১৯২
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
১৯২ আর রেখো না আঁধারে, আমায় দেখতে দাও। তোমার মাঝে আমার আপনারে দেখতে দাও॥ কাঁদাও যদি কাঁদাও এবার, সুখের গ্লানি সয় না যে আর, নয়ন আমার যাক-না ধুয়ে অশ্রুধারে— আমায় দেখতে দাও॥ জানি না তো কোন্ কালো এই ছায়া, আপন ব’লে ভুলায় যখন ঘনায় বিষম মায়া। স্বপ্নভারে জমল বোঝা, চিরজীবন শূন্য খোঁজা— যে মোর আলো লুকিয়ে আছে রাতের পারে আমায় দেখতে দাও॥ />
১৯৩
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
১৯৩ দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক তবে তাই হোক। মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক তবে তাই হোক॥ পূজার প্রদীপে তব জ্বলে যদি মম দীপ্ত শোক তবে তাই হোক। অশ্রু-আঁখি-’পরে যদি ফুটে ওঠে তব স্নেহচোখ তবে তাই হোক॥/>
১৯৪
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
১৯৪ আমার আঁধার ভালো, আলোর কাছে বিকিয়ে দেবে আপনাকে সে। আলোরে যে লোপ ক’রে খায় সেই কুয়াশা সর্বনেশে॥ অবুঝ শিশু মায়ের ঘরে সহজ মনে বিহার করে, অভিমানী জ্ঞানী তোমার বাহির দ্বারে ঠেকে এসে॥ তোমার পথ আপনায় আপনি দেখায়, তাই বেয়ে, মা, চলব সোজা। যারা পথ দেখাবার ভিড় করে গো তারা কেবল বাড়ায় খোঁজা। ওরা ডাকে আমায় পূজার ছলে, এসে দেখি দেউল-তলে— আপন মনের বিকারটারে সাজিয়ে রাখে ছদ্মবেশে॥/>
১৯৫
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
১৯৫ এবার দুঃখ আমার অসীম পাথার পার হল যে, পার হল। তোমার পায়ে এসে ঠেকল শেষে, সকল সুখের সার হল॥ এত দিন নয়নধারা বয়েছে বাঁধনহারা, কেন বয় পাই নি যে তার কূলকিনারা— আজ গাঁথল কে সেই অশ্রুমালা, তোমার গলার হার হল॥ তোমার সাঁঝের তারা ডাকল আমায় যখন অন্ধকার হল। বিরহের ব্যথাখানি খুঁজে তো পায় নি বাণী, এত দিন নীরব ছিল শরম মানি— আজ পরশ পেয়ে উঠল গেয়ে, তোমার বীণার তার হল॥/>
১৯৬
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
১৯৬ যারে নিজে তুমি ভাসিয়েছিলে দুঃখধারার ভরা স্রোতে তারে ডাক দিলে আজ কোন্ খেয়ালে আবার তোমার ও পার হতে॥ শ্রাবণ-রাতে বাদল-ধারে উদাস ক’রে কাঁদাও যারে আবার তারে ফিরিয়ে আনো ফুল-ফোটানো ফাগুন-রাতে॥ এ পার হতে ও পার ক’রে বাটে বাটে ঘোরাও মোরে। কুডিয়ে আনা, ছড়িয়ে ফেলা, এই কি তোমার একই খেলা— লাগাও ধাঁধা বারে বারে এই আঁধারে এই আলোতে॥ />
১৯৭
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
১৯৭ আমায় দাও গো বলে সে কি তুমি আমায় দাও দোলা অশান্তিদোলে। দেখতে না পাই পিছে থেকে আঘাত দিয়ে হৃদয়ে কে ঢেউ যে তোলে॥ মুখ দেখি নে তাই লাগে ভয়— জানি না যে, এ কিছু নয়। মুছব আঁখি, উঠব হেসে— দোলা যে দেয় যখন এসে ধরবে কোলে॥/>
১৯৮
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
১৯৮ তোর শিকল আমায় বিকল করবে না। তোর মারে মরম মরবে না॥ তাঁর আপন হাতের ছাড়াচিঠি সেই যে আমার মনের ভিতর রয়েছে এই যে, তোদের ধরা আমায় ধরবে না॥ যে পথ দিয়ে আমার চলাচল তোর প্রহরী তার খোঁজ পাবে কি বল্। আমি তাঁর দুয়ারে পৌঁছে গেছি রে, মোরে তোর দুয়ারে ঠেকাবে কি রে? তোর ডরে পরান ডরবে না॥/>
১৯৯
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
১৯৯ আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে॥ মাভৈঃবাণীর ভরসা নিয়ে ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে তোমার ওই পারেতেই যাবে তরী ছায়াবটের ছায়ে॥ পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়— আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী, এই শুধু মোর দায়। দিন ফুরালে, জানি জানি, পৌঁছে ঘাটে দেব আনি আমার দুঃখদিনের রক্তকমল তোমার করুণ পায়॥ />
২০০
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২০০ বাহিরে ভুল হানবে যখন অন্তরে ভুল ভাঙবে কি? বিষাদবিষে জ্বলে শেষে তোমার প্রসাদ মাঙবে কি?। রৌদ্রদাহ হলে সারা নামবে কি ওর বর্ষাধারা ? লাজের রাঙা মিটলে হৃদয় প্রেমের রঙে রাঙবে কি?। যতই যাবে দূরের পানে বাঁধন ততই কঠিন হয়ে টানবে না কি ব্যথার টানে! অভিমানের কালো মেঘে বাদল-হাওয়া লাগবে বেগে, নয়নজলের আবেগ তখন কোনোই বাধা মানবে কি॥/>
২০১
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২০১ আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন— আমার ব্যথার পূজা হয় নি সমপন॥ যখন বেলা-শেষের ছায়ায় পাখিরা যায় আপন কুলায়-মাঝে, সন্ধ্যাপূজার ঘণ্টা যখন বাজে, তখন আপন শেষ শিখাটি জ্বালবে এ জীবন— আমার ব্যথার পূজা হবে সমাপন॥ অনেক দিনের অনেক কথা, ব্যাকুলতা, বাঁধা বেদন-ডোরে, মনের মাঝে উঠেছে আজ ভ’রে। যখন পূজার হোমানলে উঠবে জ্বলে একে একে তারা, আকাশ-পানে ছুটবে বাঁধন-হারা, অস্তরবির ছবির সাথে মিলবে আয়োজন— আমার ব্যথার পূজা হবে সমাপন॥/>
২০২
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২০২ আজি বিজন ঘরে নিশীথরাতে আসবে যদি শূন্য হাতে— আমি তাইতে কি ভয় মানি! জানি জানি, বন্ধু, জানি— তোমার আছে তো হাতখানি॥ চাওয়া-পাওয়ার পথে পথে দিন কেটেছে কোনোমতে, এখন সময় হল তোমার কাছে আপনাকে দিই আনি॥ আঁধার থাকুক দিকে দিকে আকাশ-অন্ধ-করা, তোমার পরশ থাকুক আমার-হৃদয়-ভরা। জীবনদোলায় দুলে দুলে আপনারে ছিলেম ভুলে, এখন জীবন মরণ দু দিক দিয়ে নেবে আমায় টানি॥/>
২০৩
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২০৩ যখন তোমায় আঘাত করি তখন চিনি। শত্রু হয়ে দাঁড়াই যখন লও যে জিনি॥ এ প্রাণ যত নিজের তরে তোমারি ধন হরণ করে ততই শুধু তোমার কাছে হয় যে ঋণী॥ উজিয়ে যেতে চাই যতবার গর্বসুখে তোমার স্রোতের প্রবল পরশ পাই যে বুকে। আলো যখন আলস-ভরে নিবিয়ে ফেলি আপন ঘরে লক্ষ তারা জ্বালায় তোমার নিশীথিনী॥/>
২০৪
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২০৪ দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে? বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে॥ জ্বলতে দে তোর আগুনটারে, ভয় কিছু না করিস তারে, ছাই হয়ে সে নিভবে যখন জ্বলবে না আর কভু তবে॥ এড়িয়ে তাঁরে পালাস না রে, ধরা দিতে হোস না কাতর। দীর্ঘ পথে ছুটে ছুটে দীর্ঘ করিস দুঃখটা তোর। মরতে মরতে মরণটারে শেষ ক’রে দে একেবারে, তার পরে সেই জীবন এসে আপন আসন আপনি লবে॥/>
২০৫
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২০৫ যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি। ঝড় এসেছে, ওরে, এবার ঝড়কে পেলেম সাথি॥ আকাশকোণে সর্বনেশে ক্ষণে ক্ষণে উঠছে হেসে, প্রলয় আমার কেশে বেশে করছে মাতামাতি॥ যে পথ দিয়ে যেতেছিলেম ভুলিয়ে দিল তারে, আবার কোথা চলতে হবে গভীর অন্ধকারে। বুঝি বা এই বজ্ররবে নূতন পথের বার্তা কবে— কোন্ পুরীতে গিয়ে তবে প্রভাত হবে রাতি॥/>
২০৬
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২০৬ না বাঁচাবে আমায় যদি মারবে কেন তবে? কিসের তরে এই আয়োজন এমন কলরবে?। অগ্নিবাণে তূণ যে ভরা, চরণভরে কাঁপে ধরা, জীবনদাতা মেতেছে যে মরণ-মহোৎসবে॥ বক্ষ আমার এমন ক’রে বিদীর্ণ যে করো উৎস যদি না বাহিরায় হবে কেমনতরো? এই-যে আমার ব্যথার খনি জোগাবে ওই মুকুট-মণি— মরণদুখে জাগাবে মোর জীবনবল্লভে॥/>
২০৭
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২০৭ মোর মরণে তোমার হবে জয়। মোর জীবনে তোমার পরিচয়॥ মোর দুঃখ যে রাঙা শতদল আজি ঘিরিল তোমার পদতল, মোর আনন্দ সে যে মণিহার মুকুটে তোমার বাঁধা রয়॥ মোর ত্যাগে যে তোমার হবে জয়। মোর প্রেমে যে তোমার পরিচয়। মোর ধৈর্য তোমার রাজপথ সে যে লঙ্ঘিবে বনপর্বত, মোর বীর্য তোমার জয়রথ তোমারি পতাকা শিরে বয়॥/>
২০৮
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২০৮ হৃদয় আমার প্রকাশ হল অনন্ত আকাশে। বেদন-বাঁশি উঠল বেজে বাতাসে বাতাসে॥ এই-যে আলোর আকুলতা আমারি এ আপন কথা, ফিরে এসে আমার প্রাণে আমারে উদাসে॥ বাইরে তুমি নানা বেশে ফের নানা ছলে; জানি নে তো আমার মালা দিয়েছি কার গলে। আজ কী দেখি পরান-মাঝে, তোমার গলায় সব মালা যে— সব নিয়ে শেষ ধরা দিলে গভীর সর্বনাশে॥/>
২০৯
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২০৯ যখন তুমি বাঁধছিলে তার সে যে বিষম ব্যথা— বাজাও বীণা, ভুলাও ভুলাও সকল দুখের কথা॥ এতদিন যা সঙ্গোপনে ছিল তোমার মনে মনে আজকে আমার তারে তারে শুনাও সে বারতা॥ আর বিলম্ব কোরো না গো, ওই-যে নেবে বাতি। দুয়ারে মোর নিশীথিনী রয়েছে কান পাতি। বাঁধলে যে সুর তারায় তারায় অন্তবিহীন অগ্নিধারায়, সেই সুরে মোর বাজাও প্রাণে তোমার ব্যাকুলতা॥/>
২১০
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২১০ এই-যে কালো মাটির বাসা শ্যামল সুখের ধরা— এইখানেতে আঁধার-আলোয় স্বপন-মাঝে চরা॥ এরই গোপন হৃদয়-’পরে ব্যথার স্বর্গ বিরাজ করে দুঃখে-আলো-করা॥ বিরহী তোর সেইখানে যে একলা বসে থাকে— হৃদয় তাহার ক্ষণে ক্ষণে নামটি তোমার ডাকে। দুঃখে যখন মিলন হবে আনন্দলোক মিলবে তবে সুধায়-সুধায়-ভরা॥/>
২১১
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২১১ এক হাতে ওর কৃপাণ আছে, আর-এক হাতে হার। ও যে ভেঙেছে তোর দ্বার॥ আসে নি ও ভিক্ষা নিতে, না না না—লড়াই করে নেবে জিতে পরানটি তোমার॥ মরণেরই পথ দিয়ে ওই আসছে জীবন-মাঝে ও যে আসছে বীরের সাজে। আধেক নিয়ে ফিরবে না রে, না না না—যা আছে সব একেবারে করবে অধিকার॥/>
২১২
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২১২ আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে॥ আমার এই দেহখানি তুলে ধরো, তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো— নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে॥ আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব সারা রাত ফোটাক তারা নব নব। নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো, যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো— ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊধর্ব-পানে॥/>
২১৩
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২১৩ ওরে কে রে এমন জাগায় তোকে? ঘুম কেন নেই তোরই চোখে? চেয়ে আছিস আপন-মনে— ওই যে দূরে গগন-কোণে রাত্রি মেলে রাঙা নয়ন রুদ্রদেবের দীপ্তালোকে॥ রক্তশতদলের সাজি সাজিয়ে কেন রাখিস আজি ? কোন্ সাহসে একেবারে শিকল খুলে দিলি দ্বারে— জোড়হাতে তুই ডাকিস কারে, প্রলয় যে তোর ঘরে ঢোকে॥/>
২১৪
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২১৪ আঘত করে নিলে জিনে, কাড়িলে মন দিনে দিনে॥ সুখের বাধা ভেঙে ফেলে তবে আমার প্রাণে এলে— বারে বারে মরার মুখে অনেক দুখে নিলেম চিনে॥ তুফান দেখে ঝড়ের রাতে ছেড়েছি হাল তোমার হাতে। বাটের মাঝে, হাটের মাঝে, কোথাও আমায় ছাড়লে না-যে— যখন আমার সব বিকালো তখন আমায় নিলে কিনে॥/>
২১৫
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২১৫ ওগো আমার প্রাণের ঠাকুর, তোমার প্রেম তোমারে এমন ক’রে করেছে নিষ্ঠুর॥ তুমি বসে থাকতে দেবে না যে, দিবানিশি তাই তো বাজে পরান-মাঝে এমন কঠিন সুর॥ ওগো আমার প্রাণের ঠাকুর, তোমার লাগি দুঃখ আমার হয় যেন মধুর। তোমার খোঁজা খোঁজায় মোরে, তোমার বেদন কাঁদায় ওরে, আরাম যত করে কোথায় দূর॥ />
২১৬
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২১৬ সুখে আমায় রাখবে কেন, রাখো তোমার কোলে। যাক-না গো সুখ জ্বলে॥ যাক-না পায়ের তলার মাটি, তুমি তখন ধরবে আঁটি— তুলে নিয়ে দুলাবে ওই বাহুদোলার দোলে॥ যেখানে ঘর বাঁধব আমি আসে আসুক বান— তুমি যদি ভাসাও মোরে চাই নে পরিত্রাণ। হার মেনেছি, মিটেছে ভয়— তোমার জয় তো আমারি জয় ধরা দেব, তোমায় আমি ধরব যে তাই হলে॥/>
২১৭
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২১৭ ও নিঠুর, আরো কি বাণ তোমার তূণে আছে? তুমি মর্মে আমায় মারবে হিয়ার কাছে॥ আমি পালিয়ে থাকি, মুদি আঁখি, আঁচল দিয়ে মুখ যে ঢাকি গো— কোথাও কিছু আঘাত লাগে পাছে॥ আমি মারকে তোমার ভয় করেছি ব’লে। তাই তো এমন হৃদয় ওঠে জ্বলে। যে দিন সে ভয় ঘুচে যাবে সে দিন তোমার বাণ ফুরাবে গো— মরণকে প্রাণ বরণ করে বাঁচে॥/>
২১৮
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২১৮ আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি, সেথায় চরণ পড়ে, তোমার সেথায় চরণ পড়ে। তাই তো আমার সকল পরান কাঁপছে ব্যথার ভরে গো, কাঁপছে থরোথরে॥ ব্যথাপথের পথিক তুমি, চরণ চলে ব্যথা চুমি— কাঁদন দিয়ে সাধন আমার চিরদিনের তরে গো চিরজীবন ধ’রে॥ নয়নজলের বন্যা দেখে ভয় করি নে আর, আমি ভয় করি নে আর। মরণ-টানে টেনে আমায় করিয়ে দেবে পার, আমি তরব পারাবার। ঝড়ের হাওয়া আকুল গানে বইছে আজি তোমার পানে— ডুবিয়ে তরী ঝাঁপিয়ে পড়ি ঠেকব চরণ-’পরে, আমি বাঁচব চরণ ধরে॥/>
২১৯
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২১৯ তোমার কাছে শান্তি চাব না, থাক্-না আমার দুঃখ ভাবনা॥ অশান্তির এই দোলার ’পরে বোসো বোসো লীলার ভরে, দোলা দিব এ মোর কামনা॥ নেবে নিবুক প্রদীপ বাতাসে, ঝড়ের কেতন উড়ুক আকাশে— বুকের কাছে ক্ষণে ক্ষণে তোমার চরণ-পরশনে অন্ধকারে আমার সাধনা॥/>
২২০
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২২০ যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে॥ সব যে হয়ে গেল কালো, নিবে গেল দীপের আলো, আকাশ-পানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে?। অন্ধকারে রইনু পড়ে স্বপন মানি। ঝড় তে তোমার জয়ধ্বজা তাই কি জানি! সকাল বেলায় চেয়ে দেখি, দাঁড়িয়ে আছ তুমি এ কি ঘর-ভরা মোর শূন্যতারই বুকের ’পরে॥/>
২২১
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২২১ ভয়েরে মোর আঘাত করো ভীষণ, হে ভীষণ! কঠিন করে চরণ-’পরে প্রণত করো মন॥ বেঁধেছে মোরে নিত্য কাজে প্রাচীরে-ঘেরা ঘরের মাঝে, নিত্য মোরে বেঁধেছে সাজে সাজের আভরণ॥ এসো হে, ওহে আকস্মিক, ঘিরিয়া ফেলো সকল দিক, মুক্ত পথে উড়ায়ে নিক নিমেষে এ জীবন। তাহার ’পরে প্রকাশ হোক উদার তব সাহস চোখ— তব অভয় শান্তিময় স্বরূপ পুরাতন॥/>
২২২
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২২২ বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি, সে কি সহজ গান! সেই সুরেতে জাগব আমি, দাও মোরে সেই কান॥ আমি ভুলব না আর সহজেতে, সেই প্রাণে মন উঠবে মেতে মৃত্যু-মাঝে ঢাকা আছে যে অন্তহীন প্রাণ॥ সে ঝড় যেন সই আনন্দে চিত্তবীণার তারে সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত নাচাও যে ঝঙ্কারে। আরাম হতে ছিন্ন ক’রে সেই গভীরে লও গো মোরে অশান্তির অন্তরে যেথায় শান্তি সুমহান॥/>
২২৩
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২২৩ এই করেছ ভালো নিঠুর হে, নিঠুর হে, এই করেছ ভালো। এমনি ক’রে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো॥ আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে, আমার এ দীপ না জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো॥ যখন থাকে অচেতনে এ চিত্ত আমার আঘাত সে যে পরশ তব, সেই তো পুরস্কার। অন্ধকারে মোহে লাজে চোখে তোমায় দেখি না যে, বজ্রে তোলো আগুন ক’রে আমার যত কালো॥/>
২২৪
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২২৪ আরো আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারো। আরো কঠিন সুরে জীবন-তারে ঝঙ্কারো॥ যে রাগ জাগাও আমার প্রাণে বাজে নি তা চরম তানে, নিঠুর মূর্ছনায় সে গানে মূর্তি সঞ্চারো॥ লাগে না গো কেবল যেন কোমল করুণা, মৃদু সুরের খেলায় এ প্রাণ ব্যর্থ কোরো না। জ্ব’লে উঠুক সকল হুতাশ, গর্জি উঠুক সকল বাতাস, জাগিয়ে দিয়ে সকল আকাশ পূর্ণতা বিস্তারো॥/>
২২৫
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২২৫ আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে। এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর জীবন ভ’রে॥ না চাহিতে মোরে যা করেছ দান—আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ, দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায় সে মহা দানেরই যোগ্য ক’রে অতি-ইচ্ছার সঙ্কট হতে বাঁচায়ে মোরে॥ আমি কখনো বা ভুলি কখনো বা চলি তোমার পথের লক্ষ্য ধরে; তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ হতে যাও যে সরে। এ যে তব দয়া, জানি জানি হায়, নিতে চাও ব’লে ফিরাও আমায়— পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন তব মিলনেরই যোগ্য ক’রে আধা ইচ্ছার সঙ্কট হতে বাঁচায়ে মোরে॥/>
২২৬
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২২৬ প্রচণ্ড গর্জনে আসিল একি দুর্দিন— দারুণ ঘনঘটা, অবিরল অশনিতর্জন॥ ঘন ঘন দামিনী-ভুজঙ্গ-ক্ষত যামিনী, অম্বর করিছে অন্ধনয়নে অশ্রু-বরিষন॥ ছাড়ো রে শঙ্কা, জাগো ভীরু অলস, আনন্দে জাগাও অন্তরে শকতি। অকুণ্ঠ আঁখি মেলে হেরো প্রশান্ত বিরাজিত মহাভয়-মহাসনে অপরূপ মৃত্যুঞ্জয়রূপে ভয়হরণ॥/>
২২৭
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২২৭ বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা— বিপদে আমি না যেন করি ভয়। দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা, দুঃখে যেন করিতে পারি জয়॥ সহায় মোর না যদি জুটে নিজের বল না যেন টুটে— সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্চনা নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়॥ আমারে তুমি করিবে ত্রাণ এ নহে মোর প্রার্থনা— তরিতে পারি শকতি যেন রয়। আমার ভার লাঘব করি নাই বা দিলে সান্ত্বনা, বহিতে পারি এমনি যেন হয়॥ নম্রশিরে সুখের দিনে তোমারি মুখ লইব চিনে— দুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা তোমারে যেন না করি সংশয়॥/>
২২৮
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২২৮ আরো আরো, প্রভু, আরো আরো এমনি ক’রে আমায় মারো॥ লুকিয়ে থাকি, আমি পালিয়ে বেড়াই— ধরা পড়ে গেছি, আর কি এড়াই! যা-কিছু আছে সব কাড়ো কাড়ো॥ এবার যা করবার তা সারো সারো, আমি হারি কিম্বা তুমিই হারো। হাটে ঘাটে বাটে করি মেলা, কেবল হেসে খেলে গেছে বেলা— দেখি কেমনে কাঁদাতে পারো॥/>
২২৯
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২২৯ তোমার সোনার থালায় সাজাব আজ দুখের অশ্রুধার। জননী গো, গাঁথব তোমার গলার মুক্তাহার॥ চন্দ্র সূর্য পায়ের কাছে মালা হয়ে জড়িয়ে আছে, তোমার বুকে শোভা পাবে আমার দুখের অলঙ্কার॥ ধন ধান্য তোমারি ধন কী করবে তা কও। দিতে চাও তো দিয়ো আমায়, নিতে চাও তো লও। দুঃখ আমার ঘরের জিনিস, খাঁটি রতন তুই তো চিনিস— তোর প্রসাদ দিয়ে তারে কিনিস এ মোর অহঙ্কার॥/>
২৩০
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২৩০ দুখের বেশে এসেছ ব’লে তোমারে নাহি ডরিব হে। যেখানে ব্যথা তোমারে সেথা নিবিড় ক’রে ধরিব হে॥ আঁধারে মুখ ঢাকিলে, স্বামী, তোমারে তবু চিনিব আমি— মরণরূপে আসিলে, প্রভু, চরণ ধরি মরিব হে। যেমন করে দাও-না দেখা তোমারে নাহি ডরিব হে॥ নয়নে আজি ঝরিছে জল, ঝরুক জল নয়নে হে। বাজিছে বুকে বাজুক তব কঠিন বাহু-বাঁধন হে। তুমি যে আছ বক্ষে ধরে বেদনা তাহা জানাক মোরে— চাব না কিছু, কব না কথা, চাহিয়া রব বদনে হে॥/>
২৩১
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২৩১ তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি। তোমার সেবার মহান দুঃখ সহিবারে দাও ভকতি॥ আমি তাই চাই ভরিয়া পরান দুঃখের সাথে দুঃখের ত্রাণ, তোমার হাতের বেদনার দান এড়ায়ে চাহি না মুকতি। দুখ হবে মম মাথার ভূষণ সাথে যদি দাও ভকতি॥ যত দিতে চাও কাজ দিয়ো যদি তোমারে না দাও ভুলিতে, অন্তর যদি জড়াতে না দাও জালজঞ্জালগুলিতে। বাঁধিয়ো আমারে যত খুশি ডোরে মুক্ত রাখিয়ো তোমা-পানে মোরে, ধুলায় রাখিয়ো পবিত্র ক’রে তোমার চরণধূলিতে— ভুলায়ে রাখিয়ো সংসারতলে, তোমারে দিয়ো না ভুলিতে॥ যে পথে ঘুরিতে দিয়েছ ঘুরিব যাই যেন তব চরণে, সব শ্রম যেন বহি লয় মোরে সকলশ্রান্তিহরণে। দুর্গম পথ এ ভবগহন— কত ত্যাগ শোক বিরহদহন— জীবনে মৃত্যু করিয়া বহন প্রাণ পাই যেন মরণে— সন্ধ্যাবেলায় লভি গো কুলায় নিখিলশরণ চরণে॥/>
২৩২
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২৩২ দুখ দিয়েছ, দিয়েছ ক্ষতি নাই, কেন গো একেলা ফেলে রাখ? ডেকে নিলে ছিল যারা কাছে, তুমি তবে কাছে কাছে থাকো॥ প্রাণ কারো সাড়া নাহি পায়, রবি শশী দেখা নাহি যায়, এ পথে চলে যে অসহায়— তারে তুমি ডাকো, প্রভু, ডাকো॥ সংসারের আলো নিভাইলে, বিষাদের আঁধার ঘনায়, দেখাও তোমার বাতায়নে চির-আলো জ্বলিছে কোথায়। শুষ্ক নির্ঝরের ধারে রই, পিপাসিত প্রাণ কাঁদে ওই— অসীম প্রেমের উৎস কই, আমারে তৃষিত রেখো নাকো॥ কে আমার আত্মীয় স্বজন— আজ আসে, কাল চলে যায়। চরাচর ঘুরিছে কেবল, জগতের বিশ্রাম কোথায়। সবাই আপনা নিয়ে রয় কে কাহারে দিবে গো আশ্রয়— সংসারের নিরাশ্রয় জনে তোমার স্নেহেতে, নাথ, ঢাকো॥/>
২৩৩
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২৩৩ হে মহাদুঃখ, হে রুদ্র, হে ভয়ঙ্কর, ওহে শঙ্কর, হে প্রলয়ঙ্কর। হোক জটানিঃসৃত অগ্নিভুজঙ্গম -দংশনে জর্জর স্থাবর জঙ্গম, ঘন ঘন ঝন ঝন ঝননন ঝননন পিনাক টঙ্করো॥/>
২৩৪
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২৩৪ সর্ব খর্বতারে দহে তব ত্রোধদাহ— হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্ত-পানে চাহো॥ দূর করো মহারুদ্র যাহা মুগ্ধ, যাহা ক্ষুদ্র— মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উৎসাহ॥ দুঃখের মন্থনবেগে উঠিবে অমৃত, শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত। তব দীপ্ত রৌদ্র তেজে নির্ঝরিয়া গলিবে যে প্রস্তরশৃঙ্খলোন্মুক্ত ত্যাগের প্রবাহ॥/>
২৩৫
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২৩৫ নয় এ মধুর খেলা— তোমায় আমায় সারাজীবন সকাল-সন্ধ্যাবেলা নয় এ মধুর খেলা॥ কতবার যে নিবল বাতি, গর্জে এল ঝড়ের রাতি— সংসারের এই দোলায় দিলে সংশয়েরই ঠেলা॥ বারে বারে বাঁধ ভাঙিয়া বন্যা ছুটেছে। দারুণ দিনে দিকে দিকে কান্না উঠেছে। ওগো রুদ্র, দুঃখে সুখে এই কথাটি বাজল বুকে— তোমার প্রেমে আঘাত আছে, নাইকো অবহেলা॥/>
২৩৬
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২৩৬ জাগো হে রুদ্র, জাগো— সুপ্তিজড়িত তিমিরজাল সহে না, সহে না গো॥ এসো নিরুদ্ধ দ্বারে, বিমুক্ত করো তারে, তনুমনপ্রাণ ধনজনমান, হে মহাভিক্ষু, মাগো॥/>
২৩৭
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২৩৭ পিনাকেতে লাগে টঙ্কার— বসুন্ধরার পঞ্জরতলে কম্পন লাগে শঙ্কার॥ আকাশেতে লাগে ঘুর্ণি সৃষ্টির বাঁধ চুর্ণি, বজ্রভীষণ গর্জনরব প্রলয়ের জয়ডঙ্কার॥ স্বর্গ উঠিছে ক্রন্দি, সুরপরিষদ বন্দী— তিমিরগহন দুঃসহ রাতে উঠে শৃঙ্খলঝঙ্কার। দানবদম্ভ তর্জি রুদ্র উঠিল গর্জি— লণ্ডভণ্ড লুটিল ধুলায় অভ্রভেদী অহঙ্কার॥/>
২৩৮
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২৩৮ প্রাণে গান নাই, মিছে তাই ফিরিনু যে বাঁশিতে সে গান খুঁজে। প্রেমেরে বিদায় ক’রে দেশান্তরে বেলা যায় কারে পূজে॥ বনে তোর লাগাস আগুন, তবে ফাগুন কিসের তরে— বৃথা তোর ভস্ম-’পরে মরিস যুঝে॥ ওরে, তোর নিবিয়ে দিয়ে ঘরের বাতি কী লাগি ফিরিস পথে দিবারাতি— যে আলো শতধারায় আঁখিতারায় পড়ে ঝ’রে তাহারে কে পায় ওরে নয়ন বুজে?। />
২৩৯
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২৩৯ যা হারিয়ে যায় তা আগলে ব’সে রইব কত আর? আর পারি নে রাত জাগতে, হে নাথ, ভাবেত অনিবার॥ আছি রাত্রি দিবস ধ’রে দুয়ার আমার বন্ধ ক’রে, আসতে যে চায় সন্দেহে তায় তাড়াই বারে বার॥ তাই তো কারো হয় না আসা আমার একা ঘরে। আনন্দময় ভুবন তোমার বাইরে খেলা করে॥ তুমিও বুঝি পথ নাহি পাও, এসে এসে ফিরিয়া যাও— রাখতে যা চাই রয় না তাও, ধুলায় একাকার॥/>
২৪০
পূজা - দুঃখ
পূজা - দুঃখ
২৪০ আনন্দ তুমি স্বামি, মঙ্গল তুমি, তুমি হে মহাসুন্দর, জীবননাথ॥ শোকে দুখে তোমারি বাণী জাগরণ দিবে আনি, নাশিবে দারুণ অবসাদ॥ চিত মন অর্পিনু তব পদপ্রান্তে— শুভ্রশান্তিশতদল-পুণ্যমধু-পানে চাহি আছে সেবক, তব সুদৃষ্টিপাতে কবে হবে এ দুখরাত প্রভাত॥/>