পুনশ্চ
গীতাঞ্জলির গানগুলি ইংরেজি গদ্যে অনুবাদ করেছিলেম। এই অনুবাদ কাব্যশ্রেণীতে গণ্য হয়েছে। সেই অবধি আমার মনে এই প্রশ্ন ছিল যে, পদ্যছন্দের সুস্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজিরই মতো বাংলা গদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কি না। মনে আছে সত্যেন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেম। তিনি স্বীকার করেছিলেন, কিন্তু চেষ্টা করেন নি। তখন আমি নিজেই পরীক্ষা করেছি, ‘লিপিকা’র অল্প কয়েকটি লেখায় সেগুলি আছে। ছাপবার সময় বাক্যগুলিকে পদ্যের মতো খণ্ডিত করা হয় নি, বোধ করি ভীরুতাই তার কারণ।
তার পরে আমার অনুরোধক্রমে একবার অবনীন্দ্রনাথ এই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। আমার মত এই যে, তাঁর লেখাগুলি কাব্যের সীমার মধ্যে এসেছিল, কেবল ভাষাবাহুল্যের জন্যে তাতে পরিমাণ রক্ষা হয় নি। আর-একবার আমি সেই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়েছি।
এই উপলক্ষে একটা কথা বলবার আছে। গদ্যকাব্যে অতিনিরূপিত ছন্দের বন্ধন ভাঙাই যথেষ্ট নয়, পদ্যকাব্যে ভাষায় ও প্রকাশরীতিতে যে একটি সসজ্জ সলজ্জ অবগুণ্ঠনপ্রথা আছে তাও দূর করলে তবেই গদ্যের স্বাধীন ক্ষেত্রে তার সঞ্চরণ স্বাভাবিক হতে পারে। অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেক দূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব, এই আমার বিশ্বাস এবং সেই দিকে লক্ষ রেখে এই গ্রন্থে প্রকাশিত কবিতাগুলি লিখেছি। এর মধ্যে কয়েকটি কবিতা আছে তাতে মিল নেই, পদ্যছন্দ আছে, কিন্তু পদ্যের বিশেষ ভাষারীতি ত্যাগ করবার চেষ্টা করেছি। যেমন, তরে, সনে, মোর, প্রভৃতি যে-সকল শব্দ গদ্যে ব্যবহার হয় না সেগুলিকে এই-সকল কবিতায় স্থান দিই নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পুনশ্চ
পদ্মা কোথায় চলেছে দূর আকাশের তলায়, মনে মনে দেখি তাকে। এক পারে বালুর চর, নির্ভীক কেননা নিঃস্ব, নিরাসক্ত— অন্য পারে বাঁশবন, আমবন, পুরোনো বট, পোড়ো ভিটে, অনেক দিনের গুঁড়ি-মোটা কাঁঠালগাছ— পুকুরের ধারে সর্ষেক্ষেত, পথের ধারে বেতের জঙ্গল, দেড়শো বছর আগেকার নীলকুঠির ভাঙা ভিত, তার বাগানে দীর্ঘ ঝাউগাছে দিনরাত মর্মরধ্বনি। ঐখানে রাজবংশীদের পাড়া, ফাটল-ধরা ক্ষেতে ওদের ছাগল চরে, হাটের কাছে টিনের-ছাদ-ওয়ালা গঞ্জ— সমস্ত গ্রাম নির্মম নদীর ভয়ে কম্পান্বিত। পুরাণে প্রসিদ্ধ এই নদীর নাম, মন্দাকিনীর প্রবাহ ওর নাড়ীতে। ও স্বতন্ত্র। লোকালয়ের পাশ দিয়ে চলে যায়— তাদের সহ্য করে, স্বীকার করে না। বিশুদ্ধ তার আভিজাতিক ছন্দে এক দিকে নির্জন পর্বতের স্মৃতি, আর-এক দিকে নিঃসঙ্গ সমুদ্রের আহ্বান। একদিন ছিলেম ওরই চরের ঘাটে, নিভৃতে, সবার হতে বহু দূরে। ভোরের শুকতারাকে দেখে জেগেছি, ঘুমিয়েছি রাতে সপ্তর্ষির দৃষ্টির সম্মুখে নৌকার ছাদের উপর। আমার একলা দিন-রাতের নানা ভাবনার ধারে ধারে চলে গেছে ওর উদাসীন ধারা— পথিক যেমন চলে যায় গৃহস্থের সুখদুঃখের পাশ দিয়ে অথচ দূর দিয়ে। তার পরে যৌবনের শেষে এসেছি তরুবিরল এই মাঠের প্রান্তে। ছায়াবৃত সাঁওতাল-পাড়ার পুঞ্জিত সবুজ দেখা যায় অদূরে। এখানে আমার প্রতিবেশিনী কোপাই নদী। প্রাচীন গোত্রের গরিমা নেই তার। অনার্য তার নামখানি কতকালের সাঁওতাল নারীর হাস্যমুখর কলভাষার সঙ্গে জড়িত। গ্রামের সঙ্গে তার গলাগলি, স্থলের সঙ্গে জলের নেই বিরোধ। তার এ পারের সঙ্গে ও পারের কথা চলে সহজে। শনের খেতে ফুল ধরেছে একেবারে তার গায়ে গায়ে, জেগে উঠেছে কচি কচি ধানের চারা। রাস্তা যেখানে থেমেছে তীরে এসে সেখানে ও পথিককে দেয় পথ ছেড়ে— কলকল স্ফটিকস্বচ্ছ স্রোতের উপর দিয়ে। অদূরে তালগাছ উঠেছে মাঠের মধ্যে, তীরে আম জাম আমলকীর ঘেঁষাঘেঁষি। ওর ভাষা গৃহস্থপাড়ার ভাষা— তাকে সাধুভাষা বলে না। জল স্থল বাঁধা পড়েছে ওর ছন্দে, রেষারেষি নেই তরলে শ্যামলে। ছিপ্ছিপে ওর দেহটি বেঁকে বেঁকে চলে ছায়ায় আলোয় হাততালি দিয়ে সহজ নাচে। বর্ষায় ওর অঙ্গে অঙ্গে লাগে মাৎলামি মহুয়া-মাতাল গাঁয়ের মেয়ের মতো— ভাঙে না, ডোবায় না, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আবর্তের ঘাঘরা দুই তীরকে ঠেলা দিয়ে দিয়ে উচ্চ হেসে ধেয়ে চলে। শরতের শেষে স্বচ্ছ হয়ে আসে জল, ক্ষীণ হয় তার ধারা, তলার বালি চোখে পড়ে, তখন শীর্ণ সমারোহের পাণ্ডুরতা তাকে তো লজ্জা দিতে পারে না। তার ধন নয় উদ্ধত, তার দৈন্য নয় মলিন, এ দুইয়েই তার শোভা; যেমন নটী যখন অলংকারের ঝংকার দিয়ে নাচে আর যখন সে নীরবে বসে থাকে ক্লান্ত হয়ে— চোখের চাহনিতে আলস্য, একটুখানি হাসির আভাস ঠোঁটের কোণে। কোপাই, আজ কবির ছন্দকে আপন সাথি ক’রে নিলে, সেই ছন্দের আপোষ হয়ে গেল ভাষার স্থলে জলে— যেখানে ভাষার গান আর যেখানে ভাষার গৃহস্থালি। তার ভাঙা তালে হেঁটে চলে যাবে ধনুক হাতে সাঁওতাল ছেলে; পার হয়ে যাবে গোরুর গাড়ি আঁঠি আঁঠি খড় বোঝাই ক’রে; হাটে যাবে কুমোর বাঁকে ক’রে হাঁড়ি নিয়ে; পিছন পিছন যাবে গাঁয়ের কুকুরটা; আর, মাসিক তিন টাকা মাইনের গুরু ছেঁড়া ছাতি মাথায়।
পুনশ্চ
নাটক লিখেছি একটি। বিষয়টা কী বলি। অর্জুন গিয়েছেন স্বর্গে, ইন্দ্রের অতিথি তিনি নন্দনবনে। উর্বশী গেলেন মন্দারের মালা হাতে তাঁকে বরণ করবেন ব’লে। অর্জুন বললেন, “দেবী, তুমি দেবলোকবাসিনী, অতিসম্পূর্ণ তোমার মহিমা, অনিন্দিত তোমার মাধুরী, প্রণতি করি তোমাকে। তোমার মালা দেবতার সেবার জন্যে।” উর্বশী বললেন, “কোনো অভাব নেই দেবলোকের, নেই তার পিপাসা। সে জানেই না চাইতে, তবে কেন আমি হলেম সুন্দর! তার মধ্যে মন্দ নেই, তবে ভালো হওয়া কার জন্যে! আমার মালার মূল্য নেই তার গলায়। মর্তকে প্রয়োজন আমার, আমাকে প্রয়োজন মর্তের। তাই এসেছি তোমার কাছে, তোমার আকাঙ্ক্ষা দিয়ে করো আমাকে বরণ, দেবলোকের দুর্লভ সেই আকাঙ্ক্ষা মর্তের সেই অমৃত-অশ্রুর ধারা।” ভালো হয়েছে আমার লেখা। ‘ভালো হয়েছে’ কথাটা কেটে দেব কি চিঠি থেকে? কেন, দোষ হয়েছে কী? সত্য কথাই বেরিয়েছে কলমের মুখে। আশ্চর্য হয়েছ আমার অবিনয়ে, বলছ, “ভালো যে হয়েইছে জানলে কী ক’রে?” আমার উত্তর এই, নিশ্চিত নাই বা জানলেম। এক কালের ভালোটা হয়তো হবে না অন্য কালের ভালো। তাই তো এক নিশ্বাসে বলতে পারি ‘ভালো হয়েছে’। চিরকালের সত্য নিয়ে কথা হত যদি চুপ করে থাকতেম ভয়ে। কত লিখেছি কতদিন, মনে মনে বলেছি ‘খুব ভালো’। আজ পরম শত্রুর নামে পারতেম যদি সেগুলো চালাতে খুশি হতেম তবে। এ লেখারও একদিন হয়তো হবে সেই দশা— সেইজন্যেই, দোহাই তোমার, অসংকোচে বলতে দাও আজকের মতো— এ লেখা হয়েছে ভালো। এইখানটায় একটুখানি তন্দ্রা এল। হঠাৎ-বর্ষণে চারি দিক থেকে ঘোলা জলের ধারা যেমন নেমে আসে, সেইরকমটা। তবু ঝেঁকে ঝেঁকে উঠে টলমল ক’রে কলম চলছে, যেমনটা হয় মদ খেয়ে নাচতে গেলে। তবু শেষ করব এ চিঠি, কুয়াশার ভিতর দিয়েও জাহাজ যেমন চলে, কল বন্ধ করে না। বিষয়টা হচ্ছে আমার নাটক। বন্ধুদের ফর্মাশ, ভাষা হওয়া চাই অমিত্রাক্ষর। আমি লিখেছি গদ্যে। পদ্য হল সমুদ্র, সাহিত্যের আদিযুগের সৃষ্টি। তার বৈচিত্র্য ছন্দতরঙ্গে, কলকল্লোলে! গদ্য এল অনেক পরে। বাঁধা ছন্দের বাইরে জমালো আসর। সুশ্রী-কুশ্রী ভালো-মন্দ তার আঙিনায় এল ঠেলাঠেলি করে। ছেঁড়া কাঁথা আর শাল-দোশালা এল জড়িয়ে মিশিয়ে। সুরে বেসুরে ঝনাঝন্ ঝংকার লাগিয়ে দিল। গর্জনে ও গানে, তাণ্ডবে ও তরল তালে আকাশে উঠে পড়ল গদ্যবাণীর মহাদেশ। কখনো ছাড়লে অগ্নিনিশ্বাস, কখনো ঝরালে জলপ্রপাত। কোথাও তার সমতল, কোথাও অসমতল; কোথাও দুর্গম অরণ্য, কোথাও মরুভূমি। একে অধিকার যে করবে তার চাই রাজপ্রতাপ; পতন বাঁচিয়ে শিখতে হবে এর নানারকম গতি অবগতি। বাইরে থেকে এ ভাসিয়ে দেয় না স্রোতের বেগে, অন্তরে জাগাতে হয় ছন্দ গুরু লঘু নানা ভঙ্গিতে। সেই গদ্যে লিখেছি আমার নাটক, এতে চিরকালের স্তব্ধতা আছে আর চলতি কালের চাঞ্চল্য।
পুনশ্চ
আমাদের কালে গোষ্ঠে যখন সাঙ্গ হল সকালবেলার প্রথম দোহন, ভোরবেলাকার ব্যাপারিরা চুকিয়ে দিয়ে গেল প্রথম কেনাবেচা, তখন কাঁচা রৌদ্রে বেরিয়েছি রাস্তায়, ঝুড়ি হাতে হেঁকেছি আমার কাঁচা ফল নিয়ে— তাতে কিছু হয়তো ধরেছিল রঙ, পাক ধরে নি। তার পর প্রহরে প্রহরে ফিরেছি পথে পথে; কত লোক কত বললে, কত নিলে, কত ফিরিয়ে দিলে, ভোগ করলে দাম দিলে না সেও কত লোক— সেকালের দিন হল সারা। কাল আপন পায়ের চিহ্ন যায় মুছে মুছে, স্মৃতির বোঝা আমরাই বা জমাই কেন, এক দিনের দায় টানি কেন আর-এক দিনের ’পরে, দেনাপাওনা চুকিয়ে দিয়ে হাতে হাতে ছুটি নিয়ে যাই-না কেন সামনের দিকে চেয়ে? সেদিনকার উদ্বৃত্ত নিয়ে নূতন কারবার জমবে না তা নিলেম মেনে। তাতে কী বা আসে যায়! দিনের পর দিন পৃথিবীর বাসাভাড়া দিতে হয় নগদ মিটিয়ে— তার পর শেষ দিনে দখলের জোর জানিয়ে তালা বন্ধ করবার ব্যর্থ প্রয়াস, কেন সেই মূঢ়তা? তাই, প্রথম ঘণ্টা বাজল যেই বেরিয়েছিলেম হিসেব চুকিয়ে দিয়ে। দরজার কাছ পর্যন্ত এসে যখন ফিরে তাকাই তখন দেখি, তুমি যে আছ এ কালের আঙিনায় দাঁড়িয়ে। তোমার সঙ্গীরা একদিন যখন হেঁকে বলবে আর আমাকে নেই প্রয়োজন, তখন ব্যথা লাগবে তোমারই মনে এই আমার ছিল ভয়— এই আমার ছিল আশা। যাচাই করতে আস নি তুমি— তুমি দিলে গ্রন্থি বেঁধে তোমার কালে আমার কালে হৃদয় দিয়ে। দেখলেম ঐ বড়ো বড়ো চোখের দিকে তাকিয়ে, করুণ প্রত্যাশা তো এখনো তার পাতায় আছে লেগে। তাই ফিরে আসতে হল আর-একবার। দিনের শেষে নতুন পালা আবার করেছি শুরু তোমারই মুখ চেয়ে, ভালোবাসার দোহাই মেনে। আমার বাণীকে দিলেম সাজ পরিয়ে তোমাদের বাণীর অলংকারে; তাকে রেখে দিয়ে গেলেম পথের ধারে পান্থশালায়, পথিক বন্ধু, তোমারি কথা মনে ক’রে। যেন সময় হলে একদিন বলতে পারো মিটল তোমাদেরও প্রয়োজন, লাগল তোমাদেরও মনে। দশ জনের খ্যাতির দিকে হাত বাড়াবার দিন নেই আমার। কিন্তু, তুমি আমাকে বিশ্বাস করেছিলে প্রাণের টানে। সেই বিশ্বাসকে কিছু পাথেয় দিয়ে যাব এই ইচ্ছা। যেন গর্ব করে বলতে পার আমি তোমাদেরও বটে, এই বেদনা মনে নিয়ে নেমেছি এই কালে— এমন সময় পিছন ফিরে দেখি তুমি নেই। তুমি গেলে সেইখানেই যেখানে আমার পুরোনো কাল অবগুণ্ঠিত মুখে চলে গেল; যেখানে পুরাতনের গান রয়েছে চিরন্তন হয়ে। আর, একলা আমি আজও এই নতুনের ভিড়ে বেড়াই ধাক্কা খেয়ে, যেখানে আজ আছে কাল নেই।
পুনশ্চ
পশ্চিমে বাগান বন চষা-ক্ষেত মিলে গেছে দূর বনান্তে বেগনি বাষ্পরেখায়; মাঝে আম জাম তাল তেঁতুলে ঢাকা সাঁওতাল-পাড়া; পাশ দিয়ে ছায়াহীন দীর্ঘ পথ গেছে বেঁকে রাঙা পাড় যেন সবুজ শাড়ির প্রান্তে কুটিল রেখায়। হঠাৎ উঠেছে এক-একটা যূথভ্রষ্ট তালগাছ দিশাহারা অনির্দিষ্টকে যেন দিক দেখাবার ব্যাকুলতা। পৃথিবীর একটানা সবুজ উত্তরীয়, তারই এক ধারে ছেদ পড়েছে উত্তর দিকে, মাটি গেছে ক্ষয়ে, দেখা দিয়েছে উর্মিল লাল কাঁকরের নিস্তব্ধ তোলপাড়; মাঝে মাঝে মর্চে-ধরা কালো মাটি মহিষাসুরের মুণ্ড যেন। পৃথিবী আপনার একটি কোণের প্রাঙ্গণে বর্ষাধারার আঘাতে বানিয়েছে ছোটো ছোটো অখ্যাত খেলার পাহাড়, বয়ে চলেছে তার তলায় তলায় নামহীন খেলার নদী। শরৎকালে পশ্চিম আকাশে সূর্যাস্তের ক্ষণিক সমারোহে রঙের সঙ্গে রঙের ঠেলাঠেলি— তখন পৃথিবীর এই ধূসর ছেলেমানুষির উপরে দেখেছি সেই মহিমা যা একদিন পড়েছে আমার চোখে দুর্লভ দিনাবসানে রোহিতসমুদ্রের তীরে তীরে জনশূন্য তরুহীন পর্বতের রক্তবর্ণ শিখরশ্রেণীতে, রুষ্টরুদ্রের প্রলয়ভ্রূকুঞ্চনের মতো। এই পথে ধেয়ে এসেছে কালবৈশাখীর ঝড় গেরুয়া পতাকা উড়িয়ে ঘোড়সওয়ার বর্গিসৈন্যের মতো— কাঁপিয়ে দিয়েছে শাল সেগুনকে, নুইয়ে দিয়েছে ঝাউয়ের মাথা, ‘হায়-হায়’ রব তুলেছে বাঁশের বনে, কলাবাগানে করেছে দুঃশাসনের দৌরাত্ম্য। ক্রন্দিত আকাশের নীচে ঐ ধূসরবন্ধুর কাঁকরের স্তূপগুলো দেখে মনে হয়েছে লাল সমুদ্রে তুফান উঠল, ছিটকে পড়ছে তার শীকরবিন্দু। এসেছিনু বালককালে। ওখানে গুহাগহ্বরে ঝির্ ঝির্ ঝর্নার ধারায় রচনা করেছি মন-গড়া রহস্যকথা, খেলেছি নুড়ি সাজিয়ে নির্জন দুপুর বেলায় আপন-মনে একলা। তার পরে অনেক দিন হল, পাথরের উপর নির্ঝরের মতো আমার উপর দিয়ে বয়ে গেল অনেক বৎসর। রচনা করতে বসেছি একটা কাজের রূপ ঐ আকাশের তলায় ভাঙামাটির ধারে, ছেলেবেলায় যেমন রচনা করেছি নুড়ির দুর্গ। এই শালবন, এই একলা-মেজাজের তালগাছ, ঐ সবুজ মাঠের সঙ্গে রাঙামাটির মিতালি, এর পানে অনেক দিন যাদের সঙ্গে দৃষ্টি মিলিয়েছি, যারা মন মিলিয়েছিল এখানকার বাদলদিনে আর আমার বাদলগানে, তারা কেউ আছে কেউ গেল চলে। আমারও যখন শেষ হবে দিনের কাজ, নিশীথরাত্রের তারা ডাক দেবে আকাশের ও পার থেকে— তার পরে? তার পরে রইবে উত্তর দিকে ঐ বুক-ফাটা ধরণীর রক্তিমা, দক্ষিণ দিকে চাষের ক্ষেত, পুব দিকের মাঠে চরবে গোরু, রাঙা মাটির রাস্তা বেয়ে গ্রামের লোক যাবে হাট করতে। পশ্চিমের আকাশপ্রান্তে আঁকা থাকবে একটি নীলাঞ্জনরেখা।
পুনশ্চ
তোমাকে পাঠালুম আমার লেখা, এক-বই-ভরা কবিতা। তারা সবাই ঘেঁষাঘেঁষি দেখা দিল একই সঙ্গে এক খাঁচায়। কাজেই আর সমস্ত পাবে, কেবল পাবে না তাদের মাঝখানের ফাঁকগুলোকে। যে অবকাশের নীল আকাশের আসরে একদিন নামল এসে কবিতা— সেইটেই পড়ে রইল পিছনে। নিশীথরাত্রের তারাগুলি ছিঁড়ে নিয়ে যদি হার গাঁথা যায় ঠেসে, বিশ্ববেনের দোকানে হয়তো সেটা বিকোয় মোটা দামে— তবু রসিকেরা বুঝতে পারে যেন কমতি হল কিসের। যেটা কম পড়ল সেটা ফাঁকা আকাশ— তৌল করা যায় না তাকে, কিন্তু সেটা দরদ দিয়ে ভরা। মনে করো, একটি গান উঠল জেগে নীরব সময়ের বুকের মাঝখানে একটি মাত্র নীলকান্তমণি— তাকে কি দেখতে হবে গয়নার বাক্সের মধ্যে! বিক্রমাদিত্যের সভায় কবিতা শুনিয়েছেন কবি দিনে দিনে। ছাপাখানার দৈত্য তখন কবিতার সময়াকাশকে দেয় নি লেপে কালী মাখিয়ে। হাইড্রলিক জাঁতায়-পেষা কাব্যপিণ্ড তলিয়ে যেত না গলায় এক-এক গ্রাসে, উপভোগটা পুরো অবসরে উঠত রসিয়ে। হায় রে, কানে শোনার কবিতাকে পরানো হল চোখে দেখার শিকল, কবিতার নির্বাসন হল লাইব্রেরিলোকে; নিত্যকালের আদরের ধন পাব্লিশরের হাটে হল নাকাল। উপায় নেই, জটলা-পাকানোর যুগ এটা। কবিতাকে পাঠকের অভিসারে যেতে হয় পটলডাঙার অম্নিবাসে চ’ড়ে। মন বলছে নিশ্বাস ফেলে— ‘আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে’। তুমি যদি হতে বিক্রমাদিত্য— আর, আমি যদি হতেম— কী হবে বলে! জন্মেছি ছাপার কালিদাস হয়ে। তোমরা আধুনিক মালবিকা, কিনে পড় কবিতা আরাম-কেদারায় বসে। চোখ বুজে কান পেতে শোন না; শোনা হলে কবিকে পরিয়ে দাও না বেলফুলের মালা— দোকানে পাঁচ শিকে দিয়েই খালাস।
পুনশ্চ
দোতলার জানলা থেকে চোখে পড়ে পুকুরের একটি কোণা। ভাদ্রমাসে কানায় কানায় জল। জলে গাছের গভীর ছায়া টলটল করছে সবুজ রেশমের আভায়। তীরে তীরে কলমি শাক আর হেলঞ্চ। ঢালু পাড়িতে সুপারি গাছক’টা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এ ধারের ডাঙায় করবী, সাদা রঙন, একটি শিউলি; দুটি অযত্নের রজনীগন্ধায় ফুল ধরেছে গরিবের মতো। বাঁখারি-বাঁধা মেহেদির বেড়া, তার ও পারে কলা পেয়ারা নারকেলের বাগান; আরো দূরে গাছপালার মধ্যে একটা কোঠাবাড়ির ছাদ, উপর থেকে শাড়ি ঝুলছে। মাথায়-ভিজে-চাদর-জড়ানো গা-খোলা মোটা মানুষটি ছিপ ফেলে বসে আছে বাঁধা ঘাটের পৈঁঠাতে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা যায় কেটে। বেলা পড়ে এল। বৃষ্টি-ধোওয়া আকাশ, বিকেলের প্রৌঢ় আলোয় বৈরাগ্যের ম্লানতা। ধীরে ধীরে হাওয়া দিয়েছে, টলমল করছে পুকুরের জল, ঝিল্মিল্ করছে বাতাবিলেবুর পাতা। চেয়ে দেখি আর মনে হয়, এ যেন আর-কোনো-একটা দিনের আবছায়া; আধুনিকের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দূর কালের কার একটি ছবি নিয়ে এল মনে। স্পর্শ তার করুণ, স্নিগ্ধ তার কণ্ঠ, মুগ্ধ সরল তার কালো চোখের দৃষ্টি। তার সাদা শাড়ির রাঙা চওড়া পাড় দুটি পা ঘিরে ঢেকে পড়েছে; সে আঙিনাতে আসন বিছিয়ে দেয়, সে আঁচল দিয়ে ধুলো দেয় মুছিয়ে; সে আম-কাঁঠালের ছায়ায় ছায়ায় জল তুলে আনে, তখন দোয়েল ডাকে সজনের ডালে, ফিঙে লেজ দুলিয়ে বেড়ায় খেজুরের ঝোপে। যখন তার কাছে বিদায় নিয়ে চলে আসি সে ভালো করে কিছুই বলতে পারে না; কপাট অল্প একটু ফাঁক ক’রে পথের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ ঝাপ্সা হয়ে আসে।
পুনশ্চ
তুমি বল, তিনু প্রশ্রয় পায় আমার কাছে— তাই রাগ কর তুমি। ওকে ভালোবাসি, তাই ওকে দুষ্টু বলে দেখি, দোষী ব’লে দেখি নে— রাগও করি ওর ’পরে ভালোও লাগে ওকে এ কথাটা মিছে নয় হয়তো। এক-একজন মানুষ অমন থাকে— সে লোক নেহাত মন্দ নয়, সেইজন্যই সহজে তার মন্দটাই পড়ে ধরা। সে হতভাগা রঙে মন্দ, কিন্তু মন্দ নয় রসে; তার দোষ স্তূপে বেশি, ভারে বেশি নয়; তাই, দেখতে যতটা লাগে গায়ে লাগে না তত। মনটা ওর হালকা ছিপ্ছিপে নৌকো, হূহু করে চলে যায় ভেসে; ভালোই বলো আর মন্দই বলো জমতে দেয় না বেশিক্ষণ— এ পারের বোঝা ও পারে চালান করে দেয় দেখতে দেখতে— ওকে কিছুই চাপ দেয় না, তেমনি ও দেয় না চাপ। স্বভাব ওর আসর-জমানো; কথা কয় বিস্তর, তাই, বিস্তর মিছে বলতে হয়— নইলে ফাঁক পড়ে কথার ঠাস-বুনোনিতে। মিছেটা নয় ওর মনে, সে ওর ভাষায়— ওর ব্যাকরণটা যার জানা তার বুঝতে হয় না দেরি। ওকে তুমি বল নিন্দুক— তা সত্য। সত্যকে বাড়িয়ে তুলে বাঁকিয়ে দিয়ে ও নিন্দে বানায়— যার নিন্দে করে তার মন্দ হবে ব’লে নয়, যারা নিন্দে শোনে তাদের ভালো লাগবে ব’লে। তারা আছে সমস্ত সংসার জুড়ে। তারা নিন্দের নীহারিকা— ও হল নিন্দের তারা, ওর জ্যোতি তাদেরই কাছ থেকে পাওয়া। আসল কথা, ওর বুদ্ধি আছে, নেই বিবেচনা। তাই, ওর অপরাধ নিয়ে হাসি চলে। যারা ভালোমন্দ বিবেচনা করে সূক্ষ্ম তৌলের মাপে তাদের দেখে হাসি যায় বন্ধ হয়ে; তাদের সঙ্গটা ওজনে হয় ভারী, সয় না বেশিক্ষণ; দৈবে তাদের ত্রুটি যদি হয় অসাবধানে, হাঁপ ছেড়ে বাঁচে লোকে। বুঝিয়ে বলি কাকে বলে অবিবেচনা।— মাখন লক্ষ্মীছাড়াটা সংস্কৃতর ক্লাসে চৌকিতে লাগিয়ে রেখেছিল ভুষো; ছাপ লেগেছিল পণ্ডিতমশায়ের জামার পিঠে, সে হেসেছিল, সবাই হেসেছিল পণ্ডিতমশায় ছাড়া। হেড্মাস্টার দিলেন ছেলেটাকে একেবারে তাড়িয়ে; তিনি অত্যন্ত গম্ভীর, তিনি অত্যন্ত বিবেচক। তাঁর ভাবগতিক দেখে হাসি বন্ধ হয়ে যায়। তিনু অপকার করে কিছু না ভেবে, উপকার করে অনায়াসে, কোনোটাই মনে রাখে না। ও ধার নেয়, খেয়াল নেই শোধ করবার; যারা ধার নেয় ওর কাছে পাওনার তলব নেই তাদের দরজায়। মোটের উপর ওরই লোকসান হয় বেশি। তোমাকে আমি বলি, ওকে গাল দিয়ো যা খুশি, আবার হেসো মনে মনে— নইলে ভুল হবে। আমি ওকে দেখি কাছের থেকে, মানুষ ব’লে, ভালো মন্দ পেরিয়ে। তুমি দেখ দূরে ব’সে, বিশেষণের কাঠগড়ায় ওকে খাড়া রেখে। আমি ওকে লাঞ্ছনা দিই তোমার চেয়ে বেশি— ক্ষমা করি তোমার চেয়ে বড়ো ক’রে। সাজা দিই, নির্বাসন দিই নে। ও আমার কাছেই রয়ে গেল, রাগ কোরো না তাই নিয়ে।
পুনশ্চ
আমার বয়সে মনকে বলবার সময় এল– কাজ নিয়ে কোরো না বাড়াবাড়ি ধীরে সুস্থে চলো, যথোচিত পরিমাণে ভুলতে করো শুরু যাতে ফাঁক পড়ে সময়ের মাঝে মাঝে। বয়স যখন অল্প ছিল কর্তব্যের বেড়ায় ফাঁক ছিল যেখানে সেখানে। তখন যেমন-খুশির ব্রজধামে ছিল বালগোপালের লীলা। মথুরার পালা এল মাঝে, কর্তব্যের রাজাসনে। আজ আমার মন ফিরেছে সেই কাজ-ভোলার অসাবধানে। কী কী আছে দিনের দাবি পাছে সেটা যাই এড়িয়ে বন্ধু তার ফর্দ রেখে যায় টেবিলে। ফর্দটাও দেখতে ভুলি, টেবিলে এসেও বসা হয় না– এম্নিতরো ঢিলে অবস্থা। গরম পড়েছে ফর্দে এটা না ধরলেও মনে আনতে বাধে না। পাখা কোথায়, কোথায় দার্জিলিঙের টাইম-টেবিলটা, –এমনতরো হাঁপিয়ে ওঠবার ইশারা ছিল থার্মোমিটারে। তবু ছিলেম স্থির হয়ে। বেলা দুপুর, আকাশ ঝাঁ ঝাঁ করছে, ধূ ধূ করছে মাঠ, তপ্ত বালু উড়ে যায় হূহু করে– খেয়াল হয় না। বনমালী ভাবে দরজা বন্ধ করাটা ভদ্রঘরের কায়দা– দিই তাকে এক ধমক। পশ্চিমের সাশির ভিতর দিয়ে রোদ ছড়িয়ে পড়ে পায়ের কাছে। বেলা যখন চারটে বেহারা এসে খবর নেয়, চিট্ঠি? হাত উলটিয়ে বলি, নাঃ। ক্ষণকালের জন্য খটকা লাগে চিঠি লেখা উচিত ছিল– ক্ষণকালটা যায় পেরিয়ে, ডাকের সময় যায় তার পিছন পিছন। এ দিকে বাগানে পথের ধারে টগর গন্ধরাজের পুঁজি ফুরোয় না, এরা ঘাটে-জটলা-করা বউদের মতো পরস্পর হাসাহাসি ঠেলাঠেলিতে মাতিয়ে তুলেছে কুঞ্জ আমার। কোকিল ডেকে ডেকে সারা– ইচ্ছে করে তাকে বুঝিয়ে বলি, অত একান্ত জেদ কোরো না বনান্তরের উদাসীনকে মনে রাখবার জন্যে। মাঝে মাঝে ভুলো, মাঝে মাঝে ফাঁক বিছিয়ে রেখো জীবনে; মনে রাখার মানহানি কোরো না তাকে দুঃসহ ক’রে। মনে আনবার অনেক দিন-ক্ষণ আমারো আছে, অনেক কথা, অনেক দুঃখ। তার ফাঁকের ভিতর দিয়েই নতুন বসন্তের হাওয়া আসে রজনীগন্ধার গন্ধে বিষণ্ন হয়ে; তারি ফাঁকের মধ্যে দিয়ে কাঁঠালতলার ঘন ছায়া তপ্ত মাঠের ধারে দূরের বাঁশি বাজায় অশ্রুত মূলতানে। তারি ফাঁকে ফাঁকে দেখি– ছেলেটা ইস্কুল পালিয়ে খেলা করছে হাঁসের বাচ্ছা বুকে চেপে ধ’রে পুকুরের ধারে ঘাটের উপর একলা ব’সে সমস্ত বিকেল বেলাটা। তারি ফাঁকের ভিতর দিয়ে দেখতে পাই লিখছে চিঠি নূতন বধূ, ফেলছে ছিঁড়ে, লিখছে আবার। একটুখানি হাসি দেখা দেয় আমার মুখে, আবার একটুখানি নিশ্বাসও পড়ে।
পুনশ্চ
ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে আমার পোষা হরিণে বাছুরে যেমন ভাব তেমনি ভাব শালবনে আর মহুয়ায়। ওদের পাতা ঝরছে গাছের তলায়, উড়ে পড়ছে আমার জানলাতে। তালগাছটা খাড়া দাঁড়িয়ে পুবের দিকে, সকালবেলাকার বাঁকা রোদ্দুর তারি চোরাই ছায়া ফেলে আমার দেয়ালে। নদীর ধারে ধারে পায়ে-চলা পথ রাঙা মাটির উপর দিয়ে, কুড়চির ফুল ঝরে তার ধুলোয়; বাতাবি-লেবু-ফুলের গন্ধ ঘনিয়ে ধরে বাতাসকে; জারুল পলাশ মাদারে চলেছে রেষারেষি; শজনে ফুলের ঝুরি দুলছে হাওয়ায়; চামেলি লতিয়ে গেছে বেড়ার গায়ে গায়ে ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে। নদীতে নেমেছে ছোটো একটি ঘাট লাল পাথরে বাঁধানো। তারি এক পাশে অনেক কালের চাঁপাগাছ, মোটা তার গুঁড়ি। নদীর উপরে বেঁধেছি একটি সাঁকো, তার দুই পাশে কাঁচের টবে জুঁই বেল রজনীগন্ধা শ্বেতকরবী। গভীর জল মাঝে মাঝে, নীচে দেখা যায় নুড়িগুলি। সেইখানে ভাসে রাজহংস আর ঢালুতটে চরে বেড়ায় আমার পাটল রঙের গাই গোরুটি আর মিশোল রঙের বাছুর ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে। ঘরের মেঝেতে ফিকে নীল রঙের জাজিম পাতা খয়েরিরঙের-ফুল-কাটা। দেয়াল বাসন্তী রঙের, তাতে ঘন কালো রেখার পাড়। একটুখানি বারান্দা পুবের দিকে, সেইখানে বসি সূর্যোদয়ের আগেই। একটি মানুষ পেয়েছি তার গলায় সুর ওঠে ঝলক দিয়ে, নটীর কঙ্কণে আলোর মতো। পাশের কুটিরে সে থাকে, তার চালে উঠেছে ঝুম্কোলতা। আপন মনে সে গায় যখন তখনি পাই শুনতে– গাইতে বলি নে তাকে। স্বামীটি তার লোক ভালো– আমার লেখা ভালোবাসে, ঠাট্টা করলে যথাস্থানে যথোচিত হাসতে জানে, খুব সাধারণ কথা সহজেই পারে কইতে, আবার হঠাৎ কোনো-একদিন আলাপ করে –লোকে যাকে চোখ টিপে বলে কবিত্ব– রাত্রি এগারোটার সময় শালবনে ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে। বাড়ির পিছন দিকটাতে শাক-সবজির খেত। বিঘে-দুয়েক জমিতে হয় ধান। আর আছে আম-কাঁঠালের বাগিচা আস্শেওড়ার-বেড়া-দেওয়া। সকালবেলায় আমার প্রতিবেশিনী গুন্ গুন্ গাইতে গাইতে মাখন তোলে দই থেকে, তার স্বামী যায় দেখতে খেতের কাজ লাল টাট্টু ঘোড়ায় চ’ড়ে। নদীর ও পারে রাস্তা, রাস্তা ছাড়িয়ে ঘন বন– সে দিক থেকে শোনা যায় সাঁওতালের বাঁশি আর শীতকালে সেখানে বেদেরা করে বাসা ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে। এই পর্যন্ত। এ বাসা আমার হয় নি বাঁধা, হবেও না। ময়ূরাক্ষী নদী দেখিও নি কোনো দিন। ওর নামটা শুনি নে কান দিয়ে, নামটা দেখি চোখের উপরে– মনে হয় যেন ঘননীল মায়ার অঞ্জন লাগে চোখের পাতায়। আর মনে হয় আমার মন বসবে না আর কোথাও, সব কিছু থেকে ছুটি নিয়ে চলে যেতে চায় উদাস প্রাণ ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে।
পুনশ্চ
মোটা মোটা কালো মেঘ ক্লান্ত পালোয়ানের দল যেন, সমস্ত রাত বর্ষণের পর আকাশের এক পাশে এসে জমল ঘেঁষাঘেঁষি ক’রে। বাগানের দক্ষিণ সীমায় সেগুন গাছে মঞ্জরীর ঢেউগুলোতে হঠাৎ পড়ল আলো, চমকে উঠল বনের ছায়া। শ্রাবণ মাসের রৌদ্র দেখা দিয়েছে অনাহূত অতিথি, হাসির কোলাহল উঠল গাছে গাছে ডালে-পালায়। রোদ-পোহানো ভাবনাগুলো ভেসে ভেসে বেড়ালো মনের দূর গগনে। বেলা গেল অকাজে। বিকেলে হঠাৎ এল গুরু গুরু ধ্বনি, কার যেন সংকেত। এক মুহূর্তে মেঘের দল বুক ফুলিয়ে হু হু করে ছুটে আসে তাদের কোণ ছেড়ে। বাঁধের জল হয়ে গেল কালো, বটের তলায় নামল থম্থমে অন্ধকার। দূর বনের পাতায় পাতায় বেজে ওঠে ধারাপতনের ভূমিকা। দেখতে দেখতে ঘনবৃষ্টিতে পাণ্ডুর হয়ে আসে সমস্ত আকাশ, মাঠ ভেসে যায় জলে। বুড়ো বুড়ো গাছগুলো আলুথালু মাতামাতি করে ছেলেমানুষের মতো; ধৈর্য থাকে না তালের পাতায়, বাঁশের ডালে। একটু পরেই পালা হল শেষ– আকাশ নিকিয়ে গেল কে। কৃষ্ণপক্ষের কৃশ চাঁদ যেন রোগশয্যা ছেড়ে ক্লান্ত হাসি নিয়ে অঙ্গনে বাহির হয়ে এল। মন বলে, এই আমার যত দেখার টুকরো চাই নে হারাতে। আমার সত্তর বছরের খেয়ায় কত চল্তি মুহূর্ত উঠে বসেছিল, তারা পার হয়ে গেছে অদৃশ্যে। তার মধ্যে দুটি-একটি কুঁড়েমির দিনকে পিছনে রেখে যাব ছন্দে-গাঁথা কুঁড়েমির কারুকাজে, তারা জানিয়ে দেবে আশ্চর্য কথাটি একদিন আমি দেখেছিলেম এই সব-কিছু।
পুনশ্চ
প্লাটিনমের আঙটির মাঝখানে যেন হীরে। আকাশের সীমা ঘিরে মেঘ, মাঝখানের ফাঁক দিয়ে রোদ্দুর আসছে মাঠের উপর। হূহু করে বইছে হাওয়া, পেঁপে গাছগুলোর যেন আতঙ্ক লেগেছে, উত্তরের মাঠে নিমগাছে বেধেছে বিদ্রোহ, তালগাছগুলোর মাথায় বিস্তর বকুনি। বেলা এখন আড়াইটা। ভিজে বনের ঝল্মলে মধ্যাহ্ন উত্তর দক্ষিণের জানলা দিয়ে এসে জুড়ে বসেছে আমার সমস্ত মন। জানি নে কেন মনে হয় এই দিন দূর কালের আর-কোনো একটা দিনের মতো। এরকম দিন মানে না কোনো দায়কে, এর কাছে কিছুই নেই জরুরি, বর্তমানের নোঙর-ছেঁড়া ভেসে-যাওয়া এই দিন। একে দেখছি যে অতীতের মরীচিকা ব’লে সে অতীত কি ছিল কোনো কালে কোনোখানে, সে কি চিরযুগেরই অতীত নয়। প্রেয়সীকে মনে হয় সে আমার জন্মান্তরের জানা– যে কালে স্বর্গ, যে কালে সত্যযুগ, যে কাল সকল কালেরই ধরা-ছোঁওয়ার বাইরে। তেমনি এই-যে সোনায় পান্নায় ছায়ায় আলোয় গাঁথা অবকাশের নেশায় মন্থর আষাঢ়ের দিন বিহ্বল হয়ে আছে মাঠের উপর ওড়না ছড়িয়ে দিয়ে, এর মাধুরীকেও মনে হয় আছে তবু নেই, এ আকাশবীণায় গৌড়সারঙের আলাপ– সে আলাপ আসছে সর্বকালের নেপথ্য থেকে।
পুনশ্চ
ছেলেদের খেলার প্রাঙ্গণ। শুকনো ধুলো, একটি ঘাস উঠতে পায় না। এক ধারে আছে কাঞ্চন গাছ, আপন রঙের মিল পায় না সে কোথাও। দেখে মনে পড়ে আমাদের কালো রিট্রিভার কুকুরটা, সে বাঁধা থাকে কোঠাবাড়ির বারান্দায়। দূরে রান্নাঘরের চার ধারে উঞ্ছবৃত্তির উৎসাহে ঘুরে বেড়ায় দিশি কুকুরগুলো। ঝগড়া করে, মার খায়, আর্তনাদ করে, তবু আছে সুখে নিজেদের স্বভাবে। আমাদের টেডি থেকে থেকে দাঁড়িয়ে ওঠে চঞ্চল হয়ে, সমস্ত গা তার কাঁপতে থাকে, ব্যগ্র চোখে চেয়ে দেখে দক্ষিণের দিকে, ছুটে যেতে চায় ওদের মাঝখানে– ঘেউ ঘেউ ডাকতে থাকে ব্যর্থ আগ্রহে। তেমনি কাঞ্চন গাছ আছে একা দাঁড়িয়ে, আপন শ্যামল পৃথিবীতে নয়, মানুষের-পায়ে-দলা গরিব ধুলোর ’পরে। চেয়ে থাকে দূরের দিকে ঘাসের পটের উপর যেখানে বনের ছবি আঁকা। সেবার বসন্ত এল। কে জানবে হাওয়ার থেকে ওর মজ্জায় কেমন করে কী বেদনা আসে। অদূরে শালবন আকাশে মাথা তুলে মঞ্জরী-ভরা সংকেত জানালে দক্ষিণসাগরতীরের নবীন আগন্তুককে। সেই উচ্ছ্বসিত সবুজ কোলাহলের মধ্যে কোন্ চরম দিনের অদৃশ্য দূত দিল ওর দ্বারে নাড়া, কানে কানে গেল খবর দিয়ে এই- একদিন নামে শেষ আলো, নেচে যায় কচি পাতার শেষ ছেলেখেলার আসরে। দেরি করলে না। তার হাসিমুখের বেদনা ফুটে উঠল ভারে ভারে ফিকে-বেগ্নি ফুলে। পাতা গেল না দেখা– যতই ঝরে, ততই ফোটে, হাতে রাখল না কিছুই। তার সব দান এক বসন্তে দিল উজাড় ক’রে। তার পরে বিদায় নিল এই ধূসর ধূলির উদাসীনতার কাছে।
পুনশ্চ
নাম রেখেছি কোমল গান্ধার, মনে মনে। যদি তার কানে যেত অবাক হয়ে থাকত বসে, বলত হেসে "মানে কী’। মানে কিছুই যায় না বোঝা সেই মানেটাই খাঁটি। কাজ আছে কর্ম আছে সংসারে, ভালো মন্দ অনেক রকম আছে– তাই নিয়ে তার মোটামুটি সবার সঙ্গে চেনাশোনা। পাশের থেকে আমি দেখি বসে বসে কেমন একটি সুর দিয়েছে চার দিকে। আপনাকে ও আপনি জানে না। যেখানে ওর অন্তর্যামীর আসন পাতা সেইখানে তাঁর পায়ের কাছে রয়েছে কোন্ ব্যথা-ধূপের পাত্রখানি। সেখান থেকে ধোঁয়ার আভাস চোখের উপর পড়ে, চাঁদের উপর মেঘের মতো– হাসিকে দেয় একটুখানি ঢেকে। গলার সুরে কী করুণা লাগে ঝাপসা হয়ে। ওর জীবনের তানপুরা যে ওই সুরেতেই বাঁধা, সেই কথাটি ও জানে না। চলায় বলায় সব কাজেতেই ভৈরবী দেয় তান কেন যে তার পাই নে কিনারা। তাই তো আমি নাম দিয়েছি কোমল গান্ধার– যায় না বোঝা যখন চক্ষু তোলে বুকের মধ্যে অমন ক’রে কেন লাগায় চোখের জলের মিড়।
পুনশ্চ
আজ এই বাদলার দিন, এ মেঘদূতের দিন নয়। এ দিন অচলতায় বাঁধা। মেঘ চলছে না, চলছে না হাওয়া, টিপিটিপি বৃষ্টি ঘোমটার মতো পড়ে আছে দিনের মুখের উপর। সময়ে যেন স্রোত নেই, চার দিকে অবারিত আকাশ, অচঞ্চল অবসর। যেদিন মেঘদূত লিখেছেন কবি সেদিন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে নীল পাহাড়ের গায়ে। দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছুটেছে মেঘ, পুবে হাওয়া বয়েছে শ্যামজম্বুবনান্তকে দুলিয়ে দিয়ে। যক্ষনারী বলে উঠেছে, মা গো, পাহাড়সুদ্ধ নিল বুঝি উড়িয়ে। মেঘদূতে উড়ে চলে যাওয়ার বিরহ, দুঃখের ভার পড়ল না তার ’পরে– সেই বিরহে ব্যথার উপর মুক্তি হয়েছে জয়ী। সেদিনকার পৃথিবী জেগে উঠেছিল উচ্ছল ঝরনায়, উদ্বেল নদীস্রোতে, মুখরিত বনহিল্লোলে, তার সঙ্গে দুলে দুলে উঠেছে মন্দাক্রান্তা ছন্দে বিরহীর বাণী। একদা যখন মিলনে ছিল না বাধা তখন ব্যবধান ছিল সমস্ত বিশ্বে, বিচিত্র পৃথিবীর বেষ্টনী পড়ে থাকত নিভৃত বাসরকক্ষের বাইরে। যেদিন এল বিচ্ছেদ সেদিন বাঁধন-ছাড়া দুঃখ বেরোল নদী গিরি অরণ্যের উপর দিয়ে। কোণের কান্না মিলিয়ে গেল পথের উল্লাসে। অবশেষে ব্যথার রূপ দেখা গেল যে কৈলাসে যাত্রা হল শেষ! সেখানে অচল ঐশ্বর্যের মাঝখানে প্রতীক্ষার নিশ্চল বেদনা। অপূর্ণ যখন চলেছে পূর্ণের দিকে তার বিচ্ছেদের যাত্রাপথে আনন্দের নব নব পর্যায়। পরিপূর্ণ অপেক্ষা করছে স্থির হয়ে; নিত্যপুষ্প, নিত্যচন্দ্রালোক, নিত্যই সে একা– সেই তো একান্ত বিরহী। যে অভিসারিকা তারই জয়, আনন্দে সে চলেছে কাঁটা মাড়িয়ে। ভুল বলা হল বুঝি। সেও তো নেই স্থির হয়ে যে পরিপূর্ণ, সে যে বাজায় বাঁশি, প্রতীক্ষার বাঁশি– সুর তার এগিয়ে চলে অন্ধকার পথে। বাঞ্ছিতের আহ্বান আর অভিসারিকার চলা পদে পদে মিলেছে একই তালে। তাই নদী চলেছে যাত্রার ছন্দে, সমুদ্র দুলেছে আহ্বানের সুরে।
পুনশ্চ
পশ্চিমে শহর। তারি দূর কিনারায় নির্জনে দিনের তাপ আগলে আছে একটা অনাদৃত বাড়ি, চারি দিকে চাল পড়েছে ঝুঁকে। ঘরগুলোর মধ্যে চিরকালের ছায়া উপুড় হয়ে পড়ে, আর চিরবন্দী পুরাতনের একটা গন্ধ। মেঝের উপর হলদে জাজিম, ধারে ধারে ছাপ-দেওয়া বন্দুক-ধারী বাঘ-মারা শিকারীর মূর্তি। উত্তর দিকে সিসুগাছের তলা দিয়ে চলেছে সাদা মাটির রাস্তা, উড়ছে ধুলো খররৌদ্রের গায়ে হালকা উড়নির মতো। সামনের চরে গম অড়র ফুটি তরমুজের খেত, দূরে ঝক্মক্ করছে গঙ্গা, তার মাঝে মাঝে গুণ-টানা নৌকো কালির আঁচড়ে আঁকা ছবি যেন। বারান্দায় রুপোর-কাঁকন-পরা ভজিয়া গম ভাঙছে জাঁতায়, গান গাইছে একঘেয়ে সুরে, গির্ধারী দারোয়ান অনেক ক্ষণ ধরে তার পাশে বসে আছে জানি না কিসের ওজরে। বুড়ো নিমগাছের তলায় ইঁদারা, গোরু দিয়ে জল টেনে তোলে মালী, তার কাকুধ্বনিতে মধ্যাহ্ন সকরুণ, তার জলধারায় চঞ্চল ভুট্টার খেত। গরম হাওয়ায় ঝাপসা গন্ধ আসছে আমের বোলের, খবর আসছে মহানিমের মঞ্জরীতে মৌমাছির বসেছে মেলা। অপরাহ্নে শহর থেকে আসে একটি পরবাসী মেয়ে, তাপে কৃশ পাণ্ডুবর্ণ বিষণ্ন তার মুখ, মৃদুস্বরে পড়িয়ে যায় বিদেশী কবির কবিতা। নীল রঙের জীর্ণ চিকের ছায়া-মিশানো অস্পষ্ট আলোয় ভিজে খস্খসের গন্ধের মধ্যে প্রবেশ করে সাগরপারের মানবহৃদয়ের ব্যথা। আমার প্রথমযৌবন খুঁজে বেড়ায় বিদেশী ভাষার মধ্যে আপন ভাষা, প্রজাপতি যেমন ঘুরে বেড়ায় বিলিতি মৌসুমি ফুলের কেয়ারিতে নানা বর্ণের ভিড়ে।
পুনশ্চ
ছেলেটার বয়স হবে বছর দশেক– পরের ঘরে মানুষ। যেমন আগাছা বেড়ে ওঠে ভাঙা বেড়ার ধারে– মালীর যত্ন নেই, আছে আলোক বাতাস বৃষ্টি পোকামাকড় ধুলোবালি– কখনো ছাগলে দেয় মুড়িয়ে, কখনো মাড়িয়ে দেয় গোরুতে– তবু মরতে চায় না, শক্ত হয়ে ওঠে, ডাঁটা হয় মোটা, পাতা হয় চিকন সবুজ। ছেলেটা কুল পাড়তে গিয়ে গাছের থেকে পড়ে, হাড় ভাঙে, বুনো বিষফল খেয়ে ওর ভির্মি লাগে, রথ দেখতে গিয়ে কোথায় যেতে কোথায় যায়, কিছুতেই কিছু হয় না– আধমরা হয়েও বেঁচে ওঠে, হারিয়ে গিয়ে ফিরে আসে কাদা মেখে কাপড় ছিঁড়ে– মার খায় দমাদম, গাল খায় অজস্র– ছাড়া পেলেই আবার দেয় দৌড়। মরা নদীর বাঁকে দাম জমেছে বিস্তর, বক দাঁড়িয়ে থাকে ধারে, দাঁড়কাক বসেছে বৈঁচিগাছের ডালে, আকাশে উড়ে বেড়ায় শঙ্খচিল, বড়ো বড়ো বাঁশ পুঁতে জাল পেতেছে জেলে, বাঁশের ডগায় বসে আছে মাছরাঙা, পাতিহাঁস ডুবে ডুবে গুগলি তোলে। বেলা দুপুর। লোভ হয় জলের ঝিলিমিলি দেখে– তলায় পাতা ছড়িয়ে শেওলাগুলো দুলতে থাকে, মাছগুলো খেলা করে। আরো তলায় আছে নাকি নাগকন্যা? সোনার কাঁকই দিয়ে আঁচড়ায় লম্বা চুল, আঁকাবাঁকা ছায়া তার জলের ঢেউয়ে। ছেলেটার খেয়াল গেল ওইখানে ডুব দিতে– ওই সবুজ স্বচ্ছ জল, সাপের চিকন দেহের মতো। "কী আছে দেখিই-না’ সব তাতে এই তার লোভ। দিল ডুব, দামে গেল জড়িয়ে– চেঁচিয়ে উঠে, খাবি খেয়ে, তলিয়ে গেল কোথায়। ডাঙায় রাখাল চরাচ্ছিল গোরু, জেলেদের ডিঙি নিয়ে টানাটানি করে তুললে তাকে– তখন সে নিঃসাড়। তার পরে অনেক দিন ধরে মনে পড়েছে চোখে কী করে সর্ষেফুল দেখে, আঁধার হয়ে আসে, যে মাকে কচি বেলায় হারিয়েছে তার ছবি জাগে মনে, জ্ঞান যায় মিলিয়ে। ভারি মজা, কী করে মরে সেই মস্ত কথাটা। সাথিকে লোভ দেখিয়ে বলে, "একবার দেখ্-না ডুবে, কোমরে দড়ি বেঁধে, আবার তুলব টেনে।’ ভারি ইচ্ছা করে জানতে ওর কেমন লাগে। সাথি রাজি হয় না; ও রেগে বলে, "ভীতু, ভীতু, ভীতু কোথাকার।’ বক্সিদের ফলের বাগান, সেখানে লুকিয়ে যায় জন্তুর মতো। মার খেয়েছে বিস্তর, জাম খেয়েছে আরো অনেক বেশি। বাড়ির লোকে বলে, "লজ্জা করে না বাঁদর?’ কেন লজ্জা। বক্সিদের খোঁড়া ছেলে তো ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে ফল পাড়ে, ঝুড়ি ভরে নিয়ে যায়, গাছের ডাল যায় ভেঙে, ফল যায় দ’লে– লজ্জা করে না? একদিন পাকড়াশীদের মেজো ছেলে একটা কাঁচ-পরানো চোঙ নিয়ে ওকে বললে, "দেখ্-না ভিতর বাগে।’ দেখল নানা রঙ সাজানো, নাড়া দিলেই নতুন হয়ে ওঠে। বললে, "দে-না ভাই, আমাকে। তোকে দেব আমার ঘষা ঝিনুক, কাঁচা আম ছাড়াবি মজা ক’রে– আর দেব আমের কষির বাঁশি।’ দিল না ওকে। কাজেই চুরি করে আনতে হল। ওর লোভ নেই– ও কিছু রাখতে চায় না, শুধু দেখতে চায় কী আছে ভিতরে। খোদন দাদা কানে মোচড় দিতে দিতে বললে, "চুরি করলি কেন।’ লক্ষ্মীছাড়াটা জবাব করলে, "ও কেন দিল না।’ যেন চুরির আসল দায় পাকড়াশিদের ছেলের। ভয় নেই ঘৃণা নেই ওর দেহটাতে। কোলাব্যাঙ তুলে ধরে খপ ক’রে, বাগানে আছে খোঁটা পোঁতার এক গর্ত, তার মধ্যে সেটা পোষে– পোকামাকড় দেয় খেতে। গুবরে পোকা কাগজের বাক্সোয় এনে রাখে, খেতে দেয় গোবরের গুটি– কেউ ফেলে দিতে গেলে অনর্থ বাধে। ইস্কুলে যায় পকেটে নিয়ে কাঠবিড়ালি। একদিন একটা হেলে সাপ রাখলে মাস্টারের ডেস্কে– ভাবলে, "দেখিই-না কী করে মাস্টারমশায়।’ ডেক্সো খুলেই ভদ্রলোক লাফিয়ে উঠে দিলেন দৌড়– দেখবার মতো দৌড়টা। একটা কুকুর ছিল ওর পোষা, কুলীনজাতের নয়, একেবারে বঙ্গজ। চেহারা প্রায় মনিবেরই মতো, ব্যবহারটাও। অন্ন জুটত না সব সময়ে, গতি ছিল না চুরি ছাড়া– সেই অপকর্মের মুখে তার চতুর্থ পা হয়েছিল খোঁড়া। আর, সেইসঙ্গেই কোন্ কার্যকারণের যোগে শাসনকর্তাদের শসাখেতের বেড়া গিয়েছিল ভেঙে। মনিবের বিছানা ছাড়া কুকুরটার ঘুম হত না রাতে, তাকে নইলে মনিবেরও সেই দশা। একদিন প্রতিবেশীর বাড়া ভাতে মুখ দিতে গিয়ে তার দেহান্তর ঘটল। মরণান্তিক দুঃখেও কোনোদিন জল বেরোয় নি যে ছেলের চোখে দু দিন সে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদে কেঁদে বেড়ালো, মুখে অন্নজল রুচল না, বক্সিদের বাগানে পেকেছে করম্চা– চুরি করতে উৎসাহ হল না। সেই প্রতিবেশীদের ভাগ্নে ছিল সাত বছরের, তার মাথার উপর চাপিয়ে দিয়ে এল এক ভাঙা হাঁড়ি। হাঁড়ি-চাপা তার কান্না শোনালো যেন ঘানিকলের বাঁশি। গেরস্তঘরে ঢুকলেই সবাই তাকে "দূর দূর’ করে, কেবল তাকে ডেকে এনে দুধ খাওয়ায় সিধু গয়লানী। তার ছেলেটি মরে গেছে সাত বছর হল, বয়সে ওর সঙ্গে তিন দিনের তফাত। ওরই মতো কালোকোলো, নাকটা ওইরকম চ্যাপ্টা। ছেলেটার নতুন নতুন দৌরাত্মি এই গয়লানী মাসীর ’পরে। তার বাঁধা গোরুর দড়ি দেয় কেটে, তার ভাঁড় রাখে লুকিয়ে, খয়েরের রঙ লাগিয়ে দেয় তার কাপড়ে। "দেখি-না কী হয়’ তারই বিবিধ-রকম পরীক্ষা। তার উপদ্রবে গয়লানীর স্নেহ ওঠে ঢেউ খেলিয়ে। তার হয়ে কেউ শাসন করতে এলে সে পক্ষ নেয় ওই ছেলেটারই। অম্বিকে মাস্টার আমার কাছে দুঃখ ক’রে গেল, "শিশুপাঠে আপনার লেখা কবিতাগুলো পড়তে ওর মন লাগে না কিছুতেই, এমন নিরেট বুদ্ধি। পাতাগুলো দুষ্টুমি ক’রে কেটে রেখে দেয়, বলে ইঁদুরে কেটেছে। এতবড়ো বাঁদর।’ আমি বললুম, "সে ত্রুটি আমারই, থাকত ওর নিজের জগতের কবি তা হলে গুবরে পোকা এত স্পষ্ট হত তার ছন্দে ও ছাড়তে পারত না। কোনোদিন ব্যাঙের খাঁটি কথাটি কি পেরেছি লিখতে, আর সেই নেড়ি কুকুরের ট্রাজেডি।’
পুনশ্চ
সুশ্রী নয় এমন লোকের অভাব নেই জগতে– এ মানুষটি তার চেয়েও বেশি, এ অদ্ভুত। খাপছাড়া টাক সামনের মাথায়, ফুর্ফুরে চুল কোথাও সাদা কোথাও কালো। ছোটো ছোটো দুই চোখে নেই রোঁওয়া, ভ্রূ কুঁচকিয়ে কী দেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, তার দেখাটা যেন চোখের উঞ্ছবৃত্তি। যেমন উঁচু তেমনি চওড়া নাকটা, সমস্ত মুখের সে বারো-আনি অংশীদার। কপালটা মস্ত– তার উত্তর দিগন্তে নেই চুল, দক্ষিণ দিগন্তে নেই ভুরু। দাড়ি-গোঁফ-কামানো মুখে অনাবৃত হয়েছে বিধাতার শিল্পরচনার অবহেলা। কোথায় অলক্ষ্যে পড়ে আছে আল্পিন টেবিলের কোণে, তুলে নিয়ে সে বিঁধিয়ে রাখে জামায়– তাই দেখে মুখ ফিরিয়ে মুচকে হাসে জাহাজের মেয়েরা; পার্সেল-বাঁধা টুকরো ফিতেটা সংগ্রহ করে মেঝের থেকে, গুটিয়ে গুটিয়ে তাতে লাগায় গ্রন্থি; ফেলে-দেওয়া খবরের কাগজ ভাঁজ করে রাখে টেবিলে। আহারে অত্যন্ত সাবধান– পকেটে থাকে হজমি গুঁড়ো, খেতে বসেই সেটা খায় জলে মিশিয়ে, খাওয়ার শেষে খায় হজমি বড়ি। স্বল্পভাষী, কথা যায় বেধে– যা বলে মনে হয় বোকার মতো। ওর সঙ্গে যখন কেউ পলিটিক্স্ বলে বুঝিয়ে বলে অনেক ক’রে– ও থাকে চুপচাপ, কিছু বুঝল কি না বোঝা যায় না। চলেছি একসঙ্গে সাত দিন এক জাহাজে। অকারণে সকলে বিরক্ত ওর ’পরে, ওকে ব্যঙ্গ করে আঁকে ছবি, হাসে তাই নিয়ে পরস্পর। ওর নামে অত্যুক্তি বেড়ে চলেছে কেবলই, ওকে দিনে দিনে মুখে মুখে রচনা করে তুলছে সবাই। বিধির রচনায় ফাঁক থাকে, থাকে কোথাও কোথাও অস্ফুটতা। এরা ভরিয়ে তোলে এদের রচনা দৈনিক রাবিশ দিয়ে, খাঁটি সত্যের মতো চেহারা হয়, নিজেরা বিশ্বাস করে। সবাই ঠিক করে রেখেছে ও দালাল, কেউ বা বলে রবারের কুঠির মেজো ম্যানেজার; বাজি রাখা চলছে আন্দাজ নিয়ে। সবাই ওকে পাশ কাটিয়ে চলে, সেটা ওর সয়ে গেছে আগে থাকতেই। চুরোট খাওয়ার ঘরে জুয়ো খেলে যাত্রীরা, ও তাদের এড়িয়ে চলে যায়, তারা ওকে গাল দেয় মনে মনে– বলে কৃপণ, বলে ছোটোলোক। ও মেশে চাটগাঁয়ের খালাসিদের সঙ্গে। তারা কয় তাদের ভাষায়, ও বলে কী ভাষা কে জানে– বোধ করি ওলন্দাজি। সকালে রবারের নল নিয়ে তারা ডেক ধোয়, ও তাদের মধ্যে গিয়ে লাফালাফি করে, তারা হাসে। ওদের মধ্যে ছিল এক অল্প বয়সের ছেলে– শামলা রঙ, কালো চোখ, ঝাঁকড়া চুল, ছিপ্ছিপে গড়ন– ও তাকে এনে দেয় আপেল কমলালেবু, তাকে দেখায় ছবির বই। যাত্রীরা রাগ করে য়ুরোপের অসম্মানে। জাহাজ এল শিঙাপুরে। খালাসিদের ডেকে ও তাদের দিল সিগারেট, আর দশটা করে টাকার নোট। ছেলেটাকে দিলে একটা সোনা-বাঁধানো ছড়ি। কাপ্তেনের কাছে বিদায় নিয়ে তড়্বড়্ করে নেমে গেল ঘাটে। তখন তার আসল নাম হয়ে গেল জানাজানি; যারা চুরোট ফোঁকার ঘরে তাস খেলত "হায় হায়’ করে উঠল তাদের মন।
পুনশ্চ
দুঃখের দিনে লেখনীকে বলি– লজ্জা দিয়ো না। সকলের নয় যে আঘাত ধোরো না সবার চোখে। ঢেকো না মুখ অন্ধকারে, রেখো না দ্বারে আগল দিয়ে। জ্বালো সকল রঙের উজ্জ্বল বাতি, কৃপণ হোয়ো না। অতি বৃহৎ বিশ্ব, অম্লান তার মহিমা, অক্ষুব্ধ তার প্রকৃতি। মাথা তুলেছে দুর্দর্শ সূর্যলোকে, অবিচলিত অকরুণ দৃষ্টি তার অনিমেষ, অকম্পিত বক্ষ প্রসারিত গিরি নদী প্রান্তরে। আমার সে নয়, সে অসংখ্যের। বাজে তার ভেরী সকল দিকে, জ্বলে অনিভৃত আলো, দোলে পতাকা মহাকাশে। তার সমুখে লজ্জা দিয়ো না– আমার ক্ষতি আমার ব্যথা তার সমুখে কণার কণা। এই ব্যথাকে আমার বলে ভুলব যখনি তখনি সে প্রকাশ পাবে বিশ্বরূপে। দেখতে পাব বেদনার বন্যা নামে কালের বুকে শাখাপ্রশাখায়; ধায় হৃদয়ের মহানদী সব মানুষের জীবনস্রোতে ঘরে ঘরে। অশ্রুধারার ব্রহ্মপুত্র উঠছে ফুলে ফুলে তরঙ্গে তরঙ্গে; সংসারের কূলে কূলে চলে তার বিপুল ভাঙাগড়া দেশে দেশান্তরে। চিরকালের সেই বিরহতাপ, চিরকালের সেই মানুষের শোক, নামল হঠাৎ আমার বুকে; এক প্লাবনে থর্থরিয়ে কাঁপিয়ে দিল পাঁজরগুলো– সব ধরণীর কান্নার গর্জনে মিলে গিয়ে চলে গেল অনন্তে, কী উদ্দেশে কে তা জানে। আজকে আমি ডেকে বলি লেখনীকে, লজ্জা দিয়ো না। কূল ছাপিয়ে উঠুক তোমার দান। দাক্ষিণ্যে তোমার ঢাকা পড়ুক অন্তরালে আমার আপন ব্যথা। ক্রন্দন তার হাজার তানে মিলিয়ে দিয়ো বিশাল বিশ্বসুরে।
পুনশ্চ
মনে হচ্ছে শূন্য বাড়িটা অপ্রসন্ন, অপরাধ হয়েছে আমার তাই আছে মুখ ফিরিয়ে। ঘরে ঘরে বেড়াই ঘুরে, আমার জায়গা নেই– হাঁপিয়ে বেরিয়ে চলে আসি। এ বাড়ি ভাড়া দিয়ে চলে যাব দেরাদুনে। অমলির ঘরে ঢুকতে পারি নি বহুদিন মোচড় যেন দিত বুকে। ভাড়াটে আসবে, ঘর দিতেই হবে সাফ ক’রে, তাই খুললেম ঘরের তালা। একজোড়া আগ্রার জুতো, চুল বাঁধবার চিরুনি, তেল, এসেন্সের শিশি শেলফে তার পড়বার বই, ছোটো হার্মোনিয়ম। একটা অ্যালবাম, ছবি কেটে কেটে জুড়েছে তার পাতায়। আলনায় তোয়ালে, জামা, খদ্দরের শাড়ি। ছোটো কাঁচের আলমারিতে নানা রকমের পুতুল, শিশি, খালি পাউডারের কৌটো। চুপ করে বসে রইলেম চৌকিতে। টেবিলের সামনে। লাল চামড়ার বাক্স, ইস্কুলে নিয়ে যেত সঙ্গে। তার থেকে খাতাটি নিলেম তুলে, আঁক কষবার খাতা। ভিতর থেকে পড়ল একটি আখোলা চিঠি, আমারি ঠিকানা লেখা অমলির কাঁচা হাতের অক্ষরে। শুনেছি ডুবে মরবার সময় অতীত কালের সব ছবি এক মুহূর্তে দেখা দেয় নিবিড় হয়ে– চিঠিখানি হাতে নিয়ে তেমনি পড়ল মনে অনেক কথা এক নিমেষে। অমলার মা যখন গেলেন মারা তখন ওর বয়স ছিল সাত বছর। কেমন একটা ভয় লাগল মনে, ও বুঝি বাঁচবে না বেশি দিন। কেননা বড়ো করুণ ছিল ওর মুখ, যেন অকালবিচ্ছেদের ছায়া ভাবীকাল থেকে উল্টে এসে পড়েছিল ওর বড়ো বড়ো কালো চোখের উপরে। সাহস হ’ত না ওকে সঙ্গছাড়া করি। কাজ করছি আপিসে বসে, হঠাৎ হ’ত মনে যদি কোনো আপদ ঘটে থাকে। বাঁকিপুর থেকে মাসি এল ছুটিতে– বললে, "মেয়েটার পড়াশুনো হল মাটি। মুর্খু মেয়ের বোঝা বইবে কে আজকালকার দিনে।’ লজ্জা পেলেম কথা শুনে তার, বললেম "কালই দেব ভর্তি করে বেথুনে’। ইস্কুলে তো গেল, কিন্তু ছুটির দিন বেড়ে যায় পড়ার দিনের চেয়ে। কতদিন স্কুলের বাস্ অমনি যেত ফিরে। সে চক্রান্তে বাপেরও ছিল যোগ। ফিরে বছর মাসি এল ছুটিতে; বললে, "এমন করে চলবে না। নিজে ওকে যাব নিয়ে, বোর্ডিঙে দেব বেনারসের স্কুলে, ওকে বাঁচানো চাই বাপের স্নেহ থেকে।’ মাসির সঙ্গে গেল চলে। অশ্রুহীন অভিমান নিয়ে গেল বুক ভরে যেতে দিলেম বলে। বেরিয়ে পড়লেম বদ্রিনাথের তীর্থযাত্রায় নিজের কাছ থেকে পালাবার ঝোঁকে। চার মাস খবর নেই। মনে হল গ্রন্থি হয়েছে আলগা গুরুর কৃপায়। মেয়েকে মনে মনে সঁপে দিলেম দেবতার হাতে, বুকের থেকে নেমে গেল বোঝা। চার মাস পরে এলেম ফিরে। ছুটেছিলেম অমলিকে দেখতে কাশীতে– পথের মধ্যে পেলেম চিঠি– কী আর বলব, দেবতাই তাকে নিয়েছে। যাক সে-সব কথা। অমলার ঘরে বসে সেই আখোলা চিঠি খুলে দেখি, তাতে লেখা– "তোমাকে দেখতে বড্ডো ইচ্ছে করছে’। আর কিছুই নেই।
পুনশ্চ
হিরণমাসির প্রধান প্রয়োজন রান্নাঘরে। দুটি ঘড়া জল আনতে হয় দিঘি থেকে– তার দিঘিটা ওই দুই ঘড়ারই মাপে রান্নাঘরের পিছনে বাঁধা দরকারের বাঁধনে। এ দিকে তার মা-মরা বোনপো, গায়ে যে রাখে না কাপড়, মনে যে রাখে না সদুপদেশ, প্রয়োজন যার নেই কোনো কিছুতেই, সমস্ত দিঘির মালেক সেই লক্ষ্মীছাড়াটা। যখন খুশি ঝাঁপ দিয়ে পড়ে জলে, মুখে জল নিয়ে আকাশে ছিটোতে ছিটোতে সাঁতার কাটে, ছিনিমিনি খেলে ঘাটে দাঁড়িয়ে, কঞ্চি নিয়ে করে মাছ-ধরা খেলা, ডাঙায় গাছে উঠে পাড়ে জামরুল– খায় যত ছড়ায় তার বেশি। দশ-আনির টাক-পড়া মোটা জমিদার, লোকে বলে দিঘির স্বত্ব তারই– বেলা দশটায় সে চাপড়ে চাপড়ে তেল মাখে বুকে পিঠে, ঝপ্ করে দুটো ডুব দিয়ে নেয়, বাঁশবনের তলা দিয়ে দুর্গা নাম করতে করতে চলে ঘরে– সময় নেই, জরুরি মকর্দমা। দিঘিটা আছে তার দলিলে, নেই তার জগতে। আর ছেলেটার দরকার নেই কিছুতেই, তাই সমস্ত বন-বাদাড় খাল-বিল তারই– নদীর ধার, পোড়ো জমি, ডুবো নৌকা, ভাঙা মন্দির, তেঁতুল গাছের সবার উঁচু ডালটা। জামবাগানের তলায় চরে ধোবাদের গাধা, ছেলেটা তার পিঠে চড়ে– ছড়ি হাতে জমায় ঘোড়দৌড়। ধোবাদের গাধাটা আছে কাজের গরজে– ছেলেটার নেই কোনো দরকার, তাই জন্তুটা তার চার পা নিয়ে সমস্তটা তারই, যাই বলুন-না জজসাহেব। বাপ মা চায় পড়ে শুনে হবে সে সদর-আলা; সর্দার পোড়ো ওকে টেনে নামায় গাধার থেকে, হেঁচড়ে আনে বাঁশবন দিয়ে, হাজির করে পাঠশালায়। মাঠে ঘাটে হাটে বাটে জলে স্থলে তার স্বরাজ– হঠাৎ দেহটাকে ঘিরলে চার দেয়ালে, মনটাকে আঠা দিয়ে এঁটে দিলে পুঁথির পাতার গায়ে। আমিও ছিলেম একদিন ছেলেমানুষ। আমার জন্যেও বিধাতা রেখেছিলেন গড়ে অকর্মণ্যের অপ্রয়োজনের জল স্থল আকাশ। তবু ছেলেদের সেই মস্ত বড়ো জগতে মিলল না আমার জায়গা। আমার বাসা অনেক কালের পুরোনো বাড়ির কোণের ঘরে– বাইরে যাওয়া মানা। সেখানে চাকর পান সাজে, দেয়ালে মোছে হাত, গুন গুন ক’রে গায় মধুকানের গান; শান-বাঁধানো মেজে, খড়্খড়ে-দেওয়া জানলা। নীচে ঘাট-বাঁধানো পুকুর, পাঁচিল ঘেঁষে নারকেল গাছ। জটাধারী বুড়ো বট মোটা মোটা শিকড়ে আঁকড়ে ধরেছে পুব ধারটা। সকাল থেকে নাইতে আসে পাড়ার লোকে, বিকেলের পড়ন্ত রোদে ঝিকিমিকি জলে ভেসে বেড়ায় পাতিহাঁসগুলো, পাখা সাফ করে ঠোঁট দিয়ে মেজে। প্রহরের পর কাটে প্রহর। আকাশে ওড়ে চিল, থালা বাজিয়ে যায় পুরোনো কাপড়ওয়ালা, বাঁধানো নালা দিয়ে গঙ্গার জল এসে পড়ে পুকুরে। পৃথিবীতে ছেলেরা যে খোলা জগতের যুবরাজ আমি সেখানে জন্মেছি গরিব হয়ে। শুধু কেবল আমার খেলা ছিল মনের ক্ষুধায়, চোখের দেখায়, পুকুরের জলে, বটের শিকড়-জড়ানো ছায়ায়, নারকেলের দোদুল ডালে, দূর বাড়ির রোদ-পোহানো ছাদে। অশোকবনে এসেছিল হনুমান, সেদিন সীতা পেয়েছিলেন নবদূর্বাদলশ্যাম রামচন্দ্রের খবর। আমার হনুমান আসত বছরে বছরে আষাঢ় মাসে আকাশ কালো করে সজল নবনীল মেঘে। আনত তার মেদুর কণ্ঠে দূরের বার্তা, যে দূরের অধিকার থেকে আমি নির্বাসিত। ইমারত-ঘেরা ক্লিষ্ট যে আকাশটুকু তাকিয়ে থাকত একদৃষ্টে আমার মুখে, বাদলের দিনে গুরুগুরু ক’রে তার বুক উঠত দুলে। বট গাছের মাথা পেরিয়ে কেশর ফুলিয়ে দলে দলে মেঘ জুটত ডানাওয়ালা কালো সিংহের মতো। নারকেল-ডালের সবুজ হত নিবিড়, পুকুরের জল উঠত শিউরে শিউরে। যে চাঞ্চল্য শিশুর জীবনে রুদ্ধ ছিল সেই চাঞ্চল্য বাতাসে বাতাসে, বনে বনে। পুব দিকের ও পার থেকে বিরাট এক ছেলেমানুষ ছাড়া পেয়েছে আকাশে, আমার সঙ্গে সে সাথি পাতালে। বৃষ্টি পড়ে ঝমাঝম। একে একে পুকুরের পৈঁঠা যায় জলে ডুবে। আরো বৃষ্টি, আরো বৃষ্টি, আরো বৃষ্টি। রাত্তির হয়ে আসে, শুতে যাই বিছানায়, খোলা জানলা দিয়ে গন্ধ পাই ভিজে জঙ্গলের। উঠোনে একহাঁটু জল, ছাদের নালার মুখ থেকে জলে পড়ছে জল মোটা ধারায়। ভোরবেলায় ছুটেছি দক্ষিণের জানলায়, পুকুর গেছে ভেসে; জল বেরিয়ে চলেছে কল্কল্ করে বাগানের উপর দিয়ে, জলের উপর বেলগাছগুলোর ঝাঁকড়া মাথা জেগে থাকে। পাড়ার লোকে হৈ হৈ করে এসেছে গামছা দিয়ে ধুতির কোঁচা দিয়ে মাছ ধরতে। কাল পর্যন্ত পুকুরটা ছিল আমারি মতো বাঁধা, এ বেলা ও বেলা তার উপরে পড়ত গাছের ছায়া, উড়ো মেঘ জলে বুলিয়ে যেত ক্ষণিকের ছায়াতুলি, বটের ডালের ভিতর দিয়ে যেন সোনার পিচকারিতে ছিটকে পড়ত তার উপরে আলো– পুকুরটা চেয়ে থাকত আকাশে ছল্ছলে দৃষ্টিতে। আজ তার ছুটি, কোথায় সে চলল খ্যাপা গেরুয়া-পরা বাউল যেন। পুকুরের কোণে নৌকোটি দাদারা চড়ে বসল ভাসিয়ে দিয়ে, গেল পুকুর থেকে গলির মধ্যে, গলির থেকে সদর রাস্তায়– তার পরে কোথায় জানি নে। বসে বসে ভাবি। বেলা বাড়ে। দিনান্তের ছায়া মেশে মেঘের ছায়ায়, তার সঙ্গে মেশে পুকুরের জলে বটের ছায়ার কালিমা। সন্ধে হয়ে এল। বাতি জ্বলল ঝাপসা আলোয় রাস্তার ধারে ধারে, ঘরে জ্বলেছে কাঁচের সেজে মিট্মিটে শিখা, ঘোর অন্ধকারে একটু একটু দেখা যায় দুলছে নারকেলের ডাল, ভূতের ইশারা যেন। গলির পারে বড়ো বাড়িতে সব দরজা বন্ধ, আলো মিট্ মিট্ করে দুই-একটা জানলা দিয়ে চেয়ে-থাকা ঘুমন্ত চোখের মতো। তার পরে কখন আসে ঘুম। রাত দুটোর সময় স্বরূপ সর্দার নিষুত রাতে বারান্দায় বারান্দায় হাঁক দিয়ে যায় চলে। বাদলের দিনগুলো বছরে বছরে তোলপাড় করেছে আমার মন; আজ তারা বছরে বছরে নাড়া দেয় আমার গানের সুরকে। শালের পাতায় পাতায় কোলাহল, তালের ডালে ডালে করতালি, বাঁশের দোলাদুলি বনে বনে– ছাতিম গাছের থেকে মালতীলতা ঝরিয়ে দেয় ফুল। আর সেদিনকার আমারি মতো অনেক ছেলে আছে ঘরে ঘরে, লাঠাইয়ের সুতোয় মাখাচ্ছে আঠা, তাদের মনের কথা তারাই জানে।
পুনশ্চ
বাবা এসে শুধালেন, "কী করছিস সুনি, কাপড় কেন তুলিস বাক্সে, যাবি কোথায়?’ সুনৃতার ঘর তিনতলায়। দক্ষিণ দিকে দুই জানলা, সামনে পালঙ্ক, বিছানা লক্ষ্ণৌ-ছিটে ঢাকা। অন্য দেয়ালে লেখবার টেবিল, তার কোণে মায়ের ফোটোগ্রাফ– তিনি গেছেন মারা। বাবার ছবি দেয়ালে, ফ্রেমে জড়ানো ফুলের মালা। মেঝেতে লাল শতরঞ্চে শাড়ি শেমিজ ব্লাউজ মোজা রুমাল ছড়াছড়ি। কুকুরটা কাছ ঘেঁষে লেজ নাড়ছে, ঠেলা দিচ্ছে কোলে থাবা তুলে– ভেবে পাচ্ছে না কিসের আয়োজন, ভয় হচ্ছে পাছে ওকে ফেলে রেখে আবার যায় কোথাও। ছোটো বোন শমিতা বসে আছে হাঁটু উঁচু করে, বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে। চুল বাঁধা হয় নি, চোখ দুটি রাঙা কান্নার অবসানে। চুপ করে রইল সুনৃতা, মুখ নিচু করে সে কাপড় গোছায়– হাত কাঁপে। বাবা আবার বললেন, "সুনি, কোথাও যাবি নাকি।’ সুনৃতা শক্ত করে বললে, "তুমি তো বলেইছ এ বাড়িতে হতে পারবে না আমার বিয়ে, আমি যাব অনুদের বাসায়।’ শমিতা বললে, "ছি ছি, দিদি, কী বলছ।’ বাবা বললেন, "ওরা যে মানে না আমাদের মত।’ "তবু ওদের মতই যে আমাকে মানতে হবে চিরদিন–’ এই বলে সুনি সেফটিপিন ভরে রাখলে লেফাফায়। দৃঢ় ওর কণ্ঠস্বর, কঠিন ওর মুখের ভাব, সংকল্প অবিচলিত। বাবা বললেন, "অনিলের বাপ জাত মানে, সে কি রাজি হবে।’ সগর্বে বলে উঠল সুনৃতা, "চেন না তুমি অনিলবাবুকে, তাঁর জোর আছে পৌরুষের, তাঁর মত তাঁর নিজের।’ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বাবা চলে গেলেন ঘর থেকে, শমিতা উঠে তাঁকে জড়িয়ে ধরলে– বেরিয়ে গেল তাঁর সঙ্গে। বাজল দুপুরের ঘণ্টা। সকাল থেকে খাওয়া নেই সুনৃতার। শমিতা একবার এসেছিল ডাকতে– ও বললে, খাবে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে। মা-মরা মেয়ে, বাপের আদুরে, মিনতি করতে আসছিলেন তিনি; শমিতা পথ আগলিয়ে বললে, "কক্খনো যেতে পারবে না বাবা, ও না খায় তো নেই খেল।’ জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখলে সুনৃতা রাস্তার দিকে, এসেছে অনুদের গাড়ি। তাড়াতাড়ি চুলটা আঁচড়িয়ে ব্রোচটা লাগাচ্ছে যখন কাঁধে, শমি এসে বললে, "এই নাও তাদের চিঠি।’ ব’লে ফেলে দিলে ছুঁড়ে ওর কোলে। সুনৃতা পড়লে চিঠিখানা, মুখ হয়ে গেল ফ্যাকাশে, বসে পড়ল তোরঙ্গের উপর। চিঠিতে আছে– "বাবার মত করতে পারব নিশ্চিত ছিল মনে, হল না কিছুতেই, কাজেই–’ বাজল একটা। সুনি চুপ করে ব’সে, চোখে জল নেই। রামচরিত বললে এসে, "মোটর দাঁড়িয়ে অনেক ক্ষণ।’ সুনি বললে, "যেতে বলে দে।’ কুকুরটা কাছে এসে বসে রইল চুপ করে। বাবা বুঝলেন, প্রশ্ন করলেন না– বললেন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে, "চল্ সুনি, হোসেঙ্গাবাদে তোর মামার ওখানে।’ কাল বিয়ের দিন। অনিল জিদ করেছিল হবে না বিয়ে। মা ব্যথিত হয়ে বলেছিল, "থাক্-না।’ বাপ বললে, "পাগল নাকি।’ ইলেক্ট্রিক বাতির মালা খাটানো হচ্ছে বাড়িতে, সমস্ত দিন বাজছে সানাই। হূহু করে উঠছে অনিলের মনটা। তখন সন্ধ্যা সাতটা। সুনিদের বউবাজারের বাড়ির এক তলায়। ডাবাহুঁকো বাঁ হাতে ধরে তামাক খাচ্ছে কৈলেস সরকার, আর তালপাতার পাখায় বাতাস চলছে ডান হাতে; বেহারাকে ডেকেছে পা টিপে দেবে। কালিমাখা ময়লা জাজিমে কাগজপত্র রাশ করা; জ্বলছে একটা কেরোসিন লণ্ঠন। হঠাৎ অনিল এসে উপস্থিত। কৈলেস শশব্যস্ত উঠে দাঁড়ালো শিথিল কাছাকোঁচা সামলিয়ে। অনিল বললে, "পার্বণীটা ভুলেছিলেম গোলেমালে, তাই এসেছি দিতে।’ তার পরে বাধো-বাধো গলায় বললে, "অমনি দেখে যাব তোমাদের সুনিদিদির ঘরটা।’ গেল ঘরে। খাটের উপর রইল বসে মাথায় হাত দিয়ে। কিসের একটা অস্পষ্ট গন্ধ, মূর্ছিতের নিশ্বাসের মতো। সে গন্ধ চুলের না শুকনো ফুলের না শূন্য ঘরে সঞ্চিত বিজড়িত স্মৃতির– বিছানায়, চৌকিতে, পর্দায়। সিগারেট ধরিয়ে টানল কিছুক্ষণ, ছুঁড়ে ফেলে দিল জানলার বাইরে। টেবিলের নীচে থেকে ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িটা নিল কোলে তুলে। ধক্ করে উঠল বুকের মধ্যে; দেখলে ঝুড়ি-ভরা রাশি রাশি ছেঁড়া চিঠি, ফিকে নীল রঙের কাগজে অনিলেরই হাতে লেখা। তার সঙ্গে টুকরো টুকরো ছেঁড়া একটা ফোটোগ্রাফ। আর ছিল বছর চার আগেকার দুটি ফুল, লাল ফিতেয় বাঁধা মেডেন-হেয়ার পাতার সঙ্গে শুকনো প্যান্সি আর ভায়োলেট।
পুনশ্চ
এক দিকে কামিনীর ডালে মাকড়সা শিশিরের ঝালর দুলিয়েছে, আর-এক দিকে বাগানে রাস্তার ধারে লাল-মাটির-কণা-ছড়ানো পিঁপড়ের বাসা। যাই আসি তারি মাঝখান দিয়ে সকালে বিকালে। আনমনে দেখি শিউলিগাছে কুঁড়ি ধরেছে, টগর গেছে ফুলে ছেয়ে। বিশ্বের মাঝে মানুষের সংসারটুকু দেখতে ছোটো, তবু ছোটো তো নয়। তেমনি ওই কীটের সংসার। ভালো করে চোখে পড়ে না, তবু সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্রে আছে ওরা। কত যুগ থেকে অনেক ভাবনা ওদের, অনেক সমস্যা, অনেক প্রয়োজন– অনেক দীর্ঘ ইতিহাস। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত চলেছে প্রাণশক্তির দুর্বার আগ্রহ। মাঝখান দিয়ে যাই আসি, শব্দ শুনি নে ওদের চিরপ্রবাহিত চৈতন্যধারার– ওদের ক্ষুধাপিপাসা-জন্মমৃত্যুর। গুন গুন সুরে আধখানা গানের জোড় মেলাতে খুঁজে বেড়াই বাকি আধখানা পদ, এই অকারণ অদ্ভুত খোঁজের কোনো অর্থ নেই ওই মাকড়সার বিশ্বচরাচরে, ওই পিঁপড়ে-সমাজে। ওদের নীরব নিখিলে এখনি উঠছে কি স্পর্শে স্পর্শে সুর, ঘ্রাণে ঘ্রাণে সংগীত, মুখে মুখে অশ্রুত আলাপ, চলায় চলায় অব্যক্ত বেদনা। আমি মানুষ– মনে জানি সমস্ত জগতে আমার প্রবেশ, গ্রহনক্ষত্রে ধূমকেতুতে আমার বাধা যায় খুলে খুলে। কিন্তু ওই মাকড়সার জগৎ বদ্ধ রইল চিরকাল আমার কাছে, ওই পিঁপড়ের অন্তরের যবনিকা পড়ে রইল চিরদিন আমার সামনে আমার সুখে দুঃখে ক্ষুব্ধ সংসারের ধারেই। ওদের ক্ষুদ্র অসীমের বাইরের পথে আসি যাই সকালে বিকালে– দেখি, শিউলিগাছে কুঁড়ি ধরছে, টগর গেছে ফুলে ছেয়ে।
পুনশ্চ
নাম তার কমলা, দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা। সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়। আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে। মুখের এক পাশের নিটোল রেখাটি দেখা যায়, আর ঘাড়ের উপর কোমল চুলগুলি খোঁপার নীচে। কোলে তার ছিল বই আর খাতা। যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হল না। এখন থেকে সময়ের হিসাব করে বেরোই– সে হিসাব আমার কাজের সঙ্গে ঠিকটি মেলে না, প্রায় ঠিক মেলে ওদের বেরোবার সময়ের সঙ্গে, প্রায়ই হয় দেখা। মনে মনে ভাবি, আর-কোনো সম্বন্ধ না থাক্, ও তো আমার সহযাত্রিণী। নির্মল বুদ্ধির চেহারা ঝক্ঝক্ করছে যেন। সুকুমার কপাল থেকে চুল উপরে তোলা, উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি নিঃসংকোচ। মনে ভাবি একটা কোনো সংকট দেখা দেয় না কেন, উদ্ধার করে জন্ম সার্থক করি– রাস্তার মধ্যে একটা কোনো উৎপাত, কোনো-একজন গুণ্ডার স্পর্ধা। এমন তো আজকাল ঘটেই থাকে। কিন্তু আমার ভাগ্যটা যেন ঘোলা জলের ডোবা, বড়ো রকম ইতিহাস ধরে না তার মধ্যে, নিরীহ দিনগুলো ব্যাঙের মতো একঘেয়ে ডাকে– না সেখানে হাঙর-কুমিরের নিমন্ত্রণ, না রাজহাঁসের। একদিন ছিল ঠেলাঠেলি ভিড়। কমলার পাশে বসেছে একজন আধা-ইংরেজ। ইচ্ছে করছিল, অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে, ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে। কোনো ছুতো পাই নে, হাত নিশ্পিশ্ করে। এমন সময়ে সে এক মোটা চুরোট ধরিয়ে টানতে করলে শুরু। কাছে এসে বললুম, "ফেলো চুরোট।’ যেন পেলেই না শুনতে, ধোঁওয়া ওড়াতে লাগল বেশ ঘোরালো করে। মুখ থেকে টেনে ফেলে দিলেম চুরোট রাস্তায়। হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার তাকালো কট্মট্ ক’রে– আর কিছু বললে না, এক লাফে নেমে গেল। বোধ হয় আমাকে চেনে। আমার নাম আছে ফুটবল খেলায়, বেশ একটু চওড়া গোছের নাম। লাল হয়ে উঠল মেয়েটির মুখ, বই খুলে মাথা নিচু করে ভান করলে পড়বার। হাত কাঁপতে লাগল, কটাক্ষেও তাকালে না বীরপুরুষের দিকে। আপিসের বাবুরা বললে, "বেশ করেছেন মশায়।’ একটু পরেই মেয়েটি নেমে পড়ল অজায়গায়, একটা ট্যাক্সি নিয়ে গেল চলে। পরদিন তাকে দেখলুম না, তার পরদিনও না, তৃতীয় দিনে দেখি একটা ঠেলাগাড়িতে চলেছে কলেজে। বুঝলুম, ভুল করেছি গোঁয়ারের মতো। ও মেয়ে নিজের দায় নিজেই পারে নিতে, আমাকে কোনো দরকারই ছিল না। আবার বললুম মনে মনে, ভাগ্যটা ঘোলা জলের ডোবা– বীরত্বের স্মৃতি মনের মধ্যে কেবলই আজ আওয়াজ করছে কোলাব্যাঙের ঠাট্টার মতো। ঠিক করলুম ভুল শোধরাতে হবে। খবর পেয়েছি গরমের ছুটিতে ওরা যায় দার্জিলিঙে। সেবার আমারও হাওয়া বদলাবার জরুরি দরকার। ওদের ছোট্ট বাসা, নাম দিয়েছে মতিয়া– রাস্তা থেকে একটু নেমে এক কোণে গাছের আড়ালে, সামনে বরফের পাহাড়। শোনা গেল আসবে না এবার। ফিরব মনে করছি এমন সময়ে আমার এক ভক্তের সঙ্গে দেখা, মোহনলাল– রোগা মানুষটি, লম্বা, চোখে চশমা, দুর্বল পাকযন্ত্র দার্জিলিঙের হাওয়ায় একটু উৎসাহ পায়। সে বললে, "তনুকা আমার বোন, কিছুতে ছাড়বে না তোমার সঙ্গে দেখা না করে।’ মেয়েটি ছায়ার মতো, দেহ যতটুকু না হলে নয় ততটুকু– যতটা পড়াশোনায় ঝোঁক, আহারে ততটা নয়। ফুটবলের সর্দারের ’পরে তাই এত অদ্ভুত ভক্তি– মনে করলে আলাপ করতে এসেছি সে আমার দুর্লভ দয়া। হায় রে ভাগ্যের খেলা! যেদিন নেমে আসব তার দু দিন আগে তনুকা বললে, "একটি জিনিস দেব আপনাকে, যাতে মনে থাকবে আমাদের কথা– একটি ফুলের গাছ।’ এ এক উৎপাত। চুপ করে রইলেম। তনুকা বললে, "দামি দুর্লভ গাছ, এ দেশের মাটিতে অনেক যত্নে বাঁচে।’ জিগেস করলেম, "নামটা কী?’ সে বললে "ক্যামেলিয়া’। চমক লাগল– আর-একটা নাম ঝলক দিয়ে উঠল মনের অন্ধকারে। হেসে বললেম, "ক্যামেলিয়া, সহজে বুঝি এর মন মেলে না।’ তনুকা কী বুঝলে জানি নে, হঠাৎ লজ্জা পেলে, খুশিও হল। চললেম টবসুদ্ধ গাছ নিয়ে। দেখা গেল পার্শ্ববর্তিনী হিসাবে সহযাত্রিণীটি সহজ নয়। একটা দো-কামরা গাড়িতে টবটাকে লুকোলেম নাবার ঘরে। থাক্ এই ভ্রমণবৃত্তান্ত, বাদ দেওয়া যাক আরো মাস কয়েকের তুচ্ছতা। পুজোর ছুটিতে প্রহসনের যবনিকা উঠল সাঁওতাল পরগনায়। জায়গাটা ছোটো। নাম বলতে চাই নে– বায়ুবদলের বায়ু-গ্রস্তদল এ জায়গার খবর জানে না। কমলার মামা ছিলেন রেলের এঞ্জিনিয়র। এইখানে বাসা বেঁধেছেন শালবনে ছায়ায়, কাঠবিড়ালিদের পাড়ায়। সেখানে নীল পাহাড় দেখা যায় দিগন্তে, অদূরে জলধারা চলেছে বালির মধ্যে দিয়ে, পলাশবনে তসরের গুটি ধরেছে, মহিষ চরছে হর্তকি গাছের তলায়– উলঙ্গ সাঁওতালের ছেলে পিঠের উপরে। বাসাবাড়ি কোথাও নেই, তাই তাঁবু পাতলেম নদীর ধারে। সঙ্গী ছিল না কেউ, কেবল ছিল টবে সেই ক্যামেলিয়া। কমলা এসেছে মাকে নিয়ে। রোদ ওঠবার আগে হিমে-ছোঁওয়া স্নিগ্ধ হাওয়ায় শাল-বাগানের ভিতর দিয়ে বেড়াতে যায় ছাতি হাতে। মেঠো ফুলগুলো পায়ে এসে মাথা কোটে, কিন্তু সে কি চেয়ে দেখে। অল্পজল নদী পায়ে হেঁটে পেরিয়ে যায় ও পারে, সেখানে সিসুগাছের তলায় বই পড়ে। আর আমাকে সে যে চিনেছে তা জানলেম আমাকে লক্ষ্য করে না বলেই। একদিন দেখি নদীর ধারে বালির উপর চড়িভাতি করছে এরা। ইচ্ছে হল গিয়ে বলি, আমাকে দরকার কি নেই কিছুতেই। আমি পারি জল তুলে আনতে নদী থেকে– পারি বন থেকে কাঠ আনতে কেটে, আর, তা ছাড়া কাছাকাছি জঙ্গলের মধ্যে একটা ভদ্রগোছের ভালুকও কি মেলে না। দেখলেম দলের মধ্যে একজন যুবক– শট্-পরা, গায়ে রেশমের বিলিতি জামা, কমলার পাশে পা ছড়িয়ে হাভানা চুরোট খাচ্ছে। আর, কমলা অন্যমনে টুকরো টুকরো করছে একটা শ্বেতজবার পাপড়ি, পাশে পড়ে আছে বিলিতি মাসিক পত্র। মুহূর্তে বুঝলেম এই সাঁওতাল পরগনার নির্জন কোণে আমি অসহ্য অতিরিক্ত, ধরবে না কোথাও। তখনি চলে যেতেম, কিন্তু বাকি আছে একটি কাজ। আর দিন-কয়েকেই ক্যামেলিয়া ফুটবে, পাঠিয়ে দিয়ে তবে ছুটি। সমস্ত দিন বন্দুক ঘাড়ে শিকারে ফিরি বনে জঙ্গলে, সন্ধ্যার আগে ফিরে এসে টবে দিই জল আর দেখি কুঁড়ি এগোল কত দূর। সময় হয়েছে আজ। যে আনে আমার রান্নার কাঠ। ডেকেছি সেই সাঁওতাল মেয়েটিকে। তার হাত দিয়ে পাঠাব শালপাতার পাত্রে। তাঁবুর মধ্যে বসে তখন পড়ছি ডিটেকটিভ গল্প। বাইরে থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, "বাবু, ডেকেছিস কেনে।’ বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া সাঁওতাল মেয়ের কানে, কালো গালের উপর আলো করেছে। সে আবার জিগেস করলে, "ডেকেছিস কেনে।’ আমি বললেম, "এইজন্যেই।’ তার পরে ফিরে এলেম কলকাতায়।
পুনশ্চ
শালিখটার কী হল তাই ভাবি। একলা কেন থাকে দলছাড়া। প্রথম দিন দেখেছিলেম শিমুল গাছের তলায়, আমার বাগানে, মনে হল একটু যেন খুঁড়িয়ে চলে। তার পরে ওই রোজ সকালে দেখি– সঙ্গীহারা, বেড়ায় পোকা শিকার ক’রে। উঠে আসে আমার বারান্দায়– নেচে নেচে করে সে পায়চারি, আমার ’পরে একটুকু নেই ভয়। কেন এমন দশা। সমাজের কোন্ শাসনে নির্বাসনের পালা, দলের কোন্ অবিচারে জাগল অভিমান। কিছু দূরেই শালিখগুলো করছে বকাবকি, ঘাসে ঘাসে তাদের লাফালাফি, উড়ে বেড়ায় শিরীষ গাছের ডালে ডালে– ওর দেখি তো খেয়াল কিছুই নেই। জীবনে ওর কোন্খানে যে গাঁঠ পড়েছে সেই কথাটাই ভাবি। সকালবেলার রোদে যেন সহজ মনে আহার খুঁটে খুঁটে ঝরে-পড়া পাতার উপর লাফিয়ে বেড়ায় সারাবেলা। কারো উপর নালিশ কিছু আছে মনে হয় না একটুও তা। বৈরাগ্যের গর্ব তো নেই ওর চলনে, কিম্বা দুটো আগুন-জ্বলা চোখ। কিন্তু ওকে দেখি নি তো সন্ধেবেলায়– একলা যখন যায় বাসাতে ডালের কোণে, ঝিল্লি যখন ঝিঁ ঝিঁ করে অন্ধকারে, হাওয়ায় আসে বাঁশের পাতার ঝর্ঝরানি। গাছের ফাঁকে তাকিয়ে থাকে ঘুমভাঙানো সঙ্গীবিহীন সন্ধ্যাতারা।
পুনশ্চ
আমি অন্তঃপুরের মেয়ে, চিনবে না আমাকে। তোমার শেষ গল্পের বইটি পড়েছি, শরৎবাবু, "বাসি ফুলের মালা’। তোমার নায়িকা এলোকেশীর মরণ-দশা ধরেছিল পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে। পঁচিশ বছর বয়সের সঙ্গে ছিল তার রেষারেষি, দেখলেম তুমি মহদাশয় বটে– জিতিয়ে দিলে তাকে। নিজের কথা বলি। বয়স আমার অল্প। একজনের মন ছুঁয়েছিল আমার এই কাঁচা বয়সের মায়া। তাই জেনে পুলক লাগত আমার দেহে– ভুলে গিয়েছিলেম, অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে আমি। আমার মতো এমন আছে হাজার হাজার মেয়ে, অল্পবয়সের মন্ত্র তাদের যৌবনে। তোমাকে দোহাই দিই, একটি সাধারণ মেয়ের গল্প লেখো তুমি। বড়ো দুঃখ তার। তারও স্বভাবের গভীরে অসাধারণ যদি কিছু তলিয়ে থাকে কোথাও কেমন করে প্রমাণ করবে সে, এমন কজন মেলে যারা তা ধরতে পারে। কাঁচা বয়সের জাদু লাগে ওদের চোখে, মন যায় না সত্যের খোঁজে, আমরা বিকিয়ে যাই মরীচিকার দামে। কথাটা কেন উঠল তা বলি। মনে করো তার নাম নরেশ। সে বলেছিল কেউ তার চোখে পড়ে নি আমার মতো। এতবড়ো কথাটা বিশ্বাস করব যে সাহস হয় না, না করব যে এমন জোর কই। একদিন সে গেল বিলেতে। চিঠিপত্র পাই কখনো বা। মনে মনে ভাবি, রাম রাম! এত মেয়েও আছে সে দেশে, এত তাদের ঠেলাঠেলি ভিড়! আর তারা কি সবাই অসামান্য– এত বুদ্ধি, এত উজ্জ্বলতা। আর তারা সবাই কি আবিষ্কার করেছে এক নরেশ সেনকে স্বদেশে যার পরিচয় চাপা ছিল দশের মধ্যে। গেল মেলের চিঠিতে লিখেছে লিজির সঙ্গে গিয়েছিল সমুদ্রে নাইতে– বাঙালি কবির কবিতা ক’ লাইন দিয়েছে তুলে সেই যেখানে উর্বশী উঠছে সমুদ্র থেকে– তার পরে বালির ’পরে বসল পাশাপাশি– সামনে দুলছে নীল সমুদ্রের ঢেউ, আকাশে ছড়ানো নির্মল সূর্যালোক। লিজি তাকে খুব আস্তে আস্তে বললে, "এই সেদিন তুমি এসেছ, দুদিন পরে যাবে চলে; ঝিনুকের দুটি খোলা, মাঝখানটুকু ভরা থাক্ একটি নিরেট অশ্রুবিন্দু দিয়ে– দুর্লভ, মূল্যহীন।’ কথা বলবার কী অসামান্য ভঙ্গি। সেইসঙ্গে নরেশ লিখেছে, "কথাগুলি যদি বানানো হয় দোষ কী, কিন্তু চমৎকার– হীরে-বসানো সোনার ফুল কি সত্য, তবুও কি সত্য নয়।’ বুঝতেই পারছ একটা তুলনার সংকেত ওর চিঠিতে অদৃশ্য কাঁটার মতো আমার বুকের কাছে বিঁধিয়ে দিয়ে জানায়– আমি অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে। মূল্যবানকে পুরো মূল্য চুকিয়ে দিই এমন ধন নেই আমার হাতে। ওগো, নাহয় তাই হল, নাহয় ঋণীই রইলেম চিরজীবন। পায়ে পড়ি তোমার, একটা গল্প লেখো তুমি শরৎবাবু, নিতান্তই সাধারণ মেয়ের গল্প– যে দুর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয় অন্তত পাঁচ-সাতজন অসামান্যার সঙ্গে– অর্থাৎ, সপ্তরথিনীর মার। বুঝে নিয়েছি আমার কপাল ভেঙেছে, হার হয়েছে আমার। কিন্তু তুমি যার কথা লিখবে তাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে, পড়তে পড়তে বুক যেন ওঠে ফুলে। ফুলচন্দন পড়ুক তোমার কলমের মুখে। তাকে নাম দিয়ো মালতী। ওই নামটা আমার। ধরা পড়বার ভয় নেই। এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে, তারা সবাই সামান্য মেয়ে। তারা ফরাসি জর্মান জানে না, কাঁদতে জানে। কী করে জিতিয়ে দেবে। উচ্চ তোমার মন, তোমার লেখনী মহীয়সী। তুমি হয়তো ওকে নিয়ে যাবে ত্যাগের পথে, দুঃখের চরমে, শকুন্তলার মতো। দয়া কোরো আমাকে। নেমে এসো আমার সমতলে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাত্রির অন্ধকারে দেবতার কাছে যে অসম্ভব বর মাগি– সে বর আমি পাব না, কিন্তু পায় যেন তোমার নায়িকা। রাখো-না কেন নরেশকে সাত বছর লণ্ডনে, বারে বারে ফেল করুক তার পরীক্ষায়, আদরে থাক্ আপন উপাসিকামণ্ডলীতে। ইতিমধ্যে মালতী পাস করুক এম| এ| কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, গণিতে হোক প্রথম তোমার কলমের এক আঁচড়ে। কিন্তু ওইখানেই যদি থাম তোমার সাহিত্যসম্রাট নামে পড়বে কলঙ্ক। আমার দশা যাই হোক খাটো কোরো না তোমার কল্পনা। তুমি তো কৃপণ নও বিধাতার মতো। মেয়েটাকে দাও পাঠিয়ে য়ুরোপে। সেখানে যারা জ্ঞানী, যারা বিদ্বান, যারা বীর, যারা কবি, যারা শিল্পী, যারা রাজা, দল বেঁধে আসুক ওর চার দিকে। জ্যোতির্বিদের মতো আবিষ্কার করুক ওকে– শুধু বিদুষী ব’লে নয়, নারী ব’লে। ওর মধ্যে যে বিশ্বজয়ী জাদু আছে ধরা পড়ুক তার রহস্য, মূঢ়ের দেশে নয়– যে দেশে আছে সমজদার, আছে দরদি, আছে ইংরেজ জর্মান ফরাসি। মালতীর সম্মানের জন্য সভা ডাকা হোক-না, বড়ো বড়ো নামজাদার সভা। মনে করা যাক সেখানে বর্ষণ হচ্ছে মুষলধারে চাটুবাক্য, মাঝখান দিয়ে সে চলেছে অবহেলায়– ঢেউয়ের উপর দিয়ে যেন পালের নৌকো। ওর চোখ দেখে ওরা করছে কানাকানি, সবাই বলছে ভারতবর্ষের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্র মিলেছে ওর মোহিনী দৃষ্টিতে। (এইখানে জনান্তিকে বলে রাখি সৃষ্টিকর্তার প্রসাদ সত্যই আছে আমার চোখে। বলতে হল নিজের মুখেই, এখনো কোনো য়ুরোপীয় রসজ্ঞের সাক্ষাৎ ঘটে নি কপালে।) নরেশ এসে দাঁড়াক সেই কোণে, আর তার সেই অসামান্য মেয়ের দল। আর তার পরে? তার পরে আমার নটেশাকটি মুড়োল, স্বপ্ন আমার ফুরোল। হায় রে সামান্য মেয়ে! হায় রে বিধাতার শক্তির অপব্যয়!
পুনশ্চ
আধবুড়ো হিন্দুস্থানি, রোগা লম্বা মানুষ– পাকা গোঁফ, দাড়ি-কামানো মুখ শুকিয়ে-আসা ফলের মতো। ছিটের মের্জাই গায়ে, মালকোঁচা ধুতি, বাঁ কাঁধে ছাতি, ডান হাতে খাটো লাঠি, পায়ে নাগরা– চলেছে শহরের দিকে। ভাদ্রমাসের সকালবেলা, পাতলা মেঘের ঝাপসা রোদ্দুর; কাল গিয়েছে কম্বল-চাপা হাঁপিয়ে-ওঠা রাত, আজ সকালে কুয়াশা-ভিজে হাওয়া দোমনা ক’রে বইছে আমলকীর কচি ডালে। পথিকটিকে দেখা গেল আমার বিশ্বের শেষরেখাতে যেখানে বস্তুহারা ছায়াছবির চলাচল। ওকে শুধু জানলুম একজন লোক। ওর নাম নেই, সংজ্ঞা নেই, বেদনা নেই, কিছুতে নেই কোনো দরকার– কেবল হাটে-চলার পথে ভাদ্রমাসের সকালবেলায় একজন লোক। সেও আমায় গেছে দেখে তার জগতের পোড়ো জমির শেষ সীমানায়, যেখানকার নীল কুয়াশার মাঝে কারো সঙ্গে সম্বন্ধ নেই কারো, যেখানে আমি– একজন লোক। তার ঘরে তার বাছুর আছে, ময়না আছে খাঁচায়; স্ত্রী আছে তার, জাঁতায় আটা ভাঙে, পিতলের মোটা কাঁকন হাতে; আছে তার ধোবা প্রতিবেশী, আছে মুদি দোকানদার দেনা আছে কাবুলিদের কাছে; কোনোখানেই নেই আমি– একজন লোক।
পুনশ্চ
এক আছে মণিদিদি, আর আছে তার ঘরে জাপানি পুতুল নাম হানাসান। পরেছে জাপানি পেশোয়াজ ফিকে সবুজের ’পরে ফুলকাটা সোনালি রঙের। বিলেতের হাট থেকে এল তার বর; সেকালের রাজপুত্র কোমরেতে তলোয়ার বাঁধা, মাথার টুপিতে উঁচু পাখির পালখ– কাল হবে অধিবাস, পশু হবে বিয়ে। সন্ধে হল। পালঙ্কেতে শুয়ে হানাসান। জ্বলে ইলেক্ট্রিক বাতি। কোথা থেকে এল এক কালো চামচিকে, উড়ে উড়ে ফেরে ঘুরে ঘুরে, সঙ্গে তার ঘোরে ছায়া। হানাসান ডেকে বলে, "চামচিকে, লক্ষ্মী ভাই, আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাও মেঘেদের দেশে। জন্মেছি খেলনা হয়ে– যেখানে খেলার স্বর্গ সেইখানে হয় যেন গতি ছুটির খেলায়।’ মণিদিদি এসে দেখে পালঙ্কে তো নেই হানাসান। কোথা গেল! কোথা গেল! বটগাছে আঙিনার পারে বাসা ক’রে আছে ব্যাঙ্গমা; সে বলে, "আমি তো জানি, চামচিকে ভায়া তাকে নিয়ে উড়ে চলে গেছে।’ মণি বলে, "হেই দাদা, হেই ব্যাঙ্গমা, আমাকেও নিয়ে চলো, ফিরিয়ে আনি গে।’ ব্যাঙ্গমা মেলে দিল পাখা, মণিদিদি উড়ে চলে সারা রাত্রি ধ’রে। ভোর হল, এল চিত্রকূটগিরি– সেইখানে মেঘেদের পাড়া। মণি ডাকে, "হানাসান! কোথা হানাসান! খেলা যে আমার প’ড়ে আছে।’ নীল মেঘ বলে এসে, "মানুষ কী খেলা জানে? খেলা দিয়ে শুধু বাঁধে যাকে নিয়ে খেলে।’ মণি বলে, "তোমাদের খেলা কিরকম।’ কালো মেঘ ভেসে এল হেসে চিকিমিকি, ডেকে গুরু গুরু বলে, "ওই চেয়ে দেখো, হানাসান হল নানাখানা– ওর ছুটি নানা রঙে নানা চেহারায়, নানা দিকে বাতাসে বাতাসে আলোতে আলোতে।’ মণি বলে, "ব্যাঙ্গমা দাদা, এ দিকে বিয়ে যে ঠিক– বর এসে কী বলবে শেষে।’ ব্যাঙ্গমা হেসে বলে, "আছে চামচিকে ভায়া, বরকেও নিয়ে দেবে পাড়ি। বিয়ের খেলাটা সেও মিলে যাবে সূর্যাস্তের শূন্যে এসে গোধূলির মেঘে।’ মণি কেঁদে বলে, "তবে, শুধু কি রইবে বাকি কান্নার খেলা।’ ব্যাঙ্গমা বলে, "মণিদিদি, রাত হয়ে যাবে শেষ, কাল সকালের ফোটা বৃষ্টি-ধোওয়া মালতীর ফুলে সে খেলাও চিনবে না কেউ।’
পুনশ্চ
দিলে তুমি সোনা-মোড়া ফাউণ্টেন পেন, কতমতো লেখার আসবাব। ছোটো ডেস্কোখানি। আখরোট কাঠ দিয়ে গড়া। ছাপ-মারা চিঠির কাগজ নানা বহরের। রুপোর কাগজ-কাটা এনামেল-করা। কাঁচি, ছুরি, গালা, লাল ফিতে। কাঁচের কাগজ-চাপা, লাল নীল সবুজ পেন্সিল। বলে গিয়েছিলে তুমি, চিঠি লেখা চাই একদিন পরে পরে। লিখতে বসেছি চিঠি, সকালেই স্নান হয়ে গেছে। লিখি যে কী কথা নিয়ে কিছুতেই ভেবে পাই নে তো। একটি খবর আছে শুধু— তুমি চলে গেছ। সে খবর তোমারও তো জানা। তবু মনে হয়, ভালো করে তুমি সে জান না। তাই ভাবি, এ কথাটি জানাই তোমাকে— তুমি চলে গেছ। যতবার লেখা শুরু করি ততবার ধরা পড়ে, এ খবর সহজ তো নয়। আমি নই কবি— ভাষার ভিতরে আমি কণ্ঠস্বর পারি নে তো দিতে, না থাকে চোখের চাওয়া। যত লিখি তত ছিঁড়ে ফেলি। দশটা তো বেজে গেল। তোমার ভাইপো বকু যাবে ইস্কুলে, যাই তারে খাইয়ে আসিগে। শেষবার এই লিখে যাই— তুমি চলে গেছ। বাকি আর যতকিছু হিজিবিজি আঁকাজোকা ব্লটিঙের ’পরে।
পুনশ্চ
ভাই নিশি, তখন উনিশ আমি, তুমি হবে বুঝি পঁচিশের কাছাকাছি। তোমার দুখানা বই ছাপা হয়ে গেছে– "ক্ষান্তপিসি,’ তার পরে "পঞ্চুর মৌতাত’। তা ছাড়া মাসিকপত্র কালচক্রে ক্রমে বের হল "রক্তের আঁচড়’। হুলুস্থূল পড়ে গেল দেশে। কলেজের সাহিত্যসভায়। সেদিন বলেছিলেম বঙ্কিমের চেয়ে তুমি বড়ো, তাই নিয়ে মাথা-ফাটাফাটি। আমাকে খ্যাপাত দাদা নিশি-পাওয়া ব’লে। কলেজের পালা-শেষে করেছি ডেপুটিগিরি, ইস্তফা দিয়েছি কাজে স্বদেশীর দিনে। তার পর থেকে, যা আমার সৌভাগ্য অভাবনীয় তাই ঘটে গেল– বন্ধুরূপে পেলেম তোমাকে। কাছে পেয়ে কোনোদিন তোমাকে করি নি খাটো– ছোটো বড়ো নানা ত্রুটি সেও আমি হেসে ভালোবেসে তোমার মহত্ত্বে সবই মিলিয়ে নিয়েছি। এ ধৈর্য, এ পূর্ণদৃষ্টি, এও যে তোমারি কাছে শেখা। দোষে ভরা অসামান্য প্রাণ, সে চরিত্র-রচনায় সব চেয়ে ওস্তাদি তোমার সে তো আমি জানি। তার পরে কতবার অনুরোধ করেছ কেবলই– বলেছিলে, "লেখো, লেখো, গল্প লেখো। লেখকের মঞ্চে ছিল পিঠ-উঁচু তোমারি চৌকিটা। আত্ম-অবিশ্বাসে শুধু আটকে পড়েছ পড়ুয়ার নীচের বেঞ্চিতে।’ শেষকালে বহু ইতস্তত ক’রে লেখা করলেম শুরু। বিষয়টা ঘটেছিল আমারি আমলে পান্তিঘাটায়। আসামি পোলিটিকাল, সাতমাস পলাতকা। মাকে দেখে যাবে বলে একদিন রাত্রে এসেছিল প্রাণ হাতে ক’রে। খুড়ো গেল পুলিসে খবর দিতে। কিছুদিন নিল সে আশ্রয় জেলেনীর ঘরে। যখন পড়ল ধরা সত্য সাক্ষ্য দিল খুড়ো, মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়েছে জেলেনী। জেলেনীকে দিতে হল জেলে, খুড়ো হল সাব্রেজিস্ট্রার। গল্পখানা পড়ে বিস্তর বাহবা দিয়েছিলে। খাতাখানা নিজে নিয়ে শম্ভু সাণ্ডেলের ঘরে বলে এলে– কালচক্রে অবিলম্বে বের হওয়া চাই। বের হল মাসে মাসে– শুক্নো কাশে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল খ্যাতি নিমেষে নিমেষে। বাঁশরি’তে লিখে দিল– কোথা লাগে আশুবাবু এ নবীন লেখকের কাছে। শুনে হেসেছিলে তুমি। পাঞ্চজন্যে লিখেছিল রতিকান্ত ঘোষ– এত দিনে বাঙলা ভাষায় সত্য লেখা পাওয়া গেল ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার হাস নি তুমি। তার পর থেকে তোমার আমার মাঝখানে খ্যাতির কাঁটার বেড়া ক্রমে ঘন হল। এখন আমার কথা শোনো। আমার এ খ্যাতি আধুনিক মত্ততার ইঞ্চিদুই পলিমাটি-’পরে হঠাৎ-গজিয়ে-ওঠা। স্টুপিড জানে না– মূল এর বেশি দূর নয়; ফল এর কোনোখানে নেই, কেবলই পাতার ঘটা। তোমার যে পঞ্চু সে তো বাঙলার ডন্কুইক্সোট, তার যা মৌতাত সে যে জন্মখ্যাপাদের মগজে মগজে দেশে দেশে দেখা দেয় চিরকাল। আমার এ কুঞ্জলাল তুবড়ির মতো জ্বলে আর নেবে– বোকাদের চোখে লাগে ধাঁধা। আমি জানি তুমি কতখানি বড়ো। এ ফাঁকা খ্যাতির চোরা মেকি পয়সায় বিকাব কি বন্ধুত্ব তোমার। কাগজের মোড়কটা খুলে দেখো, আমার লেখার দগ্ধশেষ। আজ বাদে কাল হ’ত ধুলো, আজ হোক ছাই।
পুনশ্চ
কিনু গোয়ালার গলি। দোতলা বাড়ির লোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর পথের ধারেই। লোনা-ধরা দেওয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি, মাঝে মাঝে স্যাঁতা-পড়া দাগ। মার্কিন থানের মার্কা একখানা ছবি সিদ্ধিদাতা গণেশের দরজার ’পরে আঁটা। আমি ছাড়া ঘরে থাকে আরেকটা জীব এক ভাড়াতেই, সেটা টিকটিকি। তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু, নেই তার অন্নের অভাব। বেতন পঁচিশ টাকা, সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি। খেতে পাই দত্তদের বাড়ি ছেলেকে পড়িয়ে। শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই, সন্ধেটা কাটিয়ে আসি, আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে। এঞ্জিনের ধস্ ধস্, বাঁশির আওয়াজ, যাত্রীর ব্যস্ততা, কুলি-হাঁকাহাঁকি। সাড়ে দশ বেজে যায়, তার পরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার। ধলেশ্বরীনদীতীরে পিসিদের গ্রাম। তাঁর দেওরের মেয়ে, অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক। লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল– সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে। মেয়েটা তো রক্ষে পেলে, আমি তথৈবচ। ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসাযাওয়া– পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর। বর্ষা ঘন ঘোর। ট্রামের খরচা বাড়ে, মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়। গলিটার কোণে কোণে জমে ওঠে পচে ওঠে আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি, মাছের কান্কা, মরা বেড়ালের ছানা, ছাইপাঁশ আরো কত কী যে! ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়া মাইনের মতো, বহু ছিদ্র তার। আপিসের সাজ গোপীকান্ত গোঁসাইয়ের মনটা যেমন, সর্বদাই রসসিক্ত থাকে। বাদলের কালো ছায়া স্যাঁৎসেঁতে ঘরটাতে ঢুকে কলে-পড়া জন্তুর মতন মূর্ছায় অসাড়। দিন রাত মনে হয়, কোন্ আধমরা জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি। গলির মোড়েই থাকে কান্তবাবু, যত্নে-পাট-করা লম্বা চুল, বড়ো বড়ো চোখ, শৌখিন মেজাজ। কর্নেট বাজানো তার শখ। মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠে এ গলির বীভৎস বাতাসে– কখনো গভীর রাতে, ভোরবেলা আধো অন্ধকারে, কখনো বৈকালে ঝিকিমিকি আলোয় ছায়ায়। হঠাৎ সন্ধ্যায় সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান, সমস্ত আকাশে বাজে অনাদি কালের বিরহবেদনা। তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে এ গলিটা ঘোর মিছে, দুর্বিষহ, মাতালের প্রলাপের মতো। হঠাৎ খবর পাই মনে আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই। বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে ছেঁড়াছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে এক বৈকুণ্ঠের দিকে। এ গান যেখানে সত্য অনন্ত গোধূলিলগ্নে সেইখানে বহি চলে ধলেশ্বরী; তীরে তমালের ঘন ছায়া; আঙিনাতে যে আছে অপেক্ষা ক’রে, তার পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।
পুনশ্চ
উপরে যাবার সিঁড়ি, তারি নীচে দক্ষিণের বারান্দায় নীলমণি মাস্টারের কাছে সকালে পড়তে হত ইংলিশ রীডার। ভাঙা পাঁচিলের কাছে ছিল মস্ত তেঁতুলের গাছ। ফল পাকবার বেলা। ডালে ডালে ঝপাঝপ বাঁদরের হ’ত লাফালাফি। ইংরেজি বানান ছেড়ে দুই চক্ষু ছুটে যেত লেজ-দোলা বাঁদরের দিকে। সেই উপলক্ষে– আমার বুদ্ধির সঙ্গে রাঙামুখো বাঁদরের নির্ভেদ নির্ণয় করে মাস্টার দিতেন কানমলা। ছুটি হলে পরে শুরু হত আমার মাস্টারি উদ্ভিদ্-মহলে। ফলসা চালতা ছিল, ছিল সার-বাঁধা সুপুরির গাছ। অনাহূত জন্মেছিল কী করে কুলের এক চারা বাড়ির গা ঘেঁষে; সেটাই আমার ছাত্র ছিল। ছড়ি দিয়ে মারতেম তাকে। বলতেম, "দেখ্ দেখি বোকা, উঁচু ফলসার গাছে ফল ধরে গেল– কোথাকার বেঁটে কুল উন্নতির উৎসাহই নেই।’ শুনেছি বাবার মুখে যত উপদেশ তার মধ্যে বার বার "উন্নতি’ কথাটা শোনা যেত। ভাঙা বোতলের ঝুড়ি বেচে শেষকালে কে হয়েছে লক্ষপতি ধনী সেই গল্প শুনে শুনে উন্নতি যে কাকে বলে দেখেছি সুস্পষ্ট তার ছবি। বড়ো হওয়া চাই– অর্থাৎ, নিতান্ত পক্ষে হতে হবে বাজিদপুরের ভজু মল্লিকের জুড়ি। ফলসার ফলে ভরা গাছ বাগান-মহলে সেই ভজু মহাজন। চারাটাকে রোজ বোঝাতেম, ওরই মতো বড়ো হতে হবে। কাঠি দিয়ে মাপি তাকে এবেলা ওবেলা– আমারি কেবল রাগ বাড়ে, আর কিছু বাড়ে না তো। সেই কাঠি দিয়ে তাকে মারি শেষে সপাসপ্ জোরে– একটু ফলে নি তাতে ফল। কান-মলা যত দিই পাতাগুলো ম’লে ম’লে, ততই উন্নতি তার কমে। এ দিকে ছিলেন বাবা ইন্কম্-ট্যাক্সো-কালেক্টার, বদলি হলেন বর্ধমান ডিভিজনে। উচ্চ ইংরেজির স্কুলে পড়া শুরু করে উচ্চতার পূর্ণ পরিণতি কোলকাতা গিয়ে। বাবার মৃত্যুর পরে সেক্রেটারিয়েটে উন্নতির ভিত্তি ফাঁদা গেল। বহুকষ্টে বহু ঋণ করে বোনের দিয়েছি বিয়ে। নিজের বিবাহ প্রায় টার্মিনসে এল আগামী ফাল্গুন মাসে নবমী তিথিতে। নববসন্তের হাওয়া ভিতরে বাইরে বইতে আরম্ভ হল যেই এমন সময়ে, রিডাক্শান্। পোকা-খাওয়া কাঁচা ফল বাইরেতে দিব্যি টুপ্টুপে, ঝুপ্ করে খসে পড়ে বাতাসের এক দমকায়, আমার সে দশা। বসন্তের আয়োজনে যে একটু ত্রুটি হল সে কেবল আমারি কপালে। আপিসের লক্ষ্মী ফিরালেন মুখ, ঘরের লক্ষ্মীও স্বর্ণকমলের খোঁজে অন্যত্র হলেন নিরুদ্দেশ। সার্টিফিকেটের তাড়া হাতে, শুক্নো মুখ, চোখ গেছে বসে, তুবড়ে গিয়েছে পেট, জুতোটার তলা ছেঁড়া, দেহের বর্ণের সঙ্গে চাদরের ঘুচে গেছে বর্ণভেদ– ঘুরে মরি বড়োলোকদের দ্বারে। এমন সময় চিঠি এল ভজু মহাজন দেনায় দিয়েছে ক্রোক ভিটেবাড়িখানা। বাড়ি গিয়ে উপরের ঘরে জানলা খুলতে সেটা ডালে ঠেকে গেল। রাগ হল মনে– ঠেলাঠেলি করে দেখি, আরে আরে ছাত্র যে আমার! শেষকালে বড়োই তো হল, উন্নতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিলে ভজু মল্লিকেরই মতো আমার দুয়ারে দিয়ে হানা।
পুনশ্চ
ম্যাট্রিকুলেশনে পড়ে ব্যঙ্গসুচতুর বটেকৃষ্ট, ভীরু ছেলেদের বিভীষিকা। একদিন কী কারণে সুনীতকে দিয়েছিল উপাধি "পরমহংস’ ব’লে। ক্রমে সেটা হল "পাতিহাঁস’। শেষকালে হল "হাঁসখালি’– কোনো তার অর্থ নেই, সেই তার খোঁচা। আঘাতকে ডেকে আনে যে নিরীহ আঘাতকে করে ভয়। নিষ্ঠুরের দল বাড়ে, ছোঁয়াচ লাগায় অট্টহাসে। ব্যঙ্গরসিকের যত অংশ-অবতার নিষ্কাম বিদ্রূপসূচি বিঁধে অহৈতুক বিদ্বেষেতে সুনীতকে করে জরজর। একদিন মুক্তি পেল সে বেচারা, বেরোল ইস্কুল থেকে। তার পরে গেল বহুদিন– তবু যেন নাড়ীতে জড়িয়ে ছিল সেদিনের সশঙ্ক সংকোচ। জীবনে অন্যায় যত, হাস্যবক্র যত নির্দয়তা, তারি কেন্দ্রস্থলে বটেকৃষ্ট রেখে গেছে কালো স্থূল বিগ্রহ আপন। সে কথা জানত বটু, সুনীতের এই অন্ধ ভয়টাকে মাঝে মাঝে নাড়া দিয়ে পেত সুখ হিংস্র ক্ষমতার অহংকারে; ডেকে যেত সেই পুরাতন নামে, হেসে যেত খলখল হাসি। বি. এল. পরীক্ষা দিয়ে সুনীত ধরেছে ওকালতি, ওকালতি ধরল না তাকে। কাজের অভাব ছিল, সময়ের অভাব ছিল না– গান গেয়ে সেতার বাজিয়ে ছুটি ভরে যেত। নিয়ামৎ ওস্তাদের কাছে হ’ত তার সুরের সাধনা। ছোটো বোন সুধা, ডায়োসিসনের বি. এ. গণিতে সে এম. এ. দিবে এই তার পণ। দেহ তার ছিপ্ছিপে, চলা তার চটুল চকিত, চশমার নীচে চোখে তার ঝলমল কৌতুকের ছটা– দেহমন কূলে কূলে ভরা তার হাসিতে খুশিতে। তারি এক ভক্ত সখী নাম উমারানী– শান্ত কণ্ঠস্বর, চোখে স্নিগ্ধ কালো ছায়া, দুটি দুটি সরু চুড়ি সুকুমার দুটি তার হাতে। পাঠ্য ছিল ফিলজফি, সে কথা জানাতে তার বিষম সংকোচ। দাদার গোপন কথাখানা সুধার ছিল না অগোচর। চেপে রেখেছিল হাসি, পাছে হাসি তীব্র হয়ে বাজে তার মনে। রবিবার চা খেতে বন্ধুকে ডেকেছিল। সেদিন বিষম বৃষ্টি, রাস্তা গলি ভেসে যায় জলে, একা জানালার পাশে সুনীত সেতারে আলাপ করেছে শুরু সুরট-মল্লার। মন জানে উমা আছে পাশের ঘরেই। সেই-যে নিবিড় জানাটুকু বুকের স্পন্দনে মিলে সেতারের তারে তারে কাঁপে। হঠাৎ দাদার ঘরে ঢুকে সেতারটা কেড়ে নিয়ে বলে সুধা, "উমার বিশেষ অনুরোধ গান শোনাতেই হবে, নইলে সে ছাড়ে না কিছুতে।’ লজ্জায় সখীর মুখ রাঙা, এ মিথ্যা কথার কী করে যে প্রতিবাদ করা যায় ভেবে সে পেল না। সন্ধ্যার আগেই অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে; থেকে থেকে বাদল বাতাসে দরজাটা ব্যস্ত হয়ে ওঠে, বৃষ্টির ঝাপ্টা লাগে কাঁচের সাশিতে; বারান্দার টব থেকে মৃদুগন্ধ দেয় জুঁইফুল; হাঁটুজল জমেছে রাস্তায়, তারি ’পর দিয়ে মাঝে মাঝে ছলো ছলো শব্দে চলে গাড়ি। দীপালোকহীন ঘরে সেতারের ঝংকারের সাথে সুনীত ধরেছে গান নটমল্লারের সুরে– আওয়ে পিয়রওয়া, রিমিঝিমি বরখন লাগে! সুরের সুরেন্দ্রলোকে মন গেছে চলে, নিখিলের সব ভাষা মিলে গেছে অখণ্ড সংগীতে। অন্তহীন কালসরোবরে মাধুরীর শতদল– তার ’পরে যে রয়েছে একা বসে চেনা যেন তবু সে অচেনা। সন্ধ্যা হল বৃষ্টি থেমে গেছে; জ্বলেছে পথের বাতি। পাশের বাড়িতে কোন্ ছেলে দুলে দুলে চেঁচিয়ে ধরেছে তার পরীক্ষার পড়া। এমন সময় সিঁড়ি থেকে অট্টহাস্যে এল হাঁক, "কোথা ওরে, কোথা গেল হাঁসখালি!’ মাংসলপৃথুলদেহ বটেকৃষ্ট স্ফীতরক্তচোখ ঘরে এসে দেখে সুনীত দাঁড়িয়ে দ্বারে নিঃসংকোচ স্তব্ধ ঘৃণা নিয়ে স্থূল বিদ্রূপের ঊর্ধ্বে ইন্দ্রের উদ্যত বজ্র যেন। জোর করে হেসে উঠে কী কথা বলতে গেল বটু, সুনীত হাঁকল "চুপ’– অকস্মাৎ বিদলিত ভেকের ডাকের মতো হাসি গেল থেমে।
পুনশ্চ
টি. এস. এলিয়ট’-এর The Journey of the Magi-নামক কবিতার অনুবাদ
কন্কনে ঠাণ্ডায় আমাদের যাত্রা– ভ্রমণটা বিষম দীর্ঘ, সময়টা সব চেয়ে খারাপ, রাস্তা ঘোরালো, ধারালো বাতাসের চোট, একেবারে দুর্জয় শীত। ঘাড়ে ক্ষত, পায়ে ব্যথা, মেজাজ-চড়া উটগুলো শুয়ে শুয়ে পড়ে গলা বরফে। মাঝে মাঝে মন যায় বিগড়ে যখন মনে পড়ে পাহাড়তলিতে বসন্তমঞ্জিল, তার চাতাল, আর শর্বতের পেয়ালা হাতে রেশমি সাজে যুবতীর দল। এ দিকে উটওয়ালারা গাল পাড়ে, গন্গন্ করে রাগে, ছুটে পালায় মদ আর মেয়ের খোঁজে। মশাল যায় নিভে, মাথা রাখবার জায়গা জোটে না। নগরে যাই, সেখানে বৈরিতা; নগরীতে সন্দেহ। গ্রামগুলো নোংরা, তারা চড়া দাম হাঁকে। কঠিন মুশকিল। শেষে ঠাওরালেম চলব সারারাত, মাঝে মাঝে নেব ঝিমিয়ে আর কানে কানে কেউ বা গান গাবে– এ সমস্তই পাগলামি। ভোরের দিকে এলেম, যেখানে মিঠে শীত সেই পাহাড়ের খদে; সেখানে বরফ-সীমার নীচেটা ভিজে-ভিজে, ঘন গাছ-গাছালির গন্ধ। নদী চলেছে ছুটে, জলযন্ত্রের চাকা আঁধারকে মারছে চাপড়। দিগন্তের গায়ে তিনটে গাছ দাঁড়িয়ে, বুড়ো সাদা ঘোড়াটা মাঠ বেয়ে দৌড় দিয়েছে। পৌঁছলেম শরাবখানায়, তার কপাটের মাথায় আঙুরলতা। দুজন মানুষ খোলা দরোজার কাছে পাশা খেলছে টাকার লোভে, পা দিয়ে ঠেলছে শূন্য মদের কুপো। কোনো খবরই মিলল না সেখানে, চললেম আরো আগে। যেতে যেতে সন্ধে হল; সময় পেরিয়ে যায় যায়, তখন খুঁজে পেলেম জায়গাটা– বলা যেতে পারে ব্যাপারটা তৃপ্তিজনক। মনে পড়ে এ-সব ঘটেছে অনেক কাল আগে, আবার ঘটে যেন এই ইচ্ছে, কিন্তু লিখে রাখো– এই লিখে রাখো– এত দূরে যে আমাদের টেনে নিয়েছিল সে কি জন্মের সন্ধানে না মৃত্যুর। জন্ম একটা হয়েছিল বটে– প্রমাণ পেয়েছি, সন্দেহ নেই। এর আগে তো জন্মও দেখেছি, মৃত্যুও– মনে ভাবতেম তারা এক নয়। কিন্তু এই-যে জন্ম এ বড়ো কঠোর– দারুণ এর যাতনা, মৃত্যুর মতো, আমাদের মৃত্যুর মতোই। এলেম ফিরে আপন আপন দেশে, এই আমাদের রাজত্বগুলোয় আর কিন্তু স্বস্তি নেই সেই পুরানো বিধিবিধানে যার মধ্যে আছে সব অনাত্মীয় আপন দেবদেবী আঁকড়ে ধ’রে। আর-একবার মরতে পারলে আমি বাঁচি।
পুনশ্চ
প্রাঙ্গণে নামল অকালসন্ধ্যার ছায়া সূর্যগ্রহণের কালিমার মতো। উঠল ধ্বনি : খোলো দ্বার! প্রাণপুরুষ ছিল ঘরের মধ্যে, সে কেঁপে উঠল চমক খেয়ে। দরজা ধরল চেপে, আগলের উপর আগল লাগল। কম্পিতকণ্ঠে বললে, কে তুমি। মেঘমন্দ্র-ধ্বনি এল : আমি মাটি-রাজত্বের দূত, সময় হয়েছে, এসেছি মাটির দেনা আদায় করতে। ঝন্ঝন্ বেজে উঠল দ্বারের শিকল, থরথর কাঁপল প্রাচীর, হায়-হায় করে ঘরের হাওয়া। নিশাচরের ডানার ঝাপট আকাশে আকাশে নিশীথিনীর হৃৎকম্পনের মতো। ধক্ধক্ ধক্ধক্ আঘাতে খান্খান্ হল দ্বারের আগল, কপাট পড়ল ভেঙে। কম্পমান কণ্ঠে প্রাণ বললে, হে মাটি, হে নিষ্ঠুর, কী চাও তুমি? দূত বললে, আমি চাই দেহ। দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে প্রাণ; বললে : এতকাল আমার লীলা এই দেহে, এর অণুতে অণুতে আমার নৃত্য, নাড়ীতে নাড়ীতে ঝংকার, মুহূর্তেই কি উৎসব দেবে ভেঙে– দীর্ণ হয়ে যাবে বাঁশি, চূর্ণ হয়ে যাবে মৃদঙ্গ, ডুবে যাবে এর দিনগুলি অতল রাত্রির অন্ধকারে? দূত বললে, ঋণে বোঝাই তোমার এই দেহ, শোধ করবার দিন এল– মাটির ভাণ্ডারে ফিরবে তোমার দেহের মাটি। প্রাণ বললে, মাটির ঋণ শোধ করে নিতে চাও, নাও– কিন্তু তার চেয়ে বেশি চাও কেন? দূত বিদ্রূপ করে বললে, এই তো তোমার নিঃস্ব দেহ, কৃশ ক্লান্ত কৃষ্ণচতুর্দশীর চাঁদ– এর মধ্যে বাহুল্য আছে কোথায়? প্রাণ বললে, মাটিই তোমার, রূপ তো তোমার নয়। অট্টহাস্যে হেসে উঠল দূত; বললে, যদি পার দেহ থেকে রূপ নাও ছাড়িয়ে। প্রাণ বললে, পারবই, এই পণ আমার। প্রাণের মিতা মন। সে গেল আলোক-উৎসের তীর্থে। বললে জোড়হাত করে : হে মহাজ্যোতি, হে চিরপ্রকাশ, হে রূপের কল্পনির্ঝর, স্থূল মাটির কাছে ঘটিয়ো না তোমার সত্যের অপলাপ– তোমার সৃষ্টির অপমান। তোমার রূপকে লুপ্ত করে সে কোন্ অধিকারে। আমাকে কাঁদায় কার অভিশাপে। মন বসল তপস্যায়। কেটে গেল হাজার বছর, লক্ষ বছর– প্রাণের কান্না থামে না। পথে পথে বাটপাড়ি, রূপ চুরি যায় নিমেষে নিমেষে। সমস্ত জীবলোক থেকে প্রার্থনা ওঠে দিনরাত : হে রূপকার, হে রূপরসিক, যে দান করেছ নিজহাতে জড় দানব তাকে কেড়ে নিয়ে যায় যে। ফিরিয়ে আনো তোমার আপন ধন। যুগের পর যুগ গেল, নেমে এল আকাশবাণী : মাটির জিনিস ফিরে যায় মাটিতে, ধ্যানের রূপ রয়ে যায় আমার ধ্যানে। বর দিলেম হারা রূপ ধরা দেবে, কায়ামুক্ত ছায়া আসবে আলোর বাহু ধরে তোমার দৃষ্টির উৎসবে। রূপ এল ফিরে দেহহীন ছবিতে, উঠল শঙ্খধ্বনি। ছুটে এল চারি দিক থেকে রূপের প্রেমিক। আবার দিন যায়, বৎসর যায়। প্রাণের কান্না থামে না। আরো কী চাই। প্রাণ জোড়হাত করে বলে : মাটির দূত আসে, নির্মম হাতে কণ্ঠযন্ত্রে কুলুপ লাগায়– বলে "কণ্ঠনালী আমার’। শুনে আমি বলি, মাটির বাঁশিখানি তোমার বটে, কিন্তু বাণী তো তোমার নয়। উপেক্ষা করে সে হাসে। শোনো আমার ক্রন্দন, হে বিশ্ববাণী, জয়ী হবে কি জড়মাটির অহংকার– সেই অন্ধ সেই মূক তোমার বাণীর উপর কি চাপা দেবে চিরমূকত্ব, যে বাণী অমৃতের বাহন তার বুকের উপর স্থাপন করবে জড়ের জয়স্তম্ভ? শোনা গেল আকাশ থেকে : ভয় নেই। বায়ুসমুদ্রে ঘুরে ঘুরে চলে অশ্রুতবাণীর চক্রলহরী, কিছুই হারায় না। আশীর্বাদ এই আমার, সার্থক হবে মনের সাধনা; জীর্ণকণ্ঠ মিশবে মাটিতে, চিরজীবী কণ্ঠস্বর বহন করবে বাণী। মাটির দানব মাটির রথে যাকে হরণ করে চলেছিল মনের রথ সেই নিরুদ্দেশ বাণীকে আনলে ফিরিয়ে কণ্ঠহীন গানে। জয়ধ্বনি উঠল মর্তলোকে। দেহমুক্ত রূপের সঙ্গে যুগলমিলন হল দেহমুক্ত বাণীর প্রাণতরঙ্গিণীর তীরে, দেহনিকেতনের প্রাঙ্গণে।
পুনশ্চ
রামানন্দ পেলেন গুরুর পদ– সারাদিন তার কাটে জপে তপে, সন্ধ্যাবেলায় ঠাকুরকে ভোজ্য করেন নিবেদন, তার পরে ভাঙে তাঁর উপবাস যখন অন্তরে পান ঠাকুরের প্রসাদ। সেদিন মন্দিরে উৎসব– রাজা এলেন, রানী এলেন, এলেন পণ্ডিতেরা দূর দূর থেকে, এলেন নানাচিহ্নধারী নানা সম্প্রদায়ের ভক্তদল। সন্ধ্যাবেলায় স্নান শেষ করে। রামানন্দ নৈবেদ্য দিলেন ঠাকুরের পায়ে– প্রসাদ নামল না তাঁর অন্তরে, আহার হল না সেদিন। এমনি যখন দুই সন্ধ্যা গেল কেটে, হৃদয় রইল শুষ্ক হয়ে, গুরু বললেন মাটিতে ঠেকিয়ে মাথা, "ঠাকুর, কী অপরাধ করেছি।’ ঠাকুর বললেন, "আমার বাস কি কেবল বৈকুণ্ঠে। সেদিন আমার মন্দিরে যারা প্রবেশ পায় নি আমার স্পর্শ যে তাদের সর্বাঙ্গে, আমারই পাদোদক নিয়ে প্রাণপ্রবাহিণী বইছে তাদের শিরায়। তাদের অপমান আমাকে বেজেছে; আজ তোমার হাতের নৈবেদ্য অশুচি।’ "লোকস্থিতি রক্ষা করতে হবে যে প্রভু’ ব’লে গুরু চেয়ে রইলেন ঠাকুরের মুখের দিকে। ঠাকুরের চক্ষু দীপ্ত হয়ে উঠল; বললেন, "যে লোকসৃষ্টি স্বয়ং আমার, যার প্রাঙ্গণে সকল মানুষের নিমন্ত্রণ, তার মধ্যে তোমার লোকস্থিতির বেড়া তুলে আমার অধিকারে সীমা দিতে চাও এতবড়ো স্পর্ধা!’ রামানন্দ বললেন, "প্রভাতেই যাব এই সীমা ছেড়ে, দেব আমার অহংকার দূর করে তোমার বিশ্বলোকে।’ তখন রাত্রি তিন-প্রহর, আকাশের তারাগুলি যেন ধ্যানমগ্ন। গুরুর নিদ্রা গেল ভেঙে; শুনতে পেলেন, "সময় হয়েছে, ওঠো, প্রতিজ্ঞা পালন করো।’ রামানন্দ হাতজোড় করে বললেন, "এখনো রাত্রি গভীর, পথ অন্ধকার, পাখিরা নীরব। প্রভাতের অপেক্ষায় আছি।’ ঠাকুর বললেন, "প্রভাত কি রাত্রির অবসানে। যখনি চিত্ত জেগেছে, শুনেছ বাণী, তখনি এসেছে প্রভাত। যাও তোমার ব্রতপালনে।’ রামানন্দ বাহির হলেন পথে একাকী, মাথার উপরে জাগে ধ্রুবতারা। পার হয়ে গেলেন নগর, পার হয়ে গেলেন গ্রাম। নদীতীরে শ্মশান, চণ্ডাল শবদাহে ব্যাপৃত। রামানন্দ দুই হাত বাড়িয়ে তাকে নিলেন বক্ষে। সে ভীত হয়ে বললে, "প্রভু, আমি চণ্ডাল, নাভা আমার নাম, হেয় আমার বৃত্তি, অপরাধী করবেন না আমাকে।’ গুরু বললেন, "অন্তরে আমি মৃত, অচেতন আমি, তাই তোমাকে দেখতে পাই নি এতকাল, তাই তোমাকেই আমার প্রয়োজন– নইলে হবে না মৃতের সৎকার।’ চললেন গুরু আগিয়ে। ভোরের পাখি উঠল ডেকে, অরুণ-আলোয় শুকতারা গেল মিলিয়ে। কবীর বসেছেন তাঁর প্রাঙ্গণে, কাপড় বুনছেন আর গান গাইছেন গুন্ গুন্ স্বরে। রামানন্দ বসলেন পাশে, কণ্ঠ তাঁর ধরলেন জড়িয়ে। কবীর ব্যস্ত হয়ে বললেন, "প্রভু, জাতিতে আমি মুসলমান, আমি জোলা, নীচ আমার বৃত্তি।’ রামানন্দ বললেন, "এতদিন তোমার সঙ্গ পাই নি বন্ধু, তাই অন্তরে আমি নগ্ন, চিত্ত আমার ধুলায় মলিন, আজ আমি পরব শুচিবস্ত্র তোমার হাতে– আমার লজ্জা যাবে দূর হয়ে।’ শিষ্যেরা খুঁজতে খুঁজতে এল সেখানে, ধিক্কার দিয়ে বললে, "এ কী করলেন প্রভু!’ রামানন্দ বললেন, "আমার ঠাকুরকে এতদিন যেখানে হারিয়েছিলুম আজ তাঁকে সেখানে পেয়েছি খুঁজে।’ সূর্য উঠল আকাশে আলো এসে পড়ল গুরুর আনন্দিত মুখে।
পুনশ্চ
শঙ্করলাল দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত। শাণিত তাঁর বুদ্ধি শ্যেনপাখির চঞ্চুর মতো, বিপক্ষের যুক্তির উপর পড়ে বিদ্যুদ্বেগে– তার পক্ষ দেয় ছিন্ন করে, ফেলে তাকে ধুলোয়। রাজবাড়িতে নৈয়ায়িক এসেছে দ্রাবিড় থেকে। বিচারে যার জয় হবে সে পাবে রাজার জয়পত্রী। আহ্বান স্বীকার করেছেন শঙ্কর, এমন সময় চোখে পড়ল পাগড়ি তাঁর মলিন। গেলেন রঙরেজির ঘরে। কুসুমফুলের খেত, মেহেদিবেড়ায় ঘেরা। প্রান্তে থাকে জসীম রঙরেজি। মেয়ে তার আমিনা, বয়স তার সতেরো। সে গান গায় আর রঙ বাঁটে, রঙের সঙ্গে রঙ মেলায়। বেণীতে তার লাল সুতোর ঝালর, চোলি তার বাদামি রঙের, শাড়ি তার আশমানি। বাপ কাপড় রাঙায়, রঙের বাটি জুগিয়ে দেয় আমিনা। শঙ্কর বললেন, জসীম, পাগড়ি রাঙিয়ে দাও জাফরানি রঙে, রাজসভায় ডাক পড়েছে। কুল্ কুল্ করে জল আসে নালা বেয়ে কুসুমফুলের খেতে; আমিনা পাগড়ি ধুতে গেল নালার ধারে তুঁত গাছের ছায়ায় বসে। ফাগুনের রৌদ্র ঝলক দেয় জলে, ঘুঘু ডাকে দূরের আমবাগানে। ধোওয়ার কাজ হল, প্রহর গেল কেটে। পাগড়ি যখন বিছিয়ে দিল ঘাসের ’পরে রঙরেজিনী দেখল তারি কোণে লেখা আছে একটি শ্লোকের একটি চরণ– "তোমার শ্রীপদ মোর ললাটে বিরাজে’। বসে বসে ভাবল অনেক ক্ষণ, ঘুঘু ডাকতে লাগল আমের ডালে। রঙিন সুতো ঘরের থেকে এনে আরেক চরণ লিখে দিল– "পরশ পাই নে তাই হৃদয়ের মাঝে’। দুদিন গেল কেটে। শঙ্কর এল রঙরেজির ঘরে। শুধালো, পাগড়িতে কার হাতের লেখা? জসীমের ভয় লাগল মনে। সেলাম করে বললে, "পণ্ডিতজি, অবুঝ আমার মেয়ে, মাপ করো ছেলেমানুষি। চলে যাও রাজসভায়– সেখানে এ লেখা কেউ দেখবে না, কেউ বুঝবে না।’ শঙ্কর আমিনার দিকে চেয়ে বললে, "রঙরেজিনী, অহংকারের-পাকে-ঘেরা ললাট থেকে নামিয়ে এনেছ শ্রীচরণের স্পর্শখানি হৃদয়তলে তোমার হাতের রাঙা রেখার পথে। রাজবাড়ির পথ আমার হারিয়ে গেল, আর পাব না খুঁজে।’
পুনশ্চ
বাজিরাও পেশোয়ার অভিষেক হবে কাল সকালে। কীর্তনী এসেছে গ্রামের থেকে, মন্দিরে ছিল না তার স্থান। সে বসেছে অঙ্গনের এক কোণে পিপুল গাছের তলায়। একতারা বাজায় আর কেবল সে ফিরে ফিরে বলে, "ঠাকুর, তোমায় কে বসালো কঠিন সোনার সিংহাসনে।’ রাত তখন দুই প্রহর, শুক্লপক্ষের চাঁদ গেছে অস্তে। দূরে রাজবাড়ির তোরণে বাজছে শাঁখ শিঙে জগঝম্প, জ্বলছে প্রদীপের মালা। কীর্তনী গাইছে, "তমালকুঞ্জে বনের পথে শ্যামল ঘাসের কান্না এলেম শুনে, ধুলোয় তারা ছিল যে কান পেতে, পায়ের চিহ্ন বুকে পড়বে আঁকা এই ছিল প্রত্যাশা।’ আরতি হয়ে গেছে সারা– মন্দিরের দ্বার তখন বন্ধ, ভিড়ের লোক গেছে রাজবাড়িতে। কীর্তনী আপন মনে গাইছে– "প্রাণের ঠাকুর, এরা কি পাথর গেঁথে তোমায় রাখবে বেঁধে। তুমি যে স্বর্গ ছেড়ে নামলে ধুলোয় তোমার পরশ আমার পরশ মিলবে ব’লে।’ সেই পিপুল-তলার অন্ধকারে একা একা গাইছিল কীর্তনী, আর শুনছিল আরেকজনা গোপনে– বাজিরাও পেশোয়া। শুনুছিল সে– "তুমি আমায় ডাক দিয়েছ আগল-দেওয়া ঘরের থেকে, আমায় নিয়ে পথের পথিক হবে। ঘুচবে তোমার নির্বাসনের ব্যথা, ছাড়া পাবে হৃদয়-মাঝে। থাক্ গে ওরা পাথরখানা নিয়ে পাথরের বন্দীশালায় অহংকারের-কাঁটার-বেড়া-ঘেরা।’ রাত্রি প্রভাত হল। শুকতারা অরুণ-আলোয় উদাসী। তোরণদ্বারে বাজল বাঁশি বিভাসে ললিতে। অভিষেকের স্নান হবে, পুরোহিত এল তীর্থবারি নিয়ে। রাজবাড়ির ঠাকুরঘর শূন্য। জ্বলছে দীপশিখা, পূজার উপচার পড়ে আছে– বাজিরাও পেশোয়া গেছে চলে পথের পথিক হয়ে।
পুনশ্চ
রবিদাস চামার ঝাঁট দেয় ধুলো। সজন রাজপথ বিজন তার কাছে, পথিকেরা চলে তার স্পর্শ বাঁচিয়ে। গুরু রামানন্দ প্রাতঃস্নান সেরে চলেছেন দেবালয়ের পথে, দূর থেকে রবিদাস প্রণাম করল তাঁকে, ধুলায় ঠেকালো মাথা। রামানন্দ শুধালেন, "বন্ধু, কে তুমি।’ উত্তর পেলেন, "আমি শুক্নো ধুলো– প্রভু, তুমি আকাশের মেঘ, ঝরে যদি তোমার প্রেমের ধারা গান গেয়ে উঠবে বোবা ধুলো রঙ-বেরঙের ফুলে।’ রামানন্দ নিলেন তাকে বুকে, দিলেন তাকে প্রেম। রবিদাসের প্রাণের কুঞ্জবনে লাগল যেন গীতবসন্তের হাওয়া। চিতোরের রাণী, ঝালি তাঁর নাম। গান পৌঁছল কানে, তাঁর মন করে দিল উদাস! ঘরের কাজে মাঝে মাঝে দু চোখ দিয়ে জল পড়ে ঝ’রে। মান গেল তাঁর কোথায় ভেসে। রবিদাস চামারের কাছে হরিপ্রেমের দীক্ষা নিলেন রাজরানী। স্মৃতিশিরোমণি রাজকুলের বৃদ্ধ পুরোহিত বললে, "ধিক্ মহারানী, ধিক্। জাতিতে অন্ত্যজ রবিদাস, ফেরে পথে পথে, ঝাঁট দেয় ধুলো, তাকে তুমি প্রণাম করলে গুরু ব’লে– ব্রাহ্মণের হেঁট হল মাথা এ রাজ্যে তোমার।’ রানী বললেন, "ঠাকুর, শোনো তবে, আচারের হাজার গ্রন্থি দিনরাত্রি বাঁধ কেবল শক্ত করে– প্রেমের সোনা কখন পড়ল খসে জানতে পার নি তা। আমার ধুলোমাখা গুরু ধুলোর থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে। অর্থহারা বাঁধনগুলোর গর্বে, ঠাকুর, থাকো তুমি কঠিন হয়ে। আমি সোনার কাঙালিনী ধুলোর সে দান নিলেম মাথায় করে।’
পুনশ্চ
গুরু রামানন্দ স্তব্ধ দাঁড়িয়ে গঙ্গার জলে পূর্বমুখে। তখন জলে লেগেছে সোনার কাঠির ছোঁওয়া, ভোরের হাওয়ায় স্রোত উঠছে ছল্ছল্ করে। রামানন্দ তাকিয়ে আছেন জবাকুসুমসঙ্কাশ সূর্যোদয়ের দিকে। মনে মনে বলছেন, "হে দেব, তোমার যে কল্যাণতম রূপ সে তো আমার অন্তরে প্রকাশ পেল না। ঘোচাও তোমার আবরণ।’ সূর্য উঠল শালবনের মাথার উপর। জেলেরা নৌকায় পাল দিলে তুলে, বকের পাঁতি উড়ে চলেছে সোনার আকাশ বেয়ে ও পারে জলার দিকে। এখনো স্নান হল না সারা। শিষ্য শুধালো, "বিলম্ব কেন প্রভু, পূজার সময় যায় বয়ে।’ রামানন্দ উত্তর করলেন, "শুচি হয় নি তনু, গঙ্গা রইলেন আমার হৃদয় থেকে দূরে।’ শিষ্য বসে ভাবে, এ কেমন কথা। সর্ষেখেতে রৌদ্র ছড়িয়ে গেল। মালিনী খুলেছে ফুলের পসরা পথের ধারে, গোয়ালিনী যায় দুধের কলস মাথায় নিয়ে। গুরুর কী হল মনে, উঠলেন জল ছেড়ে। চললেন বনঝাউ ভেঙে গাঙশালিকের কোলাহলের মধ্য দিয়ে। শিষ্য শুধালো, "কোথায় যাও প্রভু, ও দিকে তো নেই ভদ্রপাড়া।’ গুরু বললেন, "চলেছি স্নানসমাপনের পথে।’ বালুচরের প্রান্তে গ্রাম। গলির মধ্যে প্রবেশ করলেন গুরু। সেখানে তেঁতুল গাছের ঘন ছায়া, শাখায় শাখায় বানরদলের লাফালাফি। গলি পৌঁছয় ভাজন মুচির ঘরে। পশুর চামড়ার গন্ধ আসছে দূর থেকে। আকাশে চিল উড়ছে পাক দিয়ে, রোগা কুকুর হাড় চিবোচ্ছে পথের পাশে। শিষ্য বললে, "রাম! রাম!’ ভ্রূকুটি করে দাঁড়িয়ে রইল গ্রামের বাইরে। ভাজন লুটিয়ে পড়ে গুরুকে প্রণাম করলে সাবধানে। গুরু তাকে বুকে নিলেন তুলে। ভাজন ব্যস্ত হয়ে উঠল, "কী করলেন প্রভু, অধমের ঘরে মলিনের গ্লানি লাগল পুণ্যদেহে।’ রামানন্দ বললেন, "স্নানে গেলেম তোমার পাড়া দূরে রেখে, তাই যিনি সবাইকে দেন ধৌত করে তাঁর সঙ্গে মনের মিল হল না। এতক্ষণে তোমার দেহে আমার দেহে বইল সেই বিশ্বপাবনধারা। ভগবান সূর্যকে আজ প্রণাম করতে গিয়ে প্রণাম বেধে গেল। বললেম, হে দেব, তোমার মধ্যে যে জ্যোতি আমার মধ্যেও তিনি, তবু আজ দেখা হল না কেন। এতক্ষণে মিলল তাঁর দর্শন তোমার ললাটে আর আমার ললাটে– মন্দিরে আর হবে না যেতে।’
পুনশ্চ
ত্রিলোকেশ্বরের মন্দির। লোকে বলে স্বয়ং বিশ্বকর্মা তার ভিত-পত্তন করেছিলেন কোন্ মান্ধাতার আমলে, স্বয়ং হনুমান এনেছিলেন তার পাথর বহন করে। ইতিহাসের পণ্ডিত বলেন, এ মন্দির কিরাত জাতের গড়া, এ দেবতা কিরাতের। একদা যখন ক্ষত্রিয় রাজা জয় করলেন দেশ দেউলের আঙিনা পূজারিদের রক্তে গেল ভেসে, দেবতা রক্ষা পেলেন নতুন নামে নতুন পূজাবিধির আড়ালে– হাজার বৎসরের প্রাচীন ভক্তিধারার স্রোত গেল ফিরে। কিরাত আজ অস্পৃশ্য, এ মন্দিরে তার প্রবেশপথ লুপ্ত। কিরাত থাকে সমাজের বাইরে, নদীর পূর্বপারে তার পাড়া। সে ভক্ত, আজ তার মন্দির নেই, তার গান আছে। নিপুণ তার হাত, অভ্রান্ত তার দৃষ্টি। সে জানে কী করে পাথরের উপর পাথর বাঁধে, কী করে পিতলের উপর রুপোর ফুল তোলা যায়– কৃষ্ণশিলায় মূর্তি গড়বার ছন্দটা কী। রাজশাসন তার নয়, অস্ত্র তার নিয়েছে কেড়ে, বেশে বাসে ব্যবহারে সম্মানের চিহ্ন হতে সে বর্জিত, বঞ্চিত সে পুঁথির বিদ্যায়। ত্রিলোকেশ্বর মন্দিরের স্বর্ণচূড়া পশ্চিম দিগন্তে যায় দেখা, চিনতে পারে নিজেদেরই মনের আকল্প, বহু দূরের থেকে প্রণাম করে। কার্তিক পূর্ণিমা, পূজার উৎসব। মঞ্চের উপরে বাজছে বাঁশি মৃদঙ্গ করতাল, মাঠ জুড়ে কানাতের পর কানাত, মাঝে মাঝে উঠেছে ধ্বজা। পথের দুই ধারে ব্যাপারীদের পসরা– তামার পাত্র, রুপোর অলংকার, দেবমূর্তির পট, রেশমের কাপড়; ছেলেদের খেলার জন্যে কাঠের ডমরু, মাটির পুতুল, পাতার বাঁশি; অর্ঘ্যের উপকরণ, ফল মালা ধূপ বাতি, ঘড়া ঘড়া তীর্থবারি। বাজিকর তারস্বরে প্রলাপবাক্যে দেখাচ্ছে বাজি, কথক পড়ছে রামায়ণকথা। উজ্জ্বলবেশে সশস্ত্র প্রহরী ঘুরে বেড়ায় ঘোড়ায় চড়ে; রাজ-অমাত্য হাতির উপর হাওদায়, সম্মুখে বেজে চলেছে শিঙা। কিংখাবে ঢাকা পাল্কিতে ধনীঘরের গৃহিণী, আগে পিছে কিংকরের দল। সন্ন্যাসীর ভিড় পঞ্চবটের তলায়– নগ্ন, জটাধারী, ছাইমাখা; মেয়েরা পায়ের কাছে ভোগ রেখে যায়– ফল, দুধ, মিষ্টান্ন, ঘি, আতপতণ্ডুল। থেকে থেকে আকাশে উঠছে চীৎকারধ্বনি "জয় ত্রিলোকেশ্বরের জয়’। কাল আসবে শুভলগ্নে রাজার প্রথম পূজা, স্বয়ং আসবেন মহারাজা রাজহস্তীতে চড়ে। তাঁর আগমন-পথের দুই ধারে সারি সারি কলার গাছে ফুলের মালা, মঙ্গলঘটে আম্রপল্লব। আর ক্ষণে ক্ষণে পথের ধুলায় সেচন করছে গন্ধবারি। শুক্লত্রয়োদশীর রাত। মন্দিরে প্রথম প্রহরের শঙ্খ ঘণ্টা ভেরী পটহ থেমেছে। আজ চাঁদের উপরে একটা ঘোলা আবরণ, জ্যোৎস্না আজ ঝাপসা– যেন মূর্ছার ঘোর লাগল। বাতাস রুদ্ধ– ধোঁয়া জমে আছে আকাশে, গাছপালাগুলো যেন শঙ্কায় আড়ষ্ট। কুকুর অকারণে আর্তনাদ করছে, ঘোড়াগুলো কান খাড়া করে উঠছে ডেকে কোন্ অলক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ গম্ভীর ভীষণ শব্দ শোনা গেল মাটির নীচে– পাতালে দানবেরা যেন রণদামামা বাজিয়ে দিলে– গুরু-গুরু গুরু-গুরু। মন্দিরে শঙ্খ ঘণ্টা বাজতে লাগল প্রবল শব্দে। হাতি বাঁধা ছিল, তারা বন্ধন ছিঁড়ে গর্জন করতে করতে ছুটল চার দিকে যেন ঘূর্ণি-ঝড়ের মেঘ। তুফান উঠল মাটিতে– ছুটল উট মহিষ গোরু ছাগল ভেড়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পালে পালে। হাজার হাজার দিশাহারা লোক আর্তস্বরে ছুটে বেড়ায়– চোখে তাদের ধাঁধা লাগে, আত্মপরের ভেদ হারিয়ে কে কাকে দেয় দ’লে। মাটি ফেটে ফেটে ওঠে ধোঁয়া, ওঠে গরম জল– ভীম-সরোবরের দিঘি বালির নীচে গেল শুষে। মন্দিরের চূড়ায় বাঁধা বড়ো ঘণ্টা দুলতে দুলতে বাজতে লাগল ঢং ঢং। আচম্কা ধ্বনি থামল একটা ভেঙে-পড়ার শব্দে। পৃথিবী যখন স্তব্ধ হল পূর্ণপ্রায় চাঁদ তখন হেলেছে পশ্চিমের দিকে। আকাশে উঠছে জ্বলে-ওঠা কানাতগুলোর ধোঁয়ার কুণ্ডলী, জ্যোৎস্নাকে যেন অজগর সাপে জড়িয়েছে। পরদিন আত্মীয়দের বিলাপে দিগ্বিদিক যখন শোকার্ত তখন রাজসৈনিকদল মন্দির ঘিরে দাঁড়ালো, পাছে অশুচিতার কারণ ঘটে। রাজমন্ত্রী এল, দৈবজ্ঞ এল, স্মার্ত পণ্ডিত এল। দেখলে বাহিরের প্রাচীর ধূলিসাৎ। দেবতার বেদীর উপরের ছাদ পড়েছে ভেঙে। পণ্ডিত বললে, সংস্কার করা চাই আগামী পূর্ণিমার পূর্বেই, নইলে দেবতা পরিহার করবেন তাঁর মূর্তিকে। রাজা বললেন, "সংস্কার করো।’ মন্ত্রী বললেন, "ওই কিরাতরা ছাড়া কে করবে পাথরের কাজ। ওদের দৃষ্টিকলুষ থেকে দেবতাকে রক্ষা করব কী উপায়ে, কী হবে মন্দিরসংস্কারে যদি মলিন হয় দেবতার অঙ্গমহিমা।’ কিরাতদলপতি মাধবকে রাজা আনলেন ডেকে। বৃদ্ধ মাধব, শুক্লকেশের উপর নির্মল সাদা চাদর জড়ানো– পরিধানে পীতধড়া, তাম্রবর্ণ দেহ কটি পর্যন্ত অনাবৃত, দুই চক্ষু সকরুণ নম্রতায় পূর্ণ। সাবধানে রাজার পায়ের কাছে রাখলে একমুঠো কুন্দফুল, প্রণাম করলে স্পর্শ বাঁচিয়ে। রাজা বললেন, "তোমরা না হলে দেবালয়-সংস্কার হয় না।’ "আমাদের ’পরে দেবতার ওই কৃপা’ এই ব’লে দেবতার উদ্দেশে মাধব প্রণাম জানালে। নৃপতি নৃসিংহরায় বললেন, "চোখ বেঁধে কাজ করা চাই, দেবমূর্তির উপর দৃষ্টি না পড়ে। পারবে?’ মাধব বললে, "অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে কাজ করিয়ে নেবেন অন্তর্যামী। যতক্ষণ কাজ চলবে, চোখ খুলব না।’ বাহিরে কাজ করে কিরাতের দল, মন্দিরের ভিতরে কাজ করে মাধব, তার দুই চক্ষু পাকে পাকে কালো কাপড়ে বাঁধা। দিনরাত সে মন্দিরের বাহিরে যায় না– ধ্যান করে, গান গায়,আর তার আঙুল চলতে থাকে। মন্ত্রী এসে বলে, "ত্বরা করো, ত্বরা করো– তিথির পরে তিথি যায়, কবে লগ্ন হবে উত্তীর্ণ।’ মাধব জোড়হাতে বলে, "যাঁর কাজ তাঁরই নিজের আছে ত্বরা, আমি তো উপলক্ষ।’ অমাবস্যা পার হয়ে শুক্লপক্ষ এল আবার। অন্ধ মাধব আঙুলের স্পর্শ দিয়ে পাথরের সঙ্গে কথা কয়, পাথর তার সাড়া দিতে থাকে। কাছে দাঁড়িয়ে থাকে প্রহরী। পাছে মাধব চোখের বাঁধন খোলে। পণ্ডিত এসে বললে, "একাদশীর রাত্রে প্রথম পূজার শুভক্ষণ। কাজ কি শেষ হবে তার পূর্বে।’ মাধব প্রণাম করে বললে, "আমি কে যে উত্তর দেব। কৃপা যখন হবে সংবাদ পাঠাব যথাসময়ে, তার আগে এলে ব্যাঘাত হবে, বিলম্ব ঘটবে।’ ষষ্ঠী গেল, সপ্তমী পেরোল– মন্দিরের দ্বার দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ে মাধবের শুক্লকেশে। সূর্য অস্ত গেল। পাণ্ডুর আকাশে একাদশীর চাঁদ। মাধব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, "যাও প্রহরী, সংবাদ দিয়ে এসো গে মাধবের কাজ শেষ হল আজ। লগ্ন যেন বয়ে না যায়।’ প্রহরী গেল। মাধব খুলে ফেললে চোখের বন্ধন। মুক্ত দ্বার দিয়ে পড়েছে একাদশী-চাঁদের পূর্ণ আলো দেবমূর্তির উপরে। মাধব হাঁটু গেড়ে বসল দুই হাত জোড় করে, একদৃষ্টে চেয়ে রইল দেবতার মুখে, দুই চোখে বইল জলের ধারা। আজ হাজার বছরের ক্ষুধিত দেখা দেবতার সঙ্গে ভক্তের। রাজা প্রবেশ করলেন মন্দিরে। তখন মাধবের মাথা নত বেদীমূলে। রাজার তলোয়ারে মুহূর্তে ছিন্ন হল সেই মাথা। দেবতার পায়ে এই প্রথম পূজা, এই শেষ প্রণাম।
পুনশ্চ
একই লতাবিতান বেয়ে চামেলি আর মধুমঞ্জরী দশটি বছর কাটিয়েছে গায়ে গায়ে, রোজ সকালে সূর্য-আলোর ভোজে পাতাগুলি মেলে বলেছে "এই তো এসেছি’। অধিকারের দ্বন্দ্ব ছিল ডালে ডালে দুই শরিকে, তবু তাদের প্রাণের আনন্দে রেষারেষির দাগ পড়ে নি কিছু। কখন যে কোন্ কুলগ্নে ওই সংশয়হীন অবোধ চামেলি কোমল সবুজ ডাল মেলে দিল বিজ্লিবাতির লোহার তারে তারে, বুঝতে পারে নি যে ওরা জাত আলাদা। শ্রাবণ মাসের অবসানে আকাশকোণে সাদা মেঘের গুচ্ছগুলি নেমে নেমে পড়েছিল শালের বনে, সেই সময়ে সোনায় রাঙা স্বচ্ছ সকালে চামেলি মেতেছিল অজস্র ফুলের গৌরবে। কোথাও কিছু বিরোধ ছিল না, মৌমাছিদের আনাগোনায় উঠত কেঁপে শিউলিতলার ছায়া। ঘুঘুর ডাকে দুই প্রহরে বেলা হত আলস্যে শিথিল। সেই ভরা শরতের দিনে সূর্য-ডোবার সময় মেঘে মেঘে লাগল যখন নানা রঙের খেয়াল, সেই বেলাতে কখন এল বিজ্লিবাতির অনুচরের দল। চোখ রাঙালো চামেলিটার স্পর্ধা দেখে– শুষ্ক শূন্য আধুনিকের রূঢ় প্রয়োজনের ’পরে নিত্যকালের লীলামধুর নিষ্প্রয়োজন অনধিকার হাত বাড়ালো কেন। তীক্ষ্ণ কুটিল আঁক্শি দিয়ে টেনে টেনে ছিনিয়ে ছিঁড়ে নিল কচি কচি ডালগুলি সব ফুলে-ভরা। এত দিনে বুঝল হঠাৎ অবোধ চামেলিটা মৃত্যু-আঘাত বক্ষে নিয়ে, বিজ্লিবাতির তারগুলো ওই জাত আলাদা।
পুনশ্চ
এল সে জর্মনির থেকে এই অচেনার মাঝখানে, ঝড়ের মুখে নৌকো নোঙর-ছেঁড়া ঠেকল এসে দেশান্তরে। পকেটে নেই টাকা, উদ্বেগ নেই মনে, দিন চলে যায় দিনের কাজে অল্পস্বল্প নিয়ে। যেমন-তেমন থাকে অন্য দেশের সহজ চালে। নেই ন্যূনতা, গুমর কিছুই নেই– মাথা-উঁচু দ্রুত পায়ের চাল। একটুও নেই অকিঞ্চনের অবসাদ। দিনের প্রতি মুহূর্তকে জয় করে সে আপন জোরে, পথের মধ্যে ফেলে দিয়ে যায় সে চলে, চায় না পিছন ফিরে– রাখে না তার এক কণাও বাকি। খেলাধুলা হাসিগল্প যা হয় যেখানে তারি মধ্যে জায়গা সে নেয় সহজ মানুষ। কোথাও কিছু ঠেকে না তার একটুকুও অনভ্যাসের বাধা। একলা বটে, তবুও তো একলা সে নয়। প্রবাসে তার দিনগুলো সব হূহু করে কাটিয়ে দিচ্ছে হালকা মনে। ওকে দেখে অবাক হয়ে থাকি, সব মানুষের মধ্যে মানুষ অভয় অসংকোচ– তার বাড়া ওর নেই তো পরিচয়। দেশের মানুষ এসেছে তার আরেক জনা। ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে যা-খুশি তাই ছবি এঁকে এঁকে যেখানে তার খুশি। সে ছবি কেউ দেখে কিম্বা না’ই দেখে ভালো বলে না’ই বলে– খেয়াল কিছুই নেই। দুইজনেতে পাশাপাশি কাঁকর-ঢালা পথ দিয়ে ওই যাচ্ছে চলে দুই টুকরো শরৎকালের মেঘ। নয় ওরা তো শিকড়-বাঁধা গাছের মতো, ওরা মানুষ– ছুটি ওদের সকল দেশে সকল কালে, কর্ম ওদের সবখানে, নিবাস ওদের সব মানুষের মাঝে। মন যে ওদের স্রোতের মতো সব-কিছুরেই ভাসিয়ে চলে– কোনোখানেই আটকা পড়ে না সে। সব মানুষের ভিতর দিয়ে আনাগোনার বড়ো রাস্তা তৈরি হবে, এরাই আছে সেই রাস্তার কাজে এই যত-সব ঘরছাড়াদের দল।
পুনশ্চ
কাছে এল পূজার ছুটি। রোদ্দুরে লেগেছে চাঁপাফুলের রঙ। হাওয়া উঠছে শিশিরে শির্শিরিয়ে, শিউলির গন্ধ এসে লাগে যেন কার ঠাণ্ডা হাতের কোমল সেবা। আকাশের কোণে কোণে সাদা মেঘের আলস্য, দেখে মন লাগে না কাজে। মাস্টারমশায় পড়িয়ে চলেন পাথুরে কয়লার আদিম কথা। ছেলেটা বেঞ্চিতে পা দোলায়, ছবি দেখে আপন-মনে— কমলদিঘির ফাটল-ধরা ঘাট, আর ভঞ্জদের পাঁচিল-ঘেঁষা আতাগাছের ফলে-ভরা ডাল। আর দেখে সে মনে মনে, তিসির ক্ষেতে গোয়ালপাড়ার ভিতর দিয়ে রাস্তা গেছে এঁকেবেঁকে হাটের পাশে নদীর ধারে। কলেজের ইকনমিক্স্-ক্লাসে খাতায় ফর্দ নিচ্ছে টুকে চশমা-চোখে মেডেল-পাওয়া ছাত্র— হালের লেখা কোন্ উপন্যাস কিনতে হবে, ধারে মিলবে কোন্ দোকানে ‘মনে-রেখো’ পাড়ের শাড়ি, সোনায়-জড়ানো শাঁখা, দিল্লির-কাজ-করা লাল মখমলের চটি। আর চাই রেশমে-বাঁধাই-করা অ্যান্টিক কাগজে ছাপা কবিতার বই, এখনো তার নাম মনে পড়ছে না। ভবানীপুরের তেতালা বাড়িতে আলাপ চলছে সরু মোটা গলায়— এবার আবু পাহাড় না মাদুরা, না ড্যাল্হৌসি কিম্বা পুরী না সেই চিরকেলে চেনা লোকের দার্জিলিঙ? আর দেখছি সামনে দিয়ে স্টেশনে যাবার রাঙা রাস্তায় শহরের-দাদন-দেওয়া দড়িবাঁধা ছাগল-ছানা পাঁচটা ছটা ক’রে— তাদের নিষ্ফল কান্নার স্বর ছড়িয়ে পড়ে কাশের-ঝালর-দোলা শরতের শান্ত আকাশে। কেমন ক’রে বুঝেছে তারা এল তাদের পূজার ছুটির দিন।
পুনশ্চ
মরণের ছবি মনে আনি। ভেবে দেখি শেষ দিন ঠেকেছে শেষের শীর্ণক্ষণে। আছে ব’লে যত কিছু রয়েছে দেশে কালে– যত বস্তু, যত জীব, যত ইচ্ছা, যত চেষ্টা, যত আশানৈরাশ্যের ঘাতপ্রতিঘাত দেশে দেশে ঘরে ঘরে চিত্তে চিত্তে, যত গ্রহনক্ষত্রের দূর হতে দূরতর ঘূর্ণ্যমান স্তরে স্তরে অগণিত অজ্ঞাত শক্তির আলোড়ন আবর্তন মহাকালসমুদ্রের কূলহীন বক্ষতলে, সমস্তই আমার এ চৈতন্যের শেষ সূক্ষ্ম আকম্পিত রেখার এ ধারে। এক পা তখনো আছে সেই প্রান্তসীমায়, অন্য পা আমার বাড়িয়েছি রেখার ও ধারে, সেখানে অপেক্ষা করে অলক্ষিত ভবিষ্যৎ লয়ে দিনরজনীর অন্তহীন অক্ষমালা আলো-অন্ধকারে-গাঁথা। অসীমের অসংখ্য যা-কিছু সত্তায় সত্তায় গাঁথা প্রসারিত অতীতে ও অনাগতে। নিবিড় সে সমস্তের মাঝে অকস্মাৎ আমি নেই। একি সত্য হতে পারে। উদ্ধত এ নাস্তিত্ব যে পাবে স্থান এমন কি অণুমাত্র ছিদ্র আছে কোনোখানে। সে ছিদ্র কি এতদিনে ডুবাতো না নিখিলতরণী মৃত্যু যদি শূন্য হত, যদি হত মহাসমগ্রের রূঢ় প্রতিবাদ।
পুনশ্চ
মৃত্যুর পাত্রে খৃস্ট যেদিন মূত্যুহীন প্রাণ উৎসর্গ করলেন রবাহূত অনাহূতের জন্যে, তার পরে কেটে গেছে বহু শত বৎসর। আজ তিনি একবার নেমে এলেন নিত্যধাম থেকে মর্তধামে। চেয়ে দেখলেন, সেকালেও মানুষ ক্ষতবিক্ষত হত যে-সমস্ত পাপের মারে– যে উদ্ধত শেল ও শল্য, যে চতুর ছোরা ও ছুরি, যে ক্রূর কুটিল তলোয়ারের আঘাতে– বিদ্যুদ্বেগে আজ তাদের ফলায় শান দেওয়া হচ্ছে হিস্হিস্ শব্দে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে বড়ো বড়ো মসীধূমকেতন কারখানাঘরে। কিন্তু দারুণতম যে মৃত্যুবাণ নূতন তৈরি হল, ঝক্ঝক্ করে উঠল নরঘাতকের হাতে, পূজারি তাতে লাগিয়েছে তাঁরই নামের ছাপ তীক্ষ্ণ নখে আঁচড় দিয়ে। খৃস্ট বুকে হাত চেপে ধরলেন; বুঝলেন শেষ হয় নি তাঁর নিরবচ্ছিন্ন মৃত্যুর মুহূর্ত, নূতন শূল তৈরি হচ্ছে বিজ্ঞানশালায়– বিঁধছে তাঁর গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে। সেদিন তাঁকে মেরেছিল যারা ধর্মমন্দিরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে, তারাই আজ নূতন জন্ম নিল দলে দলে, তারাই আজ ধর্মমন্দিরের বেদীর সামনে থেকে পূজামন্ত্রের সুরে ডাকছে ঘাতক সৈন্যকে– বলছে "মারো মারো’। মানবপুত্র যন্ত্রণায় বলে উঠলেন ঊর্ধ্বে চেয়ে, "হে ঈশ্বর, হে মানুষের ঈশ্বর, কেন আমাকে ত্যাগ করলে।’
পুনশ্চ
রাত কত হল? উত্তর মেলে না। কেননা, অন্ধ কাল যুগ-যুগান্তরের গোলকধাঁধায় ঘোরে, পথ অজানা, পথের শেষ কোথায় খেয়াল নেই। পাহাড়তলিতে অন্ধকার মৃত রাক্ষসের চক্ষুকোটরের মতো; স্তূপে স্তূপে মেঘ আকাশের বুক চেপে ধরেছে; পুঞ্জ পুঞ্জ কালিমা গুহায় গর্তে সংলগ্ন, মনে হয় নিশীথরাত্রের ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ; দিগন্তে একটা আগ্নেয় উগ্রতা ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে আর নেভে– ও কি কোনো অজানা দুষ্টগ্রহের চোখ-রাঙানি। ও কি কোনো অনাদি ক্ষুধার লেলিহ লোল জিহ্বা। বিক্ষিপ্ত বস্তুগুলো যেন বিকারের প্রলাপ, অসম্পূর্ণ জীবলীলার ধূলিবিলীন উচ্ছিষ্ট; তারা অমিতাচারী দৃপ্ত প্রতাপের ভগ্ন তোরণ, লুপ্ত নদীর বিস্মৃতিবিলগ্ন জীর্ণ সেতু, দেবতাহীন দেউলের সর্পবিবরছিদ্রিত বেদী, অসমাপ্ত দীর্ণ সোপানপঙ্ক্তি শূন্যতায় অবসিত। অকস্মাৎ উচ্চণ্ড কলরব আকাশে আবর্তিত আলোড়িত হতে থাকে– ও কি বন্দী বন্যাবারির গুহাবিদারণের রলরোল। ও কি ঘূর্ণ্যতাণ্ডবী উন্মাদ সাধকের রুদ্রমন্ত্র-উচ্চারণ। ও কি দাবাগ্নিবেষ্টিত মহারণ্যের আত্মঘাতী প্রলয়নিনাদ। এই ভীষণ কোলাহলের তলে তলে একটা অস্ফুট ধ্বনিধারা বিসর্পিত– যেন অগ্নিগিরিনিঃসৃত গদগদকলমুখর পঙ্কস্রোত; তাতে একত্রে মিলেছে পরশ্রীকাতরের কানাকানি, কুৎসিত জনশ্রুতি, অবজ্ঞার কর্কশহাস্য। সেখানে মানুষগুলো সব ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতো ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে– মশালের আলোয় ছায়ায় তাদের মুখে বিভীষিকার উল্কি পরানো। কোনা-এক সময়ে অকারণ সন্দেহে কোনো-এক পাগল তার প্রতিবেশীকে হঠাৎ মারে; দেখতে দেখতে নির্বিচার বিবাদ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে দিকে দিকে। কোনো নারী আর্তস্বরে বিলাপ করে; বলে, হায়, হায়, আমাদের দিশাহারা সন্তান উচ্ছন্ন গেল। কোনো কামিনী যৌবনমদবিলসিত নগ্ন দেহে অট্টহাস্য করে; বলে, কিছুতে কিছু আসে যায় না। ২ ঊর্ধ্বে গিরিচূড়ায় বসে আছে ভক্ত, তুষারশুভ্র নীরবতার মধ্যে; আকাশে তার নিদ্রাহীন চক্ষু খোঁজে আলোকের ইঙ্গিত। মেঘ যখন ঘনীভূত, নিশাচর পাখি চীৎকারশব্দে যখন উড়ে যায়, সে বলে, ভয় নেই ভাই, মানবকে মহান্ বলে জেনো। ওরা শোনে না, বলে পশুশক্তিই আদ্যাশক্তি, বলে পশুই শাশ্বত; বলে সাধুতা তলে তলে আত্মপ্রবঞ্চক। যখন ওরা আঘাত পায় বিলাপ ক’রে বলে, ভাই, তুমি কোথায়। উত্তরে শুনতে পায়, আমি তোমার পাশেই। অন্ধকারে দেখতে পায় না, তর্ক করে– এ বাণী ভয়ার্তের মায়াসৃষ্টি, আত্মসান্ত্বনার বিড়ম্বনা। বলে, মানুষ চিরদিন কেবল সংগ্রাম করবে মরীচিকার অধিকার নিয়ে হিংসাকণ্টকিত অন্তহীন মরুভূমির মধ্যে। ৩ মেঘ সরে গেল। শুকতারা দেখা দিল পূর্বদিগন্তে, পৃথিবীর বক্ষ থেকে উঠল আরামের দীর্ঘনিশ্বাস, পল্লবমর্মর বনপথে-পথে হিল্লোলিত, পাখি ডাক দিল শাখায়-শাখায়। ভক্ত বললে, সময় এসেছে। কিসের সময়? যাত্রার। ওরা বসে ভাবলে। অর্থ বুঝলে না, আপন আপন মনের মতো অর্থ বানিয়ে নিলে। ভোরের স্পর্শ নামল মাটির গভীরে, বিশ্বসত্তার শিকড়ে শিকড়ে কেঁপে উঠল প্রাণের চাঞ্চল্য। কে জানে কোথা হতে একটি অতি সূক্ষ্মস্বর সবার কানে কানে বললে, চলো সার্থকতার তীর্থে। এই বাণী জনতার কণ্ঠে কণ্ঠে একটি মহৎ প্রেরণায় বেগবান হয়ে উঠল। পুরুষেরা উপরের দিকে চোখ তুললে, জোড় হাত মাথায় ঠেকালে মেয়েরা। শিশুরা করতালি দিয়ে হেসে উঠল। প্রভাতের প্রথম আলো ভক্তের মাথায় সোনার রঙের চন্দন পরালে; সবাই বলে উঠল ভাই, আমরা তোমার বন্দনা করি। ৪ যাত্রীরা চারি দিক থেকে বেরিয়ে পড়ল– সমুদ্র পেরিয়ে, পর্বত ডিঙিয়ে, পথহীন প্রান্তর উত্তীর্ণ হয়ে– এল নীলনদীর দেশ থেকে, গঙ্গার তীর থেকে, তিব্বতের হিমমজ্জিত অধিত্যকা থেকে, প্রাকাররক্ষিত নগরের সিংহদ্বার দিয়ে, লতাজালজটিল অরণ্যে পথ কেটে। কেউ আসে পায়ে হেঁটে, কেউ উটে, কেউ ঘোড়ায়, কেউ হাতিতে, কেউ রথে চীনাংশুকের পতাকা উড়িয়ে। নানা ধর্মের পূজারি চলল ধূপ জ্বালিয়ে, মন্ত্র প’ড়ে। রাজা চলল, অনুচরদের বর্শাফলক রৌদ্রে দীপ্যমান, ভেরী বাজে গুরু গুরু মেঘমন্দ্রে। ভিক্ষু আসে ছিন্ন কন্থা প’রে, আর রাজ-অমাত্যের দল স্বর্ণলাঞ্ছনখচিত উজ্জ্বল বেশে। জ্ঞানগরিমা ও বয়সের ভারে মন্থর অধ্যাপককে ঠেলে দিয়ে চলে চটুলগতি বিদ্যার্থী যুবক। মেয়েরা চলেছে কলহাস্যে, কত মাতা, কুমারী, কত বধূ; থালায় তাদের শ্বেতচন্দন, ঝারিতে গন্ধসলিল। বেশ্যাও চলেছে সেই সঙ্গে; তীক্ষ্ণ তাদের কণ্ঠস্বর, অতিপ্রকট তাদের প্রসাধন। চলেছে পঙ্গু, খঞ্জ, অন্ধ, আতুর, আর সাধুবেশী ধর্মব্যবসায়ী– দেবতাকে হাটে হাটে বিক্রয় করা যাদের জীবিকা। সার্থকতা! স্পষ্ট ক’রে কিছু বলে না– কেবল নিজের লোভকে মহৎ নাম ও বৃহৎ মূল্য দিয়ে ওই শব্দটার ব্যাখ্যা করে, আর শাস্তিশঙ্কাহীন চৌর্যবৃত্তির অনন্ত সুযোগ ও আপন মলিন ক্লিন্ন দেহমাংসের অক্লান্ত লোলুপতা দিয়ে কল্পস্বর্গ রচনা করে। ৫ দয়াহীন দুর্গম পথ উপলখণ্ডে আকীর্ণ। ভক্ত চলেছে, তার পশ্চাতে বলিষ্ঠ এবং শীর্ণ, তরুণ এবং জরাজর্জর, পৃথিবী শাসন করে যারা আর যারা অর্ধাশনের মূল্যে মাটি চাষ করে। কেউ বা ক্লান্ত বিক্ষতচরণ, কারো মনে ক্রোধ, কারো মনে সন্দেহ। তারা প্রতি পদক্ষেপ গণনা করে আর শুধায়, কত পথ বাকি। তার উত্তরে ভক্ত শুধু গান গায়। শুনে তাদের ভ্রূ কুটিল হয়, কিন্তু ফিরতে পারে না, চলমান জনপিণ্ডের বেগ এবং অনতিব্যক্ত আশার তাড়না তাদের ঠেলে নিয়ে যায়। ঘুম তাদের কমে এল, বিশ্রাম তারা সংক্ষিপ্ত করলে, পরস্পরকে ছাড়িয়ে চলবার প্রতিযোগিতায় তারা ব্যগ্র, ভয়– পাছে বিলম্ব ক’রে বঞ্চিত হয়। দিনের পর দিন গেল। দিগন্তের পর দিগন্ত আসে, অজ্ঞাতের আমন্ত্রণ অদৃশ্য সংকেতে ইঙ্গিত করে। ওদের মুখের ভাব ক্রমেই কঠিন আর ওদের গঞ্জনা উগ্রতর হতে থাকে। ৬ রাত হয়েছে। পথিকেরা বটতলায় আসন বিছিয়ে বসল। একটা দমকা হাওয়ায় প্রদীপ গেল নিবে, অন্ধকার নিবিড়– যেন নিদ্রা ঘনিয়ে উঠল মূর্ছায়। জনতার মধ্য থেকে কে-একজন হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে অধিনেতার দিকে আঙুল তুলে বললে, মিথ্যাবাদী, আমাদের প্রবঞ্চনা করেছ। ভর্ৎসনা এক কণ্ঠ থেকে আরেক কণ্ঠে উদগ্র হতে থাকল। তীব্র হল মেয়েদের বিদ্বেষ, প্রবল হল পুরুষদের তর্জন। অবশেষে একজন সাহসিক উঠে দাঁড়িয়ে হঠাৎ তাকে মারলে প্রচণ্ড বেগে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা গেল না। একজনের পর একজন উঠল, আঘাতের পর আঘাত করলে, তার প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। রাত্রি নিস্তব্ধ। ঝর্নার কলশব্দ দূর থেকে ক্ষীণ হয়ে আসছে। বাতাসে যূথীর মৃদুগন্ধ। ৭ যাত্রীদের মন শঙ্কায় অভিভূত। মেয়েরা কাঁদছে; পুরুষেরা উত্ত্যক্ত হয়ে ভর্ৎসনা করছে, চুপ করো। কুকুর ডেকে ওঠে, চাবুক খেয়ে আর্ত কাকুতিতে তার ডাক থেমে যায়। রাত্রি পোহাতে চায় না। অপরাধের অভিযোগ নিয়ে মেয়ে পুরুষে তর্ক তীব্র হতে থাকে। সবাই চীৎকার করে, গর্জন করে, শেষে যখন খাপ থেকে ছুরি বেরোতে চায় এমন সময় অন্ধকার ক্ষীণ হল– প্রভাতের আলো গিরিশৃঙ্গ ছাপিয়ে আকাশ ভরে দিলে। হঠাৎ সকলে স্তব্ধ; সূর্যরশ্মির তর্জনী এসে স্পর্শ করল রক্তাক্ত মৃত মানুষের শান্ত ললাট। মেয়েরা ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল, পুরুষেরা মুখ ঢাকল দুই হাতে। কেউ বা অলক্ষিতে পালিয়ে যেতে চায়, পারে না; অপরাধের শৃঙ্খলে আপন বলির কাছে তারা বাঁধা। পরস্পরকে তারা শুধায়, কে আমাদের পথ দেখাবে। পূর্বদেশের বৃদ্ধ বললে, আমরা যাকে মেরেছি সেই দেখাবে। সবাই নিরুত্তর ও নতশির। বৃদ্ধ আবার বললে, সংশয়ে তাকে আমরা অস্বীকার করেছি, ক্রোধে তাকে আমরা হনন করেছি, প্রেমে এখন আমরা তাকে গ্রহণ করব, কেননা, মৃত্যুর দ্বারা সে আমাদের সকলের জীবনের মধ্যে সঞ্জীবিত সেই মহামৃত্যুঞ্জয়। সকলে দাঁড়িয়ে উঠল, কণ্ঠ মিলিয়ে গান করলে "জয় মৃত্যুঞ্জয়ের জয়’। ৮ তরুণের দল ডাক দিল, চলো যাত্রা করি প্রেমের তীর্থে, শক্তির তীর্থে। হাজার কণ্ঠের ধ্বনিনির্ঝরে ঘোষিত হল– আমরা ইহলোক জয় করব এবং লোকান্তর। উদ্দেশ্য সকলের কাছে স্পষ্ট নয়, কেবল আগ্রহে সকলে এক; মৃত্যুবিপদকে তুচ্ছ করেছে সকলের সম্মিলিত সঞ্চলমান ইচ্ছার বেগ। তারা আর পথ শুধায় না, তাদের মনে নেই সংশয়, চরণে নেই ক্লান্তি। মৃত অধিনেতার আত্মা তাদের অন্তরে বাহিরে– সে যে মৃত্যুকে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং জীবনের সীমাকে করেছে অতিক্রম। তারা সেই ক্ষেত্র দিয়ে চলেছে যেখানে বীজ বোনা হল, সেই ভাণ্ডারের পাশ দিয়ে যেখানে শস্য হয়েছে সঞ্চিত, সেই অনুর্বর ভূমির উপর দিয়ে যেখানে কঙ্কালসার দেহ বসে আছে প্রাণের কাঙাল; তারা চলেছে প্রজাবহুল নগরের পথ দিয়ে, চলেছে জনশূন্যতার মধ্যে দিয়ে যেখানে বোবা অতীত তার ভাঙা কীর্তি কোলে নিয়ে নিস্তব্ধ; চলেছে লক্ষ্মীছাড়াদের জীর্ণ বসতি বেয়ে আশ্রয় যেখানে আশ্রিতকে বিদ্রূপ করে। রৌদ্রদগ্ধ বৈশাখের দীর্ঘ প্রহর কাটল পথে পথে। সন্ধ্যাবেলায় আলোক যখন ম্লান তখন তারা কালজ্ঞকে শুধায়, ওই কি দেখা যায় আমাদের চরম আশার তোরণচূড়া। সে বলে, না, ও যে সন্ধ্যাভ্রশিখরে অস্তগামী সূর্যের বিলীয়মান আভা। তরুণ বলে, থেমো না বন্ধু, অন্ধতমিস্র রাত্রির মধ্য দিয়ে আমাদের পৌঁছতে হবে মৃত্যুহীন জ্যোতির্লোকে। অন্ধকারে তারা চলে। পথ যেন নিজের অর্থ নিজে জানে, পায়ের তলার ধূলিও যেন নীরব স্পর্শে দিক চিনিয়ে দেয়। স্বর্গপথযাত্রী নক্ষত্রের দল মূক সংগীতে বলে, সাথি, অগ্রসর হও। অধিনেতার আকাশবাণী কানে আসে– আর বিলম্ব নেই। ৯ প্রত্যুষের প্রথম আভা অরণ্যের শিশিরবর্ষী পল্লবে পল্লবে ঝলমল করে উঠল। নক্ষত্রসংকেতবিদ্ জ্যোতিষী বললে, বন্ধু, আমরা এসেছি। পথের দুই ধারে দিক্প্রান্ত অবধি পরিণত শস্যশীর্ষ স্নিগ্ধ বায়ুহিল্লোলে দোলায়মান– আকাশের স্বর্ণলিপির উত্তরে ধরণীর আনন্দবাণী। গিরিপদবর্তী গ্রাম থেকে নদীতলবর্তী গ্রাম পর্যন্ত প্রতিদিনের লোকযাত্রা শান্ত গতিতে প্রবহমান– কুমোরের চাকা ঘুরছে গুঞ্জনস্বরে, কাঠুরিয়া হাটে আনছে কাঠের ভার, রাখাল ধেনু নিয়ে চলেছে মাঠে, বধূরা নদী থেকে ঘট ভ’রে যায় ছায়াপথ দিয়ে। কিন্তু কোথায় রাজার দুর্গ, সোনার খনি, মারণ-উচাটন-মন্ত্রের পুরাতন পুঁথি? জ্যোতিষী বললে, নক্ষত্রের ইঙ্গিতে ভুল হতে পারে না, তাদের সংকেত এইখানেই এসে থেমেছে। এই বলে ভক্তিনম্রশিরে পথপ্রান্তে একটি উৎসের কাছে গিয়ে সে দাঁড়ালো। সেই উৎস থেকে জলস্রোত উঠছে যেন তরল আলোক, প্রভাত যেন হাসি-অশ্রুর গলিতমিলিত গীতধারায় সমুচ্ছল। নিকটে তালীকুঞ্জতলে একটি পর্ণকুটির অনির্বচনীয় স্তব্ধতায় পরিবেষ্টিত। দ্বারে অপরিচিত সিন্ধুতীরের কবি গান গেয়ে বলছে– মাতা, দ্বার খোলো। ১০ প্রভাতের একটি রবিরশ্মি রুদ্ধদ্বারের নিম্নপ্রান্তে তির্যক্ হয়ে পড়েছে। সম্মিলিত জনসংঘ আপন নাড়ীতে নাড়ীতে যেন শুনতে পেলে সৃষ্টির সেই প্রথম পরমবাণী– মাতা, দ্বার খোলো। দ্বার খুলে গেল। মা বসে আছেন তৃণশয্যায়, কোলে তাঁর শিশু, উষার কোলে যেন শুকতারা। দ্বারপ্রান্তে প্রতীক্ষাপরায়ণ সূর্যরশ্মি শিশুর মাথায় এসে পড়ল। কবি দিলে আপন বীণার তারে ঝংকার, গান উঠল আকাশে– জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের। সকলে জানু পেতে বসল, রাজা এবং ভিক্ষু, সাধু এবং পাপী, জ্ঞানী এবং মূঢ়; উচ্চস্বরে ঘোষণা করলে– জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।
পুনশ্চ
গন্ধর্ব সৌরসেন সুরলোকের সংগীতসভায় কলানায়কদের অগ্রণী। সেদিন তার প্রেয়সী মধুশ্রী গেছে সুমেরুশিখরে সূর্যপ্রদক্ষিণে। সৌরসেনের মন ছিল উদাসী। অনবধানে তার মৃদঙ্গের তাল গেল কেটে, উর্বশীর নাচে শমে পড়ল বাধা, ইন্দ্রাণীর কপোল উঠল রাঙা হয়ে। স্খলিতছন্দ সুরসভার অভিশাপে গন্ধর্বের দেহশ্রী বিকৃত হয়ে গেল, অরুণেশ্বর নাম নিয়ে তার জন্ম হল গান্ধাররাজগৃহে। মধুশ্রী ইন্দ্রাণীর পাদপীঠে মাথা রেখে পড়ে রইল; বললে, "বিচ্ছেদ ঘটিয়ো না, একই লোকে আমাদের গতি হোক, একই দুঃখভোগে, একই অবমাননায়।’ শচী সকরুণ দৃষ্টিতে ইন্দ্রের পানে তাকালেন। ইন্দ্র বললেন,"তথাস্তু, যাও মর্তে– সেখানে দুঃখ পাবে, দুঃখ দেবে। সেই দুঃখে ছন্দঃপাতন-অপরাধের ক্ষয়।’ মধুশ্রী জন্ম নিল মদ্ররাজকুলে, নাম নিল কমলিকা। একদিন গান্ধারপতির চোখে পড়ল মদ্ররাজকন্যার ছবি। সেই ছবি তার দিনের চিন্তা, তার রাত্রের স্বপ্নের ’পরে আপন ভূমিকা রচনা করলে। গান্ধারের দূত এল মদ্ররাজধানীতে। বিবাহপ্রস্তাব শুনে রাজা বললে, "আমার কন্যার দুর্লভ ভাগ্য।’ ফাল্গুন মাসের পুণ্যতিথিতে শুভলগ্ন। রাজহস্তীর পৃষ্ঠে রত্নাসনে মদ্ররাজসভায় এসেছে মহারাজ অরুণেশ্বরের অঙ্কবিহারিণী বীণা। স্তব্ধসংগীতে সেই রাজপ্রতিনিধির সঙ্গে কন্যার বিবাহ। যথাকালে রাজবধূ এল পতিগৃহে। নির্বাণদীপ অন্ধকার ঘরেই প্রতি রাত্রে স্বামীর কাছে বধূসমাগম। কমলিকা বলে, "প্রভু, তোমাকে দেখবার জন্যে আমার দিন আমার রাত্রি উৎসুক। আমাকে দেখা দাও।’ রাজা বলে, "আমার গানেই তুমি আমাকে দেখো।’ অন্ধকারে বীণা বাজে। অন্ধকারে গান্ধর্বীকলার নৃত্যে বধূকে বর প্রদক্ষিণ করে। সেই নৃত্যকলা নির্বাসনের সঙ্গিনী হয়ে এসেছে তার মর্তদেহে। নৃত্যের বেদনা রানীর বক্ষে এসে দুলে দুলে ওঠে, নিশীথরাত্রে সমুদ্রে জোয়ার এলে তার ঢেউ যেমন লাগে তটভূমিতে– অশ্রুতে প্লাবিত করে দেয়। একদিন রাত্রির তৃতীয় প্রহরের শেষে যখন শুকতারা পূর্বগগনে, কমলিকা তার সুগন্ধি এলোচুলে রাজার দুই পা ঢেকে দিলে; বললে, "আদেশ করো আজ উষার প্রথম আলোকে তোমাকে প্রথম দেখব।’ রাজা বললে, "প্রিয়ে, না-দেখার নিবিড় মিলনকে নষ্ট কোরো না এই মিনতি।’ মহিষী বললে, "প্রিয়প্রসাদ থেকে আমার দুই চক্ষু কি চিরদিন বঞ্চিত থাকবে। অন্ধতার চেয়েও এ যে বড়ো অভিশাপ।’ অভিমানে মহিষী মুখ ফেরালে। রাজা বললে, "কাল চৈত্রসংক্রান্তি। নাগকেশরের বনে নিভৃতে সখাদের সঙ্গে আমার নৃত্যের দিন। প্রাসাদশিখর থেকে চেয়ে দেখো।’ মহিষীর দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল; বললে, "চিনব কী করে।’ রাজা বললে, "যেমন খুশি কল্পনা করে নিয়ো, সেই কল্পনাই হবে সত্য।’ চৈত্রসংক্রান্তির রাত্রে আবার মিলন। মহিষী বললে, "দেখলাম নাচ। যেন মঞ্জরিত শালতরুশ্রেণীতে বসন্তবাতাসের মত্ততা। সকলেই সুন্দর, যেন ওরা চন্দ্রলোকের শুক্লপক্ষের মানুষ। কেবল একজন কুশ্রী কেন রসভঙ্গ করলে, ও যেন রাহুর অনুচর। ওখানে কী গুণে সে পেল প্রবেশের অধিকার।’ রাজা স্তব্ধ হয়ে রইল। কিছু পরে বললে, "ওই কুশ্রীর পরম বেদনাতেই তো সুন্দরের আহ্বান। কালো মেঘের লজ্জাকে সান্ত্বনা দিতেই সূর্যরশ্মি তার ললাটে পরায় ইন্দ্রধনু, মরুনীরস কালো মর্তের অভিশাপের উপর স্বর্গের করুণা যখন রূপ ধরে তখনই তো শ্যামলসুন্দরের আবির্ভাব। প্রিয়তমে, সেই করুণাই কি তোমার হৃদয়কে কাল মধুর করে নি।’ "না মহারাজ, না’ ব’লে মহিষী দুই হাতে মুখ ঢাকলে। রাজার কণ্ঠের সুরে অশ্রুর ছোঁওয়া লাগল; বললে, "যাকে দয়া করলে হৃদয় তোমার ভরে উঠত তাকে ঘৃণা ক’রে মনকে কেন পাথর করলে।’ "রসবিকৃতির পীড়া সইতে পারি নে’ এই ব’লে মহিষী আসন থেকে উঠে পড়ল। রাজা তার হাত ধরলে; বললে, "একদিন সইতে পারবে আপনারই আন্তরিক রসের দাক্ষিণ্যে– কুশ্রীর আত্মত্যাগে সুন্দরের সার্থকতা।’ ভ্রূ কুটিল করে মহিষী বললে, "অসুন্দরের জন্যে তোমার এই অনুকম্পার অর্থ বুঝি নে। ওই শোনো, উষার প্রথম কোকিলের ডাক, অন্ধকারের মধ্যে তার আলোকের অনুভূতি। আজ সূর্যোদয়মুহূর্তে তোমারও প্রকাশ হবে আমার দিনের মধ্যে, এই আশায় রইলাম।’ রাজা বলল, "তাই হোক, ভীরুতা যাক কেটে।’ দেখা হল। ট’লে উঠল যুগলের সংসার। "কী অন্যায়– কি নিষ্ঠুর বঞ্চনা’ বলতে বলতে কমলিকা ঘর থেকে ছুটে পালিয়ে গেল। গেল বহুদূরে বনের মধ্যে মৃগয়ার জন্যে যে নির্জন রাজগৃহ আছে সেইখানে। কুয়াশায় শুকতারার মতো লজ্জায় সে আচ্ছন্ন। রাত্রি যখন দুই প্রহর তখন আধ-ঘুমে সে শুনতে পায় এক বীণাধ্বনির আর্তরাগিণী। স্বপ্নে বহুদূরের আভাস আসে, মনে হয় এই সুর চিরদিনের চেনা। রাতের পরে রাত গেল। অন্ধকারে তরুতলে যে মানুষ ছায়ার মতো নাচে তাকে চোখে দেখে না, তাকে হৃদয়ে দেখা যায়– যেমন দেখা যায় জনশূন্য দেওদার বনের দোলায়িত শাখায় দক্ষিণসমুদ্রের হাওয়ার হাহাকার-মূর্তি। এ কী হল রাজমহিষীর। কোন্ হতাশের বিরহ তার বিরহকে জাগিয়ে তোলে! মাটির প্রদীপ-শিখায় সোনার প্রদীপ জ্বলে উঠল বুঝি। রাতজাগা পাখি নিস্তব্ধ নীড়ের পাশ দিয়ে হূহু করে উড়ে যায়, তার পাখার শব্দে ঘুমন্ত পাখির পাখা উৎসুক হয়ে ওঠে যে। বীণায় বাজতে থাকে কেদারা, বেহাগ, বাজে কালাংড়া। আকাশে আকাশে তারাগুলি যেন তামসী তপস্বিনীর নীরব জপমন্ত্র। রাজমহিষী বিছানার ’পরে উঠে বসে। স্রস্ত তার বেণী, ত্রস্ত তার বক্ষ। বীণার গুঞ্জরণ আকাশে মেলে দেয় এক অন্তহীন অভিসারের পথ। রাগিণী-বিছানো সেই শূন্যপথে বেরিয়ে পড়ে তার মন। কার দিকে। দেখার আগে যাকে চিনেছিল তারই দিকে। একদিন নিমফুলের গন্ধ অন্ধকার ঘরে অনির্বচনীয়ের আমন্ত্রণ নিয়ে এসেছে। মহিষী বিছানা ছেড়ে বাতায়নের কাছে এসে দাঁড়ালো। নীচে সেই ছায়ামূর্তির নৃত্য, বিরহের সেই উর্মি-দোলা। মহিষীর সমস্ত দেহ কম্পিত। ঝিল্লিঝংকৃত রাত, কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ দিগন্তে। অস্পষ্ট আলোয় অরণ্য স্বপ্নে কথা কইছে। সেই বোবা বনের ভাষাহীন বাণী লাগল রাজমহিষীর অঙ্গে অঙ্গে। কখন নাচ আরম্ভ হল সে জানে না। এ নাচ কোন্ জন্মান্তরের, কোন্ লোকান্তরের। গেল আরো দুই রাত। অভিসারের পথ একান্তই শেষ হয়ে আসছে এই জানলারই কাছে। সেদিন বীণায় পরজের বিহ্বল মিড়। কমলিকা আপন মনে নীরবে বলছে, "ওগো কাতর, ওগো হতাশ, আর ডেকো না। আমার আর দেরি নেই।’ কিন্তু যাবে কার কাছে। চোখে না দেখেছিল যাকে তারই কাছে তো? কেমন করে হবে। দেখা-মানুষ আজ না-দেখা মানুষকে ছিনিয়ে নিয়ে পাঠিয়ে দিলে সাত-সমুদ্র-পারে রূপকথার দেশে। সেখানকার পথ কোন্ দিকে। আরো এক রাত যায়। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ ডুবেছে অমাবস্যার তলায়। আঁধারের ডাক কী গভীর। পথ-না-জানা যত-সব গুহা-গহ্বর মনের মধ্যে প্রচ্ছন্ন, এই ডাক সেখানে গিয়ে প্রতিধ্বনি জাগায়। সেই অস্ফুট আকাশবাণীর সঙ্গে মিলে ওই যে বাজে বীণায় কানাড়া। রাজমহিষী উঠে দাঁড়িয়ে বললে, "আজ আমি যাব। আমার চোখকে আমি আর ভয় করি নে।’ পথের শুকনো পাতা পায়ে পায়ে বাজিয়ে দিয়ে সে গেল পুরাতন অশথ গাছের তলায়। বীণা থামল। মহিষী থমকে দাঁড়ালো। রাজা বললে, "ভয় কোরো না প্রিয়ে, ভয় কোরো না।’ তার গলার স্বর জলে-ভরা মেঘের দূর গুরু-গুরু ধ্বনির মতো। "আমার কিছু ভয় নেই, তোমারই জয় হল।’ এই বলে মহিষী আঁচলের আড়াল থেকে প্রদীপ বের করলে, ধীরে ধীরে তুললে রাজার মুখের কাছে। কণ্ঠ দিয়ে কথা বেরোতে চায় না, পলক পড়ে না চোখে। বলে উঠল, "প্রভু আমার, প্রিয় আমার, এ কী সুন্দর রূপ তোমার।’
পুনশ্চ
দাও-না ছুটি, কেমন করে বুঝিয়ে বলি কোন্খানে। যেখানে ওই শিরীষবনের গন্ধপথে মৌমাছিদের কাঁপছে ডানা সারাবেলা। যেখানেতে মেঘ-ভাসা ওই সুদূরতা, জলের প্রলাপ যেখানে প্রাণ উদাস করে সন্ধ্যাতারা ওঠার মুখে, যেখানে সব প্রশ্ন গেছে থেমে– শূন্য ঘরে অতীত স্মৃতি গুন্গুনিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে রাখে না আর বাদলরাতে। যেখানে এই মন গোরুচরা মাঠের মধ্যে স্তব্ধ বটের মতো গাঁয়ে-চলা পথের পাশে। কেউ বা এসে প্রহরখানেক বসে তলায়, পা ছড়িয়ে কেউ বা বাজায় বাঁশি, নববধূর পাল্কিখানা নামিয়ে রাখে ক্লান্ত দুই পহরে; কৃষ্ণ-একাদশীর রাতে ছায়ার সঙ্গে ঝিল্লিরবে জড়িয়ে পড়ে চাঁদের শীর্ণ আলো। যাওয়া-আসার স্রোত বহে যায় দিনে রাতে– ধরে-রাখার নাই কোনো আগ্রহ, দূরে রাখার নাই তো অভিমান। রাতের তারা স্বপ্নপ্রদীপখানি ভোরের আলোয় ভাসিয়ে দিয়ে যায় চলে, তার দেয় না ঠিকানা।
পুনশ্চ
তোমরা দুটি পাখি, মিলন-বেলায় গান কেন আজ মুখে মুখে নীরব হল। আতশবাজির বক্ষ থেকে চতুর্দিকে স্ফুলিঙ্গ সব ছিটকে পড়ে– তেমনি তোমাদের বিরহতাপ ছড়িয়ে গিয়েছিল সারারাত্রি সুরে সুরে বনের থেকে বনে। গানের মূর্তি নিয়ে তারা পড়ল না তো ধরা– বাতাস তাদের মিলিয়ে দিল দিগন্তরের অরণ্যচ্ছায়ায়। আমরা মানুষ, ভালোবাসার জন্যে বাসা বাঁধি, চিরকালের ভিত গড়ি তার গানের সুরে; খুঁজে আনি জরাবিহীন বাণী সে মন্দিরের গাঁথন দিতে। বিশ্বজনের সবার জন্যে সে গান থাকে সব প্রেমিকের প্রাণের আসন মেলে দিয়ে। বিপুল হয়ে উঠেছে সে দেশে দেশে কালে কালে। মাটির মধ্যখানে থেকে মাটিকে সে অনেক দূরে ছাড়িয়ে তোলে মাথা কল্পস্বর্গলোকে। সহজ ছন্দে যায় আনন্দে জীবন তোমাদের উধাও পাখার নাচের তালে। দুরু দুরু কোমল বুকের প্রেমের বাসা আপনি আছে বাঁধা পাখির ভুবনে। প্রাণের রসে শ্যামল মধুর, মুখরিত গুঞ্জনে মর্মরে, ঝলকিত চিকন পাতার দোলনে কম্পনে, পুলকিত ফুলের উল্লাসে, নব নব ঋতুর মায়া-তুলি সাজায় তারে নবীন রঙে– মনে-রাখা ভুলে-যাওয়া যেন দুটি প্রজাপতির মতো সেই নিভৃতে অনায়াসে হালকা পাখায় আলোছায়ার সঙ্গে বেড়ায় খেলে। আমরা কেবল বানিয়ে তুলি আপন ব্যথার রঙে রসে ধূলির থেকে পালিয়ে যাবার সৃষ্টিছাড়া ঠাঁই, বেড়া দিয়ে আগলে রাখি ভালোবাসার জন্যে দূরের বাসা– সেই আমাদের গান।
পুনশ্চ
হিমের শিহর লেগেছে আজ মৃদু হাওয়ায় আশ্বিনের এই প্রথম দিনে। ভোরবেলাকার চাঁদের আলো মিলিয়ে আসে শ্বেতকরবীর রঙে। শিউলিফুলের নিশ্বাস বয় ভিজে ঘাসের ’পরে, তপস্বিনী উষার পরা পুজোর চেলির গন্ধ যেন আশ্বিনের এই প্রথম দিনে। পুব আকাশে শুভ্র আলোর শঙ্খ বাজে– বুকের মধ্যে শব্দ যে তার রক্তে লাগায় দোলা। কত যুগের কত দেশের বিশ্ববিজয়ী মৃত্যুপথে ছুটেছিল অমর প্রাণের অসাধ্য সন্ধানে। তাদেরই সেই বিজয়শঙ্খ রেখে গেছে অরব ধ্বনি শিশির-ধোওয়া রোদে। বাজল রে আজ বাজল রে তার ঘর-ছাড়ানো ডাক আশ্বিনের এই প্রথম দিনে। ধনের বোঝা, খ্যাতির বোঝা, দুর্ভাবনার বোঝা ধুলোয় ফেলে দিয়ে নিরুদ্বেগে চলেছিল জটিল সংকটে। ললাট তাদের লক্ষ্য ক’রে পঙ্কপিণ্ড হেনেছিল দুর্জনেরা মলিন হাতে; নেমেছিল উল্কা আকাশ থেকে, পায়ের তলায় নীরস নিঠুর পথ তুলেছিল গুপ্ত ক্ষুদ্র কুটিল কাঁটা। পায় নি আরাম, পায় নি বিরাম, চায় নি পিছন ফিরে; তাদেরই সেই শুভ্রকেতনগুলি ওই উড়েছে শরৎপ্রাতের মেঘে আশ্বিনের এই প্রথম দিনে। ভয় কোরো না, লোভ কোরো না, ক্ষোভ কোরো না, জাগো আমার মন– গান জাগিয়ে চলো সমুখ-পথে যেখানে ওই কাশের চামর দোলে নবসূর্যোদয়ের দিকে। নৈরাশ্যের নখর হতে রক্ত-ঝরা আপ্নাকে আজ ছিন্ন করে আনো আশার মোহ-শিকড়গুলো উপড়ে দিয়ে যাও– লালসাকে দলো পায়ের তলায়। মৃত্যুতোরণ যখন হবে পার পরাজয়ের গ্লানিভরে মাথা তোমার না হয় যেন নত। ইতিহাসের আত্মজয়ী বিশ্ববিজয়ী তাদের মাভৈঃ বাণী বাজে নীরব নির্ঘোষণে নির্মল এই শরৎ-রৌদ্রালোকে আশ্বিনের এই প্রথম দিনে।