৫৫৯
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৫৯ আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ। খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত॥ কারা এই সমুখ দিয়ে আসে যায় খবর নিয়ে, খুশি রই আপন-মনে— বাতাস বহে সুমন্দ॥ সারাদিন আঁখি মেলে দুয়ারে রব একা, শুভখন হঠাৎ এলে তখনি পাব দেখা। ততখন ক্ষণে ক্ষণে হাসি গাই আপন-মনে, ততখন রহি রহি ভেসে আসে সুগন্ধ॥
৫৬০
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৬০ হাওয়া লাগে গানের পালে— মাঝি আমার, বোসো হালে॥ এবার ছাড়া পেলে বাঁচে, জীবনতরী ঢেউয়ে নাচে এই বাতাসের তালে তালে॥ দিন গিয়েছে, এল রাতি, নাই কেহ মোর ঘাটের সাথি। কাটো বাঁধন, দাও গো ছাড়ি— তারার আলোয় দেব পাড়ি, সুর জেগেছে যাবার কালে॥
৫৬১
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৬১ পথ দিয়ে কে যায় গো চলে ডাক দিয়ে সে যায়। আমার ঘরে থাকাই দায়॥ পথের হাওয়ায় কী সুর বাজে, বাজে আমার বুকের মাঝে— বাজে বেদনায়॥ পূর্ণিমাতে সাগর হতে ছুটে এল বান, আমার লাগল প্রাণে টান। আপন-মনে মেলে আঁখি আর কেন বা পড়ে থাকি কিসের ভাবনায়॥
৫৬২
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৬২ এই আসা-যাওয়ার খেয়ার কূলে আমার বাড়ি। কেউ বা আসে এ পারে, কেউ পারের ঘাটে দেয় রে পাড়ি॥ পথিকেরা বাঁশি ভ’রে যে সুর আনে সঙ্গে ক’রে তাই যে আমার দিবানিশি সকল পরান লয় রে কাড়ি॥ কার কথা যে জানায় তারা জানি নে তা, হেথা হতে কী নিয়ে বা যায় রে সেথা। সুরের সাথে মিশিয়ে বাণী দুই পারের এই কানাকানি, তাই শুনে যে উদাস হিয়া চায় রে যেতে বাসা ছাড়ি॥
৫৬৩
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৬৩ আমার আর হবে না দেরি— আমি শুনেছি ওই বাজে তোমার ভেরী॥ তুমি কি, নাথ, দাঁড়িয়ে আছ আমার যাবার পথে? মনে হয় যে ক্ষণে ক্ষণে মোর বাতায়ন হতে তোমায় যেন হেরি— আমার আর হবে না দেরি॥ আমার স্বপন হল সারা, এখন প্রাণে বীণা বাজায় ভোরের তারা। দেবার মতো যা ছিল মোর নাই কিছু আর হাতে, তোমার আশীর্বাদের মালা নেব কেবল মাথে আমার ললাট ঘেরি— আমার আর হবে না দেরি॥
৫৬৪
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৬৪ পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে, পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া। যাত্রাপথের আনন্দগান যে গাহে তারি কণ্ঠে তোমারি গান গাওয়া॥ চায় না সে জন পিছন-পানে ফিরে, বায় না তরী কেবল তীরে তীরে, তুফান তারে ডাকে অকূল নীরে যার পরানে লাগল তোমার হাওয়া॥ পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে, পথিকচিত্তে তোমার তরী বাওয়া। দুয়ার খুলে সমুখ-পানে যে চাহে তার চাওয়া যে তোমার পানে চাওয়া। বিপদ বাধা কিছুই ডরে না সে, রয় না পড়ে কোনো লাভের আশে, যাবার লাগি মন তারি উদাসে— যাওয়া সে যে তোমার পানে যাওয়া॥
৫৬৫
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৬৫ ওগো, পথের সাথি, নমি বারম্বার। পথিকজনের লহো লহো নমস্কার॥ ওগো বিদায়, ওগো ক্ষতি, ওগো দিনশেষের পতি, ভাঙা বাসার লহো নমস্কার॥ ওগো নব প্রভাতজ্যোতি, ওগো চিরদিনের গতি, নব আশার লহো নমস্কার। জীবনরথের হে সারথি, আমি নিত্য পথের পথী, পথে চলার লহো লহো লহো নমস্কার॥
৫৬৬
পূজা - পথ
পূজা - পথ
অশ্রুনদীর সুদূর পারে ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে॥ নিজের হাতে নিজে বাঁধা ঘরে আধা বাইরে আধা— এবার ভাসাই সন্ধ্যাহাওয়ায় আপনারে॥ কাটল বেলা হাটের দিনে লোকের কথার বোঝা কিনে। কথার সে ভার নামা রে মন, নীরব হয়ে শোন্ দেখি শোন্ পারের হাওয়ায় গান বাজে কোন্ বীণার তারে॥
৫৬৭
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৬৭ পথিক হে, ওই-যে চলে, ওই-যে চলে সঙ্গী তোমার দলে দলে॥ অন্যমনে থাকি কোণে, চমক লাগে ক্ষণে ক্ষণে— হঠাৎ শুনি জলে স্থলে পায়ের ধ্বনি আকাশতলে॥ পথিক হে, পথিক হে, যেতে যেতে পথের থেকে আমায় তুমি যেয়ো ডেকে। যুগে যুগে বারে বারে এসেছিলে আমার দ্বারে— হঠাৎ যে তাই জানিতে পাই, তোমার চলা হৃদয়তলে॥
৫৬৮
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৬৮ এবার রঙিয়ে গেল হৃদয়গগন সাঁঝের রঙে। আমার সকল বাণী হল মগন সাঁঝের রঙে॥ মনে লাগে দিনের পরে পথিক এবার আসবে ঘরে, আমার পূর্ণ হবে পুণ্যলগন সাঁঝের রঙে॥ অস্তাচলের সাগরকূলের এই বাতাসে ক্ষণে ক্ষণে চক্ষে আমার তন্দ্রা আসে। সন্ধ্যাযূথীর গন্ধভারে পান্থ যখন আসবে দ্বারে আমার আপনি হবে নিদ্রাভগন সাঁঝের রঙে॥
৫৬৯
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৬৯ হার মানালে গো, ভাঙিলে অভিমান হায় হায়। ক্ষীণ হাতে জ্বালা ম্লান দীপের থালা হল খান্ খান্ হায় হায়॥ এবার তবে জ্বালো আপন তারার আলো, রঙিন ছায়ার এই গোধূলি হোক অবসান হায় হায়॥ এসো পারের সাথি— বইল পথের হাওয়া, নিবল ঘরের বাতি। আজি বিজন বাটে, অন্ধকারের ঘাটে সব-হারানো নাটে এনেছি এই গান হায় হায়॥
৫৭০
পূজা - পথ
পূজা - পথ
আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো। তাই তো তোমার বাণী বাজে ঝর্না-ঝরানো॥ আমার বাঁশি তোমার হাতে ফুটোর পরে ফুটো তাতে— তাই শুনি সুর এমন মধুর পরান-ভরানো॥ তোমার হাওয়া যখন জাগে আমার পালে বাধা লাগে— এমন করে গায়ে প’ড়ে সাগর-তরানো। ছাড়া পেলে একেবারে রথ কি তোমার চলতে পারে— তোমার হাতে আমার ঘোড়া লাগাম-পরানো॥
৫৭১
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৭১ তুমি হঠাৎ-হাওয়ায় ভেসে-আসা ধন— তাই হঠাৎ-পাওয়ায় চমকে ওঠে মন॥ গোপন পথে আপন-মনে বাহির হও যে কোন্ লগনে, হঠাৎ-গন্ধে মাতাও সমীরণ॥ নিত্য যেথায় আনাগোনা হয় না সেথায় চেনাশোনা, উড়িয়ে ধুলো আসছে কতই জন। কখন পথের বাহির থেকে হঠাৎ বাঁশি যায় যে ডেকে, পথহারাকে করে সচেতন॥
৫৭২
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৭২ পথে চলে যেতে যেতে কোথা কোন্খানে তোমার পরশ আসে কখন কে জানে॥ কী অচেনা কুসুমের গন্ধে, কী গোপন আপন আনন্দে, কোন্ পথিকের কোন্ গানে॥ সহসা দারুণ দুখতাপে সকল ভুবন যবে কাঁপে, সকল পথের ঘোচে চিহ্ন সকল বাঁধন যবে ছিন্ন মৃত্যু-আঘাত লাগে প্রাণে— তোমার পরশ আসে কখন কে জানে॥
৫৭৩
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৭৩ আমার ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন! তারি গলার মালা হতে পাপড়ি হোথা লুটায় ছিন্ন॥ এল যখন সাড়াটি নাই, গেল চলে জানালো তাই— এমন ক’রে আমারে হায় কে বা কাঁদায় সে জন ভিন্ন॥ তখন তরুণ ছিল অরুণ আলো, পথটি ছিল কুসুমকীর্ণ। বসন্ত যে রঙিন বেশে ধরায় সে দিন অবতীর্ণ। সে দিন খবর মিলল না যে, রইনু বসে ঘরের মাঝে— আজকে পথে বাহির হব বহি আমার জীবন জীর্ণ॥
৫৭৪
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৭৪ পাতার ভেলা ভাসাই নীরে, পিছন-পানে চাই নে ফিরে॥ কর্ম আমার বোঝাই ফেলা, খেলা আমার চলার খেলা। হয় নি আমার আসন মেলা, ঘর বাঁধি নি স্রোতের তীরে॥ বাঁধন যখন বাঁধতে আসে ভাগ্য আমার তখন হাসে॥ ধুলা-ওড়া হাওয়ার ডাকে পথ যে টেনে লয় আমাকে— নতুন নতুন বাঁকে বাঁকে গান দিয়ে যাই ধরিত্রীরে॥
৫৭৫
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৭৫ আমাদের খেপিয়ে বেড়ায় যে কোথায় লুকিয়ে থাকে রে?। ছুটল বেগে ফাগুন-হাওয়া কোন্ খ্যাপামির নেশায় পাওয়া, ঘূর্ণা হাওয়ায় ঘুরিয়ে দিল সূর্যতারাকে॥ কোন্ খ্যাপামির তালে নাচে পাগল সাগর-নীর। সেই তালে যে পা ফেলে যাই, রইতে নারি স্থির। চল্ রে সোজা, ফেল্ রে বোঝা, রেখে দে তোর রাস্তা-খোঁজা, চলার বেগে পায়ের তলায় রাস্তা জেগেছে॥
৫৭৬
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৭৬ চলি গো, চলি গো, যাই গো চলে। পথের প্রদীপ জ্বলে গো গগনতলে॥ বাজিয়ে চলি পথের বাঁশি, ছড়িয়ে চলি চলার হাসি, রঙিন বসন উড়িয়ে চলি জলে স্থলে॥ পথিক ভুবন ভালোবাসে পথিকজনে রে। এমন সুরে তাই সে ডাকে ক্ষণে ক্ষণে রে। চলার পথের আগে আগে ঋতুর ঋতুর সোহাগ জাগে, চরণ-ঘায়ে মরণ মরে পলে পলে॥
৫৭৭
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৭৭ এখন আমার সময় হল, যাবার দুয়ার খোলো খোলো॥ হল দেখা, হল মেলা, আলোছায়ায় হল খেলা— স্বপন যে সে ভোলো ভোলো॥ আকাশ ভরে দূরের গানে, অলখ দেশে হৃদয় টানে। ওগো সুদূর, ওগো মধুর, পথ বলে দাও পরানবঁধুর— সব আবরণ তোলো তোলো॥
৫৭৮
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৭৮ ওরে পথিক, ওরে প্রেমিক, বিচ্ছেদে তোর খণ্ড মিলন পূর্ণ হবে। আয় রে সবে প্রলয়গানের মহোৎসবে॥ তাণ্ডবে ওই তপ্ত হাওয়ায় ঘূর্ণি লাগায়, মত্ত ঈশান বাজায় বিষাণ, শঙ্কা জাগায়— ঝঙ্কারিয়া উঠল আকাশ ঝঞ্ঝারবে॥ ভাঙন-ধরার ছিন্ন-করার রুদ্র নাটে যখন সকল ছন্দ বিকল, বন্ধ কাটে, মুক্তিপাগল বৈরাগীদের চিত্ততলে প্রেমসাধনার হোমহুতাশন জ্বলবে তবে। ওরে পথিক, ওরে প্রেমিক, সব আশাজাল যায় রে যখন উড়ে পুড়ে আশার অতীত দাঁড়ায় তখন ভুবন জুড়ে— স্তব্ধ বাণী নীরব সুরে কথা কবে। আয় রে সবে প্রলয়গানের মহোৎসবে॥
৫৭৯
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৭৯ মোর পথিকেরে বুঝি এনেছ এবার মোর করুণ রঙিন পথ! এসেছে এসেছে আহা অঙ্গনে এসেছে, মোর দুয়ারে লেগেছে রথ॥ সে যে সাগরপারের বাণী মোর পরানে দিয়েছে আনি, আহা তার আঁখির তারায় যেন গান গায় অরণ্যপর্বত॥ দুঃখসুখের এ পারে, ও পারে, দোলায় আমার মন— কেন অকারণ অশ্রুসলিলে ভরে যায় দু’নয়ন। ওগো নিদারুণ পথ, জানি—জানি পুন নিয়ে যাবে টানি, আহা, তারে— চিরদিন মোর যে দিল ভরিয়া যাবে সে স্বপনবৎ॥
৫৮০
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৮০ ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা— আন্মনা যেন দিক্বালিকার ভাসানো মেঘের ভেলা॥ যেমন হেলায় অলস ছন্দে কোন্ খেয়ালির কোন্ আনন্দে সকালে-ধরানো আমের মুকুল ঝরানো বিকালবেলা॥ যে বাতাস নেয় ফুলের গন্ধ, ভুলে যায় দিনশেষে, তার হাতে দিই আমার ছন্দ—কোথা যায় কে জানে সে। লক্ষ্যবিহীন স্রোতের ধারায় জেনো জেনো মোর সকলই হারায়, চিরদিন আমি পথের নেশায় পাথেয় করেছি হেলা॥
৫৮১
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৮১ না রে, না রে, হবে না তোর স্বর্গসাধন— সেখানে যে মধুর বেশে ফাঁদ পেতে রয় সুখের বাঁধন॥ ভেবেছিলি দিনের শেষে তপ্ত পথের প্রান্তে এসে সোনার মেঘে মিলিয়ে যাবে সারা দিনের সকল কাঁদন॥ না রে, না রে, হবে না তোর, হবে না তা— সন্ধ্যাতারার হাসির নিচে হবে না তোর শয়ন পাতা। পথিক বঁধু পাগল ক’রে পথে বাহির করবে তোরে— হৃদয় যে তোর ফেটে গিয়ে ফুটবে তবে তাঁর আরাধন॥
৫৮২
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৮২ আপনি আমার কোন্খানে বেড়াই তারি সন্ধানে॥ নানান রূপে নানান বেশে ফেরে যেজন ছায়ার দেশে তার পরিচয় কেঁদে হেসে শেষ হবে কি, কে জানে॥ আমার গানের গহন-মাঝে শুনেছিলেম যার ভাষা খুঁজে না পাই তার বাসা। বেলা কখন যায় গো বয়ে, আলো আসে মলিন হয়ে— পথের বাঁশি যায় কী কয়ে বিকালবেলার মূলতানে॥
৫৮৩
পূজা - পথ
পূজা - পথ
৫৮৩ পথ এখনো শেষ হল না, মিলিয়ে এল দিনের ভাতি। তোমার আমার মাঝখানে হায় আসবে কখন আঁধার রাতি॥ এবার তোমার শিখা আনি জ্বালাও আমার প্রদীপখানি, আলোয় আলোয় মিলন হবে পথের মাঝে পথের সাথি॥ ভালো করে মুখ যে তোমার যায় না দেখা সুন্দর হে— দীর্ঘ পথের দারুণ গ্লানি তাই তো আমায় জড়িয়ে রহে। ছায়ায়-ফেরা ধুলায়-চলা মনের কথা যায় না বলা, শেষ কথাটি জ্বালবে এবার তোমার বাতি আমার বাতি॥