২৯০
পূজা - নিঃসংশয়
পূজা - নিঃসংশয়
২৯০ ওদের কথায় ধাঁদা লাগে, তোমার কথা অমি বুঝি। তোমার আকাশতোমার বাতাস এই তো সবই সোজাসুজি॥ হৃদয়কুসুম আপনি ফোটে, জীবন আমার ভরে ওঠে— দুয়ার খুলে চেয়ে দেখি হাতের কাছে সকল পুঁজি॥ সকাল সাঁজে সুর যে বাজে ভুবন-জোড়া তোমার নাটে, আলোর জোয়ার বেয়ে তোমার তরী আসে আমার ঘাটে। শুনব কী আর বুঝব কী বা, এই তো দেখি রাত্রিদিবা ঘরেই তোমার আনাগোনা— পথে কি আর তোমায় খুঁজি॥
২৯১
পূজা - নিঃসংশয়
পূজা - নিঃসংশয়
২৯১ জানি নাই গো সাধন তোমার বলে কারে। আমি ধুলায় বসে খেলেছি এই তোমার দ্বারে॥ অবোধ আমিছিলেম বলে যেমন খুশি এলেম চলে, ভয় করি নি তোমায় আমি অন্ধকারে॥ তোমার জ্ঞানী আমায় বলে কঠিন তিরস্কারে, ’পথ দিয়ে তুই আসিস নি যে, ফিরে যা রে।’ ফেরারপন্থা বন্ধ করে আপনি বাঁধো বাহুর ডোরে, ওরা আমায় মিথ্যা ডাকে বারে বারে॥
২৯২
পূজা - নিঃসংশয়
পূজা - নিঃসংশয়
২৯২ আমায় ভুলতে দিতে নাইকো তোমার ভয়। আমার ভোলার আছে অন্ত, তোমার প্রেমের তো নাই ক্ষয়॥ দূরে গিয়েবাড়াই যে ঘুর, সে দূর শুধু আমারি দূর— তোমা কাছে দূর কভু দূর নয়॥ আমার প্রাণের কুঁড়ি পাপড়ি নাহি খোলে, তোমার বসন্তবায় নাই কি গো তাই বলে! এই খেলাতে আমার সনে হার মানো যে ক্ষণে ক্ষণে— হারের মাঝে আছে তোমার জয়॥
২৯৩
পূজা - নিঃসংশয়
পূজা - নিঃসংশয়
২৯৩ আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে ফুল ফুটবে। আমার সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে॥ আমার অনেক দিনের আকাশ-চাওয়া আসবে ছুটে দখিন-হাওয়া, হৃদয় আমার আকুল করে সুগন্ধধন লুটবে॥ আমার লজ্জা যাবে যখন পাব দেবার মতো ধন, যখন রূপ ধরিয়ে বিকশিবে প্রাণের আরাধন। আমার বন্ধু যখন রাত্রিশেষে পরশ তারে করবে এসে, ফুরিয়ে গিয়ে দলগুলি সব চরণে তার লুটবে॥
২৯৪
পূজা - নিঃসংশয়
পূজা - নিঃসংশয়
২৯৪ তাই তোমার আনন্দ আমার ’পর তুমি তাই এসেছ নীচে— আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে॥ আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা, আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা, মোর জীবনে বিচিত্র রূপ ধরে তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে॥ তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে তবু আমার হৃদয় লাগি ফিরছ কত মনোহরণ বেশে, প্রভু, নিত্য আছ জাগি। তাই তো, প্রভু যেথায় এল নেমে তোমারি প্রেম ভক্তপ্রাণের প্রেমে মূর্তি তোমার যুগলসম্মিলনে সেথায় পূর্ণ প্রকাশিছে॥
২৯৫
পূজা - নিঃসংশয়
পূজা - নিঃসংশয়
২৯৫ তব সিংহাসনের আসন হতে এলে তুমি নেমে— মোর বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে, নাথ, থেমে॥ একলা বসে আপন-মনে গাইতেছিলেম গান; তোমার কানে গেল সে সুর, এলে তুমি নেমে— মোর বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে, নাথ, থেমে॥ তোমার সভায় কত যে গান, কতই আছে গুণী— গুণহীনের গানখানি আজ বাজল তোমার প্রেমে! লাগল সকল তানের মাঝে একটি করুণ সুর, হাতে লয়ে বরণমালা এলে তুমি নেমে— মোর বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে, নাথ, থেমে॥
২৯৬
পূজা - নিঃসংশয়
পূজা - নিঃসংশয়
২৯৬ জীবনে যত পূজা হল না সারা জানি হে জানি তাও হয় নি হারা॥ যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে যে নদী মরুপথে হারালো ধারা জানি হে জানি তাও হয় নি হারা॥ জীবনে আজো যাহা রয়েছে পিছে জানি হে জানি তাও হয় নি মিছে। আমার অনাগত আমার অনাহত তোমার বীণাতারে বাজিছে তারা— জানি হে জানি তাও হয় নি হারা॥
২৯৭
পূজা - নিঃসংশয়
পূজা - নিঃসংশয়
২৯৭ জানি জানি কোন্ আদি কাল হতে ভাসালে আমারে জীবনের স্রোতে— সহসা, হে প্রিয়, কত গৃহে পথে রেখে গেছ প্রাণে কত হরষন॥ কতবার তুমি মেঘের আড়ালে এমনি মধুর হাসিয়া দাঁড়ালে, অরুণকিরণে চরণ বাড়ালে, ললাটে রাখিলে শুভ পরশন॥ সঞ্চিত হয়ে আছে এই চোখে কত কালে কালে কত লোকে লোকে কত নব নব আলোকে আলোকে অরূপের কত রূপদরশন। কত যুগে যুগে কেহ নাহি জানে ভরিয়া ভরিয়া উঠেছে পরানে কত সুখে দুখে কত প্রেমে গানে অমৃতের কত রসবরষন॥
২৯৮
পূজা - নিঃসংশয়
পূজা - নিঃসংশয়
২৯৮ তুমি যে আমারে চাও আমি সে জানি। কেন যে মোরে কাঁদাও আমি সে জানি॥ এ আলোকে এ আঁধারে কেন তুমি আপনারে ছায়াখানি দিয়ে ছাও আমি সে জানি॥ সারাদিন নানা কাজে কেন তুমি নানা সাজে কত সুরে ডাক দাও আমি সে জানি। সারা হলে দে’য়া-নে’য়া দিনান্তের শেষ খেয়া কোন্ দিক -পানে বাও আমি সে জানি॥
২৯৯
পূজা - নিঃসংশয়
পূজা - নিঃসংশয়
২৯৯ জানি হে যবে প্রভাত হবে তোমার কৃপা-তরণী লইবে মোরে ভবসাগর-কিনারে। করি না ভয়, তোমারি জয় গাহিয়া যাব চলিয়া, দাঁড়াব আসি তব অমৃতদুয়ারে হে প্রভু॥ জানি হে তুমি যুগে যুগে তোমার বাহু ঘেরিয়া রেখেছ মোরে তব অসীম ভুবনে হে— জনম মোরে দিয়েছ তুমি আলোক হতে আলোকে, জীবন হতে নিয়েছ নব জীবনে হে প্রভু॥ জানি হে নাথ, পুণ্যপাপে হৃদয় মোর সতত শয়ান আছে তব নয়নসমুখে হে প্রভু। আমার হাতে তোমার হাত রয়েছে দিনরজনী, সকল পথে-বিপথে সুখে-অসুখে হে প্রভু। জানি হে জানি, জীবন মম বিফল কভু হবে না, দিবে না ফেলি বিনাশভয়পাথারে হে— এমন দিন আসিবে যবে করুণাভরে আপনি ফুলের মত তুলিয়া লবে তাহারে হে প্রভু॥