১
পূজা - গান
পূজা - গান
কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা, তারি মধ্যে চিরজীবন বইব গানের ডালা— এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা সুরের-গন্ধ-ঢালা?। তাই কি আমার ঘুম ছুটেছে, বাঁধ টুটেছে মনে, খ্যাপা হাওয়ার ঢেউ উঠেছে চিরব্যথার বনে, কাঁপে আমার দিবানিশার সকল আঁধার আলা! এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা সুরের-গন্ধ-ঢালা?। রাতের বাসা হয় নি বাঁধা দিনের কাজে ত্রুটি, বিনা কাজের সেবার মাঝে পাই নে আমি ছুটি। শান্তি কোথায় মোর তরে হায় বিশ্বভুবন-মাঝে, অশান্তি যে আঘাত করে তাই তো বীণা বাজে। নিত্য রবে প্রাণ-পোড়ানো গানের আগুন জ্বালা— এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা সুরের-গন্ধ-ঢালা?।
২
পূজা - গান
পূজা - গান
সুরের গুরু, দাও গো সুরের দীক্ষা— মোরা সুরের কাঙাল, এই আমাদের ভিক্ষা॥ মন্দাকিনীর ধারা, ঊষার শুকতারা, কনকচাঁপা কানে কানে যে সুর পেল শিক্ষা॥ তোমার সুরে ভরিয়ে নিয়ে চিত্ত যাব যেথায় বেসুর বাজে নিত্য। কোলাহলের বেগে ঘূর্ণি উঠে জেগে, নিয়ো তুমি আমার বীণার সেইখানেই পরীক্ষা॥
৩
পূজা - গান
পূজা - গান
তোমার সুরের ধারা ঝরে যেথায় তারি পারে দেবে কি গো বাসা আমায় একটি ধারে?। আমি শুনব ধ্বনি কানে, আমি ভরব ধ্বনি প্রাণে, সেই ধ্বনিতে চিত্তবীণায় তার বাঁধিব বারে বারে॥ আমার নীরব বেলা সেই তোমারি সুরে সুরে ফুলের ভিতর মধুর মতো উঠবে পুরে। আমার দিন ফুরাবে যবে, যখন রাত্রি আঁধার হবে, হৃদয়ে মোর গানের তারা উঠবে ফুটে সারে সারে॥
৪
পূজা - গান
পূজা - গান
তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী, আমি অবাক্ হয়ে শুনি কেবল শুনি॥ সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে, সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে, পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী॥ মনে করি অমনি সুরে গাই, কণ্ঠে আমার সুর খুঁজে না পাই। কইতে কী চাই, কইতে কথা বাধে— হার মেনে যে পরান আমার কাঁদে, আমায় তুমি ফেলেছ কোন্ ফাঁদে চৌদিকে মোর সুরের জাল বুনি॥
৫
পূজা - গান
পূজা - গান
আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান তার বদলে আমি চাই নে কোনো দান॥ ভুলবে সে গান যদি নাহয় যেয়ো ভুলে উঠবে যখন তারা সন্ধ্যাসাগরকূলে, তোমার সভায় যবে করব অবসান এই ক’দিনের শুধু এই ক’টি মোর তান॥ তোমার গান যে কত শুনিয়েছিলে মোরে সেই কথাটি তুমি ভুলবে কেমন করে? সেই কথাটি, কবি, পড়বে তোমার মনে বর্ষামুখর রাতে, ফাগুন-সমীরণে— এইটুকু মোর শুধু রইল অভিমান ভুলতে সে কি পার ভুলিয়েছ মোর প্রাণ॥
৬
পূজা - গান
পূজা - গান
তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে, এ আগুন ছড়িয়ে গেল সব খানে॥ যত সব মরা গাছের ডালে ডালে নাচে আগুন তালে তালে রে, আকাশে হাত তোলে সে কার পানে॥ আঁধারের তারা যত অবাক্ হয়ে রয় চেয়ে, কোথাকার পাগল হাওয়া বয় ধেয়ে। নিশীথের বুকের মাঝে এই-যে অমল উঠল ফুটে স্বর্ণকমল রে, আগুনের কী গুণ আছে কে জানে॥
৭
পূজা - গান
পূজা - গান
তোমার বীণা আমার মনোমাঝে কখনো শুনি, কখনো ভুলি, কখনো শুনি না যে॥ আকাশ যবে শিহরি উঠে গানে গোপন কথা কহিতে থাকে ধরার কানে কানে— তাহার মাঝে সহসা মাতে বিষম কোলাহলে আমার মনে বাঁধনহারা স্বপন দলে দলে। হে বীণাপাণি, তোমার সভাতলে আকুল হিয়া উন্মাদিয়া বেসুর হয়ে বাজে॥ চলিতেছিনু তব কমলবনে, পথের মাঝে ভুলালো পথ উতলা সমীরণে। তোমার সুর ফাগুনরাতে জাগে, তোমার সুর অশোকশাখে অরুণরেণুরাগে। সে সুর বাহি চলিতে চাহি আপন-ভোলা মনে গুঞ্জরিত-ত্বরিত-পাখা মধুকরের সনে। কুহেলী কেন জড়ায় আবরণে— আঁধারে আলো আবিল করে, আঁখি যে মরে লাজে॥
৮
পূজা - গান
পূজা - গান
তোমার নয়ন আমায় বারে বারে বলেছে গান গাহিবারে॥ ফুলে ফুলে তারায় তারায় বলেছে সে কোন্ ইশারায় দিবস-রাতির মাঝ-কিনারায় ধূসর আলোয় অন্ধকারে। গাই নে কেন কী কব তা, কেন আমার আকুলতা— ব্যথার মাঝে লুকায় কথা, সুর যে হারাই অকূল পারে॥ যেতে যেতে গভীর স্রোতে ডাক দিয়েছ তরী হতে। ডাক দিয়েছ ঝড়-তুফানে বোবা মেঘের বজ্রগানে, ডাক দিয়েছ মরণপানে শ্রাবণরাতের উতল ধারে। যাই নে কেন জান না কি— তোমার পানে মেলে আঁখি কূলের ঘাটে বসে থাকি, পথ কোথা পাই পারাবারে॥
৯
পূজা - গান
পূজা - গান
অরূপ, তোমার বাণী অঙ্গে আমার চিত্তে আমার মুক্তি দিক্ সে আনি॥ নিত্যকালের উৎসব তব বিশ্বের দীপালিকা— আমি শুধু তারি মাটির প্রদীপ, জ্বালাও তাহার শিখা নির্বাণহীন আলোকদীপ্ত তোমার ইচ্ছাখানি॥ যেমন তোমার বসন্তবায় গীতলেখা যায় লিখে বর্ণে বর্ণে পুষ্পে পর্ণে বনে বনে দিকে দিকে তেমনি আমার প্রাণের কেন্দ্রে নিশ্বাস দাও পুরে, শূন্য তাহার পূর্ণ করিয়া ধন্য করুক সুরে, বিঘ্ন তাহার পুণ্য করুক তব দক্ষিণপাণি॥
১০
পূজা - গান
পূজা - গান
গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে রুদ্ধবাণীর অন্ধকারে কাঁদন জেগে উঠে॥ বিশ্বকবির চিত্তমাঝে ভুবনবীণা যেথায় বাজে জীবন তোমার সুরের ধারায় পড়ুক সেথায় লুটে॥ ছন্দ তোমার ভেঙে গিয়ে দ্বন্দ্ব বাধায় প্রাণে, অন্তরে আর বাহিরে তাই তান মেলে না তানে। সুরহারা প্রাণ বিষম বাধা— সেই তো আঁধি, সেই তো ধাঁধা— গান-ভোলা তুই গান ফিরে নে, যাক সে আপদ ছুটে॥
১১
পূজা - গান
পূজা - গান
আমার সুরে লাগে তোমার হাসি, যেমন ঢেউয়ে ঢেউয়ে রবির কিরণ দোলে আসি॥ দিবানিশি আমিও যে ফিরি তোমার সুরের খোঁজে, হঠাৎ এ মন ভোলায় কখন তোমার বাঁশি॥ আমার সকল কাজই রইল বাকি, সকল শিক্ষা দিলেম ফাঁকি। আমার গানে তোমায় ধরব ব’লে উদাস হয়ে যাই যে চলে, তোমার গানে ধরা দিতে ভালোবাসি॥
১২
পূজা - গান
পূজা - গান
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে॥ একতারাটির একটি তারে গানের বেদন বইতে নারে, তোমার সাথে বারে বারে হার মেনেছি এই খেলাতে তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে॥ এ তার বাঁধা কাছের সুরে, ঐ বাঁশি যে বাজে দূরে। গানের লীলার সেই কিনারে যোগ দিতে কি সবাই পারে বিশ্বহৃদয়পারাবারে রাগরাগিণীর জাল ফেলাতে— তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে?।
১৩
পূজা - গান
পূজা - গান
জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে॥ এ মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে, গভীর কী আশায় নিবিড় পুলকে তাহার পানে চাই দু বাহু বাড়ায়ে॥ নীরব নিশি তব চরণ নিছায়ে আঁধার-কেশভার দিয়েছে বিছায়ে। আজি এ কোন্ গান নিখিল প্লাবিয়া তোমার বীণা হতে আসিল নাবিয়া! ভুবন মিলে যায় সুরের রণনে, গানের বেদনায় যাই যে হারায়ে॥
১৪
পূজা - গান
পূজা - গান
যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে তারা কথার বেড়া গাঁথে কেবল দলের পরে দলে॥ একের কথা আরে বুঝতে নাহি পারে, বোঝায় যত কথার বোঝা ততই বেড়ে চলে॥ যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর তাদের সবার সুরে সবাই মেলে নিকট হতে দূর। বোঝে কি নাই বোঝে থাকে না তার খোঁজে, বেদন তাদের ঠেকে গিয়ে তোমার চরণতলে॥
১৫
পূজা - গান
পূজা - গান
তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে মাটির এই কলস আমার ছাপিয়ে গেল কোন্ ক্ষণে॥ রবি ঐ অস্তে নামে শৈলতলে, বলাকা কোন্ গগনে উড়ে চলে— আমি এই করুণ ধারার কলকলে নীরবে কান পেতে রই আনমনে তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে॥ দিনে মোর যা প্রয়োজন বেড়াই তারি খোঁজ করে, মেটে বা নাই মেটে তা ভাবব না আর তার তরে সারাদিন অনেক ঘুরে দিনের শেষে এসেছি সকল চাওয়ার বাহির-দেশে, নেব আজ অসীম ধারার তীরে এসে প্রয়োজন ছাপিয়ে যা দাও সেই ধনে তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে॥
১৬
পূজা - গান
পূজা - গান
কূল থেকে মোর গানের তরী দিলেম খুলে, সাগর-মাঝে ভাসিয়ে দিলেম পালটি তুলে॥ যেখানে ঐ কোকিল ডাকে ছায়াতলে সেখানে নয়, যেখানে ঐ গ্রামের বধূ আসে জলে সেখানে নয়, যেখানে নীল মরণলীলা উঠছে দুলে সেখানে মোর গানের তরী দিলেম খুলে॥ এবার, বীণা, তোমায় আমায় আমরা একা— অন্ধকারে নাইবা কারে গেল দেখা কুঞ্জবনের শাখা হতে যে ফুল তোলে সে ফুল এ নয়, বাতায়নের লতা হতে যে ফুল দোলে সে ফুল এ নয়— দিশাহারা আকাশ-ভরা সুরের ফুলে সেই দিকে মোর গানের তরী দিলেম খুলে॥
১৭
পূজা - গান
পূজা - গান
তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে যেন জাগি গানের সুরে॥ যেমনি নয়ন মেলি যেন মাতার স্তন্যসুধা-হেন নবীন জীবন দেয় গো পূরে গানের সুরে॥ সেথায় তরু তৃণ যত মাটির বাঁশি হতে ওঠে গানের মতো। আলোক সেথা দেয় গো আনি আকাশের আনন্দবাণী, হৃদয়মাঝে বেড়ায় ঘুরে গানের সুরে॥
১৮
পূজা - গান
পূজা - গান
কেন তোমরা আমায় ডাকো, আমার মন না মানে। পাই নে সময় গানে গানে॥ পথ আমারে শুধায় লোকে, পথ কি আমার পড়ে চোখে, চলি যে কোন্ দিকের পানে গানে গানে॥ দাও না ছুটি, ধর ত্রুটি, নিই নে কানে। মন ভেসে যায় গানে গানে। আজ যে কুসুম-ফোটার বেলা, আকাশে আজ রঙের মেলা, সকল দিকেই আমায় টানে গানে গানে॥
১৯
পূজা - গান
পূজা - গান
দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ও পারে— আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে॥ বাতাস বহে মরি মরি, আর বেঁধে রেখো না তরী— এসো এসো পার হয়ে মোর হৃদয়মাঝারে॥ তোমার সাথে গানের খেলা দূরের খেলা যে, বেদনাতে বাঁশি বাজায় সকল বেলা যে। কবে নিয়ে আমার বাঁশি বাজাবে গো আপনি আসি আনন্দময় নীরব রাতের নিবিড় আঁধারে॥
২০
পূজা - গান
পূজা - গান
রাজপুরীতে বাজায় বাঁশি বেলাশেষের তান। পথে চলি, শুধায় পথিক ‘কী নিলি তোর দান’॥ দেখাব যে সবার কাছে এমন আমার কী-বা আছে, সঙ্গে আমার আছে শুধু এই কখানি গান॥ ঘরে আমার রাখতে যে হয় বহু লোকের মন— অনেক বাঁশি, অনেক কাঁসি, অনেক আয়োজন। বঁধুর কাছে আসার বেলায় গানটি শুধু নিলেম গলায়, তারি গলার মাল্য ক’রে করব মূল্যবান॥
২১
পূজা - গান
পূজা - গান
জাগ’ জাগ’ রে জাগ’ সঙ্গীত—চিত্ত অম্বর কর তরঙ্গিত নিবিড়নন্দিত প্রেমকম্পিত হৃদয়কুঞ্জবিতানে॥ মুক্তবন্ধন সপ্তসুর তব করুক বিশ্ববিহার, সূর্যশশিনক্ষত্রলোকে করুক হর্ষ প্রচার। তানে তানে প্রাণে প্রাণে গাঁথ’ নন্দনহার। পূর্ণ কর’ রে গগন-অঙ্গন তাঁর বন্দনগানে॥
২২
পূজা - গান
পূজা - গান
হেথা যে গান গাইতে আসা, আমার হয় নি সে গান গাওয়া— আজও কেবলই সুর সাধা, আমার কেবল গাইতে চাওয়া॥ আমার লাগে নাই সে সুর, আমার বাঁধে নাই সে কথা, শুধু প্রাণেরই মাঝখানে আছে গানের ব্যাকুলতা। আজও ফোটে নাই সে ফুল, শুধু বহেছে এক হাওয়া॥ আমি দেখি নাই তার মুখ, আমি শুনি নাই তার বাণী, কেবল শুনি ক্ষণে ক্ষণে তাহার পায়ের ধ্বনিখানি— আমার দ্বারের সমুখ দিয়ে সে জন করে আসা-যাওয়া। শুধু আসন পাতা হল আমার সারাটি দিন ধ’রে— ঘরে হয় নি প্রদীপ জ্বালা, তারে ডাকব কেমন করে। আছি পাবার আশা নিয়ে, তারে হয় নি আমার পাওয়া॥
২৩
পূজা - গান
পূজা - গান
আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান, দিয়ো তোমার জগৎ-সভায় এইটুকু মোর স্থান॥ আমি তোমার ভুবন-মাঝে লাগি নি, নাথ, কোনো কাজে— শুধু কেবল সুরে বাজে অকাজের এই প্রাণ॥ নিশায় নীরব দেবালয়ে তোমার আরাধন, তখন মোরে আদেশ কোরো গাইতে হে রাজন। ভোরে যখন আকাশ জুড়ে বাজবে বীণা সোনার সুরে আমি যেন না রই দূরে, এই দিয়ো মোর মান॥
২৪
পূজা - গান
পূজা - গান
গানের সুরের আসনখানি পাতি পথের ধারে। ওগো পথিক, তুমি এসে বসবে বারে বারে॥ ঐ যে তোমার ভোরের পাখি নিত্য করে ডাকাডাকি, অরুণ-আলোর খেয়ায় যখন এস ঘাটের পারে, মোর প্রভাতীর গানখানিতে দাঁড়াও আমার দ্বারে॥ আজ সকালে মেঘের ছায়া লুটিয়ে পড়ে বনে, জল ভরেছে ঐ গগনের নীল নয়নের কোণে। আজকে এলে নতুন বেশে তালের বনে মাঠের শেষে, অমনি চলে যেয়ো নাকো গোপনসঞ্চারে। দাঁড়িয়ো আমার মেঘলা গানের বাদল-অন্ধকারে॥
২৫
পূজা - গান
পূজা - গান
সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই কেবল কাজে বুকে বাজে তোমার চোখের ভর্ৎসনা যে॥ উধাও আকাশ, উদার ধরা, সুনীল-শ্যামল-সুধায়-ভরা মিলায় দূরে, পরশ তাদের মেলে না যে— বুকে বাজে তোমার চোখের ভর্ৎসনা যে॥ বিশ্ব যে সেই সুরের পথের হাওয়ায় হাওয়ায় চিত্ত আমার ব্যাকুল করে আসা-যাওয়ায়। তোমায় বসাই এ-হেন ঠাঁই ভুবনে মোর আর-কোথা নাই, মিলন হবার আসন হারাই আপন-মাঝে— বুকে বাজে তোমার চোখের ভর্ৎসনা যে॥
২৬
পূজা - গান
পূজা - গান
গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি তখন তারে চিনি আমি, তখন তারে জানি। তখন তারি আলোর ভাষায় আকাশ ভরে ভালোবাসায়, তখন তারি ধুলায় ধুলায় জাগে পরম বাণী॥ তখন সে যে বাহির ছেড়ে অন্তরে মোর আসে, তখন আমার হৃদয় কাঁপে তারি ঘাসে ঘাসে। রূপের রেখা রসের ধারায় আপন সীমা কোথায় হারায়, তখন দেখি আমার সাথে সবার কানাকানি॥
২৭
পূজা - গান
পূজা - গান
খেলার ছলে সাজিয়ে আমার গানের বাণী দিনে দিনে ভাসাই দিনের তরীখানি॥ স্রোতের লীলায় ভেসে ভেসে সুদূরে কোন্ অচিন দেশে কোনো ঘাটে ঠেকবে কিনা নাহি জানি॥ নাহয় ডুবে গেলই, নাহয় গেলই বা। নাহয় তুলে লও গো, নাহয় ফেলোই বা। হে অজানা, মরি মরি, উদ্দেশে এই খেলা করি, এই খেলাতেই আপন-মনে ধন্য মানি॥
২৮
পূজা - গান
পূজা - গান
যতখন তুমি আমায় বসিয়ে রাখ বাহির-বাটে ততখন গানের পরে গান গেয়ে মোর প্রহর কাটে॥ যবে শুভক্ষণে ডাক পড়ে সেই ভিতর-সভার মাঝে এ গান লাগবে বুঝি কাজে তোমার সুরের রঙের রঙিন নাটে॥ তোমার ফাগুনদিনের বকুল চাঁপা, শ্রাবণদিনের কেয়া, তাই দেখে তো শুনি তোমার কেমন যে তান দে’য়া। আমি উতল প্রাণে আকাশ-পানে হৃদয়খানি তুলি বীণায় বেঁধেছি গানগুলি তোমার সাঁঝ-সকালের সুরের ঠাটে॥
২৯
পূজা - গান
পূজা - গান
আমার যে গান তোমার পরশ পাবে থাকে কোথায় গহন মনের ভাবে?। সুরে সুরে খুঁজি তারে অন্ধকারে, আমার যে আঁখিজল তোমার পায়ে নাবে থাকে কোথায় গহন মনের ভাবে?। যখন শুষ্ক প্রহর বৃথা কাটাই চাহি গানের লিপি তোমায় পাঠাই। কোথায় দুঃখসুখের তলায় সুর যে পলায়, আমার যে শেষ বাণী তোমার দ্বারে যাবে থাকে কোথায় গহন মনের ভাবে?।
৩০
পূজা - গান
পূজা - গান
গানের ঝরনাতলায় তুমি সাঁঝের বেলায় এলে। দাও আমারে সোনার-বরন সুরের ধারা ঢেলে॥ যে সুর গোপন গুহা হতে ছুটে আসে আকুল স্রোতে, কান্নাসাগর-পানে যে যায় বুকের পাথর ঠেলে॥ যে সুর ঊষার বাণী বয়ে আকাশে যায় ভেসে, রাতের কোলে যায় গো চলে সোনার হাসি হেসে। যে সুর চাঁপার পেয়ালা ভ’রে দেয় আপনায় উজাড় ক’রে, যায় চলে যায় চৈত্রদিনের মধুর খেলা খেলে॥
৩১
পূজা - গান
পূজা - গান
কণ্ঠে নিলেম গান, আমার শেষ পারানির কড়ি— একলা ঘাটে রইব না গো পড়ি॥ আমার সুরের রসিক নেয়ে তারে ভোলাব গান গেয়ে, পারের খেয়ায় সেই ভরসায় চড়ি॥ পার হব কি নাই হব তার খবর কে রাখে— দূরের হাওয়ায় ডাক দিল এই সুরের পাগলাকে। ওগো তোমরা মিছে ভাব, আমি যাবই যাবই যাব— ভাঙল দুয়ার, কাটল দড়াদড়ি॥
৩২
পূজা - গান
পূজা - গান
আমার ঢালা গানের ধারা সেই তো তুমি পিয়েছিলে, আমার গাঁথা স্বপন-মালা কখন চেয়ে নিয়েছিলে॥ মন যবে মোর দূরে দূরে ফিরেছিল আকাশ ঘুরে তখন আমার ব্যথার সুরে আভাস দিয়ে গিয়েছিলে॥ যবে বিদায় নিয়ে যাবে চলে মিলন-পালা সাঙ্গ হলে শরৎ-আলোয় বাদল-মেঘে এই কথাটি রইবে লেগে— এই শ্যামলে এই নীলিমায় আমায় দেখা দিয়েছিলে॥