দুলি দুলি; কহিল শেষে, “কথাটা বটে সত্য। কিন্তু আগে বিদায় করো ধূলি, ভাবিয়ো পরে পদধূলির তত্ত্ব। ধুলা-অভাবে না পেলে পদধুলা তোমরা সবে মাহিনা খাও মিথ্যে, কেন বা তবে পুষিনু এতগুলা উপাধি-ধরা বৈজ্ঞানিক ভৃত্যে। আগের কাজ আগে তো তুমি সারো, পরের কথা ভাবিয়ো পরে আরো।” আঁধার দেখে রাজার কথা শুনি, যতনভরে আনিল তবে মন্ত্রী যেখানে যত আছিল জ্ঞানীগুণী— দেশে বিদেশে যতেক ছিল যন্ত্রী। বসিল সবে চশমা চোখে আঁটি, ফুরায়ে গেল উনিশ-পিপে নস্য। অনেক ভেবে কহিল, “গেলে মাটি ধরায় তবে কোথায় হবে শস্য?” কহিল রাজা, “তাই যদি না হবে, পণ্ডিতেরা রয়েছ কেন তবে?” সকলে মিলি যুক্তি করি শেষে কিনিল ঝাঁটা সাড়ে সতেরো লক্ষ, ঝাঁটের চোটে পথের ধুলা এসে ভরিয়ে দিল রাজার মুখ বক্ষ। ধুলায় কেহ মেলিতে নারে চোখ ধুলার মেঘে পড়িল ঢাকা সূর্য; ধুলার বেগে কাশিয়া মরে লোক, ধুলার মাঝে নগর হল উহ্য। কহিল রাজা, “করিতে ধুলা দূর, জগৎ হল ধুলায় ভরপুর।” তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁক মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি। পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক, নদীর জলে নাহিকো চলে কিস্তি। জলের জীব মরিল জল বিনা, ডাঙার প্রাণী সাঁতার করে চেষ্টা। পাঁকের তলে মজিল বেচা-কিনা, সর্দিজ্বরে উজাড় হল দেশটা। কহিল রাজা, “এমনি সব গাধা ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা।” আবার সবে ডাকিল পরামর্শে; বসিল পুন যতেক গুণবন্ত— ঘুরিয়া মাথা হেরিল চোখে সর্ষে ধুলার হায় নাহিকো পায় অন্ত। কহিল, “মহী মাদুর দিয়ে ঢাকো, ফরাশ পাতি করিব ধুলা বন্ধ।” কহিল কেহ, “রাজারে ঘরে রাখো, কোথাও যেন থাকে না কোনো রন্ধ্র। ধুলার মাঝে না যদি দেন পা তা হলে পায়ে ধুলা তো লাগে না।” কহিল রাজা, “সে কথা বড়ো খাঁটি, কিন্তু মোর হতেছে মনে সন্ধ— মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি দিবসরাতি রহিলে আমি বন্ধ।” কহিল সবে, “চামারে তবে ডাকি চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী। ধূলির মহী ঝুলির মাঝে ঢাকি মহীপতির রহিবে মহাকীর্তি।” কহিল সবে, “হবে সে অবহেলে, যোগ্যমত চামার যদি মেলে।” রাজার চর ধাইল হেথা হোথা, ছুটিল সবে ছাড়িয়া সব কর্ম। যোগ্যমতো চামার নাহি কোথা, না মিলে তত উচিতমতো চর্ম। তখন ধীরে চামার কুলপতি কহিল এসে ঈষৎ হেসে বৃদ্ধ, “বলিতে পারি করিলে অনুমতি, সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ। নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।” কহিল রাজা, “এত কি হবে সিধে, ভাবিয়া ম’ল সকল দেশসুদ্ধ।” মন্ত্রী কহে, “বেটারে শূল বিঁধে কারার মাঝে করিয়া রাখো রুদ্ধ।” রাজার পদ চর্ম-আবরণে ঢাকিল বুড়া বসিয়া পদোপান্তে— মন্ত্রী কহে, “আমারো ছিল মনে, কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে!” সেদিন হতে চলিল জুতা পরা— বাঁচিল গোবু, রক্ষা পেল ধরা।