Generated on: Fri Dec 19 2014

Home

::

Show All

::

Show Current

::

Scroll TOC Up| Down

Send a Comment

৩৩
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে—
        সে তো    আজকে নয় সে আজকে নয়।
   ভুলে গেছি কবে থেকে আসছি তোমায় চেয়ে—
        সে তো    আজকে নয় সে আজকে নয়॥
   ঝরনা যেমন বাহিরে যায়, জানে না সে কাহারে চায়,
     তেমনি করে ধেয়ে এলেম জীবনধারা বেয়ে—
        সে তো    আজকে নয় সে আজকে নয়॥
 কতই নামে ডেকেছি যে,   কতই ছবি এঁকেছি যে,
     কোন্‌ আনন্দে চলেছি তার ঠিকানা না পেয়ে—
        সে তো    আজকে নয় সে আজকে নয়।
 পুষ্প যেমন আলোর লাগি না জেনে রাত কাটায় জাগি
     তেমনি তোমার আশায় আমার হৃদয় আছে ছেয়ে—
        সে তো    আজকে নয় সে আজকে নয়॥
    
৩৪
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে আলোয় আকাশ ভরা।
তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে ফুল্ল শ্যামল ধরা॥
     তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে
     রাত্রি জাগে জগৎ লয়ে কোলে,
ঊষা এসে পূর্বদুয়ার খোলে কলকণ্ঠস্বরা॥
চলছে ভেসে মিলন-আশা-তরী অনাদিস্রোত বেয়ে।
কত কালের কুসুম উঠে ভরি বরণডালি ছেয়ে।
     তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে
     যুগে যুগে বিশ্বভুবনতলে
পরান আমার বধূর বেশে চলে চিরস্বয়ম্বরা॥
    
৩৫
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 প্রভু,	তোমার বীণা যেমনি বাজে
 	আঁধার-মাঝে
 	অমনি ফোটে তারা।
 যেন	সেই বীণাটি গভীর তানে
 	আমার প্রাণে
 	বাজে তেমনিধারা॥
 তখন	নূতন সৃষ্টি প্রকাশ হবে
 	কী গৌরবে
 	হৃদয়-অন্ধকারে।
 তখন	স্তরে স্তরে আলোকরাশি
 	উঠবে ভাসি
 	চিত্তগগনপারে॥
 তখন	তোমারি সৌন্দর্যছবি,
 	ওগো কবি,
 	আমায় পড়বে আঁকা—
 তখন	বিস্ময়ের রবে না সীমা,
 	ওই মহিমা
 	আর যাবে না ঢাকা।
 তখন	তোমারি প্রসন্ন হাসি
 	পড়বে আসি
 	নবজীবন-’পরে।
 তখন	আনন্দ-অমৃতে তব
 	ধন্য হব
 	চিরদিনের তরে॥
    
৩৬
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 তুমি    একলা ঘরে বসে বসে কী সুর বাজালে
        প্রভু,   আমার জীবনে!
 তোমার   পরশরতন গেঁথে গেঁথে আমায় সাজালে
        প্রভু,   গভীর গোপনে॥
 দিনের আলোর আড়াল টানি   কোথায় ছিলে নাহি জানি,
       অস্তরবির তোরণ হতে চরণ বাড়ালে
        আমার  রাতের স্বপনে॥
 আমার   হিয়ায় হিয়ায় বাজে আকুল আঁধার যামিনী,
        সে যে  তোমার বাঁশরি।
 আমি    শুনি তোমার আকাশপারের তারার রাগিণী,
        আমার সকল পাশরি।
 কানে আসে আশার বাণী— খোলা পাব দুয়ারখানি
     রাতের শেষে শিশির-ধোওয়া প্রথম সকালে
        তোমার  করুণ কিরণে॥
    
৩৭
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়,
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো॥
সারা পথের ক্লান্তি আমার সারা দিনের তৃষা
কেমন করে মেটাব যে খুঁজে না পাই দিশা—
এ আঁধার যে পূর্ণ তোমায় সেই কথা বলিয়ো॥
হৃদয় আমার চায় যে দিতে, কেবল নিতে নয়,
বয়ে বয়ে বেড়ায় সে তার যা-কিছু সঞ্চয়।
হাতখানি ওই বাড়িয়ে আনো, দাও গো আমার হাতে—
ধরব তারে, ভরব তারে, রাখব তারে সাথে,
একলা পথে চলা আমার করব রমণীয়॥
    
৩৮
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমার   সুর শুনায়ে যে ঘুম ভাঙাও সে ঘুম আমার রমণীয়—
    জাগরণের সঙ্গিনী সে, তারে তোমার পরশ দিয়ো॥
    অন্তরে তার গভীর ক্ষুধা,   গোপনে চায় আলোকসুধা,
    আমার রাতের বুকে সে যে তোমার প্রাতের আপন প্রিয়॥
    তারি লাগি আকাশ রাঙা আঁধার-ভাঙা অরুণরাগে,
    তারি লাগি পাখির গানে নবীন আশার আলাপ জাগে।
    নীরব তোমার চরণধ্বনি   শুনায় তারে আগমনী,
    সন্ধ্যাবেলার কুঁড়ি তারে সকালবেলায় তুলে নিয়ো॥
    
৩৯
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে
একেলা রয়েছ নীরব শয়ন-’পরে—
    প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো॥
রুদ্ধ দ্বারের বাহিরে দাঁড়ায়ে আমি
আর কতকাল এমনে কাটিবে স্বামী—
    প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো॥
রজনীর তারা উঠেছে গগন ছেয়ে,
আছে সবে মোর বাতায়ন-পানে চেয়ে—
    প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।
জীবনে আমার সঙ্গীত দাও আনি,
নীরব রেখো না তোমার বীণার বাণী—
    প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো॥
মিলাব নয়ন তব নয়নের সাথে,
মিলাব এ হাত তব দক্ষিণহাতে—
    প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।
হৃদয়পাত্র সুধায় পূর্ণ হবে,
তিমির কাঁপিবে গভীর আলোর রবে—
    প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো॥
    
৪০
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 মোর	প্রভাতের এই প্রথম খনের কুসুমখানি
 তুমি	জাগাও তারে ওই নয়নের আলোক হানি॥
 সে যে	দিনের বেলায় করবে খেলা হাওয়ায় দুলে,
 রাতের	অন্ধকারে নেবে তারে বক্ষে তুলে—
 ওগো	তখনি তো গন্ধে তাহার ফুটবে বাণী॥
 আমার	বীণাখানি পড়ছে আজি সবার চোখে,
 হেরো	তারগুলি তার দেখছে গুনে সকল লোকে।
 ওগো	কখন সে যে সভা ত্যেজে আড়াল হবে,
 শুধু	সুরটুকু তার উঠবে বেজে করুণ রবে—
 যখন	তুমি তারে বুকের ’পরে লবে টানি॥
    
৪১
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মালা হতে খসে-পড়া ফুলের একটি দল
      মাথায় আমার ধরতে দাও,  ওগো,  ধরতে দাও।
ওই মাধুরীসরোবরের নাই যে কোথাও তল,
      হোথায় আমায় ডুবতে দাও,  ওগো,  মরতে দাও॥
দাও গো মুছে আমার ভালে অপমানের লিখা;
নিভৃতে আজ, বন্ধু, তোমার আপন হাতের টিকা
      ললাটে মোর পরতে দাও,  ওগো,  পরতে দাও॥
বহুক তোমার ঝড়ের হাওয়া আমার ফুলবনে,
      শুকনো পাতা মলিন কুসুম ঝরতে দাও।
পথ জুড়ে যা পড়ে আছে আমার এ জীবনে
      দাও গো তাদের সরতে দাও,  ওগো,  সরতে দাও।
তোমার মহাভাণ্ডারেতে আছে অনেক ধন—
কুড়িয়ে বেড়াই মুঠা ভ’রে, ভরে না তায় মন,
      অন্তরেতে জীবন আমার ভরতে দাও॥
    
৪২
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে
         কী উৎসবের লগনে॥
সব আলোটি কেমন ক’রে   ফেল আমার মুখের ’পরে,
    তুমি  আপনি থাকো আলোর পিছনে॥
        প্রেমটি যেদিন জ্বালি হৃদয়-গগনে
           কী উৎসবের লগনে
সব আলো তার কেমন ক’রে   পড়ে আমার মুখের ’পরে
    আমি  আপনি পড়ি আলোর পিছনে॥
    
৪৩
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
          কার হাতে এই মালা তোমার পাঠালে
            আজ    ফাগুন-দিনের সকালে॥
তার    বর্ণে তোমার নামের রেখা   গন্ধে তোমার ছন্দ লেখা,
          সেই মালাটি বেঁধেছি মোর কপালে    
            আজ    ফাগুন-দিনের সকালে॥
          গানটি তোমার চলে এল আকাশে
            আজ    ফাগুন-দিনের বাতাসে।
ওগো,   আমার নামটি তোমার সুরে  কেমন করে দিলে জুড়ে
         লুকিয়ে তুমি ওই গানেরই আড়ালে
            আজ    ফাগুন-দিনের সকালে॥
    
৪৪
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
         বল তো এইবারের মতো
প্রভু, তোমার আঙিনাতে তুলি আমার ফসল যত॥
কিছু-বা ফল গেছে ঝরে,   কিছু-বা ফল আছে ধরে,
         বছর হয়ে এল গত—
রোদের দিনে ছায়ায় বসে   বাজায় বাঁশি রাখাল যত॥
         হুকুম তুমি কর যদি
চৈত্র-হাওয়ায় পাল তুলে দিই—  ওই-যে মেতে ওঠে নদী।
পার ক’রে নিই ভরা তরী,   মাঠের যা কাজ সারা করি,
         ঘরের কাজে হই গো রত—
এবার আমার মাথার বোঝা   পায়ে তোমার করি নত॥
    
৪৫
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 তোমায় 	নতুন করে পাব ব’লে হারাই ক্ষণে-ক্ষণ
 ও মোর 	ভালোবাসার ধন।
       	দেখা দেবে ব’লে তুমি হও যে অদর্শন
 ও মোর 	ভালোবাসার ধন॥
 ওগো, 	তুমি আমার নও আড়ালের, তুমি আমার চিরকালের—
      	ক্ষণকালের লীলার স্রোতে হও যে নিমগন
 ও মোর 	ভালোবাসার ধন॥
 আমি   	তোমায় যখন খুঁজে ফিরি ভয়ে কাঁপে মন—
       	প্রেমে আমার ঢেউ লাগে তখন।
 তোমার 	শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে শেষ করে দাও আপনাকে যে—
     	ওই হাসিরে দেয় ধুয়ে মোর বিরহের রোদন
 ও মোর 	ভালোবাসার ধন॥
    
৪৬
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      ধীরে বন্ধু, ধীরে ধীরে
          চলো তোমার বিজনমন্দিরে॥
জানি নে পথ, নাই যে আলো,  ভিতর বাহির কালোয় কালো,
          তোমার চরণশব্দ বরণ করেছি
           আজ এই অরণ্যগভীরে॥
               ধীরে বন্ধু, ধীরে ধীরে
          চলো  অন্ধকারের তীরে তীরে।
   চলব আমি নিশীথরাতে  তোমার হাওয়ার ইশারাতে,
          তোমার  বসনগন্ধ বরণ করেছি
             আজ এই  বসন্তসমীরে॥
    
৪৭
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
           এবার আমায় ডাকলে দূরে
           সাগর-পারের গোপন পুরে॥
বোঝা আমার নামিয়েছি যে,   সঙ্গে আমায় নাও গো নিজে,
      স্তব্ধ রাতের স্নিগ্ধ সুধা পান করাবে তৃষ্ণাতুরে॥
             আমার সন্ধ্যাফুলের মধু
          এবার যে ভোগ করবে বঁধু।
  তারার আলোর প্রদীপখানি   প্রাণে আমার জ্বালবে আনি,
     আমার যত কথা ছিল ভেসে যাবে তোমার সুরে॥
    
৪৮
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দুঃখের বরষায়  চক্ষের জল যেই  নামল
বক্ষের দরজায়  বন্ধুর রথ সেই  থামল॥
মিলনের পত্রটি  পূর্ণ যে বিচ্ছেদ  -বেদনায়;
অর্পিনু হাতে তার,  খেদ নাই আর মোর  খেদ নাই॥
বহুদিনবঞ্চিত  অন্তরে সঞ্চিত  কী আশা,
চক্ষের নিমেষেই  মিটল সে পরশের  তিয়াষা।
এত দিনে জানলেম  যে কাঁদন কাঁদলেম  সে কাহার জন্য।
ধন্য এ জাগরণ,  ধন্য এ ত্রন্দন, ধন্য রে ধন্য॥
    
৪৯
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সে দিনে       আপদ আমার যাবে কেটে
পুলকে        হৃদয় যেদিন পড়েব ফেটে॥
তখন     তোমার গন্ধ তোমার মধু  আপনি বাহির হবে বঁধু হে,
তারে     আমার ব’লে ছলে বলে  কে বলো আর রাখবে এঁটে॥
আমারে    নিখিল ভুবন দেখছে চেয়ে রাত্রিদিবা।
আমি কি      জানি নে তার অর্থ কিবা!
তারা যে   জানে আমার চিত্তকোষে  অমৃতরূপ আছে বসে গো—
তারেই    প্রকাশ করি, আপনি মরি,  তবে আমার দুঃখ মেটে॥
    
৫০
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার  হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে  দেখতে আমি পাই নি।
       তোমায়   দেখতে আমি পাই নি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি,   আমার   হৃদয়-পানে চাই নি॥
 আমার সকল ভালোবাসায়   সকল আঘাত সকল আশায়
  তুমি ছিলে আমার কাছে, তোমার কাছে যাই নি॥
  তুমি মোর আনন্দ হয়ে  ছিলে আমার খেলায়—
  আনন্দে তাই ভুলেছিলেম,  কেটেছে দিন হেলায়।
  গোপন রহি গভীর প্রাণে  আমার দুঃখসুখের গানে
  সুর দিয়েছ তুমি, আমি  তোমার গান তো গাই নি॥
    
৫১
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কেন  চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না  শুকনো ধুলো যত!
    কে জানিত আসবে তুমি গো  অনাহূতের মতো॥
    পার হয়ে এসেছ মরু,  নাই যে সেথায় ছায়াতরু—
    পথের দুঃখ দিলেম তোমায় গো  এমন ভাগ্যহত॥
    আলসেতে বসেছিলেম আমি  আপন ঘরের ছায়ে,
    জানি নাই যে তোমায় কত ব্যথা  বাজবে পায়ে পায়ে।
    ওই বেদনা আমার বুকে  বেজেছিল গোপন দুখে—
    দাগ দিয়েছে মর্মে আমার গো  গভীর হৃদয়ক্ষত॥
    
৫২
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    আমায়   বাঁধবে যদি কাজের ডোরে
    কেন   পাগল কর এমন ক’রে?।
বাতাস আনে কেন জানি     কোন্‌ গগনের গোপন বাণী,
       পরানখানি দেয় যে ভ’রে॥
সোনার আলো কেমনে হে,    রক্তে নাচে সকল দেহে।
কারে পাঠাও ক্ষণে ক্ষণে     আমার খোলা বাতায়নে,
       সকল হৃদয় লয় যে হ’রে॥
    
৫৩
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওদের সাথে মেলাও যারা চরায় তোমার ধেনু,
      তোমার নামে বাজায় যারা বেণু॥
পাষাণ দিয়ে বাঁধা ঘাটে  এই-যে কোলাহলের হাটে
      কেন আমি কিসের লোভে এনু॥
কী ডাক ডাকে বনের পাতাগুলি,  কার ইশারা -তৃণের অঙ্গুলি!
প্রাণেশ আমার লীলাভরে  খেলেন প্রাণের খেলাঘরে,
      পাখির মুখে এই-যে খবর পেনু॥
    
৫৪
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  আমারে তুমি অশেষ করেছ,  এমনি লীলা তব—
  ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ,  জীবন নব নব॥
     কত-যে গিরি কত-যে নদী -তীরে
     বেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে,
     কত-যে তান বাজালে ফিরে ফিরে
        কাহারে তাহা কব॥
 তোমারি ওই অমৃতপরশে  আমার হিয়াখানি
 হারালো সীমা বিপুল হরষে,  উথলি উঠে বাণী।
     আমার শুধু একটি মুঠি ভরি
     দিতেছ দান দিবস-বিভাবরী—
     হল না সারা কত-না যুগ ধরি
        কেবলই আমি লব॥
    
৫৫
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
              প্রভু, বলো বলো কবে
তোমার  পথের ধুলার রঙে রঙে আঁচল রঙিন হবে।
      তোমার বনের রাঙা ধূলি  ফুটায় পূজার কুসুমগুলি,
      সেই ধূলি হায় কখন আমায় আপন করি লবে?
      প্রণাম দিতে চরণতলে  ধুলার কাঙাল যাত্রীদলে
      চলে যারা, আপন ব’লে চিনবে আমায় সবে॥
    
৫৬
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 আমার   না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে
             তোমার ভাবনা তারার মতন রাজে॥
        নিভৃত মনের বনের ছায়াটি ঘিরে
        না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ ফিরে,
 আমার   লুকায় বেদনা অঝরা অশ্রুনীরে—
           অশ্রুত বাঁশি হৃদয়গহনে বাজে॥
        ক্ষণে ক্ষণে আমি না জেনে করেছি দান
              তোমায় আমার গান।
        পরানের সাজি সাজাই খেলার ফুলে,
        জানি না কখন নিজে বেছে লও তুলে—
 তুমি     অলখ আলোকে নীরবে দুয়ার খুলে
         প্রাণের পরশ দিয়ে যাও মোর কাজে॥
    
৫৭
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
আমার    হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে দোলাও,
         কে আমারে কী-যে বলে ভোলাও ভোলাও॥
    ওরা কেবল কথার পাকে নিত্য আমায় বেঁধে রাখে,
         বাঁশির ডাকে সকল বাঁধন খোলাও॥
         মনে পড়ে, কত-না দিন রাতি
         আমি ছিলেম তোমার খেলার সাথি।
    আজকে তুমি তেমনি ক’রে  সামনে তোমার রাখো ধরে,
         আমার প্রাণে খেলার সে ঢেউ তোলাও॥
    
৫৮
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভেঙে মোর   ঘরের চাবি    নিয়ে যাবি    কে আমারে
          ও বন্ধু আমার!
না পেয়ে  তোমার দেখা,  একা একা  দিন যে আমার কাটে না রে॥
          বুঝি গো  রাত পোহালো,
          বুঝি ওই  রবির আলো
          আভাসে  দেখা দিল গগন-পারে—
সমুখে    ওই হেরি পথ,  তোমার কি রথ  পৌঁছবে না মোর দুয়ারে॥
          আকাশের  যত তারা
          চেয়ে রয়  নিমেষহারা,
          বসে রয়  রাত-প্রভাতের পথের ধারে।
তোমারি  দেখা পেলে সকল ফেলে ডুববে আলোক-পারাবারে।
          প্রভাতের  পথিক সবে
          এল কি  কলরবে—
          গেল কি  গান গেয়ে ওই সারে সারে!
বুঝি-বা  ফুল ফুটেছে, সুর উঠেছে  অরুণবীণার তারে তারে॥
    
৫৯
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমায় কিছু দেব ব’লে চায় যে আমার মন,
   নাই-বা তোমার থাকল প্রয়োজন॥
যখন তোমার পেলেম দেখা, অন্ধকারে একা একা
   ফিরতেছিলে বিজন গভীর বন।
ইচ্ছা ছিল একটি বাতি জ্বালাই তোমার পথে,
   নাই-বা তোমার থাকল প্রয়োজন॥
দেখেছিলেম হাটের লোকে তোমারে দেয় গালি,
   গায়ে তোমার ছড়ায় ধুলাবালি।
অপমানের পথের মাঝে  তোমার বীণা নিত্য বাজে
   আপন-সুরে-আপনি-নিমগন।
ইচ্ছা ছিল বরণমালা পরাই তোমার গলে,
   নাই-বা তোমার থাকল প্রয়োজন॥
দলে দলে আসে লোকে, রচে তোমার স্তব—
   নানা ভাষায় নানান কলরব।
ভিক্ষা লাগি তোমার দ্বারে  আঘাত করে বারে বারে
   কত-যে শাপ, কত-যে ত্রন্দন।
ইচ্ছা ছিল বিনা পণে আপনাকে দিই পায়ে,
   নাই-বা তোমার থাকল প্রয়োজন॥
    
৬০
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার   অভিমানের বদলে আজ নেব তোমার মালা।
আজ    নিশিশেষে শেষ করে দিই চোখের জলের পালা॥
আমার   কঠিন হৃদয়টারে ফেলে   দিলেম পথের ধারে,
তোমার   চরণ দেবে তারে মধুর   পরশ পাষাণ-গালা॥
ছিল    আমার আঁধারখানি,   তারে তুমিই নিলে টানি,
তোমার   প্রেম এল যে আগুন হয়ে— করল তারে আলা।
সেই-যে   আমার কাছে আমি   ছিল   সবার চেয়ে দামি,
তারে    উজাড় করে সাজিয়ে দিলেম   তোমার বরণডালা॥
    
৬১
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তুমি     খুশি থাক আমার পানে চেয়ে চেয়ে
তোমার   আঙিনাতে বেড়াই যখন গেয়ে গেয়ে॥
       তোমার পরশ আমার মাঝে  সুরে সুরে বুকে বাজে,
       সেই আনন্দ নাচায় ছন্দ  বিশ্বভুবন ছেয়ে ছেয়ে॥
       ফিরে ফিরে চিত্তবীণায় দাও যে নাড়া,
       গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া দেয় সে সাড়া।
       তোমার আঁধার তোমার আলো দুই আমারে লাগল ভালো—
       আমার হাসি বেড়ায় ভাসি  তোমার হাসি বেয়ে বেয়ে॥
    
৬২
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
         আমার সকল রসের ধারা
      তোমাতে আজ হোক-না হারা॥
 জীবন জুড়ে লাগুক পরশ,   ভুবন ব্যেপে জাগুক হরষ,
   তোমার রূপে মরুক ডুবে   আমার দুটি আঁখিতারা॥
         হারিয়ে-যাওয়া মনটি আমার
      ফিরিয়ে তুমি আনলে আবার॥
 ছড়িয়ে-পড়া আশাগুলি   কুড়িয়ে তুমি লও গো তুলি,
   গলার হারে দোলাও তারে   গাঁথা তোমার ক’রে সারা॥
    
৬৩
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে
 তোমায় আমায় দেখা হল সেই মোহানার ধারে॥
 সেইখানেতে সাদায় কালোয়   মিলে গেছে আঁধার আলোয়—
 সেইখানেতে ঢেউ ছুটেছে এ পারে ওই পারে॥
 নিতলনীল নীরব-মাঝে বাজল গভীর বাণী,
 নিকষেতে উঠল ফুটে সোনার রেখাখানি।
 মুখের পানে তাকাতে যাই,   দেখি-দেখি দেখতে না পাই—
 স্বপন-সাথে জড়িয়ে জাগা, কাঁদি আকুল ধারে॥
  
    
৬৪
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 আমার     খেলা যখন ছিল তোমার সনে
 তখন     কে তুমি তা কে জানত।
 তখন     ছিল না ভয়, ছিল না লাজ মনে,
 জীবন     বহে যেত অশান্ত॥
 তুমি     ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত
 যেন আমার আপন সখার মতো,
 হেসে     তোমার সাথে ফিরেছিলেম ছুটে
 সে দিন কত-না বন-বনান্ত॥
 ওগো,     সেদিন তুমি গাইতে যে-সব গান
 কোনো     অর্থ তাহার কে জানত।
 শুধু     সঙ্গে তারি গাইত আমার প্রাণ,
 সদা     নাচত হৃদয় অশান্ত।
 হঠাৎ     খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি—
 স্তব্ধ আকাশ, নীরব শশী রবি,
 তোমার     চরণ-পানে নয়ন করি নত
 ভুবন     দাঁড়িয়ে আছে একান্ত॥
    
৬৫
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর—
 আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর॥
 কত বর্ণে কত গন্ধে     কত গানে কত ছন্দে
 অরূপ, তোমার রূপের লীলায় জাগে হৃদয়পুর।
 আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর॥
 তোমায় আমায় মিলন হলে সকলই যায় খুলে,
 বিশ্বসাগর ঢেউ খেলায়ে উঠে তখন দুলে।
 তোমার আলোয় নাই তো ছায়া,     আমার মাঝে পায় সে কায়া,
 হয় সে আমার অশ্রুজলে সুন্দরবিধুর।
 আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর॥
    
৬৬
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 আজি   যত তারা তব আকাশে
 সবে   মোর প্রাণ ভরি প্রকাশে॥
 নিখিল তোমার এসেছে ছুটিয়া,   মোর মাঝে আজি পড়েছে টুটিয়া হে,
   তব নিকুঞ্জের মঞ্জরী যত   আমারি অঙ্গে বিকাশে॥
 দিকে দিগন্তে যত আনন্দ   লভিয়াছে এক গভীর গন্ধ,
   আমার চিত্তে মিলি একত্রে   তোমার মন্দিরে উছাসে।
 আজি কোনোখানে কারেও না জানি,
 শুনিতে না পাই আজি কারো বাণী হে,
 নিখিল নিশ্বাস আজি এ বক্ষে   বাঁশরির সুরে বিলাসে॥
    
৬৭
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 আমি   কেমন করিয়া জানাব আমার জুড়ালো হৃদয় জুড়ালো—
 আমার   জুড়ালো হৃদয় প্রভাতে।
 আমি   কেমন করিয়া জানাব আমার পরান কী নিধি কুড়ালো—
 ডুবিয়া   নিবিড় গভীর শোভাতে॥
 আজ   গিয়েছি সবার মাঝারে, সেথায় দেখেছি আলোক-আসনে—
 দেখেছি   আমার হৃদয়রাজারে।
 আমি   দুয়েকটি কথা কয়েছি তা সনে সে নীরব সভা-মাঝারে—
 দেখেছি   চিরজনমের রাজারে॥
 এই   বাতাস আমারে হৃদয়ে লয়েছে, আলোক আমার তনুতে
 কেমনে   মিলে গেছে মোর তনুতে—
 তাই   এ গগন-ভরা প্রভাত পশিল আমার অণুতে অণুতে।
 আজ   ত্রিভুবন-জোড়া কাহার বক্ষে দেহ মন মোর ফুরালো—
 যেন রে   নিঃশেষে আজি ফুরালো।
 আজ   যেখানে যা হেরি সকলেরই মাঝে জুড়ালো জীবন জুড়ালো—
 আমার   আদি ও অন্ত জুড়ালো॥
  
    
৬৮
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 প্রভু আমার, প্রিয় আমার পরম ধন হে।
 চিরপথের সঙ্গী আমার চিরজীবন হে॥
 তৃপ্তি আমার, অতৃপ্তি মোর,   মুক্তি আমার, বন্ধনডোর,
 দুঃখসুখের চরম আমার জীবন মরণ হে॥
 আমার সকল গতির মাঝে পরম গতি হে,
 নিত্য প্রেমের ধামে আমার পরম পতি হে।
 ওগো সবার, ওগো আমার,   বিশ্ব হতে চিত্তে বিহার—
 অন্তবিহীন লীলা তোমার নূতন নূতন হে॥
    
৬৯
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 তুমি বন্ধু, তুমি নাথ,     নিশিদিন তুমি আমার।
 তুমি সুখ, তুমি শান্তি,       তুমি হে অমৃতপাথার॥
 তুমিই তো আনন্দলোক,       জুড়াও প্রাণ, নাশো শোক,
 তাপহরণ তোমার চরণ অসীমশরণ দীনজনার॥
    
৭০
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 ও অকূলের কূল,   ও অগতির গতি,
 ও অনাথের নাথ,   ও পতিতের পতি।
 ও নয়নের আলো,   ও রসনার মধু,
 ও রতনের হার,   ও পরানের বঁধু।
 ও অপরূপ রূপ,   ও মনোহর কথা,
 ও চরমের সুখ,   ও মরমের ব্যথা।
 ও ভিখারির ধন,   ও অবোলার বোল—
 ও জনমের দোলা,   ও মরণের কোল॥
    
৭১
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 আমার মাঝে তোমারি মায়া জাগালে তুমি কবি।
 আপন-মনে আমারি পটে আঁকো মানস ছবি॥
 তাপস তুমি ধেয়ানে তব   কী দেখ মোরে কেমনে কব,
 আপন-মনে মেঘস্বপন আপনি রচ রবি।
 তোমার জটে আমি তোমারি ভাবের জাহ্নবী।
 তোমারি সোনা বোঝাই হল, আমি তো তার ভেলা—
 নিজেরে তুমি ভোলাবে ব’লে আমারে নিয়ে খেলা।
 কণ্ঠে মম কী কথা শোন   অর্থ আমি বুঝি না কোনো,
 বীণাতে মোর কাঁদিয়া ওঠে তোমারি ভৈরবী।
 মুকুল মম সুবাসে তব গোপনে সৌরভী॥
    
৭২
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 ভুলে যাই   থেকে থেকে
 তোমার   আসন-’পরে বসাতে চাও   নাম আমাদের হেঁকে হেঁকে॥
 দ্বারী মোদের চেনে না যে,   বাধা দেয় পথের মাঝে।
 বাহিরে  দাঁড়িয়ে আছি,   লও ভিতরে ডেকে ডেকে॥
 মোদের  প্রাণ দিয়েছ আপন হাতে, মান দিয়েছ তারি সাথে।
 থেকেও সে মান  থাকে না যে লোভে আর  ভয়ে লাজে—
 ম্লান হয় দিনে দিনে,   যায় ধুলাতে  ঢেকে ঢেকে॥
    
৭৩
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 তোমার   এই মাধুরী ছাপিয়ে আকাশ ঝরবে,
 আমার   প্রাণে নইলে সে কি কোথাও ধরবে?।
 এই-যে আলো সূর্যে গ্রহে তারায়   ঝ’রে পড়ে শতলক্ষ ধারায়,
 পূর্ণ হবে এ প্রাণ যখন ভরবে॥
 তোমার   ফুলে যে রঙ ঘুমের মতো লাগল
 আমার   মনে লেগে তবে সে যে জাগল গো।
 যে প্রেম কাঁপায় বিশ্ববীণায় পুলকে  সঙ্গীতে সে উঠবে হেসে পলকে
 যে দিন আমার সকল হৃদয় হরবে॥
    
৭৪
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 এরে  ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে,
   হাসিতে আকাশ ভরিলে॥
 পথে পথে ফেরে, দ্বারে দ্বারে যায়,  ঝুলি ভরি রাখে যাহা-কিছু পায়—
 কতবার তুমি পথে এসে, হায়,   ভিক্ষার ধন হরিলে॥
 ভেবেছিল চির-কাঙাল সে এই ভুবনে,   কাঙাল মরণে জীবনে।
 ওগো মহারাজা, বড়ো ভয়ে ভয়ে   দিনেশষে এল তোমারি আলয়ে—
 আধেক আসনে তারে ডেকে লয়ে  নিজ মালা দিয়ে বরিলে॥
    
৭৫
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।
 এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা॥
 কত জনম-মরণেতে  তোমারি ওই চরণেতে
 আপনাকে যে দেব, তবু   বাড়বে দেনা॥
 আমারে যে নামতে হবে   ঘাটে ঘাটে,
 বারে বারে এই ভুবনের   প্রাণের হাটে।
 ব্যবসা মোর তোমার সাথে  চলবে বেড়ে দিনে রাতে,
 আপনা নিয়ে করব যতই   বেচা কেনা॥
  
    
৭৬
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 তুমি যে  এসেছ মোর ভবনে  রব উঠেছে ভুবনে॥
 নহিলে ফুলে কিসের রঙ লেগেছে,   গগনে কোন্‌ গান জেগেছে,
 কোন্‌ পরিমল পবনে॥
 দিয়ে  দুঃখসুখের বেদনা  আমায় তোমার সাধনা।
 আমার  ব্যথায় ব্যথায় পা ফেলিয়া   এলে তোমার সুর মেলিয়া,
 এলে আমার জীবনে॥
    
৭৭
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 তুমি যে   চেয়ে আছ   আকাশ ভ’রে
 নিশিদিন   অনিমেষে   দেখছ মোরে॥
 আমি চোখ   এই আলোকে   মেলব যবে
 তোমার ওই   চেয়ে-দেখা   সফল হবে,
 এ আকাশ   দিন গুনিছে   তারি তরে॥
 ফাগুনের   কুসুম-ফোটা   হবে ফাঁকি
 আমার এই   একটি কুঁড়ি   রইলে বাকি।
 সে দিনে   ধন্য হবে   তারার মালা
 তোমার এই   লোকে লোকে   প্রদীপ জ্বালা
 আমার এই   আঁধারটুকু   ঘুচলে পরে॥
  
    
৭৮
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 আমার বাণী আমার প্রাণে লাগে—
 যত তোমায় ডাকি, আমার   আপন হৃদয় জাগে॥
 শুধু তোমায় চাওয়া   সেও আমার পাওয়া,
 তাই তো পরান পরানপণে হাত বাড়িয়ে মাগে॥
 হায় অশক্ত, ভয়ে থাকিস পিছে।
 লাগলে সেবায় অশক্তি তোর   আপনি হবে মিছে।
 পথ দেখাবার তরে যাব কাহার ঘরে—
 যেমনি আমি চলি, তোমার   প্রদীপ চলে আগে॥
    
৭৯
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 অসীম ধন তো আছে তোমার, তাহে সাধ না মেটে।
 নিতে চাও তা আমার হাতে কণায় কণায় বেঁটে॥
 নিয়ে রতন মণি, দিয়ে     তোমার রতন মণি     আমায় করলে ধনী—
 এখন দ্বারে এসে ডাকো,     রয়েছি দ্বার এঁটে॥
 আমায় তুমি করবে দাতা, আপনি ভিক্ষু হবে—
 বিশ্বভুবন মাতাল যে তাই হাসির কলরবে।
 তুমি রইবে না ওই রথে, তুমি    রইবে না ওই রথে নামবে ধুলাপথে—
 যুগ-যুগান্ত আমার সাথে চলবে হেঁটে হেঁটে॥
  
    
৮০
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 যদি   আমায় তুমি বাঁচাও, তবে
 তোমার   নিখিল ভুবন ধন্য হবে॥
 যদি   আমার মনের মলিন কালী   ঘুচাও পুণ্যসলিল ঢালি
 তোমার   চন্দ্র সূর্য নূতন আলোয়   জাগবে জ্যোতির মহোৎসবে॥
 আজও   ফোটে নি মোর শোভার কুঁড়ি,
 তারি   বিষাদ আছে জগৎ জুড়ি।
 যদি   নিশার তিমির গিয়া টুটে   আমার হৃদয় জেগে উঠে
 তবে   মুখর হবে সকল আকাশ   আনন্দময় গানের রবে॥
  
    
৮১
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 যিনি   সকল কাজের কাজী, মোরা তাঁরি কাজের সঙ্গী।
 যাঁর   নানা রঙের রঙ্গ, মোরা তাঁরি রসের রঙ্গী॥
  তাঁর বিপুল ছন্দে ছন্দে
  মোরা যাই চলে আনন্দে,
 তিনি   যেমনি বাজান ভেরী মোদের তেমনি নাচের ভঙ্গী॥
  এই  জন্ম-মরণ-খেলায়
  মোরা মিলি তাঁরি মেলায়,
 এই   দুঃখসুখের জীবন মোদের তাঁরি খেলার অঙ্গী।
  ওরে  ডাকেন তিনি যবে
  তাঁর  জলদ-মন্দ্র রবে
 ছুটি   পথের কাঁটা পায়ে দ’লে সাগর গিরি লঙ্ঘি॥
  
    
৮২
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 আমরা    তারেই জানি তারেই জানি সাথের সাথি,
    তারেই করি টানাটানি দিবারাতি॥
       সঙ্গে তারি চরাই ধেনু,
          বাজাই বেণু,
    তারি লাগি বটের ছায়ায় আসন পাতি॥
       তারে হালের মাঝি করি
          চালাই তরী,
    ঝড়ের বেলায় ঢেউয়ের খেলায় মাতামাতি।
       সারা দিনের কাজ ফুরালে
          সন্ধ্যাকালে
    তাহারি পথ চেয়ে ঘরে জ্বালাই বাতি॥
    
৮৩
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
     যা হবার তা হবে।
     যে আমারে কাঁদায় সে কি অমনি ছেড়ে রবে?।
 পথ হতে যে ভুলিয়ে আনে     পথ যে কোথায় সেই তা জানে,
     ঘর যে ছাড়ায় হাত সে বাড়ায়— সেই তো ঘরে লবে॥
    
৮৪
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 অন্ধকারের মাঝে আমায় ধরেছ দুই হাতে।
 কখন্‌ তুমি এলে, হে নাথ, মৃদু চরণপাতে?।
 ভেবেছিলেম, জীবনস্বামী,   তোমায় বুঝি হারাই আমি—
 আমায় তুমি হারাবে না বুঝেছি আজ রাতে॥
 যে নিশীথে আপন হাতে নিবিয়ে দিলেম আলো
 তারি মাঝে তুমি তোমার ধ্রুবতারা জ্বালো।
 তোমার পথে চলা যখন   ঘুচে গেল দেখি তখন
 আপনি তুমি আমার পথে লুকিয়ে চল সাথে॥
    
৮৫
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ
 কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান?।
 আমার নয়নে তোমার বিশ্বছবি
 দেখিয়া লইতে সাধ যায় তব কবি,
 আমার মুগ্ধ শ্রবণে নীরব রহি
   শুনিয়া লইতে চাহ আপনার গান॥
 আমার চিত্তে তোমার সৃষ্টিখানি
 রচিয়া তুলিছে বিচিত্র তব বাণী।
 তারি সাথে, প্রভু, মিলিয়া তোমার প্রীতি
 জাগায়ে তুলিছে আমার সকল গীতি—
 আপনারে তুমি দেখিছ মধুর রসে
   আমার মাঝারে নিজেরে করিয়া দান॥
    
৮৬
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 শুধু কি   তার বেঁধেই তোর কাজ ফুরাবে
 গুণী মোর, ও গুণী!
 বাঁধা বীণা রইবে পড়ে এমনি ভাবে,
 গুণী মোর, ও গুণী!
 তা হলে   হার হল যে হার হল,
 শুধু   বাঁধাবাঁধিই সার হল, গুণী মোর, ও গুণী!
 বাঁধনে   যদি তোমার হাত লাগে
  তা হলেই সুর জাগে, গুণী মোর, ও গুণী!
 না হলে   ধুলায় পড়ে লাজ কুড়াবে॥
  
    
৮৭
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 আমারে তুমি কিসের ছলে পাঠাবে দূরে,
 আবার আমি চরণতলে আসিব ঘুরে॥
 সোহাগ করে করিছ হেলা     টানিবে ব’লে দিতেছ ঠেলা—
 হে রাজা, তব কেমন খেলা রাজ্য জুড়ে॥
  
    
৮৮
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 সভায় তোমার থাকি সবার শাসনে,
 আমার   কণ্ঠে সেথায় সুর কেঁপে যায় ত্রাসনে॥
 তাকায় সকল লোকে,
 তখন   দেখতে না পাই চোখে
 কোথায়   অভয় হাসি হাসো আপন আসনে॥
 কবে আমার এ লজ্জাভয় খসাবে,
 তোমার   একলা ঘরের নিরালাতে বসাবে।
 যা শোনাবার আছে
 গাব   ওই চরণের কাছে,
 দ্বারের   আড়াল হতে শোনে বা কেউ না-শোনে॥
    
৮৯
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 তোমার প্রেমে ধন্য কর যারে   সত্য ক’রে পায় সে আপনারে॥
 দুঃখে শোকে নিন্দা-পরিবাদে
 চিত্ত তার ডোবে না অবসাদে,
   টুটে না বল সংসারের ভারে॥
 পথে যে তার গৃহের বাণী বাজে,   বিরাম জাগে কঠিন তার কাজে।
 নিজেরে সে যে তোমারি মাঝে দেখে,
 জীবন তার বাধায় নাহি ঠেকে,
   দৃষ্টি তার আঁধার-পরপারে॥
    
৯০
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 লুকিয়ে আস আঁধার রাতে, তুমি আমার বন্ধু!
 লও যে টেনে কঠিন হাতে, তুমি আমার আনন্দ॥
 দুঃখরথের তুমিই রথী, তুমিই আমার বন্ধু।
 তুমি সঙ্কট তুমিই ক্ষতি, তুমিই আমার আনন্দ॥
 শত্রু আমারে করো গো জয়, তুমিই আমার বন্ধু।
 রুদ্র তুমি হে ভয়ের ভয়, তুমি আমার আনন্দ॥
 বজ্র এসো হে বক্ষ চিরে, তুমিই আমার বন্ধু।
 মৃত্যু লও হে বাঁধন ছিঁড়ে, তুমি আমার আনন্দ॥
  
    
৯১
পূজা - বন্ধু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  
 তুমি কি এসেছ মোর দ্বারে
 খুঁজিতে আমার আপনারে?।
 তোমারি যে ডাকে
 কুসুম গোপন হতে বাহিরায় নগ্ন শাখে শাখে,
 সেই ডাকে ডাকো আজি তারে॥
 তোমারি সে ডাকে বাধা ভোলে,
 শ্যামল গোপন প্রাণ ধূলি-অবগুণ্ঠন খোলে
 সে ডাকে তোমারি
 সহসা নবীন ঊষা আসে হাতে আলোকের ঝারি,
 দেয় সাড়া ঘন অন্ধকারে॥