Generated on: Fri Dec 19 2014

Home

::

Show All

::

Show Current

::

Scroll TOC Up| Down

Send a Comment

বঙ্কিমচন্দ্র
আধুনিক সাহিত্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যেকালে বঙ্কিমের নবীনা প্রতিভা লক্ষ্মীরূপে সুধাভাণ্ড হস্তে লইয়া বাংলাদেশের সম্মুখে আবির্ভূত হইলেন তখনকার প্রাচীন লোকেরা বঙ্কিমের রচনাকে সসম্মান আনন্দের সহিত অভ্যর্থনা করেন নাই।

সেদিন বঙ্কিমকে বিস্তর উপহাস গ্লানি সহ্য করিতে হইয়াছিল। তাঁহার উপর একদল লোকের সুতীব্র বিদ্বেষ ছিল, এবং ক্ষুদ্র যে লেখকসম্প্রদায় তাঁহার অনুকরণের বৃথা চেষ্টা করিত তাহারাই আপন ঋণ গোপন করিবার প্রয়াসে তাঁহাকে সর্বাপেক্ষা অধিক গালি দিত।

আবার এখনকার যে নূতন পাঠক ও লেখক-সম্প্রদায় উদ্‌ভূত হইয়াছেন তাঁহারাও বঙ্কিমের পরিপূর্ণ প্রভাব হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিবার অবকাশ পান নাই তাঁহারা বঙ্কিমের গঠিত সাহিত্যভূমিতেই একেবারে ভূমিষ্ঠ হইয়াছেন, বঙ্কিমের নিকট যে তাঁহারা কতরূপে কতভাবে ঋণী তাহার হিসাব বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়া তাঁহারা দেখিতে পাইতেছেন না।

কিন্তু বর্তমান লেখকের সৌভাগ্যক্রমে আমাদের সহিত যখন বঙ্কিমের প্রথম সাক্ষাৎকার হয় তখন সাহিত্যপ্রভৃতিসম্বন্ধে কোনোরূপ পূর্বসংস্কার আমাদের মনে বদ্ধমূল হইয়া যায় নাই এবং বর্তমান কালের নূতন ভাবপ্রবাহও আমাদের নিকট অপরিচিত অনভ্যস্ত ছিল। তখন বঙ্গসাহিত্যেরও যেমন প্রাতঃসন্ধ্যা উপস্থিত আমাদেরও সেইরূপ বয়ঃসন্ধিকাল। বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্যে প্রভাতের সূর্যোদয় বিকাশ করিলেন, আমাদের হৃৎপদ্ম সেই প্রথম উদ্‌ঘাটিত হইল।

পূর্বে কী ছিল এবং পরে কী পাইলাম তাহা দুই কালের সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া আমরা এক মুহূর্তেই অনুভব করিতে পারিলাম। কোথায় গেল সেই অন্ধকার,সেই একাকার, সেই সুপ্তি, কোথায় গেল সেই বিজয়-বসন্ত, সেই গোলেবকাগুলি, সেই-সব বালক-ভুলানো কথা– কোথা হইতে আসিল এত আলোক, এত আশা, এত সংগীত, এত বৈচিত্র্য। বঙ্গদর্শন যেন তখন আষাঢ়ের প্রথম বর্ষার মতো “সমাগতো রাজবদুন্নত-ধ্বনিঃ”। এবং মুষলধারে ভাববর্ষণে বঙ্গসাহিত্যের পূর্ববাহিনী পশ্চিমবাহিনী সমস্ত নদী-নির্ঝরিণী অকস্মাৎ পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়া যৌবনের আনন্দবেগে ধাবিত হইতে লাগিল। কত কাব্য নাটক উপন্যাস কত প্রবন্ধ কত সমালোচনা কত মাসিকপত্র কত সংবাদপত্র বঙ্গভূমিকে জাগ্রত প্রভাতকলরবে মুখরিত করিয়া তুলিল। বঙ্গভাষা সহসা বাল্যকাল হইতে যৌবনে উপনীত হইল।

আমরা কিশোরকালের বঙ্গসাহিত্যের মধ্যে ভাবের সেই নবসমাগমের মহোৎসব দেখিয়াছিলাম; সমস্ত দেশ ব্যাপ্ত করিয়া যে-একটি আশার আনন্দ নূতন হিল্লোলিত হইয়াছিল তাহা অনুভব করিয়াছিলাম– সেইজন্য আজ মধ্যে মধ্যে নৈরাশ্য উপস্থিত হয়। মনে হয় সেদিন হৃদয়ে যে অপরিমেয় আশার সঞ্চার হইয়াছিল তদনুরূপ ফল লাভ করিতে পারি নাই। সে জীবনের বেগ আর নাই। কিন্তু এ নৈরাশ্য অনেকটা অমূলক। প্রথম-সমাগমের প্রবল উচ্ছ্বাস কখনো স্থায়ী হইতে পারে না। সেই নব আনন্দ নবীন আশার স্মৃতির সহিত বর্তমানের তুলনা করাই অন্যায়। বিবাহের প্রথম দিনে যে রাগিণীতে বংশীধ্বনি হয় সে রাগিণী চিরদিনের নহে। সেদিন কেবল অবিমিশ্র আনন্দ এবং আশা, তাহার পর হইতে বিচিত্র কর্তব্য, মিশ্রিত দুঃখসুখ, ক্ষুদ্র বাধাবিঘ্ন, আবর্তিত বিরহমিলন– তাহার পর হইতে গভীর গম্ভীর ভাবে নানা পথ বাহিয়া নানা শোকতাপ অতিক্রম করিয়া সংসারপথে অগ্রসর হইতে হইবে, প্রতিদিন আর সে নহবত বাজিবে না। তথাপি সেই একদিনের উৎসবের স্মৃতি কঠোর কর্তব্যপথে চিরদিন আনন্দ সঞ্চার করে।

বঙ্কিমচন্দ্র স্বহস্তে বঙ্গভাষার সহিত যেদিন নবযৌবনপ্রাপ্ত ভাবের পরিণয় সাধন করাইয়াছিলেন সেইদিনের সর্বব্যাপী প্রফুল্লতা এবং আনন্দ-উৎসব আমাদের মনে আছে। সেদিন আর নাই। আজ নানা লেখা নানা মত নানা আলোচনা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে– আজ কোনোদিন-বা ভাবের স্রোত মন্দ হইয়া আসে কোনোদিন- বা অপেক্ষাকৃত পরিপুষ্ট হইয়া উঠে।

এইরূপই হইয়া থাকে এবং এইরূপই হওয়া আবশ্যক। কিন্তু কাহার প্রসাদে এরূপ হওয়া সম্ভব হইল সে কথা স্মরণ করিতে হইবে। আমরা আত্মাভিমানে সর্বদাই তাহা ভুলিয়া যাই।

ভুলিয়া যে যাই তাহার প্রথম প্রমাণ, রামমোহন রায়কে আমাদের বর্তমান বঙ্গদেশের নির্মাণকর্তা বলিয়া আমরা জানি না। কী রাজনীতি, কী বিদ্যাশিক্ষা, কী সমাজ, কী ভাষা– আধুনিক বঙ্গদেশে এমন কিছুই নাই রামমোহন রায় স্বহস্তে যাহার সূত্রপাত করিয়া যান নাই। এমন-কি, আজ প্রাচীন শাস্ত্রালোচনার প্রতি, দেশের যে এক নূতন উৎসাহ দেখা যাইতেছে রামমোহন রায় তাহারও পথপ্রদর্শক। যখন নব শিক্ষাভিমানে স্বভাবতই পুরাতন শাস্ত্রের প্রতি অবজ্ঞা জন্মিবার সম্ভাবনা, তখন রামমোহন রায় সাধারণের অনধিগম্য বিস্মৃতপ্রায় বেদ-পুরাণ-তন্ত্র হইতে সারোদ্ধার করিয়া প্রাচীন শাস্ত্রের গৌরব উজ্জ্বল রাখিয়াছিলেন।

বঙ্গদেশ অদ্য সেই রামমোহন রায়ের নিকট কিছুতেই হৃদয়ের সহিত কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতে চাহে না।

রামমোহন বঙ্গসাহিত্যকে গ্রানিট-স্তরের উপর স্থাপন করিয়া নিমজ্জনদশা হইতে উন্নত করিয়া তুলিয়াছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র তাহারই উপর প্রতিভার প্রবাহ ঢালিয়া স্তরবদ্ধ পলিমৃত্তিকা ক্ষেপণ করিয়া গিয়াছেন। আজ বাংলা ভাষা কেবল দৃঢ় বাসযোগ্য নহে, উর্বরা শস্যশ্যামলা হইয়া উঠিয়াছে। বাসভূমি যথার্থ মাতৃভূমি হইয়াছে। এখন আমাদের মনের খাদ্য প্রায় ঘরের দ্বারেই ফলিয়া উঠিতেছে।

মাতৃভাষার বন্ধ্যদশা ঘুচাইয়া যিনি তাহাকে এমন গৌরবশালিনী করিয়া তুলিয়াছেন তিনি বাঙালির যে কী মহৎ কী চিরস্থায়ী উপকার করিয়াছেন সে কথা যদি কাহাকেও বুঝাইবার আবশ্যক হয় তবে তদপেক্ষা দুর্ভাগ্য আর কিছুই নাই। তৎপূর্বে বাংলাকে কেহ শ্রদ্ধাসহকারে দেখিত না। সংস্কৃত পণ্ডিতেরা তাহাকে গ্রাম্য এবং ইংরেজি পণ্ডিতেরা বর্বর জ্ঞান করিতেন। বাংলা ভাষায় যে কীর্তি উপার্জন করা যাইতে পারে সে কথা তাঁহাদের স্বপ্নের অগোচর ছিল। এইজন্য কেবল স্ত্রীলোক ও বালকদের জন্য অনুগ্রহপূর্বক দেশীয় ভাষায় তাঁহারা সরল পাঠ্য-পুস্তক রচনা করিতেন। সেই-সকল পুস্তকের সরলতা ও পাঠযোগ্যতা সম্বন্ধে যাঁহাদের জানিবার ইচ্ছা আছে তাঁহারা রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়-রচিত পূর্বতন এন্ট্রেন্স-পাঠ্য বাংলা গ্রন্থে দন্তস্ফুট করিবার চেষ্টা করিয়া দেখিবেন। অসম্মানিত বঙ্গভাষাও তখন অত্যন্ত দীন মলিন ভাবে কালযাপন করিত। তাহার মধ্যে যে কতটা সৌন্দর্য কতটা মহিমা প্রচ্ছন্ন ছিল তাহা তাহার দারিদ্র্য ভেদ করিয়া স্ফূর্তি পাইত না। যেখানে মাতৃভাষার এত অবহেলা সেখানে মানবজীবনের শুষ্কতা শূন্যতা দৈন্য কেহই দূর করিতে পারে না।

এমন সময়ে তখনকার শিক্ষিতশ্রেষ্ঠ বঙ্কিমচন্দ্র আপনার সমস্ত শিক্ষা সমস্ত অনুরাগ সমস্ত প্রতিভা উপহার লইয়া সেই সংকুচিতা বঙ্গভাষার চরণে সমর্পণ করিলেন; তখনকার কালে কী যে অসামান্য কাজ করিলেন তাহা তাঁহারই প্রসাদে আজিকার দিনে আমরা সম্পূর্ণ অনুমান করিতে পারি না।

তখন তাঁহার অপেক্ষা অনেক অল্পশিক্ষিত প্রতিভাহীন ব্যক্তি ইংরাজিতে দুই ছত্র লিখিয়া অভিমানে স্ফীত হইয়া উঠিতেন। ইংরাজি সমুদ্রে তাঁহারা যে কাঠবিড়ালির মতো বালির বাঁধ নির্মাণ করিতেছেন সেটুকু বুঝিবার শক্তিও তাঁহাদের ছিল না।

বঙ্কিমচন্দ্র যে সেই অভিমান সেই খ্যাতির সম্ভাবনা অকাতরে পরিত্যাগ করিয়া তখনকার বিদ্বজ্জনের অবজ্ঞাত বিষয়ে আপনার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিলেন ইহা অপেক্ষা বীরত্বের পরিচয় আর কী হইতে পারে! সম্পূর্ণ ক্ষমতাসত্ত্বেও আপন সমযোগ্য লোকের উৎসাহ এবং তাঁহাদের নিকট প্রতিপত্তির প্রলোভন পরিত্যাগ করিয়া একটি অপরীক্ষিত অনাদৃত অন্ধকার পথে আপন নবীন জীবনের সমস্ত আশা-উদ্যম-ক্ষমতাকে প্রেরণ করা কত বিশ্বাস এবং কত সাহসের বলে হয় তাহার পরিমাণ করা সহজ নহে।

কেবল তাহাই নহে। তিনি আপনার শিক্ষাগর্বে বঙ্গভাষার প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করিলেন না, একেবারেই শ্রদ্ধা প্রকাশ করিলেন। যত-কিছু আশা আকাঙক্ষা সৌন্দর্য-প্রেম মহত্ত্বভক্তি স্বদেশানুরাগ, শিক্ষিত পরিণত বুদ্ধির যত-কিছু শিক্ষালব্ধ চিন্তাজাত ধনরত্ন সমস্তই অকুণ্ঠিতভাবে বঙ্গভাষার হস্তে অর্পণ করিলেন। পরম সৌভাগ্য-গর্বে সেই অনাদর-মলিন ভাষার মুখে সহসা অপূর্ব লক্ষ্মীশ্রী প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিল।

তখন, পূর্বে যাঁহারা অবহেলা করিয়াছিলেন তাঁহারা বঙ্গভাষার যৌবনসৌন্দর্যে আকৃষ্ট হইয়া একে একে নিকটবর্তী হইতে লাগিলেন। বঙ্গসাহিত্য প্রতিদিন গৌরবে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতে লাগিল।

বঙ্কিম যে গুরুতর ভার লইয়াছিলেন তাহা অন্য কাহারো পক্ষে দুঃসাধ্য হইত। প্রথমত, তখন বঙ্গভাষা যে অবস্থায় ছিল তাহাকে যে শিক্ষিত ব্যক্তির সকলপ্রকার ভাবপ্রকাশে নিযুক্ত করা যাইতে পারে ইহা বিশ্বাস ও আবিষ্কার করা বিশেষ ক্ষমতার কার্য। দ্বিতীয়ত, যেখানে সাহিত্যের মধ্যে কোনো আদর্শ নাই, যেখানে পাঠক অসামান্য উৎকর্ষের প্রত্যাশাই করে না, যেখানে লেখক অবহেলাভরে লেখে এবং পাঠক অনুগ্রহের সহিত পাঠ করে, যেখানে অল্প ভালো লিখিলেই বাহবা পাওয়া যায় এবং মন্দ লিখিলেও কেহ নিন্দা করা বাহুল্য বিবেচনা করে, সেখানে কেবল আপনার অন্তরস্থিত উন্নত আদর্শকে সর্বদা সম্মুখে বর্তমান রাখিয়া সামান্য পরিশ্রমে সুলভখ্যাতিলাভের প্রলোভন সম্বরণ করিয়া অশ্রান্ত যত্নে অপ্রতিহত উদ্যমে দুর্গম পরিপূর্ণতার পথে অগ্রসর হওয়া অসাধারণ মাহাত্ম্যের কর্ম। চতুর্দিকব্যাপী উৎসাহহীন জীবনহীন জড়ত্বের মতো এমন গুরুভার আর কিছুই নেই; তাহার নিয়তপ্রবল ভারাকর্ষণ-শক্তি অতিক্রম করিয়া উঠা যে কত নিরলস চেষ্টা ও বলের কর্ম তাহা এখনকার সাহিত্যব্যবসায়ীরাও কতকটা বুঝিতে পারেন, তখন যে আরো কত কঠিন ছিল তাহা কষ্টে অনুমান করিতে হয়। সর্বত্রই যখন শৈথিল্য এবং সে-শৈথিল্য যখন নিন্দিত হয় না তখন আপনাকে নিয়মব্রতে বন্ধ করা মহাসত্ত্বলোকের দ্বারাই সম্ভব।

বঙ্কিম আপনার অন্তরের সেই আদর্শ অবলম্বন করিয়া প্রতিভাবলে যে কার্য করিলেন তাহা অত্যাশ্চর্য। বঙ্গদর্শনের পূর্ববর্তী এবং তাহার পরবর্তী বঙ্গসাহিত্যের মধ্যে যে উচ্চনীচতা তাহা অপরিমিত। দার্জিলিং হইতে যাঁহারা, কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরমালা দেখিয়াছেন তাঁহারা জানেন সেই অভ্রভেদী শৈলসম্রাটের উদয়রবিরশ্মি-সমুজ্জ্বল তুষারকিরীট চতুর্দিকের নিস্তব্ধ গিরি পারিষদবর্গের কত ঊর্ধ্বে সমুত্থিত হইয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্রের পরবর্তী বঙ্গসাহিত্য সেইরূপ আকস্মিক অত্যুন্নতি লাভ করিয়াছে; একবার সেইটি নিরীক্ষণ এবং পরিমাণ করিয়া দেখিলেই বঙ্কিমের প্রতিভার প্রভূত বল সহজে অনুমান করা যাইবে।

বঙ্কিম নিজে বঙ্গভাষাকে যে শ্রদ্ধা অর্পণ করিয়াছেন অন্যেও তাহাকে সেইরূপ শ্রদ্ধা করিবে ইহাই তিনি প্রত্যাশা করিতেন। পূর্ব-অভ্যাসবশত সাহিত্যের সহিত যদি কেহ ছেলেখেলা করিতে আসিত তবে বঙ্কিম তাহার প্রতি এমন দণ্ড বিধান করিতেন যে দ্বিতীয়বার সেরূপ স্পর্ধা দেখাইতে সে আর সাহস করিত না।

তখন সময় আরো কঠিন ছিল। বঙ্কিম নিজে দেশব্যাপী একটি ভাবের আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিলেন। সেই আন্দোলনের প্রভাবে কত চিত্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, এবং আপন ক্ষমতার সীমা উপলব্ধি করিতে না পারিয়া কত লোক যে এক লম্ফে লেখক হইবার চেষ্টা করিয়াছিল তাহার সংখ্যা নাই। লেখার প্রয়াস জাগিয়া উঠিয়াছে অথচ লেখার উচ্চ আদর্শ তখনো দাঁড়াইয়া যায় নাই। সেই সময় সব্যসাচী বঙ্কিম এক হস্ত গঠনকার্যে এক হস্ত নিবারণকার্যে নিযুক্ত রাখিয়াছিএলন। এক দিকে অগ্নি জ্বালাইয়া রাখিতেছিলেন আর-এক দিকে ধূম এবং ভস্মরাশি দূর করিবার ভার নিজেই লইয়াছিলেন।

রচনা এবং সমালোচনা এই উভয়কার্যের ভার বঙ্কিম একাকী গ্রহণ করাতেই বঙ্গসাহিত্য এত সত্বর এমন দ্রুত পরিণতি লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছিল।

এই দুষ্কর ব্রতানুষ্ঠানের যে ফল তাহাও তাঁহাকে ভোগ করিতে হইয়াছিল। মনে আছে, বঙ্গদর্শনে যখন তিনি সমালোচক-পদে আসীন ছিলেন তখন তাঁহার ক্ষুদ্র শত্রুর সংখ্যা অল্প ছিল না। শত শত অযোগ্য লোক তাঁহাকে ঈর্ষা করিত এবং তাঁহার শ্রেষ্ঠত্ব অপ্রমাণ করিবার চেষ্টা করিতে ছাড়িত না।

কণ্টক যতই ক্ষুদ্র হউক তাহার বিদ্ধ করিবার ক্ষমতা আছে এবং কল্পনাপ্রবণ লেখকদিগের বেদনাবোধও সাধারণের অপেক্ষা কিছু অধিক। ছোটো ছোটো দংশনগুলি যে বঙ্কিমকে লাগিত না, তাহা নহে, কিন্তু কিছুতেই তিনি কর্তব্যে পরাঙ্‌মুখ হন নাই। তাঁহার অজেয় বল, কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস ছিল। তখন জানিতেন, বর্তমানের কোনো উপদ্রব তাঁহার মহিমাকে আচ্ছন্ন করিতে পারিবে না, সমস্ত ক্ষুদ্র শত্রুর ব্যূহ হইতে তিনি অনায়াসে নিষ্ক্রমণ করিতে পারিবেন। এইজন্য চিরকাল তিনি অম্লানমুখে বীরদর্পে অগ্রসর হইয়াছেন, কোনোদিন তাঁহাকে রথবেগ খর্ব করিতে হয় নাই।

সাহিত্যের মধ্যেও দুই শ্রেণীর যোগী দেখা যায়, ধ্যানযোগী এবং কর্মযোগী। ধ্যানযোগী একান্তমনে বিরলে ভাবের চর্চা করেন,তাঁহার রচনাগুলি সংসারী লোকের পক্ষে যেন উপরি-পাওনা, যেন যথালাভের মতো।

কিন্তু বঙ্কিম সাহিত্যে কর্মযোগী ছিলেন। তাঁহার প্রতিভা আপনাতে আপনি স্থিরভাবে পর্যাপ্ত ছিল না। সাহিত্যের যেখানে যাহা-কিছু অভাব ছিল সর্বত্রই তিনি আপনার বিপুল বল এবং আনন্দ লইয়া ধাবমান হইতেন। কী কাব্য, কী বিজ্ঞান, কী ইতিহাস, কী ধর্মতত্ত্ব যেখানে যখনই তাঁহাকে আবশ্যক হইত সেখানে তখনই তিনি সম্পূর্ণ প্রস্তুত হইয়া দেখা দিতেন। নবীন বঙ্গসাহিত্যের মধ্যে সকল বিষয়েই আদর্শ স্থাপন করিয়া যাওয়া তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল। বিপন্ন বঙ্গভাষা আর্তস্বরে যেখানেই তাঁহাকে আহ্বান করিয়াছে সেখানেই তিনি প্রসন্ন চতুর্ভূজ মূর্তিতে দর্শন দিয়াছেন।

কিন্তু তিনি যে কেবল অভয় দিতেন, সান্ত্বনা দিতেন, অভাব পূর্ণ করিতেন তাহা নহে, তিনি দর্পহারীও ছিলেন। এখন যাঁহারা বঙ্গসাহিত্যের সারথ্য স্বীকার করিতে চান তাঁহারা দিনে নিশীথে বঙ্গদেশকে অত্যুক্তিপূর্ণ স্তুতিবাক্যে নিয়ত প্রসন্ন রাখিতে চেষ্টা করেন, কিন্তু বঙ্কিমের বাণী কেবল স্তুতিবাদিনী ছিল না, খড়গধারিণীও ছিল। বঙ্গদেশ যদি অসাড় প্রাণহীন না হইত তবে “কৃষ্ণচরিত্রে” বর্তমান পতিত হিন্দুসমাজ ও বিকৃত হিন্দুধর্মের উপর যে অস্ত্রাঘাত আছে সে আঘাতে বেদনাবোধ এবং কথঞ্চিৎ চেতনা লাভ করিত। বঙ্কিমের ন্যায় তেজস্বী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি ব্যতীত আর কেহই লোকাচার-দেশাচারের বিরুদ্ধে এরূপ নির্ভীক স্পষ্ট উচ্চারণে আপন মত প্রকাশ করিতে সাহস করিত না। এমন-কি, বঙ্কিম প্রাচীন হিন্দু-শাস্ত্রের প্রতি ঐতিহাসিক বিচার প্রয়োগ করিয়া তাহার সার এবং অসার ভাগ পৃথক্‌করণ, তাহার প্রামাণ্য এবং অপ্রামাণ্য অংশের বিশ্লেষণ এবং নিঃসংকোচে করিয়াছেন যে এখনকার দিনে তাহার তুলনা পাওয়া কঠিন।

বিশেষত দুই শত্রুর মাঝখান দিয়া তাঁহাকে পথ কাটিয়া চলিতে হইয়াছে। এক দিকে যাঁহারা অবতার মানেন না তাঁহারা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি দেবত্বারোপে বিপক্ষ হইয়া দাঁড়ান। অন্য দিকে যাঁহারা শাস্ত্রের প্রত্যেক অক্ষর এবং লোকাচারের প্রত্যেক প্রথাকে অভ্রান্ত বলিয়া জ্ঞান করেন তাঁহারাও, বিচারের লৌহাস্ত্র দ্বারা শাস্ত্রের মধ্য হইতে কাটিয়া কাটিয়া কুঁদিয়া কুঁদিয়া মহত্তম মনুষ্যের আদর্শ অনুসারে দেবতা-গঠনকার্যে বড়ো প্রসন্ন হন নাই। এরূপ অবস্থায় অন্য কেহ হইলে কোনো এক পক্ষকে সর্বতোভাবে আপন দলে পাইতে ইচ্ছা করিতেন। কিন্তু সাহিত্যমহারথী বঙ্কিম দক্ষিণে বামে উভয় পক্ষের প্রতিই তীক্ষ্ণ শরচালন করিয়া অকুণ্ঠিতভাবে অগ্রসর হইয়াছেন– তাঁহার নিজের প্রতিভা কেবল তাঁহার একমাত্র সহায় ছিল। তিনি যাহা বিশ্বাস করিয়াছেন তাহা স্পষ্ট ব্যক্ত করিয়াছেন– বাক্‌চাতুরী দ্বারা আপনাকে বা অন্যকে বঞ্চনা করেন নাই।

কল্পনা এবং কাল্পনিকতা দুইয়ের মধ্যে একটা মস্ত প্রভেদ আছে। যথার্থ কল্পনা, যুক্তি সংযম এবং সত্যের দ্বারা সুনির্দিষ্ট আকারবদ্ধ– কাল্পনিকতার মধ্যে সত্যের ভান আছে মাত্র, কিন্তু তাহা অদ্ভুত আতিশয্যে অসংগতরূপে স্ফীতকায়। তাহার মধ্যে যেটুকু আলোকের লেশ আছে ধূমের অংশ তাহার শতগুণ। যাহাদের ক্ষমতা অল্প তাহারা সাহিত্যে প্রায় এই প্রধূমিত কাল্পনিকতার আশ্রয় লইয়া থাকে– কারণ, ইহা দেখিতে প্রকাণ্ড কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত লঘু। এক শ্রেণীর পাঠকেরা এইরূপ ভূরিপরিমাণ কৃত্রিম কাল্পনিকতার নৈপুণ্যে মুগ্ধ ও অভিভূত হইয়া পড়েন এবং দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলায় সেই শ্রেণীর পাঠক বিরল নহে।

এইরূপ অপরিমিত অসংযত কল্পনার দেশে বঙ্কিমের ন্যয় আদর্শ আমাদের পক্ষে অত্যন্ত মূল্যবান। “কৃষ্ণচরিত্রে” উদ্দাম ভাবের আবেগে তাঁহার কল্পনা কোথাও উচ্চৃঙ্খল হইয়া ছুটিয়া যায় নাই। প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত সর্বত্রই তিনি পদে পদে আত্মসম্বরণপূর্বক যুক্তির সুনির্দিষ্ট পথ অবলম্বন করিয়া চলিয়াছেন। যাহা লিখিয়াছেন তাহাতে তাঁহার প্রতিভা প্রকাশ পাইয়াছে, যাহা লিখেন নাই তাহাতেও তাঁহার অল্প ক্ষমতা প্রকাশ পায় নাই।

বিশেষত বিষয়টি এমন যে, ইহা কোনো সাধারণ বাঙালি লেখকের হস্তে পড়িলে তিনি এই সুযোগে বিস্তর হরি হরি, মরি মরি, হায় হায়, অশ্রুপাত ও প্রবল অঙ্গভঙ্গি করিতেন এবং কল্পনার উচ্ছ্বাস, ভাবের আবেগ এবং হৃদয়াতিশয্য প্রকাশ করিবার এমন অনুকূল অবসর কখনোই ছাড়িতেন না; সুবিচারিত তর্ক দ্বারা, সুকঠিন সত্যনির্ণয়ের স্পৃহা দ্বারা পদে পদে আপন লেখনীকে বাধা দিতেন না। সর্বজনগম্য সরল পথ ছাড়িয়া দিয়া সূক্ষ্মবুদ্ধি দ্বারা স্বকপোলকল্পিত একটা নূতন আবিষ্কারকেই সর্বপ্রাধান্য দিয়া তাহাকেই বাক্‌প্রাচুর্যে এবং কল্পনাকুহকে সমাচ্ছন্ন করিয়া তুলিতেন, এবং নিজের বিশ্বাস ও ভাষাকে যথাসাধ্য টানিয়া বুনিয়া আশেপাশে দীর্ঘ করিয়া অধিকপরিমাণে লোককে আপন মতের জালে আকর্ষণ করিতে চেষ্টা করিতেন।

বস্তুত আমাদের শাস্ত্র হইতে ইতিহাস উদ্ধারের দুরূহ ভার কেবল বঙ্কিম লইতে পারিতেন। এক দিকে হিন্দুশাস্ত্রের প্রকৃত মর্ম গ্রহণে ইউরোপীয়গণের অক্ষমতা, অন্য দিকে শাস্ত্রগত প্রমাণের নিরপেক্ষ বিচার সম্বন্ধে হিন্দুদের সংকোচ; এক দিকে রীতিমত পরিচয়ের অভাব, অন্য দিকে অতিপরিচয়জনিত অভ্যাস ও সংস্কারের অন্ধতা; যথার্থ ইতিহাসটিকে এই উভয়সংকটের মাঝখান হইতে উদ্ধার করিতে হইবে। দেশানুরাগের সাহায্যে শাস্ত্রের অন্তরে প্রবেশ করিতে হইবে এবং সত্যানুরাগের সাহায্যে তাহার অমূলক অংশ পরিত্যাগ করিতে হইবে। যে বল্‌গার ইঙ্গিতে লেখনীকে বেগ দিতে হইবে, সেই বল্‌গার আকর্ষণে তাহাকে সর্বদা সংযত করিতে হইবে। এই-সকল ক্ষমতাসামঞ্জস্য বঙ্কিমের ছিল। সেইজন্য মৃত্যুর অনতিপূর্বে তিনি যখন প্রাচীন বেদ পুরাণ সংগ্রহ করিয়া প্রস্তুত হইয়া বসিয়াছিলেন তখন বঙ্গসাহিত্যের বড়ো আশার কারণ ছিল, কিন্তু মৃত্যু সে আশা সফল হইতে দিল না, এবং আমাদের ভাগ্যে যাহা অসম্পন্ন রহিয়া গেল তাহা যে কবে সমাধা হইবে কেহই বলিতে পারে না।

বঙ্কিম এই-যে সর্বপ্রকার আতিশয্য এবং অসংগতি হইতে আপনাকে রক্ষা করিয়া গিয়াছেন ইহা তাঁহার প্রতিভার প্রকৃতিগত। যে-কেহ তাঁহার রচনা পড়িয়াছেন সকলেই জানেন বঙ্কিম হাস্যরসে সুরসিক ছিলেন। যে পরিষ্কার যুক্তির আলোকের দ্বারা সমস্ত আতিশয্য ও অসংগতি প্রকাশ হইয়া পড়ে হাস্যরস সেই কিরণেরই একটি রশ্মি। কতদূর পর্যন্ত গেলে একটি ব্যাপার হাস্যজনক হইয়া উঠে তাহা সকলে অনুভব করিতে পারে না, কিন্তু যাঁহারা হাস্যরসরসিক তাঁহাদের অন্তঃকরণে একটি বোধশক্তি আছে যদ্দারা তাঁহারা সকল সময়ে নিজের না হইলেও অপরের কথাবার্তা আচারব্যবহার এবং চরিত্রের মধ্যে সুসংগতির সূক্ষ্ম সীমাটুকু সহজে নির্ণয় করিতে পারেন।

নির্মল শুভ্র সংযত হাস্য বঙ্কিমই সর্বপ্রথমে বঙ্গসাহিত্যে আনয়ন করেন। তৎপূর্বে বঙ্গসাহিত্যে হাস্যরসকে অন্য রসের সহিত এক পঙ্‌ক্তিতে বসিতে দেওয়া হইত না। সে নিম্নাসনে বসিয়া শ্রাব্য অশ্রাব্য ভাষায় ভাঁড়ামি করিয়া সভাজনের মনোরঞ্জন করিত। আদিরসেরই সহিত যেন তাহার কোনো-একটি সর্ব-উপদ্রবসহ বিশেষ কুটুম্বিতার সম্পর্ক ছিল এবং ঐ রসটাকেই সর্বপ্রকারে পীড়ন ও আন্দোলন করিয়া তাহার অধিকাংশ পরিহাস-বিদ্রূপ প্রকাশ পাইত। এই প্রগল্‌ভ বিদূষকটি যতই প্রিয়পাত্র থাক্‌ কখনো সম্মানের অধিকারী ছিল না। যেখানে গম্ভীরভাবে কোনো বিষয়ের আলোচনা হইত সেখানে হাস্যের চপলতা সর্বপ্রযত্নে পরিহার করা হইত।

বঙ্কিম সর্বপ্রথমে হাস্যরসকে সাহিত্যের উচ্চশ্রেণীতে উন্নীত করেন। তিনিই প্রথম দেখাইয়া দেন যে, কেবল প্রহসনের সীমার মধ্যে হাস্যরস বদ্ধ নহে; উজ্জ্বল শুভ্র হাস্য সকল বিষয়কেই আলোকিত করিয়া তুলিতে পারে। তিনিই প্রথম দৃষ্টান্তের দ্বারা প্রমাণ করাইয়া দেন যে, এই হাস্যজ্যোতির সংস্পর্শে কোনো বিষয়ের গভীরতার গৌরব হ্রাস হয় না, কেবল তাহার সৌন্দর্য এবং রমণীয়তার বৃদ্ধি হয়, তাহার সর্বাংশের প্রাণ এবং গতি যেন সুস্পষ্টরূপে দীপ্যমান হইয়া উঠে। যে বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্যের গভীরতা হইতে অশ্রুর উৎস উন্মুক্ত করিয়াছেন সেই বঙ্কিম আনন্দের উদয়শিখর হইতে নবজাগ্রত বঙ্গসাহিত্যের উপর হাস্যের আলোক বিকীর্ণ করিয়া দিয়াছেন।

কেবল সুসংগতি নহে, সুরুচি এবং শিষ্টতার সীমা নির্ণয় করিতেও একটি স্বাভাবিক সূক্ষ্ম বোধশক্তির আবশ্যক। মাঝে মাঝে অনেক বলিষ্ঠ প্রতিভার মধ্যে সেই বোধশক্তির অভাব দেখা যায়। কিন্তু বঙ্কিমের প্রতিভায় বল এবং সৌকুমার্যের একটি সুন্দর সংমিশ্রণ ছিল। নারীজাতির প্রতি যথার্থ বীরপুরুষের মনে যেরূপ একটি সসম্ভ্রম সম্মানের ভাব থাকে তেমনি সুরুচি এবং শীলতার প্রতি বঙ্কিমের বলিষ্ঠবুদ্ধির একটি বীরোচিত প্রীতিপূর্ণ শ্রদ্ধা ছিল। বঙ্কিমের রচনা তাহার সাক্ষ্য। বর্তমান লেখক যেদিন প্রথম বঙ্কিমকে দেখিয়াছিল, সেদিন একটি ঘটনা ঘটে যাহাতে বঙ্কিমের এই স্বাভাবিক সুরুচিপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

সেদিন লেখকের আত্মীয় পূজ্যপাদ শ্রীযুক্ত শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর মহোদয়ের নিমন্ত্রণে তাঁহাদের মরকতকুঞ্জে কলেজ-রিয়্যুনিয়ন নামক মিলনসভা বসিয়াছিল। ঠিক কতদিনের কথা স্মরণ নাই, কিন্তু আমি তখন বালক ছিলাম। সেদিন সেখানে আমার অপরিচিত বহুতর যশস্বী লোকের সমাগম হইয়াছিল। সেই বুধমণ্ডলীর মধ্যে একটি ঋজু দীর্ঘকায় উজ্জ্বলকৌতুকপ্রফুল্লমুখ গুম্ফধারী প্রৌঢ় পুরুষ চাপকানপরিহিত বক্ষের উপর দুই হস্ত আবদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। দেখিবামাত্রই যেন তাঁহাকে সকলের হইতে স্বতন্ত্র এবং আত্মসমাহিত বলিয়া বোধ হইল। আর সকলে জনতার অংশ, কেবল তিনি যেন একাকী একজন। সেদিন আর-কাহারো পরিচয় জানিবার জন্য আমার কোনোরূপ প্রয়াস জন্মে নাই, কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া তৎক্ষণাৎ আমি এবং আমার একটি আত্মীয় সঙ্গী একসঙ্গেই কৌতূহলী হইয়া উঠিলাম। সন্ধান লইয়া জানিলাম তিনিই আমাদের বহুদিনের অভিলষিতদর্শন লোকবিশ্রুত বঙ্কিমবাবু। মনে আছে, প্রথম দর্শনেই তাঁহার মুখশ্রীতে প্রতিভার প্রখরতা এবং বলিষ্ঠতা এবং সর্বলোক হইতে তাঁহার একটি সুদূর স্বাতন্ত্র্যভাব আমার মনে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল। তাহার পর অনেক বার তাঁহার সাক্ষাৎলাভ করিয়াছি, তাঁহার নিকট অনেক উৎসাহ এবং উপদেশ প্রাপ্ত হইয়াছি, এবং তাঁহার মুখশ্রী স্নেহের কোমলহাস্যে অত্যন্ত কমনীয় হইতে দেখিয়াছি, কিন্তু প্রথম দর্শনে সেই-যে তাঁহার মুখে উদ্যত খড়ে্‌গর ন্যায় একটি উজ্জ্বল সুতীক্ষ্ণ প্রবলতা দেখিতে পাইয়াছিলাম, তাহা আজ পর্যন্ত বিস্মৃত হই নাই।

সেই উৎসব উপলক্ষে একটি ঘরে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত দেশানুরাগমূলক স্বরচিত সংস্কৃত শ্লোক পাঠ এবং তাহার ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। বঙ্কিম এক প্রান্তে দাঁড়াইয়া শুনিতেছিলেন। পণ্ডিতমহাশয় সহসা একটি শ্লোকে পতিত ভারতসন্তানকে লক্ষ্য করিয়া একটা অত্যন্ত সেকেলে পণ্ডিতি রসিকতা প্রয়োগ করিলেন, সে রস কিঞ্চিৎ বীভৎস হইয়া উঠিল। বঙ্কিম তৎক্ষণাৎ একান্ত সংকুচিত হইয়া দক্ষিণ-করতলে মুখের নিম্নার্ধ ঢাকিয়া পার্শ্ববর্তী দ্বার দিয়া দ্রুতবেগে অন্য ঘরে পলায়ন করিলেন।

বঙ্কিমের সেই সসংকোচ পলায়নদৃশ্যটি অদ্যাবধি আমার মনে মুদ্রাঙ্কিত হইয়া আছে।

বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে, ঈশ্বর গুপ্ত যখন সাহিত্যগুরু ছিলেন বঙ্কিম তখন তাঁহার শিষ্যশ্রেণীর মধ্যে গণ্য ছিলেন। সে সময়কার সাহিত্য অন্য যে-কোনো প্রকার শিক্ষা দিতে সমর্থ হউক ঠিক সুরুচি শিক্ষার উপযোগী ছিল না। সে সময়কার অসংযত বাকযুদ্ধ এবং আন্দোলনের মধ্যে দীক্ষিত ও বর্ধিত হইয়া ইতরতার প্রতি বিদ্বেষ, সুরুচির প্রতি শ্রদ্ধা এবং শ্লীলতা সম্বন্ধে অক্ষুণ্ন বেদনাবোধ রক্ষা করা কী যে আশ্চর্য ব্যাপার তাহা সকলেই বুঝিতে পারিবেন। দীনবন্ধুও বঙ্কিমের সমসাময়িক এবং তাঁহার বান্ধব ছিলেন, কিন্তু তাঁহার লেখায় অন্য ক্ষমতা প্রকাশ হইলেও তাহাতে বঙ্কিমের প্রতিভার এই ব্রাহ্মণোচিত শুচিতা দেখা যায় না। তাঁহার রচনা হইতে ঈশ্বর গুপ্তের সময়ের ছাপ কালক্রমে ধৌত হইতে পারে নাই।

আমাদের মধ্যে যাঁহারা সাহিত্যব্যবসায়ী তাঁহারা বঙ্কিমের কাছে যে কী চিরঋণে আবদ্ধ তাহা যেন কোনো কালে বিস্মৃত না হন। একদিন আমাদের বঙ্গভাষা কেবল একতারা যন্ত্রের মতো এক তারে বাঁধা ছিল, কেবল সহজ সুরে ধর্ম সংকীর্তন করিবার উপযোগী ছিল; বঙ্কিম স্বহস্তে তাহাতে এক-একটি করিয়া তার চড়াইয়া আজ তাহাকে বীণাযন্ত্রে পরিণত করিয়া তুলিয়াছেন। পূর্বে যাহাতে কেবল স্থানীয় গ্রাম্য সুর বাজিত তাহা আজ বিশ্বসভায় শুনাইবার উপযুক্ত ধ্রুবপদ অঙ্গের কলাবতী রাগিণী আলাপ করিবার যোগ্য হইয়া উঠিয়াছে। সেই তাঁহার স্বহস্তসম্পূর্ণ স্নেহপালিত ক্রোড়সঙ্গিনী বঙ্গভাষা আজ বঙ্কিমের জন্য অন্তরের সহিত রোদন করিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তিনি এই শোকোচ্ছ্বাসের অতীত শান্তিধামে দুষ্কর জীবনযজ্ঞের অবসানে নির্বিকার নিরাময় বিশ্রাম লাভ করিয়াছেন। মৃত্যুর পরে তাঁহার মুখে একটি কোমল প্রসন্নতা, একটি সর্বদুঃখতাপহীন গভীর প্রশান্তি উদ্‌ভাসিত হইয়া উঠিয়াছিল– যেন জীবনের মধ্যাহ্নরৌদ্রদগ্ধ কঠিন সংসারতল হইতে মৃত্যু তাঁহাকে স্নেহসুশীতল জননীক্রোড়ে তুলিয়া লইয়াছেন। আজ আমাদের বিলাপ-পরিতাপ তাঁহাকে স্পর্শ করিতেছে না, আমাদের ভক্তি-উপহার গ্রহণ করিবার জন্য সেই প্রতিভাজ্যোতির্ময় সৌম্য প্রসন্নমূর্তি এখানে উপস্থিত নাই। আমাদের এই শোক এই ভক্তি কেবল আমাদেরই কল্যাণের জন্য। বঙ্কিম সাহিত্যক্ষেত্রে যে আদর্শ স্থাপন করিয়া গিয়াছেন এই শোকে এই ভক্তিতে সেই আদর্শপ্রতিমা আমাদের অন্তরে উজ্জ্বল এবং স্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠিত হউক। প্রস্তরের মূর্তি স্থাপনের অর্থ এবং সামর্থ্য আমাদের যদি না থাকে, তবে একবার তাঁহার মহত্ত্ব সর্বতোভাবে মনের মধ্যে উপলব্ধি করিয়া তাঁহাকে আমাদের বঙ্গহৃদয়ের স্মরণস্তম্ভে স্থায়ী করিয়া রাখি। ইংরাজ এবং ইংরাজের আইন চিরস্থায়ী নহে; রাজনৈতিক ধর্মনৈতিক সমাজনৈতিক মতামত সহস্রবার পরিবর্তিত হইতে পারে; যে-সকল ঘটনা যে-সকল অনুষ্ঠান আজ সর্বপ্রধান বলিয়া বোধ হইতেছে এবং যাহার উন্মাদনার কোলাহলে সমাজের খ্যাতিহীন শব্দহীন কর্তব্যগুলিকে নগণ্য বলিয়া ধারণা হইতেছে, কাল তাহার স্মৃতিমাত্র চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট থাকিতে না পারে; কিন্তু যিনি আমাদের মাতৃভাষাকে সর্বপ্রকার ভাবপ্রকাশের অনুকূল করিয়া গিয়াছেন তিনি এই হতভাগ্য-দরিদ্র দেশকে একটি অমূল্য চিরসম্পদ দান করিয়াছেন। তিনি স্থায়ী জাতীয় উন্নতির একমাত্র মূল উপায় স্থাপন করিয়া গিয়াছেন। তিনিই আমাদের নিকট যথার্থ শোকের মধ্যে সান্ত্বনা, অবনতির মধ্যে আশা, শ্রান্তির মধ্যে উৎসাহ এবং দারিদ্র্যের শূন্যতার মধ্যে চির-সৌন্দর্যের অক্ষয় আকর উদ্‌ঘাটিত করিয়া দিয়াছেন। আমাদিগের মধ্যে যাহা-কিছু অমর এবং আমাদিগকে যাহা-কিছু অমর করিবে সেই-সকল মহাশক্তিকে ধারণ করিবার পোষণ করিবার প্রকাশ করিবার এবং সর্বত্র প্রচার করিবার একমাত্র উপায় যে মাতৃভাষা তাহাকেই তিনি বলবতী এবং মহীয়সী করিয়াছেন।

রচনাবিশেষের সমালোচনা ভ্রান্ত হইতে পারে– আমাদিগের নিকট যাহা প্রশংসিত কালক্রমে শিক্ষা রুচি এবং অবস্থার পরিবর্তনে আমাদের উত্তরপুরুষের নিকট তাহা নিন্দিত এবং উপেক্ষিত হইতে পারে; কিন্তু বঙ্কিম বঙ্গভাষার ক্ষমতা এবং বঙ্গসাহিত্যের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করিয়া দিয়াছেন, তিনি ভগীরথের ন্যায় সাধনা করিয়া বঙ্গসাহিত্যে ভাবমন্দাকিনীর অবতারণ করিয়াছেন এবং সেই পুণ্যস্রোতস্পর্শে জড়ত্বশাপ মোচন করিয়া আমাদের প্রাচীন ভস্মরাশিকে সঞ্জীবিত করিয়া তুলিয়াছেন। ইহা কেবল সাময়িক মত নহে, এ কথা কোনো বিশেষ তর্ক বা রুচির উপর নির্ভর করিতেছে না, ইহা একটি ঐতিহাসিক সত্য।

এই কথা স্মরণে মুদ্রিত করিয়া সেই বাংলা লেখকদিগের গুরু, বাংলা পাঠকদিগের সুহৃদ, এবং সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা বঙ্গভূমির মাতৃবৎসল প্রতিভাশালী সন্তানের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করি, যিনি জীবনের সায়াহ্ন আসিবার পূর্বেই, নূতন অবকাশে নূতন উদ্যমে নূতন কার্যে হস্তক্ষেপ করিবার প্রারম্ভেই, আপনার অপরিম্লান প্রতিভারশ্মি সংহরণ করিয়া বঙ্গসাহিত্যাকাশ ক্ষীণতর জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর হস্তে সমর্পণপূর্বক গত শতাব্দীর বর্ষশেষের পশ্চিমদিগন্তসীমায় অকালে অস্তমিত হইলেন।

বিহারীলাল
আধুনিক সাহিত্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বর্তমান নববর্ষের প্রারম্ভেই কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর পরলোকপ্রাপ্তি হইয়াছে।

বঙ্গের সারস্বতকুঞ্জে মৃত্যু ব্যাধের ন্যায় প্রবেশ করিয়াছে। তাহার নিষ্ঠুর শর-সন্ধানে অল্পকালের মধ্যে অনেকগুলি কণ্ঠ নীরব হইয়া গেল।

তন্মধ্যে বিহারীলালের কণ্ঠ সাধারণের নিকট তেমন সুপরিচিত ছিল না। তাঁহার শ্রোতৃমণ্ডলীর সংখ্যা অল্প ছিল এবং তাঁহার সুমধুর সংগীত নির্জনে নিভৃতে ধ্বনিত হইতে থাকিত, খ্যাতির প্রার্থনায় পাঠক এবং সমালোচক-সমাজের দ্বারবর্তী হইত না।

কিন্তু যাহারা দৈবক্রমে এই বিজনবাসী ভাবনিমগ্ন কবির সংগীতকাকলিতে আকৃষ্ট হইয়া তাঁহার কাছে আসিয়াছিল তাহাদের নিকটে তাঁহার আদরের অভাব ছিল না। তাহারা তাঁহাকে বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবি বলিয়া জানিত।

বঙ্গদর্শন প্রকাশ হইবার বহুপূর্বে কিছুকাল ধরিয়া অবোধবন্ধু-নামক একটি মাসিক পত্র বাহির হইত। তখন বর্তমান লেখক বালকবয়সপ্রযুক্ত নিতান্ত অবোধ ছিল। কিঞ্চিৎ বয়ঃপ্রাপ্তিসহকারে যখন বোধোদয় হইল তখন উক্ত কাগজ বন্ধ হইয়া গেল।

সৌভাগ্যক্রমে পত্রগুলি কতক বাঁধানো কতক-বা খণ্ড আকারে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আলমারির মধ্যে রক্ষিত ছিল। অনেক মূল্যবান গ্রন্থাদি থাকাতে সে আলমারিতে চপলপ্রকৃতি বালকদের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ ছিল। এক্ষণে নির্ভয়ে স্বীকার করিতে পারি, অবোধবন্ধুর বন্ধুত্ব-প্রলোভনে মুগ্ধ হইয়া সে নিষেধ লঙ্ঘন করিয়াছিলাম। এই গোপন দুষ্কর্মের জন্য কোনোরূপ শাস্তি পাওয়া দূরে থাক, বহুকাল ধরিয়া যে আনন্দলাভ করিয়াছিলাম তাহা এখনো বিস্মৃত হই নাই।

এখনো মনে আছে ইস্কুল ফাঁকি দিয়া একটি দক্ষিণদ্বারী ঘরে সুদীর্ঘ নির্জন মধ্যাহ্নে অবোধবন্ধু হইতে পৌল-বর্জিনীর বাংলা অনুবাদ পাঠ করিতে করিতে প্রবল বেদনায় হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইত। তখন কলিকাতার বহির্বর্তী প্রকৃতি আমার নিকট অপরিচিত ছিল_ এবং পৌল-বর্জিনীতে সমুদ্রতটের অরণ্যদৃশ্যবর্ণনা আমার নিকট অনির্বচনীয় সুখস্বপ্নের ন্যায় প্রতিভাত হইত, এবং সেই তরঙ্গঘাতধ্বনিত বনচ্ছায়াস্নিগ্ধ সমুদ্রবেলায় পৌল-বর্জিনীর মিলন এবং বিচ্ছেদবেদনা হৃদয়ের মধ্যে যেন মূর্ছনাসহকারে অপূর্ব সংগীতের মতো বাজিয়া উঠিত।

এই ক্ষুদ্র পত্রে যে-সকল গদ্যপ্রবন্ধ বাহির হইত, তাহার মধ্যে কিছু বিশেষত্ব ছিল। তখনকার বাংলা গদ্যে সাধুভাষার অভাব ছিল না, কিন্তু ভাষার চেহারা ফোটে নাই। তখন যাঁহারা মাসিক পত্রে লিখিতেন তাঁহারা গুরু সাজিয়া লিখিতেন– এইজন্য তাঁহারা পাঠকদের নিকট আত্মপ্রকাশ করেন নাই এবং এইজন্যই তাঁহাদের লেখার যেন একটা স্বরূপ ছিল না। যখন অবোধবন্ধু পাঠ করিতাম তখন তাহাকে ইস্কুলের পড়ার অনুবৃত্তি বলিয়া মনে হইত না। বাংলা ভাষায় বোধ করি সেই প্রথম মাসিক পত্র বাহির হইয়াছিল যাহার রচনার মধ্যে একটা স্বাদবৈচিত্র্য পাওয়া যাইত। বর্তমান বঙ্গসাহিত্যের প্রাণসঞ্চারের ইতিহাস যাঁহারা পর্যালোচনা করিবেন তাঁহারা অবোধবন্ধুকে উপেক্ষা করিতে পারিবেন না। বঙ্গদর্শনকে যদি আধুনিক বঙ্গসাহিত্যের প্রভাতসূর্য বলা যায় তবে ক্ষুদ্রায়তন অবোধবন্ধুকে প্রত্যুষের শুকতারা বলা যাইতে পারে।

সে-প্রত্যুষে লোক জাগে নাই এবং সাহিত্যকুঞ্চে বিচিত্র কলগীত কুজিত হইয়া উঠে নাই। সেই উষালোকে কেবল একটি ভোরের পাখি সুমিষ্ট সুন্দর সুরে গান ধরিয়াছিল। সে সুর তাহার নিজের।

ঠিক ইতিহাসের কথা বলিতে পারি না– কিন্তু আমি সেই প্রথম বাংলা কবিতায় কবির নিজের সুর শুনিলাম।

রাত্রির অন্ধকার যখন দূর হইতে থাকে তখন যেমন জগতের মূর্তি রেখায় রেখায় ফুটিয়া ওঠে, সেইরূপ অবোধবন্ধুর গদ্যে পদ্যে যেন প্রতিভার প্রত্যুষকিরণে মূর্তির বিকাশ হইতে লাগিল। পাঠকের কল্পনার নিকটে একটি ভাবের দৃশ্য উদ্‌ঘাটিত হইয়া গেল।

     “সর্বদাই হু হু করে মন,
     বিশ্ব যেন মরুর মতন।
     চারি দিকে ঝালাফালা।
     উঃ কী জ্বলন্ত জ্বালা,
     অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গপতন।”

আধুনিক বঙ্গসাহিত্যে এই প্রথম বোধ হয় কবির নিজের কথা। তৎসময়ে অথবা তৎপূর্বে মাইকেলের চতুর্দশপদীতে কবির আত্মনিবেদন কখনো কখনো প্রকাশ পাইয়া থাকিবে– কিন্তু তাহা বিরল– এবং চতুর্দশপদীর সংক্ষিপ্ত পরিসরের মধ্যে আত্মকথা এমন কঠিন ও সংহত হইয়া আসে যে, তাহাতে বেদনার গীতোচ্ছ্বাস তেমন স্ফূর্তি পায় না।

বিহারীলাল তখনকার ইংরেজিভাষায়-নব্যশিক্ষিত কবিদিগের ন্যায় যুদ্ধবর্ণনাসংকুল মহাকাব্য, উদ্দীপনাপূর্ণ দেশানুরাগমূলক কবিতা লিখিলেন না, এবং পুরাতন কবি-

দিগের ন্যায় পৌরাণিক উপাখ্যানের দিকেও গেলেন না– তিনি নিভৃতে বসিয়া নিজের ছন্দে নিজের মনের কথা বলিলেন। তাঁহার সেই স্বগত উক্তিতে বিশ্বহিত দেশহিত অথবা সভামনোরঞ্জনের কোনো উদ্দেশ্য দেখা গেল না। এইজন্য তাঁহার সুর অন্তরঙ্গরূপে হৃদয়ে প্রবেশ করিয়া সহজেই পাঠকের বিশ্বাস আকর্ষণ করিয়া আনিল।

পাঠকদিগকে এইরূপে বিশ্রব্ধভাবে আপনার নিকটে টানিয়া আনিবার ভাব প্রথম অবোধবন্ধুর গদ্যে এবং অবোধবন্ধুর কবি বিহারীলালের কাব্যে অনুভব করিয়াছিলাম। পৌল-বর্জিনীতে যেমন মানুষের এবং প্রকৃতির নিকট-পরিচয় লাভ করিয়াছিলাম বিহারীলালের কাব্যেও সেইরূপ একটি ঘনিষ্ঠ সঙ্গ প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। মনে আছে নিম্ন-উদ্‌ধৃত শ্লোকগুলির বর্ণনায় এবং সংগীতে মনশ্চক্ষের সমক্ষে সুন্দর চিত্রপট উদ্‌ঘাটিত হইয়া হৃদয়কে চঞ্চল করিয়া তুলিত।

     “কভু ভাবি কোনো ঝরনার
     উপলে বন্ধুর যার ধার–
     প্রচণ্ড প্রপাতধ্বনি
     বায়ুবেগে প্রতিধ্বনি
     চতুর্দিকে হতেছে বিস্তার–
     গিয়ে তার তীরতরুতলে
     পুরু পুরু নধর শাদ্বলে
     ডুবাইয়ে এ শরীর
     শবসম রব স্থির
     কান দিয়ে জলকলকলে।
     যে-সময় কুরঙ্গিণীগণ
     সবিস্ময়ে ফেলিয়ে নয়ন
     আমার সে দশা দেখে
     কাছে এসে চেয়ে থেকে
     অশ্রুজল করিবে মোচন–
     সে-সময়ে আমি উঠে গিয়ে,
     তাহাদের গলা জড়াইয়ে,
     মৃত্যুকালে মিত্র এলে
     লোকে যেম্নি চক্ষু মেলে
     তেম্নিতর থাকিব চাহিয়ে।”

কবি যে মন “হু হু” করার কথা লিখিয়াছেন তাহা কী প্রকৃতির বলিতে পারি না। কিন্তু এই বর্ণনা পাঠ করিয়া বহির্জগতের জন্য একটি বালক-পাঠকের মন হু হু করিয়া উঠিত। ঝরনার ধারে জলশীকরসিক্ত স্নিগ্ধশ্যামল দীর্ঘকোমল ঘনঘাসের মধ্যে দেহ নিমগ্ন করিয়া নিস্তব্ধভঅবে জলকলধ্বনি শুনিতে পাওয়া একটি পরম আকাঙক্ষার বিষয় বলিয়া মনে হইত; এবং যদিও জ্ঞানে জানি যে, কুরঙ্গিণীগণ কবির দুঃখে অশ্রুপাত করিতে আসে না এবং সাধ্যমতে কবির আলিঙ্গনে ধরা দিতে চাহে না, তথাপি এই নির্ঝরপার্শ্বে ঘনশষ্পতটে মানবের বাহুপাশবদ্ধ মুগ্ধ কুরঙ্গিণীর দৃশ্য অপরূপ সৌন্দর্যে হৃদয়ে সম্ভববৎ চিত্রিত হইয়া উঠিত।

     “কভু ভাবি পল্লীগ্রামে যাই,
     নামধাম সকল লুকাই।
     চাষীদের মাঝে রয়ে
     চাষীদের মতো হয়ে
     চাষীদের সঙ্গেতে বেড়াই।
     প্রাতঃকালে মাঠের উপর,
     শুদ্ধ বায়ু বহে ঝর ঝর,
     চারি দিক মনোরম,
     আমোদে করিব শ্রম;
     সুস্থ স্ফূর্ত হবে কলেবর।
     বাজাইয়ে বাঁশের বাঁশরি
     সাদা সোজা গ্রাম্য গান ধরি
     সরল চাষার সনে
     প্রমোদ-প্রফুল্ল মনে
     কাটাইব আনন্দে শর্বরী।
     বরষার যে ঘোরা নিশায়
     সৌদামিনী মাতিয়ে বেড়ায়–
     ভীষণ বজ্রের নাদ,
     ভেঙে যেন পড়ে ছাদ,
     বায়ু সব কাঁপেন কোঠায়–
     সে নিশায় আমি ক্ষেত্রতীরে
     নড়বোড়ে পাতার কুটিরে
     স্বচ্ছন্দে রাজার মতো
     ভূমে আছি নিদ্রাগত,
     প্রাতে উঠে দেখিব মিহিরে।”

কলিকাতার ছেলে পল্লীগ্রামের এই সুখময় চিত্রে যে ব্যাকুল হইয়া উঠিবে ইহাতে বিচিত্র কিছুই নাই। ইহা হইতে বুঝা যায় অসন্তোষ মানবপ্রকৃতির সহজাত। অট্টালিকা অপেক্ষা নড়বোড়ে পাতার কুটিরে যে সুখের অংশ অধিক আছে অট্টালিকা-বাসী বালকের মনে এ মায়া কে জন্মাইয়া দিল? আদিম মানবপ্রকৃতি। কবি নহে। কবিকে যিনি ভুলাইয়াছেন সেই মহামায়া। কবিতায় অসন্তোষ-গানের বাহুল্য দেখা যায় বলিয়া অনেকে আক্ষেপ করিয়া থাকেন। কিন্তু দোষ কাহাকে দিব? অসন্তোষ মানুষকে কাজ করাইতেছে, আকাঙক্ষা কবিকে গান গাওয়াইতেছে। সন্তোষ এবং পরিতৃপ্তি যতই প্রার্থনীয় হউক তাহাতে কার্য এবং কাব্য উভয়েরই ব্যাঘাত করিয়া থাকে। অ যেমন বর্ণমালার আরম্ভ এবং সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণের সহিত যুক্ত, অসন্তোষ ও অতৃপ্তি সেইরূপ সৃজনের আরম্ভে বর্তমান এবং সমস্ত মানবপ্রকৃতির সহিত নিয়ত সংযুক্ত। এইজন্যই তাহা কবিতায় প্রাধান্য লাভ করিয়াছে, কবিদিগের মানসিক ক্ষিপ্ততা বা পরিপাকশক্তির বিকারবশত নহে। কৃষক-কবি যখন কবিতা রচনা করে তখন সে মাঠের শোভা কুটিরের সুখ বর্ণনা করে না– নগরের বিস্ময়জনক বৈচিত্র্য তাহার চিত্ত আকর্ষণ করে– তখন সে গাহিয়া ওঠে–

     "কী কল বানিয়েছে সাহেব কোম্পানি!
     কলেতে ধোঁয়া ওঠে আপনি, সজনি!’

কলের বাঁশি যাহারা শুনিতেছে মাঠের "বাঁশের বাঁশরি’ শুনিয়া তাহারা ব্যাকুল হয় এবং যাহারা বাঁশের বাঁশরি বাজাইয়া থাকে কলের বাঁশি শুনিলে তাহাদের হৃদয় বিচলিত হইয়া উঠে। এইজন্য শহরের কবিও সুখের কথা বলে না, মাঠের কবিও আকাঙক্ষার চাঞ্চল্য গানে প্রকাশ করিতে চেষ্টা করে।

সুখ চিরকালই দূরবর্তী, এইজন্য কবি যখন গাহিলেন– "সর্বদাই হু হু করে মন’ তখন বালকের অন্তরেও তাহার প্রতিধ্বনি জাগিয়া উঠিল। কবি যখন বলিলেন–

     “কভু ভাবি ত্যেজে এই দেশ
     যাই কোনো এ হেন প্রদেশ
     যথায় নগর গ্রাম
     নহে মানুষের ধাম,
     পড়ে আছে ভগ্ন-অবশেষ।
     গর্বভরা অট্টালিকা যায়
     এবে সব গড়াগড়ি যায়_  
     বৃক্ষলতা অগণন
     ঘোর করে আছে বন,
     উপরে বিষাদবায়ু বায়।
     প্রবেশিতে যাহার ভিতরে
     ক্ষীণপ্রার্থী নরে ত্রাসে মরে,
     যথায় শ্বাপদদল,
     করে ঘোর কোলাহল
     ঝিল্লি সব ঝিঁ ঝিঁ রব করে।
     তথা তার মাঝে বাস করি
     ঘুমাইব দিবা বিভাবরী_
     আর কারে করি ভয়,
     ব্যাঘ্রে সর্পে তত নয়,
     মানুষজন্তুকে যত ডরি।”

তখন এই চিত্রে ভয়ের উদয় না হইয়া বাসনার উদ্রেক হইল। যে ছেলে ঘরের বাহিরে একটি দিন যাপন করিতে কাতর হয় ঝিল্লিরবাকুল বিষাদবায়ুবীজিত ঘন-অরণ্যবেষ্টিত ভীষণ ভগ্নাবশেষ কেন যে তাহার নিকট বিশেষণরূপে প্রার্থনীয় বোধ হইল বলা কঠিন। আমাদের প্রকৃতির মধ্যে একটি বন্ধন-অসহিষ্ণু স্বেচ্ছাবিহারপ্রিয় পুরুষ এবং একটি গৃহবাসিনী অবরুদ্ধ রমণী দৃঢ় অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া আছে। একজন জগতের সমস্ত নূতন নূতন দেশ, ঘটনা এবং অবস্থার মধ্যে নব নব রসাস্বাদ করিয়া আপন অমর শক্তিকে বিচিত্র বিপুলভাবে পরিপুষ্ট করিয়া তুলিবার জন্য সর্বদা ব্যাকুল, আর-একজন শতসহস্র অভ্যাসে বন্ধনে প্রথায় প্রচ্ছন্ন এবং পরিবেষ্টিত। একজন বাহিরের দিকে লইয়া যায়, আর-একজন গৃহের দিকে টানে। একজন বনের পাখি, আর-একজন খাঁচার পাখি। এই বনের পাখিটাই বেশি গান গাহিয়া থাকে। কিন্তু ইহার গানের মধ্যে অসীম স্বাধীনতার জন্য একটি ব্যাকুলতা একটি অভ্রভেদী ক্রন্দন বিবিধভাবে এবং বিচিত্র রাগিণীতে প্রকাশ পাইয়া থাকে।

সিন্ধবাদ নাবিকের অপরূপ ভ্রমণ এবং রবিন্সন্‌ ক্রুসোর নির্জন দ্বীপপ্রবাস মনের মধ্যে যে এক তৃষাতুর ভাবের উদ্রেক করিয়া দিত, অবোধবন্ধুর প্রথম কবিতাটি সেই ভাবকেই সংক্ষেপে সংগীতে ব্যক্ত করিয়াছিল। যে ভাবের উদয়ে পরিচিত গৃহকে প্রবাস বোধ হয় অপরিচিত বিশ্বের জন্য মন কেমন করিতে থাকে বিহারীলালের ছন্দেই সেই ভাবের প্রথম প্রকাশ দেখিতে পাইয়াছিলাম।

     “কভু ভাবি সমুদ্রের ধারে।
     যথা যেন গর্জে একেবারে
     প্রলয়ের মেঘসংঘ,
     প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ভঙ্গ
     আক্রমিছে গর্জিয়া বেলারে–
     সম্মুখেতে অসীম অপার
     জলরাশি রয়েছে বিস্তার;
     উত্তাল তরঙ্গ সব
     ফেনপুঞ্জে ধব্‌ ধব্‌,
     গণ্ডগোলে ছোটে অনিবার–
     মহাবেগে বহিছে পবন,
     যেন সিন্ধুসঙ্গে করে রণ–
     উভে উভ প্রতি ধায়,
     শব্দে ব্যোম ফেটে যায়,
     পরস্পরে তুমুল তাড়ন–
     সেই মহা রণরঙ্গস্থলে
     স্তব্ধ হয়ে বসিয়ে বিরলে
     (বাতাসের হুহু রবে
     কান বেশ ঠাণ্ডা রবে)
     দেখিগে শুনিগে সে সকলে।
     যে সময়ে পূর্ণ সুধাকর
     ভূষিবেন নির্মল অম্বর,
     চন্দ্রিকা উজলি বেলা
     বেড়াবেন করে খেলা
     তরঙ্গের দোলার উপর–
     নিবেদিব তাঁহাদের কাছে
     মনে মোর যত খেদ আছে।
     শুনি না কি মিত্রবরে
     দুখের যে অংশী করে
     হাঁপ ছেড়ে প্রাণ তার বাঁচে।”

এই বর্ণনাগুলি কতবার পাঠ করিয়াছি তাহার সংখ্যা নাই, এবং এই-সকল শ্লোকের মধ্য দিয়া সমুদ্র-পর্বত-অরণ্যের আহ্বান বালক পাঠকের অন্তরে ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছিল। সাময়িক অন্য কবির রচনাতেও প্রকৃতিবর্ণনা আছে কিন্তু তাহা প্রথাসংগত বর্ণনামাত্র, তাহা কেবল কবির কর্তব্যপালন। তাহার মধ্যে সেই সোনার কাঠি নাই যাহার স্পর্শে নিখিল প্রকৃতির অন্তরাত্মা সজীব ও সজাগ হইয়া আমাদিগকে নিবিড় প্রেমপাশে আবদ্ধ করে।

সাময়িক কবিদিগের সহিত বিহারীলালের আর-একটি প্রধান প্রভেদ তাঁহার ভাষা। ভাষার প্রতি আমাদের অনেক কবির কিয়ৎপরিমাণে অবহেলা আছে। বিশেষত মিত্রাক্ষর ছন্দের মিলটা তাঁহারা নিতান্ত কায়ক্লেশে রক্ষা করেন। অনেকে কেবলমাত্র শেষ অক্ষরের মিলকে যথেষ্ট জ্ঞান করেন এবং অনেক "হয়েছে’ "করেছে’ "ভুলেছে’ প্রভৃতি ক্রিয়াপদের মিলকে মিল বলিয়া গণ্য করিয়া থাকেন। মিলের দুইটি প্রধান গুণ আছে, এক তাহা কর্ণতৃপ্তিকর আর-এক অভাবিতপূর্ব। অসম্পূর্ণ মিলে কর্ণের তৃপ্তি হয় না, সেটুকু মিলে স্বরের অনৈক্যটা আরো যেন বেশি করিয়া ধরা পড়ে এবং তাহাতে কবির ক্ষমতা ও ভাষার দারিদ্র্য প্রকাশ পায়। ক্রিয়াপদের মিল যত ইচ্ছা করা যাইতে পারে– সেরূপ মিলে কর্ণে প্রত্যেকবার নূতন বিস্ময় উৎপাদন করে না, এইজন্য তাহা বিরক্তিজনক ও "একঘেয়ে’ হইয়া ওঠে। বিহারীলালের ছন্দে মিলের এবং ভাষার দৈন্য নাই। তাহা প্রবহমান নির্ঝরের মতো সহজ সংগীতে অবিশ্রাম ধ্বনিত হইয়া চলিয়াছে। ভাষা স্থানে স্থানে সাধুতা পরিত্যাগ করিয়া অকস্মাৎ অশিষ্ট এবং কর্ণপীড়ক হইয়াছে, ছন্দ অকারণে আপন বাঁধ ভাঙিয়া স্বেচ্ছাচারী হইয়া উঠিয়াছে, কিন্তু সে কবির স্বেচ্ছাকৃত; অক্ষমতাজনিত নহে। তাঁহার রচনা পড়িতে পড়িতে কোথাও এ কথা মনে হয় না যে, এইখানে কবিকে দায়ে পড়িয়া মিল নষ্ট বা ছন্দ ভঙ্গ করিতে হইয়াছে।

কিন্তু উপরে যে ছন্দের শ্লোকগুলি উদ্‌ধৃত হইয়াছে "বঙ্গসুন্দরী’তে সেই ছন্দই প্রধান নহে। প্রথম উপহারটি ব্যতীত "বঙ্গসুন্দরী’র অন্য-সকল কবিতার ছন্দই পর্যায়ক্রমে বারো এবং এগারো অক্ষরে ভাগ করা। যথা–

     “সুঠাম শরীর পেলব লতিকা
          আনত সুষমা কুসুম ভরে,
     চাঁচর চিকুর নীরদ মালিকা
          লুটায়ে পড়েছে ধরণী-’পরে।”

এ ছন্দ নারীবর্ণনার উপযুক্ত বটে– ইহাতে তালে তালে নূপুর ঝংকৃত হইয়া উঠে। কিন্তু এ ছন্দের প্রধান অসুবিধা এই যে, ইহাতে যুক্ত অক্ষরের স্থান নাই। পয়ার ত্রিপদী প্রভৃতি ছন্দে লেখকের এবং পাঠকের অনেকটা স্বাধীনতা আছে। অক্ষরের মাত্রাগুলিকে কিয়ৎপরিমাণে ইচ্ছামত বাড়াইবার কমাইবার অবকাশ আছে। প্রত্যেক অক্ষরকে একমাত্রার স্বরূপ গণ্য করিয়া একেবারে এক নিশ্বাসে পড়িয়া যাইবার আবশ্যক হয় না। দৃষ্টান্তের দ্বারা আমার কথা স্পষ্ট হইবে।–

     “হে সারদে দাও দেখা।
     বাঁচিতে পারি নে একা,
     কাতর হয়েছে প্রাণ, কাতর হৃদয়।
     কী বলেছি অভিমানে
     শুনো না শুনো না কানে,
     বেদনা দিয়ো না প্রাণে ব্যথার সময়।”

ইহার মধ্যে প্রায় যুক্ত অক্ষর নাই। নিম্নলিখিত শ্লোকে অনেকগুলি যুক্তাক্ষর আছে, অথচ উভয় শ্লোকই সুখপাঠ্য এবং শ্রুতিমধুর।

     “পদে পৃথ্বী, শিরে ব্যোম,
     তুচ্ছ তারা সূর্য সোম,
     নক্ষত্র নখাগ্রে যেন গনিবারে পারে,
     সম্মুখে সাগরাম্বরা
     ছড়িয়ে রয়েছে ধরা,
     কটাক্ষে কখন যেন দেখিছে তাহারে।”

এই দুটি শ্লোকই কবির রচিত "সারদামঙ্গল’ হইতে উদ্‌ধৃত। এক্ষণে "বঙ্গসুন্দরী’ হইতে দুইটি শ্লোকই উদ্‌ধৃত করিয়া তুলনা করা যাক।

     “একদিন দেব তরুণ তপন
     হেরিলেন সুরনদীর জলে
     অপরূপ এক কুমারী রতন
     খেলা করে নীল নলিনীদলে।”

ইহার সহিত নিম্ন-উদ্‌ধৃত শ্লোকটি একসঙ্গে পাঠ করিলে প্রভেদ প্রতীয়মান হইবে।

     “অপ্সরী কিন্নরী দাঁড়াইয়ে তীরে
          ধীরয়ে ললিত করুণাতান
     বাজায়ে বাজায়ে বীণা ধীরে ধীরে
          গাহিছে আদরে স্নেহের গান।”

“অপ্সরী কিন্নরী” যুক্ত অক্ষর লইয়া এখানে ছন্দ ভঙ্গ করিয়াছে। কবিও এই কারণে “বঙ্গসুন্দরী”তে যথাসাধ্য যুক্ত অক্ষর বর্জন করিয়া চলিয়াছেন।

কিন্তু বাংলা যে-ছন্দে যুক্ত অক্ষরের স্থান হয় না সে-ছন্দ আদরণীয় নহে। কারণ, ছন্দের ঝংকার এবং ধ্বনিবৈচিত্র্য, যুক্ত অক্ষরের উপরেই অধিক নির্ভর করে। একে বাংলা ছন্দে স্বরের দীর্ঘহ্রস্বতা নাই, তার উপরে যদি যুক্ত অক্ষর বাদ পড়ে তবে ছন্দ নিতান্তই অস্থিবিহীন সুললিত শব্দপিণ্ড হইয়া পড়ে। তাহা শীঘ্রই শ্রান্তিজনক তন্দ্রাকর্ষক হইয়া উঠে, এবং হৃদয়কে আঘাতপূর্বক ক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতে পারে না। সংস্কৃত ছন্দে যে বিচিত্র সংগীত তরঙ্গিত হইতে থাকে তাহার প্রধান কারণ স্বরের দীর্ঘহ্রস্বতা এবং যুক্ত অক্ষরের বাহুল্য। মাইকেল মধুসূদন ছন্দের এই নিগূঢ় তত্ত্বটি অবগত ছিলেন সেইজন্য তাঁহার অমিত্রাক্ষরে এমন পরিপূর্ণ ধ্বনি এবং তরঙ্গিত গতি অনুভব করা যায়।

আর্যদর্শনে বিহারীলালের “সারদামঙ্গল” সংগীত যখন প্রথম বাহির হইল, তখন ছন্দের প্রভেদ মুহূর্তেই প্রতীয়মান হইল। “সারদামঙ্গলে”র ছন্দ নূতন নহে, তাহা প্রচলিত ত্রিপদী, কিন্তু কবি তাহা সংগীতে সৌন্দর্যে সিঞ্চিত করিয়া তুলিয়াছিলেন। “বঙ্গসুন্দরী”র ছন্দোলালিত্য অনুকরণ করা সহজ, এবং সেই মিষ্টতা একবার অভ্যস্ত হইয়া গেলে তাহার বন্ধন ছেদন করা কঠিন কিন্তু “সারদামঙ্গলে”র গীতসৌন্দর্য অনুকরণসাধ্য নহে।

“সারদামঙ্গল” এক অপরূপ কাব্য। প্রথম যখন তাহার পরিচয় পাইলাম তখন তাহার ভাষায় ভাবে এবং সংগীতে নিরতিশয় মুগ্ধ হইতাম, অথচ তাহার আদ্যোপান্ত একটা সুসংলগ্ন অর্থ করিতে পারিতাম না। যেই একটু মনে হয় এইবার বুঝি কাব্যের মর্ম পাইলাম অমনি তাহা আকার পরিবর্তন করে। সূর্যাস্তকালের সুবর্ণ-মণ্ডিত মেঘমালার মতো “সারদামঙ্গলে”র সোনার শ্লোকগুলি বিবিধ রূপের আভাস দেয়, কিন্তু কোনো রূপকে স্থায়ীভাবে ধারণ করিয়া রাখে না– অথচ সুদূর সৌন্দর্যস্বর্গ হইতে একটি অপূর্ব পূরবী রাগিণী প্রবাহিত হইয়া অন্তরাত্মাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিতে থাকে।

এইজন্য “সারদামঙ্গলে”র শ্রেষ্ঠতা অরসিক লোকের নিকট ভালোরূপে প্রমাণ করাবড়োই কঠিন হইত। যে বলিত “আমি বুঝিলাম না।– আমাকে বুঝাইয়া দাও” তাহার নিকট হার মানিতে হইত।

কবি যাহা দিতেছেন তাহাই গ্রহণ করিবার জন্য পাঠককে প্রস্তুত হওয়া উচিত; পাঠক যাহা চান তাহাই কাব্য হইতে আদায় করিবার চেষ্টা করিতে গেলে অধিকাংশ সময়ে নিরাশ হইতে হয়। তাহার ফল, যাহা চাই তাহা পাই না এবং কবি যাহা দিতেছেন তাহা হইতেও বঞ্চিত হইতে হয়। “সারদামঙ্গলে” কবি যাহা গাহিতেছেন তাহা কান পাতিয়া শুনিলে একটি স্বর্গীয় সংগীতসুধায় হৃদয় অভিষিক্ত হইয়া উঠে, কিন্তু সমালোচন-শাস্ত্রের আইনের মধ্য হইতে তাহাকে ছাঁকিয়া লইবার চেষ্টা করিলে তাহার অনেক রস বৃথা নষ্ট হইয়া যায়।

প্রকৃতপক্ষে “সারদামঙ্গল” একটি সমগ্র কাব্য নহে, তাহাকে কতকগুলি খণ্ড কবিতার সমষ্টিরূপে দেখিলে তাহার অর্থবোধ হইতে কষ্ট হয় না। দ্বিতীয়, সরস্বতী সম্বন্ধে সাধারণত পাঠকের মনে যেরূপ ধারণা আছে কবির সরস্বতী তাহা হইতে স্বতন্ত্র।

কবি যে-সরস্বতীর বন্দনা করিতেছেন তিনি নানা আকারে নানা লোকের নিকট উদিত হন। তিনি কখনো জননী, কখনো প্রেয়সী, কখনো কন্যা। তিনি সৌন্দর্যরূপে জগতের অভ্যন্তরে বিরাজ করিতেছেন এবং দয়া-স্নেহ-প্রেমে মানবের চিত্তকে অহরহ বিচলিত করিতেছেন। ইংরেজ কবি শেলি যে-বিশ্বব্যাপিনী সৌন্দর্য-লক্ষ্মীকে সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেন_

Spirit of Beauty, that dost consecrate
With thine own hues all thou dost shine upon
Of human thought or form.

যাহাকে বলিয়াছেন–

Thou messenger of sympathies,
That wax and wane in lovers’ eyes.

সেই দেবীই বিহারীলালের সরস্বতী।

"সারদামঙ্গলে’র আরম্ভের চারি শ্লোকে কবি সেই সারদা দেবীকে মূর্তিমতী করিয়া বন্দনা করিয়াছেন। তৎপরে, বাল্মীকির তপোবনে সেই করুণারূপিণী দেবীর কিরূপে আবির্ভাব হইল, কবি তাহা বর্ণনা করিতেছেন। পাঠকের নেত্রসম্মুখে দৃশ্যপট যখন উঠিল তখন তপোবনে অন্ধকার রাত্রি।

      “নাহি চন্দ্র সূর্য তারা
      অনল-হিল্লোল-ধারা
      বিচিত্র-বিদ্যুৎ-দাম-দ্যুতি ঝলমল।
          তিমিরে নিমগ্ন ভব,
          নীরব নিস্তব্ধ সব,
      কেবল মরুতরাশি কবে কোলাহল।”

এমন সময়ে উষার উদয় হইল।–

      “হিমাদ্রিশিখর-’পরে
      আচম্বিতে আলো করে
      অপরূপ জ্যেতি ওই পুণ্য-তপোবন।
          বিকচ নয়নে চেয়ে
          হাসিছে দুধের মেয়ে–
      তামসী-তরুণ-উষা কুমারীরতন।
          কিরণে ভুবন ভরা,
          হাসিয়ে জাগিল ধরা,
      হাসিয়ে জাগিল শূন্যে দিগঙ্গনাগণ।
          হাসিল অম্বরতলে
          পারিজাত দলে দলে,
      হাসিল মানসসরে কমলকানন।”

তপোবনে এক দিকে যেমন তিমির রাত্রি ভেদ করিয়া তরুণ উষার অভ্যুদয় হইল তেমনি অপর দিকে নিষ্ঠুর হিংসাকে বিদীর্ণ করিয়া কিরূপে করুণাময় কাব্যজ্যোতি প্রকাশ পাইল কবি তাহার বর্ণনা করিতেছেন।–

          “অম্বরে অরুণোদয়,
          তলে দুলে দুলে বয়
      তমসা তটিনী-রানী কুলুকুলুস্বনে;
          নিরখি লোচনলোভা
          পুলিনবিপিনশোভা
      ভ্রমণে বাল্মীকি মুনি ভাব-ভোলা মনে।
          শাখিশাখে রসসুখে
          ক্রৌঞ্চ ক্রৌঞ্চী মুখে মুখে
      কতই সোহাগ করে বসি দুজনায়।
          হানিল শবরে বাণ–
          নাশিল ক্রৌঞ্চের প্রাণ–
      রুধিরে- আপ্লুত পাখা ধরণী লুটায়।
          ক্রৌঞ্চি প্রিয় সহচরে
          ঘেরে ঘেরে শোক করে–
      অরণ্য পূরিল তার কাতর ক্রন্দনে।
          চক্ষে করি দরশন
          জড়িমা-জড়িত মন,
      করুণহৃদয় মুনি বিহ্বলের প্রায়।
          সহসা ললাটভাগে
          জ্যোতির্ময়ী কন্যা জাগে,
      জাগিল বিজলী যেন নীল নবঘনে।
          কিরণে কিরণময়
          বিচিত্র আলোকোদয়,
      ম্রিয়মাণ রবিচ্ছবি, ভুবন উজলে।
          চন্দ্র নয়, সূর্য নয়,
          সমুজ্জ্বল শান্তিময়
      ঋষির ললাটে আজি না জানি কী জ্বলে
          কিরণমণ্ডলে বসি
          জ্যোতির্ময়ী সুরূপসী
      যোগীর ধ্যানের ধন ললাটিকা মেয়ে
          নামিলেন ধীর ধীর,
          দাঁড়ালেন হয়ে স্থির,
      মুগ্ধনেত্রে বাল্মীকির মুখপানে চেয়ে।
          করে ইন্দ্রধনু-বালা,
          গলায় তারার মালা,
      সীমন্তে নক্ষত্র জ্বলে, ঝল্‌মলে কানন–
          কর্ণে কিরণের ফুল,
          দোদুল চাঁচর চুল
      উড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে ঢাকিয়ে আনন। ...
          করুণ ক্রন্দন রোল
          উত উত উতরোল,
      চমকি বিহ্বলা বালা চাহিলেন ফিরে–
          হেরিলেন রক্তমাখা
          মৃত ক্রৌঞ্চ ভগ্নপাখা,
      কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে ক্রৌঞ্চী ওড়ে ঘিরে ঘিরে।
          একবার সে ক্রৌঞ্চীরে
          আরবার বাল্মীকিরে
      নেহারেন ফিরে ফিরে, যেন উন্মাদিনী–
          কাতরা করুণাভরে
          গান সকরুণ স্বরে,
      ধীরে ধীরে বাজে করে বীণা বিষাদিনী।
          সে শোকসংগীতকথা
          শুনে কাঁদে তরুলতা,
      তমসা আকুল হয়ে কাঁদে উভরায়।
          নিরখি নন্দিনীছবি
          গদগদ আদিকবি
      অন্তরে করুণাসিন্ধু উথলিয়া ধায়।”

সারদা দেবীর এই এক করুণামূর্তি। তাহার পর ২১ শ্লোক হইতে আবার একটি কবিতার আরম্ভ হইয়াছে। সে কবিতায় সারদা দেবী ব্রহ্মার মানস-সরোবরে সুবর্ণপদ্মের উপর দাঁড়াইয়াছেন এবং তাঁহার অসংখ্য ছায়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রতিবিম্বিত হইয়াছে। ইহা সারদা দেবীর বিশ্বব্যাপিনী সৌন্দর্যমূর্তি।

          “ব্রহ্মার মানসসরে
          ফুটে ঢল ঢল করে
      নীল জলে মনোহর সুবর্ণনলিনী,
          পাদপদ্ম রাখি তায়
          হাসি হাসি ভাসি যায়
      ষোড়শী রূপসী বামা পূর্ণিমাযামিনী।
          কোটি শশী উপহাসি
          উথলে লাবণ্যরাশি,
      তরল দর্পণে যেন দিগন্তে আবরে;
          আচম্বিতে অপরূপ
          রূপসীর প্রতিরূপ
      হাসি হাসি ভাসি ভাসি উদয় অম্বরে।”

এই সারদা দেবীর Spirit of Beauty-র নব-অভ্যুদিত করুণা-বালিকামূর্তি এবং সর্বত্রব্যাপ্ত সুন্দরী ষোড়শীমূর্তির বর্ণনা সমাপ্ত করিয়া কবি গাহিয়া উঠিয়াছেন–

          “তোমারে হৃদয়ে রাখি
          সদানন্দ মনে থাকি,
      শ্মশান অমরাবতী দু’ই ভালো লাগে।–
          গিরিমালা, কুঞ্জবন,
          গৃহ, নাট-নিকেতন,
      যখন যেখানে যাই, যাও আগে আগে। ...
           যত মনে অভিলাষ
          তত তুমি ভালোবাসো,
      তত মনপ্রাণ ভরে আমি ভালোবাসি।
          ভক্তিভরে একতানে
          মজেছি তোমার ধ্যানে,
      কমলার ধনে মানে নহি অভিলাষী।”

এই মানসীরূপিণী সাধনার ধনকে পরিপূর্ণরূপে লাভ করিবার জন্য কাতরতা প্রকাশ করিয়া কবি প্রথম সর্গ সমাপ্ত করিয়াছেন।

তাহার পর-সর্গ হইতে প্রেমিকের ব্যাকুলতা। কখনো অভিমান কখনো বিরহ, কখনো আনন্দ কখনো বেদনা, কখনো ভর্ৎসনা কখনো স্তব। দেবী কবির প্রণয়িনী রূপে উদিত হইয়া বিচিত্র সুখদুঃখে শতধারে সংগীত উচ্ছ্বসিত করিয়া তুলিতেছেন। কবি কখনো তাঁহাকে পাইতেছেন কখনো তাঁহাকে হারাইতেছেন– কখনো তাঁহার অভয়রূপ কখনো তাঁহার সংহারমূর্তি দেখিতেছেন। কখনো তাঁহার অভয়রূপ কখনো তাঁহার সংহারমূর্তি দেখিতেছেন। কখনো তিনি অভিমানিনী, কখনো বিষাদিনী, কখনো আনন্দময়ী।

কবি বিষাদিনীকে বলিতেছেন–

          “অয়ি, এ কী, কেন কেন,
          বিষণ্ণ হইলে হেন–
      আনত আনন-শশী, আনত নয়ন,
          অধরে মন্থরে আসি
          কপোলে মিলায় হাসি
      থরথর ওষ্ঠাধর, স্ফোরে না বচন!
          তেমন অরুণ-রেখা
          কেন কুহেলিকা-ঢাকা,
      প্রভাত-প্রতিমা আজি কেন গা মলিন?
          বলো বলো চন্দ্রাননে,
          কে ব্যথা দিয়েছে মনে,
      কে এমন– এক এমন হৃদয়বিহীন!
          বুঝিলাম অনুমানে,
          করুণা-কটাক্ষ দানে
      চাবে না আমার পানে, কবেও না কথা।
          কেন যে কবে না হায়
          হৃদয় জানিতে চায়,
      শরমে কি বাধে বাণী, মরমে বা বাজে ব্যথা।
          যদি মর্মব্যথা নয়,
          কেন অশ্রুধারা বয়।
      দেববালা ছলাকলা জানে না কখন–
          সরল মধুর প্রাণ,
          সতত মুখেতে গান,
      আপন বীণার তানে আপনি মগন।
          অয়ি, হা, সরলা সতী
          সত্যরূপা সরস্বতী,
      চির-অনুরক্ত ভক্ত হয়ে কৃতাঞ্জলি
          পদপদ্মাসন-কাছে
          নীরবে দাঁড়ায়ে আছে,
      কী করিবে, কোথা যাবে, দাও অনুমতি।
          স্বরগকুসুম মালা,
          নরক-জ্বলন-জ্বালা,
      ধরিবে প্রফুল্লমুখে মস্তক সকলি।
          তব আজ্ঞা সুমঙ্গল,
          যাই যাব রসাতল,
      চাই নে এ বরমালা, এ অমরাবতী।”

কবি অভিমানিনী সরস্বতীকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন–

          “আজি এ বিষণ্ণ বেশে
          কেন দেখা দিলে এসে,
      কাঁদিলে কাঁদালে, দেবি, জন্মের মতন!
          পূর্ণিমাপ্রমোদ-আলো,
          নয়নে লেগেছে ভালো,
      মাঝেতে উথলে নদী, দু পারে দুজন–
      চক্রবাক্‌ চক্রবাকী দু পারে দুজন।
          নয়নে নয়নে মেলা,
          মানসে মানসে-খেলা,
      অধরে প্রেমের হাসি বিষাদে মলিন।
          হৃদয়বীণার মাঝে
          ললিত রাগিণী বাজে,
      মনের মধুর গান মনেই বিলীন।
          সেই আমি সেই তুমি,
          সেই এ স্বরগভূমি,
      সেই-সব কল্পতরু সেই কুঞ্জবন,
          সেই প্রেম সেই স্নেহ,
          সেই প্রাণ সেই দেহ–
      কেন মন্দাকিনী-তীরে দু পারে দুজন!”

কখনো মুহূর্তের জন্য সংশয় আসিয়া বলে–

          “তবে কি সকলি ভুল?
          নাই কি প্রেমের মূল–
      বিচিত্র গগনফুল কল্পনালতার?
          মন কেন রসে ভাসে,
          প্রাণ কেন ভালোবাসে
      আদরে পরিতে গলে সেই ফুলহার?
          শত শত নরনারী
          দাঁড়ায়েছে সারি সারি–
      নয়ন খুঁজিছে কেন সেই মুখখানি!
          হেরে হারানিধি পায়,
          না হেরিলে প্রাণ যায়–
      এমন সরল সত্য কী আছে না জানি!”

কখনো-বা প্রেমোপভোগের আদর্শ চিত্র মানসপটে উদিত হয়–

          “নন্দননিকুঞ্জবনে
          বসি শ্বেতশিলাসনে
      খোলা প্রাণে রতি-কাম বিহরে কেমন!
          আননে উদার হাসি,
          নয়নে অমৃতরাশি,
      অপরূপ আলো এক উজলে ভুবন।...
          কী এক ভাবেতে ভোর;
          কী যেন নেশার ঘোর,
      টলিয়ে ঢলিয়ে পড়ে নয়নে নয়ন–
          গলে গলে বাহুলতা,
          জড়িমা-জড়িত কথা,
      সোহাগে সোহাগে রাগে গলগল মন।
          করে কর থরথর,
          টলমল কলেবর,
      গুরুগুরু দুরুদুরু বুকের ভিতর–
          তরুণ অরুণ ঘটা
          আননে আরক্ত ছটা,
      অধর-কমলদলে কাঁপে থরথর।
          প্রণয় পবিত্র কাম
          সুখস্বর্গ মোক্ষধাম।
      আজি কেন হেরি হেন মাতোয়ারা বেশ!
          ফুলধনু ছড়াছড়ি
          দূরে যায় গড়াগড়ি,
      রতির খুলিয়ে খোঁপা আলুথালু কেশ!
          বিহ্বল পাগলপ্রাণে
          চেয়ে সতী পতিপানে,
      গলিয়ে গড়িয়ে কোথা চলে গেছে মন!
          মুগ্ধ মত্ত নেত্র দুটি,
          আধ ইন্দিবর ফুটি,
      দুলুদুলু ঢুলুঢুলু করিছে কেমন!
          আলসে উঠিছে হাই,
          ঘুম আছে, ঘুম নাই,
      কী যেন স্বপনমত চলিয়াছে মনে!
          সুখের সাগরে ভাসি
          কিবে প্রাণ-খোলা হাসি
      কী এক লহরী খেলে নয়নে নয়নে!
          উথুলে উথুলে প্রাণ
          উঠিছে ললিত তান,
      ঘুমায়ে ঘুমায়ে গান গায় দুই জন।
          সুরে সুরে সম্‌ রাখি
          ডেকে ডেকে ওঠে পাখি,
      তালে তালে ঢ’লে ঢ’লে চলে সমীরণ।
          কুঞ্জের আড়ালে থেকে
          চন্দ্রমা লুকায়ে দেখে,
      প্রণয়ীর সুখে সদা সুখী সুধাকর।
          সাজিয়ে মুকুলে ফুলে
          আহ্লাদেতে হেলে দুলে
      চৌদিকে নিকুঞ্জলতা নাচে মনোহর।
          সে আনন্দে আনন্দিনী,
          উথলিয়ে মন্দাকিনী,
      করি করি কলধ্বনি বহে কুতুহলে।”

এইরূপ বিষাদ-বিরহ-সংশয়ের পর কবি হিমালয়শিখরে প্রণয়িনী দেবীর সহিত আনন্দমিলনের চিত্র আঁকিয়া গ্রন্থ শেষ করিয়াছেন। আরম্ভ-অংশ ব্যতীত হিমালয়েরবর্ণনা প্রশংসার যোগ্য নহে, সেই বর্ণনা বাদ দিয়া অবশিষ্ট অংশ উদ্‌ধৃত করি–

          “উদার উদারতর
          দাঁড়ায়ে শিখর- ’পর
      এই-যে হৃদয়রানী ত্রিদিব-সুষমা।
          এ নিসর্গ-রঙ্গভূমি,
          মনোরমা নটী তুমি,
      শোভার সাগরে এক শোভা নিরুপমা।
          আননে বচন নাই,
          নয়নে পলক নাই,
      কান নাই মন নাই আমার কথায়–
          মুখখানি হাস-হাস,
          আলুথালু বেশবাস,
      আলুথালু কেশপাশ বাতাসে লুটায়।
          না জানি কী অভিনব
          খুলিয়ে গিয়েছে ভব
      আজি ও বিহ্বল মত্ত প্রফুল্ল নয়নে!
          আদরিণী, পাগলিনী,
          এ নহে শশি-যামিনী–
      ঘুমাইয়ে একাকিনী কী দেখ স্বপনে!
          আহা কী ফুটিল হাসি!
          বড়ো আমি ভালোবাসি
      ওই হাসিমুখখানি প্রেয়সী তোমার–
          বিষাদের আবরণে
          বিমুক্ত ও চন্দ্রাননে
      দেখিবার আশা আর ছিল না আমার।
          দরিদ্র ইন্দ্রত্বলাভে
          কতটুকু সুখ পাবে,
      আমার সুখের সিন্ধু অনন্ত উদার। ...
          এসো বোন, এসো ভাই,
          হেসে খেলে চলে যাই,
      আনন্দে আনন্দ করি আনন্দকাননে।
      এমন আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে।
          হে প্রশান্ত গিরিভূমি,
          জীবন জুড়ালে তুমি
      জীবন্ত করিয়ে মম জীবনের ধনে।
      এমন আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে।
          প্রিয়ে সঞ্জীবনী লতা,
          কত যে পেয়েছি ব্যথা
      হেরে সে বিষাদময়ী মুরতি তোমার।
          হেরে কত দুঃস্বপন
          পাগল হয়েছে মন–
      কতই কেঁদেছি আমি ক’রে হাহাকার।
          আজি সে সকলি মম
          মায়ার লহরী সম
      আনন্দসাগর-মাঝে খেলিয়া বেড়ায়।
          দাঁড়াও হৃদয়েশ্বরী,
          ত্রিভুবন আলো করি,
      দু-নয়ন ভরি ভরি দেখিব তোমায়।
          দেখিয়ে মেটে না সাধ,
          কী জানি কী আছে স্বাদ,
      কী জানি কী মাখা আছে ও শুভ-আননে!
          কী এক বিমল ভাতি
          প্রভাত করেছে রাতি,
      হাসিছে অমরাবতী নয়নকিরণে।
          এমন সাধের ধনে
          প্রতিবাদী জনে জনে–
      দয়া মায়া নাই মনে, কেমন কঠোর!
          আদরে গেঁথেছে বালা
          হৃদয়কুসুমমালা,
      কৃপাণে কাটিবে কে রে সেই ফুলডোর!
          পুন কেন অশ্রুজল,
          বহ তুমি অবিরল,
      চরণকমল আহা ধুয়াও দেবীর!
          মানসসরসী কোলে
          সোনার নলিনী দোলে,
      আনিয়ে পরাও গলে সমীর সুধীর।
          বিহঙ্গম, খুলে প্রাণ
           ধরো রে পঞ্চম তান,
      সারদামঙ্গলগান গাও কুতুহলে।”

কবি যে সূত্রে "সারদামঙ্গলে’র এই কবিতাগুলি গাঁথিয়াছেন তাহা ঠিক ধরিতে পারিয়াছি কি না জানি না– মধ্যে মধ্যে সূত্র হারাইয়া যায়, মধ্যে মধ্যে উচ্ছ্বাস উন্মত্ততায় পরিণত হয়– কিন্তু এ কথা বলিতে পারি আধুনিক বঙ্গসাহিত্যে প্রেমের সংগীত এরূপ সহস্রাধার উৎসের মতো কোথাও উৎসারিত হয় নাই। এমন নির্মল সুন্দর ভাষা, এমন ভাবের আবেগ, কথার সহিত এমন সুরের মিশ্রণ আর কোথাও পাওয়া যায় না; বর্তমান সমালোচক এককালে "বঙ্গসুন্দরী’ "সারদামঙ্গলে’র কবির নিকট হইতে কাব্যশিক্ষার চেষ্টা করিয়াছিল, কতদূর কৃতকার্য হইয়াছে বলা যায় না, কিন্তু এই শিক্ষাটি স্থায়ীভাবে হৃদয়ে মুদ্রিত হইয়াছে যে, সুন্দর ভাষা কাব্যসৌন্দর্যের একটি প্রধান অঙ্গ; ছন্দে এবং ভাষার সর্বপ্রকার শৈথিল্য কবিতার পক্ষে সাংঘাতিক। এই প্রসঙ্গে আমার সেই কাব্যগুরুর নিকট আর-একটি ঋণ স্বীকার করিয়া লই। বাল্যকালে "বাল্মীকি-প্রতিভা’ নামক একটি গীতিনাট্য রচনা করিয়া "বিদ্বজনসমাগম"- নামক সম্মিলন উপলক্ষে অভিনয় করিয়াছিলাম। বঙ্কিমচন্দ্র এবং অন্যান্য অনেক রসজ্ঞ লোকের নিকট সেই ক্ষুদ্র নাটকটি প্রীতিপদ হইয়াছিল। সেই নাটকের মূল ভাবটি, এমন-কি, স্থানে স্থানে তাহার ভাষা পর্যন্ত বিহারীলালের "সারদামঙ্গলে’র আরম্ভভাগ হইতে গৃহীত।

আজ কুড়ি বৎসর হইল "সারদামঙ্গল’ আর্যদর্শন পত্রে এবং ষোলো বৎসর হইল পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইয়াছে; ভারতী পত্রিকায় কেবল একটিমাত্র সমালোচক ইহাকে সাদর সম্ভাষণ করেন। তাহার পর হইতে "সারদামঙ্গল’ এই ষোড়শ বৎসর অনাদৃতভাবে প্রথম সংস্করণের মধ্যেই অজ্ঞাতবাস যাপন করিতেছে। কবিও সেই অবধি আর বাহিরে দর্শন দেন নাই। যিনি জীবনরঙ্গভূমির নেপথ্যে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া দর্শকমণ্ডলীর স্তুতিধ্বনির অতীত ছিলেন তিনি আজ মৃত্যুর যবনিকান্তরালে অপসৃত হইয়া সাধারণের বিদায়সম্ভাষণ প্রাপ্ত হইলেন না; কিন্তু এ কথা সাহসপূর্বক বলিতে পারি, সাধারণের পরিচিত কণ্ঠস্থ শতসহস্র রচনা যখন বিনষ্ট এবং বিস্মৃত হইয়া যাইবে "সারদামঙ্গল’ তখন লোকস্মৃতিতে প্রত্যহ উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিবে এবং কবি বিহারীলাল যশঃস্বর্গে অম্লান বরমাল্য ধারণ করিয়া বঙ্গসাহিত্যের অমরগণের সহিত একাসনে বাস করিতে থাকিবেন।