Generated on: Fri Dec 19 2014

Home

::

Show All

::

Show Current

::

Scroll TOC Up| Down

Send a Comment

সূচনা
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
         কথা কও, কথা কও।
অনাদি অতীত, অনন্ত রাতে
         কেন বসে চেয়ে রও?
         কথা কও, কথা কও।
যুগযুগান্ত ঢালে তার কথা
         তোমার সাগরতলে,
কত জীবনের কত ধারা এসে
         মিশায় তোমার জলে।
সেথা এসে তার স্রোত নাহি আর,
কলকল ভাষ নীরব তাহার–
তরঙ্গহীন ভীষণ মৌন,
         তুমি তারে কোথা লও!
হে অতীত, তুমি হৃদয়ে আমার
         কথা কও, কথা কও।
 
         কথা কও, কথা কও।
স্তব্ধ অতীত, হে গোপনচারী,
         অচেতন তুমি নও–
         কথা কেন নাহি কও!
তব সঞ্চার শুনেছি আমার
         মর্মের মাঝখানে,
কত দিবসের কত সঞ্চয়
         রেখে যাও মোর প্রাণে!
হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনে
কাজ করে যাও গোপনে গোপনে,
মুখর দিনের চপলতা-মাঝে
         স্থির হয়ে তুমি রও।
হে অতীত, তুমি গোপনে হৃদয়ে
         কথা কও, কথা কও।
 
         কথা কও, কথা কও।
কোনো কথা কভু হারাও নি তুমি,
         সব তুমি তুলে লও–
         কথা কও, কথা কও।
তুমি জীবনের পাতায় পাতায়
         অদৃশ্য লিপি দিয়া
পিতামহদের কাহিনী লিখিছ
         মজ্জায় মিশাইয়া।
যাহাদের কথা ভুলেছে সবাই
তুমি তাহাদের কিছু ভোল নাই,
বিস্মৃত যত নীরব কাহিনী
স্তম্ভিত হয়ে বও।
ভাষা দাও তারে হে মুনি অতীত,
কথা কও, কথা কও।      
    
শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অবদানশতক

অনাথপিণ্ডদ বুদ্ধের একজন প্রধান শিষ্য ছিলেন

"প্রভু বুদ্ধ লাগি আমি ভিক্ষা মাগি,
ওগো পুরবাসী, কে রয়েছে জাগি,
অনাথপিণ্ডদ কহিলা অম্বুদ-
                   নিনাদে।
সদ্য মেলিতেছে তরুণ তপন
আলস্যে অরুণ সহাস্য লোচন
শ্রাবস্তীপুরীর গগনলগন
                   প্রাসাদে।
বৈতালিকদল সুপ্তিতে শয়ান
এখনো ধরে নি মাঙ্গলিক গান,
দ্বিধাভরে পিক মৃদু কুহুতান
                   কুহরে।
ভিক্ষু কহে ডাকি, "হে নিদ্রিত পুর,
দেহো ভিক্ষা মোরে, করো নিদ্রা দূর’–
সুপ্ত পৌরজন শুনি সেই সুর
                   শিহরে।
সাধু কহে, "শুন, মেঘ বরিষার
নিজেরে নাশিয়া দেয় বৃষ্টিধার,
সর্ব ধর্মমাঝে ত্যাগধর্ম সার
                   ভুবনে।’
কৈলাসশিখর হতে দূরাগত
ভৈরবের মহাসংগীতের মতো
সে বাণী মন্দ্রিল সুখতন্দ্রারত
                   ভবনে।
রাজা জাগি ভাবে বৃথা রাজ্য ধন,
গৃহী ভাবে মিছা তুচ্ছ আয়োজন,
অশ্রু অকারণে করে বিসর্জন
                   বালিকা।
যে ললিত সুখে হৃদয় অধীর
মনে হল তাহা গত যামিনীর
স্খলিত দলিত শুষ্ক কামিনীর
                   মালিকা।
বাতায়ন খুলে যায় ঘরে ঘরে,
ঘুমভাঙা আঁখি ফুটে থরে থরে
অন্ধকার পথ কৌতূহলভরে
                   নেহারি।
"জাগো, ভিক্ষা দাও’ সবে ডাকি ডাকি
সুপ্ত সৌধে তুলি নিদ্রাহীন আঁখি
শূন্য রাজবাটে চলেছে একাকী
                   ভিখারি।
ফেলি দিল পথে বণিকধনিকা
মুঠি মুঠি তুলি রতনকণিকা–
কেহ কণ্ঠহার, মাথার মণিকা
                   কেহ গো।
ধনী স্বর্ণ আনে থালি পূরে পূরে,
সাধু নাহি চাহে, পড়ে থাকে দূরে–
ভিক্ষু কহে, "ভিক্ষা আমার প্রভুরে
                   দেহো গো।’
বসনে ভূষণে ঢাকি গেল ধূলি,
কনকে রতনে খেলিল বিজুলি,
সন্ন্যাসী ফুকারে লয়ে শূন্য ঝুলি
                   সঘনে–
"ওগো পৌরজন, করো অবধান,
ভিক্ষুশ্রেষ্ঠ তিনি বুদ্ধ ভগবান,
দেহো তারে নিজ সর্বশ্রেষ্ঠ দান
                   যতনে।’
ফিরে যায় রাজা, ফিরে যায় শেঠ,
মিলে না প্রভুর যোগ্য কোনো ভেট,
বিশাল নগরী লাজে রহে হেঁট-
                   আননে।
রৌদ্র উঠে ফুটে, জেগে উঠে দেশ,
মহানগরীর পথ হল শেষ,
পুরপ্রান্তে সাধু করিলা প্রবেশ
                   কাননে।
দীন নারী এক ভূতলশয়ন
না ছিল তাহার অশন ভূষণ,
সে আসি নমিল সাধুর চরণ-
                   কমলে।
অরণ্য-আড়ালে রহি কোনোমতে
একমাত্র বাস নিল গাত্র হতে,
বাহুটি বাড়ায়ে ফেলি দিল পথে
                   ভূতলে।
ভিক্ষু ঊর্ধ্বভুজে করে জয়নাদ–
কহে, "ধন্য মাতঃ, করি আশীর্বাদ,
মহাভিক্ষুকের পুরাইলে সাধ
                   পলকে।’
চলিলা সন্ন্যাসী ত্যজিয়া নগর
ছিন্ন চীরখানি লয়ে শিরোপর
সঁপিতে বুদ্ধের চরণনখর-
                    আলোকে।      
    
প্রতিনিধি
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অ্যাক্‌ওয়ার্থ্‌ সাহেব কয়েকটি মারাঠি গাথার যে ইংরাজি অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছেন তাহারই ভূমিকা হইতে বর্ণিত ঘটনা গৃহীত। শিবাজির গেরুয়া পতাকা "ভগোয়া ঝেণ্ডা’ নামে খ্যাত।

বসিয়া প্রভাতকালে                সেতারার দুর্গভালে
          শিবাজি হেরিলা এক দিন–
রামদাস গুরু তাঁর                 ভিক্ষা মাগি দ্বার দ্বার
          ফিরিছেন যেন অন্নহীন।
ভাবিলা, এ কী এ কাণ্ড!          গুরুজির ভিক্ষাভাণ্ড–
          ঘরে যাঁর নাই দৈন্যলেশ!
সব যাঁর হস্তগত,                   রাজ্যেশ্বর পদানত,
          তাঁরো নাই বাসনার শেষ!
এ কেবল দিনে রাত্রে              জল ঢেলে ফুটা পাত্রে
          বৃথা চেষ্টা তৃষ্ণা মিটাবারে।
কহিলা, "দেখিতে হবে           কতখানি দিলে তবে
          ভিক্ষাঝুলি ভরে একেবারে।’
তখনি লেখনী আনি                কী লিখি দিলা কী জানি,
          বালাজিরে কহিলা ডাকায়ে,
"গুরু যবে ভিক্ষা-আশে            আসিবেন দুর্গ-পাশে
          এই লিপি দিয়ো তাঁর পায়ে।’
 
গুরু চলেছেন গেয়ে,               সম্মুখে চলেছে ধেয়ে
          কত পান্থ কত অশ্বরথ!–
"হে ভবেশ, হে শংকর,             সবারে দিয়েছ ঘর,
          আমারে দিয়েছ শুধু পথ।
অন্নপূর্ণা মা আমার                 লয়েছে বিশ্বের ভার,
          সুখে আছে সর্ব চরাচর–
মোরে তুমি, হে ভিখারি,          মার কাছ হতে কাড়ি
          করেছ আপন অনুচর।’
 
সমাপন করি গান                  সারিয়া মধ্যাহ্নস্নান
          দুর্গদ্বারে আসিয়া যখন–
বালাজি নমিয়া তাঁরে              দাঁড়াইল এক ধারে
          পদমূলে রাখিয়া লিখন।
গুরু কৌতূহলভরে                 তুলিয়া লইলা করে,
          পড়িয়া দেখিলা পত্রখানি–
বন্দি তাঁর পাদপদ্ম                 শিবাজি সঁপিছে অদ্য
          তাঁরে নিজরাজ্য-রাজধানী।
 
পরদিনে রামদাস                  গেলেন রাজার পাশ,
          কহিলেন, "পুত্র, কহো শুনি,
রাজ্য যদি মোরে দেবে            কী কাজে লাগিবে এবে–
          কোন্‌ গুণ আছে তব গুণী?’
"তোমারি দাসত্বে প্রাণ             আনন্দে করিব দান’
          শিবাজি কহিলা নমি তাঁরে।
গুরু কহে, "এই ঝুলি              লহ তবে স্কন্ধে তুলি,
          চলো আজি ভিক্ষা করিবারে।’
 
শিবাজি গুরুর সাথে               ভিক্ষাপাত্র লয়ে হাতে
          ফিরিলে পুরদ্বারে-দ্বারে।
নৃপে হেরি ছেলেমেয়ে            ভয়ে ঘরে যায় ধেয়ে,
          ডেকে আনে পিতারে মাতারে।
অতুল ঐশ্বর্যে রত,                তাঁর ভিখারির ব্রত!
          এ যে দেখি জলে ভাসে শিলা!
ভিক্ষা দেয় লজ্জাভরে,          হস্ত কাঁপে থরেথরে,
          ভাবে ইহা মহতের লীলা।
দুর্গে দ্বিপ্রহর বাজে,                ক্ষান্ত দিয়া কর্মকাজে
          বিশ্রাম করিছে পুরবাসী।
একতারে দিয়ে তান               রামদাস গাহে গান
          আনন্দে নয়নজলে ভাসি,
"ওহে ত্রিভুবনপতি,                বুঝি না তোমার মতি,
          কিছুই অভাব তব নাহি–
হৃদয়ে হৃদয়ে তবু                  ভিক্ষা মাগি ফির, প্রভু,
          সবার সর্বস্বধন চাহি।’
 
অবশেষে দিবসান্তে                নগরের এক প্রান্তে
          নদীকূলে সন্ধ্যাস্নান সারি–
ভিক্ষা-অন্ন রাঁধি সুখে             গুরু কিছু দিলা মুখে,
          প্রসাদ পাইল শিষ্য তাঁরি।
রাজা তবে কহে হাসি,           "নৃপতির গর্ব নাশি
          করিয়াছ পথের ভিক্ষুক–
প্রস্তুত রয়েছে দাস,                আরো কিবা অভিলাষ–
          গুরু-কাছে লব গুরু দুখ।’
 
গুরু কহে, "তবে শোন্‌,করিলি কঠিন পণ,
          অনুরূপ নিতে হবে ভার–
এই আমি দিনু কয়ে               মোর নামে মোর হয়ে
          রাজ্য তুমি লহ পুনর্বার।
তোমারে করিল বিধি              ভিক্ষুকের প্রতিনিধি,
          রাজ্যেশ্বর দীন উদাসীন।
পালিবে যে রাজধর্ম                জেনো তাহা মোর কর্ম,
          রাজ্য লয়ে রবে রাজ্যহীন।’
 
"বৎস, তবে এই লহো            মোর আশীর্বাদসহ
          আমার গেরুয়া গাত্রবাস–
বৈরাগীর উত্তরীয়                  পতাকা করিয়া নিয়ো’
          কহিলেন গুরু রামদাস।
নৃপশিষ্য নতশিরে                 বসি রহে নদীতীরে,
          চিন্তারাশি ঘনায়ে ললাটে।
থামিল রাখালবেণু,                গোঠে ফিরে গেল ধেনু,
          পরপারে সূর্য গেল পাটে।
 
পূরবীতে ধরি তান                 একমনে রচি গান
          গাহিতে লাগিলা রামদাস,
"আমারে রাজার সাজে   বসায়ে সংসারমাঝে
          কে তুমি আড়ালে কর বাস!
হে রাজা, রেখেছি আনি তোমারি পাদুকাখানি,
          আমি থাকি পাদপীঠতলে–
সন্ধ্যা হয়ে এল ওই,              আর কত বসে রই!
          তব রাজ্যে তুমি এসো চলে।’      
    
ব্রাহ্মণ
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ছান্দোগ্যোপনিষৎ । ৪ প্রপাঠক । ৪ অধ্যায়

অন্ধকারে বনচ্ছায়ে সরস্বতীতীরে
অস্ত গেছে সন্ধ্যাসূর্য; আসিয়াছে ফিরে
নিস্তব্ধ আশ্রম-মাঝে ঋষিপুত্রগণ
মস্তকে সমিধ্‌ভার করি আহরণ
বনান্তর হতে; ফিরায়ে এনেছে ডাকি
তপোবনগোষ্ঠগৃহে স্নিগ্ধশান্ত-আঁখি
শ্রান্ত হোমধেনুগণে; করি সমাপন
সন্ধ্যাস্নান সবি মিলি লয়েছে আসন
গুরু গৌতমেরে ঘিরি কুটিরপ্রাঙ্গণে
হোমাগ্নি-আলোকে। শূন্য অনন্ত গগনে
ধ্যানমগ্ন মহাশান্তি; নক্ষত্রমণ্ডলী
সারি সারি বসিয়াছে শুষ্ক কুতূহলী
নিঃশব্দ শিষ্যের মতো। নিভৃত আশ্রম
উঠিল চকিত হয়ে; মহর্ষি গৌতম
কহিলেন, "বৎসগণ, ব্রহ্মবিদ্যা কহি,
করো অবধান।’
 
                   হেনকালে অর্ঘ্য বহি
করপুট ভরি’ পশিলা প্রাঙ্গণতলে
তরুণ বালক; বন্দী ফলফুলদলে
ঋষির চরণপদ্ম, নমি ভক্তিভরে
কহিলা কোকিলকণ্ঠে সুধাস্নিগ্ধস্বরে,
"ভগবন্‌, ব্রহ্মবিদ্যাশিক্ষা-অভিলাষী
আসিয়াছে দীক্ষাতরে কুশক্ষেত্রবাসী,
সত্যকাম নাম মোর।’
 
                         শুনি স্মিতহাসে
ব্রহ্মর্ষি কহিলা তারে স্নেহশান্ত ভাষে,
"কুশল হউক সৌম্য। গোত্র কী তোমার?
বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের কাছে অধিকার
ব্রহ্মবিদ্যালাভে।’
 
                   বালক কহিলা ধীরে,
"ভগবন্‌, গোত্র নাহি জানি। জননীরে
শুধায়ে আসিব কল্য, করো অনুমতি।’
 
এত কহি ঋষিপদে করিয়া প্রণতি
গেল চলি সত্যকাম ঘন-অন্ধকার
বনবীথি দিয়া, পদব্রজে হয়ে পার
ক্ষীন স্বচ্ছ শান্ত সরস্বতী; বালুতীরে
সুপ্তিমৌন গ্রামপ্রান্তে জননীকুটিরে
করিলা প্রবেশ।
 
                  ঘরে সন্ধ্যাদীপ জ্বালা;
দাঁড়ায়ে দুয়ার ধরি জননী জবালা
পুত্রপথ চাহি; হেরি তারে বক্ষে টানি
আঘ্রাণ করিয়া শির কহিলেন বাণী
কল্যাণকুশল। শুধাইলা সত্যকাম,
"কহো গো জননী, মোর পিতার কী নাম,
কী বংশে জনম। গিয়াছিনু দীক্ষাতরে
গৌতমের কাছে, গুরু কহিলেন মোরে–
বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের কাছে অধিকার
ব্রহ্মবিদ্যালাভে। মাতঃ, কী গোত্র আমার?’
শুনি কথা, মৃদুকণ্ঠে অবনতমুখে
কহিলা জননী, "যৌবনে দারিদ্র৻দুখে
বহুপরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে,
জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে,
গোত্র তব নাহি জানি তাত।’
 
                                 পরদিন
তপোবনতরুশিরে প্রসন্ন নবীন
জাগিল প্রভাত। যত তাপসবালক
শিশিরসুস্নিগ্ধ যেন তরুণ আলোক,
ভক্ত-অশ্রু-ধৌত যেন নব পুণ্যচ্ছটা,
প্রাতঃস্নাত স্নিগ্ধচ্ছবি আর্দ্রসিক্তজটা,
শুচিশোভা সৌম্যমূর্তি সমুজ্জ্বলকায়ে
বসেছে বেষ্টন করি বৃদ্ধ বটচ্ছায়ে
গুরু গৌতমেরে। বিহঙ্গকাকলিগান,
মধুপগুঞ্জনগীতি, জলকলতান,
তারি সাথে উঠিতেছে গম্ভীর মধুর
বিচিত্র তরুণ কণ্ঠে সম্মিলিত সুর
শান্ত সামগীতি।
 
                   হেনকালে সত্যকাম
কাছে আসি ঋষিপদে করিলা প্রণাম–
মেলিয়া উদার আঁখি রহিলা নীরবে।
আচার্য আশিষ করি শুধাইলা তবে,
"কী গোত্র তোমার সৌম্য, প্রিয়দরশন?’
তুলি শির কহিলা বালক, "ভগবন্‌,
নাহি জানি কী গোত্র আমার। পুছিলাম
জননীরে, কহিলেন তিনি, সত্যকাম,
বহুপরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে,
জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে–
গোত্র তব নাহি জানি।’
 
                          শুনি সে বারতা
ছাত্রগণ মৃদুস্বরে আরম্ভিলা কথা
মধুচক্রে লোষ্ট্রপাতে বিক্ষিপ্ত চঞ্চল
পতঙ্গের মতো–সবে বিস্ময়বিকল,
কেহ বা হাসিল কেহ করিল ধিক্কার
লজ্জাহীন অনার্যের হেরি অহংকার।
উঠিলা গৌতম ঋষি ছাড়িয়া আসন,
বাহু মেলি বালকেরে করিয়া আলিঙ্গন
কহিলেন, "অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত।
তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত।’      
    
মস্তকবিক্রয়
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মহাবস্তবদান

কোশলনৃপতির তুলনা নাই,
          জগৎ জুড়ি যশোগাথা;
ক্ষীণের তিনি সদা শরণ-ঠাঁই
          দীনের তিনি পিতামাতা।
সে কথা কাশীরাজ শুনিতে পেয়ে
          জ্বলিয়া মরে অভিমানে–
"আমার প্রজাগণ আমার চেয়ে
          তাহারে বড়ো করি মানে!
আমার হতে যার আসন নীচে
          তাহার দান হল বেশি!
ধর্ম দয়া মায়া সকলি মিছে,
          এ শুধু তার রেষারেষি।’
কহিলা, "সেনাপতি, ধরো কৃপাণ,
          সৈন্য করো সব জড়ো।
আমার চেয়ে হবে পূণ্যবান
          স্পর্ধা বাড়িয়াছে বড়ো!’
চলিলা কাশীরাজ যুদ্ধসাজে–
          কোশলরাজ হারি রণে
রাজ্য ছাড়ি দিয়া ক্ষুব্ধ লাজে
          পলায়ে গেল দূর বনে।
কাশীর রাজা হাসি কহে তখন
          আপন সভাসদ্‌-মাঝে
"ক্ষমতা আছে যার রাখিতে ধন
          তারেই দাতা হওয়া সাজে।’
 
সকলে কাঁদি বলে, "দারুণ রাহু
          এমন চাঁদেরেও হানে!
লক্ষ্মী খোঁজে শুধু বলীর বাহু,
          চাহে না ধর্মের পানে!’
"আমরা হইলাম পিতৃহারা’
          কাঁদিয়া কহে দশ দিক–
"সকল জগতের বন্ধু যাঁরা
          তাঁদের শত্রুরে ধিক্‌!’
শুনিয়া কাশীরাজ উঠিল রাগি–
          "নগরে কেন এত শোক!
আমি তো আছি, তবু কাহার লাগি
          কাঁদিয়া মরে যত লোক!
আমার বাহুবলে হারিয়া তবু
          আমারে করিবে সে জয়!
অরির শেষ নাহি রাখিবে কভু
          শাস্ত্রে এইমতো কয়।
মন্ত্রী, রটি দাও নগরমাঝে
          ঘোষণা করো চারি ধারে–
যে ধরি আনি দিবে কোশলরাজে
          কনক শত দিব তারে।’
ফিরিয়া রাজদূত সকল বাটী
          রটনা করে দিনরাত;
যে শোনে আঁখি মুদি রসনা কাটি
          শিহরি কানে দেয় হাত।
 
রাজ্যহীন রাজা গহনে ফিরে
মলিনচীর দীনবেশে,
পথিক একজন অশ্রুনীরে
          একদা শুধাইল এসে,
"কোথা গো বনবাসী, বনের শেষ,
          কোশলে যাব কোন্‌ মুখে?’
শুনিয়া রাজা কহে, "অভাগা দেশ,
          সেথায় যাবে কোন্‌ দুখে!’
পথিক কহে, "আমি বণিকজাতি,
          ডুবিয়া গেছে মোর তরী।
এখন দ্বারে দ্বারে হস্ত পাতি
          কেমনে রব প্রাণ ধরি!
করুণাপারাবার কোশলপতি
          শুনেছি নাম চারি ধারে,
অনাথনাথ তিনি দীনের গতি,
          চলেছে দীন তাঁরি দ্বারে।’
শুনিয়া নৃপসুত ঈষৎ হেসে
          রুধিলা নয়নের বারি,
নীরবে ক্ষণকাল ভাবিয়া শেষে
          কহিলা নিশ্বাস ছাড়ি,
"পান্থ, যেথা তব বাসনা পুরে
          দেখায়ে দিব তারি পথ–
এসেছ বহু দুখে অনেক দূরে,
          সিদ্ধ হবে মনোরথ।’
 
বসিয়া কাশীরাজ সভার মাঝে;
          দাঁড়ালো জটাধারী এসে।
"হেথায় আগমন কিসের কাজে’
          নৃপতি শুধাইল হেসে।
"কোশলরাজ আমি বনভবন’
          কহিলা বনবাসী ধীরে–
"আমার ধরা পেলে যা দিবে পণ
          দেহো তা মোর সাথিটিরে।’
উঠিল চমকিয়া সভার লোকে,
          নীরব হল গৃহতল;
বর্ম-আবরিত দ্বারীর চোখে
          অশ্রু করে ছলছল।
মৌন রহি রাজা ক্ষণেকতরে
          হাসিয়া কহে, "ওহে বন্দী,
মরিয়া হবে জয়ী আমার ’পরে
          এমন করিয়াছ ফন্দি!
তোমার সে আশায় হানিব বাজ,
          জিনিব আজিকার রণে–
রাজ্য ফিরি দিব হে মহারাজ,
          হৃদয় দিব তারি সনে।’
জীর্ণ-চীর-পরা বনবাসীরে
          বসালো নৃপ রাজাসনে,
মুকুট তুলি দিল মলিন শিরে–
          ধন্য কহে পুরজনে।      
    
পূজারিনী
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অবদানশতক

      নৃপতি বিম্বিসার
নমিয়া বুদ্ধে মাগিয়া লইলা
       পাদনখকণা তাঁর।
স্থাপিয়া নিভৃত প্রাসাদকাননে
তাহারি উপরে রচিলা যতনে
অতি অপরূপ শিলাময় স্তূপ
       শিল্পশোভার সার।
 
সন্ধ্যাবেলায় শুচিবাস পরি
          রাজবধূ রাজবালা
আসিতেন ফুল সাজায়ে ডালায়,
স্তূপপদমূলে সোনার থালায়
আপনার হাতে দিতেন জ্বালায়ে
          কনকপ্রদীপমালা।
 
অজাতশত্রু রাজা হল যবে,
          পিতার আসনে আসি
পিতার ধর্ম শোণিতের স্রোতে
মুছিয়া ফেলিল রাজপুরী হতে–
সঁপিল যজ্ঞ-অনল-আলোতে
          বৌদ্ধশাস্ত্ররাশি।
 
কহিল ডাকিয়া অজাতশত্রু
          রাজপুরনারী সবে,
"বেদ ব্রাহ্মণ রাজা ছাড়া আর
কিছু নাই ভবে পূজা করিবার
এই ক’টি কথা জেনো মনে সার–
          ভুলিলে বিপদ হবে।’
 
সেদিন শারদ-দিবা-অবসান–
          শ্রীমতী নামে সে দাসী
পুণ্যশীতল সলিলে নাহিয়া,
পুষ্পপ্রদীপ থালায় বাহিয়া,
রাজমহিষীর চরণে চাহিয়া
          নীরবে দাঁড়ালো আসি।
 
শিহরি সভয়ে মহিষী কহিলা,
          "এ কথা নাহি কি মনে,
অজাতশত্রু করেছে রটনা
স্তূপে যে করিবে অর্ঘ্যরচনা
শূলের উপরে মরিবে সে জনা
          অথবা নির্বাসনে?’
 
সেথা হতে ফিরি গেল চলি ধীরে
          বধূ অমিতার ঘরে।
সমুখে রাখিয়া স্বর্ণমুকুর
বাঁধিতেছিল সে দীর্ঘ চিকুর,
আঁকিতেছিল সে যত্নে সিঁদুর
          সীমন্তসীমা-’পরে।
 
শ্রীমতীরে হেরি বাঁকি গেল রেখা,
          কাঁপি গেল তার হাত–
কহিল, "অবোধ, কী সাহস-বলে
এনেছিস পূজা! এখনি যা চলে।
কে কোথা দেখিবে, ঘটিবে তা হলে
          বিষম বিপদপাত।’
 
অস্তরবির রশ্মি-আভায়
          খোলা জানালার ধারে
কুমারী শুক্লা বসি একাকিনী
পড়িতে নিরত কাব্যকাহিনী,
চমকি উঠিল শুনি কিংকিণী–
          চাহিয়া দেখিল দ্বারে।
 
শ্রীমতীরে হেরি পুঁথি রাখি ভূমে
          দ্রুতপদে গেল কাছে।
কহে সাবধানে তার কানে কানে,
"রাজার আদেশ আজি কে না জানে,
এমন ক’রে কি মরণের পানে
          ছুটিয়া চলিতে আছে!’
 
দ্বার হতে দ্বারে ফিরিল শ্রীমতী
          লইয়া অর্ঘ্যথালি।
"হে পুরবাসিনী’ সবে ডাকি কয়
"হয়েছে প্রভুর পূজার সময়’–
শুনি ঘরে ঘরে কেহ পায় ভয়,
          কেহ দেয় রাতে গালি।
 
দিবসের শেষ আলোক মিলালো
          নগরসৌধ-’পরে।
পথ জনহীন আঁধারে বিলীন,
কলকোলাহল হয়ে এল ক্ষীণ–
আরতিঘণ্টা ধ্বনিল প্রাচীন
          রাজদেবালয়ঘরে।
 
শারদনিশির স্বচ্ছ তিমিরে
          তারা অগণ্য জ্বলে।
সিংহদুয়ার বাজিল বিষাণ,
বন্দীরা ধরে সন্ধ্যার তান,
"মন্ত্রণাসভা হল সমাধান’
          দ্বারী ফুকারিয়া বলে।
 
এমন সময়ে হেরিল চমকি
          প্রাসাদে প্রহরী যত–
রাজার বিজন কানন-মাঝারে
স্তূপপদমূলে গহন আঁধারে
জ্বলিতেছে কেন যেন সারে সারে
          প্রদীপমালার মতো!
 
মুক্তকৃপাণে পুররক্ষক
          তখনি ছুটিয়া আসি
শুধালো, "কে তুই ওরে দুর্মতি,
মরিবার তরে করিস আরতি!’
মধুর কণ্ঠে শুনিল, " শ্রীমতী,
          আমি বুদ্ধের দাসী।’
 
সেদিন শুভ্র পাষাণফলকে
          পড়িল রক্তলিখা।
সেদিন শারদ স্বচ্ছ নিশীথে
প্রাসাদকাননে নীরবে নিভৃতে
স্তূপপদমূলে নিবিল চকিতে
          শেষ আরতির শিখা!      
    
অভিসার
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বোধিসত্তাবদান-কল্পলতা

          সন্ন্যাসী উপগুপ্ত
মথুরাপুরীর প্রাচীরের তলে
          একদা ছিলেন সুপ্ত–
নগরীর দীপ নিবেছে পবনে,
দুয়ার রুদ্ধ পৌর ভবনে,
নিশীথের তারা শ্রাবণগগনে
          ঘন মেঘে অবলুপ্ত।
 
কাহার নূপুরশিঞ্জিত পদ
          সহসা বাজিল বক্ষে!
সন্ন্যাসীবর চমকি জাগিল,
স্বপ্নজড়িমা পলকে ভাগিল,
রূঢ় দীপের আলোক লাগিল
          ক্ষমাসুন্দর চক্ষে।
 
নগরীর নটী চলে অভিসারে
          যৌবনমদে মত্তা।
অঙ্গ আঁচল সুনীল বরন,
রুনুঝুনু রবে বাজে আভরণ–
সন্ন্যাসী-গায়ে পড়িতে চরণ
          থামিল বাসবদত্তা।
 
প্রদীপ ধরিয়া হেরিল তাঁহার
          নবীন গৌরকান্তি–
সৌম্য সহাস তরুণ বয়ান,
করুণাকিরণে বিকচ নয়ান,
শুভ্র ললাটে ইন্দুসমান
          ভাতিছে স্নিগ্ধ শান্তি।
 
কহিল রমণী ললিত কণ্ঠে,
          নয়নে জড়িত লজ্জা,
ক্ষমা করো মোরে কুমার কিশোর,
দয়া করো যদি গৃহে চলো মোর,
এ ধরণীতল কঠিন কঠোর
          এ নহে তোমার শয্যা।’
 
সন্ন্যাসী কহে করুণ বচনে,
          "অয়ি লাবণ্যপুঞ্জ,
এখনো আমার সময় হয় নি,
যেথায় চলেছ যাও তুমি ধনী,
সময় যেদিন আসিবে আপনি
          যাইব তোমার কুঞ্জ,’
 
সহসা ঝঞ্ঝা তড়িৎশিখায়
          মেলিল বিপুল আস্য।
রমণী কাঁপিয়া উঠিল তরাসে,
প্রলয়শঙ্খ বাজিল বাতাসে,
আকাশে বজ্র ঘোর পরিহাসে
          হাসিল অট্টহাস্য।
 
                 ...   
 
বর্ষ তখনো হয় নাই শেষ,
          এসেছে চৈত্রসন্ধ্যা।
বাতাস হয়েছে উতলা আকুল,
পথতরুশাখে ধরেছে মুকুল,
রাজার কাননে ফুটেছে বকুল
          পারুল রজনীগন্ধা।
 
অতি দূর হতে আসিছে পবনে
          বাঁশির মদির মন্দ্র।
জনহীন পুরী, পুরবাসী সবে
গেছে মধুবনে ফুল-উৎসবে–
শূন্য নগরী নিরখি নীরবে
          হাসিছে পূর্ণচন্দ্র।
 
নির্জন পথে জ্যোৎস্না-আলোতে
          সন্ন্যাসী একা যাত্রী।
মাথার উপরে তরুবীথিকার
কোকিল কুহরি উঠে বারবার,
এতদিন পরে এসেছে কি তাঁর
          আজি অভিসাররাত্রি?
 
নগর ছাড়ায়ে গেলেন দণ্ডী
          বাহিরপ্রাচীরপ্রান্তে।
দাঁড়ালেন আসি পরিখার পারে–
আম্রবনের ছায়ার আঁধারে
কে ওই রমণী প’ড়ে এক ধারে
          তাঁহার চরণোপ্রান্তে!
 
নিদারুণ রোগে মারীগুটিকায়
          ভরে গেছে তার অঙ্গ–
রোগমসীঢালা কালী তনু তার
লয়ে প্রজাগণে পুরপরিখার
বাহিরে ফেলেছে, করি’ পরিহার
          বিষাক্ত তার সঙ্গ।
 
সন্ন্যাসী বসি আড়ষ্ট শির
          তুলি নিল নিজ অঙ্কে–
ঢালি দিল জল শুষ্ক অধরে,
মন্ত্র পড়িয়া দিল শির-’পরে,
লেপি দিল দেহ আপনার করে
          শীতচন্দনপঙ্কে।
 
ঝরিছে মুকুল, কূজিছে কোকিল,
          যামিনী জোছনামত্তা।
"কে এসেছ তুমি ওগো দয়াময়’
শুধাইল নারী, সন্ন্যাসী কয়–
"আজি রজনীতে হয়েছে সময়,
          এসেছি বাসবদত্তা!’
    
পরিশোধ
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মহাবস্তবদান

"রাজকোষ হতে চুরি! ধরে আন্‌ চোর,
নহিলে নগরপাল, রক্ষা নাহি তোর–
মুণ্ড রহিবে না দেহে!’ রাজার শাসনে
রক্ষী দল পথে পথে ভবনে ভবনে
চোর খুঁজে খুঁজে ফিরে। নগর-বাহিরে
ছিল শুয়ে বজ্রসেন বিদীর্ণ মন্দিরে
বিদেশী বণিক পান্থ তক্ষশিলাবাসী;
অশ্ব বেচিবার তরে এসেছিল কাশী,
দস্যুহস্তে খোয়াইয়া নিঃস্ব রিক্ত শেষে
ফিরিয়া চলিতেছিল আপনার দেশে
নিরাশ্বাসে–তাহারে ধরিল চোর বলি।
হস্তে পদে বাঁধি তার লোহার শিকলি
লইয়া চলিল বন্দীশালে।
 
                   সেই ক্ষণে
সুন্দরীপ্রধানা শ্যামা বসি বাতায়নে
প্রহর যাপিতেছিল আলস্যে কৌতুকে
পথের প্রবাহ হেরি–নয়নসম্মুখে
স্বপ্নসম লোকযাত্রা। সহসা শিহরি
কাঁপিয়া কহিল শ্যামা, "আহা মরি মরি!
মহেন্দ্রনিন্দিতকান্তি উন্নতদর্শন
কারে বন্দী করে আনে চোরের মতন
কঠিন শৃঙ্খলে! শীঘ্র যা লো সহচরী,
বল্‌ গে নগরপালে মোর নাম করি
শ্যামা ডাকিতেছে তারে, বন্দী সাথে লয়ে
একবার আসে যেন এ ক্ষুদ্র আলয়ে
দয়া করি!’ শ্যামার নামের মন্ত্রগুণে
উতলা নগররক্ষী আমন্ত্রণ শুনে
রোমাঞ্চিত; সত্বর পশিল গৃহমাঝে,
পিছে বন্দী বজ্রসেন নতশির লাজে
আরক্তকপোল। কহে রক্ষী হাস্যভরে,
"অতিশয় অসময়ে অভাজন-’পরে
অযাচিত অনুগ্রহ! চলেছি সম্প্রতি
রাজকার্যে। সুদর্শনে, দেহো অনুমতি।’
বজ্রসেন তুলি শির সহসা কহিলা,
"একি লীলা, হে সুন্দরী, একি তব লীলা!
পথ হতে ঘরে আনি কিসের কৌতুকে
নির্দোষ এ প্রবাসীর অবমানদুখে
করিতেছ অবমান!’ শুনি শ্যামা কহে,
"হায় গো বিদেশী পান্থ, কৌতুক এ নহে,
আমার অঙ্গতে যত স্বর্ণ-অলংকার
সমস্ত সঁপিয়া দিয়া শৃঙ্খল তোমার
নিতে পারি নিজদেহে; তব অপমানে
মোর অন্তরাত্মা আজি অপমান মানে।’
এত বলি সিক্তপক্ষ্ণ দুটি চক্ষু দিয়া
সমস্ত লাঞ্ছনা যেন লইল মুছিয়া
বিদেশীর অঙ্গ হতে। কহিল রক্ষীরে,
"আমার যা আছে লয়ে নির্দোষ বন্দীরে
মুক্ত করে দিয়ে যাও।’ কহিল প্রহরী,
"তব অনুনয় আজি ঠেলিনু সুন্দরী,
এত এ অসাধ্য কাজ। হৃত রাজকোষ,
বিনা কারো প্রাণপাতে নৃপতির রোষ
শান্তি মানিবে না।’ ধরি প্রহরীর হাত
কাতরে কহিল শ্যামা, "শুধু দুটি রাত
বন্দীরে বাঁচায়ে রেখো এ মিনতি করি।’
"রাখিব তোমার কথা’ কহিল প্রহরী।
 
দ্বিতীয় রাত্রির শেষে খুলি বন্দীশালা
রমণী পশিল কক্ষে, হাতে দীপ জ্বালা,
লোহার শৃঙ্খলে বাঁধা যেথা বজ্রসেন
মৃত্যুর প্রভাত চেয়ে মৌনী জপিছেন
ইষ্টনাম। রমণীর কটাক্ষ-ইঙ্গিতে
রক্ষী আসি খুলি দিল শৃঙ্খল চকিতে।
বিস্ময়বিহ্বল নেত্রে বন্দী নিরখিল
সেই শুভ্র সুকোমল কমল-উন্মীল
অপরূপ মুখ। কহিল গদ্‌গদস্বরে
"বিকারের বিভীষিকা-রজনীর ’পরে
করধৃতশুকতারা শুভ্র উষা-সম
কে তুমি উদিলে আসি কারাকক্ষে মম–
মুমূর্ষুর প্রাণরূপা, মুক্তিরূপা অয়ি,
নিষ্ঠুর নগরী-মাঝে লক্ষ্মী দয়াময়ী!’
 
"আমি দয়াময়ী!’ রমণীর উচ্চহাসে
চকিতে উঠিল জাগি নবভয়ত্রাসে
ভয়ংকর কারাগার। হাসিতে হাসিতে
উন্মত্ত উৎকট হাস্য শোকাশ্রুরাশিতে
শতধা পড়িল ভাঙি। কাঁদিয়া কহিলা,
"এ পুরীর পথমাঝে যত আছে শিলা
কঠিন শ্যামার মতো কেহ নাহি আর!’
এত বলি দৃঢ়বলে ধরি হস্ত তার
বজ্রসেনে লয়ে গেল কারার বাহিরে।
তখন জাগিছে উষা বরুণার তীরে
পূর্ব বনান্তরে। ঘাটে বাঁধা আছে তরী।
"হে বিদেশী, এসো এসো, কহিল সুন্দরী
দাঁড়ায়ে নৌকার ’পরে, "হে আমার প্রিয়,
শুধু এই কথা মোর স্মরণে রাখিয়ো–
তোমা-সাথে এক স্রোতে ভাসিলাম আমি
সকল বন্ধন টুটি হে হৃদয়স্বামী,
জীবনমরণপ্রভু!’ নৌকা দিল খুলি।
দুই তীরে বনে বনে গাহে পাখিগুলি
আনন্দ-উৎসব-গান। প্রেয়সীর মুখ
দুই বাহু দিয়া তুলি ভরি নিজবুক
বজ্রসেন শুধাইল, "কহো মোরে প্রিয়ে,
আমারে করেছ মুক্ত কী সম্পদ দিয়ে।
সম্পূর্ণ জানিতে চাহি অয়ি বিদেশিনী,
এ দীনদরিদ্রজন তব কাছে ঋণী
কত ঋণে।’ আলিঙ্গন ঘনতর করি
"সে কথা এখন নহে’ কহিল সুন্দরী।
 
নৌকা ভেসে চলে যায় পূর্ণবায়ুভরে
তূর্ণস্রোতোবেগে। মধ্যগগনের ’পরে
উদিল প্রচণ্ড সূর্য। গ্রামবধূগণ
গৃহে ফিরে গেছে করি স্নান সমাপন
সিক্তবস্ত্রে, কাংস্যঘটে লয়ে গঙ্গাজল।
ভেঙে গেছে প্রভাতের হাট; কোলাহল
থেমে গেছে দুই তীরে; জনপদবাট
পান্থহীন। বটতলে পাষাণের ঘাট,
সেথায় বাঁধিল নৌকা স্নানাহার-তরে
কর্ণধার। তন্দ্রাঘন বটশাখা-’পরে
ছায়ামগ্ন পক্ষিনীড় গীতশব্দহীন।
অলস পতঙ্গ শুধু গুঞ্জ দীর্ঘ দিন।
পক্কশস্যগন্ধহরা মধ্যাহ্নের বায়ে
শ্যামার ঘোমটা যবে ফেলিল খসায়ে
অকস্মাৎ, পরিপূর্ণ প্রণয়পীড়ায়
ব্যথিত ব্যাকুল বক্ষ, কণ্ঠ রুদ্ধপ্রায়,
বজ্রসেন কানে কানে কহিল শ্যামারে,
"ক্ষণিকশৃঙ্খলমুক্ত করিয়া আমারে
বাঁধিয়াছ অনন্ত শৃঙ্খলে। কী করিয়া
সাধিলে দুঃসাধ্য ব্রত কহি বিবরিয়া।
মোর লাগি কী করেছ জানি যদি প্রিয়ে,
পরিশোধ দিব তাহা এ জীবন দিয়ে
এই মোর পণ।’ বস্ত্র টানি মুখ-’পরি
"সে কথা এখনো নহে’ কহিল সুন্দরী।
 
গুটায়ে সোনার পাল সুদূরে নীরবে
দিনের আলোকতরী চলি গেল যবে
অস্ত-অচলের ঘাটে, তীর-উপবনে
লাগিল শ্যামার নৌকা সন্ধ্যার পবনে।
শুক্ল চতুর্থীর চন্দ্র অস্তগতপ্রায়,
নিস্তরঙ্গ শান্ত জলে সুদীর্ঘ রেখায়
ঝিকিমিকি করে ক্ষীণ আলো; ঝিল্লিস্বনে
তরুমূল-অন্ধকার কাঁপিছে সঘনে
বীণার তন্ত্রীর মতো। প্রদীপ নিবায়ে
তরীবাতায়নতলে দক্ষিণের বায়ে
ঘননিশ্বসিতমুখে যুবকের কাঁধে
হেলিয়া বসেছে শ্যামা। পড়েছে অবাধে
উন্মুক্ত সুগন্ধ কেশরাশি সুকোমল
তরঙ্গিত তমোজালে ছেয়ে বক্ষতল
বিদেশীর, সুনিবিড় তন্দ্রাজালসম।
কহিল অস্ফুটকণ্ঠে শ্যামা, "প্রিয়তম,
তোমা লাগি যা করেছি কঠিন সে কাজ
সুকঠিন, তারো চেয়ে সুকঠিন আজ
সে কথা তোমারে বলা। সংক্ষেপে সে কব;
একবার শুনে মাত্র মন হতে তব
সে কাহিনী মুছে ফেলো।–বালক কিশোর
উত্তীয় তাহার নাম, ব্যর্থ প্রেমে মোর
উন্মত্ত অধীর। সে আমার অনুনয়ে
তব চুরি-অপবাদ নিজ স্কন্ধে লয়ে
দিয়েছে আপন প্রাণ। এ জীবনে মম
সর্বাধিক পাপ মোর, ওগো সর্বোত্তম,
করেছি তোমার লাগি এ মোর গৌরব।’
 
ক্ষীণ চন্দ্র অস্ত গেল। অরণ্য নীরব
শত শত বিহঙ্গর সুপ্তি বহি শিরে
দাঁড়ায়ে রহিল স্তব্ধ। অতি ধীরে ধীরে
রমণীর কটি বাহু প্রিয়বাহুডোর
শিথিল পড়িল খসে; বিচ্ছেদ কঠোর
নিঃশব্দে বসিল দোঁহামাঝে; বাক্যহীন
বজ্রসেন চেয়ে রহে আড়ষ্ট কঠিন
পাষাণপুত্তলি; মাথারাখি তার পায়ে
ছিন্নলতাসম শ্যামা পড়িল লুটায়ে
আলিঙ্গনচ্যুতা; মসীকৃষ্ণ নদীনীরে
তীরের তিমিরপুঞ্জ ঘনাইল ধীরে।
সহসা যুবার জানু সবলে বাঁধিয়া
বাহুপাশে, আর্তনারী উঠিল কাঁদিয়া
অশ্রহারা শুষ্ককণ্ঠে, "ক্ষমা করো নাথ,
এ পাপের যাহা দণ্ড সে অভিসম্পাত
হোক বিধাতার হাতে নিদারুণতর–
তোমা লাগি যা করেছি তুমি ক্ষমা করো।’
চরণ কাড়িয়া লয়ে চাহি তার পানে
বজ্রসেন বলি উঠে, "আমার এ প্রাণে
তোমার কী কাজ ছিল! এ জন্মের লাগি
তোর পাপমূল্যে কেনা মহাপাপভাগী
এ জীবন করিলি ধিক্‌কৃত! কলঙ্কিনী,
ধিক্‌ এ নিশ্বাস মোর তোর কাছে ঋণী!
ধিক্‌ এ নিমেষপাত প্রত্যেক নিমেষে।’
 
এত বলি উঠিল সবলে। নিরুদ্দেশে
নৌকা ছাড়ি চলি গেলা তীরে, অন্ধকারে
বনমাঝে। শুষ্কপত্ররাশি পদভারে
শব্দ করি অরণ্যেরে করিল চকিত
প্রতিক্ষণে। ঘনগুল্মগন্ধপুঞ্জীকৃত
বায়ুশূন্য বনতলে তরুকাণ্ডগুলি
চারি দিকে আঁকাবাঁকা নানা শাখা তুলি
অন্ধকারে ধরিয়াছে অসংখ্য আকার
বিকৃত বিরূপ। রুদ্ধ হল চারি ধার।
নিস্তব্ধনিষেধসম প্রসারিল কর
লতাশৃঙ্খলিত বন। শ্রান্তকলেবর
পথিক বসিল ভূমে। কে তার পশ্চাতে
দাঁড়াইল উপচ্ছায়াসম! সাথে সাথে
অন্ধকারে পদে পদে তারে অনুসরি
আসিয়াছে দীর্ঘ পথ মৌনী অনুচরী
রক্তসিক্তপদে। দুই মুষ্টি বদ্ধ করে
গর্জিল পথিক, "তবু ছাড়িবি না মোরে!’
রমণী বিদ্যুৎবেগে ছুটিয়া পড়িয়া
বন্যার তরঙ্গ-সম দিল আবরিয়া
আলিঙ্গনে কেশপাশে স্রস্তবেশবাসে
আঘ্রাণে চুম্বনে স্পর্শে সঘন নিশ্বাসে
সর্ব অঙ্গ তার; আর্দ্রগদ্‌গদবচনা
কণ্ঠরুদ্ধপ্রায় "ছাড়িব না’ "ছাড়িব না’
কহে বারম্বার–"তোমা লাগি পাপ, নাথ,
তুমি শাস্তি দাও মোরে, করো মর্মঘাত,
শেষ করে দাও মোর দণ্ড পুরস্কার।’
 
অরণ্যের গ্রহতারাহীন অন্ধকার
অন্ধভাবে কী যেন করিল অনুভব
বিভীষিকা। লক্ষ লক্ষ তরুমূল সব
মাটির ভিতরে থাকি শিহরিল ত্রাসে।
বারেক ধ্বনিল রুদ্ধ নিষ্পেষিত শ্বাসে
অন্তিম কাকুতিস্বর, তারি পরক্ষণে
কে পড়িল ভূমি-’পরে অসাড় পতনে।
 
বজ্রসেন বন হতে ফিরিল যখন,
প্রথম উষার করে বিদ্যুৎবরন
মন্দিরত্রিশূলচূড়া জাহ্নবীর পারে।
জনহীন বালুতটে নদী ধারে-ধারে
কাটাইল দীর্ঘ দিন ক্ষিপ্তের মতন
উদাসীন। মধ্যাহ্নের জ্বলন্ত তপন
হানিল সর্বাঙ্গ তার অগ্নিময়ী কশা।
ঘটকক্ষে গ্রামবধূ হরি তার দশা
কহিল করুণকণ্ঠে, "কে গো গৃহছাড়া,
এসো আমাদের ঘরে।’ দিল না সে সাড়া।
তৃষায় ফাটিল ছাতি, তবি স্পর্শিল না
সম্মুখের নদী হতে জল এক কণা।
দিনশেষে জ্বরতপ্ত দগ্ধ কলেবরে
ছুটিয়া পশিল গিয়া তরণীর ’পরে,
পতঙ্গ যেমন বেগে অগ্নি দেখে ধায়
উগ্র আগ্রহের ভরে। হেরিল শয্যায়
একটি নূপুর আছে পড়ি, শতবার
রাখিল বক্ষেতে চাপি–ঝংকার তাহার
শতমুখ শরসম লাগিল বর্ষিতে
হৃদয়ের মাঝে। ছিল পড়ি এক ভিতে
নীলাম্বর বস্ত্রখানি, রাশীকৃত করি
তারি ’পরে মুখ রাখি রহিল সে পড়ি–
সুকুমার দেহগন্ধ নিশ্বাসে নিঃশেষে
লইল শোষণ করি অতৃপ্ত আবেশে।
শুক্ল পঞ্চমীর শশী অস্তাচলগামী
সপ্তপর্ণতরুশিরে পড়িয়াছে নামি
শাখা-অন্তরালে। দুই বাহু প্রসারিয়া
ডাকিতেছে বজ্রসেন "এসো এসো প্রিয়া’
চাহি অরণ্যের পানে। হেনকালে তীরে
বালুতটে ঘনকৃষ্ণ বনের তিমিরে
কার মূর্তি দেখা দিল উপচ্ছায়াসম।
 
"এসো এসো প্রিয়া!’ "আসিয়াছি প্রিয়তম!’
চরণে পড়িল শ্যামা, "ক্ষম মোরে ক্ষম!
গেল না তো সুকঠিন এ পরান মম
তোমার করুণ করে!’ শুধু ক্ষণতরে
বজ্রসেন তাকাইল তার মুখ ’পরে,
ক্ষণতরে আলিঙ্গন লাগি বাহু মেলি
চমকি উঠিল, তারে দূরে দিল ঠেলি–
গরজিল, "কেন এলি, কেন ফিরে এলি!’
বক্ষ হতে নূপুর লইয়া দিল ফেলি,
জ্বলন্ত-অঙ্গার-সম নীলাম্বরখানি
চরণের কাছ হতে ফেলে দিল টানি;
শয্যা যেন অগ্নিশয্যা, পদতলে থাকি
লাগিল দহিতে তারে। মুদি দুই আঁখি
কহিল ফিরায়ে মুখ, "যাও যাও ফিরে,
মোরে ছেড়ে চলে যাও!’ নারী নতশিরে
ক্ষণতরে রহিল নীরবে। পরক্ষণে
ভূতলে রাখিয়া জানু যুবার চরণে
প্রণমিল, তার পরে নামি নদীতীরে
আঁধার বনের পথে চলি গেল ধীরে,
নিদ্রাভঙ্গ ক্ষণিকের অপূর্ব স্বপন
নিশার তিমির-মাঝে মিলায় যেমন।
    
সামান্য ক্ষতি
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দিব্যাবদানমালা

বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস,
          স্বচ্ছসলিলা বরুণা।
পুরী হতে দূরে গ্রামে নির্জনে
শিলাময় ঘাট চম্পকবনে,
স্নানে চলেছেন শতসখীসনে
          কাশীর মহিষী করুণা।
 
সে পথ সে ঘাট আজি এ প্রভাতে
          জনহীন রাজশাসনে।
নিকটে যে ক’টি আছিল কুটির
ছেড়ে গেছে লোক, তাই নদীতীর
স্তব্ধ গভীর, কেবল পাখির
          কূজন উঠিছে কাননে।
 
আজি উতরোল উত্তর বায়ে
          উতলা হয়েছে তটিনী।
সোনার আলোক পড়িয়াছে জলে,
পুলকে উছলি ঢেউ ছলছলে–
লক্ষ মানিক ঝলকি আঁচলে
          নেচে চলে যেন নটিনী।
 
কলকল্লোলে লাজ দিল আজ
          নারী কণ্ঠের কাকলি।
মৃণালভুজের ললিত বিলাসে
চঞ্চলা নদী মাতে উল্লাসে,
আলাপে প্রলাপে হাসি-উচ্ছ্বাসে
          আকাশ উঠিল আকুলি।
 
স্নান সমাপন করিয়া যখন
          কূলে উঠে নারী সকলে
মহিষী কহিলা, "উহু! শীতে মরি,
সকল শরীর উঠিছে শিহরি,
জ্বেলে দে আগুন ওলো সহচরী–
          শীত নিবারিব অনলে।’
 
সখীগণ সবে কুড়াইতে কুটা
চলিল কুসুমকাননে।
কৌতুকরসে পাগলপরানী
শাখা ধরি সবে করে টানাটানি,
সহসা সবারে ডাক দিয়া রানী
          কহে সহাস্য আননে–
 
"ওলো তোরা আয়! ওই দেখা যায়
          কুটির কাহার অদূরে,
ওই ঘরে তোরা লাগাবি অনল,
তপ্ত করিব করপদতল’–
এত বলি রানী রঙ্গে বিভল
          হাসিয়া উঠিল মধুরে।
 
কহিল মালতী সকরুণ অতি,
          "একি পরিহাস রানীমা!
আগুন জ্বালায়ে কেন দিবে নাশি?
এ কুটির কোন্‌ সাধু সন্ন্যাসী
কোন্‌ দীনজন কোন্‌ পরবাসী
          বাঁধিয়াছে নাহি জানি মা!’
 
রানী কহে রোষে, "দূর করি দাও
          এই দীনদয়াময়ীরে।’
অতি দুর্দাম কৌতুকরত
যৌবনমদে নিষ্ঠুর যত
যুবতীরা মিলি পাগলের মতো
          আগুন লাগালো কুটিরে।
 
ঘন ঘোর ধূম ঘুরিয়া ঘুরিয়া
          ফুলিয়া ফুলিয়া উড়িল।
দেখিতে দেখিতে হুহু হুংকারি
ঝলকে ঝলকে উল্কা উগারি
শত শত লোল জিহ্বা প্রসারি
          বহ্নি আকাশ জুড়িল।
 
পাতাল ফুঁড়িয়া উঠিল যেন রে
          জ্বালাময়ী যত নাগিনী।
ফণা নাচাইয়া অম্বরপানে
মাতিয়া উঠিল গর্জনগানে,
প্রলয়মত্ত রমণীর কানে
          বাজিল দীপক রাগিণী।
 
প্রভাতপাখির আনন্দ গান
          ভয়ের বিলাপে টুটিল–
দলে দলে কাক করে কোলাহল,
উত্তরবায়ু হইল প্রবল,
কুটির হইতে কুটিরে অনল
          উড়িয়া উড়িয়া ছুটিল।
 
ছোটো গ্রামখানি লেহিয়া লইল
          প্রলয়লোলুপ রসনা।
জনহীন পথে মাঘের প্রভাতে
প্রমোদক্লান্ত শত সখী-সাথে
ফিরে গেল রানী কুবলয় হাতে
          দীপ্ত-অরুণ-বসনা।
 
তখন সভায় বিচার-আসনে
          বসিয়াছিলেন ভূপতি।
গৃহহীন প্রজা দলে দলে আসে,
দ্বিধাকম্পিত গদগদ ভাষে
নিবেদিল দুঃখ সংকোচে ত্রাসে
          চরণে করিয়া বিনতি।
 
সভাসন ছাড়ি উঠি গেল রাজা
          রক্তিমমুখ শরমে।
অকালে পশিলা রানীর আগার–
কহিলা, "মহিষী, একি ব্যবহার!
গৃহ জ্বালাইলে অভাগা প্রজার
          বলো কোন্‌ রাজধরমে!’
 
রুষিয়া কহিল রাজার মহিষী,
          "গৃহ কহ তারে কী বোধে!
গেছে গুটিকত জীর্ণ কুটির,
কতটুকু ক্ষতি হয়েছে প্রাণীর?
কত ধন যায় রাজমহিষীর
          এক প্রহরের প্রমোদে!’
 
কহিলেন রাজা উদ্যত রোষ
          রুধিয়া দীপ্ত হৃদয়ে–
"যতদিন তুমি আছ রাজরানী
দীনের কুটিরে দীনের কী হানি
বুঝিতে নারিবে জানি তাহা জানি–
          বুঝাব তোমারে নিদয়ে।’
 
রাজার আদেশে কিংকরী আসি
          ভূষণ ফেলিল খুলিয়া–
অরুণবরন অম্বরখানি
নির্মম করে খুলে দিল টানি,
ভিখারি নারীর চীরবাস আনি
          দিল রানীদেহে তুলিয়া।
 
পথে লয়ে তারে কহিলেন রাজা,
          "মাগিবে দুয়ারে দুয়ারে–
এক প্রহরের লীলায় তোমার
যে ক’টি কুটির হল ছারখার
যত দিনে পার সে-ক’টি আবার
          গড়ি দিতে হবে তোমারে।
 
"বৎসরকাল দিলেম সময়,
          তার পরে ফিরে আসিয়া
সভায় দাঁড়ায়ে করিয়া প্রণতি
সবার সমুখে জানাবে যুবতী
হয়েছে জগতে কতটুকু ক্ষতি
          জীর্ণ কুটির নাশিয়া।’      
    
মূল্যপ্রাপ্তি
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অবদানশতক

অঘ্রাণে শীতের রাতে              নিষ্ঠুর শিশিরঘাতে
           পদ্মগুলি গিয়াছে মরিয়া–
সুদাস মালীর ঘরে                 কাননের সরোবরে
          একটি ফুটেছে কী করিয়া।
তুলি লয়ে বেচিবারে               গেল সে প্রাসাদদ্বারে,
          মাগিল রাজার দরশন–
হেনকালে হেরি ফুল               আনন্দে পুলকাকুল
          পথিক কহিল একজন,
"অকালের পদ্ম তব                আমি এটি কিনি লব,
          কত মূল্য লইবে ইহার?
বুদ্ধ ভগবান আজ                  এসেছেন পুরমাঝ
          তাঁর পায়ে দিব উপহার।’
মালী কহে, "এক মাষা             স্বর্ণ পাব মনে আশা।’
          পথিক চাহিল তাহা দিতে–
হেনকালে সমারোহে              বহু পূজা-অর্ঘ্য বহে
          নৃপতি বাহিরে আচম্বিতে।
রাজেন্দ্র প্রসেনজিৎ                উচ্চারি মঙ্গলগীত
          চলেছেন বুদ্ধদরশনে–
হেরি অকালের ফুল               শুধালেন, "কত মূল?
          কিনি দিব প্রভুর চরণে।’
মালী কহে, "হে রাজন্‌,           স্বর্ণমাষা দিয়ে পণ
          কিনিছেন এই মহাশয়।’
"দশ মাষা দিব আমি’                কহিলা ধরণীস্বামী,
          "বিশ মাষা দিব’ পান্থকয়।
দোঁহে কহে "দেহো দেহো’,      হার নাহি মানে কেহ–
          মূল্য বেড়ে ওঠে ক্রমাগত।
মালী ভাবে যাঁর তরে              এ দোঁহে বিবাদ করে
          তাঁরে দিলে আরো পাব কত!
কহিল সে করজোড়ে,   "দয়া করে ক্ষম মোরে–
          এ ফুল বেচিতে নাহি মন।’
এত বলি ছুটিল সে                যেথা রয়েছেন বসে
          বুদ্ধদেব উজলি কানন।
বসেছেন পদ্মাসনে                 প্রসন্ন প্রশান্ত মনে,
          নিরঞ্জন আনন্দমূরতি।
দৃষ্টি হতে শান্তি ঝরে,    স্ফুরিছে অধর-’পরে
          করুণার সুধাহাস্যজ্যোতি।
সুদাস রহিল চাহি–               নয়নে নিমেষ নাহি,
          মুখে তার বাক্য নাহি সরে।
সহসা ভূতলে পড়ি                পদ্মটি রাখিল ধরি
          প্রভুর চরণপদ্ম-’পরে।
বরষি অমৃতরাশি                   বুদ্ধ শুধালেন হাসি,
          ’কহো বৎস, কী তব প্রার্থনা।’
ব্যাকুল সুদাস কহে,               "প্রভু, আর কিছু নহে,
          চরণের ধূলি এক কণা।’
    
নগরলক্ষ্মী
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কল্পদ্রুমাবদান

           দুর্ভিক্ষ শ্রাবস্তীপুরে যবে
           জাগিয়া উঠিল হাহারবে,
বুদ্ধ নিজভক্তগণে                  শুধালেন জনে জনে,
         "ক্ষুধিতেরে অন্নদানসেবা
         তোমরা লইবে বল কেবা?’
 
         শুনি তাহা রত্নাকর শেঠ
         করিয়া রহিল মাথা হেঁট।
কহিল সে কর জুড়ি,              "ক্ষুধার্ত বিশাল পুরী,
         এর ক্ষুধা মিটাইব আমি
         এমন ক্ষমতা নাই স্বামী!’
 
         কহিল সামন্ত জয়সেন,
         "যে আদেশ প্রভু করিছেন
তাহা লইতাম শিরে               যদি মোর বুক চিরে
         রক্ত দিলে হ’ত কোনো কাজ–
         মোর ঘরে অন্ন কোথা আজ!’
 
         নিশ্বাসিয়া কহে ধর্মপাল,
         "কী কব, এমন দগ্ধ ভাল,
আমার সোনার খেত              শুষিছে অজন্মা-প্রেত,
         রাজকর জোগানো কঠিন–
         হয়েছে অক্ষম দীনহীন।’
 
         রহে সবে মুখে মুখে চাহি,
         কাহারো উত্তর কিছু নাহি।
নির্বাক্‌ সে সভাঘরে               ব্যথিত নগরী-’পরে
         বুদ্ধের করুণ আঁখি দুটি
         সন্ধ্যাতারাসম রহে ফুটি।
 
         তখন উঠিল ধীরে ধীরে
         রক্তভাল রাজনম্রশিরে
অনাথপিণ্ডদসুতা                   বেদনায় অশ্রুপ্লুতা,
         বুদ্ধের চরণরেণু লয়ে
         মধু কণ্ঠে কহিল বিনয়ে–
 
         "ভিক্ষুণীর অধম সুপ্রিয়া
         তব আজ্ঞা লইল বহিয়া।
কাঁদে যারা খাদ্যহারা              আমার সন্তান তারা,
         নগরীরে অন্ন বিলাবার
         আমি আজি লইলাম ভার।’
 
         বিস্ময় মানিল সবে শুনি–
         "ভিক্ষুকন্যা তুমি যে ভিক্ষুণী!
কোন্‌ অহংকারে মাতি   লইলে মস্তকে পাতি
         এ-হেন কঠিন গুরু কাজ!
         কী আছে তোমার কহো আজ।’
 
         কহিল সে নমি সবা-কাছে,
         "শুধু এই ভিক্ষাপাত্র আছে।
আমি দীনহীন মেয়ে               অক্ষম সবার চেয়ে,
         তাই তোমাদের পাব দয়া–
         প্রভু-আজ্ঞা হইবে বিজয়া।
 
         "আমার ভাণ্ডার আছে ভরে      
         তোমা-সবাকার ঘরে ঘরে।
তোমরা চাহিলে সবে              এ পাত্র অক্ষয় হবে।
         ভিক্ষা-অন্নে বাঁচাব বসুধা–
         মিটাইব দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা।’      
    
অপমান-বর
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভক্তমাল

ভক্ত কবীর সিদ্ধপুরুষ খ্যাতি রটিয়াছে দেশে।
কুটির তাহার ঘিরিয়া দাঁড়ালো লাখো নরনারী এসে।
কেহ কহে "মোর রোগ দূর করি মন্ত্র পড়িয়া দেহো’,
সন্তান লাগি করে কাঁদাকাটি বন্ধ্যা রমণী কেহ।
কেহ বলে "তব দৈব ক্ষমতা চক্ষে দেখাও মোরে’,
কেহ কয় "ভবে আছেন বিধাতা বুঝাও প্রমাণ করে’।
 
কাঁদিয়া ঠাকুরে কাতর কবীর কহে দুই জোড়করে,
"দয়া করে হরি জন্ম দিয়েছ নীচ যবনের ঘরে–
ভেবেছিনু কেহ আসিবেনা কাছে অপার কৃপায় তব,
সবার চোখের আড়ালে কেবল তোমায় আমায় রব।
একি কৌশল খেলেছ মায়াবী, বুঝি দিলে মোরে ফাঁকি।
বিশ্বের লোক ঘরে ডেকে এনে তুমি পালাইবে নাকি!’
 
ব্রাহ্মণ যত নগরে আছিল উঠিল বিষম রাগি–
লোক নাহি ধরে যবন জোলার চরণধুলার লাগি!
চারি পোওয়া কলি পুরিয়া আসিল পাপের বোঝায় ভরা,
এর প্রতিকার না করিলে আর রক্ষা না পায় ধরা।
ব্রাহ্মণদল যুক্তি করিল নষ্ট নারীর সাথে–
গোপনে তাহারে মন্ত্রণা দিল, কাঞ্চন দিল হাতে।
 
বসন বেচিতে এসেছে কবীর একদা হাটের বারে,
সহসা কামিনী সবার সামনে কাঁদিয়া ধরিল তারে।
কহিল,"রে শঠ, নিঠুর কপট, কহি নে কাহারো কাছে–
এমনি করে কি সরলা নারীরে ছলনা করিতে আছে!
বিনা অপরাধে আমারে ত্যজিয়া সাধু সাজিয়াছ ভালো,
অন্নবসন বিহনে আমার বরন হয়েছে কালো!’
 
কাছে ছিল যত ব্রাহ্মণদল করিল কপট কোপ,
"ভণ্ডতাপস, ধর্মের নামে করিছ ধর্মলোপ!
তুমি সুখে ব’সে ধুলা ছড়াইছ সরল লোকের চোখে,
অবলা অখলা পথে পথে আহা ফিরিছে অন্নশোকে!’
কহিল কবীর, "অপরাধী আমি, ঘরে এসো নারী তবে–
আমার অন্ন রহিতে কেন বা তুমি উপবাসী রবে?’
 
দুষ্টা নারীরে আনি গৃহমাঝে বিনয়ে আদর করি
কবীর কহিল, "দীনের ভবনে তোমারে পাঠাল হরি।’
কাঁদিয়া তখন কহিল রমণী লাজে ভয়ে পরিতাপে,
"লোভে পড়ে আমি করিয়াছি পাপ, মরিব সাধুর শাপে।’
কহিল কবীর, "ভয় নাই মাতঃ, লইব না অপরাধ–
এনেছ আমার মাথার ভূষণ অপমান অপবাদ।’
 
ঘুচাইল তার মনের বিকার, করিল চেতনা দান–
সঁপি দিল তার মধুর কণ্ঠে হরিনামগুণগান।
রটি গেল দেশে–কপট কবীর, সাধুতা তাহার মিছে।
শুনিয়া কবীর কহে নতশির, "আমি সকলের নীচে।
যদি কূল পাই তরণী-গরব রাখিতে না চাহি কিছু–
তুমি যদি থাক আমার উপরে আমি রব সব-নিচু।’
 
রাজার চিত্তে কৌতুক হল শুনিতে সাধুর গাথা।
দূত আসি তারে ডাকিল যখন সাধু নাড়িলেন মাথা।
কহিলেন, "থাকি সবা হতে দূরে আপন হীনতা-মাঝে;
আমার মতন অভাজন জন রাজার সভায় সাজে!’
দূত কহে, "তুমি না গেলে ঘটিবে আমাদের পরমাদ,
যশ শুনে তব হয়েছে রাজার সাধু দেখিবার সাধ।’
 
রাজা বসে ছিল সভার মাঝারে, পারিষদ সারি সারি–
কবীর আসিয়া পশিল সেথায় পশ্চাতে লয়ে নারী।
কেহ হাসে কেহ করে ভুরুকুটি, কেহ রহে নতশিরে,
রাজা ভাবে–এটা কেমন নিলাজ রমণী লইয়া ফিরে!
ইঙ্গিতে তাঁর সাধুরে সভার বাহির করিল দ্বারী,
বিনয়ে কবীর চলিল কুটিরে সঙ্গ লইয়া নারী।
 
পথমাঝে ছিল ব্রাহ্মণদল, কৌতুকভরে হাসে–
শুনায়ে শুনায়ে বিদ্রূপবাণী কহিল কঠিন ভাষে।
তখন রমণী কাঁদিয়া পড়িল সাধুর চরণমূলে–
কহিল, "পাপের পঙ্ক হইতে কেন নিলে মোরে তুলে!
কেন অধমেরে রাখিয়া দুয়ারে সহিতেছ অপমান!’
কহিল কবীর, "জননী, তুমি যে আমার প্রভুর দান।’      
    
স্বামীলাভ
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভক্তমাল

একদা তুলসীদাস জাহ্নবীর তীরে
          নির্জন শ্মশানে
সন্ধ্যায় আপন-মনে একা একা ফিরে
          মাতি নিজগানে।
হেরিলেন মৃত পতি-চরণের তলে
          বসিয়াছে সতী,
তারি সনে একসাথে এক চিতানলে
          মরিবারে মতি।
সঙ্গীগণ মাঝে মাঝে আনন্দচীৎকারে
          করে জয়নাদ,
পুরোহিত ব্রাহ্মণেরা ঘেরি চারি ধারে
          গাহে সাধুবাদ।
 
সহসা সাধুরে নারী হেরিয়া সম্মুখে
          করিয়া প্রণতি
কহিল বিনয়ে, "প্রভো, আপন শ্রীমুখে
          দেহো অনুমতি।’
তুলসী কহিল, "মাতঃ, যাবে কোন্‌খানে,
          এত আয়োজন!’
সতী কহে, "পতিসহ যাব স্বর্গপানে
          করিয়াছি মন।’
"ধরা ছাড়ি কেন, নারী, স্বর্গ চাহ তুমি’
          সাধু হাসি কহে–
"হে জননী, স্বর্গ যাঁর, এ ধরণীভূমি
          তাঁহারি কি নহে?’
 
বুঝিতে না পারি কথা নারী রহে চাহি
          বিস্ময়ে অবাক্‌–
কহে করজোড় করি, "স্বামী যদি পাই
          স্বর্গ দূরে থাক্‌।’
তুলসী কহিল হাসি, "ফিরে চলো ঘরে,
          কহিতেছি আমি,
ফিরে পাবে আজ হতে মাসেকের পরে
          আপনার স্বামী।’
রমণী আশার বশে গৃহে ফিরি যায়
          শ্মশান তেয়াগি–
তুলসী জাহ্নবীতীরে নিস্তব্ধ নিশায়
          রহিলেন জাগি।
 
নারী রহে শুদ্ধচিতে নির্জন ভবনে–
          তুলসী প্রত্যহ
কী তাহারে মন্ত্র দেয়, নারী একমনে
          ধ্যায় অহরহ।
এক মাস পূর্ণ হতে প্রতিবেশীদলে
          আসি তার দ্বারে
শুধাইল, "পেলে স্বামী?’ নারী হাসি বলে,
          "পেয়েছি তাঁহারে।’
শুনি ব্যগ্র কহে তারা, "কহো তবে কহো
          আছে কোন্‌ ঘরে।’
নারী কহে, "রয়েছেন প্রভু অহরহ
          আমারি অন্তরে।’      
    
স্পর্শমণি
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভক্তমাল

নদীতীরে বৃন্দাবনে                সনাতন একমনে
                   জপিছেন নাম,
হেনকালে দীনবেশে               ব্রাহ্মণ চরণে এসে
                   করিল প্রণাম।
শুধালেন সনাতন,                  "কোথা হতে আগমন,
                   কী নাম ঠাকুর?’
বিপ্র কহে, "কিবা কব,              পেয়েছি দর্শন তব
                   ভ্রমি বহুদূর।
জীবন আমার নাম,                মানকরে মোর ধাম,
                   জিলা বর্ধমানে–
এতবড়ো ভাগ্যহত                দীনহীন মোর মতো
                   নাই কোনোখানে।
জমিজমা আছে কিছু,            করে আছি মাথা নিচু,
                   অল্পস্বল্প পাই।
ক্রিয়াকর্ম-যজ্ঞযাগে                বহু খ্যাতি ছিল আগে,
                   আজ কিছু নাই।
আপন উন্নতি লাগি                শিব-কাছে বর মাগি
                   করি আরাধনা।
একদিন নিশিভোরে               স্বপ্নে দেব কন মোরে–
                   পুরিবে প্রার্থনা!
যাও যমুনার তীর,                 সনাতন গোস্বামীর
                   ধরো দুটি পায়!
তাঁরে পিতা বলি মেনো,           তাঁরি হাতে আছে জেনো
                   ধনের উপায়।’
 
শুনি কথা সনাতন                  ভাবিয়া আকুল হন–
                   "কী আছে আমার!
যাহা ছিল সে সকলি              ফেলিয়া এসেছি চলি–
                   ভিক্ষামাত্র সার।’
সহসা বিস্মৃতি ছুটে,              সাধু ফুকারিয়া উঠে,
                   "ঠিক বটে ঠিক।
একদিন নদীতটে                  কুড়ায়ে পেয়েছি বটে
                   পরশমানিক।
যদি কভু লাগে দানে              সেই ভেবে ওইখানে
                   পুঁতেছি বালুতে–
নিয়ে যাও হে ঠাকুর,              দুঃখ তব হবে দূর
                   ছুঁতে নাহি ছুঁতে।’
 
বিপ্র তাড়াতাড়ি আসি             খুঁড়িয়া বালুকারাশি
                   পাইল সে মণি,
লোহার মাদুলি দুটি               সোনা হয়ে উঠে ফুটি,
                   ছুঁইল যেমনি।
ব্রাহ্মণ বালুর ’পরে                 বিস্ময়ে বসিয়া পড়ে–
                   ভাবে নিজে নিজে।
যমুনা কল্লোলগানে                চিন্তিতের কানে কানে
                   কহে কত কী যে!
নদীপারে রক্তছবি                  দিনান্তের ক্লান্ত রবি
                   গেল অস্তাচলে–
তখন ব্রাহ্মণ উঠে                  সাধুর চরণে লুটে
                   কহে অশ্রুজলে,
"যে ধনে হইয়া ধনী                মণিরে মান না মণি
                   তাহারি খানিক
মাগি আমি নতশিরে।’             এত বলি নদীনীরে
                   ফেলিল মানিক।      
    
বন্দী বীর
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
          পঞ্চনদীর তীরে
          বেণী পাকাইয়া শিরে
দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে
          জাগিয়া উঠেছে শিখড্ড
         নির্মম নির্ভীক।
হাজার কণ্ঠে গুরুজির জয়
          ধ্বনিয়া তুলেছে দিক্‌।
          নূতন জাগিয়া শিখ
নূতন উষার সূর্যের পানে
          চাহিল নির্নিমিখ।
 
          "অলখ নিরঞ্জন’
মহারব উঠে বন্ধন টুটে
          করে ভয়ভঞ্জন।
বক্ষের পাশে ঘন উল্লাসে
          অসি বাজে ঝন্‌ঝন্‌।
পঞ্জাব আজি গরজি উঠিল,
          "অলখ নিরঞ্জন!’
 
          এসেছে সে এক দিন
লক্ষ পরানে শঙ্কা না জানে
          না রাখে কাহারো ঋণ।
জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য,
          চিত্ত ভাবনাহীন।
পঞ্চনদীর ঘিরি দশ তীর
          এসেছে সে এক দিন।
 
          দিল্লিপ্রাসাদকূটে
হোথা বারবার বাদশাজাদার
          তন্দ্রা যেতেছে ছুটে।
কাদের কণ্ঠে গগন মন্থ,
          নিবিড় নিশীথ টুটে–
কাদের মশালে আকাশের ভালে
          আগুন উঠেছে ফুটে!
 
          পঞ্চনদীর তীরে
ভক্তদেহের রক্তলহরী
          মুক্ত হইল কি রে!
          লক্ষ বক্ষ চিরে
ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাণ পক্ষীসমান
          ছুটে যেন নিজনীড়ে।
          বীরগণ জননীরে
রক্ততিলক ললাটে পরালো
          পঞ্চনদীর তীরে।
 
          মোগল-শিখের রণে
          মরণ-আলিঙ্গনে
কণ্ঠ পাকড়ি ধরিল আঁকড়ি
          দুইজনা দুইজনে।
দংশনক্ষত শ্যেনবিহঙ্গ
          যুঝে ভুজঙ্গ-সনে।
          সেদিন কঠিন রণে
"জয় গুরুজির’ হাঁকে শিখ বীর
          সুগভীর নিঃস্বনে।
মত্ত মোগল রক্তপাগল
          "দীন্‌ দীন্‌’ গরজনে।
 
          গুরুদাসপুর গড়ে
বন্দী যখন বন্দী হইল
         তুরানি সেনার করে,
সিংহের মতো শৃঙ্খল গত
          বাঁধি লয়ে গেল ধরে
          দিল্লিনগর-’পরে।
বন্দা সমরে বন্দী হইল
          গুরুদাসপুর গড়ে।
 
সম্মুখে চলে মোগল-সৈন্য
          উড়ায়ে পথের ধূলি,
ছিন্ন শিখের মুণ্ড লইয়া
          বর্শাফলকে তুলি।
শিখ সাত শত চলে পশ্চাতে,
          বাজে শৃঙ্খলগুলি।
রাজপথ-’পরে লোক নাহি ধরে,
          বাতায়ন যায় খুলি।
শিখ গরজয়, "গুরুজির জয়’
          পরানের ভয় ভুলি।
মোগলে ও শিখে উড়ালো আজিকে
          দিল্লিপথের ধূলি।
 
পড়ি গেল কাড়াকাড়ি,
আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান
তারি লাগি তাড়াতাড়ি।
দিন গেলে প্রাতে ঘাতকের হাতে
          বন্দীরা সারি সারি
"জয় গুরুজির’ কহি শত বীর
          শত শির দেয় ডারি।
 
সপ্তাহকালে সাত শত প্রাণ
          নিঃশেষ হয়ে গেলে
বন্দার কোলে কাজি দিল তুলি
          বন্দার এক ছেলে।
কহিল, "ইহারে বধিতে হইবে
          নিজহাতে অবহেলে।’
          দিল তার কোলে ফেলে
কিশোর কুমার, বাঁধা বাহু তার,
          বন্দার এক ছেলে।
 
          কিছু না কহিল বাণী,
বন্দা সুধীরে ছোটো ছেলেটিরে
         লইল বক্ষে টানি।
ক্ষণকালতরে মাথার উপরে
         রাখে দক্ষিণ পাণি,
শুধু একবার চুম্বিল তার
         রাঙা উষ্ণীষখানি।
 
তার পরে ধীরে কটিবাস হতে
         ছুরিকা খসায়ে আনি
         বালকের মুখ চাহি
"গুরুজির জয়’ কানে কানে কয়,
         "রে পুত্র, ভয় নাহি।’
নবীন বদনে অভয় কিরণ
          জ্বলি উঠি উৎসাহি
কিশোর কণ্ঠে কাঁপে সভাতল
          বালক উঠিল গাহি
"গুরুজির জয়! কিছু নাহি ভয়’
          বন্দার মুখ চাহি।
 
বন্দা তখন বামবাহুপাশ
         জড়াইল তার গলে,
দক্ষিণ করে ছেলের বক্ষে
        ছুরি বসাইল বলেড্ড
"গুরুজির জয়’ কহিয়া বালক
        লুটালো ধরণীতলে।
        সভা হল নিস্তব্ধ
বন্দার দেহ ছিঁড়িল ঘাতক
        সাঁড়াশি করিয়া দগ্ধ।
স্থির হয়ে বীর মরিল, না করি’
       একটি কাতর শব্দ।
দর্শনজন মুদিল নয়ন,
       সভা হল নিস্তব্ধ।      
    
মানী
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আরঙজেব ভারত যবে
           করিতেছিল খান-খান
মারবপতি কহিলা আসি,
          "করহ প্রভু অবধান,
গোপন রাতে অচলগড়ে
নহর যাঁরে এনেছ ধরে
          সিরোহিপতি সুরতান।
কী অভিলাষ তাঁহার ’পরে
          আদেশ মোরে করো দান।’
 
শুনিয়া কহে আরঙজেব,
          "কি কথা শুনি অদ্ভুত!
এতদিনে কি পড়িল ধরা
          অশনিভরা বিদ্যুৎ?
পাহাড়ি লয়ে কয়েক শত
পাহাড়ে বনে ফিরিতে রত
মরুভূমির মরীচি-মতো
          স্বাধীন ছিল রাজপুত!
দেখিতে চাহি, আনিতে তারে
         পাঠাও কোনো রাজদূত।’
 
মাড়োয়ারাজ যশোবন্ত
          কহিলা তবে জোড়কর,
"ক্ষত্রকুলসিংহশিশু
          লয়েছে আজি মোর ঘর–
বাদশা তাঁরে দেখিতে চান,
বচন আগে করুন দান
কিছুতে কোনো অসম্মান
          হবে না কভু তাঁর ’পর
সভায় তবে আপনি তাঁরে
          আনিব করি সমাদর।’
 
আরঙজেব কহিলা হাসি,
          "কেমন কথা কহ আজ!
প্রবীণ তুমি প্রবল বীর
          মাড়োয়াপতি মহারাজ।
তোমার মুখে এমন বাণী
শুনিয়া মনে শরম মানি,
মানীর মান করিব হানি
          মানীরে শোভে হেন কাজ?
কহিনু আমি, চিন্তা নাহি,
          আনহ তাঁরে সভামাঝ।’
 
সিরোহিপতি সভায় আসে
          মাড়োয়ারাজে লয়ে সাথ,
উচ্চশির উচ্চ রাখি
          সমুখে করে আঁখিপাত
কহিল সবে বজ্রনাদে
"সেলাম করো বাদশাজাদে’–
হেলিয়া যশোবন্ত-কাঁধে
          কহিলা ধীরে নরনাথ,
"গুরুজনের চরণ ছাড়া
          করি নে কারে প্রণিপাত।’
 
কহিলা রোষে রক্ত-আঁখি
          বাদশাহের অনুচর,
"শিখাতে পারি কেমনে মাথা
          লুটিয়া পড়ে ভূমি-’পর।’
হাসিয়া কহে সিরহিপতি,
"এমন যেন না হয় মতি
ভয়েতে কারে করিব নতি,
          জানি নে কভু ভয়-ডর।’
এতেক বলি দাঁড়ালো রাজা
          কৃপাণ-’পরে করি ভর।
 
বাদশা ধরি সুরতানেরে
          বসায়ে নিল নিজপাশ–
কহিলা, "বীর, ভারত-মাঝে
          কী দেশ-’পরে তব আশ?’
কহিলা রাজা, "অচলগড়
দেশের সেরা জগৎ-’পর।’
সভার মাঝে পরস্পর
          নীরবে উঠে পরিহাস।
বাদশা কহে, "অচল হয়ে
          অচলগড়ে করো বাস।’      
    
প্রার্থনাতীত দান
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শিখের পক্ষে বেণীচ্ছেদন ধর্মপরিত্যাগের ন্যায় দূষণীয়

পাঠানেরা যবে বাঁধিয়া আনিল
         বন্দী শিখের দল–
সুহিদ্‌গঞ্জ রক্তবরন
          হইল ধরণীতল।
নবাব কহিল, "শুন তরুসিং,
          তোমারে ক্ষমিতে চাই।’
তরুসিং কহে, "মোরে কেন তব
          এত অবহেলা ভাই?’
নবাব কহিল, "মহাবীর তুমি,
          তোমারে না করি ক্রোধ–
বেণীটি কাটিয়া দিয়ে যাও মোরে
          এই শুধু অনুরোধ।’
তরুসিং কহে, "করুণা তোমার
          হৃদয়ে রহিল গাঁথা–
যা চেয়েছ তার কিছু বেশি দিব,
          বেণীর সঙ্গে মাথা।’      
    
রাজবিচার
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রাজস্থান

বিপ্র কহে, রমণী মোর  আছিল যেই ঘরে
নিশীথে সেথা পশিল চোর       ধর্মনাশ-তরে।
বেঁধেছি তারে, এখন কহো       চোরে কী দেব সাজা।’
"মৃত্যু’ শুধু কহিলা তারে          রতনরাও রাজা।
ছুটিয়া আসি কহিল দূত,          "চোর সে যুবরাজ–
বিপ্র তাঁরে ধরেছে রাতে,         কাটিল প্রাতে আজ।
ব্রাহ্মণেরে এনেছি ধরে,  কী তারে দিব সাজা?’
"মুক্তি দাও’ কহিলা শুধু           রতনরাও রাজা।      
    
গুরু গোবিন্দ
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
"বন্ধু, তোমরা ফিরে যাও ঘরে
          এখনো সময় নয়’–
নিশি অবসান, যমুনার তীর,
ছোটো গিরিমালা, বন সুগভীর,
গুরু গোবিন্দ কহিলা ডাকিয়া
          অনুচর গুটি ছয়।
 
"যাও রামদাস, যাও গো লেহারি,
          সাহু, ফিরে যাও তুমি।
দেখায়ো না লোভ, ডাকিয়ো না মোরে
ঝাঁপায়ে পড়িত কর্মসাগরে–
এখনো পড়িয়া থাক্‌ বহু দূরে
          জীবনরঙ্গভূমি।
 
"ফিরায়েছি মুখ, রুধিয়াছি কান,
          লুকায়েছি বনমাঝে।
সুদূরে মানবসাগর অগাধ
চিরক্রন্দিত-ঊর্মি-নিনাদ,
হেথায় বিজনে রয়েছি মগন
          আপন গোপন কাজে।
 
"মানবের প্রাণ ডাকে যেন মোরে
          সেই লোকালয় হতে।
সুপ্ত নিশীথে জেগে উঠে তাই
চমকিয়া উঠে বলি "যাই যাই’,
প্রাণ মন দেহ ফেলে দিতে চাই
          প্রবল মানবস্রোতে।
 
তোমাদের হেরি চিত চঞ্চল,
          উদ্দাম ধায় মন।
রক্ত-অনল শত শিখা মেলি
সর্পসমান করি উঠে কেলি,
গঞ্জনা দেয় তরবারি যেন
          কোষমাঝে ঝন্‌ ঝন্‌।
 
"হায়, সেকি সুখ, এ গহন ত্যজি
          হাতে লয়ে জয়তুরী
জনতার মাঝে ছুটিয়া পড়িতে,
রাজ্য ও রাজা ভাঙিতে গড়িতে,
অত্যাচারের বক্ষে পড়িয়া
          হানিতে তীক্ষ্ন ছুরি!
 
"তুরঙ্গসম অন্ধ নিয়তি,
          বন্ধন করি তায়
রশ্মি পাকড়ি আপনার করে
বিঘ্ন বিপদ লঙ্ঘন ক’রে
আপনার পথে ছুটাই তাহারে
          প্রতিকূল ঘটনায়।
 
"সমুখে যে আসে সরে যায় কেহ,
          পড়ে যায় কেহ ভূমে।
দ্বিধা হয়ে বাধা হতেছে ভিন্ন,
পিছে পড়ে থাকে চরণচিহ্ন,
আকাশের আঁখি করিছে খিন্ন
          প্রলয়বহ্নিধূমে।
 
"শত বার করে মৃত্যু ডিঙায়ে
          পড়ি জীবনের পাড়ে।
প্রান্তগগনে তারা অনিমিখ
নিশীথতিমিরে দেখাইছে দিক,
লোকের প্রবাহ ফেনায়ে ফেনায়ে
          গরজিছে দুই ধারে।
 
"কভু অমানিশা নীরব নিবিড়,
          কভু বা প্রখর দিন।
কভু বা আকাশে চারি-দিক-ময়
বজ্র লুকায়ে মেঘ জড়ো হয়,
কভু বা ঝটিকা মাথার উপরে
          ভেঙে পড়ে দয়াহীন।
 
"আয় আয় আয়’ ডাকিতেছি সবে,
          আসিতেছে সবে ছুটে।
বেগে খুলে যায় সব গৃহদ্বার,
ভেঙে বাহিরায় সব পরিবার,
সুখ সম্পদ মায়া মমতার
          বন্ধন যায় টুটে।
 
"সিন্ধুমাঝারে মিশিছে যেমন
পঞ্চ নদীর জল,
আহ্বান শুনে কে কারে থামায়,
ভক্তহৃদয় মিলিছে আমায়,
পঞ্জাব জুড়ি উঠিছে জাগিয়া
          উন্মাদ কোলাহল।
 
"কোথা যাবি ভীরু, গহন গোপনে
          পশিছে কণ্ঠ মোর।
প্রভাতে শুনিয়া "আয় আয় আয়’
কাজের লোকেরা কাজ ভুলে যায়,
নিশীথে শুনিয়া "আয় তোরা আয়’
          ভেঙে যায় ঘুমঘোর।
 
"যত আগে চলি বেড়ে যায় লোক,
          ভরে যায় ঘাট বাট।
ভুলে যায় সবে জাত-অভিমান,
অবহেলে দেয় আপনার প্রাণ,
এক হয়ে যায় মান অপমান
          ব্রাহ্মণ আর জাঠ।
 
"থাক্‌ ভাই, থাক্‌, কেন এ স্বপন–
          এখনো সময় নয়।
এখনো একাকী দীর্ঘ রজনী
জাগিতে হইবে পল গণি গণি
অনিমেষ চোখে পূর্ব গগনে
          দেখিতে অরুণোদয়।
 
"এখনো বিহার কল্পজগতে,
          অরণ্য রাজধানী–
এখনো কেবল নীরব ভাবনা,
কর্মবিহীন বিজন সাধনা,
দিবানিশি শুধু বসে বসে শোনা
          আপন মর্মবাণী।
 
"একা ফিরি তাই যমুনার তীরে
          দুর্গমগিরিমাঝে।
মানুষ হতেছি পাষাণের কোলে,
মিশাতেছি গান নদীকলরোলে,
গড়িতেছি মন আপনার মনে,
          যোগ্য হতেছি কাজে।
 
"এমনি কেটেছে দ্বাদশ বরষ,
         আরো কতদিন হবে!
চারি দিক হতে অমর জীবন
বিন্দু বিন্দু করি আহরণ
আপনার মাঝে আপনারে আমি
          পূর্ণ দেখিব কবে!
"কবে প্রাণ খুলে বলিতে পারিব–
          "পেয়েছি আমার শেষ!
তোমরা সকলে এসো মোর পিছে,
গুরু তোমাদের সবারে ডাকিছে,
আমার জীবনে লভিয়া জীবন
          জাগো রে সকল দেশ!
 
"নাহি আর ভয়, নাহি সংশয়,
          নাহি আর আগু-পিছু।
পেয়েছি সত্য, লভিয়াছি পথ,
সরিয়া দাঁড়ায় সকল জগৎ–
নাই তার কাছে জীবন মরণ,
          নাই নাই আর কিছু।’
 
"হৃদয়ের মাঝে পেতেছি শুনিতে
          দৈববাণীর মতো–
"উঠিয়া দাঁড়াও আপন আলোতে,
ওই চেয়ে দেখো কতদূর হতে
তোমার কাছেতে ধরা দিবে ব’লে
          আসে লোক কত শত।
 
"ওই শোনো শোনো কল্লোলধ্বনি,
          ছুটে হৃদয়ের ধারা।
স্থির থাকো তুমি, থাকো তুমি জাগি
প্রদীপের মতো আলস তেয়াগি,
এ নিশীথমাঝে তুমি ঘুমাইলে
           ফিরিয়া যাইবে তারা।’
 
"ওই চেয়ে দেখো দিগন্ত-পানে
          ঘনঘোর ঘটা অতি।
আসিতেছে ঝড় মরণেরে লয়ে–
তাই বসে বসে হৃদয়-আলয়ে
জ্বালাতেছি আলো, নিবিবে না ঝড়ে,
          দিবে অনন্ত জ্যোতি।
 
"যাও তবে সাহু, যাও রামদাস,
          ফিরে যাও সখাগণ।
এসো দেখি সবে যাবার সময়
বলো দেখি সবে "গুরুজির জয়’,
দুই হাত তুলি বলো "জয় জয়
          অলখ নিরঞ্জন’ ।’
 
বলিতে বলিতে প্রভাততপন
          উঠিল আকাশ-’পরে।
গিরির শিখারে গুরুর মূরতি
কিরণছটায় প্রোজ্জ্বল অতি–
বিদায় মাগিল অনুচরগণ,
          নমিল ভক্তিভরে।      
    
শেষ শিক্ষা
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একদিন শিখগুরু গোবিন্দ নির্জনে
একাকী ভাবিতেছিলা আপনার মনে
আপন জীবনকথা; সে সংকল্পলেখা
অখণ্ড সম্পূর্ণরূপে দিয়েছিল দেখা
যৌবনের স্বর্ণপটে, যে আশা একদা
ভারত গ্রাসিয়াছিল, সে আজি শতধা,
সে আজি সংকীর্ণ শীর্ণ সংশয়সংকুল,
সে আজি সংকটমগ্ন। তবে একি ভুল!
তবে কি জীবন ব্যর্থ! দারুণ দ্বিধায়
শ্রান্তদেহে ক্ষুব্ধচিত্তে আঁধার সন্ধ্যায়
গোবিন্দ ভাবিতেছিল ; হেনকালে এসে
পাঠান কহিল তাঁরে, "যাব চলি দেশে,
ঘোড়া-যে কিনেছ তুমি দাও তার দাম।’
কহিল গোবিন্দ গুরু, "শেখজি, সেলাম,
মূল্য কালি পাবে, আজি ফিরে যাও ভাই।’
পাঠান কহিল রোষে, "মূল্য আজই চাই।’
এত বলি জোর করি ধরি তাঁর হাত–
চোর বলি দিল গালি। শুনি অকস্মাৎ
গোবিন্দ বিজুলি-বেগে খুলি নিল অসি,
পলকে সে পাঠানের মুণ্ড গেল খসি;
রক্তে ভেসে গেল ভূমি। হেরি নিজকাজ
মাথা নাড়ি কহে গুরু, "বুঝিলাম আজ
আমার সময় গেছে। পাপ তরবার
লঙ্ঘন করিল আজি লক্ষ্য আপনার
নিরর্থক রক্তপাতে। এ বাহুর ’পরে
বিশ্বাস ঘুচিয়া গেল চিরকালতরে।
ধুয়ে মুছে যেতে হবে এ পাপ, এ লাজ–
আজ হতে জীবনের এই শেষ কাজ।’
 
পুত্র ছিল পাঠানের বয়স নবীন,
গোবিন্দ লইল তারে ডাকি। রাত্রিদিন
পালিতে লাগিল তারে সন্তানের মতো
চোখে চোখে। শাস্ত্র আর শস্ত্রবিদ্যা যত
আপনি শিখালো তারে। ছেলেটির সাথে
বৃদ্ধ সেই বীরগুরু সন্ধ্যায় প্রভাতে
খেলিত ছেলের মতো। ভক্তগণ দেখি
গুরুরে কহিল আসি, "একি প্রভু, একি!
আমাদের শঙ্কা লাগে। ব্যাঘ্রশাবকেরে
যত যত্ন কর, তার স্বভাব কি ফেরে?
যখন সে বড়ো হবে তখন নখর,
গুরুদেব, মনে রেখো হবে সে প্রখর।’
গুরু কহে, "তাই চাই, বাঘের বাচ্ছারে
বাঘ না করিনু যদি কী শিখানু তারে?’
 
বালক যুবক হল গোবিন্দের হাতে
দেখিতে দেখিতে। ছায়া-হেন ফিরে সাথে,
পুত্র-হেন করে তাঁর সেবা। ভালোবাসে
প্রাণের মতন–সদা জেগে থাকে পাশে
ডান হস্ত যেন। যুদ্ধে হয়ে গেছে গত
শিখগুরু গোবিন্দের পুত্র ছিল যত–
আজি তাঁর প্রৌঢ়কালে পাঠানতনয়
জুড়িয়া বসিল আসি শূন্য সে হৃদয়
গুরুজির। বাজে-পোড়া বটের কোটরে
বাহির হইতে বীজ পড়ি বায়ুভরে
বৃক্ষ হয়ে বেড়ে বেড়ে কবে ওঠে ঠেলি,
বৃদ্ধ বটে ঢেকে ফেলে ডালপালা মেলি।
 
একদা পাঠান কহে নমি গুরু-পায়,
"শিক্ষা মোর সারা হল চরণকৃপায়,
এখন আদেশ পেলে নিজভুজবলে
উপার্জন করি গিয়া রাজসৈন্যদলে।’
গোবিন্দ কহিলা তার পিঠে হাত রাখি,
"আছে তব পৌরুষের এক শিক্ষা বাকি।’
পরদিন বেলা গেলে গোবিন্দ একাকী
বাহিরিলা; পাঠানেরে কহিলেন ডাকি,
"অস্ত্র হাতে এসো মোর সাথে।’ ভক্তদল
"সঙ্গ যাব’ "সঙ্গ যাব’ করে কোলাহল–
গুরু কন, "যাও সবে ফিরে।’
 
                             দুই জনে
কথা নাই ধীরগতি চলিলেন বনে
নদীতীরে। পাথর-ছড়ানো উপকূলে
বরষার জলধারা সহস্র আঙুলে
কেটে গেছে রক্তবর্ণ মাটি। সারি সারি
উঠেছে বিশাল শাল, তলায় তাহারি
ঠেলাঠেলি ভিড় করে শিশু তরুদল
আকাশের অংশ পেতে। নদী হাঁটুজল
ফটিকের মতো স্বচ্ছ, চলে এক ধারে
গেরুয়া বালির কিনারায়। নদীপারে
ইশারা করিল গুরু; পাঠান দাঁড়ালো।
নিবে-আসা দিবসের দগ্ধ রাঙা আলো
বাদুড়ের পাখা-সম দীর্ঘ ছায়া জুড়ি
পশ্চিমপ্রান্তর-পারে চলেছিল উড়ি
নিঃশব্দ আকাশে। গুরু কহিলা পাঠানে,
"মামুদ, হেথায় এসো, খোঁড়ো এইখানে।’
উঠিল সে বালু খুঁড়ি একখণ্ড শিলা
অঙ্কিত লোহিত রাগে। গোবিন্দ কহিলা,
"পাষাণে এই যে রাঙা দাগ, এ তোমার
আপন বাপের রক্ত। এইখানে তার
মুণ্ড ফেলেছিনু কেটে, না শুধিয়া ঋণ,
না দিয়া সময়। আজি আসিয়াছে দিন,
রে পাঠান, পিতার সুপুত্র হও যদি
খোলো তরবার–পিতৃঘাতকেরে বধি
উষ্ণ রক্ত-উপহারে করিবে তর্পণ
তৃষাতুর প্রেতাত্মার।’ বাঘের মতন
হুংকারিয়া লম্ফ দিয়া রক্তনেত্রে বীর
পড়িল গুরুর ’পরে; গুরু রহে স্থির
কাঠের মূর্তির মতো। ফেলি অস্ত্রখান
তখনি চরণে তাঁর পড়িল পাঠান।
কহিল, "হে গুরুদেব, লয়ে শয়তানে
কোরো না এমনতরো খেলা। ধর্ম জানে
ভুলেছিনু পিতৃরক্তপাত; একাধারে
পিতা গুরু বন্ধু বলে জেনেছি তোমারে
এতদিন। ছেয়ে থাক্‌ মনে সেই স্নেহ,
ঢাকা পড়ে হিংসা যাক মরে। প্রভু, দেহো
পদধূলি।’ এত বলি বনের বাহিরে
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেল, না চাহিল ফিরে,
না থামিল একবার। দুটি বিন্দু জল
ভিজাইল গোবিন্দের নয়নযুগল।
 
পাঠান সেদিন হতে থাকে দূরে দূরে।
নিরালা শয়নঘরে জাগাতে গুরুরে
দেখা নাহি দেয় ভোরবেলা। গৃহদ্বারে
অস্ত্র হাতে নাহি থাকে রাতে। নদীপারে
গুরু-সাথে মৃগয়ায় নাহি যায় একা।
নির্জনে ডাকিলে গুরু দেয় না সে দেখা।
 
একদিন আরম্ভিল শতরঞ্চ খেলা
গোবিন্দ পাঠান-সাথে। শেষ হল বেলা
না জানিতে কেহ। হার মানি বারে বারে
মাতিছে মামুদ। সন্ধ্যা হয়, রাত্রি বাড়ে।
সঙ্গীরা যে যার ঘরে চলে গেল ফিরে।
ঝাঁ ঝাঁ করে রাতি। একমনে হেঁটশিরে
পাঠান ভাবিছে খেলা। কখন হঠাৎ
চতুরঙ্গ বল ছুঁড়ি করিল আঘাত
মামুদের শিরে গুরু; কহে অট্টহাসি,
"পিতৃঘাতকের সাথে খেলা করে আসি
এমন যে কাপুরুষ, জয় হবে তার!’
তখনি বিদ্যুৎ-হেন ছুরি খরধার
খাপ হতে খুলি লয়ে গোবিন্দের বুকে
পাঠান বিঁধিয়া দিল। গুরু হাসিমুখে
কহিলেন, "এতদিনে হল তোর বোধ
কী করিয়া অন্যায়ের লয় প্রতিশোধ।
শেষ শিক্ষা দিয়ে গেনু–আজি শেষবার
আশীর্বাদ করি তোরে হে পুত্র আমার।’      
    
নকল গড়
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রাজস্থান

"জলস্পর্শ করব না আর’
          চিতোর-রানার পণ,
"বুঁদির কেল্লা মাটির ’পরে
          থাকবে যতক্ষণ।’
"কী প্রতিজ্ঞা! হায় মহারাজ,
মানুষের যা অসাধ্য কাজ
কেমন ক’রে সাধবে তা আজ’
          কহেন মন্ত্রিগণ।
কহেন রাজা, "সাধ্য না হয়
          সাধব আমার পণ।’
 
বুঁদির কেল্লা চিতোর হতে
          যোজন-তিনেক দূর।
সেথায় হারাবংশী সবাই
           মহা মহা শূর।
হামু রাজা দিচ্ছে থানা,
ভয় কারে কয় নাইকো জানা–
তাহার সদ্য প্রমাণ রানা
          পেয়েছেন প্রচুর।
হারাবংশীর কেলা বুঁদির
         যোজন-তিনেক দূর।
 
মন্ত্রী কহে যুক্তি করি,
         "আজকে সারারাতি
মাটি দিয়ে বুঁদির মতো
          নকল কেল্লা পাতি।
রাজা এসে আপন করে
দিবেন ভেঙে ধূলির ’পরে,
নইলে শুধু কথার তরে
          হবেন আত্মঘাতী!’
মন্ত্রী দিল চিতোর-মাঝে
          নকল কেল্লা পাতি।
 
কুম্ভ ছিল রানার ভৃত্য
          হারাবংশী বীর,
হরিণ মেরে আসছে ফিরে
          স্কন্ধে ধনু তীর।
খবর পেয়ে কহে, "কে রে
নকল বুঁদি কেল্লা মেরে
হারাবংশী রাজপুতেরে
          করবে নতশির!
নকল বুঁদি রাখব আমি
          হারাবংশী বীর।’
 
মাটির কেল্লা ভাঙতে আসেন
          রানা মহারাজ।
"দূরে রহো’ কহে কুম্ভ,
          গর্জে যেন বাজ–
"বুঁদির নামে করবে খেলা
সইবে না সে অবহেলা,
নকল গড়ের মাটির ঢেলা
          রাখব আমি আজ।’
কহে কুম্ভ, "দূরে রহো
          রানা মহারাজ।’
 
ভূমির ’পরে জানু পাতি
          তুলি ধনুঃশর
একা কুম্ভ রক্ষা করে
          নকল বুঁদিগড়।
রানার সেনা ঘিরি তারে
মুণ্ড কাটে তরবারে,
খেলাঘরের সিংহদ্বারে
          পড়ল ভূমি-’পর।
রক্তে তাহার ধন্য হল
          নকল বুঁদিগড়।      
    
হোরিখেলা
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রাজস্থান

পত্র দিল পাঠান কেসর খাঁ’রে
          কেতুন হতে ভূনাগ রাজার রানী–
"লড়াই করি আশ মিটেছে মিঞা?
বসন্ত যায় চোখের উপর দিয়া,
এসো তোমার পাঠান সৈন্য নিয়া–
          হোরি খেলব আমরা রাজপুতানী।’
যুদ্ধে হারি কোটা শহর ছাড়ি
          কেতুন হতে পত্র দিল রানী।
 
পত্র পড়ি কেসর উঠে হাসি,
          মনের সুখে গোঁফে দিল চাড়া।
রঙিন দেখে পাগড়ি পরে মাথে,
সুর্মা আঁকি দিল আঁখির পাতে,
গন্ধভরা রুমাল নিল হাতে–
          সহস্রবার দাড়ি দিল ঝাড়া।
পাঠান সাথে হোরি খেলবে রানী,
          কেসর হাসি গোঁফে দিল চাড়া।
 
ফাগুন মাসে দখিন হতে হাওয়া
          বকুলবনে মাতাল হয়ে এল।
বোল ধরেছে আমের বনে বনে,
ভ্রমরগুলো কে কার কথা শোনে,
গুন্‌গুনিয়ে আপন-মনে-মনে
          ঘুরেঘুরে বেড়ায় এলোমেলো।
কেতুন পুরে দলে দলে আজি
          পাঠান-সেনা হোরি খেলতে এল।
 
কেতুনপুরে রাজার উপবনে
          তখন সবে ঝিকিমিকিবেলা।
পাঠানেরা দাঁড়ায় বনে আসি,
মুলতানেতে তান ধরেছে বাঁশি–
এল তখন একশো রানীর দাসী
          রাজপুতানী করতে হোরিখেলা।
রবি তখন রক্তরাগে রাঙা,
                   সবে তখন ঝিকিমিকি বেলা।
 
পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে,
          ওড়না ওড়ে দক্ষিনে বাতাসে।
ডাহিন হাতে বহে ফাগের থারি,
নীবিবন্ধে ঝুলিছে পিচকারি,
বামহস্তে গুলাব-ভরা ঝারি–
          সারি সারি রাজপুতানী আসে।
পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে,
          ওড়না ওড়ে দক্ষিনে বাতাসে।
 
আঁখির ঠারে চতুর হাসি হেসে
          কেসর তবে কহে কাছে আসি,
"বেঁচে এলেম অনেক যুদ্ধ করি,
আজকে বুঝি জানে-প্রাণে মরি!’
শুনে রানীর শতেক সহচরী
          হঠাৎ সবে উঠল অট্টহাসি।
রাঙা পাগড়ি হেলিয়ে কেসর খাঁ
          রঙ্গভরে সেলাম করে আসি।
 
শুরু হল হোরির মাতামাতি,
          উড়তেছে ফাগ রাঙা সন্ধ্যাকাশে।
নব বরন ধরল বকুল ফুলে,
রক্তরেণু ঝরল তরুমূলে–
ভয়ে পাখি কূজন গেল ভুলে
          রাজপুতানীর উচ্চ উপহাসে।
কোথা হতে রাঙা কুজ্ঝটিকা
          লাগল যেন রাঙা সন্ধ্যাকাশে।
 
চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা
          মনে মনে ভাবছে কেসর খাঁ।
বক্ষ কেন উঠছে নাকো দুলি,
নারীর পায়ে বাঁকা নূপুরগুলি
কেমন যেন বলছে বেসুর বুলি,
          তেমন ক’রে কাঁকন বাজছে না!
চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা
          মনে মনে ভাগছে কেসর খাঁ।
 
পাঠান কহে, "রাজপুতানীর দেহে
          কোথাও কিছু নাই কি কোমলতা!
বাহুযুগল নয় মৃণালের মতো,
কণ্ঠস্বরে বজ্র লজ্জাহত–
বড়ো কঠিন শুষ্ক স্বাধীন যত
          মঞ্জরীহীন মরুভূমির লতা।’
পাঠান ভাবে দেহে কিম্বা মনে
          রাজপুতানীর নাইকো কোমলতা।
 
তান ধরিয়া ইমন-ভূপালীতে
          বাঁশি বেজে উঠল দ্রুত তালে।
কুণ্ডলেতে দোলে মুক্তামালা,
কঠিন হাতে মোটা সোনার বালা,
দাসীর হাতে দিয়ে ফাগের থালা
          রানী বনে এলেন হেনকালে।
তান ধরিয়া ইমন-ভূপালীতে
          বাঁশি তখন বাজছে দ্রুত তালে।
 
কেসর কহে, "তোমারি পথ চেয়ে
          দুটি চক্ষু করেছি প্রায় কানা!’
রানী কহে, "আমারো সেই দশা।’
একশো সখী হাসিয়া বিবশা–
পাঠান-পতির ললাটে সহসা
          মারেন রানী কাঁসার থালাখানা।
রক্তধারা গড়িয়ে পড়ে বেগে
        পাঠান-পতির চক্ষু হল কানা।
 
বিনা মেঘে বজ্ররবের মতো
          উঠল বেজে কাড়া-নাকাড়া।
জ্যোৎস্নাকাশে চমকে ওঠে শশী,
ঝন্‌ঝনিয়ে ঝিকিয়ে ওঠে অসি,
সানাই তখন দ্বারের কাছে বসি
          গভীর সুরে ধরল কানাড়া।
কুঞ্জবনের তরু-তলে-তলে
          উঠল বেজে কাড়া-নাকাড়া।
 
বাতাস বেয়ে ওড়না গেল উড়ে,
          পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।
মন্ত্রে যেন কোথা হতে কে রে
বাহির হল নারী-সজ্জা ছেড়ে,
এক শত বীর ঘিরল পাঠানেরে
          পুষ্প হতে একশো সাপের মতো।
স্বপ্নসম ওড়না গেল উড়ে,
          পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।
 
যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
          সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।
ফাগুন-রাতে কুঞ্জবিতানে
মত্ত কোকিল বিরাম না জানে,
কেতুনপুরে বকুল-বাগানে
           কেসর খাঁয়ের খেলা হল সারা।
যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
          সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।      
    
বিবাহ
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রাজস্থান

প্রহর-খানেক রাত হয়েছে শুধু,
          ঘন ঘন বেজে ওঠে শাঁখ।
বরকন্যা যেন ছবির মতো
আঁচল-বাঁধা দাঁড়িয়ে আঁখি নত,
জানলা খুলে পুরাঙ্গনা যত                      
          দেখছে চেয়ে ঘোমটা করি ফাঁক।
বর্ষারাতে মেঘের গুরুগুরু–
          তারি সঙ্গে বাজে বিয়ের শাঁখ।
 
ঈশান কোণে থমকে আছে হাওয়া,
          মেঘে মেঘে আকাশ আছে ঘেরি।
সভাকক্ষে হাজার দীপালোকে
মণিমালায় ঝিলিক হানে চোখে–
সভার মাঝে হঠাৎ এল ও কে,
          বাহির-দ্বারে বেজে উঠল ভেরী!
চমকে ওঠে সভার যত লোক
          উঠে দাঁড়ায় বর-কনেরে ঘেরি।
 
টোপর-পরা মেত্রিরাজকুমারে
          কহে তখন মাড়োয়ারের দূত,
"যুদ্ধ বাধে বিদ্রোহীদের সনে,
রামসিংহ রানা চলেন রণে–
তোমরা এসো তাঁরি নিমন্ত্রণে
          যে যে আছ মর্তিয়া রাজপুত।’
 
"জয় রানা রাম সিঙের জয়’
          গর্জি উঠে মাড়োয়ারের দূত।
"জয় রানা রাম সিঙের জয়’
          মেত্রিপতি ঊর্ধ্বস্বরে কয়।
কনের বক্ষ কেঁপে ওঠে ডরে,
দুটি চক্ষু ছলো ছলো করে–
বরযাত্রী হাঁকে সমস্বরে,
          "জয় রানা রাম সিঙের জয়’
"সময় নাহি মেত্রিরাজকুমার’
          মহারানার দূত উচ্চে কয়।
 
বৃথা কেন উঠে হুলুধ্বনি,
          বৃথা কেন বেজে ওঠে শাঁখ!
বাঁধা আঁচল খুলে ফেলে বর,
মুখের পানে চাহে পরস্পর–
কহে, "প্রিয়ে, নিলেম অবসর,
          এসেছে ওই মৃত্যুসভার ডাক।’
বৃথা এখন ওঠে হুলুধ্বনি,
          বৃথা এখন বেজে ওঠে শাঁখ!
 
বরের বেশে টোপর পরি শিরে
          ঘোড়ায় চড়ি ছুটে রাজকুমার।
মলিন মুখে নম্র নতশিরে
কন্যা গেল অন্তঃপুরে ফিরে,
হাজার বাতি নিবল ধীরে ধীরে–
          রাজার সভা হল অন্ধকার।
গলায় মালা, টোপর-পরা শিরে
          ঘোড়ায় চড়ি ছুটে রাজকুমার।
 
মাতা কেঁদে কহেন, "বধূবেশ
          খুলিয়া ফেল্‌ হায় রে হতভাগী!’
শান্তমুখে কন্যা কহে মায়ে,
"কেঁদো না মা, ধরি তোমার পায়ে,
বধূসজ্জা থাক্‌ মা, আমার গায়েড্ড
         মেত্রিপুরে যাইব তাঁর লাগি।’
শুনে মাতা কপালে কর হানি
          কেঁদে কহেন, "হায় রে হতভাগী!’
গ্রহবিপ্র আশীর্বাদ করি
          ধানদূর্বা দিল তাহার মাথে।
চড়ে কন্যা চতুর্দোলা-’পরে,
পুরনারী হুলুধ্বনি করে,
রঙিন বেশে কিংকরী কিংকরে
          সারি সারি চলে বালার সাথে।
মাতা আসি চুমো খেলেন মুখে,
          পিতা আসি হস্ত দিলেন মাথে।
 
নিশীথ-রাতে আকাশ আলো করি
          কে এল রে মেত্রিপুরদ্বারে!
"থামাও বাঁশি’ কহে, "থামাও বাঁশি–
চতুর্দোলা নামাও রে দাসদাসী।
মিলেছি আজ মেত্রিপুরবাসী
          মেত্রিপতির চিতা রচিবারে।
মেত্রিরাজা যুদ্ধে হত আজি,
          দুঃসময়ে কারা এল দ্বারে?’
 
"বাজাও বাঁশি, ওরে, বাজাও বাঁশি’
          চতুর্দোলা হতে বধূ বলে,
"এবার লগ্ন আর হবে না পার,
আঁচলে গাঁঠ খুলবে না তো আর–
শেষের মন্ত্র উচ্চারো এইবার
          শ্মশান-সভায় দীপ্ত চিতানলে।’
"বাজাও বাঁশি, ওরে, বাজাও বাঁশি’
          চতুর্দোলা হতে বধূ বলে।
 
বরের বেশে মোতির মালা গলে
         মেত্রিপতি চিতার ’পরে শুয়ে।
দোলা হতে নামল আসি নারী,
আঁচল বাঁধি রক্তবাসে তাঁরি
শিয়র-’পরে বৈসে রাজকুমারী
          বরের মাথা কোলের ’পরে থুয়ে।
নিশীথ-রাতে মিলনসজ্জা-পরা
          মেত্রিপতি চিতার ’পরে শুয়ে।
 
ঘন ঘন জাগল হুলুধ্বনি,
          দলে দলে আসে পুরাঙ্গনা।
কয় পুরোহিত "ধন্য সুচরিতা’,
গাহিছে ভাট "ধন্য মৃত্যুজিতা’,
ধূ ধূ করে জ্বলে উঠল চিতা–
          কন্যা বসে আছেন যোগাসনা।
জয়ধ্বনি উঠে শ্মশান-মাঝে,
          হুলুধ্বনি করে পুরাঙ্গনা।      
    
বিচারক
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পন্ডিত শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন-প্রণীত চরিতমালা হইতে গৃহীত।

অ্যাকওয়ার্থ সাহেব-প্রণীত Ballads of the Marathas নামক গ্রন্থে রঘুনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র নারায়ণ রাওয়ের হত্যা সম্বন্ধে প্রচলিত মারাঠি গাথার ইংরেজি অ্যানুবাদ প্রকাশিত হইয়াছে।

পুণ্য নগরে রঘুনাথ রাও
          পেশোয়া-নৃপতি-বংশ
রাজাসনে উঠি কহিলেন বীর,
"হরণ করিব ভার পৃথিবীরড্ড
মৈসুরপতি হৈদরালির
            দর্প করিব ধ্বংস।’
 
দেখিতে দেখিতে পুরিয়া উঠিল
          সেনানী আশি সহস্র।
নানা দিকে দিকে নানা পথে পথে
মারাঠার যত গিরিদরি হতে
বীরগণ যেন শ্রাবণের স্রোতে
          ছুটিয়া আসে অ্যাজস্র।
 
উড়িল গগনে বিজয়পতাকা,
          ধ্বনিল শতেক শঙ্খ।
হুলুরব করে অ্যাঙ্গনা সবে,
মারাঠা-নগরী কাঁপিল গরবে,
রহিয়া রহিয়া প্রলয়-আরবে
          বাজে ভৈরব ডঙ্ক।
 
ধুলার আড়ালে ধ্বজ-অ্যারণ্যে
          লুকালো প্রভাতসূর্য।
রক্ত অ্যাশ্বে রঘুনাথ চলে,
আকাশ বধির জয়কোলাহলে–
সহসা যেন কী মন্ত্রের বলে
          থেমে গেল রণতূর্য!
 
সহসা কাহার চরণে ভূপতি
          জানালো পরম দৈন্য?
সমরোন্মাদে ছুটিতে ছুটিতে
সহসা নিমেষে কার ইঙ্গিতে
সিংহদুয়ার থামিল চকিতে
          আশি সহস্র সৈন্য?
 
ব্রাহ্মণ আসি দাঁড়ালো সমুখে
          ন্যায়াধীশ রামশাস্ত্রী।
দুই বাহু তাঁর তুলিয়া উধাও
কহিলেন ডাকি, "রঘুনাথ রাও,
নগর ছাড়িয়া কোথা চলে যাও,
          না লয়ে পাপের শাস্তি?’
 
নীরব হইল জয়কোলাহল,
          নীরব সমরবাদ্য।
"প্রভু, কেন আজি’ কহে রঘুনাথ,
"অ্যাসময়ে পথ রুধিলে হঠাৎ!
চলেছি করিতে যবননিপাত,
          জোগাতে যমের খাদ্য।’
 
কহিলা শাস্ত্রী, "বধিয়াছ তুমি
          আপন ভ্রাতার পুত্রে।
বিচার তাহার না হয় য’দিন
ততকাল তুমি নহ তো স্বাধীন,
বন্দী রয়েছ অ্যামোঘ কঠিন
          ন্যায়ের বিধানসূত্রে।’
 
রুষিয়া উঠিলা রঘুনাথ রাও,
          কহিলা করিয়া হাস্য,
"নৃপতি কাহারো বাঁধন না মানে–
চলেছি দীপ্ত মুক্ত কৃপাণে,
শুনিতে আসি নি পথমাঝখানে
          ন্যায়বিধানের ভাষ্য।’
 
কহিলা শাস্ত্রী, "রঘুনাথ রাও,
          যাও করো গিয়ে যুদ্ধ!
আমিও দণ্ড ছাড়িনু এবার,
ফিরিয়া চলিনু গ্রামে আপনার,
বিচারশালার খেলাঘরে আর
          না রহিব অ্যাবরুদ্ধ।’
 
বাজিল শঙ্খ, বাজিল ডঙ্ক,
          সেনানী ধাইল ক্ষিপ্র।
ছাড়ি দিয়া গেলা গৌরবপদ,
দূরে ফেলি দিলা সব সম্পদ,
গ্রামের কুটিরে চলি গেলা ফিরে
          দীন দরিদ্র বিপ্র।      
    
পণরক্ষা
কথা ও কাহিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
"মারাঠা দস্যু আসিছে রে ওই,
          করো করো সবে সাজ’
আজমীর গড়ে কহিলা হাঁকিয়া
          দুর্গেশ দুমরাজ।
বেলা দু’পহরে যে যাহার ঘরে
          সেঁকিছে জোয়ারি রুটি,
দুর্গতোরণে নাকাড়া বাজিছে                
          বাহিরে আসিল ছুটি।
প্রাকারে চড়িয়া দেখিল চাহিয়া
          দক্ষিণে বহু দূরে
আকাশ জুড়িয়া উড়িয়াছে ধুলা
          মারাঠি অশ্বখুরে।
"মারাঠার যত পতঙ্গপাল
          কৃপাণ-অনলে আজ
ঝাঁপ দিয়া পড়ি ফিরে নাকো যেন’
          গর্জিলা দুমরাজ।
 
মাড়োয়ার হতে দূত আসি বলে,
          "বৃথা এ সৈন্যসাজ,
হেরো এ প্রভুর আদেশপত্র
          দুর্গেশ দুমরাজ!
সিন্দে আসিছে, সঙ্গে তাঁহার
          ফিরিঙ্গি সেনাপতি–
সাদরে তাঁদের ছাড়িবে দুর্গ
          আজ্ঞা তোমার প্রতি।
বিজয়লক্ষ্মী হয়েছে বিমুখ
          বিজয়সিংহ-’পরে–
বিনা সংগ্রামে আজমীর গড়
          দিবে মারাঠার করে।’
"প্রভুর আদেশে বীরের ধর্মে
          বিরোধ বাধিল আজ’
নিশ্বাস ফেলি কহিলা কাতরে
          দুর্গেশ দুমরাজ।
 
মাড়োয়ার-দূত করিল ঘোষণা,
          "ছাড়ো ছাড়ো রণসাজ।’
রহিল পাষাণ-মুরতি-সমান
          দুর্গেশ দুমরাজ।
বেলা যায় যায়, ধূ ধূ করে মাঠ,
          দূরে দূরে চরে ধেনু–
তরুতলছায়ে সকরুণ রবে
          বাজে রাখালের বেণু।
"আজমীর গড় দিলা যবে মোরে
          পণ করিলাম মনে,
প্রভুর দুর্গ শত্রুর করে
          ছাড়িব না এ জীবনে।
প্রভুর আদেশে সে সত্য হায়
          ভাঙিতে হবে কি আজ!’
এতেক ভাবিয়া ফেলে নিশ্বাস
          দুর্গেশ দুমরাজ।
 
রাজপুত সেনা সরোষে শরমে
          ছাড়িল সমর-সাজ।
নীরবে দাঁড়ায়ে রহিল তোরণে
          দুর্গেশ দুমরাজ।
গেরুয়া-বসনা সন্ধ্যা নামিল
          পশ্চিম মাঠ-পারে;
মারাঠি সৈন্য ধুলা উড়াইয়া      
          থামিল দুর্গদ্বারে।
"দুয়ারের কাছে কে ওই শয়ান,
          ওঠো ওঠো, খোলো দ্বার।’
নাহি শোনে কেহ–প্রাণহীন দেহ
          সাড়া নাহি দিল আর।
প্রভুর কর্মে বীরের ধর্মে
          বিরোধ মিটাতে আজ
দুর্গদুয়ারে ত্যজিয়াছে প্রাণ
          দুর্গেশ দুমরাজ।