Generated on: Fri Dec 19 2014

Home

::

Show All

::

Show Current

::

Scroll TOC Up| Down

Send a Comment

৯২
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      আলোকের  এই ঝর্ণাধারায়  ধুইয়ে  দাও।
             আপনাকে  এই লুকিয়ে-রাখা  ধুলার ঢাকা ধুইয়ে  দাও॥
     যে জন   আমার  জড়িয়ে আছে  ঘুমের জালে
     আজ     এই  সকালে ধীরে ধীরে তার  কপালে
     এই      অরুণ-আলোর  সোনার-কাঠি  ছুঁইয়ে  দাও।
            বিশ্বহৃদয়-হতে-ধাওয়া  আলোয়-পাগল প্রভাত-হাওয়া,
             সেই  হাওয়াতে হৃদয়  আমার নুইয়ে  দাও॥
     আজ      নিখিলের আনন্দধারায়  ধুইয়ে  দাও,
             মনের  কোণের সব  দীনতা মলিনতা  ধুইয়ে  দাও।
     আমার    পরান-বীণায় ঘুমিয়ে  আছে অমৃতগান—
     তার     নাইকো  বাণী,  নাইকো ছন্দ, নাইকো  তান।
     তারে     আনন্দের এই জাগরণী ছুঁইয়ে  দাও।
            বিশ্বহৃদয়-হতে-ধাওয়া   প্রাণে-পাগল  গানের হাওয়া,
            সেই  হাওয়াতে হৃদয়  আমার নুইয়ে  দাও॥
                       
    
৯৩
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এ   অন্ধকার  ডুবাও তোমার  অতল অন্ধকারে
              ওহে     অন্ধকারের  স্বামী।
        এসো  নিবিড়, এসো  গভীর,  এসো  জীবন-পারে
              আমার   চিত্তে এসো নামি।
        এ দেহ  মন মিলায়ে  যাক, হইয়া  যাক হারা
              ওহে     অন্ধকারের  স্বামী।
        বাসনা  মোর,  বিকৃতি  মোর, আমার  ইচ্ছাধারা
              ওই     চরণে  যাক থামি।
        নির্বাসনে  বাঁধা  আছি  দুর্বাসনার  ডোরে
              ওহে     অন্ধকারের  স্বামী।
        সব  বাঁধনে তোমার  সাথে বন্দী  করো মোরে
              ওহে    আমি  বাঁধন-কামী।
        আমার  প্রিয়,  আমার শ্রেয়, আমার  হে পরম,
              ওহে    অন্ধকারের  স্বামী,
        সকল ঝরে সকল  ভরে আসুক সে  চরম—
              ওগো,   মরুক-না এই  আমি॥
  
    
৯৪
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
          ধায়  যেন মোর সকল  ভালোবাসা
   প্রভু,     তোমার পানে, তোমার  পানে,  তোমার পানে।
          যায়  যেন মোর সকল  গভীর আশা
   প্রভু,     তোমার কানে, তোমার  কানে,  তোমার  কানে॥
          চিত্ত  মম যখন যেথা  থাকে    সাড়া যেন দেয়  সে তব ডাকে,
          যত  বাঁধন সব টুটে  গো যেন
   প্রভু,     তোমার টানে, তোমার  টানে,  তোমার  টানে॥
          বাহিরের  এই ভিক্ষা-ভরা  থালি    এবার যেন নিঃশেষে  হয় খালি,
          অন্তর  মোর গোপনে যায়  ভরে
   প্রভু,     তোমার দানে, তোমার  দানে,  তোমার দানে।
          হে  বন্ধু মোর, হে অন্তরতর,   এ  জীবনে যা-কিছু  সুন্দর
          সকলই  আজ বেজে উঠুক  সুরে
   প্রভু,     তোমার গানে, তোমার  গানে,  তোমার  গানে॥
  
    
৯৫
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   জীবন  যখন শুকায়ে  যায় করুণাধারায়  এসো।
          সকল  মধুরী লুকায়ে  যায়,   গীতসুধারসে এসো॥
      কর্ম  যখন  প্রবল-আকার   গরজি  উঠিয়া ঢাকে চারিধার
          হৃদয়প্রান্তে, হে জীবননাথ,   শান্ত  চরণে এসো॥
      আপনারে  যবে করিয়া  কৃপণ   কোণে পড়ে  থাকে দীনহীন  মন
          দুয়ার  খুলিয়া,  হে উদার নাথ, রাজসমারোহে এসো।
      বাসনা  যখন বিপুল  ধুলায়    অন্ধ করিয়া অবোধে  ভুলায়,
          ওহে  পবিত্র,  ওহে অনিদ্র, রুদ্র  আলোকে এসো॥
  
    
৯৬
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার    পাত্রখানা  যায় যদি যাক ভেঙেচুরে—
     আছে   অঞ্জলি  মোর, প্রসাদ  দিয়ে দাও-না  পূরে॥
             সহজ  সুখের সুধা  তাহার মূল্য  তো নাই,
             ছড়াছড়ি  যায় সে-যে  ওই যেখানে চাই—
             বড়ো-আপন  কাছের জিনিস রইল দূরে।
             হৃদয়  আমার সহজ  সুধায় দাও-না  পূরে॥
     বারে বারে চাইব  না আর মিথ্যা  টানে
     ভাঙন-ধরা  আঁধার-করা  পিছন-পানে।
         বাসা  বাঁধার বাঁধনখানা  যাক-না  টুটে,
         অবাধ  পথের শূন্যে  আমি চলব ছুটে।
             শূন্য-ভরা  তোমার বাঁশির  সুরে সুরে
              হৃদয়  আমার সহজ  সুধায় দাও-না  পূরে॥
  
   
    
৯৭
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
         গাব  তোমার সুরে   দাও সে বীণাযন্ত্র,
         শুনব  তোমার বাণী   দাও সে  অমর মন্ত্র।
         করব  তোমার সেবা   দাও সে  পরম শক্তি,
         চাইব  তোমার মুখে   দাও সে  অচল ভক্তি॥
         সইব  তোমার আঘাত  দাও সে  বিপুল ধৈর্য,
         বইব  তোমার ধ্বজা    দাও সে  অটল  স্থৈর্য॥
         নেব  সকল বিশ্ব     দাও সে  প্রবল প্রাণ,
         করব  আমায় নিঃস্ব   দাও সে  প্রেমের  দান॥
         যাব  তোমার সাথে    দাও সে  দখিন হস্ত,
         লড়ব  তোমার রণে   দাও সে  তোমার  অস্ত্র॥
         জাগব  তোমার সত্যে  দাও সেই  আহবান।
         ছাড়ব  সুখের দাস্য,   দাও  দাও  কল্যাণ॥
  
    
৯৮
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শ্রাবণের     ধারার মতো পড়ুক ঝরে,  পড়ুক ঝরে
     তোমারি     সুরটি  আমার মুখের ’পরে, বুকের ’পরে॥
     পুরবের     আলোর  সাথে পড়ুক  প্রাতে দুই নয়ানে—
     নিশীথের      অন্ধকারে  গভীর ধারে  পড়ুক প্রাণে।
     নিশিদিন     এই  জীবনের সুখের ’পরে, দুখের ’পরে
     শ্রাবণের     ধারার মতো পড়ুক ঝরে,  পড়ুক ঝরে॥
     যে  শাখায়     ফুল ফোটে  না, ফল  ধরে না  একেবারে,
     তোমার  ওই    বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে  সেই শাখারে।
     যা-কিছু      জীর্ণ  আমার,  দীর্ণ আমার, জীবনহারা,
     তাহারি       স্তরে স্তরে  পড়ুক ঝরে  সুরের ধারা।
     নিশিদিন      এই  জীবনের তৃষার ’পরে, ভুখের ’পরে
     শ্রাবণের      ধারার মতো পড়ুক ঝরে,  পড়ুক ঝরে॥
  
    
৯৯
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                বাজাও  আমারে বাজাও।
       বাজালে  যে সুরে  প্রভাত-আলোরে  সেই সুরে মোরে  বাজাও॥
       যে সুর ভরিলে ভাষাভোলা  গীতে    শিশুর নবীন জীবনবাঁশিতে
            জননীর-মুখ-তাকানো  হাসিতে—  সেই সুরে  মোরে বাজাও॥
                সাজাও  আমারে সাজাও।
            যে  সাজে সাজালে  ধরার ধূলিরে  সেই সাজে মোরে  সাজাও।
       সন্ধ্যামালতী  সাজে যে  ছন্দে    শুধু আপনারই  গোপন গন্ধে,
            যে সাজ নিজেরে ভোলে  আনন্দে—  সেই সাজে  মোরে সাজাও॥
  
  
    
১০০
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তুমি  যত ভার দিয়েছ  সে ভার    করিয়া দিয়েছ  সোজা।
      আমি যত  ভার জমিয়ে  তুলেছি    সকলই হয়েছে বোঝা।
         এ বোঝা  আমার নামাও  বন্ধু,  নামাও—
      ভারের বেগেতে  চলেছি কোথায়,   এ  যাত্রা তুমি  থামাও॥
      আপনি  যে দুখ  ডেকে আনি সে-যে    জ্বালায় বজ্রানলে—
      অঙ্গার  ক’রে  রেখে যায়, সেথা   কোনো ফল  নাহি ফলে।
         তুমি  যাহা দাও সে-যে দুঃখের  দান
         শ্রাবণধারায়  বেদনার রসে   সার্থক  করে প্রাণ।
      যেখানে  যা-কিছু  পেযেছি কেবলই   সকলই  করেছি জমা—
      যে  দেখে সে আজ  মাগে-যে  হিসাব,   কেহ  নাহি করে  ক্ষমা।
         এ বোঝা  আমার নামাও  বন্ধু নামাও—
      ভারের বেগেতে  ঠেলিয়া চলেছি,   এ  যাত্রা মোর  থামাও॥
    
১০১
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        দাঁড়াও  আমার আঁখির  আগে।
               তোমার  দৃষ্টি হৃদয়ে  লাগে॥
   সমুখ-আকাশে চরাচরলোকে  এই  অপরূপ আকুল  আলোকে দাঁড়াও  হে,
     আমার  পরান পলকে পলকে  চোখে চোখে তব  দরশ মাগে॥
       এই-যে  ধরণী চেয়ে ব’সে  আছে   ইহার মাধুরী  বাড়াও হে।
          ধুলায়  বিছানো  শ্যাম  অঞ্চলে   দাঁড়াও হে  নাথ, দাঁড়াও  হে।
   যাহা-কিছু  আছে সকলই ঝাঁপিয়া, ভুবন ছাপিয়া, জীবন ব্যাপিয়া  দাঁড়াও হে।
     দাঁড়াও  যেখানে বিরহী  এ হিয়া  তোমারি  লাগিয়া একেলা  জাগে॥
    
১০২
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     যদি এ  আমার হৃদয়দুয়ার  বন্ধ রহে গো কভু
     দ্বার  ভেঙে তুমি এসো  মোর প্রাণে,   ফিরিয়া  যেয়ো না প্রভু॥
   যদি  কোনো দিন এ  বীণার তারে   তব  প্রিয় নাম নাহি ঝঙ্কারে
     দয়া  করে তবু রহিয়ো  দাঁড়ায়ে,  ফিরিয়া  যেয়ো না  প্রভু॥
   যদি  কোনো দিন  তোমার  আহ্বানে   সুপ্তি  আমার চেতনা না  মানে
     বজ্রবেদনে জাগায়ো  আমারে,   ফিরিয়া  যেয়ো না  প্রভু।
   যদি  কোনো দিন  তোমার আসনে  আর-কাহারেও  বসাই যতনে,
     চিরদিবসের  হে রাজা আমার,  ফিরিয়া  যেয়ো না  প্রভু॥
    
১০৩
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমারি  রাগিণী জীবনকুঞ্জে   বাজে  যেন সদা বাজে  গো।
     তোমারি  আসন  হৃদয়পদ্মে   রাজে  যেন সদা রাজে  গো॥
     তব নন্দনগন্ধমোদিত   ফিরি  সুন্দর ভুবনে
     তব পদরেণু  মাখি লয়ে  তনু    সাজে যেন সদা  সাজে গো॥
     সব  বিদ্বেষ দূরে  যায় যেন তব মঙ্গলমন্ত্রে ,
     বিকাশে  মাধুরী হৃদয়ে  বাহিরে তব সঙ্গীতছন্দে।
     তব  নির্মল নীরব  হাস্য   হেরি  অম্বর ব্যাপিয়া
     তব  গৌরবে সকল  গর্ব লাজে যেন  সদা লাজে গো॥
    
১০৪
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চরণ  ধরিতে দিয়ো  গো আমারে,   নিয়ো না, নিয়ো  না সরায়ে—
      জীবন মরণ সুখ দুখ দিয়ে   বক্ষে  ধরিব জড়ায়ে॥
   স্থলিত  শিথিল কামনার  ভার   বহিয়া বহিয়া  ফিরি কত  আর—
      নিজ  হাতে তুমি গেঁথে  নিয়ো হার,   ফেলো  না আমারে ছড়ায়ে॥
      চিরপিপাসিত  বাসনা বেদনা   বাঁচাও  তাহারে  মারিয়া।
      শেষ  জয়ে যেন হয় সে  বিজয়ী   তোমারি কাছেতে হারিয়া।
   বিকায়ে বিকায়ে  দীন আপনারে   পারিনা  ফিরিতে দুয়ারে দুয়ারে—
      তোমারি  করিয়া নিয়ো  গো আমারে   বরণের  মালা পরায়ে॥
  
        
    
১০৫
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
            তোমারি  নাম বলব নানা  ছলে,
         বলব  একা বসে আপন  মনের ছায়াতলে॥
         বলব  বিনা ভাষায়,   বলব  বিনা আশায়,
         বলব  মুখের হাসি  দিয়ে,   বলব  চোখের জলে॥
         বিনা  প্রয়োজনের  ডাকে    ডাকব তোমার  নাম,
         সেই  ডাকে মোর শুধু-শুধুই   পূরবে  মনস্কাম।
         শিশু  যেমন মাকে   নামের  নেশায় ডাকে,
         বলতে  পারে এই সুখেতেই   মায়ের  নাম সে বলে॥
    
১০৬
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার এ  ঘরে আপনার  করে   গৃহদীপখানি  জ্বালো হে।
     সব দুখশোক  সার্থক হোক    লভিয়া  তোমারি  আলো হে॥
     কোণে কোণে যত লুকানো  আঁধার    মিলাবে ধন্য  হয়ে,
     তোমারি পুণ্য-আলোকে  বসিয়া   সবারে  বাসিব ভালো  হে॥
     পরশমণির  প্রদীপ তোমার,   অচপল  তার জ্যোতি
     সোনা ক’রে লবে  পলকে আমার   সকল  কলঙ্ক কালো।
     আমি যত  দীপ জ্বালিয়াছি  তাহে    শুধু জ্বালা, শুধু  কালী—
     আমার  ঘরের দুয়ার  শিয়রে   তোমারি  কিরণ ঢালো  হে॥
    
১০৭
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        সংসারে  তুমি রাখিলে  মোরে যে ঘরে
              সেই  ঘরে রব সকল দুঃখ ভুলিয়া।
          করুণা  করিয়া  নিশিদিন নিজ  করে
              রাখিয়ো  তাহার  একটি দুয়ার  খুলিয়া॥
          মোর  সব কাজে মোর  সব অবসরে
          সে দুয়ার রবে তোমারি  প্রবেশ-তরে,
          সেথা  হতে বায়ু বহিবে  হৃদয়’পরে
              চরণ  হইতে তব পদধূলি  তুলিয়া॥
          যত  আশ্রয় ভেঙে ভেঙে যায়, স্বামী,
              এক  আশ্রয়ে রহে  যেন চিত  লাগিয়া।
          যে অনলতাপ  যখনি সহিব আমি
              এক  নাম বুকে বার বার দেয় দাগিয়া।
          যবে  দুখদিনে শোকতাপ  আসে প্রাণে
          তোমারি  আদেশ বহিয়া  যেন সে আনে,
          পরুষ  বচন যতই আঘাত  হানে
              সকল  আঘাতে তব সুর  উঠে জাগিয়া॥
    
১০৮
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার  মুখের কথা  তোমার    নাম দিয়ে দাও  ধুয়ে,
        আমার নীরবতায়  তোমার    নামটি রাখো  থুয়ে।
        রক্তধারার  ছন্দে আমার   দেহবীণার  তার
        বাজাক  আনন্দে  তোমার    নামেরই  ঝঙ্কার।
        ঘুমের ’পরে জেগে  থাকুক    নামের তারা  তব,
        জাগরণের  ভালে আঁকুক   অরুণলেখা  নব।
        সব  আকাঙক্ষা  আশায় তোমার   নামটি জ্বলুক শিখা,
        সকল  ভালোবাসায়  তোমার    নামটি রহুক  লিখা।
        সকল  কাজের শেষে  তোমার    নামটি উঠুক ফ’লে
        রাখব কেঁদে হেসে  তোমার    নামটি বুকে  কোলে।
        জীবনপদ্মে  সঙ্গোপনে   রবে  নামের মধু,
        তোমায়  দিব মরণ-ক্ষণে   তোমারি  নাম বঁধু॥
    
১০৯
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
          প্রাণ  ভরিয়ে  তৃষা হরিয়ে
         মোরে   আরো আরো  আরো দাও  প্রাণ।
               তব  ভুবনে তব ভবনে
         মোরে   আরো আরো  আরো দাও  স্থান॥
               আরো  আলো আরো আলো
         এই    নয়নে, প্রভু, ঢালো।
               সুরে  সুরে বাঁশি  পূরে
         তুমি   আরো আরো  আরো দাও  তান॥
               আরো  বেদনা আরো  বেদনা
         প্রভু,   দাও  মোরে আরো  চেতনা।
               দ্বার  ছুটায়ে  বাধা টুটায়ে
         মোরে   করো  ত্রাণ মোরে  করো ত্রাণ।
               আরো  প্রেমে আরো  প্রেমে
         মোর   আমি  ডুবে যাক  নেমে।
               সুধাধারে  আপনারে
         তুমি   আরো আরো  আরো করো  দান॥
  
    
১১০
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বল দাও মোরে বল দাও,   প্রাণে দাও মোর শকতি
        সকল হৃদয় লুটায়ে   তোমারে করিতে প্রণতি—
        সরল সুপথে ভ্রমিতে,   সব অপকার ক্ষমিতে,
        সকল গর্ব দমিতে   খর্ব করিতে কুমতি॥
        হৃদয়ে তোমারে বুঝিতে,   জীবনে তোমারে পূজিতে,
        তোমার মাঝারে খুঁজিতে   চিত্তের চিরবসতি
        তব কাজ শিরে বহিতে,   সংসারতাপ সহিতে,
        ভবকোলাহলে রহিতে,   নীরবে করিতে ভকতি॥
        তোমার বিশ্বছবিতে   তব প্রেমরূপ লভিতে,
        গ্রহ-তারা-শশী-রবিতে   হেরিতে তোমার আরতি।
        বচনমনের অতীতে   ডুবিতে তোমার জ্যোতিতে,
        সুখে দুখে লাভে ক্ষতিতে   শুনিতে তোমার ভারতী॥
    
    
১১১
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে—
 নির্মল করো, ঊজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে॥
 জাগ্রত করো, উদ্যত করো, নির্ভয় করো হে।
 মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে॥
 যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ।
 সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ।
 চরণপদ্মে মম চিত নিস্পন্দিত করো হে।
 নন্দিত করো, নন্দিত করো, নন্দিত করো হে॥
    
১১২
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

      আমার বিচার তুমি করো তব   আপন করে।
      দিনের কর্ম আনিনু তোমার    বিচারঘরে॥
      যদি পূজা করি মিছা দেবতার,   শিরে ধরি যদি মিথ্যা আচার,
      যদি পাপমনে করি অবিচার   কাহারো ’পরে,
      আমার বিচার তুমি করো তব   আপন করে॥
      লোভে যদি কারে দিয়ে থাকি দুখ,   ভয়ে হয়ে থাকি ধর্মবিমুখ,
      পরের পীড়ায় পেয়ে থাকি সুখ   ক্ষণেক-তরে—
      তুমি যে জীবন দিয়েছ আমায়   কলঙ্ক যদি দিয়ে থাকি তায়,
      আপনি বিনাশ করি আপনায়   মোহের ভরে,
      আমার বিচার তুমি করো তব   আপন করে॥
    
১১৩
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমারি ইচ্ছা হউক পূর্ণ করুণাময় স্বামী।
       তোমারি প্রেম স্মরণে রাখি, চরণে রাখি আশা—
       দাও দুঃখ, দাও তাপ, সকলই সহিব আমি॥
       তব প্রেম-আঁখি সতত জাগে, জেনেও না জানি।
       ওই   মঙ্গলরূপ ভুলি, তাই শোকসাগরে নামি॥
       আনন্দময় তোমার বিশ্ব শোভাসুখপূর্ণ,
       আমি   আপন দোষে দুঃখ পাই বাসনা-অনুগামী॥
       মোহবন্ধ ছিন্ন করো কঠিন আঘাতে,
       অশ্রুসলিলধৌত হৃদয়ে থাকো দিবসযামী॥
    
১১৪
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                      

       অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ—
       তুমি করুণামৃতসিন্ধু করো করুণাকণা দান॥
          শুষ্ক হৃদয় মম   কঠিন পাষাণসম,
       প্রেমসলিলধারে সিঞ্চহ শুষ্ক নয়ান॥
       যে তোমারে ডাকে না হে তারে তুমি ডাকো-ডাকো।
       তোমা হতে দূরে যে যায় তারে তুমি রাখো রাখো।
          তৃষিত যেজন ফিরে   তব সুধাসাগরতীরে
       জুড়াও তাহারে স্নেহনীরে,  সুধা করাও হে পান॥
       তোমারে পেয়েছিনু যে,  কখন্‌ হারানু অবহেলে,
       কখন্‌ ঘুমাইনু হে, আঁধার হেরি আঁখি মেলে।
          বিরহ জানাইব কায়, সান্ত্বনা কে দিবে হায়,
       বরষ বরষ চলে যায়, হেরি নি প্রেমবয়ান—
       দরশন দাও হে, দাও হে দাও, কাঁদে হৃদয় ম্রিয়মাণ॥
  
    
১১৫
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

     হে মহাজীবন, হে মহামরণ,   লইনু শরণ, লইনু শরণ॥
               আঁধার প্রদীপে জ্বালাও শিখা,
        পরাও পরাও জ্যোতির টিকা— করো হে আমার লজ্জাহরণ॥
     পরশরতন তোমারি চরণ— লইনু শরণ, লইনু শরণ।
                যা-কিছু মলিন, যা- কিছু কালো,
        যা-কিছু বিরূপ হোক তা ভালো— ঘুচাও ঘুচাও সব আবরণ॥
    
১১৬
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

              পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে।
           পিছিয়ে পড়েছি আমি, যাব যে কী করে?।
           এসেছে নিবিড় নিশি,   পথরেখা গেছে মিশি—
           সাড়া দাও, সাড়া দাও আঁধারের ঘোরে॥
    ভয় হয়, পাছে ঘুরে ঘুরে   যত আমি যাই তত যাই চলে দূরে—
           মনে করি আছ কাছে   তবু ভয় হয়, পাছে          আমি আছি তুমি নাই কালি নিশিভোরে॥
    
    
১১৭
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া   নিত্য কল্যাণ-কাজে হে।
       ফিরিব আহ্বান মানিয়া   তোমারি রাজ্যের মাঝে হে॥
       মজিয়া অনুখন লালসে  রব না পড়িয়া আলসে,
       হয়েছে জর্জর জীবন   ব্যর্থ দিবসের লাজে হে॥
       আমারে রহে যেন না ঘিরি   সতত বহুতর সংশয়ে,
       বিবিধ পথে যেন না ফিরি    বহুল-সংগ্রহ-আশয়ে।
       অনেক নৃপতির শাসনে   না রহি শঙ্কিত আসনে,
       ফিরিব নির্ভয়গৌরবে   তোমারি ভৃত্যের সাজে হে॥
    
১১৮
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     ধনে জনে আছি জড়ায়ে হায়,
             তবু জানো মন তোমারে চায়॥
                অন্তরে আছ অন্তর্যামী,
                আমা চেয়ে আমায় জানিছ স্বামী—
                সব সুখে দুখে ভুলে থাকায়
                   জানো মম মন তোমারে চায়॥
          ছাড়িতে পারি নি অহঙ্কারে,
          ঘুরে মরি শিরে বহিয়া তারে,
          ছাড়িতে পারিলে বাঁচি যে হায়—
             তুমি জানো মন তোমারে চায়।
                 যা আছে আমার সকলই কবে
                 নিজ হাতে তুমি তুলিয়া লবে—
                 সব ছেড়ে সব পাব তোমায়।
                    মনে মনে মন তোমারে চায়॥
    
১১৯
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 তোমারি সেবক করো হে আজি হতে আমারে।
        চিত্ত-মাঝে দিবারাত   আদেশ তব দেহো নাথ,
             তোমার কর্মে রাখো বিশ্বদুয়ারে॥
          করো ছিন্ন মোহপাশ   সকল লুব্ধ আশ,
             লোকভয় দূর করি দাও দাও।
          রত রাখো কল্যাণে   নীরবে নিরভিমানে,
             মগ্ন করো আনন্দরসধারে॥
    
১২০
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তুমি   এবার আমায় লহো হে নাথ, লহো।
              এবার তুমি ফিরো না হে—
                  হৃদয় কেড়ে নিয়ে রহো॥
          যে দিন গেছে তোমা বিনা   তারে আর ফিরে চাহি না,
                  যাক সে ধুলাতে।
     এখন   তোমার আলোয় জীবন মেলে যেন জাগি অহরহ॥
          কী আবেশে কিসের কথায়   ফিরেছি হে যথায় তথায়
                  পথে প্রান্তরে,
     এবার   বুকের কাছে ও মুখ রেখে   তোমার  আপন বাণী কহো॥
          কত কলুষ কত ফাঁকি   এখনো যে আছে বাকি
                  মনের গোপনে,
          আমায়  তার লাগি আর ফিরায়ো না—
              তারে   আগুন দিয়ে দহো॥
    
১২১
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাই।
              সংসারে যা দিবে মানিব তাই,
                    হৃদয়ে তোমায় যেন পাই॥
              তব দয়া জাগিবে স্মরণে
              নিশিদিন জীবনে মরণে,
    দুঃখে সুখে সম্পদে বিপদে   তোমারি দয়া-পানে চাই—
                    তোমারি দয়া যেন পাই॥
    তব দয়া শান্তির নীরে  অন্তরে নামিবে ধীরে।
              তব দয়া মঙ্গল-আলো
              জীবন-আঁধারে জ্বালো—
    প্রেমভক্তি মম  সকল শক্তি মম   তোমারি দয়ারূপে পাই,
                    আমার বলে কিছু নাই।
    
১২২
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
             ভুবনেশ্বর হে,
           মোচন কর’ বন্ধন সব মোচন কর’ হে॥
               প্রভু মোচন কর’ ভয়,
               সব   দৈন্য করহ লয়,
           নিত্য চকিত চঞ্চল চিত কর’ নিঃসংশয়।
               তিমিররাত্রি,   অন্ধ যাত্রী,
           সমুখে তব দীপ্ত দীপ তুলিয়া ধর’ হে॥
                   ভুবনেশ্বর হে,
           মোচন কর’ জড়বিষাদ মোচন কর’ হে।
               প্রভু,   তব প্রসন্ন মুখ
               সব   দুঃখ করুক সুখ,
           ধূলিপতিত দুর্বল চিত করহ জাগরূক।
               তিমিররাত্রি, অন্ধ যাত্রী,
           সমুখে তব দীপ্ত দীপ তুলিয়া ধর’ হে॥
                   ভুবনেশ্বর হে,
           মোচন কর’ স্বার্থপাশ মোচন কর’ হে।
               প্রভু,   বিরস বিকল প্রাণ,
               কর   প্রেমসলিল দান,
           
ক্ষতিপীড়িত শঙ্কিত চিত কর’ সম্পদবান।
               তিমিররাত্রি,   অন্ধ  যাত্রী,
           সমুখে তব দীপ্ত দীপ তুলিয়া ধর’ হে॥
  
    
১২৩
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    আমার  সত্য মিথ্যা সকলই ভুলায়ে দাও,
              আমায়   আনন্দে ভাসাও॥
      না চাহি তর্ক  না চাহি যুক্তি,   না জানি বন্ধ না জানিমুক্তি,
     তোমার   বিশ্বব্যাপিনী ইচ্ছা আমার অন্তরে জাগাও॥
              সকল বিশ্ব ডুবিয়া যাক শান্তিপাথারে,
   
              সব সুখ দুখ থামিয়া যাক হৃদয়মাঝারে।
            সকল বাক্য সকল শব্দ   সকল চেষ্টা হউক স্তব্ধ—
     তোমার   চিত্তজয়িনী বাণী আমার অন্তরে শুনাও॥
  
    
১২৪
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভয় হতে তব অভয়মাঝে   নূতন জনম দাও হে॥
       দীনতা হতে অক্ষয় ধনে,   সংশয় হতে সত্যসদনে,
       জড়তা হতে নবীন জীবনে   নূতন জনম দাও হে॥
       আমার ইচ্ছা হইতে, প্রভু,   তোমার ইচ্ছামাঝে—
       আমার স্বার্থ হইতে, প্রভু,   তব মঙ্গলকাজে—
       অনেক হইতে একের ডোরে,   সুখদুখ হতে শান্তিক্রোড়ে—
       আমা হতে, নাথ, তোমাতে মোরে   নূতন জনম দাও হে॥
    
১২৫
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     পাদপ্রান্তে রাখ’ সেবকে,
              শান্তিসদন সাধনধন দেবদেব হে॥
          সর্বলোকপরমশরণ,   সকলমোহকলুষহরণ,
          দুঃখতাপবিঘ্নতরণ,    শোকশান্তস্নিগ্ধচরণ,
              সত্যরূপ প্রেমরূপ হে,
              দেবমনুজবন্দিতপদ বিশ্বভূপ হে॥
          হৃদয়ানন্দ পূর্ণ ইন্দু,   তুমি অপার প্রেমসিন্ধু।
          যাচে তৃষিত অমিয়বিন্দু,   করুণালয় ভক্তবন্ধু
              প্রেমনেত্রে চাহ’ সেবকে,
              বিকশিতদল চিত্তকমল হৃদয়দেব হে॥
          পুণ্যজ্যোতিপূর্ণগগন,   মধুর হেরি সকল ভুবন,
          সুধাগন্ধমুদিত পবন, ধ্বনিতগীত হৃদয়ভবন।
              এস’ এস’ শুন্য জীবনে,
              মিটাও আশ সব তিয়াষ অমৃতপ্লাবনে॥
          দেহ’ জ্ঞান, প্রেম দেহ’, শুষ্ক চিত্তে বরিষ স্নেহ।
          ধন্য হোক হৃদয় দেহ, পুণ্য হোক সকল গেহ।
              পাদপ্রান্তে রাখ’ সেবকে,
              শান্তিসদন সাধনধন দেবদেব হে॥
    
১২৬
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
          বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি।
              শুষ্ক হৃদয় লয়ে   আছে দাঁড়াইয়ে
                 ঊধর্বমুখে নরনারী॥
              না থাকে অন্ধকার,   না থাকে মোহপাপ,
                 না থাকে শোকপরিতাপ।
              হৃদয় বিমল হোক,   প্রাণ সবল হোক,
                 বিঘ্ন দাও অপসারি॥
              কেন এ হিংসাদ্বেষ,  কেন এ ছদ্মবেশ,
                 কেন এ মান-অভিমান।
              বিতর’ বিতর’ প্রেম   পাষাণহৃদয়ে,
                 জয় জয় হোক তোমারি॥
    
১২৭
পূজা - প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
         সার্থক কর’ সাধন,
        সান্ত্বন কর ধরিত্রীর বিরহাতুর কাঁদন
        প্রাণভরণ দৈন্যহরণ   অক্ষয়করুণাধন॥
               বিকশিতকর’ কলিকা,
        চম্পকবন করুক রচন নব কুসুমাঞ্জলিকা।
        কর’ সুন্দর গীতমুখর   নীরব আরাধন
               অক্ষয়করুণাধন॥
                চরণপরশহরষে
        লজ্জিত বনবীথিধূলি সজ্জিত তুমি কর’ সে।
                মোচন কর’ অন্তরতর
                  হিমজড়িমা-বাঁধন
                   অক্ষয়করুণাধন॥