Generated on: Fri Dec 19 2014

Home

::

Show All

::

Show Current

::

Scroll TOC Up| Down

Send a Comment

১২৮
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার মিলন লাগি তুমি   আসছ কবে থেকে!
       তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়  রাখবে কোথায় ঢেকে?।
       কত কালের সকাল-সাঁঝে  তোমার চরণধ্বনি বাজে,
       গোপনে দূত হৃদয়-মাঝে   গেছে আমায় ডেকে॥
       ওগো পথিক, আজকে আমার  সকল পরান ব্যেপে
       থেকে থেকে হরষে যেন   উঠছে কেঁপে কেঁপে।
       যেন সময় এসেছে আজ   ফুরালো মোর যা ছিল কাজ—
       বাতাস আসে, হে মহারাজ,  তোমার গন্ধ মেখে॥
  
    
১২৯
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো!
           বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো॥
     রয়েছে দীপ, না আছে শিখা,   এই কি ভালে ছিল রে লিখা—
           ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।
              বিরহানলে প্রদীপখানি জ্বালো॥
           বেদনাদূতী গাহিছে, ’ওরে প্রাণ,
           তোমার লাগি জাগেন ভগবান।
     নিশীথে  ঘন অন্ধকারে   ডাকেন তোরে প্রেমাভিসারে,
           দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান।
              তোমার লাগি জাগেন ভগবান।’
           গগনতল গিয়েছে মেঘে ভরি,
           বাদলজল পড়িছে ঝরি ঝরি।
     এ ঘোর রাতে কিসের লাগি   পরান মম সহসা জাগি
           এমন কেন করিছে মরি মরি।
              বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি॥
           বিজুলি শুধু ক্ষণিক আভা হানে,
           নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।
     জানি না কোথা অনেক দূরে   বাজিল গান গভীর সুরে,
           সকল প্রাণ টানিছে পথপানে
              নিবিড়তর তিমির চোখে আনে॥
           কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো!
           বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
     ডাকিছে মেঘ, হাঁকিছে হাওয়া,   সময় গেলে হবে না যাওয়া—
           নিবিড় নিশা নিকষঘনকালো।
              পরান দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালো॥
    
১৩০
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোরা   শুনিস নি কি শুনিস নি তার পায়ের ধ্বনি,
               ওই যে  আসে, আসে, আসে।
             যুগে যুগে পলে পলে দিন-রজনী
               সে যে  আসে, আসে, আসে॥
       গেয়েছি গান যখন যত   আপন মনে খ্যাপার মতো
             সকল সুরে বেজেছে তার আগমনী—
               সে যে  আসে, আসে, আসে॥
             কত কালের ফাগুন-দিনে বনের পথে
               সে যে  আসে, আসে, আসে।
             কত শ্রাবণ-অন্ধকারে মেঘের রথে
               সে যে  আসে, আসে, আসে।
       দুখের পরে পরম দুখে   তারি চরণ বাজে বুকে,
             সুখে কখন বুলিয়ে সে দেয় পরশমণি।
               সে যে  আসে, আসে, আসে॥
    
১৩১
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
            হে অন্তরের ধন,
            তুমি যে বিরহী,তোমার শুন্য এ ভবন॥
       আমার ঘরে তোমায় আমি   একা রেখে দিলাম স্বামী—
            কোথায় যে বাহিরে আমি ঘুরি সকল ক্ষণ॥
                   হে অন্তরের ধন,
            এই বিরহে কাঁদে আমার নিখিল ভুবন।
       তোমার বাঁশি নানা সুরে   আমায় খুঁজে বেড়ায় দূরে,
            পাগল হল বসন্তের এই দখিন-সমীরণ॥
    
১৩২
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমার পূজার   ছলে তোমায়   ভুলেই থাকি।
        বুঝতে নারি   কখন্‌ তুমি   দাও-যে ফাঁকি॥
        ফুলের মালা   দীপের আলো   ধূপের ধোঁওয়ার
        পিছন হতে   পাই নে সুযোগ   চরণ ছোঁওয়ার,
        স্তবের বাণীর   আড়াল টানি   তোমায় ঢাকি॥
        দেখব ব’লে    এই আয়োজন  মিথ্যা রাখি,
        আছে তো মোর   তৃষা-কাতর   আপন আঁখি।
        কাজ কী আমার   মন্দিরেতে   আনাগোনায়—
        পাতব আসন   আপন মনের   একটি কোণায়,
        সরল প্রাণে   নীরব হয়ে   তোমায় ডাকি॥
    
১৩৩
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
           নীরবে  আছ কেন  বাহিরদুয়ারে—
            আঁধার  লাগে চোখে, দেখি  না তুহারে॥
               সময়  হল জানি, নিকটে  লবে টানি,
                 আমার তরীখানি ভাসাবে জুয়ারে॥
            সফল  হোক প্রাণ এ  শুভলগনে,
            সকল তারা  তাই গাহুক  গগনে।
               করো  গো সচকিত  আলোকে পুলকিত
                 স্বপননিমীলিত হৃদয়গুহারে॥
  
    
১৩৪
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমার  আমার এই  বিরহের  অন্তরালে
        কত আর  সেতু বাঁধি  সুরে সুরে  তালে তালে॥
            তবু  যে পরানমাঝে  গোপনে বেদনা  বাজে—
            এবার  সেবার কাজে  ডেকে লও  সন্ধ্যাকালে॥
        বিশ্ব  হতে থাকি দূরে  অন্তরের অন্তঃপুরে,
        চেতনা  জড়ায়ে রহে   ভাবনার  স্বপ্নজালে।
            দুঃখ  সুখ আপনারই   সে বোঝা  হয়েছে ভারী,
            যেন  সে সঁপিতে  পারি    চরম পূজার  থালে॥
    
১৩৫
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নিশা-অবসানে  কে দিল গোপনে  আনি
        তোমার  বিরহ-বেদনা-মানিকখানি॥
           সে  ব্যথার দান  রাখিব  পরানমাঝে—
           হারায়  না যেন জটিল  দিনের কাজে,
               বুকে  যেন দোলে সকল  ভাবনা হানি॥
        চিরদুখ  মম চিরসম্পদ হবে,
        চরম  পূজায় হবে  সার্থক কবে।
           স্বপনগহন  নিবিড়তিমিরতলে
           বিহ্বল  রাতে সে যেন  গোপনে জ্বলে,
               সেই  তো নীরব তব  আহ্বানবাণী॥
    
১৩৬
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিশ্ব  যখন  নিদ্রামগন, গগন  অন্ধকার,
         কে দেয়  আমার বীণার তারে  এমন ঝঙ্কার॥
      নয়নে  ঘুম নিল কেড়ে,   উঠে বসি  শয়ন ছেড়ে—
             মেলে  আঁখি চেয়ে  থাকি, পাই নে  দেখা তার॥
      গুঞ্জরিয়া  গুঞ্জরিয়া  প্রাণ উঠিল  পূরে,
         জানি  নে কোন্‌  বিপুল বাণী  বাজে ব্যাকুল  সুরে।
      কোন্‌  বেদনায় বুঝি  না রে    হৃদয় ভরা  অশ্রুভারে,
             পরিয়ে  দিতে চাই  কাহারে আপন  কণ্ঠহার॥
    
১৩৭
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যে  দিন    ফুটল কমল  কিছুই জানি  নাই,
                আমি  ছিলেম  অন্যমনে।
        আমার   সাজিয়ে  সাজি তারে আনি  নাই,
                সে যে  রইল  সঙ্গোপনে॥
             মাঝে মাঝে  হিয়া  আকুলপ্রায়
             স্বপন  দেখে চমকে ঊঠে  চায়,
             মন্দ  মধুর গন্ধ আসে  হায়
                কোথায়   দখিন-সমীরণে॥
        ওগো,  সেই  সুগন্ধে  ফিরায়  উদাসিয়া
                আমায়   দেশে-দেশান্তে।
        যেন    সন্ধানে তার  উঠে  নিশ্বাসিয়া
                ভুবন   নবীন-বসন্তে।
              কে  জানিত দূরে তো  নেই সে,
              আমারি  গো আমারি সেই  যে,
              এ  মাধুরী  ফুটেছে হায় রে
                আমার   হৃদয়-উপবনে॥
    
১৩৮
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রভু,   তোমা  লাগি আঁখি  জাগে;
                  দেখা  নাই পাই
                    পথ  চাই,
             সেও  মনে ভালো  লাগে॥
          ধূলাতে  বসিয়া  দ্বারে    ভিখারি হৃদয়  হা রে
             তোমারি  করুণা মাগে;
                  কৃপা  নাই পাই
                    শুধু  চাই,
             সেও  মনে ভালো লাগে॥
          আজি এ  জগতমাঝে   কত সুখে  কত কাজে
             চলে  গেল সবে আগে;
                 সাথি  নাই পাই
                    তোমায়  চাই,
             সেও  মনে ভালো  লাগে॥
          চারি  দিকে সুধা-ভরা    ব্যাকুল  শ্যামল ধরা
             কাঁদায়  রে অনুরাগে;
                 দেখা  নাই পাই
                    ব্যথা  পাই,
             সেও  মনে ভলো  লাগে॥
    
১৩৯
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যদি   তোমার  দেখা না পাই, প্রভু,  এবার এ জীবনে
     তবে  তোমায়  আমি পাই নি  যেন সে কথা রয়  মনে।
     যেন   ভুলে না  যাই, বেদনা  পাই    শয়নে  স্বপনে॥
                   এ  সংসারের হাটে
          আমার   যতই  দিবস কাটে,
          আমার   যতই দু  হাত ভরে উঠে  ধনে
     তবু  কিছুই  আমি পাই নি  যেন   সে  কথা রয় মনে।
     যেন  ভুলে না  যাই, বেদনা  পাই    শয়নে  স্বপনে॥
                   যদি  আলসভরে
           আমি   বসি  পথের ’পরে,
           যদি    ধূলায়  শয়ন পাতি  সযতনে,
     যেন  সকল পথই  বাকি আছে সে  কথা রয় মনে।
     যেন  ভুলে না  যাই, বেদনা  পাই    শয়নে  স্বপনে॥
                   যতই  উঠে হাসি,
           ঘরে   যতই  বাজে বাঁশি,
           ওগো  যতই গৃহ  সাজাই আয়োজনে,
     যেন  তোমায়  ঘরে হয় নি আনা   সে কথা রয়  মনে।
     যেন  ভুলে না  যাই, বেদনা  পাই    শয়নে  স্বপনে॥
  
    
১৪০
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হেরি  অহরহ তোমারি  বিরহ ভুবনে  ভুবনে রাজে হে,
      কত রূপ  ধরে কাননে  ভূধরে আকাশে  সাগরে সাজে  হে॥
         সারা  নিশি ধরি  তারায় তারায় অনিমেষ  চোখে নীরবে  দাঁড়ায়,
             পল্লবদলে  শ্রাবণধারায়  তোমারি বিরহ  বাজে হে॥
   ঘরে ঘরে  আজি কত  বেদনায়    তোমারি গভীর  বিরহ ঘনায়
       কত  প্রেমে হায়, কত  বাসনায়, কত  সুখে দুখে  কাজে হে।
           সকল  জীবন উদাস  করিয়া    কত গানে সুরে  গলিয়া ঝরিয়া
             তোমার  বিরহ উঠিছে  ভরিয়া আমার  হিয়ার মাঝে  হে॥
    
১৪১
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার    গোধূলিলগন  এল বুঝি কাছে  গোধূলি লগন  রে।
            বিবাহের  রঙে রাঙা হয়ে  আসে সোনার গগন  রে।
     শেষ  ক’রে দিল পাখি  গান-গাওয়া,   নদীর  উপরে পড়ে এল  হাওয়া;
          ও  পারের তীর, ভাঙা  মন্দির  আঁধারে মগন  রে।
            আসিছে  মধুর  ঝিল্লিনূপুরে  গোধূলিলগন  রে॥
     আমার   দিন  কেটে গেছে  কখনো খেলায়, কখনো  কত কী কাজে।
              
এখন কি শুনি পুরবীর সুরে কোন্‌ দূরে বাঁশি বাজে।
     বুঝি  দেরি নাই, আসে  বুঝি আসে, আলোকের  আভা লেগেছে  আকাশে—
          বেলাশেষে  মোরে কে  সাজাবে, ওরে, নবমিলনের  সাজে!
              
সারা হল কাজ, মিছে কেন আজ ডাক মোরে আর কাজে॥
     আমি   জানি যে  আমার হয়ে গেছে  গণা গোধূলিলগন  রে।
               ধূসর  আলোকে মুদিবে  নয়ন অস্তগগন  রে।
     তখন এ  ঘরে কে খুলিবে  দ্বার,   কে  লইবে টানি  বাহু আমার,
           আমায়  কে জানে কী  মন্ত্রে গানে  করিবে মগন রে—
               সব  গান সেরে  আসিবে যখন  গোধূলিলগন  রে॥
    
১৪২
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নাই  বা ডাকো রইব  তোমার দ্বারে,
            মুখ  ফিরালে ফিরব  না এইবারে॥
               বসব  তোমার পথের  ধূলার ’পরে,
               এড়িয়ে  আমায় চলবে  কেমন করে—
               তোমার  তরে যে জন  গাঁথে মালা
                 গানের কুসুম জুগিয়ে দেব তারে॥
            রইব  তোমার ফসল-খেতের  কাছে
            যেথায়  তোমার পায়ের  চিহ্ন আছে।
               জেগে  রব গভীর  উপবাসে
               অন্ন  তোমার আপনি  যেথায় আসে—
               যেথায়  তুমি লুকিয়ে  প্রদীপ  জ্বালো
                 বসে রব সেথায় অন্ধকারে॥
    
১৪৩
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
              সকাল-সাঁজে
                 ধায়  যে ওরা নানা  কাজে॥
           আমি  কেবল বসে আছি,   আপন মনে  কাঁটা বাছি
                পথের মাঝে   সকাল-সাঁজে॥
                      এ পথ বেয়ে
                   সে আসে, তাই আছি চেয়ে।
           কতই  কাঁটা বাজে  পায়ে,   কতই  ধুলা লাগে  গায়ে—
                   মরি লাজে    সকাল-সাঁজে॥
  
    
১৪৪
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    জগত  জুড়ে উদার  সুরে  আনন্দগান  বাজে,
           সে গান  কবে গভীর রবে  বাজিবে হিয়া-মাঝে॥
        বাতাস  জল আকাশ আলো  সবারে  কবে বাসিব ভালো,
           হৃদয়সভা  জুড়িয়া তারা  বসিবে নানা  সাজে॥
           নয়ন  দুটি মেলিলে  কবে পরান হবে  খুশি,
           যে পথ  দিয়া চলিয়া  যাব সবারে যাব  তুষি।
           রয়েছ  তুমি এ কথা  কবে   জীবনমাঝে  সহজ হবে,
           আপনি  কবে তোমারি  নাম ধ্বনিবে  সব কাজে॥
    
১৪৫
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   কোন্‌  শুভখনে উদিবে  নয়নে   অপরূপ রূপ-ইন্দু
          চিত্তকুসুমে  ভরিয়া উঠিবে  মধুময়  রসবিন্দু॥
          নব  নন্দনতানে    চিরবন্দনগানে
          উৎসববীণা  মন্দমধুর   ঝঙ্কৃত  হবে প্রাণে—
          নিখিলের  পানে উথলি  উঠিবে    উতলা চেতনাসিন্ধু।
          জাগিয়া  রহিবে  রাত্রি    নিবিড়মিলনদাত্রী,
          মুখরিয়া  দিক চলিবে  পথিক  অমৃতসভার  যাত্রী—
          গগনে  ধ্বনিবে ‘নাথ  নাথ বন্ধু  বন্ধু  বন্ধু’॥
  
    
১৪৬
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        আজ    জ্যোৎস্নারাতে  সবাই গেছে বনে
              বসন্তের  এই মাতাল  সমীরণে॥
        যাব না  গো যাব না যে,   রইনু  পড়ে ঘরের  মাঝে—
              এই  নিরালায় রব  আপন কোণে।
                   যাব না এই মাতাল সমীরণে॥
              আমার  এ ঘর বহু যতন  ক’রে
                   ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।
        আমারে  যে জাগতে হবে,   কী জানি  সে আসবে কবে
              যদি  আমায় পড়ে  তাহার মনে
                   বসন্তের এই মাতাল সমীরণে॥
    
১৪৭
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তুমি   এ-পার ও-পার  কর কে গো ওগো  খেয়ার নেয়ে?
     আমি   ঘরের  দ্বারে বসে  বসে দেখি যে  সব চেয়ে॥
           ভাঙিলে  হাট দলে দলে   সবাই  যাবে ঘরে চলে
           আমি  তখন মনে ভাবি, আমিও  যাই ধেয়ে॥
     দেখি   সন্ধ্যাবেলা  ও পার-পানে  তরণী যাও  বেয়ে।
     দেখে   মন আমার  কেমন করে,   ওঠে যে  গান গেয়ে
                 ওগো  খেয়ার নেয়ে॥
           কালো  জলের কলকলে   আঁখি  আমার ছলছলে,
           ও পার  হতে সোনার আভা  পরান ফেলে  ছেয়ে।
     দেখি   তোমার  মুখে কথাটি  নাই ওগো খেয়ার  নেয়ে—
     কী যে  তোমার  চোখে লেখা আছে  দেখি যে সব চেয়ে
                 ওগো  খেয়ার নেয়ে।
           আমার  মুখে  ক্ষণতরে   যদি  তোমার আঁখি পড়ে
           আমি  তখন মনে ভাবি  আমিও  যাই ধেয়ে
                 ওগো  খেয়ার নেয়ে॥
  
    
১৪৮
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
         বেলা গেল  তোমার পথ  চেয়ে।
     শূন্য  ঘাটে একা আমি, পার  ক’রে লও খেয়ার  নেয়ে॥
     ভেঙে  এলেম খেলার  বাঁশি,   চুকিয়ে  এলেম কান্না  হাসি,
         সন্ধ্যাবায়ে  শ্রান্তকায়ে  ঘুমে নয়ন আসে  ছেয়ে॥
     ও  পারেতে ঘরে  ঘরে    সন্ধ্যাদীপ  জ্বলিল রে,
         আরতির  শঙ্খ বাজে  সুদূর মন্দির-’পরে।
     এসো  এসো  শ্রান্তিহরা,   এসো  শান্তি-সুপ্তি-ভরা,
         এসো  এসো তুমি এসো, এসো  তোমার তরী  বেয়ে॥
    
১৪৯
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
            তোর     ভিতরে  জাগিয়া কে যে,
            তারে     বাঁধনে  রাখিলি  বাঁধি।
            হায়      আলোর  পিয়াসী সে যে
            তাই      গুমরি  উঠিছে  কাঁদি॥
            যদি        বাতাসে বহিল  প্রাণ
            কেন      বীণায়  বাজে না গান,
            যদি       গগনে  জাগিল আলো
            কেন      নয়নে  লাগিল আঁধি?।
            পাখি       নবপ্রভাতের  বাণী
            দিল       কাননে  কাননে আনি,
            ফুলে       নবজীবনের  আশা
            কত      রঙে  রঙে পায় ভাষা।
            হোথা       ফুরায়ে  গিয়েছে রাতি,
            হেথা      জ্বলে  নিশীথের বাতি—
            তোর      ভবনে  ভুবনে কেন
            হেন       হয়ে  গেল আধা-আধি?।
    
১৫০
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
            তুমি     বাহির  থেকে দিলে  বিষম তাড়া।
            তাই     ভয়ে  ঘোরায় দিক্‌বিদিকে,
                     শেষে অন্তরে পাই সাড়া॥
            যখন     হারাই  বন্ধ ঘরের  তালা—
            যখন     অন্ধ  নয়ন, শ্রবণ  কালা,
            তখন      অন্ধকারে  লুকিয়ে  দ্বারে
                      শিকলে দাও নাড়া॥
            যত      দুঃখ  আমার দুঃস্বপনে,
            সে যে    ঘুমের  ঘোরেই আসে  মনে—
                    ঠেলা দিয়ে মায়ার আবেশ
                      কর গো দেশছাড়া।
            আমি      আপন  মনের মারেই  মরি,
            শেষে     দশ  জনারে দোষী  করি—
            আমি      চোখ  বুজে পথ পাই  নে ব’লে
                    কেঁদে ভাসাই পাড়া॥
    
১৫১
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
          এখনো  গেল না আঁধার, এখনো  রহিল বাধা।
          এখনো  মরণব্রত  জীবনে হল না  সাধা॥
          কবে যে  দুঃখজ্বালা   হবে রে  বিজয়মালা,
          ঝলিবে  অরুণরাগে  নিশীথ রাতের  কাঁদা॥
          এখনো  নিজেরই ছায়া   রচিছে  কত যে মায়া।
          এখনো  কেন-যে মিছে   চাহিছে  কেবলই পিছে,
          চকিতে  বিজলি-আলো  চোখেতে  লাগালো  ধাঁদা॥
  
    
১৫২
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        লক্ষ্মী  যখন আসবে তখন  কোথায় তারে  দিবি রে ঠাঁই?
        দেখ্‌  রে চেয়ে আপন-পানে,  পদ্মটি নাই, পদ্মটি  নাই॥
     ফিরছে  কেঁদে  প্রভাতবাতাস,     আলোক  যে তার ম্লান  হতাশ,
        মুখে  চেয়ে আকাশ  তোরে শুধায়  আজি নীরবে  তাই॥
        কত  গোপন আশা নিয়ে  কোন্‌ সে গহন  রাত্রি শেষে
        অগাধ  জলের তলা হতে  অমল কুঁড়ি উঠল  ভেসে।
     হল না  তার ফুটে ওঠা,   কখন  ভেঙে পড়ল  বোঁটা—
        মর্ত-কাছে  স্বর্গ যা চায়  সেই মাধুরী  কোথা রে পাই॥
    
১৫৩
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যেতে  যেতে চায় না  যেতে, ফিরে  ফিরে চায়—
         সবাই  মিলে পথে চলা  হল আমার দায়  গো॥
      দুয়ার  ধরে দাঁড়িয়ে  থাকে—      দেয় না সাড়া  হাজার ডাকে—
         বাঁধন  এদের সাধনধন, ছিঁড়তে  যে ভয় পায়॥
         আবেশভরে  ধুলায় প’ড়ে  কতই করে ছল,
         যখন  বেলা যাবে চলে  ফেলবে  আঁখিজল।
      নাই  ভরসা, নাই যে  সাহস,     চিত্ত  অবশ, চরণ অলস—
         লতার  মতো জড়িয়ে ধরে  আপন বেদনায়॥
    
১৫৪
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                  বেসুর  বাজে রে,
        আর  কোথা নয়, কেবল  তোরই আপন-মাঝে  রে॥
        মেলে  না সুর এই  প্রভাতে    আনন্দিত  আলোর সাথে,
        সবারে  সে আড়াল করে, মরি  লাজে রে॥
               ওরে  থামা রে  ঝঙ্কার।
        নীরব  হয়ে দেখ্‌ রে  চেয়ে, দেখ্ রে  চারি ধার।
        তোরি  হৃদয় ফুটে  আছে   মধুর হয়ে  ফুলের গাছে,
        নদীর  ধারা ছুটেছে  ওই তোরই কাজে  রে॥
    
১৫৫
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    আমার   কণ্ঠ  তাঁরে ডাকে,
            তখন   হৃদয়  কোথায় থাকে॥
      যখন    হৃদয়  আসে ফিরে   আপন  নীরব নীড়ে
      আমার   জীবন  তখন কোন্‌  গহনে বেড়ায়  কিসের পাকে॥
            যখন   মোহ  আমায় ডাকে
            তখন   লজ্জা  কোথায় থাকে!
      যখন    আনেন  তমোহারী   আলোক-তরবারি
      তখন    পরান আমার  কোন্‌ কোণে যে
                  লজ্জাতে  মুখ ঢাকে॥
    
১৫৬
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
           দেবতা  জেনে দূরে রই  দাঁড়ায়ে,
                   আপন জেনে আদর করি নে।
            পিতা  ব’লে প্রণাম  করি পায়ে,
                   বন্ধু ব’লে দু হাত ধরি নে॥
            আপনি  তুমি অতি সহজ  প্রেমে
            আমার  হয়ে যেথায় এলে  নেমে
       সেথায়  সুখে বুকের  মধ্যে ধ’রে  সঙ্গী বলে  তোমায় বরি  নে॥
            ভাই  তুমি যে  ভাইয়ের মাঝে, প্রভু ,
            তাদের  পানে তাকাই না  যে তবু—
       ভাইয়ের  সাথে ভাগ ক’রে  মোর ধন তোমার  মুঠো কেন ভরি  নে॥
            ছুটে  এসে সবার সুখে  দুখে
            দাঁড়াই  নে তো তোমারি  সম্মুখে,
       সঁপিঁয়ে  প্রাণ  ক্লান্তিবিহীন  কাজে প্রাণসাগরে  ঝাঁপিয়ে পড়ি  নে॥
    
১৫৭
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    ক্লান্তি  আমার ক্ষমা  করো প্রভু,
          পথে  যদি পিছিয়ে পড়ি  কভু॥
      এই-যে  হিয়া থরোথরো   কাঁপে  আজি এমনতরো
      এই  বেদনা ক্ষমা  করো, ক্ষমা  করো,ক্ষমা করো  প্রভু॥
          এই  দীনতা ক্ষমা  করো প্রভু,
          পিছন-পানে  তাকাই যদি  কভু।
      দিনের  তাপে  রৌদ্রজ্বালায়   শুকায়  মালা পূজার  থালায়,
      সেই ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু॥             
    
১৫৮
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
             অগ্নিবীণা  বাজাও তুমি  কেমন ক’রে!
          আকাশ  কাঁপে তারার  আলোর গানের  ঘোরে॥
       তেমনি  ক’রে আপন হাতে   ছুঁলে  আমার বেদনাতে,
          নূতন  সৃষ্টি জাগল  বুঝি জীবন-’পরে॥
         বাজে  ব’লেই বাজাও  তুমি সেই গরবে,
          ওগো  প্রভু, আমার  প্রাণে সকল  সবে।
       বিষম  তোমার  বহ্নিঘাতে   বারে  বারে আমার  রাতে
          জ্বালিয়ে  দিলে নূতন  তারা ব্যথায়  ভ’রে॥
  
    
১৫৯
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   পথ  চেয়ে যে কেটে  গেল কত দিনে  রাতে,
    আজ  তোমায়  আমায় প্রাণের  বঁধু মিলব গো  এক সাথে॥
     রচবে  তোমার মুখের  ছায়া    চোখের জলে  মধুর মায়া,
        নীরব  হয়ে তোমার  পানে চাইব গো  জোড় হাতে॥
         এরা  সবাই কী বলে  গো লাগে না মন  আর,
         আমার  হৃদয় ভেঙে  দিল   তোমার    কী মাধুরীর  ভার!
    বাহুর  ঘেরে তুমি  মোরে    রাখবে না কি  আড়াল করে,
        তোমার  আঁখি চাইবে না  কি আমার  বেদনাতে?।
  
    
১৬০
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  সন্ধ্যা  হল গো—ও মা,   সন্ধ্যা  হল, বুকে ধরো।
      অতল  কালো স্নেহের  মাঝে ডুবিয়ে  আমায় স্নিগ্ধ করো॥
  ফিরিয়ে  নে মা, ফিরিয়ে  নে গো—সব যে  কোথায়  হারিয়েছে গো
      ছড়ানো  এই জীবন, তোমার  আঁধার-মাঝে  হোক-না জড়ো॥
      আর  আমারে বাইরে  তোমার কোথাও  যেন না যায়  দেখা।
      তোমার  রাতে মিলাক  আমার  জীবনসাঁজের  রশ্মিরেখা।
      আমায়  ঘিরি আমায়  চুমি    কেবল তুমি, কেবল  তুমি—
      আমার  ব’লে যা আছে, মা, তোমার  ক’রে সকল  হরো॥
  
    
১৬১
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   তুমি     ডাক  দিয়েছ কোন্‌  সকালে কেউ তা  জানে না,
   আমার    মন যে  কাঁদে আপন-মনে  কেউ তা মানে  না॥
         ফিরি  আমি উদাস  প্রাণে,    তাকাই সবার  মুখের পানে,
           তোমার  মতো এমন টানে   কেউ তো  টানে না॥
           বেজে  ওঠে পঞ্চমে  স্বর,   কেঁপে  ওঠে বন্ধ এ ঘর,
           বাহির  হতে দুয়ারে  কর   কেউ  তো হানে না।
         আকাশে  কার  ব্যাকুলতা,   বাতাস  বহে কার বারতা,
           এ পথে  সেই গোপন   কথা কেউ  তো আনে না॥
    
১৬২
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
           এ যে  মোর আবরণ
                  ঘুচাতে  কতক্ষণ!
             নিশ্বাসবায়     উড়ে  চলে যায়
                  তুমি  কর যদি মন॥
                  যদি  পড়ে থাকি ভূমে
                  ধুলার  ধরণী চুমে
             তুমি  তারি লাগি   দ্বারে  রবে জাগি
                  এ  কেমন তব পণ॥
                  রথের  চাকার রবে
                  জাগাও  জাগাও সবে,
             আপনার  ঘরে      এসো বলভরে
                  এসো  এসো গৌরবে।
                  ঘুম  টুটে যাক চলে,
                  চিনি  যেন প্রভু  ব’লে—
             ছুটে  এসে দ্বারে   করি  আপনারে
                  চরণে  সমর্পণ॥
    
১৬৪
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার     ব্যথা  যখন আনে আমায়  তোমার দ্বারে
   তখন      আপনি  এসে দ্বার  খুলে দাও, ডাকো  তারে॥
          বাহুপাশের  কাঙাল সে যে,   চলেছে  তাই সকল  ত্যেজে,
            কাঁটার  পথে ধায় সে  তোমার  অভিসারে॥
   আমার     ব্যথা  যখন বাজায়  আমায় বাজি  সুরে—
   সেই      গানের  টানে পারো না  আর রইতে দূরে।
          লুটিয়ে  পড়ে সে গান মম   ঝড়ের  রাতের পাখি-সম,
            বাহির  হয়ে এসো তুমি  অন্ধকারে॥
  
    
১৬৩
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
           সকল  জনম ভ’রে      ও মোর দরদিয়া,
           কাঁদি  কাঁদাই তোরে    ও মোর  দরদিয়া॥
                  আছ  হৃদয়-মাঝে
           সেথা    কতই  ব্যথা বাজে,
           ওগো    এ কি  তোমায় সাজে
                       ও মোর দরদিয়া?।
           এই     দুয়ার-দেওয়া  ঘরে
           কভু     আঁধার  নাহি সরে,
           তবু     আছ  তারি ’পরে
                       ও মোর দরদিয়া।
           সেথা    আসন হয়  নি পাতা,
           সেথা    মালা হয়  নি গাঁথা,
           আমার    লজ্জাতে  হেঁট মাথা
                       ও মোর দরদিয়া॥
    
১৬৫
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যতবার  আলো জ্বালাতে  চাই, নিবে যায়  বারে বারে।
   আমার  জীবনে তোমার  আসন গভীর  অন্ধকারে॥
   যে  লতাটি আছে  শুকায়েছে  মূল—কুঁড়ি ধরে  শুধু, নাহি  ফোটে ফুল,
         আমার  জীবনে তব সেবা  তাই বেদনার  উপহারে॥
         পূজাগৌরব  পুণ্যবিভব  কিছু নাহি, নাহি  লেশ—
         এ তব  পূজারী পরিয়া  এসেছে লজ্জার  দীন বেশ।
   উৎসবে  তার আসে নাই  কেহ,  বাজে  নাই বাঁশি, সাজে  নাই গেহ—
         কাঁদিয়া  তোমায় এনেছে  ডাকিয়া  ভাঙামন্দির-দ্বারে॥
    
১৬৬
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
            আবার  এরা ঘিরেছে  মোর মন।
             আবার  চোখে নামে যে  আবরণ॥
   আবার এ  যে নানা কথাই  জমে,   চিত্ত  আমার নানা  দিকে ভ্রমে,
   দাহ  আবার বেড়ে ওঠে  ক্রমে,   আবার  এ যে হারাই  শ্রীচরণ॥
             তব  নীরব বাণী  হৃদয়তলে
             ডোবে  না যেন লোকের  কোলাহলে।
   সবার  মাঝে আমার  সাথে থাকো,   আমায়  সদা তোমার  মাঝে ঢাকো,
   নিয়ত  মোর চেতনা-’পরে  রাখো    আলোকে-ভরা  উদার  ত্রিভুবন॥
    
১৬৭
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
           তুমি   নব নব  রূপে এসো  প্রাণে
           এসো  গন্ধে  বরনে এসো  গানে॥
                  এসো   অঙ্গে পুলকময় পরশে,
                  এসো   চিত্তে সুধাময় হরষে,
                  এসো   মুগ্ধ মুদিত দু’নয়ানে॥
           এসো  নির্মল  উজ্জ্বল  কান্ত,
           এসো  সুন্দর  স্নিগ্ধ  প্রশান্ত,
           এসো  এসো হে  বিচিত্র  বিধানে।
                  এসো   দুঃখে সুখে, এসো মর্মে,
                  এসো   নিত্য নিত্য সব কর্মে,
                  এসো   সকল কর্ম-অবসানে॥
    
১৬৮
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     হৃদয়নন্দনবনে  নিভৃত এ  নিকেতনে
            এসো  হে আনন্দময়, এসো  চিরসুন্দর॥
            দেখাও  তব প্রেমমুখ, পাসরি  সর্ব দুখ,
            বিরহকাতর  তপ্ত চিত্ত-মাঝে  বিহরো॥
            শুভদিন  শুভরজনী আনো  আনো এ জীবনে,
            ব্যর্থ  এ নরজনম সফল  করো প্রিয়তম।
            মধুর  চিরসঙ্গীতে  ধ্বনিত করো  অন্তর,
            ঝরিবে  জীবনে মনে  দিবানিশা  সুধানিঝর॥
    
১৬৯
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বসে  আছি হে    কবে    শুনিব তোমার  বাণী।
      কবে   বাহির  হইব জগতে  মম   জীবন  ধন্য মানি॥
      কবে   প্রাণ  জাগিবে, তব   প্রেম  গাহিবে,
      দ্বারে  দ্বারে ফিরি  সবার    হৃদয় চাহিবে,
      নরনারীমন  করিয়া হরণ   চরণে  দিবে আনি॥
      কেহ   শুনে না  গান,   জাগে  না প্রাণ,
      বিফলে  গীত-অবসান—
      তোমার  বচন করিব রচন   সাধ্য  নাহি নাহি।
      তুমি  না কহিলে  কেমনে কব   প্রবল  অজেয় বাণী তব,
      তুমি  যা বলিবে তাই  বলিব,   আমি  কিছুই না  জানি।
      তব  নামে আমি  সবারে ডাকিব,   হৃদয়ে  লইব টানি॥
    
১৭০
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   ডাকিছ  শুনি জাগিনু  প্রভু, আসিনু  তব পাশে।
          আঁখি  ফুটিল, চাহি  উঠিল চরণদরশ-আশে॥
          খুলিল  দ্বার, তিমিরভার  দূর হইল  ত্রাসে।
          হেরিল  পথ বিশ্বজগত, ধাইল  নিজ বাসে॥
          বিমলকিরণ  প্রেম-আঁখি  সুন্দর  পরকাশে।
          নিখিল  তায় অভয় পায়, সকল  জগত হাসে॥
          কানন  সব ফুল্ল আজি, সৌরভ  তব ভাসে।
          মুগ্ধ  হৃদয় মত্ত  মধুপ  প্রেমকুসুমবাসে॥
          উজ্জ্বল  যত ভকতহৃদয়, মোহতিমির  নাশে।
          দাও, নাথ,  প্রেম-অমৃত  বঞ্চিত তব  দাসে॥
    
১৭১
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    আমি     কারে  ডাকি গো,
            আমার    বাঁধন  দাও গো টুটে।
            আমি     হাত  বাড়িয়ে আছি,
            আমায়    লও কেড়ে  লও লুটে॥
            তুমি     ডাকো  এমনি ডাকে
            যেন      লজ্জাভয় না  থাকে,
            যেন     সব  ফেলে যাই, সব  ঠেলে যাই,
                          যাই ধেয়ে যাই ছুটে॥
            আমি     স্বপন  দিয়ে বাঁধা—
            কেবল    ঘুমের  ঘোরের বাধা,
            সে যে    জড়িয়ে  আছে প্রাণের  কাছে
                           মুদিয়ে আঁখিপুটে।
            ওগো,     দিনের  পরে দিন
            আমার     কোথায়  হল লীন,
            কেবল      ভাষাহারা  অশ্রুধারায়
                           পরান কেঁদে উঠে॥
    
১৭২
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


          আজি মন  চাহে  জীবনবন্ধুরে,
          সেই  জনমে মরণে  নিত্যসঙ্গী
             নিশিদিন  সুখে শোকে—
                সেই  চির-আনন্দ, বিমল  চিরসুধা,
                যুগে  যুগে কত নব নব  লোকে  নিয়তশরণ।
          পরাশান্তি,পরমপ্রেম,          পরামুক্তি, পরমক্ষেম,
             সেই  অন্তরতম  চিরসুন্দর  প্রভু, চিত্তসখা,
                ধর্ম-অর্থ-কাম-ভরণ রাজা হৃদয়হরণ॥ />
    
১৭৩
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


           আমার   মন তুমি,  নাথ, লবে হ’রে
           আমি    আছি বসে  সেই আশা ধরে॥
     নীলাকাশে  ওই তারা ভাসে,     নীরব  নিশীথে শশী  হাসে,
     আমার   দু নয়নে  বারি আসে ভরে—  আছি আশা ধরে॥
     স্থলে  জলে তব  ধূলিতলে, তরুলতা  তব ফুলে ফলে,
               নরনারীদের  প্রেমডোরে,
     নানা  দিকে দিকে  নানা কালে,   নানা  সুরে সুরে  নানা তালে
             নানা  মতে তুমি লবে  মোরে— আছি আশা  ধরে॥ />
    
১৭৪
পূজা - বিরহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   ঘাটে  বসে আছি আনমনা,    যেতেছে  বহিয়া সুসময়—
   সে  বাতাসে তরী  ভাসাব না    যাহা  তোমা পানে  নাহি বয়॥
   দিন যায়  ওগো দিন যায়,     দিনমণি  যায় অস্তে—
   নিশার  তিমিরে দশদিক  ঘিরে    জাগিয়া  উঠিছে শত ভয়॥
   ঘরের  ঠিকানা হল না  গো,    মন  করে তবু যাই-যাই—
   ধ্রুবতারা  তুমি যেথা  জাগ     সে  দিকের পথ চিনি  নাই॥
   এত দিন  তরী বাহিলাম     যে  সুদূরে পথ  বাহিয়া—
   শত বার  তরী ডুবুডুবু  করি   সে  পথে ভরসা নাহি  পাই॥
   তীর-সাথে  হেরো শত ডোরে  বাঁধা  আছে মোর  তরীখান—
   রশি  খুলে দেবে কবে  মোরে,   ভাসিতে  পারিলে বাঁচে  প্রাণ।
   কবে  অকূলের খোলা  হাওয়া    দিবে সব  জ্বালা  জুড়ায়ে,
   শুনা  যাবে কবে  ঘনঘোর রবে    মহাসাগরের কলগান॥