Generated on: Fri Dec 19 2014

Home

::

Show All

::

Show Current

::

Scroll TOC Up| Down

Send a Comment

৩৩৪
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                       ৩৩৪

              আজিকে এই সকালবেলাতে
         বসে আছি আমার প্রাণের সুরটি মেলাতে॥
       আকাশে ওই অরুণ রাগে  মধুর তান করুণ লাগে,
         বাতাস মাতে আলোছায়ার মায়ার খেলাতে॥
         নীলিমা এই নিলীন হল আমার চেতনায়।
         সোনার আভা জড়িয়ে গেল মনের কামনায়।
       লোকান্তরের ও পার হতে  কে উদাসী বায়ুর স্রোতে
         ভেসে বেড়ায় দিগন্তে ওই মেঘের ভেলাতে॥
    
৩৩৫
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                       ৩৩৫

             যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে
             মিলাব তাই জীবনগানে॥
         গগনে তব বিমল নীল—হৃদয়ে লব তাহারি মিল,
             শান্তিময়ী গভীর বাণী নীরব প্রাণে॥
             বাজায় ঊষা নিশীথকূলে যে গীতভাষা
             সে ধ্বনি নিয়ে জাগিবে মোর নবীন আশা।
         ফুলের মতো সহজ সুরে  প্রভাত মোর উঠিবে পূরে,
             সন্ধ্যা মম সে সুরে যেন মরিতে জানে॥
    
৩৩৬
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                       ৩৩৬

               ওরে,  তোরা যারা শুনবি না
         তোদের তরে আকাশ-’পরে নিত্য বাজে কোন্‌ বীণা॥
        দূরের শঙ্খ উঠল বেজে,  পথে বাহির হল সে যে,
         দুয়ারে তোর আসবে কবে তার লাগি দিন গুনবি না?।
         রাতগুলো যায় হায় রে বৃথায়, দিনগুলো যায় ভেসে—
         মনে আশা রাখবি না কি মিলন হবে শেষে?
        হয়তো দিনের দেরি আছে,  হয়তো সে দিন আস্‌ল কাছে—
         মিলনরাতে ফুটবে যে ফুল তার কি রে বীজ বুনবি না?।
    
৩৩৭
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                       ৩৩৭

          মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে
          আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে॥
          তুমি আছ, বিশ্বনাথ, অসীম রহস্যমাঝে
          নীরবে একাকী আপন মহিমানিলয়ে॥
          অনন্ত এ দেশকালে, অগণ্য এ দীপ্ত লোকে,
          তুমি আছ মোরে চাহি—আমি চাহি তোমা-পানে।
          স্তব্ধ সর্ব কোলাহল, শান্তিমগ্ন চরাচর—
          এক তুমি, তোমা-মাঝে আমি একা নির্ভয়ে॥
    
৩৩৮
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                       ৩৩৮

          আছ আপন মহিমা লয়ে মোর গগনে রবি,
          আঁকিছ মোর মেঘের পটে তব রঙেরই ছবি॥
      তাপস, তুমি ধেয়ানে তব  কী দেখ মোরে কেমনে কব—
          তোমার জটে আমি তোমারি ভাবের জাহ্নবী॥
          তোমারি সোনা বোঝাই হল, আমি তো তার ভেলা।
          নিজেরে তুমি ভোলাবে ব’লে আমারে নিয়ে খেলা।
      কণ্ঠে মম কী কথা শোন  অর্থ আমি বুঝি না কোনো—
          বীণাতে মোর কাঁদিয়া ওঠে তোমারি ভৈরবী॥
    
৩৩৯
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                       ৩৩৯

         আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,
            আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে॥
         দেহমনের সুদূর পারে  হারিয়ে ফেলি আপনারে,
            গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধে ভাসে॥
            আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,
            দুঃখবিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে।
         বিশ্বধাতার যজ্ঞশালা,  আত্মহোমের বহ্নি জ্বালা—
            জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি-আশে॥
    
৩৪০
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                       ৩৪০

         আমার প্রাণে গভীর গোপন মহা-আপন সে কি,
             অন্ধকারে হঠাৎ তারে দেখি॥
         যবে দুর্দম ঝড়ে   আগল খুলে পড়ে,
             কার সে নয়ন-’পরে  নয়ন যায় গো ঠেকি॥
         যখন আসে পরম লগন তখন গগন-মাঝে
             তাহার ভেরী বাজে।
         বিদ্যুত-উদ্ভাসে  বেদনারই দূত আসে,
             আমন্ত্রণের বাণী  যায় হৃদয়ে লেখি॥
    
৩৪১
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                       ৩৪১

               আজি মর্মরধ্বনি কেন জাগিল রে!
          মম   পল্লবে পল্লবে  হিল্লোলে হিল্লোলে
                 থরথর কম্পন লাগিল রে॥
          কোন্‌ ভিখারি হায় রে   এল  আমারি এ অঙ্গনদ্বারে,
                 বুঝি  সব মন ধন মম মাগিল রে॥
                 হৃদয় বুঝি তারে জানে,
                 কুসুম ফোটায় তারি গানে।
          আজি মম অন্তরমাঝে  সেই  পথিকেরই পদধ্বনি বাজে,
              তাই  চকিতে চকিতে ঘুম ভাঙিল রে॥
    
৩৪২
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                       ৩৪২

            প্রথম আলোর চরণধ্বনি উঠল বেজে যেই
            নীড়বিরাগী হৃদয় আমার উধাও হল সেই॥
         নীল অতলের কোথা থেকে  উদাস তারে করল যে কে
            গোপনবাসী সেই উদাসীর ঠিক-ঠিকানা নেই॥
            ‘সুপ্তিশয়ন আয় ছেড়ে আয়’ জাগে রে তার ভাষা,
             সে বলে ‘চল্‌ আছে যেথায় সাগরপারের বাসা’।
         দেশ-বিদেশের সকল ধারা   সেইখানে হয় বাঁধনহারা,
             কোণের প্রদীপ মিলায় শিখা জ্যোতিসমুদ্রেই॥

    
৩৪৩
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                       ৩৪৩

        তোমার হাতের রাখীখানি বাঁধো আমার দখিন-হাতে
        সূর্য যেমন ধরার করে আলোক-রাখী জড়ায় প্রাতে॥
      তোমার আশিস আমার কাজে     সফল হবে বিশ্ব-মাঝে,
        জ্বলবে তোমার দীপ্ত শিখা আমার সকল বেদনাতে॥
        কর্ম করি যে হাত লয়ে কর্মবাঁধন তারে বাঁধে।
        ফলের আশা শিকল হয়ে জড়িয়ে ধরে জটিল ফাঁদে।
      তোমার রাখী বাঁধো আঁটি—সকল বাঁধন যাবে কাটি,
        কর্ম তখন বীণার মতো বাজবে মধুর মূর্ছনাতে॥
    
৩৪৪
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                       ৩৪৪

         বুঝেছি কি বুঝি নাই বা সে তর্কে  কাজ নাই,
         ভালো আমার লেগেছে যে রইল সেই কথাই॥
       ভোরের আলোয় নয়ন ভ’রে  নিত্যকে পাই নূতন করে,
                 কাহার মুখে চাই॥
         প্রতিদিনের কাজের পথে করতে আনাগোনা
         কানে আমার লেগেছে গান, করেছে আন্‌মনা।
         হৃদয়ে মোর কখন জানি  পড়ল পায়ের চিহ্নখানি
                 চেয়ে দেখি তাই॥
    
৩৪৫
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                       ৩৪৫

   ফেলে   রাখলেই কি পড়ে রবে  ও অবোধ।
   যে তার  দাম জানে সে কুড়িয়ে লবে  ও অবোধ॥
   ও যে   কোন্‌ রতন তা দেখ্‌-না ভাবি,  ওর ’পরে কি ধুলোর দাবি?
   ও      হারিয়ে গেলে তারি গলার হার গাঁথা যে ব্যর্থ হবে॥
   ওর     খোঁজ পড়েছে জানিস নে তা?
   তাই     দূত বেরোল হেথা সেথা।
   যারে     করলি হেলা সবাই মিলি  আদর যে তার বাড়িয়ে দিলি—
   যারে     দরদ দিলি তার ব্যথা কি সেই দরদীর প্রাণে সবে?।
    
৩৪৬
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                     ৩৪৬

         দেওয়া নেওয়া ফিরিয়ে-দেওয়া তোমায় আমায়—
         জনম জনম এই চলেছে, মরণ কভু তারে থামায়?।
   যখন   তোমার গানে আমি জাগি  আকাশে চাই তোমার লাগি,
   আবার  একতারাতে আমার গানে মাটির পানে তোমায় নামায়॥
   ওগো,  তোমার সোনার আলোর ধারা, তার ধারি ধার—
   আমার  কালো মাটির ফুল ফুটিয়ে শোধ করি তার।
   আমার  শরৎরাতের শেফালিবন  সৌরভেতে মাতে যখন
   তখন   পালটা সে গান লাগে তব শ্রাবণ-রাতের প্রেম-বরিষায়॥
    
৩৪৮
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                       ৩৪৮

         আমি   জ্বালব না মোর বাতায়নে প্রদীপ আনি,
         আমি   শুনব বসে আঁধার-ভরা গভীর বাণী॥
         আমার  এ দেহ মন মিলায়ে যাক নিশীথরাতে,
         আমার  লুকিয়ে-ফোটা এই হৃদয়ের পুষ্পপাতে
               থাক্‌-না ঢাকা মোর বেদনার গন্ধখানি॥
         আমার  সকল হৃদয় উধাও হবে তারার মাঝে
               যেখানে ওই আঁধারবীণায় আলো বাজে।
         আমার  সকল দিনের পথ খোঁজা এই হল সারা,
         এখন   দিক্‌-বিদিকের শেষে এসে দিশাহারা
               কিসের আশায় বসে আছি অভয় মানি॥
    
৩৪৯
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                       ৩৪৯

       আমি যখন তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই  তখন যাহা পাই
              সে যে আমি হারাই বারে বারে॥
       তিনি যখন ভিক্ষা নিতে আসেন আমার দ্বারে
       বন্ধ তালা ভেঙে দেখি আপন-মাঝে গোপন রতনভার,
       হারায় না সে আর॥
       প্রভাত আসে তাঁহার কাছে আলোক ভিক্ষা নিতে,
       সে আলো তার লুটায় ধরণীতে।
       তিনি যখন সন্ধ্যা-কাছে দাঁড়ান ঊধর্বকরে  তখন স্তরে স্তরে
       ফুটে ওঠে অন্ধকারের আপন প্রাণের ধন,
       মুকুটে তাঁর পরেন সে রতন॥
    
৩৫০
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                       ৩৫০

  আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে  তোমারি নাম সকল তারার মাঝে॥
  সে নামখানি নেমে এল ভুঁয়ে,   কখন আমার ললাট দিল ছুঁয়ে,
  শান্তিধারায় বেদন গেল ধুয়ে—   আপন আমার আপনি মরে লাজে॥
  মন মিলে যায় আজ ওই নীরব রাতে  তারায়-ভরা ওই গগনের সাথে।
  অমনি করে আমার এ হৃদয়  তোমার নামে হোক-না নামময়,
  আঁধারে মোর তোমার আলোর জয়  গভীর হয়ে থাক্‌ জীবনের কাজে॥
    
৩৫১
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
          অকারণে অকালে মোর পড়ল যখন ডাক
              তখন আমি ছিলেম শয়ন পাতি।
          বিশ্ব তখন তারার আলোয় দাঁড়ায়ে নির্বাক্‌,
              ধরায় তখন তিমিরগহন রাতি।
              ঘরের লোকে কেঁদে কইল মোরে,
              ‘আঁধারে পথ চিনবে কেমন ক’রে?’
          আমি কইনু, ‘চলব আমি নিজের আলো ধরে,
              হাতে আমার এই-যে আছে বাতি।’
          বাতি যতই উচ্চ শিখায় জ্বলে আপন তেজে
              চোখে ততই লাগে আলোর বাধা,
          ছায়ায় মিশে চারি দিকে মায়া ছড়ায় সে-যে—
              আধেক দেখা করে আমায় আঁধা।
              গর্বভরে যতই চলি বেগে
              আকাশ তত ঢাকে ধুলার মেঘে,
          শিখা আমার কেঁপে ওঠে অধীর হাওয়া লেগে,
              পায়ে পায়ে সৃজন করে ধাঁদা॥
          হঠাৎ শিরে লাগল আঘাত বনের শাখাজালে,
              হঠাৎ হাতে নিবল আমার বাতি।
          চেয়ে দেখি পথ হারিয়ে ফেলেছি কোন্‌ কালে—
              চেয়ে দেখি, তিমিরগহন রাতি।
              কেঁদে বলি মাথা করে নিচু,
              ‘শক্তি আমার রইল না আর কিছু!’
          সেই নিমেষে হঠাৎ দেখি, কখন পিছু পিছু
              এসেছে মোর চিরপথের সাথি॥
    
৩৫২
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                ভুবনজোড়া আসনখানি
         আমার   হৃদয়-মাঝে বিছাও আনি॥
         রাতের তারা, দিনের রবি,  আঁধার-আলোর সকল ছবি,
  তোমার   আকাশ-ভরা সকল বাণী  হৃদয়-মাঝে বিছাও আনি॥
                ভুবনবীণার সকল সুরে
         আমার   হৃদয় পরান দাও-না পূরে।
         দুঃখসুখের সকল হরষ,  ফুলের পরশ, ঝড়ের পরশ—
  তোমার   করুণ শুভ উদার পাণি 
            আমার হৃদয়-মাঝে দিক্‌-না আনি॥
    
৩৫৩
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                  ডাকে বার বার ডাকে,
          শোনো রে, দুয়ারে দুয়ারে আঁধারে আলোকে॥
          কত সুখদুঃখশোকে  কত মরণে জীবনলোকে
                  ডাকে বজ্রভয়ঙ্কর রবে,
          সুধাসঙ্গীতে ডাকে দ্যুলোকে ভূলোকে॥
    
৩৫৪
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
          অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
                সেই তো তোমার আলো!
          সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো
                সেই তো তোমার ভালো॥
          পথের ধুলায় বক্ষ পেতে রয়েছে যেই গেহ
                সেই তো তোমার গেহ।
          সমরঘাতে অমর করে রুদ্রনিঠুর স্নেহ
                সেই তো তোমার স্নেহ।
          সব ফুরালে বাকি রহে অদৃশ্য যেই দান
                সেই তো তোমার দান।
          মৃত্যু আপন পাত্রে ভরি বহিছে যেই প্রাণ
                সেই তো তোমার প্রাণ॥
          বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি
                সেই তো স্বর্গভূমি।
          সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি
                সেই তো আমার তুমি॥
    
৩৫৫
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
           সারা জীবন দিল আলো সূর্য গ্রহ চাঁদ
           তোমার আশীর্বাদ, হে প্রভু, তোমার আশীর্বাদ॥
         মেঘের কলস ভ’রে ভ’রে  প্রসাদবারি পড়ে ঝ’রে,
           সকল দেহে প্রভাত বায়ু ঘুচায় অবসাদ—
           তোমার আশীর্বাদ, হে প্রভু, তোমার আশীর্বাদ॥
           তৃণ যে এই ধুলার ’পরে পাতে আঁচলখানি,
           এই-যে আকাশ চিরনীরব অমৃতময় বাণী,
         ফুল যে আসে দিনে দিনে  বিনা রেখার পথটি চিনে,
           এই-যে ভুবন দিকে দিকে পূরায় কত সাধ—
           তোমার আশীর্বাদ, হে প্রভু, তোমার আশীর্বাদ॥
    
৩৫৬
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
             আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,
             বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া॥
         এই-যে বিপুল ঢেউ লেগেছে  তোর মাঝেতে উঠুক নেচে,
                সকল পরান দিক-না নাড়া॥
             বোস্‌-না ভ্রমর, এই নীলিমায় আসন লয়ে
             অরুণ-আলোর স্বর্ণরেণু-মাখা হয়ে।
         যেখানেতে অগাধ ছুটি   মেল সেথা তোর ডানাদুটি,
                সবার মাঝে পাবি ছাড়া॥
    
৩৫৭
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      যে থাকে   থাক‌-না দ্বারে,   যে যাবি   যা-না পারে॥
      যদি ওই    ভোরের পাখি  তোরি নাম  যায় রে ডাকি
                একা তুই   চলে যা রে॥
      কুঁড়ি চায়    আঁধার রাতে   শিশিরের  রসে মাতে।
      ফোটা ফুল    চায় না নিশা,  প্রাণে তার  আলোর তৃষা,
                  কাঁদে সে   অন্ধকারে॥
    
৩৫৮
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
            আকাশে    দুই হাতে প্রেম বিলায় ও কে!
            সে সুধা    গড়িয়ে গেল লোকে লোকে॥
            গাছেরা     ভরে নিল সবুজ পাতায়,
            ধরণী       ধরে নিল আপন মাথায়।
            ছেলেরা      সকল গায়ে নিল মেখে,
            পাখিরা      পাখায় পাখায় নিল এঁকে।
            ছেলেরা     কুড়িয়ে নিল মায়ের বুকে,
            মায়েরা      দেখে নিল ছেলের মুখে।
            সে যে ওই   দুঃখশিখায় উঠল জ্বলে,
            সে যে ওই   অশ্রুধারায় পড়ল গলে॥
            সে যে ওই   বিদীর্ণ বীর-হৃদয় হতে
            বহিল       মরণরূপী জীবনস্রোতে।
            সে যে ওই   ভাঙাগড়ার তালে তালে
            নেচে যায়    দেশে দেশে কালে কালে॥
    
৩৫৯
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
              নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে ফুলবনে
       তারি    মধু কেন মনমধুপে খাওয়াও না?
              নিত্যসভা বসে তোমার প্রাঙ্গণে,
       তোমার   ভৃত্যেরে সেই সভায় কেন গাওয়াও না?।
              বিশ্বকমল ফুটে চরণচুম্বনে,
       সে যে   তোমার মুখে মুখ তুলে চায় উন্মনে,
              আমার চিত্ত-কমলটিরে সেই রসে
       কেন    তোমার পানে নিত্য-চাওয়া চাওয়াও না?।
              আকাশে ধায় রবি-তারা ইন্দুতে,
       তোমার   বিরামহারা নদীরা যায় সিন্ধুতে,
               তেমনি করে সুধাসাগর-সন্ধানে
       আমার    জীবনধারা নিত্য কেন ধাওয়াও না?
               পাখির কণ্ঠে আপনি জাগাও আনন্দ,
       তুমি      ফুলের বক্ষে ভরিয়া দাও সুগন্ধ,
                তেমনি করে আমার হৃদয়ভিক্ষুরে
       কেন      দ্বারে তোমার নিত্য প্রসাদ পাওয়াও না?।
    
৩৬০
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
               এমনি করে ঘুরিব দূরে বাহিরে,
               আর তো গতি নাহি রে মোর নাহি রে॥
               যে পথে তব রথের রেখা ধরিয়া
               আপনা হতে কুসুম উঠে ভরিয়া,
        চন্দ্র ছুটে, সূর্য ছুটে,  সে পথতলে পড়িব লুটে—
               সবার পানে রহিব শুধু চাহি রে॥
               তোমার ছায়া পড়ে যে সরোবরে গো
               কমল সেথা ধরে না, নাহি ধরে গো।
        জলের ঢেউ তরল তানে   সে ছায়া লয়ে মাতিল গানে,
               ঘিরিয়া তারে ফিরিব তরী বাহি রে।
               যে বাঁশিখানি বাজিছে তব ভবনে
               সহসা তাহা শুনিব মধু পবনে।
        তাকায়ে রব দ্বারের পানে,  সে তানখানি লইয়া কানে
               বাজায়ে বীণা বেড়াব গান গাহি রে॥
    
৩৬১
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
         কোলাহল তো বারণ হল, এবার কথা কানে কানে।
         এখন হবে প্রাণের আলাপ কেবলমাত্র গানে গানে॥
       রাজার পথে লোক ছুটেছে, বেচা-কেনার হাঁক উঠেছে,
         আমার ছুটি অবেলাতেই দিন-দুপুরের মধ্যখানে—
         কাজের মাঝে ডাক পড়েছে কেন যে তা কেই-বা জানে॥
         মোর কাননে অকালে ফুল উঠুক তবে মুঞ্জরিয়া।
         মধ্যদিনে মৌমাছিরা বেড়াক মৃদু গুঞ্জরিয়া।
       মন্দভালোর দ্বন্দ্বে খেটে   গেছে তো দিন অনেক কেটে,
         অলস বেলার খেলার সাথি এবার আমার হৃদয় টানে।
              বিনা কাজের ডাক পড়েছে
                    কেন যে তা কেই-বা জানে॥
    
৩৬২
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
            যেথায় তোমার লুট হতেছে ভুবনে
            সেইখানে মোর চিত্ত যাবে কেমনে॥
        সোনার ঘটে সূর্য তারা  নিচ্ছে তুলে আলোর ধারা,
            অনন্ত প্রাণ ছড়িয়ে পড়ে গগনে॥
            যেথায় তুমি বস দানের আসনে
            চিত্ত আমার সেথায় যাবে কেমনে?
        নিত্য নূতন রসে ঢেলে  আপনাকে যে দিচ্ছ মেলে,
            সেথা কি ডাক পড়বে না গো জীবনে?।
    
৩৬৩
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
            বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
            সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও॥
      নয়কো বনে, নয় বিজনে,   নয়কো আমার আপন মনে—
      সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়,  সেথায় আপন আমারও॥
            সবার পানে যেথায় বাহু পসারো
            সেইখানেতেই প্রেম জাগিবে আমারও।
      গোপনে প্রেম রয় না ঘরে,  আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে—
      সবার তুমি আনন্দধন হে প্রিয়,    আনন্দ সেই আমারও॥
    
৩৬৪
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        প্রভু,  আজি তোমার দক্ষিণ হাত রেখো না ঢাকি।
             এসেছি তোমারে, হে নাথ, পরাতে রাখী॥
        যদি বাঁধি তোমার হাতে    পড়ব বাঁধা সবার সাথে,
             যেখানে যে আছে কেহই রবে না বাকি॥
             আজি যেন ভেদ নাহি রয় আপনা পরে,
             তোমায় যেন এক দেখি হে বাহিরে ঘরে।
        তোমা সাথে যে বিচ্ছেদে  ঘুরে বেড়াই কেঁদে কেঁদে
             ক্ষণেকতরে ঘুচাতে তাই তোমারে ডাকি॥
    
৩৬৫
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  অমন   আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না।
  এবার   হৃদয়-মাঝে লুকিয়ে বোসো,  কেউ জানবে না, কেউ বলবে না॥
        বিশ্বে তোমার লুকোচুরি,    দেশ-বিদেশে কতই ঘুরি—
  এবার   বলো আমার মনের কোণে   দেবে ধরা, ছলবে না॥
        জানি আমার কঠিন হৃদয়    চরণ রাখার যোগ্য সে নয়—
  সখা,   তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়  তবু কি প্রাণ গলবে না?
        নাহয় আমার নাই সাধনা—ঝরলে তোমার কৃপার কণা
  তখন   নিমেষে কি ফুটবে না ফুল,  চকিতে ফল ফলবে না?।
    
৩৬৬
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      কত অজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই—
      দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই॥
  পুরানো আবাস ছেড়ে যাই যবে  মনে ভেবে মরি কী জানি কী হবে—
      নূতনের মাঝে তুমি পুরাতন সে কথা যে ভুলে যাই॥
      জীবনে মরণে নিখিল ভুবনে যখনি যেখানে লবে
      চিরজনমের পরিচিত ওহে তুমিই চিনাবে সবে।
  তোমারে জানিলে নাহি কেহ পর, নাহি কোনো মানা, নাহি কোনো ডর—
      সবারে মিলায়ে তুমি জাগিতেছ দেখা যেন সদা পাই॥
    
৩৬৭
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
         সবার মাঝারে তোমারে স্বীকার করিব হে।
         সবার মাঝারে তোমারে হৃদয়ে বরিব হে॥
         শুধু আপনার মনে নয়,  আপন ঘরের কোণে নয়,
  শুধু আপনার রচনার মাঝে নহে—তোমার মহিমা যেথা উজ্জ্বল রহে
         সেই সবা-মাঝে তোমারে স্বীকার করিব হে।
দ্যুলোকে ভূলোকে তোমারে হৃদয়ে বরিব হে॥
         সকলই তেয়াগি তোমারে স্বীকার করিব হে।
         সকলই গ্রহণ করিয়া তোমারে বরিব হে।
         কেবলই তোমার স্তবে নয়,  শুধু সঙ্গীতরবে নয়,
  শুধু নির্জনে ধ্যানের আসনে নহে—তব সংসার যেথা জাগ্রত রহে,
         কর্মে সেথায় তোমারে স্বীকার করিব হে।
         প্রিয়ে অপ্রিয়ে তোমারে হৃদয়ে বরিব হে॥
         জানি না বলিয়া তোমারে স্বীকার করিব হে।
         জানি ব’লে, নাথ, তোমারে হৃদয়ে বরিব হে।
         শুধু জীবনের সুখে নয়,   শুধু প্রফুল্লমুখে নয়,
  শুধু সুদিনের সহজ সুযোগে নহে— দুখশোক যেথা আঁধার করিয়া রহে
         নত হয়ে সেথা তোমারে স্বীকার করিব হে।
         নয়নের জলে তোমারে হৃদয়ে বরিব হে॥
    
৩৬৮
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  মোরে  ডাকি লয়ে যাও মুক্তদ্বারে  তোমার বিশ্বের সভাতে
              আজি  এ মঙ্গলপ্রভাতে॥
  উদয়গিরি হতে উচ্চে কহো মোরে ঃ  তিমির লয় হল দীপ্তিসাগরে—
  স্বার্থ হতে জাগো, দৈন্য হতে জাগো, সব জড়তা হতে জাগো জাগো রে
              সতেজ উন্নত শোভাতে॥
  বাহির করো তব পথের মাঝে,  বরণ করো মোরে তোমার কাজে।
  নিবিড় আবরণ করো বিমোচন,  মুক্ত করো সব তুচ্ছ শোচন,
  ধৌত করো মম মুগ্ধ লোচন  তোমার উজ্জ্বল শুভ্ররোচন
              নবীন নির্মল বিভাতে॥
    
৩৬৯
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক্‌, তারা তো পারে না জানিতে—
     তাহাদের চেয়ে তুমি কাছে আছ আমার হৃদয়খানিতে॥
   যারা কথা বলে তাহারা বলুক,  আমি করিব না কারেও বিমুখ—
     তারা নাহি জানে ভরা আছে প্রাণ তব অকথিত বাণীতে।
     নীরবে নিয়ত রয়েছ আমার নীরব হৃদয়খানিতে॥
   তোমার লাগিয়া কারেও, হে প্রভু,  পথ ছেড়ে দিতে বলিব না কভু,
     যত প্রেম আছে সব প্রেম মোরে তোমা-পানে রবে টানিতে—
     সকলের প্রেমে রবে তব প্রেম আমার হৃদয়খানিতে।
   সবার সহিতে তোমার বাঁধন   হেরি যেন সদা এ মোর সাধন—
     সবার সঙ্গ পারে যেন মনে তব আরাধনা আনিতে।
          সবার মিলনে তোমার মিলন
                    জাগিবে হৃদয়খানিতে॥
    
৩৭০
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                জাগ্রত বিশ্বকোলাহল-মাঝে
              তুমি গম্ভীর, স্তব্ধ, শান্ত, নির্বিকার,
                    পরিপূর্ণ মহাজ্ঞান॥
          তোমা-পানে ধায় প্রাণ  সব কোলাহল ছাড়ি,
                চঞ্চল নদী যেমন ধায় সাগরে॥
    
৩৭১
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
               শান্তিসমুদ্র তুমি গভীর,
                   অতি অগাধ আনন্দরাশি।
               তোমাতে সব দুঃখ জ্বালা
                   করি নির্বাণ ভুলিব সংসার,
                অসীম সুখসাগরে ডুবে যাব॥
    
৩৭২
পূজা - বিশ্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
             ডুবি অমৃতপাথারে— যাই ভুলে চরাচর,
                     মিলায় রবি শশী॥
             নাহি দেশ, নাহি কাল, নাহি হেরি সীমা—
                 প্রেমমুরতি হৃদয়ে জাগে,
                     আনন্দ নাহি ধরে॥