চিত্ত পিপাসিত রে
প্রেম
প্রেম
চিত্ত পিপাসিত রে গীতসুধার তরে॥ তাপিত শুষ্কলতা বর্ষণ যাচে যথা কাতর অন্তর মোর লুণ্ঠিত ধূলি-’পরে গীতসুধার তরে॥ আজি বসন্তনিশা, আজি অনন্ত তৃষা, আজি এ জাগ্রত প্রাণ তৃষিত চকোর-সমান গীতসুধার তরে। চন্দ্র অতন্দ্র নভে জাগিছে সুপ্ত ভবে, অন্তর বাহির আজি কাঁদে উদাস স্বরে গীতসুধার তরে॥
আমার মনের মাঝে যে গান বাজে
প্রেম
প্রেম
আমার মনের মাঝে যে গান বাজে শুনতে কি পাও গো আমার চোখের ’পরে আভাস দিয়ে যখনি যাও গো॥ রবির কিরণ নেয় যে টানি ফুলের বুকের শিশিরখানি, আমার প্রাণের সে গান তুমি তেমনি কি নাও গো॥ আমার উদাস হৃদয় যখন আসে বাহির-পানে আপনাকে যে দেয় ধরা সে সকলখানে। কচি পাতা প্রথম প্রাতে কী কথা কয় আলোর সাথে, আমার মনের আপন কথা বলে যে তাও গো॥
কাহার গলায় পরাবি গানের রতনহার
প্রেম
প্রেম
কাহার গলায় পরাবি গানের রতনহার, তাই কি বীণায় লাগালি যতনে নূতন তার॥ কানন পরেছে শ্যামল দুকূল, আমের শাখাতে নূতন মুকুল, নবীনের মায়া করিল আকুল হিয়া তোমার॥ যে কথা তোমার কোনো দিন আর হয় নি বলা নাহি জানি কারে তাই বলিবারে করে উতলা! দখিনপবনে বিহ্বলা ধরা কাকলিকূজনে হয়েছে মুখরা, আজি নিখিলের বাণীমন্দিরে খুলেছে দ্বার॥
যে ছায়ারে ধরব বলে করেছিলেম পণ
প্রেম
প্রেম
যে ছায়ারে ধরব বলে করেছিলেম পণ আজ সে মেনে নিল আমার গানেরই বন্ধন॥ আকাশে যার পরশ মিলায় শরতমেঘের ক্ষণিক লীলায় আপন সুরে আজ শুনি তার নূপুরগুঞ্জন॥ অলস দিনের হাওয়ায় গন্ধখানি মেলে যেত গোপন আসা-যাওয়ায়। আজ শরতের ছায়ানটে মোর রাগিণীর মিলন ঘটে, সেই মিলনের তালে তালে বাজায় সে কঙ্কণ॥
গানগুলি মোর শৈবালেরই দল
প্রেম
প্রেম
গানগুলি মোর শৈবালেরই দল— ওরা বন্যাধারায় পথ যে হারায় উদ্দাম চঞ্চল॥ ওরা কেনই আসে যায় বা চলে, অকারণের হাওয়ায় দোলে— চিহ্ন কিছুই যায় না রেখে, পায় না কোনো ফল॥ ওদের সাধন তো নাই, কিছু সাধন তো নাই, ওদের বাঁধন তো নাই, কোনো বাঁধন তো নাই। উদাস ওরা উদাস করে গৃহহারা পথের স্বরে, ভুলে-যাওয়ার স্রোতের ’পরে করে টলোমল॥
তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায়
প্রেম
প্রেম
তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া। বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক’ ওগো দুখজাগানিয়া॥ এল আঁধার ঘিরে, পাখি এল নীড়ে, তরী এল তীরে— শুধু আমার হিয়া বিরাম পায় নাকো ওগো দুখজাগানিয়া॥ আমার কাজের মাঝে মাঝে কান্নাহাসির দোলা তুমি থামতে দিলে না যে। আমায় পরশ ক’রে প্রাণ সুধায় ভ’রে তুমি যাও যে সরে— বুঝি আমার ব্যথার আড়ালেতে দাঁড়িয়ে থাক ওগো দুখজাগানিয়া॥
৭
প্রেম
প্রেম
৭ গানের ডালি ভরে দে গো ঊষার কোলে— আয় গো তোরা, আয় গো তোরা, আয় গো চলে॥ চাঁপার কলি চাঁপার গাছে সুরের আশায় চেয়ে আছে, কান পেতেছে নতুন পাতা গাইবি ব’লে॥ কমলবরণ গগন-মাঝে কমলচরণ ওই বিরাজে। ওইখানে তোর সুর ভেসে যাক, নবীন প্রাণের ওই দেশে যাক, ওই যেখানে সোনার আলোয় দুয়ার খোলে॥
৮
প্রেম
প্রেম
৮ ওরে আমার হৃদয় আমার, কখন তোরে প্রভাতকালে দীপের মতো গানের স্রোতে কে ভাসালে॥ যেন রে তুই হঠাৎ বেঁকে শুকনো ডাঙায় যাস নে ঠেকে, জড়াস নে শৈবালের জালে॥ তীর যে হোথায় স্থির রয়েছে, ঘরের প্রদীপ সেই জ্বালালো— অচল রহে তাহার আলো। গানের প্রদীপ তুই যে গানে চলবি ছুটে অকূল-পানে চপল ঢেউয়ের আকুল তালে॥
কাল রাতের বেলা গান এলো মোর মনে
প্রেম
প্রেম
কাল রাতের বেলা গান এলো মোর মনে, তখন তুমি ছিলে না মোর সনে॥ যে কথাটি বলব তোমায় ব’লে কাটল জীবন নীরব চোখের জলে সেই কথাটি সুরের হোমানলে উঠল জ্বলে একটি আঁধার ক্ষণে— তখন তুমি ছিলে না মোর সনে॥ ভেবেছিলেম আজকে সকাল হলে সেই কথাটি তোমায় যাব বলে। ফুলের উদাস সুবাস বেড়ায় ঘুরে, পাখির গানে আকাশ গেল পূরে, সেই কথাটি লাগল না সেই সুরে যতই প্রয়াস করি পরানপণে— যখন তুমি আছ আমার সনে॥
মনে রবে কি না রবে আমারে
প্রেম
প্রেম
মনে রবে কি না রবে আমারে সে আমার মনে নাই। ক্ষণে ক্ষণে আসি তব দুয়ারে, অকারণে গান গাই॥ চলে যায় দিন, যতখন আছি পথে যেতে যদি আসি কাছাকাছি তোমার মুখের চকিত সুখের হাসি দেখিতে যে চাই— তাই অকারণে গান গাই॥ ফাগুনের ফুল যায় ঝরিয়া ফাগুনের অবসানে— ক্ষণিকের মুঠি দেয় ভরিয়া, আর কিছু নাহি জানে। ফুরাইবে দিন, আলো হবে ক্ষীণ, গান সারা হবে, থেমে যাবে বীন, যতখন থাকি ভরে দিবে না কি এ খেলারই ভেলাটাই— তাই অকারণে গান গাই॥
১১
প্রেম
প্রেম
১১ আকাশে আজ কোন্ চরণের আসা-যাওয়া। বাতাসে আজ কোন্ পরশের লাগে হাওয়া॥ অনেক দিনের বিদায়বেলার ব্যাকুল বাণী আজ উদাসীর বাঁশির সুরে কে দেয় আনি— বনের ছায়ায় তরুণ চোখের করুণ চাওয়া॥ কোন্ ফাগুনে যে ফুল ফোটা হল সারা মৌমাছিদের পাখায় পাখায় কাঁদে তারা। বকুলতলায় কাজ-ভোলা সেই কোন্ দুপুরে যে-সব কথা ভাসিয়ে দিলেম গানের সুরে ব্যথায় ভরে ফিরে আসে সে গান-গাওয়া॥
১২
প্রেম
প্রেম
১২ নিদ্রাহারা রাতের এ গান বাঁধব আমি কেমন সুরে। কোন্ রজনীগন্ধা হতে আনব সে তান কণ্ঠে পূরে॥ সুরের কাঙাল আমার ব্যথা ছায়ার কাঙাল রৌদ্র যথা সাঁঝ-সকালে বনের পথে উদাস হয়ে বেড়ায় ঘুরে॥ ওগো, সে কোন্ বিহান বেলায় এই পথে কার পায়ের তলে নাম-না-জানা তৃণকুসুম শিউরেছিল শিশিরজলে। অলকে তার একটি গুছি করবীফুল রক্তরুচি, নয়ন করে কী ফুল চয়ন নীল গগনে দূরে দূরে॥
আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিল ভুলায়ে
প্রেম
প্রেম
আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিল ভুলায়ে, সে যে বাসা বাঁধে নীরব মনের কুলায়ে॥ মেঘের দিনে শ্রাবণমাসে যূথীবনের দীর্ঘশ্বাসে আমার প্রাণে সে দেয় পাখার ছায়া বুলায়ে॥ যখন শরৎ কাঁপে শিউলিফুলের হরষে নয়ন ভরে যে সেই গোপন গানের পরশে। গভীর রাতে কী সুর লাগায় আধো-ঘুমে আধো-জাগায়, আমার স্বপন-মাঝে দেয় যে কী দোল দুলায়ে॥
১৪
প্রেম
প্রেম
১৪ যায় নিয়ে যায় আমায় আপন গানের টানে ঘর-ছাড়া কোন্ পথের পানে॥ নিত্যকালের গোপন কথা বিশ্বপ্রাণের ব্যাকুলতা আমার বাঁশি দেয় এনে দেয় আমার কানে॥ মনে যে হয় আমার হৃদয় কুসুম হয়ে ফোটে, আমার হিয়া উচ্ছলিয়া সাগরে ঢেউ ওঠে। পরান আমার বাঁধন হারায় নিশীথরাতের তারায় তারায়, আকাশ আমায় কয় কী-যে কয় কেই বা জানে॥
দিয়ে গেনু বসন্তের এই গানখানি
প্রেম
প্রেম
দিয়ে গেনু বসন্তের এই গানখানি— বরষ ফুরায়ে যাবে, ভুলে যাবে জানি॥ তবু তো ফাল্গুনরাতে এ গানের বেদনাতে আঁখি তব ছলোছলো, এই বহু মানি॥ চাহি না রহিতে বসে ফুরাইলে বেলা, তখনি চলিয়া যাব শেষ হলে খেলা। আসিবে ফাল্গুন পুন, তখন আবার শুনো নব পথিকেরই গানে নূতনের বাণী॥
১৬
প্রেম
প্রেম
১৬ গান আমার যায় ভেসে যায়— চাস্ নে ফিরে, দে তারে বিদায়॥ সে যে দখিনহাওয়ায় মুকুল ঝরা, ধুলার আঁচল হেলায় ভরা, সে যে শিশির-ফোঁটার মালা গাঁথা বনের আঙিনায়॥ কাঁদন-হাসির আলোছায়া সারা অলস বেলা— মেঘের গায়ে রঙের মায়া, খেলার পরে খেলা। ভুলে-যাওয়ার বোঝাই ভরি গেল চলে কতই তরী— উজান বায়ে ফেরে যদি কে রয় সে আশায়॥
১৭
প্রেম
প্রেম
১৭ সময় কারো যে নাই, ওরা চলে দলে দলে— গান হায় ডুবে যায় কোন্ কোলাহলে॥ পাষাণে রচিছে কত কীর্তি ওরা সবে বিপুল গরবে, যায় আর বাঁশি-পানে চায় হাসিছলে॥ বিশ্বের কাজের মাঝে জানি আমি জানি তুমি শোন মোর গানখানি। আঁধার মথন করি যবে লও তুলি গ্রহতারাগুলি শোন যে নীরবে তব নীলাম্বরতলে॥
এই কথাটি মনে রেখো
প্রেম
প্রেম
এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসিখেলায় আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়। শুকনো ঘাসে শূন্য বনে আপন-মনে অনাদরে অবহেলায় আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়॥ দিনের পথিক মনে রেখো, আমি চলেছিলেম রাতে সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে। যখন আমায় ও পার থেকে গেল ডেকে ভেসেছিলেম ভাঙা ভেলায়। আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়॥
১৯
প্রেম
প্রেম
১৯ আসা-যাওয়ার পথের ধারে গান গেয়ে মোর কেটেছে দিন। যাবার বেলায় দেব কারে বুকের কাছে বাজল যে বীণ॥ সুরগুলি তার নানা ভাগে রেখে যাব পুষ্পরাগে, মীড়গুলি তার মেঘের রেখায় স্বর্ণলেখায় করব বিলীন॥ কিছু বা সে মিলনমালায় যুগলগলায় রইবে গাঁথা, কিছু বা সে ভিজিয়ে দেবে দুই চাহনির চোখের পাতা। কিছু বা কোন্ চৈত্রমাসে বকুল-ঢাকা বনের ঘাসে মনের কথার টুকরো আমার কুড়িয়ে পাবে কোন্ উদাসীন॥
২০
প্রেম
প্রেম
২০ গানের ভেলায় বেলা-অবেলায় প্রাণের আশা ভোলা মনের স্রোতে ভাসা॥ কোথায় জানি ধায় সে বাণী, দিনের শেষে কোন্ ঘাটে যে ঠেকে এসে চিরকালের কাঁদা-হাসা॥ এমনি খেলার ঢেউয়ের দোলে খেলার পারে যাবি চলে। পালের হাওয়ার ভরসা তোমার—করিস নে ভয় পথের কড়ি না যদি রয়, সঙ্গে আছে বাঁধন-নাশা॥
২১
প্রেম
প্রেম
২১ অনেক দিনের আমার যে গান আমার কাছে ফিরে আসে তারে আমি শুধাই, তুমি ঘুরে বেড়াও কোন্ বাতাসে॥ যে ফুল গেছে সকল ফেলে গন্ধ তাহার কোথায় পেলে, যার আশা আজ শূন্য হল কী সুর জাগাও তাহার আশে॥ সকল গৃহ হারালো যার তোমার তানে তারি বাসা, যার বিরহের নাই অবসান তার মিলনের আনে ভাষা। শুকালো যেই নয়নবারি তোমার সুরে কাঁদন তারি, ভোলা দিনের বাহন তুমি স্বপন ভাসাও দূর আকাশে॥
২২
প্রেম
প্রেম
২২ পাখি আমার নীড়ের পাখি অধীর হল কেন জানি— আকাশ-কোণে যায় শোনা কি ভোরের আলোর কানাকানি॥ ডাক উঠেছে মেঘে মেঘে, অলস পাখা উঠল জেগে— লাগল তারে উদাসী ওই নীল গগনের পরশখানি॥ আমার নীড়ের পাখি এবার উধাও হল আকাশ-মাঝে। যায় নি কারো সন্ধানে সে, যায় নি যে সে কোনো কাজে। গানের ভরা উঠল ভরে, চায় দিতে তাই উজাড় করে— নীরব গানের সাগর-মাঝে আপন প্রাণের সকল বাণী॥
২৩
প্রেম
প্রেম
২৩ ছুটির বাঁশি বাজল যে ওই নীল গগনে, আমি কেন একলা বসে এই বিজনে॥ বাঁধন টুটে উঠবে ফুটে শিউলিগুলি, তাই তো কুঁড়ি কানন জুড়ি উঠছে দুলি, শিশির-ধোওয়া হাওয়ার ছোঁওয়া লাগল বনে— সুর খুঁজে তাই শূন্যে তাকাই আপন-মনে॥ বনের পথে কী মায়াজাল হয় যে বোনা, সেইখানেতে আলোছায়ার চেনাশোনা। ঝরে-পড়া মালতী তার গন্ধশ্বাসে কান্না-আভাস দেয় মেলে ওই ঘাসে ঘাসে, আকাশ হাসে শুভ্র কাশের আন্দোলনে— সুর খুঁজে তাই শূন্যে তাকাই আপন-মনে॥
২৪
প্রেম
প্রেম
২৪ বাঁশি আমি বাজাই নি কি পথের ধারে ধারে। গান গাওয়া কি হয় নি সারা তোমার বাহির-দ্বারে॥ ওই-যে দ্বারের যবনিকা নানা বর্ণে চিত্রে লিখা নানা সুরের অর্ঘ্য হোথায় দিলেম বারে বারে। আজ যেন কোন্ শেষের বাণী শুনি জল স্থলে— ‘পথের বাঁধন ঘুচিয়ে ফেলো’ এই কথা সে বলে। মিলন-ছোঁওয়া বিচ্ছেদেরই অন্তবিহীন ফেরাফেরি কাটিয়ে দিয়ে যাও গো নিয়ে আনাগোনার পারে॥
২৫
প্রেম
প্রেম
২৫ তোমার শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে চলে এসেছি। কেউ কি তা জানে॥ তোমার আছে গানে গানে গাওয়া, আমার কেবল চোখে চোখে চাওয়া— মনে মনে মনের কথাখানি বলে এসেছি কেউ কি তা জানে॥ ওদের নেশা তখন ধরে নাই, রঙিন রসে প্যালা ভরে নাই॥ তখনো তো কতই আনাগোনা, নতুন লোকের নতুন চেনাশোনা— ফিরে ফিরে ফিরে-আসার আশা দলে এসেছি কেউ কি তা জানে॥
২৬
প্রেম
প্রেম
২৬ আমার শেষ রাগিণীর প্রথম ধুয়ো ধরলি রে কে তুই। আমার শেষ পেয়ালা চোখের জলে ভরলি রে কে তুই॥ দূরে পশ্চিমে ওই দিনের পারে অস্তরবির পথের ধারে রক্তরাগের ঘোমটা মাথায় পরলি রে কে তুই॥ সন্ধ্যাতারার শেষ চাওয়া তোর রইলো কি ওই-যে। তোর হঠাৎ-খসা প্রাণের মালা ভরল আমার শূন্য ডালা— মরণপথের সাথি আমায় করলি রে কে তুই॥
২৭
প্রেম
প্রেম
২৭ পাছে সুর ভুলি এই ভয় হয়— পাছে ছিন্ন তারের জয় হয়॥ পাছে উৎসবক্ষণ তন্দ্রালসে হয় নিমগন, পুণ্য লগন হেলায় হেলায় ক্ষয় হয়— পাছে বিনা গানেই মিলনবেলা ক্ষয় হয়॥ যখন তাণ্ডবে মোর ডাক পড়ে পাছে তার তালে মোর তাল না মেলে সেই ঝড়ে। যখন মরণ এসে ডাকবে শেষে বরণ-গানে, পাছে প্রাণে মোর বাণী সব লয় হয়— পাছে বিনা গানেই বিদায়বেলা লয় হয়॥
২৮
প্রেম
প্রেম
২৮ বিরস দিন, বিরল কাজ, প্রবল বিদ্রোহে এসেছ প্রেম, এসেছ আজ কী মহা সমারোহে॥ একেলা রই অলসমন, নীরব এই ভবনকোণ, ভাঙিলে দ্বার কোন্ সে ক্ষণ অপরাজিত ওহে॥ কানন-’পর ছায়া বুলায়, ঘনায় ঘনঘটা। গঙ্গা যেন হেসে দুলায় ধূর্জটির জটা। যেথা যে রয় ছাড়িল পথ, ছুটালে ওই বিজয়রথ, আঁখি তোমার তড়িতবৎ ঘনঘুমের মোহে॥
২৯
প্রেম
প্রেম
২৯ বাজিল কাহার বীণা মধুর স্বরে আমার নিভৃত নব জীবন-’পরে। প্রভাতকমলসম ফুটিল হৃদয় মম কার দুটি নিরুপম চরণ-তরে॥ জেগে উঠে সব শোভা, সব মাধুরী, পলকে পলকে হিয়া পুলকে পূরি। কোথা হতে সমীরণ আনে নব জাগরণ, পরানের আবরণ মোচন করে॥ লাগে বুকে সুখে দুখে কত যে ব্যথা, কেমনে বুঝায়ে কব না জানি কথা। আমার বাসনা আজি ত্রিভুবনে উঠে বাজি, কাঁপে নদী বনরাজি বেদনাভরে॥
৩০
প্রেম
প্রেম
৩০ সবার সাথে চলতেছিল অজানা এই পথের অন্ধকারে, কোন্ সকালের হঠাৎ আলোয় পাশে আমার দেখতে পেলেম তারে॥ এক নিমেষেই রাত্রি হল ভোর, চিরদিনের ধন যেন সে মোর পরিচয়ের অন্ত যেন কোনোখানেই নাইকো একেবারে— চেনা কুসুম ফুটে আছে না-চেনা এই গহন বনের ধারে অজানা এই পথের অন্ধকারে॥ জানি আমি দিনের শেষে সন্ধ্যাতিমির নামবে পথের মাঝে— আবার কখন পড়বে আড়াল, দেখাশোনার বাঁধন রবে না যে। তখন আমি পাব মনে মনে পরিচয়ের পরশ ক্ষণে ক্ষণে; জানব চিরদিনের পথে আঁধার আলোয় চলছি সারে সারে— হৃদয়-মাঝে দেখব খুঁজে একটি মিলন সব-হারানোর পারে অজানা এই পথের অন্ধকারে॥
৩১
প্রেম
প্রেম
৩১ আমার পরান লয়ে কী খেলা খেলাবে ওগো পরানপ্রিয়। কোথা হতে ভেসে কূলে লেগেছে চরণমূলে তুলে দেখিয়ো॥ এ নহে গো তৃণদল, ভেসে আসা ফুলফল— এ যে ব্যথাভরা মন মনে রাখিয়ো॥ কেন আসে কেন যায় কেহ না জানে। কে আসে কাহার পাশে কিসের টানে। রাখ যদি ভালোবেসে চিরপ্রাণ পাইবে সে, ফেলে যদি যাও তবে বাঁচিবে কি ও॥
৩২
প্রেম
প্রেম
৩২ সুন্দর হৃদিরঞ্জন তুমি নন্দনফুলহার, তুমি অনন্ত নববসন্ত অন্তরে আমার॥ নীল অম্বর চুম্বনরত, চরণে ধরণী মুগ্ধ নিয়ত, অঞ্চল ঘেরি সঙ্গীত যত গুঞ্জরে শতবার॥ ঝলকিছে কত ইন্দুকিরণ, পুলকিছে ফুলগন্ধ— চরণভঙ্গে ললিত অঙ্গে চমকে চকিত ছন্দ। ছিঁড়ি মর্মের শত বন্ধন তোমা-পানে ধায় যত ত্রন্দন— লহো হৃদয়ের ফুলচন্দন বন্দন-উপহার॥
৩৩
প্রেম
প্রেম
৩৩ আমারে করো তোমার বীণা, লহো গো লহো তুলে। উঠিবে বাজি তন্ত্রীরাজি মোহন অঙ্গুলে॥ কোমল তব কমলকরে, পরশ করো পরান-’পরে, উঠিবে হিয়া গুঞ্জরিয়া তব শ্রবণমূলে॥ কখনো সুখে কখনো দুখে কাঁদিবে চাহি তোমার মুখে, চরণে পড়ি রবে নীরবে রহিবে যবে ভুলে। কেহ না জানে কী নব তানে উঠিবে গীত শূন্য-পানে, আনন্দের বারতা যাবে অনন্তের কূলে॥
৩৪
প্রেম
প্রেম
৩৪ ভালোবেসে, সখী, নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো—তোমার মনের মন্দিরে। আমার পরানে যে গান বাজিছে তাহারি তালটি শিখো— তোমার চরণমঞ্জীরে॥ ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে আমার মুখর পাখি— তোমার প্রাসাদপ্রাঙ্গণে। মনে করে, সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো আমার হাতের রাখী— তোমার কনককঙ্কণে॥ আমার লতার একটি মুকুল ভুলিয়া তুলিয়া রেখো— তোমার অলকবন্ধনে। আমার স্মরণ-শুভ-সিন্দুরে একটি বিন্দু এঁকো— তোমার ললাটচন্দনে। আমার মনের মোহের মাধুরী মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো— তোমার অঙ্গসৌরভে। আমার আকুল জীবনমরণ টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো— তোমার অতুল গৌরবে॥
৩৫
প্রেম
প্রেম
৩৫ ওগো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ, আরো কী তোমার চাই। ওগো ভিখারি আমার ভিখারি, চলেছ কী কাতর গান গাই॥ প্রতিদিন প্রাতে নব নব ধনে তুষিব তোমারে সাধ ছিল মনে— ভিখারি আমার ভিখারি, হায় পলকে সকলই সঁপেছি চরণে, আর তো কিছুই নাই॥ আমি আমার বুকের আঁচল ঘেরিয়া তোমারে পরানু বাস। আমি আমার ভুবন শূন্য করেছি তোমার পুরাতে আশ। হেরো মম প্রাণ মন যৌবন নব করপুটতলে পড়ে আছে তব— ভিখারি আমার ভিখারি, হায়, আরো যদি মোরে কিছু দাও, ফিরে আমি দিব তাই॥
৩৬
প্রেম
প্রেম
৩৬ তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা, মম শূন্যগগনবিহারী। আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা— তুমি আমারি, তুমি আমারি, মম অসীমগগনবিহারী॥ মম হৃদয়রক্তরাগে তব চরণ দিয়েছি রাঙিয়া অয়ি সন্ধ্যাস্বপনবিহারী। তব অধর এঁকেছি সুধাবিষে মিশে মম সুখদুখ ভাঙিয়া— তুমি আমারি, তুমি আমারি, মম বিজনজীবনবিহারী॥ মম মোহের স্বপন-অঞ্জন তব নয়নে দিয়েছি পরায়ে, অয়ি মুগ্ধনয়নবিহারী। মম সঙ্গীত তব অঙ্গে অঙ্গে দিয়েছি জড়ায়ে জড়ায়ে— তুমি আমারি, তুমি আমারি, মম জীবনমরণবিহারী॥
৩৭
প্রেম
প্রেম
৩৭ কত কথা তারে ছিল বলিতে। চোখে চোখে দেখা হল পথ চলিতে॥ বসে বসে দিবারাতি বিজনে সে কথা গাঁথি কত যে পুরবীরাগে কত ললিতে॥ সে কথা ফুটিয়া উঠে কুসুমবনে, সে কথা ব্যাপিয়া যায় নীল গগনে। সে কথা লইয়া খেলি হৃদয়ে বাহিরে মেলি, মনে মনে গাহি কার মন ছলিতে॥
৩৮
প্রেম
প্রেম
৩৮ সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে॥ এ কথা কভু আর পারেনা ঘুচিতে, আছে সে নিখিলের মাধুরীরুচিতে। এ কথা শিখানু যে আমার বীণারে, গানেতে চিনালেম সে চির-চিনারে॥ সে কথা সুরে সুরে ছড়াব পিছনে স্বপনফসলের বিছনে বিছনে। মধুপগুঞ্জে সে লহরী তুলিবে, কুসুমকুঞ্জে সে পবনে দুলিবে, ঝরিবে শ্রাবণের বাদলসিচনে। শরতে ক্ষীণ মেঘে ভাসিবে আকাশে স্মরণবেদনার বরনে আঁকা সে। চকিতে ক্ষণে ক্ষণে পাব যে তাহারে ইমনে কেদারায় বেহাগে বাহারে॥
৩৯
প্রেম
প্রেম
৩৯ হে নিরুপমা, গানে যদি লাগে বিহবল তান করিয়ো ক্ষমা॥ ঝরোঝরো ধারা আজি উতরোল, নদীকূলে-কূলে উঠে কল্লোল, বনে বনে গাহে মর্মরস্বরে নবীন পাতা। সজল পবন দিশে দিশে তোলে বাদলগাথা॥ হে নিরুপমা, চপলতা আজি যদি ঘটে তবে করিয়ো ক্ষমা। এল বরষার সঘন দিবস, বনরাজি আজি ব্যাকুল বিবশ, বকুলবীথিকা মুকুলে মত্ত কানন-’পরে। নবকদম্ব মদির গন্ধে আকুল করে॥ হে নিরুপমা, চপলতা আজি যদি ঘটে তবে করিয়ো ক্ষমা। তোমার দুখানি কালো আঁখি-’পরে বরষার কালো ছায়াখানি পড়ে, ঘন কালো তব কুঞ্চিত কেশে যূথীর মালা। তোমার চরণে নববরষার বরণডালা॥ হে নিরুপমা, আঁখি যদি আজ করে অপরাধ, করিয়ো ক্ষমা। হেরো আকাশের দূর কোণে কোণে বিজলি চমকি ওঠে খনে খনে, দ্রুত কৌতুকে তব বাতায়নে কী দেখে চেয়ে। অধীর পবন কিসের লাগিয়া আসিছে ধেয়ে॥
৪০
প্রেম
প্রেম
৪০ অজানা খনির নূতন মণির গেঁথেছি হার, ক্লান্তিবিহীনা নবীনা বীণায় বেঁধেছি তার॥ যেমন নূতন বনের দুকূল, যেমন নূতন আমের মুকুল, মাঘের অরুণে খোলে স্বর্গের নূতন দ্বার, তেমনি আমার নবীন রাগের নব যৌবনে নব সোহাগের রাগিণী রচিয়া উঠিল নাচিয়া বীণার তার॥ যে বাণী আমার কখনো কারেও হয় নি বলা তাই দিয়ে গানে রচিব নূতন নৃত্যকলা। আজি অকারণ বাতাসে বাতাসে যুগান্তরের সুর ভেসে আসে, মর্মরস্বরে বনের ঘুচিল মনের ভার। যেমনি ভাঙিল বাণীর বন্ধ উচ্ছ্বসি উঠে নূতন ছন্দ সুরের সাহসে আপনি চকিত বীণার তার॥
৪১
প্রেম
প্রেম
৪১ আজি এ নিরালা কুঞ্জে আমার অঙ্গ-মাঝে বরণের ডালা সেজেছে আলোকমালার সাজে॥ নব বসন্তে লতায় লতায় পাতায় ফুলে বাণীহিল্লোল উঠে প্রভাতের স্বর্ণকূলে, আমার দেহের বাণীতে সেগান উঠিছে দুলে— এ বরণগান নাহি পেলে মান মরিব লাজে। ওহে প্রিয়তম, দেহে মনে মম ছন্দ বাজে॥অঘর্য তোমার আনি নি ভরিয়া বাহির হতে, ভেসে আসে পূজা পূর্ণ প্রাণের আপন স্রোতে। মোর তনুময় উছলে হৃদয় বাঁধনহারা, অধীরতা তারি মিলনে তোমারি হোক-না সারা। ঘন যামিনীর আঁধারে যেমন জ্বলিছে তারা, দেহ ঘেরি মম প্রাণের চমক তেমনি রাজে— সচকিত আলো নেচে ওঠে মোর সকল কাজে॥
৪২
প্রেম
প্রেম
৪২ ফিরে যাও কেন ফিরে ফিরে যাও বহিয়া বিফল বাসনা। চিরদিন আছ দূরে অজানার মতো নিভৃত অচেনা পুরে, কাছে আস তবু আস না বহিয়া বফল বাসনা॥ পারি না তোমায় বুঝিতে— ভিতরে কারে কি পেয়েছ, বাহিরে চাহ না খুঁজিতে। না-বলা তোমার বেদনা যত বিরহপ্রদীপে শিখারই মতো নয়নে তোমার উঠিছে জ্বলিয়া নীরব কী সম্ভাষণা॥
৪৩
প্রেম
প্রেম
৪৩ আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান— তুমি জান নাই, তুমি জান নাই, তুমি জান নাই তার মূল্যের পরিমাণ॥ রজনীগন্ধা অগোচরে যেমন রজনী স্বপনে ভরে সৌরভে, তুমি জান নাই, তুমি জান নাই তুমি জান নাই, মরমে আমার ঢেলেছ তোমার গান॥ বিদায় নেবার সময় এবার হল— প্রসন্ন মুখ তোলো, মুখ তোলো, মুখ তোলো— মধুর মরণে পূর্ণ করিয়া সঁপিয়া যাব প্রাণ চরণে। যারে জান নাই, যারে জান নাই, যারে জান নাই তার গোপন ব্যথার নীরব রাত্রি হোক আজি অবসান॥
৪৪
প্রেম
প্রেম
৪৪ জানি জানি, তুমি এসেছ এ পথে মনের ভুলে। তাই হোক তবে তাই হোক, দ্বার দিলেম খুলে॥ এসেছ তুমি তো বিনা আভরণে, মুখর নূপুর বাজে না চরণে, তাই হোক তবে তাই হোক, এস সহজ মনে। ওই তো মালতী ঝরে পড়ে যায় মোর আঙিনায়, শিথিল কবরী সাজাতে তোমার লও-না তুলে॥ কোনো আয়োজন নাই একেবারে, সুর বাঁধা নাই এ বীণার তারে, তাই হোক তবে, এসো হৃদয়ের মৌনপারে। ঝরোঝরো বারি ঝরে বনমাঝে, আমারি মনের সুর ওই বাজে, উতলা হাওয়ার তালে তালে মন উঠিছে দুলে॥
৪৫
প্রেম
প্রেম
৪৫ হে সখা, বারতা পেয়েছি মনে মনে তব নিশ্বাসপরশনে, এসেছ অদেখা বন্ধু দক্ষিণসমীরণে॥ কেন বঞ্চনা কর মোরে, কেন বাঁধ অদৃশ্য ডোরে— দেখা দাও, দেখা দাও দেহ মন ভরে মম নিকুঞ্জবনে॥ দেখা দাও চম্পকে রঙ্গণে, দেখা দাও কিংশুকে কাঞ্চনে। কেন শুধু বাঁশরির সুরে ভুলায়ে লয়ে যাও দূরে, যৌবন-উৎসবে ধরা দাও দৃষ্টির বন্ধনে॥
৪৬
প্রেম
প্রেম
৪৬ যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম। কে যে আমায় কাঁদায় আমি কী জানি তার নাম॥ কোথায় যে হাত বাড়াই মিছে, ফিরি আমি কাহার পিছে— সব যেন মোর বিকিয়েছে, পাই নি তাহার দাম॥ এই বেদনার ধন সে কোথায় ভাবি জনম ধরে। ভুবন ভরে আছে যেন, পাই নে জীবন ভরে। সুখ যারে কয় সকল জনে বাজাই তারে ক্ষণে ক্ষণে— গভীর সুরে ‘চাই নে’ ‘চাই নে’ বাজে অবিশ্রাম॥
৪৭
প্রেম
প্রেম
৪৭ আমি যে আর সইতে পারি নে। সুরে বাজে মনের মাঝে গো, কথা দিয়ে কইতে পারি নে॥ হৃদয়লতা নুয়ে পড়ে ব্যথাভরা ফুলের ভরে গো, আমি সে আর বইতে পারি নে॥ আজি আমার নিবিড় অন্তরে কী হাওয়াতে কাঁপিয়ে দিল গো পুলক-লাগা আকুল মর্মরে। কোন্ গুণী আজ উদাস প্রাতে মীড় দিয়েছে কোন্ বীণাতে গো— ঘরে যে আর রইতে পারি নে॥
৪৮
প্রেম
প্রেম
আমার নয়ন তব নয়নের নিবিড় ছায়ায় মনের কথার কুসুমকোরক খোঁজে।
৪৯
প্রেম
প্রেম
আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরণীতে মুগ্ধ ললিত অশ্রুগলিত গীতে॥ পঞ্চশরের বেদনামাধুরী দিয়ে বাসররত্রি রচিব না মোরা প্রিয়ে— ভাগ্যের পায়ে দুর্বল প্রাণে ভিক্ষা না যেন যাচি। কিছু নাই ভয়, জানি নিশ্চয় তুমি আছ আমি আছি॥ উড়াব ঊধের্ব প্রেমের নিশান দুর্গমপথমাঝে দুর্গম বেগে দুঃসহতম কাজে। রুক্ষ দিনের দুঃখ পাই তো পাব— চাই না শান্তি, সান্ত্বনা নাহি চাব। পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি, মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি। দুজনের চোখে দেখেছি জগৎ, দোঁহারে দেখেছি দোঁহে— মরুপথতাপ দুজনে নিয়েছি সহে। ছুটি নি মোহন মরীচিকা-পিছে-পিছে, ভুলাই নি মন সত্যেরে করি মিছে— এই গৌরবে চলিব এ ভবে যত দিন দোঁহে বাঁচি। এ বাণী, প্রেয়সী, হোক মহীয়সী ‘তুমি আছ আমি আছি’॥
৫০
প্রেম
প্রেম
৫০ আরো কিছুক্ষণ নাহয় বসিয়ো পাশে, আরো যদি কিছু কথা থাকে তাই বলে।। শরত-আকাশ হেরো ম্লান হয়ে আসে, বাষ্প-আভাসে দিগন্ত ছলোছলো॥ জানি তুমি কিছু চেয়েছিলে দেখিবারে, তাই তো প্রভাতে এসেছিলে মোর দ্বারে, দিন না ফুরাতে দেখিতে পেলে কি তারে হে পথিক, বলো বলো— সে মোর অগম অন্তরপারাবারে রক্তকমল তরঙ্গে টলোমলো॥ দ্বিধাভরে আজো প্রবেশ কর নি ঘরে, বাহির আঙনে করিলে সুরের খেলা। জানি না কী নিয়ে যাবে যে দেশান্তরে, হে অতিথি, আজি শেষ বিদায়ের বেলা। প্রথম প্রভাতে সব কাজ তব ফেলে যে গভীর বাণী শুনিবারে কাছে এলে কোনোখানে কিছু ইশারা কি তার পেলে, হে পথিক, বলো বলো— সে বাণী আপন গোপন প্রদীপ জ্বেলে রক্ত আগুনে প্রাণে মোর জ্বলোজ্বলো॥
৫১
প্রেম
প্রেম
৫১ এখনো কেন সময় নাহি হল, নাম-না-জানা অতিথি— আঘাত হানিলে না দুয়ারে, কহিলে না ‘দ্বার খোলো’॥ হাজার লোকের মাঝে রয়েছি একেলা যে— এসো আমার হঠাৎ-আলো, পরান চমকি তোলো॥ আঁধার বাধা আমার ঘরে, জানি না কাঁদি কাহার তরে। চরণসেবার সাধনা আনো, সকল দেবার বেদনা আনো— নবীন প্রাণের জাগরমন্ত্র কানে আমার বোলো॥
৫২
প্রেম
প্রেম
৫২ আজি গোধূলিলগনে এই বাদলগগনে তার চরণধ্বনি আমি হৃদয়ে গণি— ‘সে আসিবে’ আমার মন বলে সারাবেলা, অকারণ পুলকে আঁখি ভাসে জলে॥ অধীর পবনে তার উত্তরীয় দূরের পরশন দিল কি ও— রজনীগন্ধার পরিমলে ‘সে আসিবে’ আমার মন বলে॥ উতলা হয়েছে মলতীর লতা, ফুরালো না তাহার মনের কথা। বনে বনে আজি একি কানাকানি, কিসের বারতা ওরা পেয়েছে না জানি, কাঁপন লাগে দিগঙ্গনার বুকের আঁচলে— ‘সে আসিবে’ আমার মন বলে॥
৫৩
প্রেম
প্রেম
৫৩ আমি চাহিতে এসেছি শুধু একখানি মালা তব নব প্রভাতের নবীন-শিশির-ঢালা॥ হেরো শরমে-জড়িত কত-না গোলাপ কত-না গরবি করবী, ওগো, কত-না কুসুম ফুটেছে তোমার মালঞ্চ করি আলা॥ ওগো, অমল শরত-শীতল-সমীর বহিছে তোমারি কেশে, ওগো, কিশোর-অরুণ-কিরণ তোমার অধরে পড়েছে এসে। তব অঞ্চল হতে বনপথে ফুল যেতেছে পড়িয়া ঝরিয়া— ওগো, অনেক কুন্দ অনেক শেফালি ভরেছে তোমার ডালা॥
৫৪
প্রেম
প্রেম
৫৪ ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশের পাখি, নয়নে দেখেছি তব নূতন আকাশ॥ দুখানি আঁখির পাতে কী রেখেছ ঢাকি, হাসিলে ফুটিয়া পড়ে ঊষার আভাস॥ হৃদয় উড়িতে চায় হোথায় একাকী— আঁখিতারকার দেশে করিবারে বাস। ওই গগনেতে চেয়ে উঠিয়াছে ডাকি— হোথায় হারাতে চায় এ গীত-উচ্ছ্বাস॥
৫৫
প্রেম
প্রেম
৫৫ কী রাগিণী বাজালে হৃদয়ে, মোহন, মনোমোহন, তাহা তুমি জান হে, তুমি জান॥ চাহিলে মুখপানে, কী গাহিলে নীরবে, কিসে মোহিলে মন প্রাণ, তাহা তুমি জান হে, তুমি জান॥ আমি শুনি দিবারজনী তারি ধ্বনি, তারি প্রতিধ্বনি। তুমি কেমনে মরম পরশিলে মম, কোথা হতে প্রাণ কেড়ে আন, তাহা তুমি জান হে, তুমি জান॥
৫৬
প্রেম
প্রেম
ওগো শোনো কে বাজায়। বনফুলের মালার গন্ধ বাঁশির তানে মিশে যায়॥ অধর ছুঁয়ে বাঁশিখানি চুরি করে হাসিখানি— বঁধুর হাসি মধুর গানে প্রাণের পানে ভেসে যায়॥ কুঞ্জবনের ভ্রমর বুঝি বাঁশির মাঝে গুঞ্জরে বকুলগুলি আকুল হয়ে বাঁশির গানে মুঞ্জরে। যমুনারই কলতান কানে আসে, কাঁদে প্রাণ— আকাশে ওই মধুর বিধু কাহার পানে হেসে চায়॥
৫৭
প্রেম
প্রেম
বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে আমার প্রাণে, মন যে কেমন করে মনে মনে তাহা মনই জানে॥ তোমারে হৃদয়ে করে আছি নিশিদিন ধরে, চেয়ে থাকি আঁখি ভরে মুখের পানে॥ বড়ো আশা, বড়ো তৃষা, বড়ো আকিঞ্চন তোমারি লাগি। বড়ো সুখে, বড়ো দুখে, বড়ো অনুরাগে রয়েছি জাগি॥ এ জন্মের মতো আর হয়ে গেছে যা হবার, ভেসে গেছে মন প্রাণ মরণ-টানে॥
৫৮
প্রেম
প্রেম
আমার মন মানে না— দিনরজনী। আমি কী কথা স্মরিয়া এ তনু ভরিয়া পুলক রাখিতে নারি ওগো কী ভাবিয়া মনে এ দুটি নয়নে উথলে নয়নবারি— ওগো সজনি॥ সে সুধাবচন, সে সুখপরশ, অঙ্গে বাজিছে বাঁশি। তাই শুনিয়া শুনিয়া আপনার মনে হৃদয় হয় উদাসী— কেন না জানি॥ ওগো, বাতাসে কী কথা ভেসে চলে আসে, আকাশে কী মুখ জাগে। ওগো, বনমর্মরে নদীনির্ঝরে কী মধুর সুর লাগে। ফুলের গন্ধ বন্ধুর মতো জড়ায়ে ধরিছে গলে— আমি এ কথা, এ ব্যথা, সুখব্যাকুলতা কাহার চরণতলে দিব নিছনি॥
৫৯
প্রেম
প্রেম
মরি লো মরি, আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে॥ ভেবেছিলেম ঘরে রব, কোথাও যাব না— ওই-যে বাহিরে বাজিল, বলো কী করি॥ শুনেছি কোন্ কুঞ্জবনে যমুনাতীরে সাঁঝের বেলা বাজে বাঁশি ধীর সমীরে— ওগো তোরা জানিস যদি আমায় পথ বলে দে॥ দেখি গে তার মুখের হাসি, তারে ফুলের মালা পরিয়ে আসি, তারে বলে আসি ‘তোমার বাঁশি আমার প্রাণে বেজেছে’॥
৬০
প্রেম
প্রেম
এবার উজাড় করে লও হে আমার যা-কিছু সম্বল। ফিরে চাও, ফিরে চাও, ফিরে চাও ওগো চঞ্চল॥ চৈত্ররাতের বেলায় নাহয় এক প্রহরের খেলায় আমার স্বপনস্বরূপিণী প্রাণে দাও পেতে অঞ্চল॥ যদি এই ছিল গো মনে, যদি পরম দিনের স্মরণ ঘুচাও চরম অযতনে, তবে ভাঙা খেলার ঘরে নাহয় দাঁড়াও ক্ষণেক-তরে— সেথা ধুলায় ধুলায় ছড়াও হেলায় ছিন্ন ফুলের দল॥
৬১
প্রেম
প্রেম
সখী, প্রতিদিন হায় এসে ফিরে যায় কে। তারে আমার মাথার একটি কুসুম দে॥ যদি শুধায় কে দিল কোন্ ফুলকাননে, মোর শপথ, আমার নামটি বলিস নে॥ সখী, সে আসি ধুলায় বসে যে তরুর তলে সেথা আসন বিছায়ে রাখিস বকুলদলে। সে যে করুণা জাগায় সকরুণ নয়নে— যেন কী বলিতে চায়, না বলিয়া যায় সে॥
৬২
প্রেম
প্রেম
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম॥ মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম॥ জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি, তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি। মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম॥
৬৩
প্রেম
প্রেম
তোমার গোপন কথাটি, সখী, রেখো না মনে। শুধু আমায়, বোলো আমায় গোপনে॥ ওগো ধীরমধুরহাসিনী, বোলো ধীরমধুর ভাষে— আমি কানে না শুনিব গো, শুনিব প্রাণের শ্রবণে॥ যবে গভীর যামিনী, যবে নীরব মেদিনী, যবে সুপ্তিমগন বিহগনীড় কুসুমকাননে, বোলো অশ্রুজড়িত কণ্ঠে, বোলো কম্পিত স্মিত হাসে— বোলো মধুরবেদনবিধুর হৃদয়ে শরমনমিত নয়নে॥
৬৪
প্রেম
প্রেম
এসো আমার ঘরে। বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে॥ স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে মুগ্ধ এ চোখে। ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে এসো আমার ঘরে॥ দুঃখসুখের দোলে এসো, প্রাণের হিল্লোলে এসো। ছিলে আশার অরূপ বাণী ফাগুনবাতাসে বনের আকুল নিশ্বাসে— এবার ফুলের প্রফুল্ল রূপ এসো বুকের ’পরে॥
৬৫
প্রেম
প্রেম
ঘুমের ঘন গহন হতে যেমন আসে স্বপ্ন তেমনি উঠে এসো এসো। শমীশাখার বক্ষ হতে যেমন জ্বলে অগ্নি তেমনি তুমি এসো এসো॥ ঈশানকোণে কালো মেঘের নিষেধ বিদারি যেমন আসে সহসা বিদ্যুৎ তেমনি তুমি চমক হানি এসো হৃদয়তলে— এসো তুমি, এসো তুমি, এসো এসো॥ আঁধার যবে পাঠায় ডাক মৌন ইশারায় যেমন আসে কালপুরুষ সন্ধ্যাকাশে তেমনি তুমি এসো তুমি এসো এসো। সুদূর হিমগিরির শিখরে মন্ত্র যবে প্রেরণ করে তাপস বৈশাখ প্রখর তাপে কঠিন ঘন তুষার গলায়ে, বন্যাধারা যেমন নেমে আসে, তেমনি তুমি এসো তুমি এসো এসো॥
৬৬
প্রেম
প্রেম
মম রুদ্ধমুকুলদলে এসো সৌরভ-অমৃতে, মম অখ্যাততিমিরতলে এসো গৌরবনিশীথে॥ এই মূল্যহারা মম শুক্তি, এসো মুক্তাকণায় তুমি মুক্তি— মম মৌনী বীণার তারে তারে এসো সঙ্গীতে॥ নব অরুণের এসো আহবান, চিররজনীর হোক অবসান— এসো। এসো শুভস্মিত শুকতারায়, এসো শিশির-অশ্রুধারায়, সিন্দুর পরাও ঊষারে তব রশ্মিতে॥
৬৭
প্রেম
প্রেম
এসো এসো পুরুষোত্তম, এসো এসো বীর মম।
৬৮
প্রেম
প্রেম
আমার নিশীথরাতের বাদল ধারা এস হে গোপনে আমার স্বপনলোকে দিশাহারা॥ ওগো অন্ধকারের অন্তরধন, দাও ঢেকে মোর পরান মন — আমি চাইনে তপন, চাই নে তারা॥ যখন সবাই মগন ঘুমের ঘোরে নিয়ো গো, নিয়ো গো, আমার ঘুম নিয়ো গো হরণ করে। একলা ঘরে চুপে চুপে এসো কেবল সুরের রূপে — দিয়ো গো, দিয়ো গো, আমার চোখের জলের দিয়ো সাড়া॥
৬৯
প্রেম
প্রেম
একলা ব’সে হেরো তোমার ছবি এঁকেছি আজ বসন্তী রঙ দিয়া। খোঁপার ফুলে একটি মধুলোভী মৌমাছি ওই গুঞ্জরে বন্দিয়া॥ সমুখ-পানে বালুতটের তলে শীর্ণ নদী শ্রান্তধারায় চলে, বেণুচ্ছায়া তোমার চেলাঞ্চলে উঠিছে স্পন্দিয়া॥ মগ্ন তোমার স্নিগ্ধ নয়ন দুটি ছায়ায় ছন্ন অরণ্য-অঙ্গনে প্রজাপতির দল যেখানে জুটি রঙ ছড়ালো প্রফুল্ল রঙ্গণে। তপ্ত হাওয়ায় শিথিলমঞ্জরী গোলকচাঁপা একটি দুটি করি পায়ের কাছে পড়ছে ঝরি ঝরি তোমারে নন্দিয়া॥ ঘাটের ধারে কম্পিত ঝাউশাখে দোয়েল দোলে সঙ্গীতে চঞ্চলি, আকাশ ঢালে পাতার ফাঁকে ফাঁকে তোমার কোলে সুবর্ণ-অঞ্জলি। বনের পথে কে যায় চলি দূরে — বাঁশির ব্যথা পিছন-ফেরা সুরে তোমায় ঘিরে হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে ফিরিছে ত্রন্দিয়া॥
৭০
প্রেম
প্রেম
কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুমচয়নে। সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে॥ দেখিতে দেখিতে নূতন আলোকে কে দিল রচিয়া ধ্যানের পুলকে নূতন ভুবন নূতন দ্যুলোকে মোদের মিলিত নয়নে॥ বাহির-আকাশে মেঘ ঘিরে আসে, এল সব তারা ঢাকিতে। হারানো সে আলো আসন বিছালো শুধু দুজনের আঁখিতে ভাষাহারা মম বিজন রোদনা প্রকাশের লাগি করেছে সাধনা, চিরজীবনেরই বাণীর বেদনা মিটিল দোঁহার নয়নে॥
৭১
প্রেম
প্রেম
দে পড়ে দে আমায় তোরা কী কথা আজ লিখেছে সে । তার দূরের বাণীর পরশমানিক লাগুক আমার প্রাণে এসে॥ শস্যখেতের গন্ধখানি একলা ঘরে দিক সে আনি, ক্লান্তগমন পান্থ হাওয়া লাগুক আমার মুক্ত কেশে॥ নীল আকাশের সুরটি নিয়ে বাজাক আমার বিজন মনে, ধূসর পথের উদাস বরন মেলুক আমার বাতায়নে। সূর্য ডোবার রাঙা বেলায় ছড়াবো প্রাণ রঙের খেলায়, আপন-মনে চোখের কোণে অশ্রু-আভাস উঠেব ভেসে॥
৭২
প্রেম
প্রেম
রাতে রাতে আলোর শিখা রাখি জ্বেলে ঘরের কোণে আসন মেলে॥ বুঝি সময় হল এবার আমার প্রদীপ নিবিয়ে দেবার — পূর্ণিমাচাঁদ, তুমি এলে॥ এত দিন সে ছিল তোমার পথের পাশে তোমার দরশনের আশে। আজ তারে যেই পরশিরে যাক সে নিবে,যাক সে নিবে— যা আছে সব দিক সে ঢেলে॥
৭৩
প্রেম
প্রেম
অনেক কথা বলেছিলেম কবে তোমার কানে কানে॥ কত নিশীথ-অন্ধকারে, কত গোপন গানে গানে॥ সে কি তোমার মনে আছে তাই শুধাতে এলেম কাছে— রাতের বুকের মাঝে মাঝে তারা মিলিয়ে আছে সকল খানে॥ ঘুম ভেঙে তাই শুনি যবে দীপ-নেভা মোর বাতায়নে। স্বপ্নে-পাওয়া বাদল-হাওয়া ছুটে আসে ক্ষণে ক্ষণে— বৃষ্টিধারার ঝরোঝরে ঝাউবাগানের মরোমরে ভিজে মাটির গন্ধে হঠাৎ সেই কথা সব মনে আনে॥
৭৪
প্রেম
প্রেম
জানি তোমার অজানা নাহি গো কী আছে আমার মনে। আমি গোপন করিতে চাহি গো, ধরা পড়ে দুনয়নে॥ কী বলিতে পাছে কী বলি তাই দূরে চলে যাই কেবলই, পথপাশে দিন বাহি গো- তুমি দেখে যাও আঁখিকোণে কী আছে আমার মনে॥ চির নিশীথতিমিরগহনে আছে মোর পূজাবেদী — চকিত হাসির দহনে সে তিমির দাও ভেদি। বিজন দিবস-রাতিয়া কাটে ধেয়ানের মালা গাঁথিয়া, আনমনে গান গাহি গো — তুমি শুনে যাও খনে খনে কী আছে আমার মনে॥
৭৫
প্রেম
প্রেম
পুরানো জানিয়া চেয়ো না আমারে আধেক আঁখির কোণে অলস অন্যমনে। আপনারে আমি দিতে আসি যেই জেনো জেনো সেই শুভ নিমেষেই জীর্ণ কিছুই নেই কিছু নেই, ফেলে দিই পুরাতনে॥ আপনারে দেয় ঝর্না আপন ত্যাগরসে উচ্ছলি — লহরে লহরে নূতন নূতন অঘের্যর অঞ্জলি। মাধবীকুঞ্জ বার বার করি বনলক্ষ্মীর ডালা দেয় ভরি — বারবার তার দানমঞ্জরী নব নব ক্ষণে ক্ষণে॥ তোমার প্রেমে যে লেগেছে আমায় চিরনূতনের সুর। সব কাজে মোর সব ভাবনায় জাগে চিরসুমধুর। মোর দানে নাই দীনতার লেশ, যত নেবে তুমি না পাবে শেষ — আমার দিনের সকল নিমেষ ভরা অশেষের ধনে॥
৭৬
প্রেম
প্রেম
আমার যদিই বেলা যায় গো বয়ে জেনো জেনো আমার মন রয়েছে তোমায় লয়ে॥ পথের ধারে আসন পাতি, তোমায় দেবার মালা গাঁথি — জেনো জেনো তাইতে আছি মগন হয়ে॥ চলে গেল যাত্রী সবে নানান পথে কলরবে। আমার চলা এমনি ক’রে আপন হাতে সাজি ভ’রে — জেনো জেনো আপন মনে গোপন রয়ে॥
৭৭
প্রেম
প্রেম
চপল তব নবীন আঁখি দুটি সহসা যত বাঁধন হতে আমারে দিল ছুটি॥ হৃদয় মম আকাশে গেল খুলি, সুদূরবনগন্ধ আসি করিল কোলাকুলি। ঘাসের ছোঁওয়া নিভৃত তরুছায়ে চুপিচুপি কী করুণ কথা কহিল সারা গায়ে। আমের বোল, ঝাউয়ের দোল, ঢেউয়ের লুটোপুটি — বুকের কাছে সবাই এল জুটি॥
৭৮
প্রেম
প্রেম
জয়যাত্রায় যাও গো, ওঠো জয়রথে তব। মোরা জয়মালা গেঁথে আশা চেয়ে বসে রব॥ মোরা আঁচল বিছায়ে রাখি পথ ধুলা দিব ঢাকি, ফিরে এলে হে বিজয়ী, তোমায় হৃদয়ে বরিয়া লব॥ আঁকিয়ো হাসির রেখা সজল আঁখির কোণে, নব বসন্তশোভা এনো এ কুঞ্জবনে। তোমার সোনার প্রদীপে জ্বলো আঁধার ঘরের আলো, পরাও রাতের ভালে চাঁদের তিলক নব॥
৭৯
প্রেম
প্রেম
বিজয়মালা এনো আমার লাগি। দীর্ঘরাত্রি রইব আমি জাগি॥ চরণ যখন পড়বে তোমার মরণকূলে বুকের মধ্যে উঠবে আমার পরান দুলে, সব যদি যায় হব তোমার সর্বনাশের ভাগী॥
৮০
প্রেম
প্রেম
আন্মনা, আন্মনা, তোমার কাছে আমার বাণীর মাল্যখানি আনব না॥ বার্তা আমার ব্যর্থ হবে, সত্য আমার বুঝবে কবে, তোমারো মন জানব না, আন্মনা, আন্মনা॥ লগ্ন যদি হয় অনুকূল মৌনমধুর সাঁঝে, নয়ন তোমার মগ্ন যখন ম্লান আলোর মাঝে, দেব তোমায় শান্ত সুরের সান্ত্বনা॥ ছন্দে গাঁথা বাণী তখন পড়ব তোমার কানে মন্দ মৃদুল তানে, ঝিল্লি যেমন শালের বনে নিদ্রানীরব রাতে অন্ধকারের জপের মালায় একটানা সুর গাঁথে একলা তোমার বিজন প্রাণের প্রাঙ্গণে প্রান্তে বসে একমনে এঁকে যাব আমার গানের আল্পনা, আন্মনা, আন্মনা॥
৮১
প্রেম
প্রেম
ওলো সই, ওলো সই, আমার ইচ্ছা করে তোদের মতো মনের কথা কই। ছড়িয়ে দিয়ে পা দুখানি কোণে বসে কানাকানি, কভু হেসে কভু কেঁদে চেয়ে বসে রই॥ ওলো সই, ওলো সই, তোদের আছে মনের কথা, আমার আছে কই। আমি কী বলিব, কার কথা, কোন্ সুখ, কোন্ ব্যথা — নাই কথা, তবু সাধ শত কথা কই॥ ওলো সই, ওলো সই, তোদের এত কী বলিবার আছে ভেবে অবাক হই। আমি একা বসি সন্ধ্যা হলে আপনি ভাসি নয়নজলে, কারণ কেহ শুধাইলে নীরব হয়ে রই॥
৮২
প্রেম
প্রেম
হৃদয়ের এ কূল, ও কূল, দু কূল ভেসে যায়, হায় সজনি, উথলে নয়নবারি। যে দিকে চেয়ে দেখি ওগো সখী, কিছু আর চিনিতে না পারি॥ পরানে পড়িয়াছে টান, ভরা নদীতে আসে বান, আজিকে কী ঘোর তুফান সজনি গো, বাঁধ আর বাঁধিতে নারি॥ কেন এমন হল গো, আমার এই নবযৌবনে। সহসা কী বহিল কোথাকার কোন্ পবনে। হৃদয় আপনি উদাস, মরমে কিসের হুতাশ — জানি না কী বাসনা, কী বেদনা গো — কেমনে আপনা নিবারি॥
৮৩
প্রেম
প্রেম
না বলে যেয়ো না চলে মিনতি করি, গোপনে জীবন মন লইয়া হরি॥ সারা নিশি জেগে থাকি, ঘুমে ঢুলে পড়ে আঁখি — ঘুমালে হারাই পাছে সে ভয়ে মরি॥ চকিতে চমকি, বঁধু, তোমায় খুঁজি — থেকে থেকে মনে হয় স্বপন বুঝি। নিশিদিন চাহে হিয়া পরান পসারি দিয়া অধীর চরণ তব বাঁধিয়া ধরি॥
৮৪
প্রেম
প্রেম
আর নাই রে বেলা, নামল ছায়া ধরণীতে। এখন চল্ রে ঘাটে কলসখানি ভরে নিতে॥ জলধারার কলস্বরে সন্ধ্যাগগন আকুল করে, ওরে, ডাকে আমায় পথের ’পরে সেই ধ্বনিতে॥ এখন বিজন পথে করে না কেউ আসা যাওয়া। ওরে, প্রেমনদীতে উঠেছে ঢেউ, উতল হাওয়া। জানি নে আর ফিরব কিনা, কার সাথে আজ হবে চিনা — ঘাটে সেই অজানা বাজায় বীণা তরণীতে॥
৮৫
প্রেম
প্রেম
বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা, নিয়ো হে নিয়ো। হৃদয় বিদারি হয়ে গেল ঢালা, পিয়ো হে পিয়ো॥ ভরা সে পাত্র তারে বুকে করে বেড়ানু বহিয়া সারা রাতি ধরে, লও তুলে লও আজি নিশিভোরে প্রিয় হে প্রিয়॥ বাসনার রঙে লহরে লহরে রঙিন হল। করুণ তোমার অরুণ অধরে তোলো হে তোলো। এ রসে মিশাক তব নিশ্বাস নবীন ঊষার পুষ্পসুবাস — এরই ’পরে তব আঁখির আভাস দিয়ো হে দিয়ো॥
৮৬
প্রেম
প্রেম
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী। তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী॥ তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে, তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে, তোমায় দেখেছি হৃদি-মাঝারে ওগো বিদেশিনী॥ আমি আকাশে পাতিয়া কান শুনেছি শুনেছি তোমারি গান, আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ ওগো বিদেশিনী। ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নূতন দেশে, আমি অতিথি তোমারি দ্বারে ওগো বিদেশিনী॥
৮৭
প্রেম
প্রেম
যা ছিল কালো-ধলো তোমার রঙে রঙে রাঙা হল। যেমন রাঙাবরন তোমার চরণ তার সনে আর ভেদ না র’ল॥ রাঙা হল বসন-ভূষণ, রাঙা হল শয়ন-স্বপন — মন হল কেমন দেখ্ রে, যেমন রাঙা কমল টলোমলো॥
৮৮
প্রেম
প্রেম
আহা, তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা, প্রিয় আমার, ওগো প্রিয় — বড়ো উতলা আজ পরান আমার, খেলাতে হার মানবে কি ও॥ কেবল তুমিই কি গো এমনি ভাবে রাঙিয়ে মোরে পালিয়ে যাবে। তুমি সাধ করে, নাথ, ধরা দিয়ে আমারও রঙ বক্ষে নিয়ো — এই হৃৎকমলের রাঙা রেণু রাঙাবে ওই উত্তরীয়॥
৮৯
প্রেম
প্রেম
আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়। আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়॥ যে জন দেয় না দেখা, যায় যে দেখে —ভালোবাসে আড়াল থেকে — আমার মন মজেছে সেই গভীরের গোপন ভালোবাসায়॥
৯০
প্রেম
প্রেম
আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব। আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাব॥ ভরাব না ভূষণভারে, সাজাব না ফুলের হারে — সোহাগ আমার মালা করে গলায় তোমার দোলাব। জানবে না কেউ কোন্ তুফানে তরঙ্গদল নাচবে প্রাণে, চাঁদের মতন অলখ টানে জোয়ারে ঢেউ তোলাব॥
৯১
প্রেম
প্রেম
আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী। আমি সকল দাগে হব দাগি॥ তোমার পথের কাঁটা করব চয়ন, যেথা তোমার ধুলায় শয়ন সেথা আঁচল পাতব আমার — তোমার রাগে অনুরাগী॥ আমি শুচি-আসন টেনে টেনে বেড়াব না বিধান মেনে, যে পঙ্কে ওই চরণ পড়ে তাহারি ছাপ বক্ষে মাগি॥
৯২
প্রেম
প্রেম
আমার নয়ন তোমার নয়নতলে মনের কথা খোঁজে, সেথায় কালো ছায়ার মায়ার ঘোরে পথ হারালো ও যে॥ নীরব দিঠে শুধায় যত পায় না সাড়া মনের মতো, অবুঝ হয়ে রয় সে চেয়ে অশ্রুধারায় মজে॥ তুমি আমার কথার আভাখানি পেয়েছ কি মনে। এই-যে আমি মালা আনি তার বাণী কেউ শোনে? পথ দিয়ে যাই, যেতে যেতে হাওয়ায় ব্যথা দিই যে পেতে — বাঁশি বিছায় বিষাদ-ছায়া তার ভাষা কেউ বোঝে॥
৯৩
প্রেম
প্রেম
ফুল তুলিতে ভুল করেছি প্রেমের সাধনে। বঁধু, তোমায় বাঁধব কিসে মধুর বাঁধনে॥ ভোলাব না মায়ার ছলে, রইব তোমার চরণতলে, মোহের ছায়া ফেলব না মোর হাসি-কাঁদনে॥ রইল শুধু বেদন-ভরা আশা, রইল শুধু প্রাণের নীরব ভাষা। নিরাভরণ যদি থাকি চোখের কোণে চাইবে না কি — যদি আঁখি নাই-বা ভোলাই রঙের ধাঁদনে॥
৯৪
প্রেম
প্রেম
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পেড়ে আলো। ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো॥ পাগল হাওয়া বুঝেত নারে ডাক পড়েছে কোথায় তারে — ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো॥ নীল গগনের ললাটখানি চন্দনে আজ মাখা, বাণীবনের হংসমিথুন মেলেছে আজ পাখা। পারিজাতের কেশর নিয়ে ধরায়, শশী, ছড়াও কী এ। ইন্দ্রপুরীর কোন্ রমণী বসরপ্রদীপ জ্বাল॥
৯৫
প্রেম
প্রেম
তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে আমায় শুধু ক্ষণেক-তরে। আজি হাতে আমার যা-কিছু কাজ আছে আমি সাঙ্গ করব পরে॥ না চাহিলে তোমার মুখপানে হৃদয় আমার বিরাম নাহি জানে, কাজের মাঝে ঘুরে বে.দাই যত ফিরি কূলহারা সাগরে॥ বসন্ত আজ উচ্ছ্বাসে নিশ্বাসে এল আমার বাতায়নে। অলস ভ্রমর গুঞ্জরিয়া আসে, ফেরে কুঞ্জের প্রাঙ্গণে। আজকে শুধু একান্তে আসীন চোখে চোখে চেয়ে থাকার দিন, আজকে জীবন-সমর্পণের গান গাব নীরব অবসরে॥
৯৬
প্রেম
প্রেম
ওগো, তোমার চক্ষু দিয়ে মেলে সত্য দৃষ্টি
৯৭
প্রেম
প্রেম
হে নবীনা, প্রতিদিনের পথের ধুলায় যায় না চিনা॥ শুনি বাণী ভাস বসন্তবাতাসে, প্রথম জাগরণে দেখি সোনার মেঘে লীনা॥ স্বপনে দাও ধরা কী কৌতুকে ভরা। কোন্ অলকার ফুলে মালা সাজাও চুলে, কোন্ অজানা সুরে বিজনে বাজাও বীণা॥
৯৮
প্রেম
প্রেম
ওগো শান্ত পাষাণমুরতি সুন্দরী, চঞ্চলেরে হৃদয়তলে লও বরি॥ কুঞ্জবনে এসো একা, নয়নে অশ্রু দিক্ দেখা — অরুণরাগে হোক রঞ্জিত বিকশিত বেদনার মঞ্জরী॥
৯৯
প্রেম
প্রেম
তোমার পায়ের তলায় যেন গো রঙ লাগে — আমার মনের বনের ফুলের রাঙা রাগে॥ যেন আমার গানের তানে তোমায় ভূষণ পরাই কানে, যেন রক্তমণির হার গেঁথে দিই প্রাণের অনুরাগে॥
১০০
প্রেম
প্রেম
অনেক পাওয়ার মাঝে মাঝে কবে কখন একটুখানি পাওয়া, সেইটুকুতেই জাগায় দখিন হাওয়া॥ দিনের পরে দিন চলে যায় যেন তারা পথের স্রোতেই ভাসা, বাহির হতেই তাদের যাওয়া আসা। কখন্ আসে একটি সকাল সে যেন মোর ঘরেই বাঁধে বাসা, সে যেন মোর চিরদিনের চাওয়া॥ হারিয়ে-যাওয়া আলোর মাঝে কণা কণা কুড়িয়ে পেলেম যারে রইল গাঁথা মোর জীবনের হারে। সেই-যে আমার জোড়া-দেওয়া ছিন্ন দিনের খণ্ড আলোর মালা সেই নিয়ে আজ সাজাই আমার থালা — এক পলকের পুলক যত, এক নিমেষের প্রদীপখানি জ্বালা, একতারাতে আধখানা গান গাওয়া॥
১০১
প্রেম
প্রেম
দিনশেষের রাঙা মুকুল জাগল চিতে। সঙ্গোপনে ফুটবে প্রেমের মঞ্জরীতে॥ মন্দবায়ে অন্ধকারে দুলবে তোমার পথের ধারে, গন্ধ তাহার লাগবে তোমার আগমনীতে — ফুটবে যখন মুকুল প্রেমের মঞ্জরীতে। রাত যেন না বৃথা কাটে প্রিয়তম হে — এসো এসো প্রাণে মম, গানে মম হে। এসো নিবিড় মিলনক্ষণে রজনীগন্ধার কাননে, স্বপন হয়ে এসো আমার নিশীথিনীতে — ফুটবে যখন মুকুল প্রেমের মঞ্জরীতে॥
১০২
প্রেম
প্রেম
আছ আকাশ-পানে তুলে মাথা, কোলে আধেকখানি মালা গাঁথা॥ ফাগুনবেলায় বহে আনে আলোর কথা ছায়ার কানে, তোমার মনে তারি সনে ভাবনা যত ফেরে যা-তা॥ কাছে থেকে রইলে দূরে, কায়া মিলায় গানের সুরে। হারিয়ে-যাওয়া হৃদয় তব মূর্তি ধরে নব নব — পিয়ালবনে উড়ালো চুল, বকুলবনে আঁচল পাতা॥
১০৩
প্রেম
প্রেম
না, না গো না, কোরো না ভাবনা — যদি বা নিশি যায় যাব না, যাব না॥ যখনি চলে যাই আসিব বলে যাই, আলোছায়ার পথে করি আনাগোনা॥ দোলাতে দোলে মন মিলনে বিরহে। বারে বারেই জানি তুমি তো চির হে। ক্ষণিক আড়ালে বারেক দাঁড়ালে মরি ভয়ে ভয়ে পাব কি পাব না॥
১০৪
প্রেম
প্রেম
চৈত্রপবনে মম চিত্তবনে বাণীমঞ্জরী সঞ্চলিতা ওগো ললিতা॥ যদি বিজনে দিন বহে যায় খর তপনে ঝরে পড়ে হায় অনাদরে হবে ধূলিদলিতা ওগো ললিতা॥ তোমার লাগিয়া আছি পথ চাহি — বুঝি বেলা আর নাহি নাহি বনছায়াতে তারে দেখা দাও, করুণ হাতে তুলে নিয়ে যাও — কণ্ঠহারে করো সঙ্কলিতা ওগো ললিতা॥
১০৫
প্রেম
প্রেম
নূপুর বেজে যায় রিনিরিনি আমার মন কয়, চিনি চিনি॥ গন্ধ রেখে যায় মধুবায়ে মাধবীবিতানের ছায়ে ছায়ে, ধরণী শিহরায় পায়ে পায়ে, কলসে কঙ্কণে কিনিকিনি॥ পারুল শুধাইল, কে তুমি গো, অজানা কাননের মায়ামৃগ। কামিনী ফুলকুল বরষিছে, পবন এলোচুল পরশিছে, আঁধারে তারাগুলি হরষিছে, ঝিল্লি ঝনকিছে ঝিনিঝিনি॥
১০৬
প্রেম
প্রেম
আরো একটু বসো তুমি, আরো একটু বলো। পথিক, কেন অথির হেন, নয়ন ছলোছলো॥ আমার কী যে শুনতে এলে তার কিছু কি আভাস পেলে — নীরব কথা বুকে আমার করে টলোমলো॥ যখন থাক দূরে আমার মনের গোপন বাণী বাজে গভীর সুরে। কাছে এলে তোমার আঁখি সকল কথা দেয় যে ঢাকি — সে যে মৌন প্রাণের রাতে তারা জ্বলোজ্বলো॥
১০৭
প্রেম
প্রেম
বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি তোমারি দ্বারে, পথিকেরে লহো ডাকি তব মন্দিরের এক ধারে॥ বনপথ হতে, সুন্দরী, এনেছি মল্লিকামঞ্জরী — তুমি লবে নিজ বেণীবন্ধে মনে রেখেছি এ দুরাশারে॥ কোনো কথা নাহি বলে ধীরে ধীরে ফিরে যাব চলে। ঝিল্লিঝঙ্কৃত নিশীথে পথে যেতে বাঁশরিতে শেষ গান পাঠাব তোমা-পানে শেষ উপহারে॥
১০৮
প্রেম
প্রেম
মেঘছায়ে সজল বায়ে মন আমার উতলা করে সারাবেলা কার লুপ্ত হাসি, সুপ্ত বেদনা হায় রে। কোন্ বসন্তের নিশীথে যে বকুলমালাখানি পরালে তার দলগুলি গেছে ঝরে, শুধু গন্ধ ভাসে প্রাণে॥ জানি, ফিরিবে না আর ফিরিবে না, পথ তব গেছে সুদূরে। পারিলে না তবু পারিলে না চির শূন্য করিতে এ ভুবন — তুমি নিয়ে গেছ মোর বাঁশিখানি, দিয়ে গেছ তোমার গান॥
১০৯
প্রেম
প্রেম
গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা। আমার যা কথা ছিল হয়ে গেল সারা॥ হয়তো সে তুমি শোন নাই, সহজে বিদায় দিলে তাই — আকাশ মুখর ছিল যে তখন, ঝরোঝরো বারিধারা॥ চেয়েছিনু যবে মুখে তোলো নাই আঁখি, আঁধারে নীরব ব্যথা দিয়েছিল ঢাকি। আর কি কখনো কবে এমন সন্ধ্যা হবে — জনমের মতো হায় হয়ে গেল হারা॥
১১০
প্রেম
প্রেম
আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে, চাও কি — হায় বুঝি তার খবর পেলে না। পারিজাতের মধুর গন্ধ পাও কি — হায় বুঝি তার নাগাল মেলে না॥ প্রেমের বাদল নামল, তুমি জানো না হায় তাও কি। মেঘের ডাকে তোমার মনের ময়ূরকে নাচাও কি। আমি সেতারেতে তার বেঁধেছি, আমি সুরলোকের সুর সেধেছি, তারি তানে তানে মনে প্রাণে মিলিয়ে গলা গাও কি — হায় আসরেতে বুঝি এলে না। ডাক উঠেছে বারে বারে, তুমি সাড়া দাও কি! আজ ঝুলনদিনে দোলন লাগে, তোমার পরান হেলে না॥
১১১
প্রেম
প্রেম
তোমার মনের একটি কথা আমায় বলো। তোমার নয়ন কেন এমন ছলোছলো॥ বনের ’পরে বৃষ্টি ঝরে ঝরোঝরো রবে। সন্ধ্যা মুখরিত ঝিল্লিস্বরে নীপকুঞ্জতলে। শালের বীথিকায় বারি বহে যায় কলোকলো॥ আজি দিগন্তসীমা বৃষ্টি-আড়ালে হারালো নীলিমা — ছায়া পড়ে তব মুখের ’পরে, ছায়া ঘনায় তব মনে মনে ক্ষণে ক্ষণে, অশ্রুমন্থর বাতাসে বাতাসে তোমার হৃদয় টলোটলো॥
১১২
প্রেম
প্রেম
উদাসিনী-বেশে বিদেশিনী কে সে নাইবা তাহারে জানি, রঙে রঙে লিখা আঁকি মরীচিকা মনে মনে ছবিখানি॥ পুবের হাওয়ায় তরীখানি তার এই ভাঙা ঘাট কবে হল পার দূর নীলিমার বক্ষে তাহার উদ্ধত বেগ হানি॥ মুগ্ধ আলসে গণি একা বসে পলাতকা যত ঢেউ। যারা চলে যায় ফেরে না তো হায় পিছু-পানে আর কেউ। মনে জানি, কারো নাগাল পাব না— তবু যদি মোর উদাসী ভাবনা কোনো বাসা পায় সেই দুরাশায় গাঁথি সাহানায় বাণী॥
১১৩
প্রেম
প্রেম
আমি যাব না গো অমনি চলে। অনেক সুখে অনেক দুখে তোমার বাণী নিলেম বুকে, ফাগুনশেষে যাবার বেলা আমার বাণী যাব বলে॥ কিছু হল, অনেক বাকি। ক্ষমা আমায় করবে না কি। গান এসেছে সুর আসে নাই, হল না যে শোনানো তাই — সে সুর আমার রইল ঢাকা নয়নজলে॥
১১৪
প্রেম
প্রেম
খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়ো না আর বাহিরে আমারে দাঁড়ায়ে। দাও সাড়া দাও, এই দিকে চাও, এসো দুই বাহু বাড়ায়ে॥ কাজ হয়ে গেছে সারা, উঠেছে সন্ধ্যাতারা। আলোকের খেয়া হয়ে গেল দেয়া অস্তসাগর পারায়ে॥ ভরি লয়ে ঝারি এনেছ কি বারি, সেজেছ কি শুচি দুকূলে। বেঁধেছ কি চুল, তুলেছ কি ফুল, গেঁথেছ কি মালা মুকুলে। ধেনু এল গোঠে ফিরে, পাখিরা এসেছে নীড়ে, পথ ছিল যত জুড়িয়া জগত আঁধারে গিয়েছে হারায়ে॥
১১৫
প্রেম
প্রেম
বাজিবে, সখী, বাঁশি বাজিবে — হৃদয়রাজ হৃদে রাজিবে॥ বচন রাশি রাশি কোথা যে যাবে ভাসি, অধরে লাজহাসি সাজিবে॥ নয়নে আঁখিজল করিবে ছলছল সুখবেদনা মনে বাজিবে। মরমে মুরছিয়া মিলাতে চাবে হিয়া সেই চরণযুগরাজীবে॥
১১৬
প্রেম
প্রেম
কে বলেছে তোমায়, বঁধু, এত দুঃখ সইতে। আপনি কেন এলে, বঁধু, আমার বোঝা বইতে॥ প্রাণের বন্ধু, বুকের বন্ধু, সুখের বন্ধু, দুখের বন্ধু — তোমায় দেব না দুখ, পাব না দুখ, হেরব তোমার প্রসন্ন মুখ, আমি সুখে দুঃখে পারব বন্ধু, চিরানন্দে রইতে — তোমার সঙ্গে বিনা কথায় মনের কথা কইতে॥
১১৭
প্রেম
প্রেম
সে আমার গোপন কথা শুনে যা ও সখী! ভেবে না পাই বলব কী॥ প্রাণ যে আমর বাঁশি শোনে নীল গগনে, গান হয়ে যায় মনে মনে যাহাই বকি॥ সে যেন আসবে আমার মন বলেছে, হাসির ’পরে তাই তো চোখের জল গলেছে। দেখ্ লো তাই দেয় ইশারা তারায় তারা, চাঁদ হেসে ওই হল সারা তাহাই লখি॥
১১৮
প্রেম
প্রেম
এ কী সুধারস আনে আজি মম মনে প্রাণে॥ সে যে চিরদিবসেরই, নূতন তাহারে হেরি — বাতাস সে মুখ ঘেরি মাতে গুঞ্জনগানে॥ পুরাতন বীণাখানি ফিরে পেল হারা বাণী। নীলাকাশ শ্যামধরা পরশে তাহারি ভরা — ধরা দিল অগোচরা নব নব সুরে তানে॥
১১৯
প্রেম
প্রেম
ও যে মানে না মানা। আঁখি ফিরাইলে বলে, ’না, না, না।’ যত বলি ‘নাই রাতি —মলিন হয়েছে বাতি’ মুখপানে চেয়ে বলে, ‘না, না, না।’ বিধুর বিকল হয়ে খেপা পবনে ফাগুন করিছে হা-হা ফুলের বনে। আমি যত বলি ‘তবে এবার যে যেতে হবে’ দুয়ারে দাঁড়ায়ে বলে, ‘না, না, না।’
১২০
প্রেম
প্রেম
মান অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে আয়— তারে এগিয়ে নিয়ে আয় চোখের জলে মিলিয়ে হাসি ঢেলে দে তার পায়— ওরে, ঢেলে দে তার পায়॥ আসছে পথে ছায়া পড়ে, আকাশ এল আঁধার করে, শুষ্ক কুসুম পড়ছে ঝরে, সময় বহে যায়— ওরে সময় বহে যায়॥
১২১
প্রেম
প্রেম
তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা, এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা॥ যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো, আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা॥ তব মুখ সদা মনে জাগিতেছে সংেগাপনে, তিলেক অন্তর হলে না হেরি কূল-কিনারা। কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা॥
১২২
প্রেম
প্রেম
যদি বারণ কর তবে গাহিব না। যদি শরম লাগে মুখে চাহিব না॥ যদি বিরলে মালা গাঁথা সহসা পায় বাধা তোমার ফুলবনে যাইব না॥ যদি থমকি থেমে যাও পথমাঝে আমি চমকি চলে যাব আন কাজে। যদি তোমার নদীকূলে ভুলিয়া ঢেউ তুলে আমার তরীখানি বাহিব না॥
১২৩
প্রেম
প্রেম
কেন বাজাও কাঁকন কনকন কত ছলভরে। ওগো, ঘরে ফিরে চলো কনককলসে জল ভরে॥ কেন জলে ঢেউ তুলি ছলকি ছলকি কর খেলা। কেন চাহ খনে খনে চকিত নয়নে কার তরে কত ছলভরে॥ হেরো যমুনা-বেলায় আলসে হেলায় গেল বেলা, যত হাসিভরা ঢেউ করে কানাকানি কলস্বরে কত ছলভরে। হেরো নদীপরপারে গগনকিনারে মেঘমেলা, তারা হাসিয়া হাসিয়া চাহিছে তোমারি মুখ’পরে কত ছলভরে॥
১২৪
প্রেম
প্রেম
যামিনী না যেতে জাগালে না কেন, বেলা হল মরি লাজে। শরমে জড়িত চরণে কেমনে চলিব পথের মাঝে॥ আলোকপরশে মরমে মরিয়া হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া, কোনোমতে আছে পরান ধরিয়া কামিনী শিথিল সাজে॥ নিবিয়া বাঁচিল নিশার প্রদীপ ঊষার বাতাস লাগি, রজনীর শশী গগনের কোণে লুকায় শরণ মাগি। পাখি ডাকি বলে ‘গেল বিভাবরী’, বধূ চলে জলে লইয়া গাগরি। আমি এ আকুল কবরী আবরি কেমনে যাইব কাজে॥
১২৫
প্রেম
প্রেম
নিশি না পোহাতে জীবনপ্রদীপ জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া, তোমার অনল দিয়া॥ কবে যাবে তুমি সমুখের পথে দীপ্ত শিখাটি বাহি আছি তাই পথ চাহি। পুড়িবে বলিয়া রয়েছে আশায় আমার নীরব হিয়া আপন আঁধার নিয়া॥
১২৬
প্রেম
প্রেম
অলকে কুসুম না দিয়ো, শুধু শিথিল কবরী বাঁধিয়ো। কাজলবিহীন সজল নয়নে হৃদয়দুয়ারে ঘা দিয়ো॥ আকুল আঁচলে পথিকচরণে মরনের ফাঁদ ফাঁদিয়ো— না করিয়া বাদ মনে যাহা সাধ, নিদয়া, নীরবে সাধিয়ো॥ এসো এসো বিনা ভূষণেই, দোষ নেই তাহে দোষ নেই। যে আসে আসুক ওই তব রূপ অযতন-ছাঁদে ছাঁদিয়ো। শুধু হাসিখানি আঁখিকোণে হানি উতলা হৃদয় ধাঁদিয়ো॥
১২৭
প্রেম
প্রেম
নিশীথে কী কয়ে গেল মনে কী জানি, কী জানি। সে কি ঘুমে, সে কি জাগরণে কী জানি, কীজানি॥ নানা কাজে নানা নানা মতে ফিরি ঘরে, ফিরি পথে— সে কথা কি অগোচরে বাজে ক্ষণে ক্ষণে। কী জানি, কী জানি॥ সে কথা কি অকারণে ব্যথিছে হৃদয়, একি ভয়, একি জয়। সে কথা কি কানে কানে বারে বারে কয় ‘আর নয়’ ‘আর নয়’। সে কথা কি নানা সুরে বলে মোরে ‘চলো দূরে’— সে কি বাজে বুকে মম, বাজে কি গগনে। কী জানি, কী জানি॥
১২৮
প্রেম
প্রেম
মোর স্বপন-তরীর কে তুই নেয়ে। লাগল পালে নেশার হাওয়া, পাগল পরান চলে গেয়ে॥ আমায় ভুলিয়ে দিয়ে যা তোর দুলিয়ে দিয়ে না, তোর সুদূর ঘাটে চল্ রে বেয়ে॥ আমার ভাবনা তো সব মিছে, আমার সব পড়ে থাক্ পিছে। তোমার ঘোমটা খুলে দাও, তোমার নয়ন তুলে চাও, দাও হাসিতে মোর পরান ছেয়ে॥
১২৯
প্রেম
প্রেম
ভালোবাসি, ভালোবাসি— এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি॥ আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে, দিগন্তে কার কালো আঁখি আঁখির জলে যায় গো ভাসি॥ সেই সুরে সাগরকূলে বাঁধন খুলে অতল রোদন উঠে দুলে। সেই সুরে বাজে মনে অকারণে ভুলে-যাওয়া গানের বাণী, ভোলা দিনের কাঁদন-হাসি॥
১৩০
প্রেম
প্রেম
এবার মিলন-হাওয়ায়-হাওয়ায় হেলতে হবে। ধরা দেবার খেলা এবার খেলতে হবে॥ ওগো পথিক, পথের টানে চলেছিলে মরণ-পানে, আঙিনাতে আসন এবার মেলতে হবে॥ মাধবিকার কুঁড়িগুলি আনো তুলে—মালতিকার মালা গাঁথো নবীন ফুলে। স্বপ্নস্রোতে ভিড়বি পারে, বাঁধবি দুজন দুইজনারে, সেই মায়াজাল হৃদয় ঘিরে ফেলতে হবে॥
১৩১
প্রেম
প্রেম
তোমার রঙিন পাতায় লিখব প্রাণের কোন্ বারতা। রঙের তুলি পাব কোথা॥ সে রঙ তো নেই চোখের জলে, আছে কেবল হৃদয়তলে, প্রকাশ করি কিসের ছলে মনের কথা। কইতে গেলে রইবে কি তার সরলতা॥ বন্ধু, তুমি বুঝবে কি মোর সহজ বলা— নাই যে আমার ছলা কলা। সুর যা ছিল বাহির ত্যেজে অন্তরেতে উঠল বেজে, একলা কেবল জানে সে যে মোর দেবতা। কেমন করে করব বাহির মনের কথা॥
১৩২
প্রেম
প্রেম
আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে। ওগো আমার প্রিয়, তোমার রঙিন উত্তরীয় পরো পরো পরো তবে॥ মেঘ রঙে রঙে বোনা, আজ রবির রঙে সোনা, আজ আলোর রঙ বাজল পাখির রবে॥ আজ রঙ-সাগরে তুফান ওঠে মেতে। যখন তারি হাওয়া লাগে তখন রঙের মাতন জাগে কাঁচা সবুজ ধানের খেতে। সেই রাতের-স্বপন-ভাঙা আমার হৃদয় হোক-না রাঙা তোমার রঙেরই গৌরবে॥
১৩৩
প্রেম
প্রেম
এই বুঝি মোর ভোরের তারা এল সাঁঝের তারার বেশে। অবাক্-চোখে ওই চেয়ে রয় চিরদিনের হাসি হেসে॥ সকল বেলা পাই নি দেখা, পাড়ি দিল কখন একা, নামল আলোক-সাগর-পারে অন্ধকারের ঘাটে এসে॥ সকাল বেলা আমার হৃদয় ভরিয়ে ছিল পথের গানে, সন্ধ্যাবেলা বাজায় বীণা কোন্ সুরে যে কেই বা জানে। পরিচয়ের রসের ধারা কিছুতে আর হয় না হারা, বারে বারে নতুন করে চিত্ত আমার ভুলাবে সে॥
১৩৪
প্রেম
প্রেম
আমার দোসর যে জন ওগো তারে কে জানে। একতারা তার দেয় কি সাড়া আমার গানে কে জানে॥ আমার নদীর যে ঢেউ ওগো জানে কি কেউ যায় বহে যায় কাহার পানে। কে জানে॥ যখন বকুল ঝরে আমার কাননতল যায় গো ভরে তখন কে আসে-যায় সেই বনছায়ায়, কে সাজি তার ভরে আনে। কে জানে॥
১৩৫
প্রেম
প্রেম
আমার লতার প্রথম মুকুল চেয়ে আছে মোর পানে, শুধায় আমারে ‘এসেছি এ কোনখানে’॥ এসেছ আমার জীবনলীলার রঙ্গে, এসেছ আমার তরল ভাবের ভঙ্গে, এসেছ আমার স্বরতরঙ্গ-গানে॥ আমার লতার প্রথম মুকুল প্রভাত-আলোক-মাঝে শুধায় আমারে ‘এসেছি এ কোন্ কাজে’। টুটিতে গ্রন্থি কাজের জটিল বন্ধে, বিবশ চিত্ত ভরিতে অলস গন্ধে, বাজাতে বাঁশরি প্রেমাতুর দুনয়ানে॥
১৩৬
প্রেম
প্রেম
দুঃখ দিয়ে মেটাব দুঃখ তোমার, স্নান করাব অতল জলে বিপুল বেদনার॥ মোর সংসার দিব যে জ্বালি, শোধন হবে এ মোহের কালী, মরণব্যথা দিব তোমার চরণে উপহার॥
১৩৭
প্রেম
প্রেম
একদিন চিনে নেবে তারে, তারে চিনে নেবে অনাদরে যে রয়েছে কুণ্ঠিতা॥ সরে যাবে নবারুণ-আলোকে এই কালো অবগুণ্ঠন— ঢেকে রবে না রবে না মায়াকুহেলীর মলিন আবরণ, তারে চিনে নেরব॥ আজ গাঁথুক মালা সে গাঁথুক মালা, তার দুঃখরজনীর অশ্রুমালা। কখন দুয়ারে অতিথি আসিবে, লবে তুলি মালাখানি ললাটে। আজি জ্বালুক প্রদীপ চির-অপরিচিতা পূর্ণপ্রকাশের লগন-লাগি— তারে চিনে নেবে॥
১৩৮
প্রেম
প্রেম
মম যৌবননিকুঞ্জে গাহে পাখি— সখি, জাগ জাগ। মেলি রাগ-অলস আঁখি— অনু রাগ-অলস আঁখি সখি, জাগ জাগ॥ আজি চঞ্চল এ নিশীথে জাগ ফাগুনগুণগীতে অয়ি প্রথমপ্রণয়ভীতে, মম নন্দন-অটবীতে পিক মুহু মুহু উঠে ডাকি—সখি, জাগ জাগ॥ জাগ নবীন গৌরবে, নব বকুলসৌরভে, মৃদু মলয়বীজনে জাগ নিভৃত নির্জনে। আজি আকুল ফুলসাজে জাগ মৃদুকম্পিত লাজে, মম হৃদয়শয়নমাঝে, শুন মধুর মুরলী বাজে মম অন্তরে থাকি থাকি— সখি, জাগ জাগ॥
১৩৯
প্রেম
প্রেম
আহা, জাগি পোহালো বিভাবরী। ক্লান্ত নয়ন তব সুন্দরী॥ ম্লান প্রদীপ ঊষানিলচঞ্চল, পাণ্ডুর শশধর গত-অস্তাচল, মুছ আঁখিজল, চল সখি, চল অঙ্গে নীলঞ্চল সম্বরি॥ শরতপ্রভাত নিরাময় নির্মল, শান্ত সমীরে কোমল পরিমল, নির্জন বনতল শিশিরসুশীতল, পুলকাকুল তরুবল্লরী। বিরহশয়নে ফেলি মলিন মালিকা এস নবভুবনে এস গো বালিকা, গাঁথি লহ অঞ্চলে নব শেফালিকা অলকে নবীন ফুলমঞ্জরী॥
১৪০
প্রেম
প্রেম
সে আসে ধীরে, যায় লাজে ফিরে। রিনিকি রিনিকি রিনিঝিনি মঞ্জু মঞ্জু মঞ্জীরে রিনিঝিনি-ঝিন্নীরে॥ বিকচ নীপকুঞ্জে নিবিড়তিমিরপুঞ্জে কুন্তলফুলগন্ধ আসে অন্তরমন্দিরে উন্মদ সমীরে॥ শঙ্কিত চিত কম্পিত অতি, অঞ্চল উড়ে চঞ্চল। পুষ্পিত তৃণবীথি, ঝঙ্কৃত বনগীতি— কোমলপদপল্লবতলচুম্বিত ধরণীরে নিকুঞ্জকুটীরে॥
১৪১
প্রেম
প্রেম
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি, আছে অন্তরে। পরানে বসন্ত এল কার মন্তরে॥ মুঞ্জরিল শুষ্ক শাখী, কুহরিল মৌন পাখি, বহিল আনন্দধারা মরুপ্রান্তরে॥ দুখেরে করি না ডর, বিরহে বেঁধেছি ঘর, মনোকুঞ্জে মধুকর তবু গুঞ্জরে। হৃদয়ে সুখের বাসা, মরমে অমর আশা, চিরবন্দী ভালোবাসা প্রাণপিঞ্জরে॥
১৪২
প্রেম
প্রেম
আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো। তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো॥ তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও— আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে, আর কিছু নাহি চাই গো॥ আমি তোমারি বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস— দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস। যদি আর-কারে ভালোবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস, তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো॥
১৪৩
প্রেম
প্রেম
আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি, তুমি অবসরমত বাসিয়ো। নিশিদিন হেথায় বসে আছি, তোমার যখন মনে পড়ে আসিয়ো॥ আমি সারনিশি তোমা-লাগিয়া রব বিরহশয়নে জাগিয়া— তুমি নিমেষের তরে প্রভাতে এসে মুখপানে চেয়ে হাসিয়ো॥ তুমি চিরদিন মধুপবনে চির- বিকশিত বনভবনে যেয়ো মনোমত পথ ধরিয়া তুমি নিজ সুখস্রোতে ভাসিয়ো। যদি তার মাঝে পড়ি আসিয়া তবে আমিও চলিব ভাসিয়া, যদি দূরে পড়ি তাহে ক্ষতি কী— মোর স্মৃতি মন হতে নাশিয়ো॥
১৪৪
প্রেম
প্রেম
সখী, ওই বুঝি বাঁশি বাজে— বনমাঝে কি মনোমাঝে॥ বসন্তবায় বহিছে কোথায়, কোথায় ফুটেছে ফুল, বলো গো সজনি, এ সুখরজনী কোন্খানে উদিয়াছে— বনমাঝে কি মনোমাঝে॥ যাব কি যাব না মিছে এ ভাবনা, মিছে মরি লোকলাজে। কে জানে কোথা সে বিরহহুতাশে ফিরে অভিসারসাজে— বনমাঝে কি মনোমাঝে॥
১৪৫
প্রেম
প্রেম
ওরে, কী শুনেছিস ঘুমের ঘোরে, তোর নয়ন এল জলে ভরে॥ এত দিনে তোমায় বুঝি আঁধার ঘরে পেল খুঁজি— পথের বঁধু দুয়ার ভেঙে পথের পথিক করবে তোরে॥ তোর দুখের শিখায় জ্বাল্ রে প্রদীপ জ্বাল্ রে। তোর সকল দিয়ে ভরিস পূজার থাল রে। যেন জীবন মরণ একটি ধারায় তাঁর চরণে আপনা হারায়, সেই পরশে মোহের বাঁধন রূপ যেন পায় প্রেমের ডোরে॥
১৪৬
প্রেম
প্রেম
কার চোখের চাওয়ার হাওয়ায় দোলায় মন, তাই কেমন হয়ে আছিস সারাক্ষণ। হাসি যে অশ্রুভারে নোওয়া, ভাবনা যে তাই মৌন দিয়ে ছোঁওয়া, ভাষায় যে তোর সুরের আবরণ॥ তোর পরানে কোন্ পরশমণির খেলা, তাই হৃদগগনে সোনার মেঘের মেলা দিনের স্রোতে তাই তো পলকগুলি ঢেউ খেলে যায় সোনার ঝলক তুলি, কালোয় আলোয় কাঁপে আঁখির কোণ॥
১৪৭
প্রেম
প্রেম
অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি। তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি॥ যে আছে মম গভীর প্রাণে ভেদিবে তারে হাসির বাণে, চকিতে চাহ মুখের পানে তুমি যে কুতূহলী। তোমারে তাই এড়াতে চাই, ফিরিয়া যাই চলি॥ আমার চোখে যে চাওয়াখানি ধোওয়া সে আঁখিলোরে— তোমারে আমি দেখিতে পাই, তুমি না পাও মোরে। তোমার মনে কুয়াশা আছে, আপনি ঢাকা আপন-কাছে— নিজের অগোচরেই পাছে আমারে যাও ছলি তোমারে তাই এড়াতে চাই, ফিরিয়া যাই চলি॥
১৪৮
প্রেম
প্রেম
না বলে যায় পাছে সে আঁখি মোর ঘুম না জানে। কাছে তার রই, তবুও ব্যথা যে রয় পরানে॥ যে পথিক পথের ভুলে এল মোর প্রাণের কূলে পাছে তার ভুল ভেঙে যায়, চলে যায় কোন্ উজানে॥ এল যেই এল আমার আগল টুটে, খোলা দ্বার দিয়ে আবার যাবে ছুটে। খেয়ালের হাওয়া লেগে যে খ্যাপা ওঠে জেগে সে কি আর সেই অবেলায় মিনতির বাধা মানে॥
১৪৯
প্রেম
প্রেম
তবে শেষ করে দাও শেষ গান, তার পরে যাই চলে। তুমি ভুলে যেও এ রজনী, আজ রজনী ভোর হলে॥ বাহুডোরে বাঁধি কারে, স্বপ্ন কভু বাঁধা পড়ে? বক্ষে শুধু বাজে ব্যথা, আঁখি ভাসে জলে॥
১৫০
প্রেম
প্রেম
সখী, আমারি দুয়ারে কেন আসিল নিশিভোরে যোগী ভিখারি। কেন করুণস্বরে বীণা বাজিল॥ আমি আসি যাই যতবার চোখে পড়ে মুখ তার, তারে ডাকিব কি ফিরাইব তাই ভাবি লো॥ শ্রাবণে আঁধার দিশি, শরতে বিমল নিশি, বসন্তে দখিন বায়ু, বিকশিত উপবন— কত ভাবে কত গীতি গাহিতেছে নিতি নিতি মন নাহি লাগে কাজে, আঁখিজলে ভাসি লো॥
১৫১
প্রেম
প্রেম
তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে। যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে। যদি থাকি কাছাকাছি, দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি— তবু মনে রেখো যদি জল আসে আঁখিপাতে, এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে, এক দিন যদি বাধা পড়ে কাজে শারদ প্রাতে— তবু মনে রেখো॥ যদি পড়িয়া মনে ছলোছলো জল নাই দেখা দেয় নয়নকোণে— তবু মনে রেখো॥
১৫২
প্রেম
প্রেম
লক্ষ্মী যখন আসবে তখন কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই? দেখ্ রে চেয়ে আপন-পানে, পদ্মটি নাই, পদ্মটি নাই॥ ফিরছে কেঁদে প্রভাতবাতাস, আলোক যে তার ম্লান হতাশ, মুখে চেয়ে আকাশ তোরে শুধায় আজি নীরবে তাই॥ কত গোপন আশা নিয়ে কোন্ সে গহন রাত্রি শেষে অগাধ জলের তলা হতে অমল কুঁড়ি উঠল ভেসে। হল না তার ফুটে ওঠা, কখন ভেঙে পড়ল বোঁটা— মতর্য-কাছে স্বর্গ যা চায় সেই মাধুরী কোথা রে পাই॥
১৫৩
প্রেম
প্রেম
আকুল কেশে আসে, চায় ম্লাননয়নে, কে গো চিরবিরহিণী— নিশিভোরে আঁখি জড়িত ঘুমঘোরে, বিজন ভবনে, কুসুমসুরভি মৃদু পবনে, সুখশয়নে, মম প্রভাতস্বপনে শিহরি চমকি জাগি তারি লাগি। চকিতে মিলায় ছায়াপ্রায়, শুধু রেখে যায় ব্যাকুল বাসনা কুসুমকাননে॥
১৫৪
প্রেম
প্রেম
কে দিল আবার আঘাত আমার দুয়ারে। এ নিশীথকালে কে আসি দাঁড়ালে, খুঁজিতে আসিলে কাহারে॥ বহুকাল হল বসন্তদিন এসেছিল এক অতিথি নবীন আকুল জীবন করিল মগন অকূল পুলকপাথারে॥ আজি এ বরষা নিবিড়তিমির, ঝরোঝরো জল, জীর্ণ কুটীর— বাদলের বায়ে প্রদীপ নিবায়ে জেগে বসে আছি একা রে। অতিথি অজানা, তব গীতসুর লাগিতেছে কানে ভীষণমধুর— ভাবিতেছি মনে যাব তব সনে অচেনা অসীম আঁধারে॥
১৫৫
প্রেম
প্রেম
নাই বা এলে যদি সময় নাই, ক্ষণেক এসে বোলো না গো ‘যাই যাই যাই’॥ আমার প্রাণে আছে জানি সীমাবিহীন গভীর বাণী, তোমায় চিরদিনের কথাখানি বলতে যেন পাই॥ যখন দখিনহাওয়া কানন ঘিরে এক কথা কয় ফিরে ফিরে, পূর্ণিমাচাঁদ কারে চেয়ে এক তানে দেয় আকাশ ছেয়ে, যেন সময়হারা সেই সময়ে একটি সে গান গাই॥
১৫৬
প্রেম
প্রেম
জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না, হায় ভীরু প্রেম, হায় রে। আশার আলোয় তবুও ভরসা পায় না, মুখে হাসি তবু চোখে জল না শুকায় রে॥ বিরহের দাহ আজি হল যদি সারা, ঝরিল মিলনরসের শ্রাবণধারা, তবুও এমন গোপন বেদনতাপে অকারণ দুখে পরান কেন দুখায় রে॥ যদিবা ভেঙেছে ক্ষণিক মোহের ভুল, এখনো প্রাণে কি যাবে না মানের মূল। যাহা খুঁজিবার সাঙ্গ হল তো খোঁজা, যাহা বুঝিবার শেষ হয়ে গেল বোঝা, তবু কেন হেন সংশয়ঘনছায়ে মনের কথাটি নীরব মনে লুকায় রে॥
১৫৭
প্রেম
প্রেম
কাঁদালে তুমি মোরে ভলোবাসারই ঘায়ে— নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে॥ তোমার অভিসারে যাব অগম-পারে চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে॥ পরানে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধারা— দুখের মাধুরীতে করিল দিশাহারা। সকলই নিবে কেড়ে, দিবে না তবু ছেড়ে— মন সরে না যেতে, ফেলিলে একি দায়ে॥
১৫৮
প্রেম
প্রেম
আমার মনের কোণের বাইরে জানলা খুলে ক্ষণে ক্ষণে চাই রে॥ কোন্ অনেক দূরে উদাস সুরে আভাস যে কার পাই রে— আছে-আছে নাই রে॥ আমার দুই আঁখি হল হারা, কোন্ গগনে খোঁজে কোন্ সন্ধ্যাতারা। কার ছায়া আমায় ছুঁয়ে যে যায়, কাঁপে হৃদয় তাই রে— গুন্গুনিয়ে গাই রে॥
১৫৯
প্রেম
প্রেম
মুখপানে চেয়ে দেখি, ভয় হয় মনে— ফিরেছ কি ফের নাই বুঝিব কেমনে॥ আসন দিয়েছি পাতি, মালিকা রেখেছি গাঁথি, বিফল হল কি তাহা ভাবি খনে খনে॥ গোধূলিলগনে পাখি ফিরে আসে নীড়ে, ধানে ভরা তরীখানি ঘাটে এসে ভিড়ে। আজো কি খোঁজার শেষে ফের নি আপন দেশে। বিরামবিহীন তৃষা জ্বলে কি নয়নে॥
১৬০
প্রেম
প্রেম
স্বপনে দোঁহে ছিনু কী মোহে, জাগার বেলা হল— যাবার আগে শেষ কথাটি বোলো। ফিরিয়া চেয়ে এমন কিছু দিয়ো বেদনা হবে পরমরমণীয়— আমার মনে রহিবে নিরবধি বিদায়খনে খনেক-তরে যদি সজল আঁখি তোল॥ নিমেষহারা এ শুকতারা এমনি ঊষাকালে উঠিবে দূরে বিরহাকাশভালে। রজনীশেষে এই-যে শেষ কাঁদা বীণার তারে পড়িল তাহা বাঁধা, হারানো মণি স্বপনে গাঁথা রবে— হে বিরহিণী, আপন হাতে তবে বিদায়দ্বার খোলো॥
১৬১
প্রেম
প্রেম
মিলনরাতি পোহালো, বাতি নেভার বেলা এল— ফুলের পালা ফুরালে ডালা উজাড় করে ফেলো॥ স্মৃতির ছবি মিলাবে যবে ব্যথার তাপ কিছু তো রবে, তা নিয়ে মনে বিজন খনে বিরহদীপ জ্বেলো॥ ফাল্গুনের মাধবীলীলা কুঞ্জ ছিল ঘিরে, চৈত্রবনে বেদনা তারি মর্মরিয়া ফিরে। হয়েছে শেষ, তবুও বাকি কিছু তো গান গিয়েছি রাখি— সেটুকু নিয়ে গুনগুনিয়ে সুরের খেলা খেলো॥
১৬২
প্রেম
প্রেম
হে ক্ষণিকের অতিথি, এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া॥ কোন্ অমরার বিরহিণীরে চাহ নি ফিরে, কার বিষাদের শিশিরনীরে এলে নাহিয়া॥ ওগো অকরুণ, কী মায়া জান, মিলনছলে বিরহ আন। চলেছ পথিক আলোকযানে আঁধার-পানে মনভুলানো মোহনতানে গান গাহিয়া॥
১৬৩
প্রেম
প্রেম
হায় অতিথি, এখনি কি হল তোমার যাবার বেলা। দেখো আমার হৃদয়তলে সারারাতের আসন মেলা॥ এসেছিলে দ্বিধাভরে কিছু বুঝি চাবার তরে, নীরব চোখে সন্ধ্যালোকে খেয়াল নিয়ে করলে খেলা॥ জানালে না গানের ভাষায় এনেছিলে যে প্রত্যাশা। শাখার আগায় বসল পাখি, ভুলে গেল বাঁধতে বাসা। দেখা হল, হয় নি চেনা— প্রশ্ন ছিল শুধালে না— আপন মনের আকাঙ্খারে আপনি কেন করলে হেলা॥
১৬৪
প্রেম
প্রেম
মুখখানি কর মলিন বিধুর যাবার বেলা— জানি আমি জানি, সে তব মধুর ছলের খেলা॥ গোপন চিহ্ন এঁকে যাবে তব রথে— জানি তুমি তারে ভুলিবে না কোনোমতে যার সাথে তব হল এক দিন মিলনমেলা॥ জানি আমি যবে আঁখিজল ভরে রসের স্নানে মিলনের বীজ অঙ্কুর ধরে নবীন প্রাণে। খনে খনে এই চিরবিরহের ভান, খনে খনে এই ভয়রোমাঞ্চদান— তোমার প্রণয়ে সত্য সোহাগে মিথ্যা হেলা॥
১৬৫
প্রেম
প্রেম
ওকে বাঁধিবি কে রে, হবে যে ছেড়ে দিতে। ওর পথ খোলে রে বিদায়রজনীতে॥ গগনে তার মেঘদুয়ার ঝেঁপে বুকেরই ধন বুকেতে ছিল চেপে, প্রভাতবায়ে গেল সে দ্বার কেঁপে— এল যে ডাক ভোরের রাগিণীতে॥ শীতল হোক বিমল হোক প্রাণ, হৃদয়ে শোক রাখুক তার দান। যা ছিল ঘিরে শূন্যে সে মিলালো, সে ফাঁক দিয়ে আসুক তবে আলো— বিজনে বসি পূজাঞ্জলি ঢালো শিশিরে-ভরা সেঁউতি-ঝরা গীতে॥
১৬৬
প্রেম
প্রেম
সকালবেলার আলোয় বাজে বিদায়ব্যথার ভৈরবী— আন্ বাঁশি তোর, আয় কবি॥ শিশিরশিহর শরতপ্রাতে শিউলিফুলের গন্ধ-সাথে গান রেখে যাস আকুল হাওয়ায়, নাই যদি রোস নাই রবি॥ এমন ঊষা আসবে আবার সোনায় রঙিন দিগন্তে, কুন্দের দুল সীমন্তে। কপোতকূজনকরুণ ছায়ায় শ্যামল কোমল মধুর মায়ায় তোমার গানের নূপুরমুখর জাগবে আবার এই ছবি॥
১৬৭
প্রেম
প্রেম
শেষ বেলাকার শেষের গানে ভোরের বেলার বেদন আনে॥ তরুণ মুখের করুণ হাসি গোধূলি-আলোয় উঠেছে ভাসি, প্রথম ব্যথার প্রথম বাঁশি বাজে দিগন্তে কী সন্ধানে শেষের গানে॥ আজি দিনান্তে মেঘের মায়া সে আঁখিপাতার ফেলেছে ছায়া। খেলায় খেলায় যে কথাখানি চোখে চোখে যেত বিজলি হানি সেই প্রভাতের নবীন বাণী চলেছে রাতের স্বপন-পানে শেষের গানে॥
১৬৮
প্রেম
প্রেম
কাঁদার সময় অল্প ওরে, ভোলার সময় বড়ো। যাবার দিনে শুকনো বকুল মিথ্যে করিস জড়ো॥ আগমনীর নাচের তালে নতুন মুকুল নামল ডালে, নিঠুর হাওয়ায় পুরানো ফুল ওই-যে পড়ো-পড়ো॥ ছিন্নবাঁধন পান্থরা যায় ছায়ার পানে চলে, কান্না তাদের রইল পড়ে শীর্ণ তৃণের কোলে। জীর্ণ পাতা উড়িয়ে ফেলা খেল্, কবি, সেই শিশুর খেলা— নতুন গানে কাঁচা সুরের প্রাণের বেদী গড়ো॥
১৬৯
প্রেম
প্রেম
কেন রে এতই যাবার ত্বরা— বসন্ত, তোর হয়েছে কি ভোর গানের ভরা॥ এখনি মাধবী ফুরালো কি সবই, বনছায়া গায় শেষ ভৈরবী— নিল কি বিদায় শিথিল করবী বৃন্তঝরা॥ এখনি তোমার পীত উত্তরী দিবে কি ফেলে তপ্ত দিনের শুষ্ক তৃণের আসন মেলে। বিদায়ের পথে হতাশ বকুল কপোতকূজনে হল যে আকুল, চরণপূজনে ঝরাইছে ফুল বসুন্ধরা॥
১৭০
প্রেম
প্রেম
জানি, জানি হল যাবার আয়োজন— তবু পথিক, থামো কিছুক্ষণ॥ শ্রাবণগগন বারি-ঝরা, কাননবীথি ছায়ায় ভরা, শুনি জলের ঝরোঝরে যূথীবনের ফুল-ঝরা ত্রন্দন॥ যেয়ো— যখন বাদলশেষের পাখি পথে পথে উঠবে ডাকি। শিউলিবনের মধুর স্তবে জাগবে শরতলক্ষ্মী যবে,
১৭১
প্রেম
প্রেম
আমায় যাবার বেলায় পিছু ডাকে ভোরের আলো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে॥ বাদলপ্রাতের উদাস পাখি ওঠে ডাকি বনের গোপন শাখে শাখে, পিছু ডাকে॥ ভরা নদী ছায়ার তলে ছুটে চলে— খোঁজে কাকে, পিছু ডাকে। আমার প্রাণের ভিতর সে কে থেকে থেকে বিদায়প্রাতের উতলাকে পিছু ডাকে॥
১৭২
প্রেম
প্রেম
কে বলে ‘যাও যাও’— আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া। টুটবে আগল বারে বারে তোমার দ্বারে, লাগবে আমায় ফিরে ফিরে ফিরে-আসার হাওয়া॥ ভাসাও আমায় ভাঁটার টানে অকূল-পানে, আবার জোয়ার-জলে তীরের তলে ফিরে তরী বাওয়া॥ পথিক আমি, পথেই বাসা— আমার যেমন যাওয়া তেমনি আসা। ভোরের আলোয় আমার তারা হোক-না হারা, আবার জ্বলবে সাঁজে আঁধার-মাঝে তারি নীরব চাওয়া॥
১৭৩
প্রেম
প্রেম
কেন আমায় পাগল করে যাস ওরে চলে-যাওয়ার দল। আকাশে বয় বাতাস উদাস, পরান টলোমল॥ প্রভাততারা দিশাহারা, শরতমেঘের ক্ষণিক ধারা— সভা ভাঙার শেষ বীণাতে তান লাগে চঞ্চল॥ নাগকেশরের ঝরা কেশর ধুলার সাথে মিতা। গোধূলি সে রক্ত-আলোয় জ্বালে আপন চিতা। শীতের হাওয়ায় ঝরায় পাতা, আম্লকী-বন মরণ-মাতা, বিদায়বাঁশির সুরে বিধুর সাঁঝের দিগঞ্চল॥
১৭৪
প্রেম
প্রেম
যদি হল যাবার ক্ষণ তবে যাও দিয়ে যাও শেষের পরশন॥ বারে বারে যেথায় আপন গানে স্বপন ভাসাই দূরের পানে, মাঝে মাঝে দেখে যেয়ো শূন্য বাতায়ন— বনের প্রান্তে ওই মালতীলতা করুণ গন্ধে কয় কী গোপন কথা। ওরই ডালে আর শ্রাবণের পাখি স্মরণখানি আনবে না কি, আজ-শ্রাবণের সজল ছায়ায় বিরহ মিলন— আমাদের বিরহ মিলন॥
১৭৫
প্রেম
প্রেম
ক্লান্ত বাঁশির শেষ রাগিণী বাজে শেষের রাতে। শুকনো ফুলের মালা এখন দাও তুলে মোর হাতে॥ সুরখানি ওই নিয়ে কানে পাল তুলে দিই পারের পানে, চৈত্ররাতের মলিন মালা রইবে আমার সাথে॥ পথিক আমি এসেছিলেম তোমার বকুলতলে— পথ আমারে ডাক দিয়েছে, এখন যাব চলে। ঝরা যূথীর পাতায় ঢেকে আমার বেদন গেলম রেখে, কোন্ ফাগুনে মিলবে সে-যে তোমার বেদনাতে॥
১৭৬
প্রেম
প্রেম
কখন দিলে পরায়ে স্বপনে বরণমালা, ব্যথার মালা॥ প্রভাতে দেখি জেগে অরুণ মেঘে বিদায়বাঁশরি বাজে অশ্রু-গালা॥ গোপনে এসে গেলে, দেখি নাই আঁখি মেলে। আঁধারে দুঃখডোরে বাঁধিলে মোরে, ভূষণ পরালে বিরহবেদন-ঢালা॥
১৭৭
প্রেম
প্রেম
যাবার বেলা শেষ কথাটি যাও বলে, কোন্খানে যে মন লুকানো দাও বলে॥ চপল লীলা ছলনাভরে বেদনখানি আড়াল করে, যে বাণী তব হয় নি বলা নাও বলে॥ হাসির বাণে হেনেছ কত শ্লেষকথা, নয়নজলে ভরো গো আজি শেষ কথা। হায় রে অভিমানিনী নারী, বিরহ হল দ্বিগুণ ভারী দানের ডালি ফিরায়ে নিতে চাও বলে॥
১৭৮
প্রেম
প্রেম
জানি তুমি ফিরে আসিবে আবার, জানি। তবু মনে মনে প্রবোধ নাহি যে মানি॥ বিদায়লগনে ধরিয়া দুয়ার তাই তো তোমায় বলি বারবার ‘ফিরে এসো এসো বন্ধু আমার’, বাষ্পবিভল বাণী॥ যাবার বেলায় কিছু মোরে দিয়ো দিয়ো গানের সুরেতে তব আশ্বাস প্রিয়। বনপথ যবে যাবে সে ক্ষণের হয়তো বা কিছু রবে স্মরণের, তুলি লব সেই তব চরণের দলিত কুসুমখানি॥
১৭৯
প্রেম
প্রেম
না রে, না রে, ভয় করব না বিদায়বেদনারে। আপন সুধা দিয়ে ভরে দেব তারে॥ চোখের জলে সে যে নবীন রবে, ধ্যানের মণিমালায় গাঁথা হবে, পরব বুকের হারে॥ নয়ন হতে তুমি আসবে প্রাণে, মিলবে তোমার বাণী আমার গানে। বিরহব্যথায় বিধুর দিনে দুখের আলোয় তোমায় নেব চিনে এ মোর সাধনা রে॥
১৮০
প্রেম
প্রেম
তোর প্রাণের রস তো শুকিয়ে গেল ওরে। তবে মরণরসে নে পেয়ালা ভরে॥ সে যে চিতার আগুন গালিয়ে ঢালা, সব জ্বলনের মেটায় জ্বালা— সব শূন্যকে সে অট্টহেসে দেয় যে রঙিন করে॥ তোর সূর্য ছিল গহন মেঘের মাঝে, তোর দিন মরেছে অকাজেরই কাজে। তবে আসুক-না সেই তিমির-রাতি লুপ্তিনেশার চরম সাথি—
১৮১
প্রেম
প্রেম
মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমন। মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটজূট, রক্তকমলকর, রক্ত-অধরপুট, তাপবিমোচন করুণ কোর তব মৃত্যু-অমৃত করে দান॥ আকুল রাধা-রিঝ অতি জরজর, ঝরই নয়নদউ অনুখন ঝরঝর— তুঁহুঁ মম মাধব, তুঁহুঁ মম দোসর, তুঁহুঁ মম তাপ ঘুচাও। মরণ তু আও রে আও। ভুজপাশে তব লহ সম্বোধয়ি, আঁখিপাত মঝু দেহ তু রোধয়ি, কোর-উপর তুঝ রোদয়ি রোদয়ি নীদ ভরব সব দেহ। তুঁহুঁ নহি বিসরবি, তুঁহুঁ নহি ছোড়বি, রাধাহৃদয় তু কবহুঁ ন তোড়বি, হিয়-হিয় রাখবি অনুদিন অনুখন— অতুলন তোঁহার লেহ। গগন সঘন অব, তিমিরমগন ভব, তড়িতচকিত অতি, ঘোর মেঘরব, শালতালতরু সভয়-তবধ সব— পন্থ বিজন অতি ঘোর। একলি যাওব তুঝ অভিসারে, তুঁহুঁ মম প্রিয়তম, কি ফল বিচারে— ভয়বাধা সব অভয় মূর্তি ধরি পন্থ দেখায়ব মোর। ভানু ভনে, ‘অয়ি রাধা, ছিয়ে ছিয়ে চঞ্চল চিত্ত তোহারি। জীবনবল্লভ মরণ-অধিক সো, অব তুঁহুঁ দেখ বিচারি।’
১৮২
প্রেম
প্রেম
উতল হাওয়া লাগল আমার গানের তরণীতে। দোলা লাগে দোলা লাগে তোমার চঞ্চল ওই নাচের লহরীতে॥ যদি কাটে রশি, হাল পড়ে খসি, যদি ঢেউ ওঠে উচ্ছ্বসি, সম্মুখেতে মরণ যদি জাগে, করি নে ভয়— নেবই তারে, নেবই তারে জিতে॥
১৮৩
প্রেম
প্রেম
না না না, ডাকব না, ডাকব না অমন করে বাইরে থেকে। পারি যদি অন্তরে তার ডাক পাঠাব, আনব ডেকে॥ দেবার ব্যথা বাজে আমার বুকের তলে, নেবার মানুষ জানি নে তো কোথায় চলে— এই দেওয়া-নেওয়ার মিলন আমার ঘটাবে কে॥ মিলবে না কি মোর বেদনা তার বেদনাতে— গঙ্গাধারা মিশবে নকি কালো যমুনাতে। আপনি কি সুর উঠল বেজে আপনা হতে এসেছে যে— গেল যখন আশার বচন গেছে রেখে॥
১৮৪
প্রেম
প্রেম
তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই। ও সেই মনোহরণ চপলচরণ সোনার হরিণ চাই॥ সে-যে চমকে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা। সে-যে নাগাল পেলে পালায় ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁদা। আমি ছুটব পিছে মিছে-মিছে পাই বা নাহি পাই— আমি আপন-মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই॥ তোরা পাবার জিনিস হাটে কিনিস, রাখিস ঘরে ভরে— যারে যায় না পাওয়া তারি হাওয়া লাগল কেন মোরে। আমার যা ছিল তা গেল ঘুচে যা নেই তার ঝোঁকে— আমার ফুরোয় পুঁজি, ভাবিস বুঝি মরি তারি শোকে? ওরে, আছি সুখে হাস্যমুখে, দুঃখ আমার নাই। আমি আপন-মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই॥
১৮৫
প্রেম
প্রেম
ও আমার ধ্যানেরই ধন, তোমায় হৃদয়ে দোলায় যে হাসি রোদন॥ আসে বসন্ত, ফোটে বকুল, কুঞ্জে পূর্ণিমাচাঁদ হেসে আকুল— তারা তোমায় খুঁজে না পায়, প্রাণের মাঝে আছ গোপন স্বপন॥ আঁখিরে ফাঁকি দাও, একি ধারা। অশ্রুজলে তারে কর সারা। গন্ধ আসে, কেন দেখি নে মালা। পায়ের ধ্বনি শুনি পথ নিরালা। বেলা যে যায়, ফুল যে শুকায়—
১৮৬
প্রেম
প্রেম
হায় রে, ওরে যায় না কি জানা। নয়ন ওরে খুঁজে বেড়ায়, পায় না ঠিকানা॥ অলখ পথেই যাওয়া আসা, শুনি চরণধ্বনির ভাষা— গন্ধে শুধু হাওয়ায় হাওয়ায় রইল নিশানা॥ কেমন করে জানাই তারে বসে আছি পথের ধারে। প্রাণে এল সন্ধ্যাবেলা আলোয় ছায়ায় রঙিন খেলা— ঝরে-পড়া বকুলদলে বিছায় বিছানা॥
১৮৭
প্রেম
প্রেম
ওহে সুন্দর, মম গৃহে আজি পরমোৎসব-রাতি। রেখেছি কনকমন্দিরে কমলাসন পাতি। তুমি এস হৃদে এস, হৃদিবল্লভ হৃদয়েশ, মম অশ্রুনেত্রে কর বরিষন করুণ হাস্যভাতি॥ তব কণ্ঠে দিব মালা, দিব চরণে ফুলডালা— আমি সকল কুঞ্জকানন ফিরি এনেছি যূথী জাতি। তব পদতললীনা আমি বাজাব স্বর্ণবীণা— বরণ করিয়া লব তোমারে মম মানাসসাথি॥
১৮৮
প্রেম
প্রেম
কে আমারে যেন এনেছে ডাকিয়া, এসেছি ভুলে। তবু একবার চাও মুখপানে নয়ন তুলে। দেখি ও নয়নে নিমেষের তরে সে দিনের ছায়া পড়ে কি না পড়ে, সজল আবেগে আঁখিপাতা-দুটি পড়ে কি ঢুলে। ক্ষণেকের তরে ভুল ভাঙায়ো না, এসেছি ভুলে॥ ব্যথা দিয়ে কবে কথা কয়েছিলে পড়ে না মনে, দূরে থেকে কবে ফিরে গিয়েছিলে নাই স্মরণে। শুধু মন পড়ে হাসিমুখখানি, লাজে বাধো-বাধো সোহাগের বাণী, মনে পড়ে সেই হৃদয়-উছাস নয়নকূলে। তুমি যে ভুলেছ ভুলে গেছি, তাই এসেছি ভুলে॥ কাননের ফুল এরা তো ভোলে নি, আমরা ভুলি। এই তো ফুটেছে পাতায় পাতায় কামিনীগুলি। চাঁপা কোথা হতে এনেছে ধরিয়া অরুণকিরণ কোমল করিয়া, বকুল ঝরিয়া মরিবারে চায় কাহার চুলে। কেহ ভোলে কেউ ভোলে না যে, তাই এসেছি ভুলে॥ এমন করিয়া কেমনে কাটিবে মাধবীরাতি। দখিনবাতাসে কেহ নাহি পাশে সাথের সাথি। চারিদিক হতে বাঁশি শোনা যায়, সুখে আছে যারা তারা গান গায়— আকুল বাতাসে, মদির সুবাসে, বিকচ ফুলে, এখনো কি কেঁদে চাহিবে না কেউ আসিলে ভুলে॥
১৮৯
প্রেম
প্রেম
সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা।
১৯০
প্রেম
প্রেম
সেই ভালো সেই ভালো, আমারে না হয় না জান। দূরে গিয়ে নয় দুঃখ দেবে, কাছে কেন লাজে লাজানো॥ মোর বসন্তে লেগেছে তো সুর, বেণুবনছায়া হয়েছে মধুর— থাক্-না এমনি গন্ধে-বিধুর মিলনকুঞ্জ সাজানো॥ গোপনে দেখেছি তোমার ব্যাকুল নয়নে ভাবের খেলা। উতল আঁচল, এলোথেলো চুল, দেখেছি ঝড়ের বেলা। তোমাতে আমাতে হয় নি যে কথা মর্মে আমার আছে সে বারতা— না-বলা বাণীর নিয়ে আকুলতা আমার বাঁশিটি বাজানো॥
১৯১
প্রেম
প্রেম
কাছে যবে ছিল পাশে হল না যাওয়া, চলে যবে গেল তারি লাগিল হাওয়া॥ যবে ঘাটে ছিল নেয়ে তারে দেখি নাই চেয়ে, দূর হতে শুনি স্রোতে তরণী-বাওয়া॥ যেখানে হল না খেলা সে খেলাঘরে আজি নিশিদিন মন কেমন করে। হারানো দিনের ভাষা স্বপ্নে আজি বাঁধে বাসা, আজ শুধু আঁখিজলে পিছনে চাওয়া॥
১৯২
প্রেম
প্রেম
আমার প্রাণের ’পরে চলে গেল কে বসন্তের বাতাসটুকুর মতো। সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে— ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত। সে চলে গেল, বলে গেল না— সে কোথায় গেল ফিরে এল না। সে যেতে যেতে চেয়ে গেল, কী যেন গেয়ে গেল— তাই আপন-মনে বসে আছি কুসুমবনেতে। সে ঢেউয়ের মতো ভেসে গেছে, চাঁদের আলোর দেশে গেছে, যেখান দিয়ে হেসে গেছে হাসি তার রেখে গেছে রে— মনে হল, আঁখির কোণে আমায় যেন ডেকে গেছে সে। আমি কোথায় যাব, কোথায় যাব, ভাবতেছি তাই একলা বসে। সে চাঁদের চোখে বুলিয়ে গেল ঘুমের ঘোর। সে প্রাণের কোথায় দুলিয়ে গেল ফুলের ডোর। কুসুমবনের উপর দিয়ে কী কথা সে বলে গেল, ফুলের গন্ধ পাগল হয়ে সঙ্গে তারি চলে গেল। হৃদয় আমার আকুল হল, নয়ন আমার মুদে এল রে— কোথা দিয়ে কোথায় গেল সে॥
১৯৩
প্রেম
প্রেম
মনে রয়ে গেল মনের কথা— শুধু চোখের জল, প্রাণের ব্যথা॥ মনে করি দুটি কথা ব’লে যাই, কেন মুখের পানে চেয়ে চলে যাই। সে যদি চাহে মরি যে তাহে, কেন মুদে আসে আঁখির পাতা॥ ম্লানমুখে, সখী, সে যে চলে যায়— ও তারে ফিরায়ে ডেকে নিয়ে আয়। বুঝিল না সে যে কেঁদে গেল— ধুলায় লুটাইল হৃদয়লতা॥
১৯৪
প্রেম
প্রেম
ওগো আমার চির-অচেনা পরদেশী, ক্ষণতরে এসেছিলে নির্জন নিকুঞ্জ হতে কিসের আহবানে॥ যে কথা বলেছিলে ভাষা বুঝি নাই তার, আভাস তারি হৃদয়ে বাজিছে সদা যেন কাহার বাঁশির মনোমোহোন সুরে॥ প্রভাতে একা বসে গেঁথেছিনু মালা, ছিল পড়ে তৃণতলে অশোকবনে। দিনশেষে ফিরে এসে পাই নি তারে, তুমিও কোথা গেছ চলে— বেলা গেল, হল না আর দেখা॥
১৯৫
প্রেম
প্রেম
কোথা হতে শুনতে যেন পাই— আকাশে আকাশে বলে ‘যাই’॥ পাতায় পাতায় ঘাসে ঘাসে জেগে ওঠে দীর্ঘশ্বাসে ‘হায়, তারা নাই, তারা নাই’॥ কত দিনের কত ব্যথা হাওয়ায় ছড়ায় ব্যাকুলতা। চলে যাওয়ার পথ যে দিকে সে দিক-পানে অনিমিখে আজ ফিরে চাই, ফিরে চাই॥
১৯৬
প্রেম
প্রেম
পান্থপাখির রিক্ত কুলায় বনের গোপন ডালে কান পেতে ওই তাকিয়ে আছে পাতার অন্তরালে॥ বাসায়-ফেরা ডানার শব্দ নিঃশেষে সব হল স্তব্ধ, সন্ধ্যাতারার জাগল মন্ত্র দিনের বিদায়-কালে॥ চন্দ্র দিল রোমাঞ্চিয়া তরঙ্গ সিন্ধুর, বনচ্ছায়ার রন্ধে্র রন্ধে্র লাগল আলোর সুর। সুপ্তিবিহীন শূন্যতা যে সারা প্রহর বক্ষে বাজে রাতের হাওয়ায় মর্মরিত বেণুশাখার ডালে॥
১৯৭
প্রেম
প্রেম
বাজে করুণ সুরে হায় দূরে তব চরণতলচুম্বিত পন্থবীণা। এ মম পান্থচিত চঞ্চল জানি না কী উদ্দেশে॥ যূথীগন্ধ অশান্ত সমীরে ধায় উতলা উচ্ছাসে, তেমনি চিত্ত উদাসী রে নিদারুণ বিচ্ছেদের নিশীথে॥
১৯৮
প্রেম
প্রেম
জীবনে পরম লগন কোরো না হেলা, কোরো না হেলা হে গরবিনি। বৃথাই কাটিবে বেলা, সাঙ্গ হবে যে খেলা, সুধার হাটে ফুরাবে বিকিকিনি হে গরবিনি॥ মনের মানুষ লুকিয়ে আসে, দাঁড়ায় পাশে, হায় হেসে চলে যায় জোয়ার-জলে, ভাসিয়ে ভেলা— দুর্লভ ধনে দুঃখের পণে লও গো জিনি হে গরবিনি॥ ফাগুন যখন যাবে গো নিয়ে ফুলের ডালা কী দিয়ে তখন গাঁথিবে তোমার বরণমালা হে বিরহিণী। বাজবে বাঁশি দূরের হাওয়ায়, চোখের জলে শূন্যে চাওয়ায় কাটবে প্রহর— বাজবে বুকে বিদায়পথের চরণ ফেলা দিনযামিনী হে গরবিনি॥
১৯৯
প্রেম
প্রেম
সখী, দেখে যা এবার এল সময়। আর বিলম্ব নয়, নয়, নয়॥ কাছে এল বেলা, মরণ-বাঁচনেরই খেলা, ঘুচিল সংশয়। আর বিলম্ব নয়॥ বাঁধন ছিঁিড়ল তরী, হঠাৎ দখিন-হাওয়ায়-হাওয়ায় পাল উঠিল ভরি। ঢেউ উঠেছে ওই খেপে, ও যে হাল গেল তার কেঁপে, ঘূর্ণিজলে ডুবে গেল সকল লজ্জ ভয়॥
২০০
প্রেম
প্রেম
আমি আশায় আশায় থাকি। আমার তৃষিত আকুল আঁখি॥ ঘুমে-জাগরণে-মেশা প্রাণে স্বপনের নেশা— দূর দিগন্তে চেয়ে কাহারে ডাকি॥ বনে বনে করে কানাকানি অশ্রুত বাণী, কী গাহে পাখি। কী কব না পাই ভাষা, মোর জীবন রঙিন কুয়াশা
২০১
প্রেম
প্রেম
আমার নিখিল ভুবন হারালেম আমি যে। বিশ্ববীণায় রাগিণী যায় থামি যে॥ গৃহহারা হৃদয় হায় আলোহারা পথে ধায়, গহন তিমিরগুহাতলে যাই নামি যে॥ তোমারি নয়নে সন্ধ্যাতারার আলো আমার পথের অন্ধকারে জ্বালো জ্বালো। মরীচিকার পিছে পিছে তৃষ্ণাতপ্ত প্রহর কেটেছে মিছে, দিন-অবসানে তোমারি হৃদয়ে শ্রান্ত পান্থ অমৃততীর্থগামী যে॥
২০২
প্রেম
প্রেম
না না, ভুল কোরো না গো, ভুল কোরো না, ভুল কোরো না ভালোবাসায়। ভুলায়ো না, ভুলায়ো না, ভুলায়ো না নিষ্ফল আশায়॥ বিচ্ছেদদুঃখ নিয়ে আমি থাকি, দেয় না সে ফাঁকি, পরিচিত আমি তারি ভাষায়॥ দয়ার ছলে তুমি হোয়ো না নিদয়। হৃদয় দিতে চেয়ে ভেঙো না হৃদয়। রেখো না লুব্ধ করে, মরণের বাঁশিতে মুগ্ধ করে টেনে নিয়ে যেয়ো না সর্বনাশায়॥
২০৩
প্রেম
প্রেম
ভুল করেছিনু, ভুল ভেঙেছে। জেগেছি, জেনেছি— আর ভুল নয়, ভুল নয়॥ মায়ার পিছে পিছে ফিরেছি, জেনেছি স্বপনসম সব মিছে— বিঁধেছে কাঁটা প্রাণে—এ তো ফুল নয়, ফুল নয়॥ ভালোবাসা হেলা করিব না, খেলা করিব না নিয়ে মন— হেলা করিব না। তব হৃদয়ে সখী, আশ্রয় মাগি। অতল সাগর সংসারে এ তো কূল নয়, কূল নয়॥
২০৪
প্রেম
প্রেম
ডেকো না আমারে, ডেকো না, ডেকো না। চলে যে এসেছে মনে তারে রেখো না॥ আমার বেদনা আমি নিয়ে এসেছি, মূল্য নাহি চাই যে ভালোবেসেছি, কৃপাকণা দিয়ে আঁখিকোণে ফিরে দেখো না॥ আমার দুঃখজোয়ারের জলস্রোতে নিয়ে যাবে মোরে সব লাঞ্ছনা হতে। দূরে যাব যবে সরে তখন চিনিবে মোরে— আজ অবহেলা ছলনা দিয়ে ঢেকো না॥
২০৫
প্রেম
প্রেম
যে ছিল আমার স্বপনচারিণী তারে বুঝিতে পারি নি। দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে॥ শুভখনে কাছে ডাকিলে, লজ্জা আমার ঢাকিলে গো, তোমারে সহজে পেরেছি বুঝিতে॥ কে মোরে ফিরাবে অনাদরে, কে মোরে ডাকিবে কাছে কাহার প্রেমের বেদনায় আমার মূল্য আছে, এ নিরন্তর সংশয়ে হায় পারি নে যুঝিতে— আমি তোমারেই শুধু পেরেছি বুঝিতে॥
২০৬
প্রেম
প্রেম
হায় হতভাগিনী, স্রোতে বৃথা গেল ভেসে— কূলে তরী লাগে নি, লাগে নি॥ কাটালি বেলা বীণাতে সুর বেঁধে, কঠিন টানে উঠল কেঁদে, ছিন্ন তারে থেমে গেল যে রাগিণী॥ এই পথের ধারে এসে ডেকে গেছে তোরে সে। ফিরায়ে দিলি তারে রুদ্ধদ্বারে— বুক জ্বলে গেল গো, ক্ষমা তবু ও কেন মাগি নি॥
২০৭
প্রেম
প্রেম
কোন্ সে ঝড়ের ভুল ঝরিয়ে দিল ফুল, প্রথম যেমনি তরুণ মাধুরী মেলেছিল এ মুকুল, হায় রে॥ নব প্রভাতের তারা সন্ধ্যাবেলায় হয়েছে পথহারা। অমরাবতীর সুরযুবতীর এ ছিল কানের দুল, হায় রে॥ এ যে মুকুটশোভার ধন। হায় গো দরদী কেহ থাক যদি শিরে দাও পরশন। এ কি স্রোতে যাবে ভেসে—দূর দয়াহীন দেশে কোন্খানে পাবে কূল, হায় রে॥
২০৮
প্রেম
প্রেম
ছি ছি, মরি লাজে, মরি লাজে— কে সাজালে মোরে মিছে সাজে। হায়॥ বিধাতার নিষ্ঠুর বিদ্রূপে নিয়ে এল চুপ চুপে মোরে তোমাদের দুজনের মাঝে॥ আমি নাই, আমি নাই— আদরিণী লহো তব ঠাঁই যেথা তব আসন বিরাজে। হায়॥
২০৯
প্রেম
প্রেম
শুভ মিলনলগনে বাজুক বাঁশি, মেঘমুক্ত গগনে জাগুক হাসি॥ কত দুখে কত দূরে দূরে আঁধারসাগর ঘুরে ঘুরে সোনার তরী তীরে এল ভাসি। পূর্ণিমা-আকাশে জাগুক হাসি॥ ওগো পুরবালা আনো সাজিয়ে বরণডালা, যুগলমিলনমহোৎসবে শুভ শঙ্খরবে বসন্তের আনন্দ দাও উচ্ছ্বাসি। পূর্ণিমা-আকাশে জাগুক হাসি॥
২১০
প্রেম
প্রেম
আর নহে, আর নহে— বসন্তবাতাস কেন আর শুষ্ক কফুল বহে॥ লগ্ন গেল বয়ে সকল আশা লয়ে, এ কোন্ প্রদীপ জ্বাল, এ যে বক্ষ আমার দহে॥ কানন মরু হল, আজ এই সন্ধ্যা-অন্ধকারে সেথায় কী ফুল তোল। কাহার ভাগ্য হতে বরণমালা হরণ কর, ভাঙা ডালি ভর— মিলনমালার কণ্টকভার কণ্ঠে কি আর সহে॥
২১১
প্রেম
প্রেম
ছিহন্ন শিকল পায়ে নিয়ে ওরে পাখি, যা উড়ে, যা উড়ে, যা রে একাকী॥ বাজবে তোর পায়ে সেই বন্ধ, পাখাতে পাবি আনন্দ, দিশাহারা মেঘ যে গেল ডাকি॥ নির্মল দুঃখ যে সেই তো মুক্তি নির্মল শূন্যের প্রেমে— আত্মবিড়ম্বনা দারুণ লজ্জা, নিঃশেষে যাক সে থেমে। দুরাশায় যে মরাবাঁচায় এত দিন ছিলি তোর খাঁচায় ধূলিতলে তারে যাবি রাখি॥
২১২
প্রেম
প্রেম
যাক ছিঁড়ে, যাক ছিঁড়ে যাক মিথ্যার জাল। দুঃখের প্রসাদে এল আজি মুক্তির কাল॥ এই ভালো ওগো এই ভালো বিচ্ছেদবহ্নিশিখার আলো, নিষ্ঠুর সত্য করুক বরদান— ঘুচে যাক ছলনার অন্তরাল॥ যাও প্রিয়, যাও তুমি যাও জয়রথে— বাধা দিব না পথে। বিদায় নেবার আগে মন তব স্বপ্ন হতে যেন জাগে— নির্মল হোক হোক সব জঞ্জাল॥
২১৩
প্রেম
প্রেম
দুঃখের যজ্ঞ-অনল-জ্বলনে জন্মে যে প্রেম দীপ্ত সে হেম, নিত্য সে নিঃসংশয়, গৌরব তার অক্ষয়॥ দুরাকাঙ্খার পরপারে বিরহতীর্থে করে বাস যেথা জ্বলে ক্ষুব্ধ হোমাগ্নিশিখায় চিরনৈরাশ— তৃষ্ণাদাহনমুক্ত অনুদিন অমলিন রয়। গৌরব তার অক্ষয়॥ অশ্রু-উৎস-জল-স্নানে তাপস জ্যোতির্ময় আপনারে আহুতি-দানে হল সে মৃত্যুঞ্জয়। গৌরব তার অক্ষয়॥
২১৪
প্রেম
প্রেম
আমার মন কেমন করে— কে জানে, কে জানে, কে জানে কাহার তরে॥ অলখ পথের পাখি গেল ডাকি, গেল ডাকি সুদূর দিগন্তরে॥ ভাবনারে মোর ধাওয়ায় সাগরপারের হাওয়ায় হাওয়ায় হাওয়ায়। স্বপনবলাকা মেলেছে ওই পাখা, আমায় বেঁধেছে কে সোনার পিঞ্জরে ঘরে॥
২১৫
প্রেম
প্রেম
গোপন কথাটি রবে না গোপনে, উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে। না না না, রবে না গোপনে॥ বিভল হাসিতে বাজিল বাঁশিতে, স্ফুরিল অধরে নিভৃত স্বপনে। না না না, রবে না গোপনে॥ মধুপ গুঞ্জরিল, মধুর বেদনায় আলোকপিয়াসী অশোক মুঞ্জরিল। হৃদয়শতদল করিছে টলমল অরুণ প্রভাতে করুণ তপনে। না না না, রবে না গোপনে॥
২১৬
প্রেম
প্রেম
বলো সখী, বলো তারি নাম আমার কানে কানে। যে নাম বাজে তোমার প্রাণের বীণার তানে তানে॥ বসন্তবাতাসে বনবীথিকায় সে নাম মিলে যাবে বিরহীবিহঙ্গকলগীতিকায়। সে নাম মধুর হবে যে বকুলঘ্রাণে॥ নাহয় সখীদের মুখে মুখে সে নাম দোলা খাবে সকৌতুকে। পূর্ণিমারাতে একা যবে অকারণে মন উতলা হবে সে নাম শুনাইব গানে গানে॥
২১৭
প্রেম
প্রেম
অজানা সুর কে দিযে যায় কানে কানে। ভাবনা আমার ভেসে যায় গানে গানে॥ বিস্মৃত জন্মের ছায়ালোকে হারিয়ে যাওয়া বীণার শোকে ফাগুন-হাওয়ায় কেঁদে ফিরে পথহারা রাগিণী। কোন্ বসন্তের মিলনরাতে তারার পানে ভাবনা আমার যায় ভেসে যায় গানে গানে॥
২১৮
প্রেম
প্রেম
ধরা সে যে দেয় নাই, দেয় নাই, যারে আমি আপনারে সঁপিতে চাই। কোথা সে যে আছে সঙ্গোপনে প্রতিদিন শত তুচ্ছের আড়ালে আড়ালে। এসো মম সার্থক স্বপ্ন, করো মম যৌবন সুন্দর, দক্ষিণবায়ু আনো পুষ্পবনে। ঘুচাও বিষাদের কুহেলিকা, নব প্রাণমন্ত্রের আনো বাণী। পিপাসিত জীবনের ক্ষুব্ধ আশা আঁধারে আঁধারে খোঁজে ভাষা শূন্যে পথহারা পবনের ছন্দে, ঝরে-পড়া বকুলের গন্ধে॥
২১৯
প্রেম
প্রেম
কোন্ বাঁধনের গ্রন্থি বাঁধিল দুই অজানারে এ কী সংশয়েরই অন্ধকারে। দিশাহারা হাওয়ায় তরঙ্গদোলায় মিলনতরণীখানি ধায় রে কোন্ বিচ্ছেদের পারে॥
২২০
প্রেম
প্রেম
ওগো কিশোর, আজি তোমার দ্বারে পরান মম জাগে। নবীন কবে করিবে তারে রঙিন তব রাগে॥ ভাবনাগুলি বাঁধনখোলা রচিয়া দিবে তোমার দোলা, দাঁড়িয়ো আসি হে ভাবে-ভোলা আমার আঁখি-আগে॥ দোলের নাচে বুঝি গো আছ অমরাবতীপুরে— বাজাও বেণু বুকের কাছে, বাজাও বণু দূরে। শরম ভয় সকলি ত্যেজে মাধবী তাই আসিল সেজে— শুধায় শুধু, ‘বাজায় কে যে মধুর মধুসুরে।’ গগনে শুনি একি এ কথা, কাননে কী যে দেখি। একি মিলন চঞ্চলতা, বিরহব্যথা একি। আঁচল কাঁপে ধরার বুকে, কী জানি তাহা সুখে না দুখে— ধরিতে যারে না পারে তারে স্বপনে দেখিছে কি। লাগিল দোল জলে স্থলে, জাগিল দোল বনে বনে— সোহাগিনীর হৃদয়তলে বিরহিণীর মনে মনে। মধুর মোরে বিধুর করে সুদূর তার বেণুর স্বরে, নিখিল হিয়া কিসের তরে দুলিছে অকারণে। আনো গো আনো ভরিয়া ডালি করবীমালা লয়ে, আনো গো আনো সাজায়ে থালি কোমল কিশলয়ে। এসো গো পীত বসনে সাজি, কোলেতে বীণা উঠুক বাজি, ধ্যানেতে আর গানেতে আজি যামিনী যাক বয়ে। এসো গো এসো দোল্বিলাসী বাণীতে মোর দোলো, ছন্দে মোর চকিতে আসি মাতিয়ে তারে তোলো। অনেক দিন বুকের কাছে রসের স্রোত থমকি আছে, নাচিবে আজি তোমার নাচে সময় তারি হল॥
২২১
প্রেম
প্রেম
তুমি কোন্ ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে। আমার ভাঙল যা তাই ধন্য হল চরণপাতে॥ আমি রাখব গেঁথে তারে রক্তমণির হারে, বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে॥ তুমি কোলে নিয়েছিলে সেতার, মীড় দিলে নিষ্ঠুর করে— ছিন্ন যবে হল তার ফেলে গেলে ভূমি-’পরে। নীরব তাহারি গান আমি তাই জানি তোমারি দান— ফেরে সে ফাল্গুন-হাওয়ায়-হাওয়ায় সুরহারা মূর্ছনাতে॥
২২২
প্রেম
প্রেম
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে— তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে॥ সে সাধনায় মিশিয়া যায় বকুলগন্ধ, সে সাধনায় মিলিয়া যায় কবির ছন্দ— তুমি জান না, ঢেকে রেখেছি তোমার নাম রঙিন ছায়ার আচ্ছাদনে॥ তোমার অরূপ মূর্তিখানি ফাল্গুনের আলোতে বসাই আনি। বাঁশরি বাজাই ললিত-বসন্তে, সুদূর দিগন্তে সোনার আভায় কাঁপে তব উত্তরী গানের তানের সে উন্মাদনে॥
২২৩
প্রেম
প্রেম
এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে; আমি কুড়িয়ে নিয়েছি, তোমার চরণে দিয়েছি— লহো লহো করুণ করে॥ যখন যাব চলে ওরা ফুটবে তোমার কোলে, তোমার মালা গাঁথার আঙুলগুলি মধুর বেদনভরে যেন আমায় স্মরণ করে॥ বউকথাকও তন্দ্রাহারা বিফল ব্যথায় ডাক দিয়ে হয় সারা আজি বিভোর রাতে। দুজনের কানাকানি কথা, দুজনের মিলনবিহবলতা, জ্যোৎস্নাধারায় যায় ভেসে যায় দোলের পূর্ণিমাতে। এই আভাসগুলি পড়বে মালায় গাঁথা কালকে দিনের তরে তোমার অলস দ্বিপ্রহরে॥
২২৪
প্রেম
প্রেম
বসন্ত সে যায় যে হেসে, যাবার কালে শেষ কুসুমের পরশ রাখে বনের ভালে॥ তেমনি তুমি যাবে জানি, সঙ্গে যাবে হাসিখানি— অলক হতে পড়বে অশোক বিদায়-থালে॥ রইব একা ভাসন-খেলার নদীর তটে, বেদনাহীন মুখের ছবি স্মৃতির পটে— অবসানের অস্ত-আলো তোমার সাথি, সেই তো ভালো— ছায়া সে থাক্ মিলনশেষের অন্তরালে॥
২২৫
প্রেম
প্রেম
মম দুঃখের সাধন যবে করিনু নিবেদন তব চরণতলে, শুভলগন গেল চলে, প্রেমের অভিষেক কেন হল না তব নয়নজলে॥ রসের ধারা নামিল না, বিরহে তাপের দিনে ফুল গেল শুকায়ে— মালা পরানো হল না তব গলে॥ মনে হয়েছিল দেখেছিনু করুণা তব আঁখিনিমেষে, গেল সে ভেসে। যদি দিতে বেদনার দান আপনি পেতে তারে ফিরে অমৃতফলে॥
২২৬
প্রেম
প্রেম
বাণী মোর নাহি, স্তব্ধ হৃদয় বিছায়ে চাহিতে শুধু জানি॥ আমি অমাবিভাবরী আলোহারা, মেলিয়া অগণ্য তারা নিষ্ফল আশায় নিঃশেষ পথ চাহি॥ তুমি যবে বাজাও বাঁশি সুর আসে ভাসি নীরবতার গভীরে বিহবল বায়ে নিদ্রাসমুদ্র পারায়ে। তোমারি সুরের প্রতিধ্বনি তোমারে দিই ফিরায়ে, কে জানে সে কি পশে তব স্বপ্নের তীরে বিপুল অন্ধকার বাহি॥
২২৭
প্রেম
প্রেম
আজি দক্ষিণপবনে দোলা লাগিল বনে বনে॥ দিক্ললনার নৃত্যচঞ্চল মঞ্জীরধ্বনি অন্তরে ওঠে রনরনি বিরহবিহবল হৃৎস্পন্দনে॥ মাধবীলতায় ভাষাহারা ব্যাকুলতা পল্লবে পল্লবে প্রলপিত কলরবে। প্রজাপতির পাখায় দিকে দিকে লিপি নিয়ে যায় উৎসব-আমন্ত্রণে॥
২২৮
প্রেম
প্রেম
যদি হায় জীবন পূরণ নাই হল মম তব অকৃপণ করে মন তবু জানে জানে— চকিত ক্ষণিক আলোছায়া তব আলিপন আঁকিয়া যায় ভাবনার প্রাঙ্গণে॥ বৈশাখের শীর্ণ নদী ভরা স্রোতের দান না পায় যদি তবু সংকুচিত তীরে তীরে ক্ষীণ ধারায় পলাতক পরশখানি দিয়ে যায়, পিয়াসী লয় তাহা ভাগ্য মানি॥ মম ভীরু বাসনার অঞ্জলিতে যতটুকু পাই রয় উচ্ছলিতে। দিবসের দৈন্যের সঞ্চয় যত যত্নে ধরে রাখি, সে যে রজনীর স্বপ্নের আয়োজন॥
২২৯
প্রেম
প্রেম
আমার আপন গান আমার অগোচরে আমার মন হরণ করে, নিয়ে সে যায় ভাসায়ে সকল সীমারই পারে॥ ওই-যে দূরে কূলে কূলে ফাল্গুন উচ্ছসিত ফুলে ফুলে— সেথা হতে আসে দুরন্ত হাওয়া, লাগে আমার পালে॥ কোথায় তুমি মম অজানা সাথি কাটাও বিজনে বিরহরাতি, এসো এসো উধাও পথের যাত্রী— তরী আমার টলোমলো ভরা জোয়ারে॥
২৩০
প্রেম
প্রেম
অধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে। ও যে সুদূর প্রাতের পাখি গাহে সুদূর রাতের গান॥ বিগত বসন্তের অশোকরক্তরাগে ওর রঙিন পাখা, তারি ঝরা ফুলের গন্ধ ওর অন্তরে ঢাকা॥ ওগো বিদেশিনী তুমি ডাকো ওরে নাম ধরে ও যে তোমারি চেনা। তোমারি দেশের আকাশ ও যে জানে, তোমারি রাতের তারা, তোমারি বকুলবনের গানে ও দেয় সাড়া— নাচে তোমারি কঙ্কণেরই তালে॥
২৩১
প্রেম
প্রেম
আমি যে গান গাই জানি নে সে কার উদ্দেশে॥ যবে জাগে মনে অকারণে চঞ্চল হাওয়া প্রবাসী পাখি যেন যায় সুর ভেসে, কার উদ্দেশে॥ ওই মুখপানে চেয়ে দেখি— তুমি সে কি অতীত কালের স্বপ্ন এলে নতুন কালের বেশে। কভু জাগে মনে আজও যে আসে নি এ জীবনে গানের খেয়া সে মাগে আমার তীরে এসে, কার উদ্দেশে॥
২৩২
প্রেম
প্রেম
ওগো পড়োশিনি, শুনি বনপথে সুর মেলে যায় তব কিঙ্কিণী॥ ক্লান্তকূজন দিনশেষে, আম্রশাখে, আকাশে বাজে তব নীরব রিনিরিনি॥ এই নিকটে থাকা অতিদূর আবরণে রয়েছে ঢাকা। যেমন দূরে বাণী আপনহারা গানের সুরে, মাধুরীরহস্যমায়ায় চেনা তোমারে না চিনি॥
২৩৩
প্রেম
প্রেম
ওগো স্বপ্নস্বরূপিণী তব অভিসারের পথে পথে স্মৃতির দীপ জ্বালা॥ সেদিনেরই মাধবীবনে আজও তেমনি ফুল ফুটেছে তেমনি গন্ধ ঢালা॥ আজি তন্দ্রাবিহীন রাতে ঝিল্লিঝঙ্কারে স্পন্দিত পবনে তব অঞ্চলের কম্পন সঞ্চারে। আজি পরজে বাজে বাঁশি যেন হৃদয়ে বহুদূরে আবেশবিহবল সুরে। বিকচ মল্লিমাল্যে তোমারে স্মরিয়া রেখেছি ভরিয়া ডালা॥
২৩৪
প্রেম
প্রেম
ওরে জাগায়ো না, ও যে বিরাম মাগে নির্মম ভাগ্যের পায়ে। ও যে সব চাওয়া দিতে চাহে অতলে জলাঞ্জলি॥ দুরাশার দুঃসহ ভার দিক নামায়ে, যাক ভুলে অকিঞ্চন জীবনের বঞ্চনা। আসুক নিবিড় নিদ্রা, তামসী তুলিকায় অতীতের বিদ্রূপবাণী দিক মুছায়ে স্মরণের পত্র হতে। স্তব্ধ হোক বেদনগুঞ্জন সুপ্ত বিহঙ্গের নীড়ের মতো— আনো তমস্বিনী, শ্রান্ত দুঃখের মৌনতিমিরে শান্তির দান॥
২৩৫
প্রেম
প্রেম
দিনান্তবেলায় শেষের ফসল দিলেম তরী-পরে, এ পারে কৃষি হল সারা, যাব ও পারের ঘাটে। হংসবলাকা উড়ে যায় দূরের তীরে, তারার আলোয়, তারি ডানার ধ্বনি বাজে মোর অন্তরে। ভাঁটার নদী ধায় সাগর-পানে কলতানে, ভাবনা মোর ভেসে যায় তারি টানে॥ যা-কিছ নিয়ে চলি শেষ সঞ্চয় সুখ নয় সে, দুঃখ সে নয়, নয় সে কামনা— শুনি শুধু মাঝির গান আর দাঁড়ের ধ্বনি তাহার স্বরে॥
২৩৬
প্রেম
প্রেম
ধূসর জীবনের গোধূলিতে ক্লান্ত আলোয় ম্লানস্মৃতি। সেই সুরের কায়া মোর সাথের সাথি, স্বপ্নের সঙ্গিনী, তারি আবেশ লাগে মনে বসন্তবিহবল বনে॥ দেখি তার বিরহী মূর্তি বেহাগের তানে সকরুণ নত নয়ানে। পূর্ণিমা জ্যোৎস্নালোকে মিলে যায় জাগ্রত কোকিল-কাকলিতে, মোর বাঁশির গীতে॥
২৩৭
প্রেম
প্রেম
দোষী করিব না, করিব না তোমারে। আমি নিজেরে নিজে করি ছলনা। মনে মনে ভাবি ভালোবাস, মনে মনে বুঝি তুমি হাস, জান এ আমার খেলা— এ আমার মোহের রচনা॥ সন্ধ্যামেঘের রাগে অকারণে ছবি জাগে, সেইমতো মায়ার আভাসে মনের আকাশে হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসে শূন্যে শূন্যে ছিন্নলিপি মোর বিরহমিলনকল্পনা॥
২৩৮
প্রেম
প্রেম
দৈবে তুমি কখন নেশায় পেযে আপন মনে যাও একা গান গেয়ে। যে আকাশে সুরের লেখা লেখ তার পানে রই চেয়ে চেয়ে॥ হৃদয় আমার অদৃশ্যে যায় চলে, চেনা দিনের ঠিক-ঠিকানা ভোলে, মৌমাছিরা আপনা হারায় যেন গন্ধের পথ বেয়ে বেয়ে॥ গানের টানা জালে নিমেষ-ঘেরা গহন থেকে তোলে অসীমকালে। মাটির আড়াল করি ভেদন সুরলোকের আনে বেদন, মতর্যলোকের বীণাতারে রাগিণী দেয় ছেয়ে॥
২৩৯
প্রেম
প্রেম
ভরা থাক্ স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি। মিলনের উৎসবে তায় ফিরায়ে দিয়ো আনি॥ বিষাদের অশ্রুজলে নীরবের মর্মতলে গোপনে উঠুক ফলে হৃদয়ের নূতন বাণী॥ যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা— নয়নে আঁধার রবে, ধেয়ানে আলোকরেখা। সারাদিন সংগোপনে সুধারস ঢালবে মনে পরানের পদ্মবনে বিরহের বীণাপাণি॥
২৪০
প্রেম
প্রেম
ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না— ওকে দাও ছেড়ে দাও ছেড়ে। মন নাই যদি দিল নাই দিল, মন নেয় যদি নিক্ কেড়ে॥ একি খেলা মোরা খেলেছি, শুধু নয়নের জল ফেলেছি— ওরই জয় যদি হয় জয় হোক, মোরা হারি যদি যাই হেরে॥ এক দিন মিছে আদরে মনে গরব সোহাগ না ধরে, শেষে দিন না ফুরাতে ফুরাতে সব গরব দিয়েছে সেরে। ভেবেছিনু ওকে চিনেছি, বুঝি বিনা পণে ওকে কিনেছি—
২৪১
প্রেম
প্রেম
কেন ধরে রাখা, ও যে যাবে চলে মিলনযামিনী গত হলে॥ স্বপনশেষে নয়ন মেলো, নিব-নিব দীপ নিবায়ে ফেলো— কী হবে শুকানো ফুলদলে॥ জাগে শুকতারা, ডাকিছে পাখি, ঊষা সকরুণ অরুণ-আঁখি। এসো, প্রাণপণ হাসিমুখে বলো ‘যাও সখা! থাকো সুখে’— ডেকো না, রেখো না আঁখিজলে॥
২৪২
প্রেম
প্রেম
ও চাঁদ, চোখের জলের লাগল জোয়ার দুখের পারাবারে, হল কানায় কানায় কানাকানি এই পারে ওই পারে॥ আমার তরী ছিল চেনার কূলে, বাঁধন যে তার গেল খুলে; তারে হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়ে গেল কোন্ অচেনার ধারে॥ পথিক সবাই পেরিয়ে গেল ঘাটের কিনারাতে, আমি সে কোন্ আকুল আলোর দিশাহারা রাতে। সেই পথ হারানোর অধীর টানে অকূলে পথ আপনি টানে, দিক ভোলাবার পাগল আমার হাসে অন্ধকারে॥
২৪৩
প্রেম
প্রেম
হায় গো, ব্যথায় কথা যায় ডুবে যায়, যায় গো— সুর হারালেম অশ্রুধারে॥ তরী তোমার সাগরনীরে, আমি ফিরি তীরে তীরে, ঠাঁই হল না তোমার সোনার নায় গো— পথ কোথা পাই অন্ধকারে॥ হায় গো, নয়ন আমার মরে দুরাশায় গো, চেয়ে থাকি দাঁড়িয়ে দ্বারে। যে ঘরে ওই প্রদীপ জ্বলে তার ঠিকানা কেউ না বলে, বসে থাকি পথের নিরালায় গো চির-রাতের পাথার-পারে॥
২৪৪
প্রেম
প্রেম
তোমার বীণায় গান ছিল আর আমার ডালায় ফুল ছিল গো। একই দখিন হাওয়ায় সে দিন দোঁহায় মোদের দুল দিল গো॥ সে দিন সে তো জানে না কেউ আকাশ ভরে কিসের সে ঢেউ, তোমার সুরের তরী আমার রঙিন ফুলে কূল নিল গো॥ সে দিন আমার মনে হল, তোমার গানের তাল ধরে আমার প্রাণে ফুল-ফোটানো রইবে চিরকাল ধরে। গান তবু তো গেল ভেসে, ফুল ফুরালো দিনের শেষে, ফাগুনবেলার মধুর খেলায় কোন্খানে হায় ভুল ছিল গো॥
২৪৫
প্রেম
প্রেম
তার হাতে ছিল হাসির ফুলের হার কত রঙে রঙ-করা। মোর সাথে ছিল দুখের ফুলের ভার অশ্রুর রসে ভরা॥ সহসা আসিল, কহিল সে সুন্দরী ‘এসো না বদল করি’। মুখপানে তার চাহিলাম, মরি মরি, নিদয়া সে মনোহরা॥ সে লইল মোর ভরা বাদলের ডালা, চাহিল সকৌতুকে। আমি লয়ে তার নবফাগুনের মালা তুলিয়া ধরিনু বুকে। ‘মোর হল জয়’ যেতে যেতে কয় হেসে, দূরে চলে গেল ত্বরা। সন্ধ্যায় দেখি তপ্ত দিনের শেষে ফুলগুলি সব ঝরা॥
২৪৬
প্রেম
প্রেম
কেন নয়ন আপনি ভেসে যায় জলে। কেন মন কেন এমন করে॥ যেন সহসা কী কথা মনে পড়ে— মনে পড়ে না গো তবু মনে পড়ে॥ চারি দিকে সব মধুর নীরব, কেন আমারি পরান কেঁদে মরে। কেন মন কেন এমন কেন রে॥ যেন কাহার বচন দিয়েছে বেদন, যেন কে ফিরে গিয়েছে অনাদরে— বাজে তারি অযতন প্রাণের ’পরে। যেন সহসা কী কথা মনে পড়ে— মনে পড়ে না গো তবু মনে পড়ে॥
২৪৭
প্রেম
প্রেম
আজি যে রজনী যায় ফিরাইব তায় কেমনে। কেন নয়নের জল ঝরিছে বিফল নয়নে॥ এ বেশভূষণ লহো সখী,লহো, এ কুসুমমালা হয়েছে অসহ— এমন যামিনী কাটিল বিরহশয়নে॥ আমি বৃথা অভিসারে এ যমুনাপারে এসেছি, বহি বৃথা মনো-আশা এত ভালোবাসা বেসেছি। শেষে নিশিশেষে বদন মলিন, ক্লান্তচরণ, মন উদাসীন, ফিরিয়া চলেছি কোন্ সুখহীন ভবনে॥ ওগো, ভোলা ভালো তবে, কাঁদিয়া কী হবে মিছে আর। যদি যেতে হল হায় প্রাণ কেন চায় মিছে আর। কুঞ্জদুয়ারে অবোধের মতো রজনীপ্রভাতে বসে রব কত— এবারের মতো বসন্ত গত জীবনে॥
২৪৮
প্রেম
প্রেম
এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়। এমন দিনে মন খোলা যায়— এমন মেঘস্বরে বদল-ঝরঝরে তপনহীন ঘন তমসায়॥ সে কথা শুনিবে না কেহ আর, নিভৃত নির্জন চারিধার। দুজনে মুখোমুখি, গভীর দুখে দুখি, আকাশে জল ঝরে অনিবার— জগতে কেহ যেন নাহি আর॥ সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব। কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব— আঁধারে মিশে গেছে আর সব॥ তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার, নামাতে পারি যদি মনোভার। শ্রাবণবরিষনে একদা গৃহকোণে দু কথা বলি যদি কাছে তার, তাহাতে আসে যাবে কিবা কার॥ ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়, বিজুলি থেকে থেকে চমকায়। যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে সে কথা আজি যেন বলা যায়— এমন ঘনঘোর বরিষায়॥
২৪৯
প্রেম
প্রেম
সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায় বিদেশী নায়ে, তাহারি রাগিণী লাগিল গায়ে॥ সে সুর বাহিয়া ভেসে আসে কার সুদূর বিরহবিধুর হিয়ার অজানা বেদনা, সাগরবেলার অধীর বায়ে বনের ছায়ে॥ তাই শুনে আজি বিজন প্রবাসে হৃদয়মাঝে শরৎশিশিরে ভিজে ভৈরবী নীরবে বাজে। ছবি মনে আনে আলোতে ও গীতে—যেন জনহীন নদীপথটিতে কে চলেছে জলে কলস ভরিতে অলস পায়ে বনের ছায়ে॥
২৫০
প্রেম
প্রেম
এ পারে মুখর হল কেকা ওই, এ পারে নীরব কেন কুহু হায়। এক কহে, ‘আর-একটি একা কই, শুভযোগে কবে হব দুঁহু হায়।’ অধীর সমীর পুরবৈয়াঁ নিবিড় বিরহব্যথা বইয়া নিশ্বাস ফেল মুহু মুহু হায়॥ আষাঢ় সজলঘন আঁধারে ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে— ‘আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে।’ ঋতুর দু ধারে থাকে দুজনে, মেলে না যে কাকলি ও কূজনে, আকাশের প্রাণ করে হূহু হায়॥
২৫১
প্রেম
প্রেম
রোদনভরা এ বসন্ত সখী, কখনো আসে নি বুঝি আগে। মোর বিরহবেদনা রাঙালো কিংশুকরক্তিমরাগে॥ কুঞ্জদ্বারে বনমল্লিকা সেজেছে পরিয়া নব পত্রালিকা, সারা দিন-রজনী অনিমিখা কার পথ চেয়ে জাগে॥ দক্ষিণসমীরে দূর গগনে একেলা বিরহী গাহে বুঝি গো। কুঞ্জবনে মোর মুকুল যত আবরণবন্ধন ছিঁড়িতে চাহে। আমি এ প্রাণের রুদ্ধদ্বারে ব্যাকুল কর হানি বারে বারে— দেওয়া হল না যে আপনারে এই ব্যথা মনে লাগে॥
২৫২
প্রেম
প্রেম
এসো এসো ফিরে এসো, বঁধু হে ফিরে এসো। আমার ক্ষুধিত তৃষিত তাপিত চিত, নাথ হে, ফিরে এসো। ওহে নিষ্ঠুর, ফিরে এসো, আমার করুণকোমল এসো, আমার সজলজলদস্নিগ্ধকান্ত সুন্দর ফিরে এসো। আমার নিতিসুখ ফিরে এসো, আমার চিরদুখ ফিরে এসো, আমার সবসুখদুখমন্থনধন অন্তরে ফিরে এসো। আমার চিরবাঞ্ছিত এসো, আমার চিতসঞ্চিত এসো ওহে চঞ্চল, হে চিরন্তন, ভুজ-বন্ধনে ফিরে এসো। আমার বক্ষে ফিরিয়া এসো, আমার চক্ষে ফিরিয়া এসো, আমার শয়নে স্বপনে বসনে ভূষনে নিখিল ভুবনে এসো। আমার মুখের হাসিতে এসো, আমার চোখের সলিলে এসো, আমার আদরে আমার ছলনে আমার অভিমানে ফিরে এসো। আমার সকল স্মরণে এসো, আমার সকল ভরমে এসো, আমার ধরম-করম-সোহাগ-শরম-জনম-মরণে এসো॥
২৫৩
প্রেম
প্রেম
তোমার গীতি জাগালো স্মৃতি নয়ন ছলছলিয়া, বাদলশেষে করুণ হেসে যেন চামেলি-কলিয়া॥ সজল ঘন মেঘের ছায়ে মৃদু সুবাস দিল বিছায়ে, না-দেখা কোন্ পরশঘায়ে পড়িছে টলটলিয়া॥ তোমার বাণী-স্মরণখানি আজি বাদলপবনে নিশীথে বারিপতন-সম ধ্বনিছে মম শ্রবণে। সে বাণী যেন গানেতে লিখা দিতেছে আঁকি সুরের রেখা যে পথ দিয়ে তোমারি, প্রিয়ে, চরণ গেল চলিয়া॥
২৫৪
প্রেম
প্রেম
যুগে যুগে বুঝি আমায় চেয়েছিল সে। সেই যেন মোর পথের ধারে রয়েছে বসে॥ আজ কেন মোর পড়ে মনে কখন্ তারে চোখের কোণে দেখেছিলেম অফুট প্রদোষে— সেই যেন মোর পথের ধারে রয়েছে বসে। আজ ওই চাঁদের বরণ হবে আলোর সঙ্গীতে, রাতের মুখের আঁধারখানি খুলবে ইঙ্গিতে। শুক্লরাতে সেই আলোকে দেখা হবে এক পলকে, সব আবরণ যাবে যে খসে। সেই যেন মোর পথের ধারে রয়েছে বসে॥
২৫৫
প্রেম
প্রেম
বনে যদি ফুটল কুসুম নেই কেন সেই পাখি। কোন্ সুদূরের আকাশ হতে আনব তারে ডাকি॥ হাওয়ায় হাওয়ায় মাতন জাগে, পাতায় পাতায় নাচন লাগে গো— এমন মধুর গানের বেলায় সেই শুধু রয় বাকি॥ উদাস-করা হৃদয়-হরা না জানি কোন্ ডাকে সাগর-পারের বনের ধারে কে ভুলালো তাকে। আমার হেথায় ফাগুন বৃথায় বারে বারে ডাকে যে তায় গো— এমন রাতের ব্যাকুল ব্যথায় কেন সে দেয় ফাঁকি॥
২৫৬
প্রেম
প্রেম
ধূসর জীবনের গোধূলিতে ক্লান্ত মলিন যেই স্মৃতি মুছে-আসা সেই ছবিটিতে রঙ এঁকে দেয় মোর গীতি॥ বসন্তের ফুলের পরাগে যেই রঙ জাগে, ঘুম-ভাঙা পিককাকলীতে যেই রঙ লাগে, যেই রঙ পিয়ালছায়ায় ঢালে শুক্লসপ্তমীর তিথি॥ সেই ছবি দোলা খায় রক্তের হিল্লোলে, সেই ছবি মিশে যায় নির্ঝরকল্লোলে, দক্ষিণসমীরণে ভাসে, পূর্ণিমাজ্যোৎস্নায় হাস— সে আমারি স্বপ্নের অতিথি॥
২৫৭
প্রেম
প্রেম
আমার জ্বলে নি আলো অন্ধকারে দাও না সাড়া কি তাই বারে বারে॥ তোমার বাঁশি আমার বাজে বুকে কঠিন দুখে, গভীর সুখে— যে জানে না পথ কাঁদাও তারে॥ চেয়ে রই রাতের আকাশ-পানে, মন যে কী চায় তা মনই জানে। আশা জাগে কেন অকারণে আমার মনে ক্ষণে ক্ষণে, ব্যথার টানে তোমায় আনবে দ্বারে॥
২৫৮
প্রেম
প্রেম
নীলাঞ্জনছায়া, প্রফুল্ল কদম্ববন, জম্বুপুঞ্জে শ্যাম বনান্ত, বনবীথিকা ঘনসুগন্ধ॥ মন্থর নব নীলনীরদ- পরিকীর্ণ দিগন্ত। চিত্ত মোর পন্থহারা কান্তবিরহকান্তারে॥
২৫৯
প্রেম
প্রেম
ফিরবে না তা জানি, তা জানি— আহা, তবু তোমার পথ চেয়ে জ্বলুক প্রদীপখানি॥ গাঁথিবে না মালা জানি মনে, আহা, তবু ধরুক মুকুল আমার বকুলবনে প্রাণে ওই পরশের পিয়াস আনি॥ কোথায় তুমি পথভোলা, তবু থাক্-না আমার দুয়ার খোলা। রাত্রি আমার গীতহীনা, আহা, তবু বাঁধুক সুরে বাঁধুক তোমার বীণা— তারে ঘিরে ফিরুক কাঙাল বাণী॥
২৬০
প্রেম
প্রেম
দিনের পরে দিন যে গেল আঁধার ঘরে, তোমার আসনখানি দেখে মন যে কেমন করে॥ ওগো বঁধু, ফুলের সাজি মঞ্জরীতে ভরল আজি— ব্যথার হারে গাঁথব তারে, রাখব চরণ-’পরে॥ পায়ের ধ্বনি গণি গণি রাতের তারা জাগে, উত্তরীয়ের হাওয়া এসে ফুলের বনে লাগে। ফাগুনবেলার বুকের মাঝে পথ-চাওয়া সুর কেঁদে বাজে— প্রাণের কথা ভাষা হারায়, চোখের জলে ঝরে॥
২৬১
প্রেম
প্রেম
না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে, দিবসে সে ধন হারায়েছি আমি, পেয়েছি আঁধার রাতে॥ না দেখিবে তারে, পরশিবে না গো, তারি পানে প্রাণ মেলে দিয়ে জাগো— তারায় তারায় রবে তারি বাণী, কুসুমে ফুটিবে প্রাতে॥ তারি লাগি যত ফেলেছি অশ্রুজল বীণাবাদিনীর শতদলদলে করিছে সে টলোমল। মোর গানে গানে পলকে পলকে ঝলসি উঠিছে ঝলকে ঝলকে, শান্ত হাসির করুণ আলোকে ভাতিছে নয়নপাতে॥
২৬২
প্রেম
প্রেম
বিরহ মধুর হল আজি মধুরাতে। গভীর রাগিণী উঠে বাজি বেদনাতে॥ ভরি দিয়া পূর্ণিমানিশা অধীর অদর্শনতৃষা কী করুণ মরীচিকা আনে আঁখিপাতে॥ সুদূরের সুগন্ধধারা বায়ুভরে পরানে আমার পথহারা ঘুরে মরে। কার বাণী কোন্ সুরে তালে মর্মরে পল্লবজালে, বাজে মম মঞ্জীররাজি সাথে সাথে॥
২৬৩
প্রেম
প্রেম
ফিরে ফিরে ডাক্ দেখি রে পরান খুলে, ডাক্ ডাক্ ডাক্ ফিরে ফিরে।
২৬৪
প্রেম
প্রেম
প্রভাত-আলোরে মোর কাঁদায়ে গেলে মিলনমালার ডোর ছিঁড়িয়া ফেলে॥ পড়ে যা রহিল পিছে সব হয়ে গেল মিছে, বসে আছি দূর-পানে নয়ন মেলে॥ একে একে ধূলি হতে কুড়ায়ে মরি যে ফুল বিদায়পথে পড়িছে ঝরি। ভাবি নি রবে না লেশ সে দিনের অবশেষ— কাটিল ফাগুনবেলা কী খেলা খেলে॥
২৬৫
প্রেম
প্রেম
নাই যদি বা এলে তুমি এড়িয়ে যাবে তাই বলে? অন্তরেতে নাই কি তুমি সামনে আমার নাই বলে॥ মন যে আছে তোমায় মিশে, আমায় তবে ছাড়বে কিসে— প্রেম কি আমার হারায় দিশে অভিমানে যাই বলে॥ বিরহ মোর হোক-না অকূল, সেই বিরহের সরোবরে মিলনকমল উঠছে দুলে অশ্রুজলের ঢেউয়ের ’পরে। তবু তৃষায় মরে আঁখি, তোমার লাগি চেয়ে থাকি— চোখের ’পরে পাব না কি বুকের ’পরে পাই বলে॥
২৬৬
প্রেম
প্রেম
শ্রাবণের পবনে আকুল বিষণ্ণ সন্ধ্যায় সাথিহারা ঘরে মন আমার প্রবাসী পাখি ফিরে যেতে চায় দূরকালের অরণ্যছায়াতলে। কী জানি সেথা আছে কিনা আজও বিজনে বিরহী হিয়া নীপবনগন্ধঘন অন্ধকারে— সাড়া দিবে কি গতিহীন নীরব সাধনায়॥ হায়, জানি সে নাই জীর্ণ নীড়ে, জানি সে নাই নাই। তীর্থহারা যাত্রী ফিরে ব্যর্থ বেদনায়— ডাকে তবু হৃদয় মম মনে-মনে রিক্ত ভুবনে রোদন-জাগা সঙ্গীহারা অসীম শূন্যে শূন্যে॥
২৬৭
প্রেম
প্রেম
সে যে পাশে এসে বসেছিল, তবু জাগি নি। কী ঘুম তোরে পেয়েছিল হতভাগিনি॥ এসেছিল নীরব রাতে, বীণাখানি ছিল হাতে— স্বপন-মাঝে বাজিয়ে গেল গভীর রাগিণী॥ জেগে দেখি দখিন-হাওয়া, পাগল করিয়া গন্ধ তাহার ভেসে বেড়ায় আঁধার ভরিয়া। কেন আমার রজনী যায়, কাছে পেয়ে কাছে না পায়— কেন গো তার মালার পরশ বুকে লাগে নি॥
২৬৮
প্রেম
প্রেম
কোন্ গহন অরণ্যে তারে এলেম হারায়ে কোন্ দূর জনমের কোন্ স্মৃতিবিস্মৃতিছায়ে॥ আজ আলো-আঁধারে কখন্-বুঝি দেখি, কখন্ দেখি না তারে— কোন্ মিলনসুখের স্বপনসাগর এল পারায়ে॥ ধরা-অধরার মাঝে ছায়ানটের রাগিণীতে আমার বাঁশি বাজে। বকুলতলায় ছায়ার নাচন ফুলের গন্ধে মিশে জানি নে মন পাগল করে কিসে। কোন্ নটিনীর ঘূর্ণি-আঁচল লাগে আমার গায়ে॥
২৬৯
প্রেম
প্রেম
কাছে থেকে দূর রচিল কেন গো আঁধারে। মিলনের মাঝে বিরহকারায় বাঁধা রে॥ সমুখে রয়েছে সুধাপারাবার, নাগাল না পায় তবু আঁখি তার— কেমনে সরাব কুহেলিকার এই বাধা রে॥ আড়ালে আড়ালে শুনি শুধু তারি বাণী যে — জানি তারে আমি, তবু তারে নাহি জানি যে। শুধু বেদনায় অন্তরে পাই, অন্তরে পেয়ে বাহিরে হারাই— আমার ভুবন রবে কি কেবলই আধা রে॥
২৭০
প্রেম
প্রেম
অশান্তি আজ হানল একি দহনজ্বালা। বিঁধল হৃদয় নিদয় বাণে বেদনঢালা॥ বক্ষে জ্বালায় অগ্নিশিখা, চক্ষে কাঁপায় মরীচিকা— মরণসুতোয় গাঁথল কে মোর বরণডালা॥ চেনা ভুবন হারিয়ে গেল স্বপনছায়াতে, ফাগুনদিনের পলাশরঙের রঙিন মায়াতে। যাত্রা আমার নিরুদ্দেশা, পথ-হারানোর লাগল নেশা— অচিন দেশে এবার আমার যাবার পালা॥
২৭১
প্রেম
প্রেম
স্বপ্নমদির নেশায় মেশা এ উন্মত্ততা জাগায় দেহে মনে একি বিপুল ব্যথা॥ বহে মম শিরে শিরে একি দাহ, কী প্রবাহ, চকিতে সর্বদেহে ছুটে তড়িৎলতা॥ ঝড়ের পবনগর্জে হারাই আপনায় দুরন্তযৌবনক্ষুব্ধ অশান্ত বন্যায়। তরঙ্গ উঠে প্রাণে দিগন্তে কাহার পানে— ইঙ্গিতের ভাষায় কাঁদে, নাহি নাহি কথা॥
২৭২
প্রেম
প্রেম
শুনি ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে অতল জলের আহবান। মন রয় না, রয় না, রয় না ঘরে, চঞ্চল প্রাণ॥ ভাসায়ে দিব আপনারে ভরা জোয়ারে, সকল-ভাবনা-ডুবানো ধারায় করিব স্নান— ব্যর্থ বাসনার দাহ হবে নির্বাণ॥ ঢেউ দিয়েছে জলে। ঢেউ দিল, ঢেউ দিল, ঢেউ দিল আমার মর্মতলে। একি ব্যাকুলতা আজি আকাশে, এই বাতাসে, যেন উতলা অপ্সরীর উত্তরীয় করে রোমাঞ্চদান— দূর সিন্ধুতীরে কার মঞ্জীরে গুঞ্জরতান॥
২৭৩
প্রেম
প্রেম
দিন পরে যায় দিন, বসি পথপাশে গান পরে গাই গান বসন্তবাতাসে॥ ফুরাতে চায় না বেলা, তাই সুর গেঁথে খেলা— রাগিণীর মরীচিকা স্বপ্নের আভাসে॥ দিন পরে যায় দিন, নাই তব দেখা। গান পরে গাই গান, রই বসে একা। সুর থেমে যায় পাছে তাই নাহি আস কাছে— ভালোবাসা ব্যথা দেয় যারে ভালোবাসে॥
২৭৪
প্রেম
প্রেম
আমার ভুবন তো আজ হল কাঙাল, কিছু তো নাই বাকি, ওগো নিঠুর, দেখতে পেলে তা কি॥ তার সব ঝরেছে, সব মরেছে, জীর্ণ বসন ওই পরেছে— প্রেমের দানে নগ্ন প্রাণের লজ্জা দেহ ঢাকি॥ কুঞ্জে তাহার গান যা ছিল কোথায় গেল ভাসি। এবার তাহার শূন্য হিয়ায় বাজাও তোমার বাঁশি। তার দীপের আলো কে নিভালো, তারে তুমি জ্বালো জ্বালো— আমার আপন আঁধার আমার আঁখিরে দেয় ফাঁকি॥
২৭৫
প্রেম
প্রেম
যখন এসেছিলে অন্ধকারে চাঁদ ওঠে নি সিন্ধুপারে॥ হে অজানা, তোমায় তবে জেনেছিলেম অনুভবে— গানে তোমার পরশখানি বেজেছিল প্রাণের তারে॥ তুমি গেলে যখন একলা চলে চাঁদ উঠেছে রাতের কোলে। তখন দেখি, পথের কাছে মালা তোমার পড়ে আছে— বুঝেছিলেম অনুমানে এ কণ্ঠহার দিলে কারে॥
২৭৬
প্রেম
প্রেম
এ পথে আমি-যে গেছি বার বার, ভুলি নি তো এক দিনও। আজ কি ঘুচিল চিহ্ন তাহার, উঠিল বনের তৃণ॥ তবু মনে মনে জানি নাই ভয়, অনুকূল বায়ু সহসা যে বয়— চিনিব তোমায় আসিবে সময়, তুমি যে আমায় চিন॥ একেলা যেতাম যে প্রদীপ হাতে নিবেছে তাহার শিখা। তবু জানি মনে, তারার ভাষাতে ঠিকানা রয়েছে লিখা। পথের ধারেতে ফুটিল যে ফুল জানি জানি তারা ভেঙে দেবে ভুল— গন্ধে তাদের গোপন মৃদুল সঙ্কেত আছে লীন॥
২৭৭
প্রেম
প্রেম
মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে সে দিন ভরা সাঁঝে, যেতে যেতে দুয়ার হতে কী ভেবে ফিরালে মুখখানি— কী কথা ছিল যে মনে॥ তুমি সে কি হেসে গেলে আঁখিকোণে— আমি বসে বসে ভাবি নিয়ে কম্পিত হৃদয়খানি, তুমি আছ দূর ভুবনে॥ আকাশে উড়িছে বকপাঁতি, বেদনা আমার তারি সাথি। বারেক তোমায় শুধাবারে চাই বিদায়কালে কী বল নাই, সে কি রয়ে গেল গো সিক্ত যূথীর গন্ধবেদনে॥
২৭৮
প্রেম
প্রেম
কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে। গন্ধ ছড়ালো ঘুমের প্রান্তপারে॥ একা এসেছিল ভুলে অন্ধরাতের কূলে অরুণ-আলোর বন্দনা করিবারে। ক্ষীণ দেহে মরি মরি সে যে নিয়েছিল বরি অসীম সাহসে নিষ্ফল সাধনারে॥ কী যে তার রূপ দেখা হল না তো চোখে, জানি না কী নামে স্মরণ করিব ওকে। আঁধারে যাহারা চলে সেই তারাদের দলে এসে ফিরে গেল বিরহের ধারে ধারে। করুণ মাধুরীখানি কহিতে জানে না বাণী কেন এসেছিল রাতের বন্ধ দ্বারে॥
২৭৯
প্রেম
প্রেম
লিখন তোমার ধুলায় হয়েছে ধূলি, হারিয়ে গিয়েছে তোমার আখরগুলি॥ চৈত্ররজনী আজ বসে আছি একা, পুন বুঝি দিল দেখা— বনে বনে তব লেখনীলীলার রেখা, নবকিশলয়ে গো কোন্ ভুলে এল ভুলি, তোমার পুরানো আখরগুলি॥ মল্লিকা আজি কাননে কাননে কত সৌরভে-ভরা তোমারি নামের মতো। কোমল তোমার অঙ্গুলি-ছোঁয়া বাণী মনে দিল আজি আনি বিরহের কোন্ ব্যথাভরা লিপিখানি। মাধবীশাখায় উঠিতেছে দুলি দুলি তোমার পুরানো আখরগুলি॥
২৮০
প্রেম
প্রেম
আজি সাঁঝের যমুনায় গো তরুণ চাঁদের কিরণতরী কোথায় ভেসে যায় গো॥ তারি সুদূর সারিগানে বিদায়স্মৃতি জাগায় প্রাণে সেই-যে দুটি উতল আঁখি উছল করুণায় গো॥ আজ মনে মোর যে সুর বাজে কেউ তা শোনে নাই কি। একলা প্রাণের কথা নিয়ে একলা এ দিন যায় কি। যায় যাবে, সে ফিরে ফিরে লুকিয়ে তুলে নেয় নি কি রে আমার পরম বেদনখানি আপন বেদনায় গো॥
২৮১
প্রেম
প্রেম
সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না। কিসেরই পিয়াসে কোথা যে যাবে সে, পথ জানে না॥ ঝরোঝরো নীরে, নিবিড় তিমিরে, সজল সমীরে গো যেন কার বাণী কভু কানে আনে—কভু আনে না॥
২৮২
প্রেম
প্রেম
যখন ভাঙল মিলন-মেলা ভেবেছিলেম ভুলব না আর চক্ষের জল ফেলা॥ দিনে দিনে পথের ধুলায় মালা হতে ফুল ঝরে যায়— জানি নে তো কখন এল বিস্মরণের বেলা॥ দিনে দিনে কঠিন হল কখন্ বুকের তল— ভেবেছিলেম ঝরবে না আর আমার চোখের জল। হঠাৎ দেখা পথের মাঝে, কান্না তখন থামে না যে— ভোলার তলে তলে ছিল অশ্রুজলের খেলা॥
২৮৩
প্রেম
প্রেম
আমার এ পথ তোমার পথের থেকে অনেক দূরে গেছে বেঁকে॥ আমার ফুলে আর কি কবে তোমার মালা গাঁথা হবে, তোমার বাঁশি দূরের হাওয়ায় কেঁদে বাজে কারে ডেকে॥ শ্রান্তি লাগে পায়ে পায়ে, বসি পথের তরুছাযে। সাথিহারার গোপন ব্যথা বলব যারে সেজন কোথা— পথিকরা যায় আপন-মনে, আমারে যায় পিছে রেখে॥
২৮৪
প্রেম
প্রেম
একলা বসে একে একে অন্যমনে পদ্মের দল ভাসাও জলে অকারণে॥ হায় রে, বুঝি কখন তুমি গেছ ভুলে ও যে আমি এনেছিলেম আপনি তুলে রেখেছিলেম প্রভাতে ওই চরণমূলে অকারণে— কখন তুলে নিলে হাতে যাবার ক্ষণে অন্যমনে॥ দিনের পরে দিনগুলি মোর এমনি ভাবে তোমার হাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে হারিয়ে যাবে। সবগুলি এই শেষ হবে যেই তোমার খেলায় এমনি তোমার আলস-ভরা অবহেলায়, হয়তো তখন বাজবে ব্যথা সন্ধেবেলায় অকারণে— চোখের জলের লাগবে আভাস নয়নকোণে অন্যমনে॥
২৮৫
প্রেম
প্রেম
তার বিদায়বেলার মালাখানি আমার গলে রে দোলে দোলে বুকের কাছে পলে পলে রে॥ গন্ধ তাহার ক্ষণে ক্ষণে জাগে ফাগুন সমীরণে গুঞ্জরিত কুঞ্জতলে রে॥ দিনের শেষে যেতে যেতে পথের ’পরে ছায়াখানি মিলিয়ে দিল বনান্তরে। সেই ছায়া এই আমার মনে, সেই ছায়া ওই কাঁপে বনে, কাঁপে সুনীল দিগঞ্চলে রে॥
২৮৬
প্রেম
প্রেম
আমি এলেম তারি দ্বারে, ডাক দিলেম অন্ধকারে॥ আগল ধরে দিলেম নাড়া— প্রহর গেল, পাই নি সাড়া, দেখতে পেলেম না যে তারে॥ তবে যাবার আগে এখান থেকে এই লিখনখানি যাব রেখে— দেখা তোমার পাই বা না পাই দেখতে এলেম জেনো গো তাই, ফিরে যাই সুদূরের পারে॥
২৮৭
প্রেম
প্রেম
দীপ নিবে গেছে মম নিশীথসমীরে, ধীরে ধীরে এসে তুমি যেও না গো ফিরে॥ এ পথে যখন যাবে আঁধারে চিনিতে পাবে— রজনীগন্ধার গন্ধ ভরেছে মন্দিরে॥ আমারে পড়িবে মনে কখন সে লাগি প্রহরে প্রহরে আমি গান গেয়ে জাগি। ভয় পাছে শেষ রাতে ঘুম আসে আঁখিপাতে, ক্লান্ত কণ্ঠে মোর সুর ফুরায় যদি রে॥
২৮৮
প্রেম
প্রেম
তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে, তখন ছিলেম বহু দূরে কিসের অন্বেষণে॥ কূলে যখন এলেম ফিরে তখন অস্তশিখরশিরে চাইল রবি শেষ চাওয়া তার কনকচাঁপার বনে। আমার ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে॥ লিখন তোমার বিনিসুতোর শিউলিফুলের মালা, বাণী যে তার সোনায়-ছোঁওয়া অরুণ-আলোয়-ঢালা— এল আমার ক্লান্ত হাতে ফুল-ঝরানো শীতের রাতে কুহেলিকায় মন্থর কোন্ মৌন সমীরণে। তখন ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে॥
২৮৯
প্রেম
প্রেম
সে যে বাহির হল আমি জানি, বক্ষে আমার বাজে তাহার পথের বাণী॥ কোথায় কবে এসেছে সে সাগরতীরে, বনের শেষে, আকাশ করে সেই কথারই কানাকানি॥ হায় রে, আমি ঘর বেঁধেছি এতই দূরে, না জানি তার আসতে হবে কত ঘুরে। হিয়া আমার পেতে রেখে সারাটি পথ দিলেম ঢেকে, আমার ব্যথায় পড়ুক তাহার চরণখানি॥
২৯০
প্রেম
প্রেম
কবে তুমি আসবে ব’লে রইব না বসে, আমি চলব বাহিরে। শুকনো ফুলের পাতাগুলি পড়তেছে খসে, আর সময় নাহি রে॥ বাতাস দিল দোল, দিল দোল; ও তুই ঘাটের বাঁধন খোল্, ও তুই খোল্। মাঝ-নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে তরী বাহি রে॥ আজ শুক্লা একাদশী, হেরো নিদ্রাহারা শশী ওই স্বপ্নপারাবারের খেয়া একলা চালায় বসি। তোর পথ জানা নাই, নাইবা জানা নাই— ও তোর নাই মানা নাই, মনের মানা নাই— সবার সাথে চলবি রাতে সামনে চাহি রে॥
২৯১
প্রেম
প্রেম
জাগরণে যায় বিভাবরী— আঁখি হতে ঘুম নিল হরি মরি মরি॥ যার লাগি ফিরি একা একা— আঁখি পিপাসিত, নাহি দেখা, তারি বাঁশি ওগো তারি বাঁশি তারি বাঁশি বাজে হিয়া ভরি মরি মরি॥ বাণী নাহি, তবু কানে কানে কী যে শুনি তাহা কেবা জানে। এই হিয়াভরা বেদনাতে, বারি-ছলোছলো আঁখিপাতে, ছায়া দোলে তারি ছায়া দোলে ছায়া দোলে দিবানিশি ধরি মরি মরি॥
২৯২
প্রেম
প্রেম
নাই নাই নাই যে বাকি, সময় আমার— শেষের প্রহর পূর্ণ করে দেবে না কি॥ বারে বারে কারা করে আনাগোনা, কোলাহলে সুরটুকু আর যায় না শোনা— ক্ষণে ক্ষণে গানে আমার পড়ে ফাঁকি॥ পণ করেছি, তোমার হাতে আপনারে শেষ করে আজ চুকিয়ে দেব একেবারে। মিটিয়ে দেব সকল খোঁজা, সকল বোঝা, ভোরবেলাকার একলা পথে চলব সোজা— তোমার আলোয় ডুবিয়ে নেব সজাগ আঁখি॥
২৯৩
প্রেম
প্রেম
একদা তুমি, প্রিয়ে, আমারি এ তরুমূলে বসেছ ফুলসাজে সে কথা যে গেছ ভুলে॥ সেথা যে বহে নদী নিরবধি সে ভোলে নি, তারি যে স্রোতে আঁকা বাঁকা বাঁকা তব বেণী, তোমারি পদরেখা আছে লেখা তারি কূলে। আজি কি সবই ফাঁকি—সে কথা কি গেছ ভুলে॥ গেঁথেছ যে রাগিণী একাকিনী দিনে দিনে আজিও যায় ব্যেপে কেঁপে কেঁপে তৃণে তৃণে। গাঁথিতে যে আঁচলে ছায়াতলে ফুলমালা তাহারি পরশন হরষন- সুধা-ঢালা ফাগুন আজো যে রে খুঁজে ফেরে চাঁপাফুলে। আজি কি সবই ফাঁকি— সে কথা কি গেছ ভুলে॥
২৯৪
প্রেম
প্রেম
আমার একটি কথা বাঁশি জানে, বাঁশিই জানে॥ ভরে রইল বুকের তলা, কারো কাছে হয় নি বলা, কেবল বলে গেলেম বাঁশির কানে কানে॥ আমার চোখে ঘুম ছিল না গভীর রাতে, চেয়ে ছিলেম চেয়ে-থাকা তারার সাথে। এমনি গেল সারা রাতি, পাই নি আমি জাগার সাথি— বাঁশিটিরে জাগিয়ে গেলেম গানে গানে॥
২৯৫
প্রেম
প্রেম
ও দেখা দিয়ে যে চলে গেল, ও চুপিচুপি কী বলে গেল। ও যেতে যেতে গো, কাননেতে গো কত যে ফুল দ’লে গেল॥ মনে মনে কী ভাবে কে জানে, মেতে আছে ও যেন কী গানে, নয়ন হানে আকাশ-পানে— চাঁদের হিয়া গ’লে গেল॥ ও পায়ে পায়ে যে বাজায়ে চলে বীণার ধ্বনি তৃণের দলে। কে জানে কারে ভালো কি বাসে, বুঝিতে নারি কাঁদে কি হাসে, জানি নে ও কি ফিরিয়া আসে— জানি নে ও কি ছ’লে গেল॥
২৯৬
প্রেম
প্রেম
কেন সারা দিন ধীরে ধীরে বালু নিয়ে শুধু খেল তীরে॥ চলে গেল বেলা, রেখে মিছে খেলা ঝাঁপ দিয়ে পড়ো কালো নীরে। অকূল ছানিয়ে যা পাও তা নিয়ে হেসে কেঁদে চলো ঘরে ফিরে॥ নাহি জানি মন কী বাসিয়া পথে বসে আছে কে আসিয়া। কী কুসুমবাসে ফাগুনবাতাসে হৃদয় দিতেছে উদাসিয়া॥ চল্ ওরে এই খ্যাপা বাতাসেই সাথে নিয়ে সেই উদাসীরে॥
২৯৭
প্রেম
প্রেম
কী সুর বাজে আমার প্রাণে আমিই জানি, মনই জানে॥ কিসের লাগি সদাই জাগি, কাহার কাছে কী ধন মাগি— তাকাই কেন পথের পানে॥ দ্বারের পাশে প্রভাত আসে, সন্ধ্যা নামে বনের বাসে। সকাল-সাঁঝে বাঁশি বাজে, বিকল করে সকল কাজে— বাজায় কে যে কিসের তানে॥
২৯৮
প্রেম
প্রেম
গহন ঘন বনে পিয়াল-তমাল-সহকার-ছায়ে সন্ধ্যাবায়ে তৃণশয়নে মুগ্ধ নয়নে রয়েছি বসি॥ শ্যামল পল্লবভার আঁধারে মর্মরিছে, বায়ুভরে কাঁপে শাখা, বকুলদল পড়ে খসি॥ স্তব্ধ নীড়ে নীরব বিহগ, নিস্তরঙ্গ নদীপ্রান্তে অরণ্যের নিবিড় ছায়া। ঝিল্লিমন্দ্রে তন্দ্রাপূর্ণ জলস্থল শূন্যতল, চরাচরে স্বপনের মায়া। নির্জন হৃদয়ে মোর জাগিতেছে সেই মুখশশী॥
২৯৯
প্রেম
প্রেম
কে উঠে ডাকি মম বক্ষোনীড়ে থাকি করুণ মধুর অধীর তানে বিরহবিধুর পাখি॥ নিবিড় ছায়া গহন মায়া, পল্লবঘন নির্জন বন— শান্ত পবনে কুঞ্জভবনে কে জাগে একাকী॥ যামিনী বিভোরা নিদ্রাঘনঘোরা— ঘন তমালশাখা নিদ্রাঞ্জন-মাখা। স্তিমিত তারা চেতনহারা, পাণ্ডু গগন তন্দ্রামগন— চন্দ্র শ্রান্ত দিকভ্রান্ত নিদ্রালস-আঁখি॥
৩০০
প্রেম
প্রেম
ওগো কে যায় বাঁশরি বাজায়ে, আমার ঘরে কেহ নাই যে। তারে মনে পড়ে যারে চাই যে॥ তার আকুল পরান, বিরহের গান, বাঁশি বুঝি গেল জানায়ে। আমি আমার কথা তারে জানাব কী করে, প্রাণ কাঁদে মোর তাই যে॥ কুসুমের মালা গাঁথা হল না, ধূলিতে পড়ে শুকায় রে। নিশি হয় ভোর, রজনীর চাঁদ মলিন মুখ লুকায় রে। সারা বিভাবরী কার পূজা করি যৌবনডালা সাজায়ে— বাঁশিস্বরে হায় প্রাণ নিয়ে যায়, আমি কেন থাকি হায় রে॥
৩০১
প্রেম
প্রেম
হেলাফেলা সারা বেলা একি খেলা আপন-সনে। এই বাতাসে ফুলের বাসে মুখখানি কার পড়ে মনে॥ আঁখির কাছে বেড়ায় ভাসি কে জানে গো কাহার হাসি, দুটি ফোঁটা নয়নসলিল রেখে যায় এই নয়নকোণে॥ কোন্ ছায়াতে কোন্ উদাসী দূরে বাজায় অলস বাঁশি, মনে হয় কার মনের বেদন কেঁদে বেড়ায় বাঁশির গানে। সারা দিন গাঁথি গান কারে চাহে, গাহে প্রাণ— তরুতলের ছায়ার মতন বসে আছি ফুলবনে॥
৩০২
প্রেম
প্রেম
ওগো এত প্রেম-আশা, প্রাণের তিয়াষা কেমনে আছে সে পাশরি। তবে সেথা কি হাসে না চাঁদিনি যামিনী, সেথা কি বাজে না বাঁশরি॥ সখী, হেথা সমীরণ লুটে ফুলবন, সেথা কি পবন বহে না। সে যে তার কথা মোরে কহে অনুখন, মোর কথা তারে কহে না! যদি আমারে আজি সে ভুলিবে সজনী, আমারে ভুলালে কেন সে। ওগো এ চিরজীবন করিব রোদন, এই ছিল তার মানসে! যবে কুসুমশয়নে নয়নে নয়নে কেটেছিল সুখরাতি রে, তবে কে জানিত তার বিরহ আমার হবে জীবনের সাথি রে। যদি মনে নাহি রাখে, সুখে যদি থাকে, তোরা একবার দেখে আয়— এই নয়নের তৃষা, পরানের আশা, চরণের তলে রেখে আয়। আর নিয়ে যা রাধার বিরহের ভার, কত আর ঢেকে রাখি বল্। আর পারিস যদি তো আনিস হরিয়ে এক-ফোঁটা তার আঁখিজল। না না, এত প্রেম, সখী, ভুলিতে যে পারে তারে আর কেহ সেধো না। আমি কথা নাহি কব, দুখ লয়ে রব, মনে মনে স’ব বেদনা। ওগো মিছে মিছে, সখী, মিছে এই প্রেম, মিছে পরানের বাসনা। ওগো সুখদিন হায় যবে চলে যায় আর ফিরে আর আসে না॥
৩০৩
প্রেম
প্রেম
আমি নিশি নিশি কত রচিব শয়ন আকুলনয়ন রে। কত নিতি নিতি বনে করিব যতনে কুসুমচয়ন রে। কত শারদ যামিনী হইবে বিফল, বসন্ত যাবে চলিয়া। কত উদিবে তপন, আশার স্বপন প্রভাতে যাইবে ছলিয়া। এই যৌবন কত রাখিব বাঁধিয়া, মরিব কাঁদিয়া রে। সেই চরণ পাইলে মরণ মাগিব সাধিয়া সাধিয়া রে। আমি কার পথ চাহি এ জনম বাহি, কার দরশন যাচি রে। যেন আসিবে বলিয়া কে গেছে চলিয়া, তাই আমি বসে আছি রে। তাই মালাটি গাঁথিয়া পরেছি মাথায়, নীলবাসে তনু ঢাকিয়া। তাই বিজন আলয়ে প্রদীপ জ্বালায়ে একেলা রয়েছি জাগিয়া। ওগো তাই কত নিশি চাঁদ ওঠে হাসি, তাই কেঁদে যায় প্রভাতে। ওগো তাই ফুলবনে মধুসমীরণে ফুটে ফুল কত শোভাতে। ওই বাঁশিস্বর তার আসে বারবার, সেই শুধু কেন আসে না! এই হৃদয়-আসন শূন্য পড়ে থাকে, কেঁদে মরে শুধু বাসনা। মিছে পরশিয়া কায় বায়ু বহে যায়, বহে যমুনার লহরী। কেন কুহু কুহু পিক কুহরিয়া ওঠে, যামিনী যে উঠে শিহরি। ওগো, যদি নিশিশেষে আসে হেসে হেসে মোর হাসি আর রবে কি। এই জাগরণে-ক্ষীণ বদনমলিন আমারে হেরিয়া কবে কী। আমি সারা রজনীর গাঁথা ফুলমালা প্রভাতে চরণে ঝরিব— ওগো, আছে সুশীতল যমুনার জল, দেখে তারে আমি মরিব॥
৩০৪
প্রেম
প্রেম
কখন বসন্ত গেল, এবার হল না গান। কখন বকুলমূল ছেয়েছিল ঝরা ফুল, কখন যে ফুল-ফোটা হয়ে গেল অবসান॥ এবার বসন্তে কি রে যূথীগুলি জাগে নি রে— অলিকুল গুঞ্জরিয়া করে নি কি মধুপান। এবার কি সমীরণ জাগায় নি ফুলবন— সাড়া দিয়ে গেল না তো, চলে গেল ম্রিয়মাণ॥ বসন্তের শেষ রাতে এসেছি যে শূন্য হাতে— এবার গাঁথি নি মালা, কী তোমারে করি দান। কাঁদিছে নীরব বাঁশি, অধরে মিলায় হাসি— তোমার নয়নে ভাসে ছলোছলো অভিমান॥
৩০৫
প্রেম
প্রেম
বাঁশরি বাজাতে চাহি, বাঁশরি বাজিল কই। বিহরিছে সমীরণ, কুহরিছে পিকগণ, মথুরার উপবন কুসুমে সাজিল ওই॥ বিকচ বকুলফুল দেখে যে হতেছে ভুল, কোথাকার অলিকুল গুঞ্জরে কোথায়। এ নহে কি বৃন্দাবন, কোথা সেই চন্দ্রানন, ওই কি নূপুরধ্বনি বনপথে শুনা যায়। একা আছি বনে বসি, পীত ধড়া পড়ে খসি, সোঙরি সে মুখশশী পরান মজিল সই॥ একবার রাধে রাধে ডাক্ বাঁশি মনোসাধে— আজি এ মধুর চাঁদে মধুর যামিনী ভায়। কোথা সে বিধুরা বালা— মলিনমালতীমালা, হৃদয়ে বিরহজ্বালা, এ নিশি পোহায় হায়। কবি যে হল আকুল, একি রে বিধির ভুল, মথুরায় কেন ফুল ফুটেছে আজি লো সই॥
৩০৬
প্রেম
প্রেম
পথিক পরান, চল্, চল্ সে পথে তুই যে পথ দিয়ে গেল রে তোর বিকেলবেলার জুঁই॥ সে পথ বেয়ে গেছে যে তোর সন্ধ্যামেঘের সোনা, প্রাণের ছায়াবীথির তলে গানের আনাগোনা— রইল না কিছুই॥ যে পথে তার পাপড়ি দিয়ে বিছিয়ে গেল ভুঁই পথিক পরান, চল্, চল সে পথে তুই। অন্ধকারে সন্ধ্যাযূথীর স্বপনময়ী ছায়া উঠবে ফুটে তারার মতো কায়াবিহীন মায়া— ছুঁই তারে না ছুঁই॥
৩০৭
প্রেম
প্রেম
তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মন রে আমার। তাই জনম গেল, শান্তি পেলি না রে, মন, মন রে আমার॥ যে পথ দিয়ে চলে এলি সে পথ এখন ভুলে গেলি— কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে মন, মন রে আমার॥ নদীর জলে থাকি রে কান পেতে, কাঁপে রে প্রাণ পাতার মর্মরেতে। মনে হয় যে পাব খুঁজি ফুলের ভাষা যদি বুঝি যে পথ গেছে সন্ধ্যাতারার পারে মন, মন রে আমার॥
৩০৮
প্রেম
প্রেম
যে দিন সকল মুকুল গেল ঝরে আমায় ডাকলে কেন গো, এমন করে॥ যেতে হবে যে পথ বেয়ে শুকনো পাতা আছে ছেয়ে, হাতে আমার শূন্য ডালা কী ফুল দিয়ে দেব ভরে॥ গানহারা মোর হৃদয়তলে তোমার ব্যাকুল বাঁশি কী যে বলে। নেই আয়োজন, নেই মম ধন, নেই আভরণ, নেই আবরণ— রিক্ত বাহু এই তো আমার বাঁধবে তোমায় বাহুডোরে॥
৩০৯
প্রেম
প্রেম
আমায় থাকতে দে-না আপন-মনে। সেই চরণের পরশখানি মনে পড়ে ক্ষণে ক্ষণে॥ কথার পাকে কাজের ঘোরে ভুলিয়ে রাখে কে আর মোরে, তার স্মরণের বরণমালা গাঁথি বসে গোপন কোণে॥ এই-যে ব্যথার রতনখানি আমার বুকে দিল আনি এই নিয়ে আজ দিনের শেষে একা চলি তার উদ্দেশে। নয়নজলে সামনে দাঁড়াই, তারে সাজাই তারি ধনে॥
৩১০
প্রেম
প্রেম
হে বিরহী, হায়, চঞ্চল হিয়া তব, নীরবে জাগ একাকী শূন্যমন্দিরে দীর্ঘ বিভাবরী— কোন্ সে নিরুদ্দেশ-লাগি আছ জাগিয়া॥ স্বপনরূপিণী অলোকসুন্দরী অলক্ষ্য অলকাপুরী-নিবাসিনী, তাহার মুরতি রচিলে বেদনায় হৃদয়মাঝারে॥
৩১১
প্রেম
প্রেম
ওগো সখী, দেখি দেখি, মন কোথা আছে। কত কাতর হৃদয় ঘুরে ঘুরে হেরো কারে যাচে॥ কী মধু, কী সুধা, কী সৌরভ, কী রূপ রেখেছ লুকায়ে— কোন্ প্রভাতে, ও কোন্ রবির আলোকে দিবে খুলিয়ে কাহার কাছে॥ সে যদি না আসে এ জীবনে, এ কাননে পথ না পায়। যারা এসেছে তারা বসন্ত ফুরালে নিরাশ প্রাণে ফেরে পাছে॥
৩১২
প্রেম
প্রেম
সখী, বহে গেল বেলা, শুধু হাসিখেলা এ কি আর ভালো লাগে। আকুল তিয়াষ, প্রেমের পিয়াস, প্রাণে কেন নাহি জাগে॥ কবে আর হবে থাকিতে জীবন আঁখিতে আঁখিতে মদির মিলন— মধুর হুতাশে মধুর দহন নিতি-নব অনুরাগে॥ তরল কোমল নয়নের জল, নয়নে উঠিবে ভাসি, সে বিষাদনীরে নিবে যাবে ধীরে প্রখর চপল হাসি। উদার নিশ্বাস আকুলি উঠিবে, আশানিরাশায় পরান টুটিবে— মরমের আলো কপোলে ফুটিবে শরম-অরুণরাগে॥
৩১৩
প্রেম
প্রেম
ওলো রেখে দে সখী, রেখে দে, মিছে কথা ভালোবাসা। সুখের বেদনা, সোহাগযাতনা, বুঝিতে পারি না ভাষা॥ ফুলের বাঁধন, সাধের কাঁদন, পরান সঁপিতে প্রাণের সাধন, লহো-লহো বলে পরে আরাধন— পরের চরণে আশা॥ তিলেক দরশ পরশ মাগিয়া বরষ বরষ কাতরে জাগিয়া পরের মুখের হাসির লাগিয়া অশ্রুসাগরে ভাসা— জীবনের সুখ খুঁজিবারে গিয়া জীবনের সুখ নাশা॥
৩১৪
প্রেম
প্রেম
তারে দেখাতে পারি নে কেন প্রাণ খুলে গো। বুঝাতে পারি নে হৃদয়বেদনা॥ কেমনে সে হেসে চলে যায়, কোন্ প্রাণে ফিরেও না চায়— এত সাধ এত প্রেম করে অপমান॥ এত ব্যথাভরা ভালোবাসা কেহ দেখে না, প্রাণে গোপনে রহিল। এ প্রেম কুসুম যদি হত প্রাণ হতে ছিঁড়ে লইতাম, তার চরণে করিতাম দান। বুঝি সে তুলে নিত না, শুকাতো অনাদরে, তবু তার সংশয় হত অবসান॥
৩১৫
প্রেম
প্রেম
এ তো খেলা নয়, খেলা নয়—এ যে হৃদয়দহনজ্বালা সখী॥ এ যে প্রাণভরা ব্যাকুলতা, গোপন মর্মের ব্যথা, এ যে কাহার চরণোদ্দেশে জীবন মরণ ঢালা॥ কে যেন সতত মোরে ডাকিয়ে আকুল করে— যাই-যাই করে প্রাণ, যেতে পারি নে। যে কথা বলিতে চাহি তা বুঝি বলিতে নাহি— কোথায় নামায়ে রাখি, সখী, এ প্রেমের ডালা। যতনে গাঁথিয়ে শেষে পরাতে পারি নে মালা॥
৩১৬
প্রেম
প্রেম
দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি। তাই চমকিত মন, চকিত শ্রবণ, তৃষিত আকুল আঁখি॥ চঞ্চল হয়ে ঘুরিয়ে বেড়াই, সদা মনে হয় যদি দেখা পাই— ‘কে আসিছে’ বলে চমকিয়ে চাই কাননে ডাকিলে পাখি॥ জাগরণে তারে না দেখিতে পাই, থাকি স্বপনের আশে— ঘুমের আড়ালে যদি ধরা দেয় বাঁধিব স্বপনপাশে। এত ভালোবাসি, এত যারে চাই, মনে হয় না তো সে যে কাছে নাই— যেন এ বাসনা ব্যাকুল আবেগে তাহারে আনিবে ডাকি॥
৩১৭
প্রেম
প্রেম
অলি বার বার ফিরে যায়, অলি বার বার ফিরে আসে— তবে তো ফুল বিকাশে॥ কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না, মরে লাজে, মরে ত্রাসে॥ ভুলি মান অপমান দাও মন প্রাণ, নিশিদিন রহো পাশে। ওগো, আশা ছেড়ে তবু আশা রেখে দাও হৃদয়রতন-আশে॥ ফিরে এসো, ফিরে এসো— বন মোদিত ফুলবাসে। আজ বিরহ রজনী ফুল্ল কুসুম শিশিরসলিলে ভাসে॥
৩১৮
প্রেম
প্রেম
দূরের বন্ধু সুরের দূতীরে পাঠালো তোমার ঘরে। মিলনবীণা যে হৃদয়ের মাঝে বাজে তব অগোচরে॥ মনের কথাটি গোপনে গোপনে বাতাসে বাতাসে ভেসে আসে মনে, বনে উপবনে, বকুলশাখার চঞ্চলতায় মর্মরে মর্মরে॥ পুষ্পমালার পরশপুলক পেয়েছ বক্ষতলে, রাখো তুমি তারে সিক্ত করিয়া সুখের অশ্রুজলে। ধরো সাহানাতে মিলনের পালা, সাজাও যতনে বরণের ডালা— মালতীর মালা, অঞ্চলে ঢেকে কনকপ্রদীপ আনো আনো তার পথ-’পরে।
৩১৯
প্রেম
প্রেম
আমার মন চেয়ে রয় মনে মনে হেরে মাধুরী। নয়ন আমার কাঙাল হয়ে মরে না ঘুরি॥ চেয়ে চেয়ে বুকের মাঝে গুঞ্জরিল একতারা যে— মনোরথের পথে পথে বাজল বাঁশুরি। রূপের কোলে ওই-যে দোলে অরূপ মাধুরী॥ কূলহারা কোন্ রসের সরোবরে মূলহারা ফুল ভাসে জলের ’পরে। হাতের ধরা ধরতে গেলে ঢেউ দিয়ে তায় দিই যে ঠেলে— আপন-মনে স্থির হয়ে রই, করি নে চুরি। ধরা দেওয়ার ধন তো সে নয়, অরূপ মাধুরী॥
৩২০
প্রেম
প্রেম
বিনা সাজে সাজি দেখা দিয়েছিলে কবে, আভরণে আজি আবরণ কেন তবে॥ ভালোবাসা যদি মেশে আধা-আধি মোহে আলোতে আঁধারে দোঁহারে হারাব দোঁহে। ধেয়ে আসে হিয়া তোমার সহজ রবে, আভরণ দিয়া আবরণ কেন তবে॥ ভাবের রসেতে যাহার নয়ন ডোবা ভূষণে তাহারে দেখাও কিসের শোভা। কাছে এসে তবু কেন রয়ে গেলে দূরে— বাহির-বাঁধনে বাঁধিবে কি বন্ধুরে, নিজের ধনে কি নিজে চুরি করে লবে। আভরণে আজি আবরণ কেন তবে॥
৩২১
প্রেম
প্রেম
বাহির পথে বিবাগী হিয়া কিসের খোঁজে গেলি, আয় রে ফিরে আয়। পুরানো ঘরে দুয়ার দিয়া ছেঁড়া আসন মেলি বসিবি নিরালায়॥ সারাটা বেলা সাগরধারে কুড়ালি যত নুড়ি, নানা রঙের শামুক-ভারে বোঝাই হল ঝুড়ি, লবণপারাবারের পারে প্রখর তাপে পুড়ি মরিলি পিপাসায়— ঢেউয়ের দোল তুলিল রোল অকূলতল জুড়ি, কহিল বাণী কী জানি কী ভাষায়॥ বিরাম হল আরামহীন যদি রে তোর ঘরে, না যদি রয় সাথি, সন্ধ্যা যদি তন্দ্রালীন মৌন অনাদরে, না যদি জ্বালে বাতি, তবু তো আছে আঁধার কোণে ধ্যানের ধনগুলি— একেলা বসি আপন-মনে মুছিবি তার ধূলি, গাঁথিবি তারে রতনহারে, বুকেতে নিবি তুলি মধুর বেদনায়। কাননবীথি ফুলের রীতি নাহয় গেছে ভুলি, তারকা আছে গগনকিনারায়॥
৩২২
প্রেম
প্রেম
এলেম নতুন দেশে— তলায় গেল ভগ্ন তরী, কূলে এলেম ভেসে॥ অচিন মনের ভাষা শোনাবে অপূর্ব কোন্ আশা, বোনাবে রঙিন সুতোয় দুঃখসুখের জাল, বাজবে প্রাণে নতুন গানের তাল— নতুন বেদনায় ফিরব কেঁদে হেসে॥ নাম-না-জানা প্রিয়া নাম-না-জানা ফুলের মালা নিয়া হিয়ায় দেবে হিয়া। যৌবনেরই নবোচ্ছ্বাসে ফাগুনমাসে বাজবে নূপুর ঘাসে ঘাসে। মাতবে দখিনবায় মঞ্জরিত লবঙ্গলতায়, চঞ্চলিত এলো কেশে॥
৩২৩
প্রেম
প্রেম
ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো আমার মুখের আঁচলখানি। ঢাকা থাকে না হায় গো, তারে রাখতে নারি টানি॥ আমার রইল না লাজলজ্জা, আমার ঘুচল গো সাজসজ্জা— তুমি দেখলে আমারে এমন প্রলয়-মাঝে আনি আমায় এমন মরণ হানি॥ হঠাৎ আকাশ উজলি কারে খুঁজে কে ওই চলে, চমক লাগায় বিজুলি আমার আঁধার ঘরের তলে। তবে নিশীথগগন জুড়ে আমার যাক সকলই উড়ে, এই দারুণ কল্লোলে বাজুক আমার প্রাণের বাণী কোনো বাঁধন নাহি মানি॥
৩২৪
প্রেম
প্রেম
পূর্ণ প্রাণে চাবার যাহা রিক্ত হাতে চাস নে তারে, সিক্তচোখে যাস নে দ্বারে॥ রত্নমালা আনবি যবে মাল্যবদল তখন হবে— পাতবি কি তোর দেবীর আসন শূন্য ধুলায় পথের ধারে॥ বৈশাখে বন রুক্ষ যখন, বহে পবন দৈন্যজ্বালা, হায় রে তখন শুকনো ফুলে ভরবি কি তোর বরণডালা। অতিথিরে ডাকবি যবে ডাকিস যেন সগৌরবে, লক্ষ শিখায় জ্বলবে যখন দীপ্ত প্রদীপ অন্ধকারে॥
৩২৫
প্রেম
প্রেম
লুকালে বলেই খুঁজে বাহির করা, ধরা যদি দিতে তবে যেত না ধরা॥ পাওয়া ধন আন্মনে হারাই যে অযতনে, হারাধন পেলে সে যে হৃদয়-ভরা॥ আপনি যে কাছে এল দূরে সে আছে, কাছে যে টানিয়া আনে সে আসে কাছে। দূরে বারি যায় চলে, লুকায় মেঘের কোলে, তাই সে ধরায় ফেরে পিপাসাহরা॥
৩২৬
প্রেম
প্রেম
ঘরেতে ভ্রমর এল গুন্গুনিয়ে। আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে॥ আলোতে কোন্ গগনে মাধবী জাগল বনে, এল সেই ফুল-জাগানোর খবর নিয়ে। সারা দিন সেই কথা সে যায় শুনিয়ে॥ কেমনে রহি ঘরে, মন যে কেমন করে— কেমনে কাটে যে দিন দিন গুনিয়ে। কী মায়া দেয় বুলায়ে, দিল সব কাজ ভুলায়ে, বেলা যায় গানের সুরে জাল বুনিয়ে। আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে॥
৩২৭
প্রেম
প্রেম
কোথা বাইরে দূরে যায় রে উড়ে হায় রে হায়, তোমার চপল আঁখি বনের পাখি বনে পালায়॥ ওগো, হৃদয়ে যবে মোহন রবে, বাজবে বাঁশি তখন আপনি সেধে ফিরবে কেঁদে, পরবে ফাঁসি— তখন ঘুচবে ত্বরা ঘুরিয়া মরা হেথা হোথায়। আহা, আজি সে আঁখি বনের পাখি বনে পালায়॥ চেয়ে দেখিস না রে হৃদয়দ্বারে কে আসে যায়, তোরা শুনিস কানে বারতা আনে দখিনবায়। আজি ফুলের বাসে সুখের হাসে আকুল গানে চির- বসন্ত যে তোমারি খোঁজে এসেছে প্রাণে— তারে বাহিরে খুঁজি ফিরিছ বুঝি পাগলপ্রায়। তোমার চপল আঁখি বনের পাখি বনে পালায়॥
৩২৮
প্রেম
প্রেম
দে তোরা আমায় নূতন করে দে নূতন আভরণে॥ হেমন্তের অভিসম্পাতে রিক্ত অকিঞ্চন কাননভূমি, বসন্তে হোক দৈন্যবিমোচন নব লাবণ্যধনে। শূন্য শাখা লজ্জা ভুলে যাক পল্লব-আবরণে॥ বাজুক প্রেমের মায়ামন্ত্রে পুলকিত প্রাণের বীণাযন্ত্রে চিরসুন্দরের অভিবন্দনা। আনন্দচঞ্চল নৃত্য অঙ্গে অঙ্গে বহে যাক হিল্লোলে হিল্লোলে, যৌবন পাক সম্মান বাঞ্ছিতসম্মিলনে॥
৩২৯
প্রেম
প্রেম
তোমার বৈশাখে ছিল প্রখর রৌদ্রের জ্বালা, কখন্ বাদল আনে আষাঢের পালা, হায় হায় হায়। কঠিন পাষাণে কেমনে গোপনে ছিল, সহসা ঝরনা নামিল অশ্রুঢালা, হায় হায় হায়। মৃগয়া করিতে বাহির হল যে বনে মৃগী হয়ে শেষে এল কি অবলা বালা, হায় হায় হায়। যে ছিল আপন শক্তির অভিমানে কার পায়ে আনে হার মানিবার ডালা, হায় হায় হায়॥
৩৩০
প্রেম
প্রেম
আমার এই রিক্ত ডালি দিব তোমারি পায়ে। দিব কাঙালিনীর আঁচল তোমার পথে পথে বিছায়ে॥ যে পুষ্পে গাঁথ পুষ্পধনু তারি ফুলে ফুলে হে অতনু, আমার পূজানিবেদনের দৈন্য দিয়ো ঘুচায়ে॥ তোমার রণজয়ের অভিযানে তুমি আমায় নিয়ো, ফুলবাণের টিকা আমার ভালে এঁকে দিয়ো। আমার শূন্যতা দাও যদি সুধায় ভরি দিব তোমার জয়ধ্বনি ঘোষণ করি— ফাল্গুনের আহবান জাগাও আমার কায়ে দক্ষিণবায়ে॥
৩৩১
প্রেম
প্রেম
আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি। আনন্দে বিষাদে মন উদাসী॥ পুষ্পবিকাশের সুরে দেহ মন উঠে পূরে, কী মাধুরীসুগন্ধ বাতাসে যায় ভাসি॥ সহসা মনে জাগে আশা, মোর আহুতি পেয়েছে অগ্নির ভাষা। আজ মম রূপে বেশে লিপি লিখি কার উদ্দেশে— এল মর্মের বন্দিনী বাণী বন্ধন নাশি॥
৩৩২
প্রেম
প্রেম
কোন্ দেবতা সে কী পরিহাসে ভাসালো মায়ার ভেলায়। স্বপ্নের সাথি, এসো মোরা মাতি স্বর্গের কৌতুকখেলায়॥ সুরের প্রবাহে হাসির তরঙ্গে বাতাসে বাতাসে ভেসে যাব রঙ্গে নৃত্যবিভঙ্গে মাধবীবনের মধুগন্ধে মোদিত মোহিত মন্থর বেলায়॥ যে ফুলমালা দুলায়েছ আজি রোমাঞ্চিত বক্ষতলে মধুরজনীতে রেখো সরসিয়া মোহের মদির জলে। নবোদিত সূর্যের করসম্পাতে বিকল হবে হায় লজ্জা-আঘাতে, দিন গত হলে নূতন প্রভাতে মিলাবে ধুলার তলে কার অবহেলায়॥
৩৩৩
প্রেম
প্রেম
নারীর ললিত লোভন লীলায় এখনি কেন এ ক্লান্তি। এখনি কি, সখা, খেলা হল অবসান॥ যে মধুর রসে ছিলে বিহবল সে কি মধুমাখা ভ্রান্তি— সে কি স্বপ্নের দান, সে কি সত্যের অপমান। দূর দুরাশায় হৃদয় ভরিছ, কঠিন প্রেমের প্রতিমা গড়িছ— কী মনে ভাবিয়া নারীতে করিছ পৌরুষসন্ধান। এও কি মায়ার দান॥ সহসা মন্ত্রবলে নমনীয় এই কমনীয়তারে যদি আমাদের সখী একেবারে পরের বসন-সমান ছিন্ন করি ফেলে ধূলিতলে সবে না সবে না সে নৈরাশ্য— ভাগ্যের সেই অট্টহাস্য জানি জানি, সখা, ক্ষুব্ধ করিবে লুব্ধ পুরুষপ্রাণ— হানিবে নিঠুর বাণ॥
৩৩৪
প্রেম
প্রেম
ওরে চিত্ররেখাডোরে বাঁধিল কে— বহু- পূর্বস্মৃতিসম হেরি ওকে॥ কার তুলিকা নিল মন্ত্রে জিনি এই মঞ্জুল রূপের নির্ঝরিণী— স্থির নির্ঝরিণী। যেন ফাল্গুন-উপবন শুক্লরাতে দোলপূর্ণিমাতে এল ছন্দমুরতি কার নব-অশোকে॥ নৃত্যকলা যেন চিত্রে-লিখা কোন্ স্বর্গের মোহিনী-মরীচিকা। শরৎ-নীলাম্বরে তড়িৎলতা কোথা হারাইল চঞ্চলতা। হে স্তব্ধবাণী, কারে দিবে আনি নন্দনমন্দারমাল্যখানি— বরমাল্যখানি। প্রিয়- বন্দনাগান-জাগানো রাতে শুভ দর্শন দিবে তুমি কাহার চোখে?।
৩৩৫
প্রেম
প্রেম
চিনিলে না আমারে কি। দীপহারা কোণে ছিনু অন্যমনে, ফিরে গেলে কারেও না দেখি॥ দ্বারে এসে গেলে ভুলে— পরশনে দ্বার যেত খুলে, মোর ভাগ্যতরী এটুকু বাধায় গেল ঠেকি॥ ঝড়ের রাতে ছিনু প্রহর গণি। হায়, শুনি নাই তব রথের ধ্বনি। গুরুগুরু গরজনে কাঁপি বক্ষ ধরিয়াছিনু চাপি, আকাশে বিদ্যুৎবহ্নি অভিশাপ গেল লেখি॥
৩৩৬
প্রেম
প্রেম
কঠিন বেদনার তাপস দোঁহে যাও চিরবিরহের সাধনায়। ফিরো না, ফিরো না, ভুলো না মোহে। গভীর বিষাদের শান্তি পাও হৃদয়ে, জায়ী হও অন্তরবিদ্রোহে॥ যাক পিয়াসা, ঘুচুক দুরাশা, যাক মিলায়ে কামনাকুয়াশা। স্বপ্ন-আবেশ-বিহীন পথে যাও বাঁধনহারা তাপবিহীন মধুর স্মৃতি নীরবে বহে॥
৩৩৭
প্রেম
প্রেম
সব কিছু কেন নিল না, নিল না, নিল না ভালোবাসা— ভালো আর মন্দেরে। আপনাতে কেন মিটালো না যত কিছু দ্বন্দ্বেরে— ভালো আর মন্দেরে॥ নদী নিয়ে আসে পঙ্কিল জলধারা, সাগরহৃদয়ে গহনে হয় হারা। ক্ষমার দীপ্তি দেয় স্বর্গের আলো প্রেমের আনন্দেরে— ভালো আর মন্দেরে॥
৩৩৮
প্রেম
প্রেম
নীরবে থাকিস, সখী, ও তুই নীরবে থাকিস। তোর প্রেমেতে আছে যে কাঁটা তারে আপন বুকে বিঁধিয়ে রাখিস॥ দয়িতেরে দিয়েছিলি সুধা, আজিও তাহার মেটে নি ক্ষুধা এখনি তাহে মিশাবি কি বিষ। যে জ্বলনে তুই মরিবি মরমে মরমে কেন তারে বাহিরে ডাকিস॥
৩৩৯
প্রেম
প্রেম
প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে— বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও দাও। ভুলিব ভাবনা, পিছনে চাব না— পাল তুলে দাও, দাও দাও দাও॥ প্রবল পবনে তরঙ্গ তুলিল, হৃদয় দুলিল, দুলিল দুলিল— পাগল হে নাবিক, ভুলাও দিগ্বিদিক— পাল তুলে দাও, দাও দাও দাও॥
৩৪০
প্রেম
প্রেম
জেনো প্রেম চিরঋণী আপনারই হরষে, জেনো প্রিয়ে। সব পাপ ক্ষমা করি ঋণশোধ করে সে। কলঙ্ক যাহা আছে দূর হয় তার কাছে, কালিমার ’পরে তার অমৃত সে বরষে॥
৩৪১
প্রেম
প্রেম
কোন্ অযাচিত আশার আলো দেখা দিল রে তিমিররাত্রি ভেদি দুর্দিনদুর্যোগে— কাহার মাধুরী বাজাইল করুণ বাঁশি। অচেনা নির্মম ভুবনে দেখিনু একি সহসা— কোন্ অজানার সুন্দর মুখে সান্ত্বনাহাসি॥
৩৪২
প্রেম
প্রেম
যদি আসে তবে কেন যেতে চায়। দেখা দিয়ে তবে কেন গো লুকায়॥ চেয়ে থাকে ফুল, হৃদয় আকুল— বায়ু বলে এসে ‘ভেসে যাই’। ধরে রাখো, ধরে রাখো— সুখপাখি ফাঁকি দিয়ে উড়ে যায়॥ পথিকের বেশে সুখনিশি এসে বলে হেসে হেসে ‘মিশে যাই’। জেগে থাকো, জেগে থাকো— বরষের সাধ নিমেষে মিলায়॥
৩৪৩
প্রেম
প্রেম
আমার মন বলে, ‘চাই, চা ই, চাই গো—যারে নাহি পাই গো’। সকল পাওয়ার মাঝে আমার মনে বেদন বাজে, ‘না ই, না ই, নাই গো’। হারিয়ে যেতে হবে, আমায় ফিরিয়ে পাব তবে। সন্ধ্যাতারা যায় যে চলে ভোরের তারায় জাগবে বলে— বলে সে, ‘যা ই, যা ই, যাই গো।’
৩৪৪
প্রেম
প্রেম
আমি ফুল তুলিতে এলেম বনে— জানি নে, আমার কী ছিল মনে। এ তো ফুল তোলা নয়, বুঝি নে কী মনে হয়, জল ভরে যায় দু নয়নে॥
৩৪৫
প্রেম
প্রেম
প্রাণ চায় চক্ষু না চায়, মরি একি তোর দুস্তরলজ্জা। সুন্দর এসে ফিরে যায়, তবে কার লাগি মিথ্যা এ সজ্জা॥ মুখে নাহি নিঃসরে ভাষ, দহে অন্তরে নির্বাক্ বহ্নি। ওষ্ঠে কী নিষ্ঠুর হাস, তব মর্মে যে ত্রন্দন তন্বী! মাল্য যে দংশিছে হায়, তোর শয্যা যে কণ্টকশয্যা— মিলনসমুদ্রবেলায় চির- বিচ্ছেদজর্জর মজ্জা॥
৩৪৬
প্রেম
প্রেম
দ্বারে কেন দিলে নাড়া ওগো মালিনী! কার কাছে পাবে সাড়া ওগো মালিনী॥ তুমি তো তুলেছ ফুল, গেঁথেছ মালা, আমার আঁধার ঘরে লেগেছে তালা। খুঁজে তো পাই নি পথ, দীপ জ্বালি নি॥ ওই দেখো গোধূলির ক্ষীণ আলোতে দিনের শেষের সোনা ডোবে কালোতে। আঁধার নিবিড় হলে আসিয়ো পাশে, যখন দূরের আলো জ্বালে আকাশে অসীম পথের রাতি দীপশালিনী॥
৩৪৭
প্রেম
প্রেম
তুমি মোর পাও নাই পরিচয়। তুমি যারে জান সে যে কেহ নয়, কেহ নয়॥ মালা দাও তারি গলে, শুকায় তা পলে পলে, আলো তার ভয়ে ভয়ে রয়— বায়ুপরশন নাহি সয়॥ এসো এসো দুঃখ, জ্বালো শিখা, দাও ভালে অগ্নিময়ী টিকা। মরণ আসুক চুপে পরমপ্রকাশরূপে, সব আবরণ হোক লয়— ঘুচুক সকল পরাজয়॥
৩৪৮
প্রেম
প্রেম
এবার, সখী, সোনার মৃগ দেয় বুঝি দেয় ধরা। আয় গো তোরা পুরাঙ্গনা, আয় সবে আয় ত্বরা॥ ছুটেছিল পিয়াস-ভরে মরীচিকা-বারির তরে, ধরে তারে কোমল করে কঠিন ফাঁসি পরা॥ দয়ামায়া করিস নে গো, ওদের নয় সে ধারা। দয়ার দোহাই মানবে না গো একটু পেলেই ছাড়া। বাঁধন-কাটা বন্যটাকে মায়ার ফাঁদে ফেলাও পাকে, ভুলাও তাকে বাঁশির ডাকে বুদ্ধিবিচার-হরা॥
৩৪৯
প্রেম
প্রেম
কী হল আমার! বুঝি বা সখী, হৃদয় আমার হারিয়েছি। পথের মাঝেতে খেলাতে গিয়ে হৃদয় আমার হারিয়েছি॥ প্রভাতকিরণে সকালবেলাতে মন লয়ে, সখী, গেছিনু খেলাতে— মন কুড়াইতে, মন ছড়াইতে, মনের মাঝারে খেলি বেড়াইতে, মনোফুল দলি চলি বেড়াইতে— সহসা, সজনী, চেতনা পেয়ে সহসা, সজনী, দেখিনু চেয়ে রাশি রাশি ভাঙা হৃদয়-মাঝে হৃদয় আমার হারিয়েছি॥ যদি কেহ, সখী, দলিয়া যায়, তার ’পর দিয়া চলিয়া যায়— শুকায়ে পড়িবে, ছিঁড়িয়া পড়িবে, দলগুলি তার ঝরিয়া পড়িবে— যদি কেহ, সখী, দলিয়া যায়। আমার কুসুমকোমল হৃদয় কখনো সহে নি রবির কর, আমার মনের কামিনীপাপড়ি সহে নি ভ্রমরচরণভর। চিরদিন, সখী, হাসিত খেলিত, জোছনা-আলোকে নয়ন মেলিত— সহসা আজ সে হৃদয় আমার কোথায়, সজনী, হারিয়েছি॥
৩৫০
প্রেম
প্রেম
আজি আঁখি জুড়ালো হেরিয়ে আহা আঁখি জুড়ালো হেরিয়ে মনোমোহন মিলনমাধুরী, যুগলমুরতি॥ ফুলগন্ধে আকুল করে, বাজে বাঁশরি উদাস স্বরে, নিকুঞ্জ প্লাবিত চন্দ্রকরে— তারি মাঝে মনোমোহন মিলনমাধুরী, যুগলমুরতি॥ আনো আনো ফুলমালা, দাও দোঁহে বাঁধিয়ে। হৃদয়ে পশিবে ফুলপাশ, অক্ষয় হবে প্রেমবন্ধন, চিরদিন হেরিব হে মনোমোহন মিলনমাধুরী, যুগলমুরতি॥
৩৫১
প্রেম
প্রেম
সকল হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছি যারে সে কি ফিরাতে পারে সখী! সংসারবাহিরে থাকি, জানি নে কী ঘটে সংসারে॥ কে জানে হেথায় প্রাণপণে প্রাণ যারে চায় তারে পায় কি না পায়— জানি নে— ভয়ে ভয়ে তাই এসেছি গো অজানা হৃদয়দ্বারে॥ তোমার সকলই ভালোবাসি— ওই রূপরাশি, ওই খেলা, ওই গান, ওই মধু হাসি। ওই দিয়ে আছ ছেয়ে জীবন আমারই। কোথায় তোমার সীমা ভুবনমাঝারে॥
৩৫২
প্রেম
প্রেম
তারে কেমনে ধরিবে, সখী, যদি ধরা দিলে। তারে কেমনে কাঁদাবে যদি আপনি কাঁদিলে॥ যদি মন পেতে চাও মন রাখো গোপনে। কে তারে বাঁধিবে তুমি আপনায় বাঁধিলে॥ কাছে আসিলে তো কেহ কাছে রহে না। কথা কহিলে তো কেহ কথা কহে না। হাতে পেলে ভূমিতলে ফেলে চলে যায়। হাসিয়ে ফিরায় মুখ কাঁদিয়া সাধিলে॥
৩৫৩
প্রেম
প্রেম
ওই মধুর মুখ জাগে মনে। ভুলিব না এ জীবনে, কী স্বপনে কী জাগরণে॥ তুমি জান বা না জান, মনে সদা যেন মধুর বাঁশরি বাজে— হৃদয়ে সদা আছ বলে। আমি প্রকাশিতে পারি নে, শুধু চাহি কাতরনয়নে॥
৩৫৪
প্রেম
প্রেম
সুখে আছি, সুখে আছি সখা, আপনমনে। কিছু চেয়ো না, দূরে যেয়ো না, শুধু চেয়ে দেখো, শুধু ঘিরে থাকো কাছাকাছি॥ সখা, নয়নে শুধু জানাবে প্রেম, নীরবে দিবে প্রাণ, রচিয়া ললিতমধুর বাণী আড়ালে গাবে গান। গোপনে তুলিয়া কুসুম গাঁথিয়া রেখে যাবে মালাগাছি। মন চেয়ো না, শুধু চেয়ে থাকো, শুধু ঘিরে থাকো কাছাকাছি॥ মধুর জীবন, মধুর রজনী, মধুর মলয়বায়। এই মাধুরীধারা বহিছে আপনি, কেহ কিছু নাহি চায়। আমি আপনার মাঝে আপনি হারা, আপন সৌরভে সারা— যেন আপনার মন আপনার প্রাণ আপনারে সঁপিয়াছি॥
৩৫৫
প্রেম
প্রেম
ভালোবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন, তবে কেন মিছে ভালোবাসা। মন দিয়ে মন পেতে চাহি। ওগো কেন, ওগো কেন মিছে এ দুরাশা॥ হৃদয়ে জ্বালায়ে বাসনার শিখা, নয়নে সাজায়ে মায়ামরীচিকা, শুধু ঘুরে মরি মরুভূমে। ওগো কেন, ওগো কেন মিছে এ পিপাসা॥ আপনি যে আছে আপনার কাছে নিখিল জগতে কী অভাব আছে। আছে মন্দ সমীরণ, পুষ্পবিভূষণ, কোকিলকূজিত কুঞ্জ। বিশ্বচরাচর লুপ্ত হয়ে যায়, একি ঘোর প্রেম অন্ধরাহু-প্রায় জীবন যৌবন গ্রাসে। তবে কেন, তবে কেন মিছে এ কুয়াশা॥
৩৫৬
প্রেম
প্রেম
সখা, আপন মন নিয়ে কাঁদিয়ে মরি, পরের মন নিয়ে কী হবে। আপন মন যদি বুঝিতে নারি, পরের মন বুঝে কে কবে॥ অবোধ মন লয়ে ফিরি ভবে, বাসনা কাঁদে প্রাণে হা-হা-রবে— এ মন দিতে চাও দিয়ে ফেলো, কেন গো নিতে চাও মন তবে॥ স্বপনসম সব জানিয়ো মনে, তোমার কেহ নাহি এ ত্রিভুবনে— যে জন ফিরিতেছে আপন আশে তুমি ফিরিছ কেন তাহার পাশে। নয়ন মেলি শুধু দেখে যাও, হৃদয় দিয়ে শুধু শান্তি পাও— তোমারে মুখ তুলে চাহে না যে থাক্ সে আপনার গরবে॥
৩৫৭
প্রেম
প্রেম
প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে। কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে— গরব সব হায় কখন্ টুটে যায়, সলিল বহে যায় নয়নে। এ সুখধরণীতে কেবলই চাহ নিতে, জান না হবে দিতে আপনা— সুখের ছায়া ফেলি কখন যাবে চলি, বরিবে সাধ করি বেদনা। কখন বাজে বাঁশি, গরব যায় ভাসি, পরান পড়ে আসি বাঁধনে॥
৩৫৮
প্রেম
প্রেম
এসেছি গো এসেছি, মন দিতে এসেছি যারে ভালোবেসেছি। ফুলদলে ঢাকি মন যাব রাখি চরণে, পাছে কঠিন ধরণী পায়ে বাজে। রেখো রেখো চরণ হৃদি-মাঝে। নাহয় দলে যাবে, প্রাণ ব্যথা পাবে— আমি তো ভেসেছি, অকূলে ভেসেছি॥
৩৫৯
প্রেম
প্রেম
যেয়ো না, যেয়ো না ফিরে। দাঁড়াও বারেক, দাঁড়াও হৃদয়-আসনে॥ চঞ্চল সমীরসম ফিরিছ কেন কুসুমে কুসুমে, কাননে কাননে। তোমায় ধরিতে চাহি, ধরিতে পারি নে, তুমি গঠিত যেন স্বপনে— এসো হে, তোমারে বারেক দেখি ভরিয়ে আঁখি, ধরিয়ে রাখি যতনে॥ প্রাণের মাঝে তোমারে ঢাকিব, ফুলের পাশে বাঁধেয় রাখিব— তুমি দিবসনিশি রহিবে মিশি কোমল প্রেমশয়নে॥
৩৬০
প্রেম
প্রেম
কাছে আছে দেখিতে না পাও। তুমি কাহার সন্ধানে দূরে যাও॥ মনের মতো কারে খুঁজে মর, সে কি আছে ভুবনে— সে যে রয়েছে মনে। ওগো, মনের মতো সেই তো হবে তুমি শুভক্ষণে যাহার পানে চাহ॥ তোমার আপনার যে জন দেখিলে না তারে তুমি যাবে কার দ্বারে। যারে চাবে তারে পাবে না, যে মন তোমার আছে যাবে তাও॥
৩৬১
প্রেম
প্রেম
জীবনে আজ কি প্রথম এল বসন্ত। নবীনবাসনাভরে হৃদয় কেমন করে, নবীন জীবনে হল জীবন্ত॥ সুখভরা এ ধরায় মন বাহিরিতে চায়, কাহারে বসাতে চায় হৃদয়ে। তাহারে খুঁজিব দিক-দিগন্ত॥ যেমন দখিনে বায়ু ছুটেছে, না জানি কোথায় ফুল ফুটেছে, তেমনি আমিও, সখী, যাব— না জানি কোথায় দেখা পাব। কার সুধাস্বর-মাঝে জগতের গীত বাজে, প্রভাত জাগিছে কার নয়নে, কাহার প্রাণের প্রেম অনন্ত। তাহারে খুঁজিব দিক-দিগন্ত॥
৩৬২
প্রেম
প্রেম
পথহারা তুমি পথিক যেন গো সুখের কাননে ওগো যাও, কোথা যাও। সুখে ঢলঢল বিবশ বিভল পাগল নয়নে তুমি চাও, কারে চাও। কোথা গেছে তব উদাস হৃদয়, কোথা পড়ে আছে ধরণী। মায়ার তরণী বাহিয়া যেন গো মায়াপুরী-পানে ধাও— কোন্ মায়াপুরী-পানে ধাও॥
৩৬৩
প্রেম
প্রেম
তুমি কোন্ কাননের ফুল, তুমি কোন্ গগনের তারা। তোমায় কোথায় দেখেছি যেন কোন্ স্বপনের পারা॥ কবে তুমি গেয়েছিলে, আঁখির পানে চেয়েছিলে ভুলে গিয়েছি। শুধু মনের মধ্যে জেগে আছে ওই নয়নের তারা॥ তুমি কথা কোয়ো না, তুমি চেয়ে চলে যাও। এই চাঁদের আলোতে তুমি হেসে গলে যাও। আমি ঘুমের ঘোরে চাঁদের পানে চেয়ে থাকি মধুর প্রাণে, তোমার আঁখির মতন দুটি তারা ঢালুক কিরণধারা॥
৩৬৪
প্রেম
প্রেম
আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান। আন্ তবে বীণা— সপ্তম সুরে বাঁধ্ তবে তান॥ পাশরিব ভাবনা, পাশরিব যাতনা, রাখিব প্রমোদে ভরি দিবানিশি মনপ্রাণ, আন্ তবে বীণা— সপ্তম সুরে বাঁধ্ তবে তান॥ ঢালো ঢালো শশধর, ঢালো ঢালো জোছনা। সমীরণ, বহে যা রে ফুলে ফুলে ঢলি ঢলি। উলসিত তটিনী, উথলিত গীতরবে খুলে দে রে মনপ্রাণ॥
৩৬৫
প্রেম
প্রেম
আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে। ভয় কোরো না, সুখে থাকো, বেশিক্ষণ থাকব নাকো— এসেছি দণ্ড-দুয়ের তরে॥ দেখব শুধু মুখখানি, শুনাও যদি শুনব বাণী, নাহয় যাব আড়াল থেকে হাসি দেখে দেশান্তরে॥
৩৬৬
প্রেম
প্রেম
মনে যে আশা লয়ে এসেছি হল না, হল না হে। ওই মুখপানে চেয়ে ফিরিনু লুকাতে আঁখিজল, বেদনা রহিল মনে মনে॥ তুমি কেন হেসে যাও, হেসে যাও হে, আমি কেন কেঁদে ফিরি— কেন আনি কম্পিত হৃদয়খানি, কেন যাও দূরে না দেখে॥
৩৬৭
প্রেম
প্রেম
এখনো তারে চোখে দেখি নি, শুধু বাঁশি শুনেছি— মন প্রাণ যাহা ছিল দিয়ে ফেলেছি॥ শুনেছি মুরতি কালো, তারে না দেখাই ভালো। সখী, বলো আমি জল আনিতে যমুনায় যাব কি॥ শুধু স্বপনে এসেছিল সে, নয়নকোণে হেসেছিল সে। সে অবধি সই, ভয়ে ভয়ে রই— আঁখি মেলিতে ভেবে সারা হই। কাননপথে যে খুশি সে যায়, কদমতলে যে খুশি সে চায়— সখী, বলো আমি কারো পানে চাব কি॥
৩৬৮
প্রেম
প্রেম
বঁধু, তোমায় করব রাজা তরুতলে, বনফুলের বিনোদমালা দেব গলে॥ সিংহাসনে বসাইতে হৃদয়খানি দেব পেতে, অভিষেক করব তোমায় আঁখিজলে॥
৩৬৯
প্রেম
প্রেম
এরা পরকে আপন করে, আপনারে পর— বাহিরে বাঁশির রবে ছেড়ে যায় ঘর॥ ভালোবাসে সুখে দুখে, ব্যথা সহে হাসিমুখে, মরণেরে করে চিরজীবননির্ভর॥
৩৭০
প্রেম
প্রেম
সমুখেতে বহিছে তটিনী, দুটি তারা আকাশে ফুটিয়া। বায়ু বহে পরিমল লুটিয়া। সাঁঝের অধর হতে ম্লান হাসি পড়িছে টুটিয়া॥ দিবস বিদায় চাহে, যমুনা বিলাপ গাহে— সায়াহ্নেরই রাঙা পায়ে কেঁদে কেঁদে পড়িছে লুটিয়া॥ এসো বঁধু, তোমায় ডাকি— দোঁহে হেথা বসে থাকি, আকাশের পানে চেয়ে জলদের খেলা দেখি, আঁখি-’পরে তারাগুলি একে একে উঠিবে ফুটিয়া॥
৩৭১
প্রেম
প্রেম
বুঝি বেলা বহে যায়, কাননে আয় তোরা আয়। আলোতে ফুল উঠল ফুটে, ছায়ায় ঝরে পড়ে যায়॥ সাধ ছিল রে পরিয়ে দেব মনের মতো মালা গেঁথে— কই সে হল মালা গাঁথা, কই সে এল হায়। যমুনার ঢেউ যাচ্ছে বয়ে, বেলা চলে যায়॥
৩৭২
প্রেম
প্রেম
বনে এমন ফুল ফুটেছে, মান ক’রে থাকা আজ কি সাজে। মান অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে চলো চলো কুঞ্জমাঝে॥ আজ কোকিলে গেয়েছে কুহু মুহুর্মুহু, আজ কাননে ওই বাঁশি বাজে। মান ক’রে থাকা আজ কি সাজে॥ আজ মধুরে মিশাবি মধু, পরানবঁধু চাঁদের আলোয় ওই বিরাজে। মান ক’রে থাকা আজ কি সাজে॥
৩৭৩
প্রেম
প্রেম
আমি কেবল তোমার দাসী। কেমন করে আনব মুখে ‘তোমায় ভালোবাসি’॥ গুণ যদি মোর থাকত তবে অনেক আদর মিলত ভবে, বিনামূল্যের কেনা আমি শ্রীচরণপ্রয়াসী॥
৩৭৪
প্রেম
প্রেম
আজ যেমন ক’রে গাইছে আকাশ তেমনি ক’রে গাও গো। আজ যেমন ক’রে চাইছে আকাশ তেমনি ক’রে চাও গো॥ আজ হাওয়া যেমন পাতায় পাতায় মর্মরিয়া বনকে কাঁদায়, তেমনি আমার বুকের মাঝে কাঁদিয়া কাঁদাও গো॥
৩৭৫
প্রেম
প্রেম
যৌবনসরসীনীরে মিলনশতদল কোন্ চঞ্চল বন্যায় টলোমল টলোমল॥ শরমরক্তরাগে তার গোপন স্বপ্ন জাগে, তারি গন্ধকেশর-মাঝে এক বিন্দু নয়নজল॥ ধীরে বও ধীরে বও, সমীরণ, সবেদন পরশন। শঙ্কিত চিত্ত মোর পাছে ভাঙে বৃন্তডোর— তাই অকারণ করুণায় মোর আঁখি করে ছলোছল॥
৩৭৬
প্রেম
প্রেম
সখী বলো দেখি, সখী লো, নিরদয় লাজ তোর টুটিবে কি লো। চেয়ে আছি ললনা— মুখানি তুলিবি কি লো, ঘোমটা খুলিবি কি লো, আধফোটা অধরে হাসি ফুটিবে কি লো॥ শরমের মেঘে ঢাকা বিধুমুখানি— মেঘ টুটে জোছনা ফুটে উঠিবে কি লো। তৃষিত আঁখির আশা পুরাবি কি লো— তবে ঘোমটা খোলো, মুখটি তোলো, আঁখি মেলো লো॥
৩৭৭
প্রেম
প্রেম
দেখে যা, দেখে যা, দেখে যা লো তোরা সাধের কাননে মোর আমার সাধের কুসুম উঠেছে ফুটিয়া, মলয় বহিছে সুরভি লুটিয়া রে— হেথায় জোছনা ফুটে, তটিনী ছুটে, প্রমোদে কানন ভোর॥ আয় আয় সখী, আয় লো হেথা দুজনে কহিব মনের কথা। তুলিব কুসুম দুজনে মিলিয়ে— সুখে গাঁথিব মালা, গণিব তারা, করিব রজনী ভোর॥ এ কাননে বসি গাহিব গান, সুখের স্বপনে কাটাব প্রাণ, খেলিব দুজনে মনের খেলা রে— প্রাণে রহিবে মিশি দিবসনিশি আধো-আধো ঘুমঘোর॥
৩৭৮
প্রেম
প্রেম
নিমেষের তরে শরমে বাধিল, মরমের কথা হল না। জনমের তরে তাহারি লাগিয়ে রহিল মরমবেদনা॥ চোখে চোখে সদা রাখিবারে সাধ— পলক পড়িল, ঘটিল বিষাদ। মেলিতে নয়ন মিলালো স্বপন এমনি প্রেমের ছলনা॥
৩৭৯
প্রেম
প্রেম
আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ। সে তো এল না যারে সঁপিলাম এই প্রাণ মন দেহ॥ সে কি মোর তরে পথ চাহে, সে কি বিরহগীত গাহে যার বাঁশরিধ্বনি শুনিয়ে আমি ত্যজিলাম গেহ॥
৩৮০
প্রেম
প্রেম
ওকে বল্, সখী, বল্— কেন মিছে করে ছল, মিছে হাসি কেন সখী, মিছে আঁখিজল॥ জানি নে প্রেমের ধারা, ভয়ে তাই হই সারা— কে জানে কোথায় সুধা কোথা হলাহল॥ কাঁদিতে জানে না এরা, কাঁদাইতে জানে কল— মুখের বচন শুনে মিছে কী হইবে ফল। প্রেম নিয়ে শুধু খেলা— প্রাণ নিয়ে হেলাফেলা— ফিরে যাই এই বেলা, চল্ সখী, চল্॥
৩৮১
প্রেম
প্রেম
কে ডাকে। আমি কভু ফিরে নাহি চাই। কত ফুল ফুটে উঠে কত ফুল যায় টুটে, আমি শুধু বহে চলে যাই॥ পরশ পুলকরস-ভরা রেখে যাই, নাহি দিই ধরা। উড়ে আসে ফুলবাস, লতাপাতা ফেলে শ্বাস, বনে বনে উঠে হাহুতাশ— চকিতে শুনিতে শুধু পাই। চলে যাই॥
৩৮২
প্রেম
প্রেম
সখী, সে গেল কোথায় তারে ডেকে নিয়ে দাঁড়াব ঘিরে তারে তরুতলায়॥ আজি এ মধুর সাঁঝে কাননে ফুলের মাঝে হেসে হেসে বেড়াবে সে, দেখিব তায়॥ অকাশে তারা ফুটেছে, দখিনে বাতাস ছুটেছে, পাখিটি ঘুমঘোরে গেয়ে উঠেছে। আয় লো আনন্দময়ী, মধুর বসন্ত লয়ে লাবণ্য ফুটাবি লো তরুলতায়॥
৩৮৩
প্রেম
প্রেম
বিদায় করেছ যারে নয়নজলে, এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে গো॥ আজি মধু সমীরণে নিশীথে কুসুমবনে তারে কি পড়েছে মনে বকুলতলে॥ সে দিনও তো মধুনিশি প্রাণে গিয়েছিল মিশি, মুকুলিত দশ দিশি কুসুমদলে। দুটি সোহাগের বাণী যদি হত কানাকানি, যদি ওই মালাখানি পরাতে গলে। এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে গো॥ মধুরাতি পূর্ণিমার ফিরে আসে বার বার, সে জন ফিরে না আর যে গেছে চলে॥ ছিল তিথি অনুকূল, শুধু নিমেষের ভুল— চিরদিন তৃষাকুল পরান জ্বলে। এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে গো॥
৩৮৪
প্রেম
প্রেম
না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখিজলে। ওগো, কে আছে চাহিয়া শূন্য পথপানে— কাহার জীবনে নাহি সুখ, কাহার পরান জ্বলে॥ পড় নি কাহার নয়নের ভাষা, বোঝ নি কাহার মরমের আশা, দেখ নি ফিরে— কার ব্যাকুল প্রাণের সাধ এসেছ দলে॥
৩৮৫
প্রেম
প্রেম
নয়ন মেলে দেখি আমায় বাঁধন বেঁধেছে। গোপনে কে এমন করে এ ফাঁদ ফেঁদেছে॥ বসন্ত রজনীশেষে বিদায় নিতে গেলেম হেসে— যাবার বেলায় বঁধু আমায় কাঁদিয়ে কেঁদেছে॥
৩৮৬
প্রেম
প্রেম
হাসিরে কি লুকাবি লাজে। চপলা সে বাঁধা পড়ে না যে॥ রুধিয়া অধরদ্বারে ঝাঁপিয়া রাখিলি যারে কখন সে ছুটে এল নয়নমাঝে॥
৩৮৭
প্রেম
প্রেম
যে ফুল ঝরে সেই তো ঝরে, ফুল তো থাকে ফুটিতে— বাতাস তারে উড়িয়ে নে যায়, মাটি মেশায় মাটিতে॥ গন্ধ দিলে, হাসি দিলে, ফুরিয়ে গেল খেলা। ভালোবাসা দিয়ে গেল, তাই কি হেলাফেলা॥
৩৮৮
প্রেম
প্রেম
সাজাব তোমারে হে ফুল দিয়ে দিয়ে, নানা বরনের বনফুল দিয়ে দিয়ে॥ আজি বসন্তরাতে পূর্ণিমাচন্দ্রকরে দক্ষিণপবনে, প্রিয়ে, সাজাব তোমারে হে ফুল দিয়ে দিয়ে॥
৩৮৯
প্রেম
প্রেম
মন জানে মনোমোহন আইল, মন জানে সখা। তাই কেমন করে আজি আমার প্রাণে॥ তারি সৌরভ বহি বহিল কি সমীরণ আমার পরানপানে॥
৩৯০
প্রেম
প্রেম
হল না, হল না, সই, হায়— মরমে মরমে লুকানো রহিল, বলা হল না॥ বলি বলি বলি তারে কত মনে করিনু— হল না, হল না সই॥ না কিছু কহিল, চাহিয়া রহিল, গেল সে চলিয়া, আর সে ফিরিল না। ফিরাব ফিরাব বলে কত মনে করিনু— হল না, হল না সই॥
৩৯১
প্রেম
প্রেম
ও কেন চুরি করে চায়। নুকোতে গিয়ে হাসি হেসে পলায়॥ বনপথে ফুলের মেলা, হেলে দুলে করে খেলা— চকিতে সে চমকিয়ে কোথা দিয়ে যায়॥ কী যেন গানের মতো বেজেছে কানের কাছে, যেন তার প্রাণের কথা আধেকখানি শোনা গেছে। পথেতে যেতে চলে মালাটি গেছে ফেলে— পরানের আশাগুলি গাঁথা যেন তায়॥
৩৯২
প্রেম
প্রেম
কেহ কারো মন বোঝে না, কাছে এসে সরে যায়। সোহাগের হাসিটি কেন চোখের জলে মরে যায়॥ বাতাস যখন কেঁদে গেল প্রাণ খুলে ফুল ফুটিল না, সাঁঝের বেলায় একাকিনী কেন রে ফুল ঝরে যায়॥ মুখের পানে চেয়ে দেখো, আঁখিতে মিলাও আঁখি— মধুর প্রাণের কথা প্রাণেতে রেখো না ঢাকি। এ রজনী রহিবে না, আর কথা হইবে না— প্রভাতে রহিবে শুধু হৃদয়ের হায়-হায়॥
৩৯৩
প্রেম
প্রেম
গেল গো— ফিরিল না, চাহিল না, পাষাণ সে। কথাটিও কহিল না, চলে গেল গো॥ না যদি থাকিতে চায় যাক যেথা সাধ যায়, একেলা আপন-মনে দিন কি কাটিবে না। তাই হোক, হোক তবে— আর তারে সাধিব না॥
৩৯৪
প্রেম
প্রেম
বল্, গোলাপ, মোরে বল্, তুই ফুটিবি, সখী, কবে। ফুল ফুটেছে চারি পাশ, চাঁদ হাসিছে সুধাহাস, বায়ু ফেলিছে মৃদু শ্বাস, পাখি গাহিছে মধুরবে— তুই ফুটিবি, সখী, কবে॥ প্রাতে পড়েছে শিশিরকণা, সাঁঝে বহিছে দখিনা বায়, কাছে ফুলবালা সারি সারি— দূরে পাতার আড়ালে সাঁঝের তারা মুখানি দেখিতে চায়। বায়ু দূর হতে আসিয়াছে, যত ভ্রমর ফিরিছে কাছে, কচি কিশলয়গুলি রয়েছে নয়ন তুলি— তারা শুধাইছে মিলি সবে, তুই ফুটিবি, সখী, কবে॥
৩৯৫
প্রেম
প্রেম
আমার যেতে সরে না মন— তোমার দুয়ার পারায়ে আমি যাই যে হারায়ে অতল বিরহে নিমগন। চলিতে চলিতে পথে সকলই দেখি যেন মিছে, নিখিল ভুবন মিছে ডাকে অনুক্ষণ॥ আমার মনে কেবলই বাজে তোমায় কিছু দেওয়া হল না যে। যবে চলে যাই পদে পদে বাধা পাই, ফিরে ফিরে আসি অকারণ॥