Generated on: Fri Dec 19 2014

Home

::

Show All

::

Show Current

::

Scroll TOC Up| Down

Send a Comment


প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে।
স্থলে জলে নভতলে বনে উপবনে
নদীনদে গিরিগুহা-পারাবারে
নিত্য জাগে সরস সঙ্গীতমধুরিমা,
নিত্য নৃত্যরসভঙ্গিমা।—
নব বসন্তে নব আনন্দ, উৎসব নব।
অতি মঞ্জুল, অতি মঞ্জুল, শুনি মঞ্জুল গুঞ্জন কুঞ্জে—
শুনি রে শুনি মর্মর পল্লবপুঞ্জে,
পিককূজন পুষ্পবনে বিজনে,
মৃদু বায়ুহিলোলবিলোল বিভোল বিশাল সরোবর-মাঝে
কলগীত সুললিত বাজে।
শ্যমল কান্তার-’পরে অনিল সঞ্চারে ধীরে রে,
নদীতীরে শরবনে উঠে ধবনি সরসর মরমর।
কত দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা॥
আষাঢ়ের নব আনন্দ, উৎসব নব।
অতি গম্ভীর, অতি গম্ভীর নীল অম্বরে ডম্বরু বাজে,
যেন রে প্রলয়ঙ্করী শঙ্করী নাচে।
করে গর্জন নির্ঝরিণী সঘনে,
হেরো ক্ষুব্ধ ভয়াল বিশাল নিরালা পিয়ালতমালবিতানে
উঠে রব ভৈরবতানে।
পবন মল্লারগীত গাহিছে আঁধার রাতে,
উন্মাদিনী সৌদামিনী রঙ্গভরে নৃত্য করে অম্বরতলে।
দিকে দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা।আশ্বিনে নব আনন্দ, উৎসব নব।
অতি নির্মল, অতি নির্মল, অতি নির্মল উজ্জ্বল সাজে
ভুবনে নব শারদলক্ষ্মী বিরাজে।
নব ইন্দুলেখা অলকে ঝলকে,
অতি নির্মল হাসবিভাসবিকাশ আকাশনীলাম্বুজ-মাঝে
শ্বেত ভুজে শ্বেত বীণা বাজে —
উঠিছে আলাপ মৃদু মধুর বেহাগতানে,
চন্দ্রকরে উল্লসিত ফুল্লবনে ঝিল্লিরবে তন্দ্রা আনে রে।
দিকে দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা।
    

প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন   দিয়ে যাও, শেষে  দাও মুছে।
ওহে  চঞ্চল, বেলা   না যেতে খেলা  কেন তব যায় ঘুচে॥
চকিত চোখের অশ্রুসজল   বেদনায় তুমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে চল —
   কোথা সে পথের শেষ   কোন্‌ সুদূরের দেশ
        সবাই তোমায় তাই পুছে॥
বাঁশরির ডাকে কুঁড়ি ধরে শাখে,  ফুল যবে ফোটে নাই দেখা।
তোমার লগন যায় যে কখন,  মালা গেঁথে আমি রই একা।
‘এসো এসো এসো’ আঁখি কয় কেঁদে।  তৃষিত বক্ষ বলে ‘রাখি বেঁধে’।
   যেতে যেতে, ওগো প্রিয়,  কিছু ফেলে রেখে দিয়ো
        ধরা দিতে যদি নাই রুচে॥
    

প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একি  আকুলতা ভুবনে!  একি  চঞ্চলতা পবনে॥
একি  মধুরমদির রসরাশি   আজি  শূন্যতলে চলে ভাসি,
  ঝরে  চন্দ্রকরে একি হাসি,  ফুল-  গন্ধ লুটে গগনে॥
একি  প্রাণভরা অনুরাগে  আজি  বিশ্বজগতজন জাগে,
আজি  নিখিল নীলগগনে  সুখ-  পরশ কোথা হতে লাগে।
সুখে  শিহরে সকল বনরাজি,  উঠে  মোহনবাঁশরি বাজি,
  হেরো  পূর্ণবিকশিত আজি  মম  অন্তর সুন্দর স্বপনে॥
    

প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ  তালের বনের করতালি  কিসের তালে
পূর্ণিমাচাঁদ মাঠের পারে    ওঠার কালে॥
    না-দেখা কোন্‌ বীণা বাজে  আকাশ-মাঝে,
    না-শোনা কোন্‌ রাগ রাগিণী  শূন্যে ঢালে॥
ওর  খুশির সাথে কোন্‌ খুশির আজ  মেলামেশা,
কোন্‌  বিশ্বমাতন গানের নেশায়  লাগল নেশা।
    তারায় কাঁপে রিনিঝিনি  যে কিঙ্কিণী
    তারি কাঁপন লাগল কি ওর  মুগ্ধ ভালে॥
    

প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আঁধার কুঁড়ির বাঁধন টুটে  চাঁদের ফুল উঠেছে ফুটে॥
    তার  গন্ধ কোথায়, গন্ধ কোথায় রে।
    গন্ধ আমার গভীর ব্যথায় হৃদয়-মাঝে লুটে॥
ও  কখন যাবে সরে,  আকাশ হতে পড়বে ঝরে।
    ওরে  রাখব কোথায়, রাখব কোথায় রে।
    রাখব ওরে আমার ব্যথায় গানের পত্রপুটে॥
    

প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    পূর্ণচাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে,
যেন  সিন্ধুপারের পাখি তারা যা য়  যা য়  যায় চলে॥
   আলোছায়ার সুরে  অনেক কালের সে কোন্‌ দূরে
         ডাকে  আ য়  আ য়  আয় ব’লে॥
   যেথায় চলে গেছে আমার হারা ফাগুনরাতি
   সেথায় তারা ফিরে ফিরে খোঁজে আপন সাথি।
আলোছায়ায় যেথা  অনেক দিনের সে কোন্‌ ব্যথা
     কাঁদে  হা য়  হা য়  হায় ব’লে॥
    

প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    কত যে তুমি মনোহর মনই তাহা জানে,
    হৃদয় মম থরোথরো কাঁপে তোমার গানে॥
আজিকে এই প্রভাতবেলা  মেঘের সাথে রোদের খেলা,
    জলে নয়ন ভরোভরো চাহি তোমার পানে॥
    আলোর অধীর ঝিলিমিলি নদীর ঢেউয়ে ওঠে,
    বনের হাসি খিলিখিলি পাতায় পাতায় ছোটে।
আকাশে ওই দেখি কী যে—  তোমার চোখের চাহনি যে।
    সুনীল সুধা ঝরোঝরো ঝরে আমার প্রাণে॥
    

প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥
অসীম কালের যে হিল্লোলে  জোয়ার-ভাঁটায় ভুবন দোলে
নাড়ীতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥
ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে,
ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে,
ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।
কান পেতেছি, চোখ মেলেছি,  ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি,
জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥
    

প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ব্যাকুল বকুলের ফুলে   ভ্রমর মরে পথ ভুলে॥
      আকাশে কী গোপন বাণী   বাতাসে করে কানাকানি,
             বনের অঞ্চলখানি   পুলকে উঠে দুলে দুলে॥
বেদনা সুমধুর হয়ে   ভুবনে আজি গেল বয়ে।
      বাঁশিতে মায়া-তান পূরি   কে আজি মন করে চুরি,
             নিখিল তাই মরে ঘুরি   বিরহসাগরের কূলে॥
    
১০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা।   খেলো খেলো তব নীরব ভৈরব খেলা॥
    যদি   ঝ’রে পড়ে পড়ুক পাতা,   ম্লান হয়ে যাক মালা গাঁথা,
           থাক্‌ জনহীন পথে পথে   মরীচিকাজাল ফেলা॥
শুষ্ক ধুলায় খসে-পড়া ফুলদলে   ঘূর্ণী-আঁচল উড়াও আকাশতলে।
     প্রাণ যদি কর মরুসম   তবে তাই হোক— হে নির্মম,
         তুমি একা আর আমি একা,   কঠোর মিলনমেলা॥
    
১১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দারুণ অগ্নিবাণে রে   হৃদয় তৃষায় হানে রে॥
    রজনী নিদ্রাহীন,   দীর্ঘ দগ্ধ দিন
         আরাম নাহি যে জানে রে॥
    শুষ্ক কাননশাখে   ক্লান্ত কপোত ডাকে
         করুণ কাতর গানে রে॥
ভয় নাহি, ভয় নাহি।   গগনে রয়েছি চাহি।
    জানি ঝঞঝার বেশে   দিবে দেখা তুমি এসে
         একদা তাপিত প্রাণে রে॥
    
১২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এসো এসো হে তৃষ্ণার জল,   কলকল্‌ ছলছল্‌—
ভেদ করো কঠিনের ত্রূর বক্ষতল   কলকল্‌ ছলছল্‌॥
      এসো এসো উৎসস্রোতে গূঢ় অন্ধকার হতে
      এসো হে নির্মল   কলকল্‌ ছলছল্‌॥
রবিকর রহে তব প্রতীক্ষায়।
তুমি যে খেলার সাথি, সে তোমারে চায়।
      তাহারি সোনার তান   তোমাতে জাগায় গান,
      এসো হে উজ্জ্বল, কলকল্‌ ছলছল্‌॥
হাঁকিছে অশান্ত বায়,
‘আয়, আয়, আয়।’   সে তোমায় খুঁজে যায়।
      তাহার মৃদঙ্গরবে   করতালি দিতে হবে,
      এসো হে চঞ্চল, কলকল্‌ ছলছল্‌॥
মরুদৈত্য কোন্‌ মায়াবলে
তোমারে করেছে বন্দী পাষাণশৃঙ্খলে।
      ভেঙে ফেলে দিয়ে কারা   এসো বন্ধহীন ধারা,
     এসো হে প্রবল,   কলকল্‌ ছলছল্‌॥
    
১৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে।
বেড়া-ভাঙার মাতন নামে উদ্দাম উল্লাসে॥
তোমার   মোহন এল ভীষণ বেশে,   আকাশ ঢাকা জটিল কেশে—
    বুঝি   এল তোমার সাধনধন চরম সর্বনাশে॥
বাতাসে তোর সুর ছিল না,   ছিল তাপে ভরা।
পিপাসাতে বুক-ফাটা তোর শুষ্ক কঠিন ধরা।
এবার  জাগ্‌ রে হতাশ, আয় রে ছুটে   অবসাদের বাঁধন টুটে—
      বুঝি   এল তোমার পথের সাথি বিপুল অট্টহাসে॥
    
১৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে   মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
    বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি,   যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
    অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
    মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
    অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি   শুষ্ক করি দাও আসি,
    আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
    মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক॥
    
১৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নমো নমো, হে বৈরাগী।
     তপোবহ্নির শিখা জ্বালো জ্বালো,
        নির্বাণহীন নির্মল আলো
          অন্তরে থাক্‌ জাগি॥
    
১৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি,
হে রাখাল, বেণু তব বাজাও একাকী॥
প্রান্তরপ্রান্তের কোণে   রুদ্র বসি তাই শোনে
মধুরের-স্বপ্নাবেশে-ধ্যানমগন-আঁখি—
হে রাখাল, বেণু যবে বাজাও একাকী॥
সহসা উচ্ছ্বসি উঠে ভরিয়া আকাশ
তৃষাতপ্ত বিরহের নিরুদ্ধ নিশ্বাস।
অম্বরপ্রান্তে যে দূরে   ডম্বরু গম্ভীর সুরে
জাগায় বিদ্যুতছন্দে আসন্ন বৈশাখী—
হে রাখাল, বেণু যবে বাজাও একাকী॥
    
১৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
           ওই বুঝি কালবৈশাখী
           সন্ধ্যা-আকাশ দেয় ঢাকি॥
ভয় কী রে তোর ভয় কারে,   দ্বার খুলে দিস চার ধারে—
শোন্‌ দেখি ঘোর হুঙ্কারে   নাম তোরই ওই যায় ডাকি॥
           তোর সুরে আর তোর গানে
           দিস সাড়া তুই ওর পানে।
যা নড়ে তায় দিক নেড়ে,   যা যাবে তা যাক ছেড়ে,
যা ভাঙা তাই ভাঙবে রে—  যা রবে তাই থাক্‌ বাকি॥
    
১৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রখর তপনতাপে   আকাশ তৃষায় কাঁপে,
    বায়ু করে হাহাকার।
দীর্ঘপথের শেষে   ডাকি মন্দিরে এসে,
    ‘খোলো খোলো খোলো দ্বার।’
বাহির হয়েছি কবে   কার আহবানরবে,
এখনি মলিন হবে   প্রভাতের ফুলহার॥
বুকে বাজে আশাহীনা   ক্ষীণমর্মর বীণা,
জানি না কে আছে কিনা,   সাড়া তো পাই না তার।
আজি সারা দিন ধ’রে   প্রাণে সুর ওঠে ভরে,
একেলা কেমন ক’রে  বহিব গানের ভার॥
    
১৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদুমন্দ।
  আনে আমার মনের কোণে সেই চরণের ছন্দ॥
      স্বপ্নশেষের বাতায়নে  হঠাৎ-আসা ক্ষণে ক্ষণে
      আধো-ঘুমের-প্রান্ত-ছোঁওয়া বকুলমালার গন্ধ॥
বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া বহে কিসের হর্ষ,
যেন রে সেই উড়ে-পড়া এলো কেশের স্পর্শ।
    চাঁপাবনের কাঁপন-ছলে  লাগে আমার বুকের তলে
    আরেক দিনের প্রভাত হতে হৃদয়দোলার স্পন্দ॥
    
২০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      বৈশাখ হে, মৌনী তাপস, কোন্‌ অতলের বাণী
            এমন কোথায় খুঁজে পেলে।
      তপ্ত ভালের দীপ্তি ঢাকি মন্থর মেঘখানি
          এল  গভীর ছায়া ফেলে॥
              রুদ্রতপের সিদ্ধি এ কি  ওই-যে তোমার বক্ষে দেখি,
                  ওরই লাগি আসন পাতো হোমহুতাশন জ্বেলে॥
      নিঠুর, তুমি তাকিয়েছিলে মৃত্যুক্ষুধার মতো
         তোমার রক্তনয়ন মেলে।
      ভীষণ, তোমার প্রলয়সাধন প্রাণের বাঁধন যত
          যেন   হানবে অবহেলে।
             হঠাৎ তোমার কণ্ঠে এ যে আশার ভাষা উঠলো বেজে,
                  দিলে তরুণ শ্যামল রূপে করুণ সুধা ঢেলে॥
    
২১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      শুষ্কতাপের দৈত্যপুরে দ্বার ভাঙবে ব’লে,
      রাজপুত্র,  কোথা হতে হঠাৎ এলে চলে॥
  সাত সমুদ্র- পারের থেকে   বজ্রস্বরে এলে হেঁকে,
      দুন্দুভি যে উঠল বেজে বিষম কলরোলে॥
      বীরের পদপরশ পেয়ে মূর্ছা হতে জাগে,
      বসুন্ধরার তপ্ত প্রাণে বিপুল পুলক লাগে।
  মরকতমণির থালা   সাজিয়ে গাঁথে বরণমালা,
      উতলা তার হিয়া আজি সজল হাওয়ায় দোলে॥
    
২২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  হে তাপস, তব শুষ্ক কঠোর রূপের গভীর রসে
  মন আজি মোর উদাস বিভোর কোন্‌ সে ভাবের বশে॥
     তব পিঙ্গল জটা  হানিছে দীপ্ত ছটা,
     তব দৃষ্টির বহ্নিবৃষ্টি অন্তরে গিয়ে পশে॥
          বুঝি না, কিছু না জানি
     মর্মে আমার মৌন তোমার কী বলে রুদ্রবাণী।
  দিগ্‌‍ দিগন্ত দহি  দুঃসহ তাপ বহি
  তব নিশ্বাস আমার বক্ষে রহি রহি নিশ্বসে॥
         সারা হয়ে এলে দিন
  সন্ধ্যামেঘের মায়ার মহিমা নিঃশেষে হবে লীন।
  দীপ্তি তোমার তবে  শান্ত হইয়া রবে,
  তারায় তারায় নীরব মন্ত্রে ভরি দিবে শূন্য সে॥
    
২৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে 
ক্লান্তি-ভরা কোন্‌ বেদনার মায়া  স্বপ্নাভাসে ভাসে মনে-মনে॥
কৈশোরে যে সলাজ কানাকানি  খুঁজেছিল প্রথম প্রেমের বাণী
আজ কেন তাই তপ্ত হাওয়ায় হাওয়ায়  মর্মরিছে গহন বনে বনে॥
যে নৈরাশা গভীর অশ্রুজলে  ডুবেছিল বিস্মরণের তলে
আজ কেন সেই বনযূথীর বাসে  উচ্ছুসিল মধুর নিশ্বাসে,
সারাবেলা চাঁপার ছায়ায় ছায়ায়  গুঞ্জরিযা ওঠে ক্ষণে ক্ষণে॥
    
২৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     তপস্বিনী হে ধরণী,  ওই-যে তাপের বেলা আসে—
     তপের আসনখানি   প্রসারিল মৌন নীলাকাশে॥
        অন্তরে প্রাণের লীলা  হোক তব অন্তঃশীলা,
        যৌবনের পরিসর  শীর্ণ হোক হোমাগ্নিনিশ্বাসে॥
     যে তব বিচিত্রতান  উচ্ছসি উঠিত বহু গীতে
     এক হয়ে মিশে যাক  মৌনমন্ত্রে ধ্যানের শান্তিতে।
        সংযমে বাঁধুক লতা  কুসুমিত চঞ্চলতা,
        সাজুক লাবণ্যলক্ষ্মী  দৈন্যের ধুসর ধুলিবাসে॥                    
    
২৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    চক্ষে আমার তৃষ্ণা ওগো, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।
আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন, সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে॥
    ঝড় উঠেছে তপ্ত হাওয়ায়,  মনকে সুদূর শূন্যে ধাওয়ায়—
                 অবগুণ্ঠন যায় যে উড়ে॥
                 যে ফুল কানন করত আলো
                 কালো হয়ে সে শুকালো।
    ঝরনারে কে দিল বাধা—         নিষ্ঠুর পাষাণে বাঁধা
                 দুঃখের শিখরচূড়ে॥
    
২৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                 এসো শ্যামল সুন্দর,
          আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।
          বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে॥
          সে যে  ব্যথিত হৃদয় আছে বিছায়ে
                তমালকুঞ্জপথে সজল ছায়াতে,
                নয়নে জাগিছে করুণ রাগিণী॥
          বকুলমুকুল রেখেছে গাঁথিয়া,
          বাজিছে অঙ্গনে মিলনবাঁশরি।
                আনো সাথে তোমার মন্দিরা
                চঞ্চল নৃত্যের বাজিবে ছন্দে সে—
                বাজিবে কঙ্কণ, বাজিবে কিঙ্কিণী,
                ঝঙ্কারিবে মঞ্জীর রুণু রুণু॥
    
২৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
          ওই আসে ওই  অতি ভৈরব হরষে
          জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে
          ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা
          শ্যামগম্ভীর সরসা।
          গুরু গর্জনে নীল অরণ্য শিহরে,
          উতলা কলাপী কেকাকলরবে বিহরে—
          নিখিলচিত্তহরষা
          ঘনগৌরবে আসিছে মত্ত বরষা॥          কোথা তোরা অয়ি তরুণী পথিকললনা,
          জনপদবধূ তড়িতচকিতনয়না,
          মালতীমালিনী কোথা প্রিয়পরিচারিকা,
          কোথা তোরা অভিসারিকা।
          ঘনবনতলে এসো ঘননীলবসনা,
          ললিত নত্যে বাজুক স্বর্ণরসনা,
          আনো বীণা মনোহারিকা।
          কোথা বিরহিণী, কোথা তোরা অভিসারিকা॥          আনো মৃদঙ্গ মুরজ মুরলী মধুরা,
          বাজাও শঙ্খ, হুলুরব করো বধুরা—
          এসেছে বরষা, ওগো নব-অনুরাগিণী,
          ওগো প্রিয়সুখভাগিনী।
          কুঞ্জকুটিরে অয়ি ভাবাকুললোচনা,
          ভূর্জপাতায় নবগীত করো রচনা
          মেঘমল্লাররাগিণী।
          এসেছে বরষা, ওগো নব-অনুরাগিণী॥
         
          কেতকীকেশরে কেশপাশ করো সুরভি,
          ক্ষীণ কটিতটে গাঁথি লয়ে পরো করবী॥
          কদম্বরেণু বিছাইয়া দাও শয়নে,
          অঞ্জন আঁকো নয়নে।
          তালেতালে দুটি কঙ্কন কনকনিয়া
          ভবনশিখীরে নাচাও গণিয়া গণিয়া
          স্মিতবিকশিত বয়নে—
          কদম্বরেণু বিছাইয়া ফুলশয়নে॥          এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
          গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা॥
          দুলিছে পবনে সনসন বনবীথিকা,
          গীতময় তরুলতিকা।
          শতেক যুগের কবিদলে মিলি আকাশে
          ধ্বনিয়া তুলিছে মত্তমদির বাতাসে
          শতেক যুগের গীতিকা।
          শতশতগীতমুখরিত বনবীথিকা॥
    
২৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     ঝরঝর বরিষে বারিধারা।
     হায় পথবাসী, হায় গতিহীন,   হায় গৃহহারা॥
     ফিরে বায়ু হাহাস্বরে,  ডাকে কারে জনহীন অসীম প্রান্তরে—
     রজনী আঁধারা॥
     অধীরা যমুনা তরঙ্গ-আকূলা রে,   তিমিরদুকূলা রে।
     নিবিড় নীরদ গগনে  গরগর গরজে সঘনে,
     চঞ্চলচপলা চমকে—  নাহি শশীতারা॥
    
২৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     গহন ঘন ছাইল গগন ঘনাইয়া।
     স্তিমিত দশদিশি, স্তম্ভিত কানন,
     সব চরাচর আকুল— কী হবে কে জানে
     ঘোরা রজনী, দিকললনা ভয়বিভলা॥
     চমকে চমকে সহসা দিক উজলি
     চকিতে চকিতে মাতি ছুটিল বিজলি
     থরথর চরাচর পলকে ঝলকিয়া
     ঘোর তিমিরে ছায় গগন মেদিনী
     গুরুগুরু নীরদ গরজনে স্তব্ধ আঁধার ঘুমাইছে,
     সহসা উঠিল জেগে প্রচণ্ড সমীরন— কড়কড় বাজ॥
    
৩১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা,  নিশীথযামিনী রে।
     কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।
     উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত, ঘন ঘন গর্জিত মেহ।
     দমকত বিদ্যুত, পথতরু লুণ্ঠিত, থরহর কম্পিত দেহ
     ঘন ঘন রিম্‌‍ঝিম্‌ রিম্‌‍ঝিম্‌ রিম্‌‍ঝিম্‌ বরখত নীরদপুঞ্জ।
     শাল-পিয়ালে তাল-তমালে নিবিড়তিমিরময় কুঞ্জ।
     কহ রে সজনী, এ দুরুযোগে কুঞ্জে নিরদয় কান
     দারুণ বাঁশী কাহ বজায়ত সকরুণ রাধা নাম।
     মোতিম হারে বেশ বনা দে, সীঁথি লগা দে ভালে।
     উরহি বিলুণ্ঠিত লোল চিকুর মম বাঁধহ চম্পকমালে।
     গহন রয়নমে ন যাও, বালা, নওলকিশোরক পাশ।
     গরজে ঘন ঘন, বহু ডর পাওব, কহে ভানু তব দাস॥
    
৩২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে।
     আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে॥
       কাজের দিনে নানা কাজে  থাকি নানা লোকের মাঝে,
       আজ আমি যে বসে আছি তোমারি আশ্বাসে॥
     তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,
     কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা।
        দূরের পানে মেলে আঁখি  কেবল আমি চেয়ে থাকি,
        পরান আমার কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে॥
    
৩৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে।
    বাঁধন-হারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে॥
        একলা বসে ঘরের কোণে  কী ভাবি যে আপন-মনে,
        সজল হাওয়া যূথীর বনে  কী কথা যায় কয়ে॥
    হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে, খুঁজে না পাই কূল—
    সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তোলে ভিজে বনের ফুল।
        আঁধার রাতে প্রহরগুলি  কোন্‌ সুরে আজ ভরিয়ে তুলি,
        কোন্‌ ভুলে আজ সকল ভুলি  আছি আকুল হয়ে॥
    
৩৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    আজ বারি ঝরে ঝরঝর ভরা বাদরে,
    আকাশ-ভাঙা আকুল ধারা কোথাও না ধরে॥
      শালের বনে থেকে থেকে  ঝড় দোলা দেয় হেঁকে হেঁকে,
      জল ছুটে যায় এঁকে বেঁকে মাঠের ’পরে।
    আজ  মেঘের জটা উডিয়ে দিয়ে নৃত্য কে করে॥
    ওরে  বৃষ্টিতে মোর ছুটেছে মন, লুটেছে এই ঝড়ে—
      বুক ছাপিয়ে তরঙ্গ মোর কাহার পায়ে পড়ে।
    অন্তরে আজ কী কলরোল,  দ্বারে দ্বারে ভাঙল আগল—
    হৃদয়-মাঝে জাগল পাগল আজি ভাদরে।
    আজ  এমন ক’রে কে মেতেছে বাহিরে ঘরে॥
    
৩৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                  কাঁপিছে দেহলতা থরথর,
                  চোখের জলে আঁখি ভরভর॥
দোদুল তমালেরই বনছায়া তোমারি নীল বাসে নীলকায়া,
                  বাদল-নিশীথেরই ঝরঝর
                  তোমারই আঁখি-’পরে ভরভর॥
                  যেকথা ছিল তব মনেমনে
                  চমকে অধরের কোণেকোণে
নীরব হিয়া তব দিল ভরি ভরি   কী মায়া স্বপনে যে, মরি মরি
                  আঁধার কাননের মরমর
                  বাদল নিশীথের ঝরঝর॥
    
৩৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার     দিন ফুরাল ব্যাকুল বাদলসাঁঝে
          গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে॥
      বনের ছায়ায় জল ছলছল সুরে
      হৃদয় আমার কানায় কানায় পূরে।
      খনে খনে ওই গুরুগুরু তালে তালে
        গগনে গগনে গভীর মৃদঙ বাজে॥
কোন্‌   দূরের মানুষ যেন এল আজ কাছে,
        তিমির-আড়ালে নীরবে দাঁড়ায়ে আছে।
      বুকে দোলে তার বিরহব্যথার মালা
      গোপন-মিলন-অমৃতগন্ধ-ঢালা।
      মনে হয় তার চরণের ধ্বনি জানি —
        হার মানি তার অজানা জনের সাজে॥
    
৩৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাদল-মেঘে মাদল বাজে     গুরুগুরু গগন-মাঝে॥
      তারি গভীর রোলে     আমার হৃদয় দোলে,
        আপন সুরে আপনি ভোলে॥
কোথায় ছিল গহন প্রাণে      গোপন ব্যথা গোপন গানে—
      আজি সজল বায়ে       শ্যামল বনের ছায়ে
        ছড়িয়ে গেল সকলখানে গানে গানে॥
    
৩৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তিমির অবগুণ্ঠনে বদন তব ঢাকি
কে তুমি মম অঙ্গনে দাঁড়ালে একাকী॥
        আজি সঘন শর্বরী মেঘমগন তারা
        নদীর জলে ঝর্ঝরি ঝরিছে জলধারা,
           তমালবন মর্মরি পবন চলে হাঁকি॥
যে কথা মাম অন্তরে আনিছ তুমি টানি
জানি না কোন মন্তরে তাহারে দিব বাণী।
        রয়েছি বাঁধা বন্ধনে, ছিঁড়িব, যাব বাটে
        যেন এ বৃথা ত্রন্দনে এ নিশি নাহি কাটে।
            কঠিন বাধা-লঙ্ঘনে দিব না আমি ফাঁকি॥
    
৪০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আকাশতলে দলে দলে মেঘ যে ডেকে যায়
            ‘আ য়    আ য়   আ য়’॥
জামের বনে আমের বনে রব উঠেছে তাই—
            ‘যা ই     যা ই    যা ই’॥
উড়ে যাওয়ার সাধ জাগে তার পুলক-ভরা ডালে
             পাতায় পাতায়॥
নদীর ধারে বারে বারে মেঘ যে ডেকে যায়—
            ‘আ য়    আ য়   আ য়’॥
কাশের বনে ক্ষণে ক্ষণে রব উঠেছে তাই—
            ‘যা ই     যা ই    যা ই’॥
মেঘের গানে তরীগুলি তান মিলিয়ে চলে
             পাল-তোলা পাখায়॥
    
৪২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আষাঢ়, কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া।
মাঠের শেষে শ্যামল বেশে ক্ষণেক দাঁড়া॥
    জয়ধ্বজা ওই-যে তোমার গগন জুড়ে।
    পূব হতে কোন্‌ পশ্চিমেতে যায় রে উড়ে,
        গুরু গুরু ভেরী কারে দেয় যে সাড়া॥
নাচের নেশা লাগল তালের পাতায় পাতায়,
হাওয়ার দোলায় দোলায় শালের বনকে মাতায়।
    আকাশ হতে আকাশে কার ছুটোছুটি,
    বনে বনে মেঘের চায়ায় লুটোপুটি—
       ভরা নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে কে দেয় নাড়া॥
    
৪৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছায়া ঘনাইছে বনে বনে,   গগনে গগনে ডাকে দেয়া।
কবে নবঘন-বরিষনে   গোপনে গোপনে এলি কেয়া।
  পূরবে নীরব ইশারাতে  একদা নিদ্রাহীন রাতে
      হাওয়াতে কী পথে দিলি খেয়া—
           আষাঢ়ের খেয়ালের কোন্‌ খেয়া॥
যে মধু হৃদয়ে ছিল মাখা  কাঁটাতে কী ভয়ে দিলি ঢাকা।
  বুঝি এলি যার অভিসারে  মনে মনে দেখা হল তারে
       আড়ালে আড়ালে দেয়া-নেয়া—
          আপনায় লুকায়ে দেয়া-নেয়া॥
    
৪৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  এই শ্রাবণ-বেলা বাদল-ঝরা   যূথীবনের গন্ধে ভরা॥
  কোন্‌  ভোলা দিনের বিরহিণী,  যেন তারে চিনি চিনি—
ঘন বনের কোণে কোণে ফেরে ছায়ার-ঘোমটা-পরা॥
কেন বিজন বাটের পানে  তাকিয়ে আছি কে তা জানে।
    হঠাৎ কখন অজানা সে  আসবে আমার দ্বারের পাশে,
বাদল-সাঁঝের আঁধার-মাঝে   গান গাবে প্রাণ-পাগল-করা॥
    
৪৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শ্রাবণবরিষন পার হয়ে   কী বাণী আসে ওই রয়ে রয়ে॥
  গোপন কেতকীর পরিমলে,   সিক্ত বকুলের বনতলে,
  দূরের আঁখিজল বয়ে বয়ে   কী বাণী আসে ওই রয়ে রয়ে॥
কবির হিয়াতলে ঘুরে ঘুরে   আঁচল ভরে লয় সুরে সুরে।
  বিজনে বিরহীর কানে কানে   সজল মল্লার গানে গানে 
       কাহার নামখানি কয়ে কয়ে
            কী বাণী আসে ওই রয়ে রয়ে॥
    
৪৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার,
দিনের আকাশ মেঘে অন্ধকার— হায় রে॥
    মনে ছিল আসবে বুঝি,   আমায় সে কি পায় নি খুঁজি—
    না-বলা তার কথাখানি জাগায় হাহাকার॥
সজল হাওয়ায় বারে বারে
সারা আকাশ ডাকে তারে।
    বাদল-দিনের দীর্ঘশ্বাসে   জানায় আমায় ফিরবে না সে—
    বুক ভরে সে নিয়ে গেল বিফল অভিসার॥
    
৪৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গহন রাতে শ্রাবণধারা পড়িছে ঝরে,
   কেন গো মিছে জাগাবে ওরে॥
এখনো দুটি আঁখির কোণে যায় যে দেখা
        জলের রেখা,
  না-বলা বাণী রয়েছে যেন অধর ভরে॥
নাহয় যেয়ো গুঞ্জরিয়া বীণার তারে
  মনের কথা শয়নদ্বারে।
নাহয় রেখো মালতীকলি শিথিল কেশে
       নীরবে এসে,
নাহয় রাখী পরায়ে যেয়ো ফুলের ডোরে।
  কেন গো মিছে জাগাবে ওরে॥
    
৪৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        যেতে দাও   যেতে দাও গেল যারা।
             তুমি যেয়ো না,   তুমি যেও না,
     আমার  বাদলের গান হয় নি সারা॥
কুটিরে কুটিরে বন্ধ দ্বার,   নিভৃত রজনী অন্ধকার,
  বনের অঞ্চল কাঁপে চঞ্চল—আধীর সমীর তন্দ্রাহারা॥
দীপ নিবেছে নিবুক নাকো,   আঁধারে তব পরশ রাখো।
বাজুক কাঁকন তোমার হাতে   আমার গানের তালের সাথে,
  যেমন নদীর ছলোছলো জলে   ঝরে ঝরোঝরো শ্রাবণধারা॥
    
৪৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        ভেবেছিলেম আসবে ফিরে,
তাই    ফাগুনশেষে দিলেম বিদায়।
তুমি    গেলে ভাসি নয়ননীরে
এখন   শ্রাবণদিনে মরি দ্বিধায়॥
এখন   বাদল-সাঁঝের অন্ধকারে   আপনি কাঁদাই আপনারে,
একা   ঝরোঝরো বারিধারে   ভাবি  কী ডাকে ফিরাব তোমায়॥
        যখন থাকি আঁখির কাছে
        তখন দেখি ভিতর বাহির সব ভরে আছে।
সেই    ভরা দিনের ভরসাতে   চাই বিরহের ভয় ঘোচাতে,
তবু     তোমা-হারা বিজন রাতে
কেবল   হারাই হারাই বাজে হিয়ায়॥
      
    
৫০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজি ওই   আকাশ-’পরে সুধায় ভরে আষাঢ়-মেঘের ফাঁক।
    হৃদয়-মাঝে মধুর বাজে কী উৎসবের শাঁখ॥
একি হাসির বাঁশির তান,   একি    চোখের জলের গান—
    পাই নে দিশে কে জানি সে দিল আমায় ডাক॥
আমায় নিরুদ্দেশের পানে  কেমন করে টানে  এমন করুণ গানে।
  ওই  পথের পারের আলো  আমার  লাগল চোখে ভালো,
           গগনপারে দেখি তারে সুদূর নির্বাক্॥
    
৫১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ও আষাঢ়ের পূর্ণিমা আমার,   আজি রইলে আড়ালে—
         স্বপনের আবরণে লুকিয়ে দাঁড়ালে॥
আপনারই মনে জানিনা একেলা   হৃদয়-আঙিনায় করিছ কী খেলা—
তুমি আপনায় খুঁজিয়া ফেরো কি   তুমি আপনায় হারালে॥
        একি    মনে রাখা     একি    ভুলে যাওয়া।
        একি    স্রোতে ভাসা,     একি    কূলে যাওয়া।
কভুবা নয়নে কভুবা পরানে  কর লুকোচুরি কেন যে কে জানে।
কভুবা ছায়ায় কভুবা আলোয়   কোন্‌ দোলায় যে নাড়ালে॥
    
৫২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        শ্যামল ছায়া, নাইবা গেলে
        শেষ বরষার ধারা ঢেলে॥
সময় যদি ফুরিয়ে থাকে—  হেসে বিদায় করো তাকে,
এবার নাহয় কাটুক বেলা অসময়ের খেলা খেলে॥
        মলিন, তোমার মিলাবে লাজ—
        শরৎ এসে পরাবে সাজ।
নবীন রবি উঠবে হাসি,   বাজাবে মেঘ সোনার বাঁশি—
কালোয় আলোয় যুগলরূপে শূন্যে দেবে মিলন মেলে॥
    
৫৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    আহবান আসিল মহোৎসবে
    অম্বরে গম্ভীর ভেরিরবে॥
পূর্ববায়ু চলে ডেকে   শ্যামলের অভিষেকে—
    অরণ্যে অরণ্যে নৃত্য হবে॥
    নির্ঝরকল্লোল-কলকলে
    ধরণীর আনন্দ উচ্ছলে।
শ্রাবণের বীণাপাণি   মিলালো বর্ষণবাণী
    কদম্বের পল্লবে পল্লবে॥
    
৫৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                কোন্‌ পুরাতন প্রাণের টানে
                ছুটেছে মন মাতির পানে॥
চোখ ডুবে যায় নবীন ঘাসে,   ভাবনা ভাসে পুব-বাতাসে—
মল্লার গান প্লাবন জাগায় মনের মধ্যে শ্রাবণ-গানে॥
                লাগল যে দোল বনের মাঝে
                অঙ্গে সে মোর দেয় দোলা যে।
যে বাণী ওই ধানের ক্ষেতে   আকুল হল অঙ্কুরেতে
          আজ এই মেঘের শ্যামল মায়ায়
                 সেই বাণী মোর সুরে আনে॥
    
৫৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীল-   অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্‌বৃত অম্বর    হে গম্ভীর!
        বনলক্ষ্মীর কম্পিত কায়, চঞ্চল অন্তর—
        ঝঙ্কৃত তার ঝিল্লির মঞ্জীর   হে গম্ভীর॥
        বর্ষণগীত হল মুখরিত মেঘমন্দ্রিত ছন্দে,
        কদম্ববন গভীর মগন আনন্দঘন গন্ধে—
        নন্দিত তব উৎসবমন্দির    হে গম্ভীর॥
        দহনশয়নে তপ্ত ধরণী পড়েছিল পিপাসার্তা,
        পাঠালে তাহারে ইন্দ্রলোকের অমৃতবারির বার্তা।
        মাটির কঠিন বাধা হল ক্ষীণ, দিকে দিকে হল দীর্ণ—
        নব-অঙ্কুর-জয়পতাকায় ধরাতল সমাকীর্ণ—
        ছিন্ন হয়েছে বন্ধন বন্দীর    হে গম্ভীর॥
    
৫৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
         আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে
         দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে,
         ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে॥
ধরিত্রী তার অঙ্গনেতে    নাচের তালে ওঠেন মেতে,
         চঞ্চল তাঁর অঞ্চল যায় লুটে॥
         প্রথম যুগের বচন শুনি মনে
         নবশ্যামল প্রাণের নিকেতনে।
পুব-হাওয়া ধায় আকাশতলে,   তার সাথে মোর ভাবনা চলে
         কালহারা কোন্‌ কালের পানে ছুটে॥
    
৫৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        পথিক মেঘের দল জোটে ওই শ্রাবণগগন-অঙ্গনে।
শোন্‌  শোন্‌ রে   মন রে আমার,   উধাও হয়ে নিরুদ্দেশের সঙ্গ নে॥
     দিক্‌-হারানো দুঃসাহসে   সকল বাঁধন পড়ুক খসে,
     কিসের বাধা ঘরের কোণের শাসনসীমা-লঙ্ঘনে॥
         বেদনা তোর বিজুলিশিখা জ্বলুক অন্তরে।
         সর্বনাশের করিস সাধন বজ্রমন্তরে।
     অজানাতে করবি গাহন, ঝড় সে পথের হবে বাহন—
     শেষ করে দিস আপনারে তুই প্রলয় রাতের ত্রন্দনে॥
    
৫৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা।
তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা॥
তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে,   ফসল ফলে—
মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা॥
মরোমরো পাতায় পাতায়   ঝরোঝরো বারির রবে
গুরুগুরু মেঘের মাদল বাজে তোমার কী উৎসবে।
সবুজ   সুধার ধারায়   প্রাণ এনে দাও তপ্ত ধরায়,
বামে রাখ ভয়ঙ্করী বন্যা মরণ-ঢালা॥

    
৫৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওরে   ঝড় নেমে আয়, আয় রে আমার শুকনো পাতার ডালে
        এই বরষায় নবশ্যামের আগমনের কালে॥
        যা উদাসীন, যা প্রাণহীন, যা আনন্দহারা,
        চরম রাতের অশ্রুধারায় আজ হয়ে যাক সারা—
        যাবার যাহা যাক সে চলে রুদ্র নাচের তালে॥  
        আসন আমায় পাততে হবে রিক্ত প্রাণের ঘরে,
        নবীন বসন পরতে হবে সিক্ত বুকের ’পরে।
        নদীর জলে বান ডেকেছে, কূল গেল তার ভেসে,
        যূথীবনের গন্ধবাণী ছুটল নিরুদ্দেশে—
        পরান আমার জাগল বুঝি মরণ-অন্তরালে॥
    
৬০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই শ্রাবণের বুকের ভিতর আগুন আছে।
সেই আগুনের   কালোরূপ যে   আমার চোখের ’পরে নাচে॥
ও তার   শিখার জটা ছড়িয়ে পড়ে   দিক হতে ওই দিগন্তরে,
তার   কালো আভার কাঁপন দেখো তালবনের ওই গাছে গাছে॥
বাদল-হাওয়া পাগল হল সেই আগুনের হুহুঙ্কারে।
দুন্দুভি তার বাজিয়ে বেড়ায় মাঠ হতে কোন্‌ মাঠের পারে।
ওরে,   সেই আগুনের পুলক ফুতে   কদম্ববন রঙিয়ে উঠে,
সেই আগুনের বেগ লাগে আজ আমার গানের পাখার পাছে॥
    
৬১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  মেঘের   কোলে কোলে যায় রে চলে বকের পাঁতি।
ওরা   ঘর-ছাড়া মোর মনের কথা যায় বুঝি ওই গাঁথি গাঁথি॥
     সুদূরের   বীণার স্বরে  কে ওদের  হৃদয় হরে
     দুরাশার   দুঃসাহসে উদাস করে—
সে কোন্‌  উধাও হাওয়ার পাগলামিতে পাখা ওদের ওঠে মাতি॥
ওদের ঘুম ছুটেছে, ভয় টুটেছে একেবারে,
অলক্ষ্যেতে লক্ষ ওদের— পিছন-পানে তাকায় না রে।
     যে বাসা  ছিল জানা   সে ওদের  দিল হানা,
     না-জানার  পথে ওদের নাই রে মানা—
ওরা   দিনের শেষে দেখেছে কোন্‌ মনোহরণ আঁধার রাতি॥
    
৬২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উতল-ধারা বাদল ঝরে।  সকল বেলা একা ঘরে॥
  সজল হাওয়া বহে বেগে,  পাগল নদী ওঠে জেগে,
  আকাশ ঘেরে কাজল মেঘে,  তমালবনে আঁধার করে॥
ওগো বঁধু দিনের শেষে  এলে তুমি কেমন বেশে—
আঁচল দিয়ে শুকাব জল,  মুছাব পা আকুল কেশে।
  নিবিড় হবে তিমির-রাতি,  জ্বেলে দেব প্রেমের বাতি,
  পরানখানি দেব পাতি— চরণ রেখো তাহার ’পরে।
ভুলে গিয়ে জীবন মরণ  লব তোমায় ক’রে বরণ—
করিব জয় শরম-ত্রাসে,  দাঁড়াব আজ তোমার পাশে—
  বাঁধন বাধা যাবে জ্ব’লে,   সুখ দুঃখ দেব দ’লে,
  ঝড়ের রাতে তোমার সাথে  বাহির হব অভয়ভরে॥
উতল-ধারা বাদল ঝরে,  দুয়ার খুলে এলে ঘরে।
  চোখে আমার ঝলক লাগে,  সকল মনে পুলক জাগে,
চাহিতে চাই মুখের বাগে— নয়ন মেলে কাঁপি ডরে॥
    
৬৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    ওই-যে ঝড়ের মেঘের কোলে
বৃষ্টি আসে মুক্তকেশে আঁচলখানি দোলে॥
ওরই গানের তালে তালে  আমে জামে শিরীষ শালে
      নাচন লাগে পাতায় পাতায় আকুল কল্লোলে॥
          আমার    দুই আঁখি ওই সুরে
      যায় হারিয়ে সজল ধারয়  ওই ছায়াময় দূরে।
ভিজে হাওয়ায় থেকে থেকে  কোন্‌ সাথি মোর যায় যে ডেকে,
      একলা দিনের বুকের ভিতর ব্যথার তুফান তোলে॥
    
৬৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    কখন  বাদল-ছোঁওয়া লেগে
    মাঠে মাঠে ঢাকে মাটি সবুজ মেঘে মেঘে॥
    ওই   ঘাসের ঘনঘোরে
ধরণীতল হল শীতল চিকন আভায় ভ’রে—
ওরা  হঠাৎ-গাওয়া গানের মতো এলো প্রাণের বেগে॥
ওরা যে এই প্রাণের রণে মরুজয়ের সেনা,
ওদের সাথে আমার প্রাণের প্রথম যুগের চেনা—
     তাই   এমন গভীর স্বরে
     আমারি আঁখি নিল ডাকি ওদের খেলঘরে—
ওদের   দোল দেখে আজ প্রাণে আমার দোলা ওঠে জেগে॥
    
৬৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ  নবীন মেঘের সুর লেগেছে আমার মনে।
আমার  ভাবনা যত উতল হল অকারণে॥
কেমন ক’রে যায় যে ডেকে,  বাহির করে ঘরের থেকে,
   ছায়াতে চোখ ফেলে ছেয়ে ক্ষণে ক্ষণে॥
   বাঁধনহারা জলধারার কলরোলে
   আমারে কোন্‌ পথের বাণী যায় যে ব’লে।
সে পথ গেছে নিরুদ্দেশে  মানসলোকে গানের শেষে
   চিরদিনের বিরহিণীর কুঞ্জবনে॥
    
৬৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   আজ আকাশের মনের কথা ঝরোঝরো বাজে
    সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে॥
দিঘির কালো জলের ’পরে  মেঘের ছায়া ঘনিয়ে ধরে,
   বাতাস বহে যুগান্তরের প্রাচীন বেদনা যে
    সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে॥
        আঁধার বাতায়নে
একলা আমার কানাকানি ওই আকাশের সনে।
ম্লানস্মৃতির বাণী যত    পল্লবমর্মরের মতো
   সজল সুরে ওঠে জেগে ঝিল্লীমুখর সাঁঝে
     সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে॥
        
    
৬৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        এই   সকাল বেলার বাদল-আঁধারে
        আজি  বনের বীণায় কী সুর বাঁধা রে॥
ঝরো ঝরো বৃষ্টিকলরোলে  তালের পাতা মুখর ক’রে তোলে  রে,
        উতল হাওয়া বেণুশাখায় লাগায় ধাঁদা রে॥
        ছায়ার  তলে তলে জলের ধারা ওই
        হেরো  দলে দলে নাচে তাথৈ থৈ— তাথৈ থৈ।
মন যে আমার পথ-হারানো সুরে  সকল আকাশ বেড়ায় ঘুরে ঘুরে  রে,
        শোনে যেন কোন্‌ ব্যাকুলের করুণ কাঁদা রে॥
    
৬৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পুব-সাগরের পার হতে কোন্‌ এল পরবাসী—
শূন্যে বাজায় ঘন ঘন  হাওয়ায় হাওয়ায় সন সন
    সাপ খেলাবার বাঁশি॥
সহসা তাই কোথা হতে  কুলু কুলু কলস্রোতে
দিকে দিকে জলের ধারা ছুটেছে উল্লাসী॥
আজ দিগন্তে ঘন ঘন গভীর গুরু গুরু  ডমরুরব হয়েছে ওই শুরু।
    তাই শুনে আজ গগনতলে  পলে পলে দলে দলে
        অগ্নিবরন নাগ নাগিনী ছুটেছে উদাসী॥
    
৬৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      আজি  বর্ষারাতের শেষে
সজল মেঘের কোমল কালোয় অরুণ আলো মেশে॥
বেণুবনের মাথায় মাথায়   রঙ লেগেছে পাতায় পাতায়,
রঙের ধারায় হৃদয় হারায়,   কোথা যে যায ভেসে॥
         এই ঘাসের ঝিলিমিলি,
তার সাথে মোর প্রাণের কাঁপন এক তালে যায় মিলি।
মাটির প্রেমে আলোর রাগে  রক্তে আমার পুলক লাগে—
বনের সাথে মন যে মাতে,  ওঠে আকুল হেসে॥                         
    
৭০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  শ্রাবণমেঘের আধেক দুয়ার ওই খোলা,
  আড়াল থেকে দেয় দেখা কোন্‌ পথ-ভোলা॥
ওই-যে পূরব-গগন জুড়ে  উত্তরী তার যায় রে উড়ে,
  সজল হাওয়ার হিন্দোলাতে দেয় দোলা॥
  লুকাবে কি প্রকাশ পাবে কেই জানে—
  আকাশে কি ধরায় বাসা কোন্‌খানে।
নানা বেশে ক্ষণে ক্ষণে  ওই তো আমার লাগায় মনে
  পরশখানি নানা-সুরের-ঢেউ-তোলা॥
    
৭১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বহু যুগের ও পার হতে আষাঢ় এল আমার মনে,
কোন্‌ সে কবির ছন্দ বাজে ঝরো ঝরো বরিষনে॥
যে মিলনের মালাগুলি  ধুলায় মিশে হল ধূলি
গন্ধ তারি ভেসে আসে আজি সজল সমীরণে॥
সে দিন এমনি মেঘের ঘটা রেবানদীর তীরে,
এমনি বারি ঝরেছিল শ্যামলশৈলশিরে।
মালবিকা অনিমিখে   চেয়ে ছিল পথের দিকে,
সেই চাহনি  এল ভেসে কালো মেঘের ছায়ার সনে॥
    
৭২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
       বাদল-বাউল বাজায় রে একতারা—
    সারা  বেলা ধ’রে ঝরোঝরো ঝরো ধারা॥
জামের বনে ধানের ক্ষেতে   আপন তানে আপনি মেতে
           নেচে নেচে হল সারা॥
    ঘন জটার ঘটা ঘনায় আঁধার আকাশ-মাঝে,
    পাতায় পাতায় টুপুর টুপুর নূপুর মধুর বাজে।
ঘর-ছাড়ানো আকুল সুরে    উদাস হয়ে বেড়ায় ঘুরে
            পুবে হাওয়া গৃহহারা॥
    
৭৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একি  গভীর বাণী এল  ঘন  মেঘের আড়াল ধ’রে
          সকল  আকাশ আকুল ক’রে॥
সেই  বাণীর পরশ লাগে,   নবীন  প্রাণের বাণী জাগে,
হঠাৎ দিকে দিগন্তরে  ধরার  হৃদয় ওঠে ভরে॥
    সে কে বাঁশি বাজিয়েছিল কবে প্রথম সুরে তালে,
    প্রাণেরে ডাক দিয়েছিল সুদুর আঁধার আদিকালে।
তার  বাঁশির ধ্বনিখানি আজ  আষাঢ় দিল আনি,
সেই  অগোচরের তরে  আমার  হৃদয় নিল হ’রে॥
    
৭৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     আজি  হৃদয় আমার যায় যে ভেসে
     যার   পায় নি দেখা তার উদ্দেশে॥
বাঁধন ভোলে, হাওয়ায় দোলে,  যায় সে বাদল-মেঘের কোলে  রে
           কোন্‌-সে অসম্ভবের দেশে॥
           সেথায় বিজন সাগরকূলে
           শ্রাবণ ঘনায় শৈলমূলে।
রাজার পুরে তমালগাছে  নূপুর শুনে ময়ূর নাচে  রে
        সুদূর তেপান্তরের শেষে॥
    
৭৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
           ভোর হল যেই শ্রাবণশর্বরী
        তোমার বেড়ায় উঠল ফুটে হেনার মঞ্জরী॥
        গন্ধ তারি রহি রহি   বাদল-বাতাস আনে বহি,
        আমার মনের কোণে কোণে বেড়ায় সঞ্চরি॥
        বেড়া দিলে কবে তুমি তোমার ফুলবাগানে—
        আড়াল ক’রে রেখেছিলে আমার বনের পানে।
        কখন গোপন অন্ধকারে   বর্ষারাতের অশ্রুধারে
        তোমার আড়াল মধুর হয়ে ডাকে মর্মরি॥
    
৭৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        বৃষ্টিশেষের হাওয়া কিসের খোঁজে  বইছে ধীরে ধীরে
        গুঞ্জরিয়া কেন বেড়ায় ও যে  বুকের শিরে শিরে॥
অলখ তারে বাঁধা অচিন বীণা  ধরার বক্ষে রহে নিত্য লীনা— এই হাওয়া
        কত যুগের কত মনের কথা  বাজায় ফিরে ফিরে॥
        ঋতুর পরে ঋতু ফিরে আসে  বসুন্ধরার কূলে
        চিহ্ন পড়ে বনের ঘাসে ঘাসে  ফুলের পরে ফুলে।
গানের পরে গানে তারি সাথে  কত সুরের কত যে হার গাঁথে— এই হাওয়া
        ধরার কণ্ঠ বাণীর বরণমালায় সাজায় ঘিরে ঘিরে॥
    
৭৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        বাদল-ধারা হল সারা, বাজে বিদায়-সুর।
        গানের পালা শেষ ক’রে দে রে, যাবি অনেক দূর॥
        ছাড়ল খেয়া ও পার হতে  ভাদ্রদিনের ভরা স্রোতে  রে,
        দুলছে তরী নদীর পথে তরঙ্গবন্ধুর॥
        কদমকেশর ঢেকেছে আজ বনতলের ধূলি,
        মৌমাছিরা কেয়াবনের পথ গিয়েছে ভুলি।
        অরণ্যে আজ স্তব্ধ হাওয়া,  আকাশ আজি শিশির-ছাওয়া  রে
                  আলোতে আজ স্মৃতির আভাস বৃষ্টির বিন্দুর॥
    
৭৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ঝরো ঝরো ঝরো ভাদরবাদর,    বিরহকাতর শর্বরী।
ফিরিছে এ কোন্‌ অসীম রোদন    কানন কানন মর্মরি॥
আমার প্রাণের রাগিণী আজি এ    গগনে গগনে উঠিছে বাজিয়ে।
মোর  হৃদয় একি রে ব্যাপিল তিমিরে    সমীরে সমীরে সঞ্চরি॥
    
৭৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে,   এসো করো স্নান নবধারাজলে॥
দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ,   পরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ—
কাজলনয়নে, যূথীমালা গলে,   এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে॥
আজি ক্ষণে ক্ষণে হাসিখানি, সখী,   অধরে নয়নে উঠুক চমকি।
মল্লারগানে তব মধুস্বরে   দিক্‌ বাণী আনি বনমর্মরে।
ঘনবরিষনে জলকলকলে  এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে॥
    
৮০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     কোথা যে উধাও হল মোর প্রাণ উদাসী
            আজি ভরা বাদরে॥
        ঘন ঘন গুরু গুরু গরজিছে,
     ঝরো ঝরো নামে দিকে দিগন্তে জলধারা—
     মন ছুটে শূন্যে শূন্যে অনন্তে অশান্ত বাতাসে॥
    
৮১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে   কী এনেছিস বল্‌—
হাসির কানায় কানায় ভরা   নয়নের জল॥
বাদল-হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে যূথীবনের বেদন আসে—
ফুল-ফোটানোর খেলায় কেন ফুল-ঝরানোর ছল।
         ও তুই     কী এনেছিস বল্‌॥
ওগো,   কী আবেশ হেরি চাঁদের চোখে,
         ফেরে সে কোন্‌ স্বপন-লোকে।
মন বসে রয় পথের ধারে,   জানে না সে পাবে কারে—
আসা-যাওয়ার আভাস ভাসে বাতাসে চঞ্চল।
           ও তুই   কী এনেছিস বল্‌॥
    
৮২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পূব-হাওয়াতে দেয় দোলা আজ   মরি মরি।
হৃদয়নদীর কূলে কূলে জাগে লহরী॥
পথ চেয়ে তাই একলা ঘাতে   বিনা কাজে সময় কাটে,
পাল তুলে ওই আসে তোমার সুরেরই তরী॥
ব্যথা আমার কূল মানে না,   বাধা মানে না।
পরান আমার ঘুম জানেনা,  জাগা জানে না।
মিলবে যে আজ অকূল-পানে  তোমার গানে আমার গানে,
ভেসে যাবে রসের বানে   আজ বিভাবরী॥
    
৮৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অশ্রুভরা বেদনা দিকে দিকে জাগে।
আজি   শ্যামল মেঘের মাঝে   বাজে কার কামনা॥
   চলিছে ছুটিয়া অশান্ত বায়,
   ত্রন্দন কার তার গানে ধ্বনিছে—
   করে কে সে বিরহী বিফল সাধনা॥
    
৮৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে
বাদল বাতাস মাতে মালতীর গন্ধে॥
উৎসবসভা-মাঝে   শ্রাবণের বীণা বাজে,
শিহরে শ্যামল মাটি প্রাণের আনন্দে॥
দুই কূল আকুলিয়া অধীর বিভঙ্গে
নাচন উঠিল জেগে নদীর তরঙ্গে।
কাঁপিছে বনের হিয়া   বরষনে মুখরিয়া,
বিজলি ঝলিয়া উঠে নবঘনমন্দ্রে॥
    
৮৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বন্ধু, রহো রহো সাথে
আজি এ সঘন শ্রাবণপ্রাতে।
ছিলে কি মোর স্বপনে   সাথিহারা রাতে॥
বন্ধু, বেলা বৃথা যায় রে
আজি এ বাদলে   আকুল হাওয়ায় রে—
কথা কও মোর হৃদয়ে,   হাত রাখো হাতে॥
    
৮৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একলা বসে বাদল-শেষে শুনি কত কী—
‘এবার আমার গেল বেলা’ বলে কেতকী॥
বৃষ্টি-সারা মেঘ যে তারে   ডেকে গেল আকাশপারে,
তাই তো সে যে উদাস হল— নইলে যেত কি॥
ছিল সে যে একটি ধারে বনের কিনারায়,
উঠত কেঁপে তড়িৎ-আলোর চকিত ইশারায়।
শ্রাবণঘন অন্ধকারে   গন্ধ যেত অভিসারে—
সন্ধ্যাতারা আড়াল থেকে খবর পেত কি॥
    
৮৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        শ্যামল শোভন শ্রাবণ, তুমি নাই বা গেলে
        সজল বিলোল আঁচল মেলে॥
        পুব হাওয়া কয়,  ‘ওর যে সময় গেল চলে।’
        শরৎ বলে, ‘ভয় কী সময় গেল বলে,
     বিনা কাজে আকাশ-মাঝে কাটবে বেলা অসময়ের খেলা খেলে।’
         কালো মেঘের আর কি আছে দিন
             ও যে হল সাথিহীন।
      পূব-হাওয়া কয়, ‘কালোর এবার যাওয়াই ভালো।’
          শরৎ বলে, ‘মিলবে যুগল কালোয় আলো,
     সাজবে বাদল সোনার সাজে আকাশ-মাঝে কালিমা ওর ঘুচিয়ে ফেলে।’
    
৮৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
       নমো, নমো, নমো করুণাঘন, নমো হে।
           নয়ন স্নিগ্ধ অমৃতাঞ্জনপরশে,
           জীবন পূর্ণ সুধারসবরষে,
তব দর্শনধনসার্থক মন হে, অকৃপণবর্ষণ করুণাঘন হে॥
    
৮৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        তপের তাপের বাঁধন কাটুক রসের বর্ষণে।
        হৃদয় আমার, শ্যামল-বঁধুর করুণ স্পর্শ নে॥
অঝোর-ঝরণ শ্রাবণজলে       তিমিরমেদুর বনাঞ্চলে
        ফুটুক সোনার কদম্বফুল নিবিড় হর্ষণে॥
        ভরুক গগন, ভরুক কানন, ভরুক নিখিল ধরা,
        দেখুক ভুবন মিলনস্বপন মধুর-বেদনা-ভরা।
পরান-ভরানো ঘনছায়াজাল   বাহির-আকাশ করুক আড়াল—
        নয়ন ভুলুক, বিজুলি ঝলুক পরম দর্শনে॥
    
৯০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        ওই কি এলে আকাশপারে দিক্‌-ললনার প্রিয়—
        চিত্তে আমার লাগল তোমার ছায়ার উত্তরীয়॥
        মেঘের মাঝে মৃদঙ তোমার বাজিয়ে দিলে কি ও,
        ওই তালেতে মাতিয়ে আমায় নাচিয়ে দিয়ো দিয়ো॥
    
৯১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
       গগনে গগনে আপনার মনে কী খেলা তব।
       তুমি কত বেশে নিমেষে নিমেষে নিতুই নব॥
জটার গভীরে লুকালে রবিরে,   ছায়াপটে আঁক এ কোন্‌ ছবি রে।
       মেঘমল্লারে কী বল আমারে কেমনে কব॥
        বৈশাখী ঝড়ে সে দিনের সেই অট্টহাসি
       গুরুগুরু সুরে কোন্‌ দূরে দূরে যায় যে ভাসি।
সে সোনার আলো শ্যামলে মিশালো— শ্বেত উত্তরী আজ কেন কালো॥
       লুকালে ছায়ায় মেঘের মায়ায় কী বৈভব॥
    
৯২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শ্রাবণ, তুমি বাতাসে কার আভাস পেলে।
পথে তারি সকল বারি দিলে ঢেলে।
কেয়া কাঁদে, ‘যা য় যা য় যা য়।’
কদম ঝরে, ‘হা য় হা য় হা য়।’
পুব-হাওয়া কয়, ‘ওর তো সময় নাই বাকি আর।’
শরৎ বলে, ‘যাক-না সময়, ভয় কিবা তার—
কাটবে বেলা আকাশ-মাঝে   বিনা কাজে   অসময়ের খেলা খেলে।’
কালো মেঘের আর কি আছে দিন,   ও যে  হল সাথিহীন।
পুব-হাওয়া কয়, ‘কালোর এবার যাওয়াই ভালো।’
শরৎ বলে, ‘মিলিয়ে দেব কালোয় আলো—
সাজবে বাদল আকাশ-মাঝে সোনার সাজে কালিমা ওর মুছে ফেলে।’
    
৯৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
       কেন     পান্থ, এ চঞ্চলতা।
       কোন্‌     শূন্য হতে এল কার বারতা॥
নয়ন কিসের প্রতীক্ষা-রত    বিদায়বিষাদে উদাস-মতো—
ঘনকুন্তলভার ললাটে নত,    ক্লান্ত তড়িতবধূ তন্দ্রাগতা॥
কেশরকীর্ণ  কদম্ববনে  মর্মরমুখরিত মৃদুপবনে
বর্ষনহর্ষ-ভরা  ধরণীর   বিরহবিশঙ্কিত করুণ কথা।
ধৈর্য মানো ওগো, ধৈর্য মানো!  বরমাল্য গলে তব হয় নি ম্লান—
               আজও হয় নি ম্লান—
ফুলগন্ধনিবেদনবেদনসুন্দর   মালতী তব চরণে প্রণতা॥
    
৯৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজি   শ্রাবণঘনগহন মোহে     গোপন তব চরণ ফেলে
        নিশার মতো নীরব ওহে,      সবার দিঠি এড়ায়ে এলে॥
        প্রভাত আজি মুদেছে আঁখি,   বাতাস বৃথা যেতেছে ডাকি,
        নিলাজ নীল আকাশ ঢাকি    নিবিড় মেঘ কে দিল মেলে॥
        কূজনহীন কাননভূমি,   দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে—
        একেলা কোন্‌ পথিক তুমি   পথিকহীন পথের ’পরে।
        হে একা সখা, হে প্রিয়তম,   রয়েছে খোলা এ ঘর মম—
        সমুখ দিয়ে স্বপন-সম   যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে॥
    
৯৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজি      ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
         পরানসখা বন্ধু হে আমার॥
      আকাশ কাঁদে হতাশ-সম,   নাই যে ঘুম নয়নে মম—
      দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম, চাই যে বারে বার॥
          বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,
          তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।
      সুদূর কোন্‌ নদীর পারে    গহন কোন্‌ বনের ধারে
      গভীর কোন্‌ অন্ধকারে হতেছ তুমি পার॥
    
৯৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চলে    ছলোছলো নদীধারা   নিবিড় ছায়ায়   কিনারায় কিনারায়।
       ওকে  মেঘের ডাকে ডাকল সুদূরে,  ‘আ য়  আ য়  আয়।’
       কূলে   প্রফুল্ল বকুলবন   ওরে   করিছে আবাহন—
        কোথা   দূরে বেণুবন গায়,   ‘আ য়  আ য়  আয়।’
        তীরে তীরে, সখী,  ওই-যে উঠে নবীন ধন্য পুলকি।
       কাশের বনে বনে  দুলিছে ক্ষণে ক্ষণে—
       গাহিছে সজল বায়,   ‘আ য়  আ য়  আয়।’
    
৯৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      আমারে যদি জাগালে আজি নাথ,
      ফিরো না তবে ফিরোনা, করো করুণ আঁখিপাত॥
নিবিড় বনশাখার ’পরে  আষাঢ়মেঘে বৃষ্টি ঝরে,
বাদল-ভরা আলস-ভরে  ঘুমায়ে আছে রাত॥
      বিরামহীন বিজুলিঘাতে নিদ্রাহারা প্রাণ
      বরষাজলধারার সাথে গাহিতে চাহে গান।
হৃদয় মোর চোখের জলে   বাহির হল তিমিরতলে,
আকাশ খোঁজে ব্যাকুল বলে  বাড়ায়ে দুই হাত॥
    
৯৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
          আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে,
          আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে॥
এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি  পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি
          নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে॥
   রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের ’পরে  নব তৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে।
‘এসেছে এসেছে’ এই কথা বলে প্রাণ,  ‘এসেছে এসেছে’ উঠিতেছে এই গান—
               নয়নে এসেছে, হৃদয়ে এসেছে ধেয়ে॥
    
৯৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  এসো হে এসো সজল ঘন, বাদলবরিষনে—
  বিপুল তব শ্যামল স্নেহে এসো হে এ জীবনে॥
এসো হে গিরিশিখর চুমি,   ছায়ায় ঘিরি কাননভূমি
  গগন ছেয়ে এসো হে তুমি গভীর গরজনে॥
  ব্যথিয়া উঠে নীপের বন পুলক-ভরা ফুলে,
   উছলি উঠে কলরোদন নদীর কূলে কূলে।
এসো হে এসো হৃদয়-ভরা,    এসো হে এসো পিপাসাহরা,
   এসো হে আঁখি-শীতল-করা,   ঘনায়ে এসো মনে॥
    
১০০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিত্ত আমার হারালো আজ মেঘের মাঝখানে—
কোথায় ছুটে চলেছে সে কোথায় কে জানে॥
  বিজুলি তার বীণার তারে  আঘাত করে বারে বারে,
  বুকের মাঝে বজ্র বাজে কী মহাতানে॥
পুঞ্জ পুঞ্জ ভারে ভারে  নিবিড় নীল অন্ধকারে
জড়ালো রে অঙ্গ আমার, ছড়ালো প্রাণে।
  পাগল হাওয়া নৃত্যে মাতি   হল আমার সাথের সাথি—
  অট্টহাসে ধায় কোথা সে, বারণ না মানে॥
    
১০১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        আবার  শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে,
            মেঘ-আঁচলে নিলে ঘিরে॥
সূর্য হারায়, হারায় তারা, আঁধারে পথ হয়-যে হারা,
            ঢেউ দিয়েছে নদীর নীরে॥
সকল আকাশ, সকল ধরা   বর্ষণেরই-বাণী-ভরা।
ঝরো ঝরো ধারায় মাতি   বাজে আমার আঁধার রাতি,
            বাজে আমার শিরে শিরে॥
    
১০২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ধরণী,    দূরে চেয়ে   কেন আজ   আছিস জেগে
যেন কার উত্তরীয়ের   পরশের   হরষ লেগে॥
  আজি কার    মিলনগীতি    ধ্বনিছে    কাননবীথি,
  মুখে চায়   কোন্‌ অতিথি   আকাশের   নবীন মেঘে॥
ঘিরেছিস   মাথায় বসন     কদমের   কুসুম-ডোরে,
সেজেছিস   নয়নপাতে    নীলিমার     কাজল পরে।
  তোমার ওই   বক্ষতলে    নবশ্যাম    দূর্বাদলে
  আলোকের    ঝলক ঝলে    পরানের পুলক-বেগে॥
    
১০৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
             হৃদয়ে মন্দ্রিল ডমরু গুরু গুরু,
            ঘন মেঘের ভুরু কুটিল কুঞ্চিত,
        হল রোমঞ্চিত বন বনান্তর—
দুলিল চঞ্চল বক্ষোহিন্দোলে    মিলনস্বপ্নে সে কোন্‌ অতিথি রে।
   সঘন-বর্ষণ-শব্দ-মুখরিত    বজ্রসচকিত ত্রস্ত শর্বরী,
       মালতিবল্লরী কাঁপায় পল্লব করুণ কল্লোলে—
           কানন শঙ্কিত ঝিল্লিঝংকৃত॥
    
১০৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মধু    -গন্ধে-ভরা   মৃদু   -স্নিগ্ধছায়া   নীপ   -কুঞ্জতলে
শ্যাম   -কান্তিময়ী    কোন্‌   স্বপ্নমায়া    ফিরে   বৃষ্টিজলে॥
ফিরে   রক্ত-অলক্তক-ধৌত পায়ে  ধারা   -সিক্ত বায়ে,
মেঘ   -মুক্ত সহাস্য শশাঙ্ককলা   সিঁথি   -প্রান্তে জ্বলে॥
পিয়ে   উচ্ছল তরল প্রলয়মদিরা   উন্‌   মুখর তরঙ্গিণী ধায় অধীরা,
কার    নির্ভীক মূর্তি তরঙ্গদোলে   কল   -মন্দ্ররোলে।
এই তারাহারা নিঃসীম অন্ধকারে   কার   তরণী চলে॥
    
১০৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     আমি   তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে
     যখন   বৃষ্টি  নামল  তিমিরনিবিড় রাতে॥
দিকে দিকে সঘন গহন মত্ত প্রলাপে  প্লাবন-ঢালা শ্রাবণধারাপাতে
             সে দিন   তিমিরনিবিড়রাতে॥
    আমার   স্বপ্নস্বরূপ বাহির হয়ে এল,   সে যে   সঙ্গ পেল
    আমার   সুদূর পারের স্বপ্নদোসর-সাথে
                      সে দিন   তিমিরনিবিড়রাতে॥
আমার   দেহের সীমা গেল পারায়ে—ক্ষুব্ধ বনের মন্দ্ররবে গেল হারায়ে।
     মিলে গেল কুনজবীথির সিক্ত যূথীর গন্ধে   মত্ত হাওয়ার ছন্দে
মেঘে মেঘে তড়িৎশিখার ভুজঙ্গপ্রয়াতে  সে দিন  তিমিরনিবিড় রাতে॥
    
১০৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   আমি  শ্রাবণ-আকাশে ওই দিযেছি পাতি
        মম    জল-ছলো-ছলো আঁখি মেঘে মেঘে।
 বিরহদিগন্ত পারায়ে সারা রাতি  অনিমেষে আছে জেগে॥
 যে   গিয়েছে দেখার বাহিরে  আছে তারি উদ্দেশে চাহি রে,
    স্বপ্নে উড়িছে তারি কেশরাশি  পূরব-পবনবেগে॥
            শ্যামল তমালবনে
 যে পথে সে চলে গিয়েছিল  বিদায়গোধূলি-খনে
     বেদনা জড়ায়ে আছে তারি ঘাসে,  কাঁপে নিশ্বাসে—
 সেই  বারে বারে ফিরে ফিরে চাওয়া  ছায়ায় রয়েছে লেগে॥
    
১০৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভোর থেকে আজ বাদল ছুটেছে— আয় গো আয়।
কাঁচা রোদখানি পড়েছে বনের ভিজে পাতায়॥
      ঝিকি ঝিকি করি কাঁপিতেছে বট—
      ওগো ঘাটে আয়, নিয়ে আয় ঘট—
পথের দু ধারে শাখে শাখে আজি পাখিরা গায়॥
তপন-আতপে আতপ্ত হয়ে উঠেছে বেলা,
খঞ্জন-দুটি আলস্যভরে ছেড়েছে খেলা।
     কলস পাকড়ি আঁকড়িয়া বুকে
     ভরা জলে তোরা ভেসে যাবি সুখে
তিমিরনিবিড় ঘনঘোর ঘুমে স্বপন-প্রায়—   আয় গো আয়॥
মেঘ ছুটে গেল, নাই গো বাদল— আয় গো আয়।
আজিকে সকালে শিথিল কোমল বহিছে বায়—  আয় গো আয়।
      এ ঘাট হইতে ও ঘাটে তাহার
      কথা-বলাবলি নাহি চলে আর,
একাকার হল তীরে আর নীরে তাল-তলায়—   আয় গো আয়॥
    
১০৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে॥
বাদলের ধারা ঝরে ঝরো ঝরো,   আউশের ক্ষেত জলে ভরো ভরো,
কালীমাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ্‌ চাহি রে॥
ওই শোনো শোনো পারে যাবে বলে কে ডাকিছে যেন মাঝিরে।
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।
পূবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ,   দু কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ—
দরো দরো বেগে জলে পড়ি জল ছলো ছলো উঠে বাজি রে।
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে॥
ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘন ঘন, ধবলীরে আনো গোহালে—
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখো দেখি,   মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি,
রাখালবালক না জানি কোথায় সারা দিন আজি খোয়ালে।
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে॥
ওগো, আজ তোরা যাস নে গো তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে।
ঝরো ঝরো ধারে ভিজিবে নিচোল,   ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল—
ওই বেণুবন দোলে ঘন ঘন পথপাশে দেখো চাহি রে॥
    
১০৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
থামাও   রিমিকি ঝিমিকি বরিষন, ঝিল্লিঝনক-ঝন-নন,   হে শ্রাবণ।
           ঘুচাও ঘুচাও স্বপ্নমোহ-অবগুণ্ঠন ঘুচাও—
             এসো হে, এসো হে, দুর্দম বীর এসো  হে।
    ঝড়ের রথে  অগম পথে  জড়ের বাধা যত করো উন্‌মূলন॥
জ্বালো জ্বালো বিদ্যুৎ-শিখা জ্বালো,
    দেখাও তিমিরভেদী দীপ্তি তোমার দেখাও।
দিগ্‌‍বিজয়ী তব বাণী দেহো আনি, গগনে গগনে সুপ্তিভেদী তব গর্জন জাগাও॥
    
১১০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজি   পল্লিবালিকা অলকগুচ্ছ সাজালো   বকুলফুলের দুলে,
 যেন   মেঘরাগিণী-রচিত কী সুর দুলালো কর্ণমূলে।
 ওরা চলেছে কুঞ্জচ্ছায়াবীথিকায় হস্যকল্লোল-উছল গীতিকায়
         বেণুমর্মরমুখর পবনে তরঙ্গ তুলে॥
  আজি   নীপশাখায়-শাখায়  দুলিছে  পুষ্পদোলা,
  আজি   কূলে কূলে তরল প্রলাপে যমুনা কলরোলা।
     মেঘপুঞ্জ গরজে গুরু গুরু   বনের বক্ষ কাঁপে দুরু দুরু—
          স্বপ্নলোকে পথ হারানু মনের ভুলে॥
    
১১১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওই   মালতীলতা দোলে
পিয়ালতরুর কোলে   পূব-হাওয়াতে॥
   মোর   হৃদয়ে লাগে দোলা,   ফিরি আপন-ভোলা—
   মোর ভাবনা কোথায় হারা   মেঘের মতন যায় চলে॥
জানি নে কোথায় জাগো   ওগো বন্ধু পরবাসী—
        কোন্‌   নিভৃত বাতায়নে।
   সেথা   নিশীথের জল-ভরা কণ্ঠে
   কোন্‌   বিরহিণীর বাণী তোমারে কী যায় বলে॥
    
১১২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আঁধার অম্বরে প্রচণ্ড ডম্বরু   বাজিল গম্ভীর গরজনে।
অশত্থপল্লবে অশান্ত হিল্লোল   সমীরচঞ্চল দিগঙ্গনে॥
নদীর কল্লোল, বনের মর্মর,     বাদল-উচ্ছল নির্ঝর-ঝর্ঝর,
ধ্বনি তরঙ্গিল নিবিড় সঙ্গীতে—শ্রাবণসন্ন্যাসী রচিল রাগিণী॥
কদম্বকুঞ্জের সুগন্ধমদিরা   অজস্র লুটিছে দুরন্ত ঝটিকা।
তড়িৎশিখা ছুটে দিগন্ত সন্ধিয়া,   ভয়ার্ত যামিনী উঠিছে ত্রন্দিয়া—
নাচিছে যেন কোন্‌ প্রমত্ত দানব   মেঘের দুর্গের দুয়ার হানিয়া॥
    
১১৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচেরে।
        শত বরনের ভাব উচ্ছ্বাস  কলাপের মতো করেছে বিকাশ,
        আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে॥
ওগো, নির্জনে বকুলশাখায় দোলায় কে আজি দুলিছে, দোদুল দুলিছে।
        ঝরকে ঝরকে ঝরিছে বকুল,  আঁচল আকাশে হতেছে আকুল,
        উড়িয়া অলক ডাকিছে পলক— কবরী খসিয়া খুলিছে।
        ঝরে ঘনধারা নবপল্লবে,  কাঁপিছে কানন ঝিল্লির রবে—
        তীর ছাপি নদী কলকল্লোলে এল পল্লির কাছে রে॥
    
১১৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     আজ   বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে—
            চলেছে গরজি, চলেছে নিবিড় সাজে।
                  হৃদয়ে তাহার নাচিয়া উঠেছে ভীমা,
                  ধাইতে ধাইতে লোপ করে চলে সীমা,
                  কোন্‌ তাড়নায় মেঘের সহিত মেঘে
                           বক্ষে বক্ষে মিলিয়া বজ্র বাজে॥
             পুঞ্জে পুঞ্জে দূরে সুদূরের পানে
             দলে দলে চলে, কেন চলে নাহি জানে।
                  জানে না কিছুই কোন্ মহাদ্রিতলে
                  গভীর শ্রাবণে গলিয়া পড়িবে জলে,
                  নাহি জানে তার ঘনঘোর সমারোহে
                           কোন্‌ সে ভীষণ জীবন মরণ রাজে॥
    
১১৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ   আসিতে তোমার দ্বারে
         মরুতীর হতে সুধাশ্যামলিম পারে॥
      পথ হতে আমি গাঁথিয়া এনেছি সিক্ত যূথীর মালা
         সকরুণ-নিবেদনের-গন্ধ-ঢালা—
            লজ্জা দিয়ো   না তারে॥
         সজল মেঘের ছায়া ঘনাইছে বনে বনে,
         পথ-হারানোর বাজিছে বেদনা সমীরণে।
দূর হতে আমি দেখেছি তোমার ওই বাতায়নতলে  নিভৃতে প্রদীপ জ্বলে —
      আমার এ আখিঁ উৎসুক পাখি ঝড়ের অন্ধকারে॥
    
১১৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
           তৃষ্ণার শান্তি     সুন্দরকান্তি,
               তুমি এলে নিখিলের সন্তাপভঞ্জন॥
           আঁকো ধরাবক্ষে   দিগ্‌বধূচক্ষে
               সুশীতল সুকোমল শ্যামরসরঞ্জন।
           এলে বীরছন্দে, তব কটিবন্ধে
               বিদ্যুত-অসিলতা বেজে ওঠে ঝন্‌ঝন॥
           তব উত্তরীয়ে   ছায়া দিলে ভরিয়ে—
               তমালবনশিখরে নবনীল-অঞ্জন।
           ঝিল্লির মন্দ্রে  মালতীর গন্ধে
               মিলাইলে চঞ্চল মধুকরগুঞ্জন।
           নৃত্যের ভঙ্গে   এলে নব রঙ্গে,
               সচকিত পল্লবে নাচে যেন খঞ্জন॥
    
১১৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মম মন-উপবনে চলে অভিসারে   আঁধার রাতে বিরহিণী।
   রক্তে তারি নূপুর বাজে রিনিরিনি॥
      দুরু দুরু করে হিয়া,   মেঘ ওঠে গরজিয়া,
         ঝিল্লি ঝনকে ঝিনিঝিনি॥
মম মন-উপবনে ঝরে বারিধারা,   গগনে নাহি শশীতারা।
   বিজুলির চমকনে   মিলে আলো ক্ষণে ক্ষণে,
      ক্ষণে ক্ষণে পথ ভোলে উদাসিনী॥
    
১১৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজি   বরিষনমুখরিত শ্রাবণরাতি,
        স্মৃতিবেদনার মালা একেলা গাঁথি॥
আজি   কোন্‌ ভুলে ভুলি,   আঁধার ঘরেতে রাখি দুয়ার খুলি,
  মনে হয় বুঝি আসিছে সে   মোর দুখরজনীর সাথি॥
        আসিছে সে ধারাজলে সুর লাগায়ে,
        নীপবনে পুলক জাগায়ে।
  যদিও বা নাহি আসে   তবু বৃথা আশ্বাসে
  ধূলি-’পরে   রাখিব রে   মিলন-আসনখানি পাতি॥
    
১১৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যায় দিন, শ্রাবণদিন যায়।
আঁধারিল মন মোর আশঙ্কায়,
মিলনের বৃথা প্রত্যাশায়   মায়াবিনী এই সন্ধ্যা ছলিছে॥
আসন্ন নির্জন রাতি,   হায়, মম পথ-চাওয়া বাতি
ব্যাকুলিছে শূন্যেরে কোন্‌ প্রশ্নে॥
দিকে দিকে কোথাও নাহি সাড়া,
ফিরে খ্যাপা হাওয়া গৃহছাড়া।
নিবিড়-তমিস্র-বিলুপ্ত-আশা   ব্যথিতা যামিনী খোঁজে ভাষা—
বৃষ্টিমুখরিত মর্মরছন্দে,   সিক্ত মালতীগন্ধে॥
    
১২০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমি কী গান গাব যে   ভেবে না পাই—
   মেঘলা আকাশে   উতলা বাতাসে   খুঁজে বেড়াই॥
   বনের গাছে গাছে জেগেছে ভাষা   ভাষাহারা নাচে—
   মন ওদের কাছে   চঞ্চলতার রাগিণী যাচে,
       সারা দিন   বিরামহীন   ফিরি যে তাই॥
আমার অঙ্গে   সুরতরঙ্গে   ডেকেছে বান,
    রসের প্লাবনে ডুবিয়া যাই।
       কী কথা রয়েছে আমার মনের ছায়াতে
       স্বপ্নপ্রদোষে— আমি   তারে যে চাই॥
    
১২১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কিছু বলব বলে এসেছিলেম,
রইনু চেয়ে না বলে॥
      দেখিলাম, খোলা বাতায়নে   মালা গাঁথ আপন-মনে,
      গাও গুন্‌-গুন্‌ গুঞ্জরিয়া   যূথীকুঁড়ি নিয়ে কোলে॥
সারা আকাশ তোমার দিকে
চেয়ে ছিল অনিমিখে।
      মেঘ-ছেঁড়া আলো এসে   পড়েছিল কালো কেশে,
      বাদল-মেঘে মৃদুল হাওয়ায়   অলক দোলে॥
    
১২২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মন মোর মেঘের সঙ্গী,
উড়ে চলে দিগ্‌‍দিগন্তের পানে
নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে
রিমিঝিম   রিমিঝিম   রিমিঝিম॥
     মন মোর হংসবলাকার পাখায় যায় উড়ে
     ক্বচিৎ ক্বচিৎ চকিত তড়িত-আলোকে।
     ঝঞ্ঝনমঞ্জীর বাজায় ঝঞ্ঝা রুদ্র আনন্দে।
     কলো কলো কলমন্দ্রে নির্ঝরিণী
     ডাক দেয় প্রলয়-আহবানে॥
বায়ু বহে পূর্বসমুদ্র হতে
উচ্ছল ছলো ছলো তটিনীতরঙ্গে।
     মন মোর ধায় তারি মত্ত প্রবাহে
     তাল-তমাল-অরণ্যে
     ক্ষুব্ধ শাখার আন্দোলনে॥
    
১২৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  মোর   ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো,
  দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।
  হৃদয়গগনে সজল ঘন নবীন মেঘে
             রসের ধারা বরষে॥
        তাহারে দেখি না যে দেখি না,
        শুধু   মনে মনে ক্ষণে ক্ষণে ওই শোনা যায়
        বাজে অলখিত তারি চরণে
        রুনুরুনু  রুনুরুনু  নূপুরধ্বনি॥
গোপন  স্বপনে ছাইল
অপরশ  আঁচলের নব নীলিমা।
       উড়ে যায় বাদলের এই বাতাসে
তার     ছায়াময় এলো কেশ আকাশে।
        সে যে মন মোর দিল আকুলি
        জল-ভেজা কেতকীর দূর সুবাসে॥
    
১২৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                  আমার   প্রিয়ার ছায়া
        আকাশে আজ ভাসে,   হায় হায়।
                   বৃষ্টিসজল বিষণ্ণ নিশ্বাসে,   হায় হায়॥
                  আমার প্রিয়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
                  সন্ধ্যাতারায় লুকিয়ে দেখে কাকে,
                  সন্ধ্যাদীপের লুপ্ত আলো স্মরণে তার আসে,   হায়॥
        বারি-ঝরা বনের গন্ধ নিয়া
        পরশ-হারা বরণমালা গাঁথে আমার প্রিয়া।
                  আমার প্রিয়া ঘন শ্রাবণধারায়
                  আকাশ ছেয়ে মনের কথা হারায়॥
                  আমার প্রিয়ার আঁচল দোলে
                  নিবিড় বনের শ্যামল উচ্ছাসে,   হায়॥
    
১২৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        ওগো সাঁওতালি ছেলে,
শ্যামল সঘন নববরষার কিশোর দূত কি এলে।
ধানের ক্ষেতের পারে   শালের ছায়ার ধারে
বাঁশির সুরেতে  সুদূর দূরেতে  চলেছ হৃদয় মেলে॥
    পুব-দিগন্ত দিল তব দেহে নীলিমলেখা,
       পীত ধড়াটিতে অরুণরেখা,
    কেয়াফুলখানি   কবে তুলে আনি
       দ্বারে মোর রেখে গেলে॥
আমার গানের হংসবলাকাপাঁতি
বাদল-দিনের তোমার মনের সাথি।
    ঝড়ে চঞ্চল তমালবনের প্রাণে
        তোমাতে আমাতে মিলিয়াছি একখানে,
           মেঘের ছায়ায় চলিয়াছি ছায়া ফেলে॥
    
১২৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল     করেছ দান,
       আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান॥
    মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে   রেখেছি ঢেকে তারে
       এই-যে আমার সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান॥
    আজ এনে দিলে, হয়তো দিবে না কাল—
রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল।
   এ গান আমার শ্রাবণে শ্রাবণে   তব বিস্মৃতিস্রোতের প্লাবনে
       ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী বহি তব সম্মান॥
    
১২৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজি   তোমায় আবার চাই শুনাবারে
যে কথা শুনায়েছি বারে বারে—
    আমার পরানে আজি   যে বাণী উঠিছে বাজি
            অবিরাম বর্ষণধারে॥
কারণ শুধায়ো না, অর্থ নাহি তার,
সুরের সঙ্কেত জাগে পুঞ্জিত বেদনার।
   স্বপ্নে যে বাণী মনে মনে   ধ্বনিয়া উঠে ক্ষণে ক্ষণে
       কানে কানে গুঞ্জরিব তাই বাদলের অন্ধকারে॥
    
১২৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     এসো গো জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি
             বিজন ঘরের কোণে,   এসো গো।
     নামিল শ্রাবণসন্ধ্যা, কালো ছায়া ঘনায় বনে বনে॥
আনো বিস্ময় মম নিভৃত প্রতীক্ষায়   যূথীমালিকার মৃদু গন্ধে —
                নীলবসন-অঞ্চল-ছায়া
                   সুখরজনী-সম মেলুক মনে॥
        হারিয়ে গেছে মোর বাঁশি,
আমি   কোন্‌ সুরে ডাকি তোমারে।
        পথ-চেয়ে-থাকা মোর দৃষ্টিখানি
             শুনিতে পাও কি তাহার বাণী—
        কম্পিত বক্ষের পরশ মেলে কি সজল সমীরণে॥
    
১২৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   আজি   ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে
জানি নে,   জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না॥
   এই   চঞ্চল সজল পবন-বেগে  উদ্‌ভ্রান্ত মেঘে মন চায়
         মন চায়   ওই বলাকার পথখানি নিতে চিনে॥
মেঘমল্লারে সারা দিনমান
   বাজে ঝরনার গান।
      মন হারাবার আজি বেলা,   পথ ভুলিবার খেলা—মন চায়
           মন চায়   হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে॥
    
১৩০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শ্রাবণের গগনের গায়   বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়।
   ক্ষণে ক্ষণে শর্বরী শিহরিয়া উঠে,   হায়॥
       তেমনি তোমার বাণী   মর্মতলে যায় হানি   সঙ্গোপনে,
                ধৈরজ যায় যে টুটে,   হায়॥
   যেমন বরষধারায়   অরণ্য আপনা হারায়   বারে বারে
                   ঘন রস-আবরণে
          তেমনি তোমার স্মৃতি   ঢেকে ফেলে মোর গীতি
                  নিবিড় ধারে   আনন্দ-বরিষনে,   হায়॥
    
১৩১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্বপ্নে আমার মনে হল   কখন   ঘা দিলে আমার দ্বারে,   হায়।
      আমি   জাগি নাই জাগি নাই গো,
            তুমি   মিলালে অন্ধকারে,   হায়॥
   অচেতন মনো-মাঝে   তখন   রিমিঝিমি ধ্বনি বাজে,
            কাঁপিল বনের হাওয়া ঝিল্লিঝঙ্কারে।
   আমি  জাগি নাই জাগি নাই গো,  নদী বহিল বনের পারে॥
পথিক এল দুই প্রহরে   পথের আহবান আনি ঘরে।
      শিয়রে নীরব বীণা     বেজেছিল কি জানি না—
            জাগি নাই জাগি নাই গো,
       ঘিরেছিল বনগন্ধ ঘুমের চারিধারে॥
    
১৩২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে,    শেষ কথা যাও বলে॥
    সময় পাবেনা আর,     নামিছে অন্ধকার,
        গোধূলিতে আলো-আঁধারে
            পথিক যে পথ ভোলে॥
        পশ্চিমগগনে ওই দেখা যায় শেষ রবিরেখা,
           তমাল-অরণ্যে ওই শুনি শেষ কেকা।
    কে আমার অভিসারিকা বুঝি   বাহিরিল অজানারে খুঁজি,
           শেষবার মোর আঙিনায় দ্বার খোলে॥
    
১৩৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   এসেছিলে তবু আস নাই   জানায়ে গেলে
   সমুখের পথ দিযে   পলাতকা ছায়া ফেলে॥
তোমার সে উদাসীনতা     সত্য কিনা জানি না সে,
   চঞ্চল চরণ গেল ঘাসে ঘাসে বেদনা মেলে॥
   তখন পাতায় পাতায়   বিন্দু বিন্দু ঝরে জল,
   শ্যামল বনান্তভূমি   করে ছলোছল্‌।
তুমি চলে গেছ ধীরে ধীরে,     সিক্ত সমীরে,
   পিছনে নীপবীথিকায় রৌদ্রছায়া যায় খেলে॥
    
১৩৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        এসেছিনু দ্বারে তব শ্রাবণরাতে,
        প্রদীপ নিভালে কেন অঞ্চলঘাতে॥
        অন্তরে কালো ছায়া পড়ে আঁকা,
        বিমুখ মুখের ছবি মনে রয় ঢাকা,
                  দুঃখের সাথি তারা ফিরিছে সাথে॥
কেন দিলে না মাধুরীকণা,   হায় রে কৃপণা।
        লাবণ্যলক্ষ্মী বিরাজে   ভুবনমাঝে,
                  তারি লিপি দিলে না হাতে॥
    
১৩৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   নিবিড় মেঘের ছায়ায় মন দিয়েছি মেলে,
      ওগো প্রবাসিনী, স্বপনে তব
           তাহার বারতা কি পেলে॥
আজি তরঙ্গকল্লোলে   দক্ষিণসিন্ধুর ত্রন্দনধ্বনি
        আনে বহিয়া কাহার বিরহ॥
   লুপ্ত তারার পথে চলে কাহার সুদূর স্মৃতি
       নিশীথরাতের রাগিণী বহি।
       নিদ্রাবিহীন ব্যথিত হৃদয়
        ব্যর্থ শূন্যে তাকায়ে রহে॥
    
১৩৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    আমার   যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে,
    তারি    ছায়া পড়েছে শ্রাবণগগনতলে॥
সে দিন যে রাগিণী গেছে থেমে     অতল বিরহে নেমে
    আজি   পুবের হাওয়ায় হাওয়ায় হায় হায় হায় রে
           কাঁপন ভেসে চলে॥
    নিবিড় সুখে মধুর দুখে জড়িত ছিল সেই দিন—
    দুই তার জীবনের বাঁধা ছিল বীন।
তার ছিঁড়ে গেছে কবে     এক দিন কোন্‌ হাহারবে,
       সুর হারায়ে গেল পলে পলে॥
    
১৩৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
      পাগল আমার মন জেগে উঠে॥
চেনাশোনার কোন্‌ বাইরে     যেখানে পথ নাই নাই রে
      সেখানে অকারণে যায় ছুটে॥
ঘরের মুখে আর কি রে     কোনো দিন সে যাবে ফিরে।
            যাবে না, যাবে না—
               দেয়াল যত সব গেল টুটে॥
বৃষ্টি-নেশা-ভরা সন্ধ্যাবেলা   কোন্‌ বলরামের আমি চেলা,
আমার     স্বপ্ন ঘিরে নাচে মাতাল জুটে—
               যত    মাতাল জুটে।
    যা     না চাইবার তাই আজি চাই গো,
    যা     না পাইবার তাই কোথা পাই গো।
            পাব না, পাবনা,
         মরি   অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে॥
    
১৩৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        আজি   মেঘ কেটে গেছে সকালবেলায়,
        এসো এসো এসো   তোমার হাসিমুখে—
             এসো আমার অলস দিনের খেলায়॥
        স্বপ্ন যতো জমেছিল আশা-নিরাশায়
        তরুণ প্রাণের বিফল ভালোবাসায়
দিব   অকূল-পানে ভাসায়ে ভাঁটার গাঙের ভেলায়।
        দুঃখসুখের বাঁধন তারি গ্রন্থি দিব খুলে,
        আজি ক্ষণেক-তরে মোরা রব আপন ভুলে।
যে গান হয় নি গাওয়া     যে দান হয় নি পাওয়া—
        আজি পুরব-হাওয়ায় তারি পরিতাপ
                  উড়াব অবহেলায়॥
    
১৩৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    সঘন গহন রাত্রি,     ঝরিছে শ্রাবণধারা—
          অন্ধ বিভাবরী সঙ্গপরশহারা॥
        চেয়ে থাকি যে শূন্যে   অন্যমনে
    সেথায় বিরহিণীর অশ্রু   হরণ করেছে ওই তারা॥
অশত্থপল্লবে বৃষ্টি ঝরিয়া   মর্মরশব্দে
    নিশীথের অনিদ্রা দেয় যে ভরিয়া।
       মায়ালোক হতে ছায়াতরণী
          ভাসায় স্বপ্নপারাবারে— নাহি তার কিনারা॥
    
১৪০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
             ওগো তুমি পঞ্চদশী,
তুমি    পৌঁছিলে পূর্ণিমাতে।
মৃদুস্মিত স্বপ্নের আভাস তব বিহবল রাতে॥
        ক্বচিৎ জাগরিত বিহঙ্গকাকলী
           তব নবযৌবনে উঠিছে আকুলি   ক্ষণে ক্ষণে।
        প্রথম আষাঢ়ের কেতকীসৌরভ তব নিদ্রাতে॥
                     যেন অরণ্যমর্মর
                  গুঞ্জরি উঠে তব বক্ষে থরথর।
                      অকারণ বেদনার ছায়া ঘনায় মনের দিগন্তে,
                           ছলো ছলো জল এনে দেয় তব নয়নপাতে॥
    
১৪১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজি    শরততপনে   প্রভাতস্বপনে   কী জানি পরান কী যে চায়।
ওই     শেফালির শাখে   কী বলিয়া ডাকে,   বিহগ বিহগী কী যে গায়॥
আজি    মধুর বাতাসে   হৃদয় উদাসে,   রহে না আবাসে মন হায়—
কোন্‌    কুসুমের আশে   কোন্‌ ফুলবাসে   সুনীল আকাশে মন ধায়॥
আজি    কে যেন গো নাই, এ প্রভাতে তাই   জীবন বিফল হয় গো—
তাই     চারিদিকে চায়,   মন কেঁদে গায়   ‘এ নহে, এ নহে, নয় গো ’।
কোন্‌    স্বপনের দেশে   আছে এলোকেশে   কোন্‌ ছায়াময়ী অমরায়।
আজি    কোন্‌ উপবনে,    বিরহবেদনে    আমারি কারণে কেঁদে যায়॥
আমি    যদি গাঁথি গান   অথিরপরান   সে গান শুনাব কারে আর।
আমি    যদি গাঁথি মালা  লয়ে ফুলডালা,   কাহারে পরাব ফুলহার॥
আমি    আমার এ প্রাণ   যদি করি দান,   দিব প্রাণ তবে কার পায়।
সদা     ভয় হয় মনে,   পাছে অযতনে   মনে মনে কেহ ব্যথা পায়॥
    
১৪২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি।   আহা, হাহা, হা।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি।  আহা, হাহা, হা।
    কী করি আজ ভেবে না পাই,   পথ হারিয়ে কোন্‌ বনে যাই,
    কোন্‌ মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি। আহা, হাহা, হা।
কেয়া- পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে—
তাল দিঘিতে ভাসিয়ে দেব, চলবে দুলে দুলে।
    রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু  চরাব আজ বাজিয়ে বেণু,
    মাখব গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি।  আহা, হাহা, হা॥
    
১৪৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ   ধানের ক্ষেতে রৌদ্রচায়ায় লুকোচুরি খেলা—
 নীল  আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা॥
        আজ  ভ্রমর ভোলে মধু খেতে— উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে,
                  আজ   কিসের তরে নদীর চরে চখা-চখীর মেলা॥
        ওরে,   যাব না আজ ঘরে রে ভাই, যাব না আজ ঘরে।
        ওরে,   আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ নেব রে লুট করে।
            যেন জোয়ার-জলে ফেনার রাশি   বাতাসে আজ ছুটেব হাসি,
                 আজ   বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি কাটবে সকল বেলা॥
    
১৪৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমরা   বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা—
       নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা॥
       এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,
এসো            নির্মল নীলপথে,
এসো            ধৌত শ্যামল আলো-ঝলমল বনগিরি-পর্বতে—
এসো            মুকুটে পরিয়া শ্বেতশতদল শীতল-শিশির-ঢালা।
       ঝরা মলতীর ফুলে
       আসন বিছানো নিভৃত কুঞ্জে ভরা গঙ্গার কূলে,
       ফিরিছে মরাল ডানা পাতিবারে তোমার চরণমূলে।
       গুঞ্জর তাল তুলিয়ো তোমার সোনার বীণার তারে
       মৃদুমধু ঝংকারে,
       হাসি-ঢালা সুর গলিয়া পড়িবে ক্ষণিক অশ্রুধারে।
       রহিয়া রহিয়া যে পরশমণি ঝলকে অলককোণে
       পলকের তরে সকরুণ করে বুলায়ো বুলায়ো মনে—
       সোনা হয়ে যাবে সকল ভাবনা, আঁধার হইবে আলা॥
    
১৪৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অমল ধবল পালে লেগেছে   মন্দ মধুর হাওয়া—
   দেখি নাই কভু দেখি নাই   এমন তরণী-বাওয়া॥
      কোন্‌ সাগরের পার হতে আনে কোন্‌ সুদূরের ধন—
                ভেসে যেতে চায় মন,
      ফেলে যেতে চায় এই কিনারায় সব চাওয়া সব পাওয়া॥
পিছনে ঝরিছে ঝরো ঝরো জল, গুরু গুরু দেয়া ডাকে,
   মুখে এসে পড়ে অরুণকিরণ ছিন্ন মেঘের ফাঁকে।
      ওগো কাণ্ডারী, কে গো তুমি, কার হাসিকান্নার ধন
                ভেবে মরে মোর মন—
      কোন্‌ সুরে আজ বাঁধিবে যন্ত্র, কী মন্ত্র হবে গাওয়া॥
    
১৪৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        আমার নয়ন-ভুলানো এলে,
     আমি   কী হেরিলাম হৃদয় মেলে॥
  শিউলিতলার পাশে পাশে   ঝরা ফুলের রাশে রাশে
       শিশির-ভেজা ঘাসে ঘাসে   অরুণরাঙা চরণ ফেলে
            নয়ন-ভুলানো এলে॥
আলোছায়ার আঁচলখানি লুটিয়ে পড়ে বনে বনে,
   ফুলগুলি ওই মুখে চেয়ে কী কথা কয় মনে মনে।
       তোমায় মোরা করব বরণ,   মুখের ঢাকা করো হরণ,
   ওইটুকু ওই মেঘাবরণ   দু হাত দিয়ে ফেলো ঠেলে॥
বনদেবীর দ্বারে দ্বারে শুনি গভীর শঙ্খধ্বনি,
  আকাশবীণার তারে তারে জাগে তোমার আগমনী।
     কোথায় সোনার নূপুর বাজে,   বুঝি আমার হিয়ার মাঝে
  সকল ভাবে সকল কাজে   পাষাণ-গালা সুধা ঢেলে—
             নয়ন-ভুলানো এলে॥
    
১৪৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিউলি ফুল,    শিউলি ফুল,    কেমন ভুল,    এমন ভুল॥
    রাতের বায়   কোন্‌ মায়ায়   আনিল হায়   বনছায়ায়,
        ভোরবেলায়   বারে বারেই   ফিরিবারে হলি ব্যাকুল॥
           কেন রে তুই উন্মনা!   নয়নে তোর হিমকণা।
        কোন্‌ ভাষায়   চাস বিদায়,   গন্ধ তোর   কী জানায়—
           সঙ্গে হায়   পলে পলেই   দলে দলে   যায় বকুল॥
    
১৪৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শরতে আজ কোন্‌ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে।
আনন্দগান গা রে হৃদয়,   আনন্দগান গা রে॥
    নীল আকাশের নীরব কথা   শিশির-ভেজা ব্যাকুলতা
       বেজে উঠুক আজি তোমার বীণার তারে তারে॥
শস্যক্ষেতের সোনার গানে   যোগ দে রে আজ সমান তানে,
ভাসিয়ে দে সুর ভরা নদীর অমল জলাধারে।
   যে এসেছে তাহার মুখে   দেখ্‌ রে চেয়ে গভীর সুখে,
       দুয়ার খুলে তাহার সাথে বাহির হয়ে যা রে॥
    
১৪৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ   প্রথম ফুলের পাব প্রসাদখানি,   তাই   ভোরে উঠেছি।
আজ   শুনতে পাব প্রথম আলোর বাণী,   তাই   বাইরে ছুটেছি॥
   এই   হল মোদের পাওয়া,   তাই   ধরেছি গান-গাওয়া,
   আজ   লুটিয়ে হিরণ-কিরণ-পদ্মদলে   সোনার   রেণু লুটেছি॥
আজ পারুলদিদির বনে   মোরা   চলব নিমন্ত্রণে,
   চাঁপা-ভায়ের শাখা-ছায়ের তলে    মোরা    সবাই জুটেছি।
   আজ   মনের মধ্যে ছেয়ে   সুনীল   আকাশ ওঠে গেয়ে,
   আজ   সকালবেলায় ছেলেখেলার ছলে   সকল   শিকল টুটেছি॥
    
১৫০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        ওগো   শেফালিবনের মনের কামনা,
        কেন    সুদূর গগনে গগনে
        আছ    মিলায়ে পবনে পবনে।
        কেন    কিরণে কিরণে ঝলিয়া
        যাও    শিশিরে শিশিরে গলিয়া।
        কেন    চপল আলোতে ছায়াতে
        আছ    লুকায়ে আপন মায়াতে।
        তুমি    মুরতি ধরিয়া চকিতে নামো-না,
        ওগো   শেফালিবনের মনের কামনা॥
        আজি   মাঠে মাঠে চলো বিহরি,
        তৃণ    উঠুক শিহরি শিহরি।
        নামো   তালপল্লববীজনে,
        নামো   জলে ছয়াছবিসৃজনে।
        এসো   সৌরভ ভরি আঁচলে,
        আঁখি   আঁকিয়া সুনীল কাজলে।
        মম    চোখের সমুখে ক্ষণেক থামো-না,
        ওগো   শেফালিবনের মনের কামনা॥
        ওগো   সোনার স্বপন, সাধের সাধনা,
        কত   আকুল হাসি ও রোদনে
        রাতে   দিবসে স্বপনে বোধনে
        জ্বালি   জোনাকিপ্রদীপমালিকা,
        ভরি   নিশীথতিমিরথালিকা,
        প্রাতে  কুসুমের সাজি সাজায়ে,
        সাঁজে  ঝিল্লি-ঝাঁঝর বাজায়ে,
        কত   করেছে তোমার স্তুতি-আরাধনা,
        ওগো  সোনার স্বপন, সাধের সাধনা॥
        ওই   বসেছ শুভ্র আসনে
        আজি  নিখিলের সম্‌ভাষণে।
        আহা  শ্বেতচন্দনতিলকে
        আজি  তোমারে সাজায়ে দিল কে।
        আহা  বরিল তোমারে কে আজি
        তার   দুঃখশয়ন তেয়াজি—
        তুমি   ঘুচালে কাহার বিরহকাঁদনা,
        ওগো  সোনার স্বপন, সাধের সাধনা॥
    
১৫১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                  শরত-আলোর কমলবনে,
বাহির হয়ে বিহার করে যে ছিল মোর মনে মনে॥
        তারি সোনার কাঁকন বাজে   আজি প্রভাত-কিরণ-মাঝে,
        হাওয়ায় কাঁপে আঁচলখানি—ছড়ায় ছায়া ক্ষণে ক্ষণে॥
আকুল কেশের পরিমলে
শিউলিবনের উদাস বায়ু পড়ে থাকে তরুতলে।
        হৃদয়মাঝে হৃদয় দুলায়,    বাহিরে সে ভুবন ভুলায়—
        আজি সে তার চোখের চাওয়া ছড়িয়ে দিল নীল গগনে॥
    
১৫২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমার   মোহন রূপে কে রয় ভুলে।
জানি না কি মরণ নাচে, নাচে গো ওই চরণমূলে॥
  শরৎ-আলোর আঁচল টুটে    কিসের ঝলক নেচে উঠে,
           ঝড় এনেছ এলোচুলে॥
        কাঁপন ধরে বাতাসেতে—
পাকা ধানের তরাস লাগে, শিউরে ওঠে ভরা ক্ষেতে॥
   জানি গো আজ হাহারবে   তোমার পূজা সারা হবে
            নিখিল-অশ্রু-সাগর-কূলে॥
    
১৫৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
        ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি॥
        শরৎ, শিশির-ধোওয়া কুন্তলে
        বনের-পথে-লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
        আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি॥
মানিক-গাঁথা ওই-যে তোমার কঙ্কণে
ঝিলিক লাগায় তোমার শ্যামল অঙ্গনে।
        কুঞ্জছায়া গুঞ্জরণের সঙ্গীতে
        ওড়না ওড়ায় একি নাচের ভঙ্গীতে,
        শিউলিবনের বুক যে ওঠে আন্দোলি॥
    
১৫৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমরা   যা বল তাই বলো, আমার   লাগে না মনে।
আমার   যায় বেলা   বয়ে যায় বেলা   কেমন   বিনা কারণে॥
   এই   পাগল হাওয়া   কী গান-গাওয়া
   ছড়িয়ে দিয়ে গেল আজি   সুনীল গগনে॥
     সে গান আমার লাগল যে গো   লাগল মনে,
আমি   কিসের মধু খুঁজে বেড়াই   ভ্রমরগুঞ্জনে।
         ওই   আকাশ-ছাওয়া   কাহার চাওয়া
         এমন করে লাগে আজি   আমার নয়নে॥
    
১৫৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কোন্‌   খেপা শ্রাবণ ছুটে এল আশ্বিনেরই আঙিনায়।
         দুলিয়ে জটা ঘনঘটা পাগল হাওয়ার গান সে গায়॥
           মাঠে মাঠে পুলক লাগে   ছয়ানটের নৃত্যরাগে,
         শরৎ-রবির সোনার আলো উদাস হয়ে মিলিয়ে যায়॥
     কী কথা সে বলতে এল ভরা ক্ষেতের কানে কানে।
   লুটিয়ে-পড়া কিসের কাঁদন উঠেছে আজ নবীন ধানে।
     মেঘে অধীর আকাশ কেন   ডানা-মেলা গরুড় যেন—
        পথ-ভোলা এই পথিক এসে পথের বেদন আনল ধরায়॥
    
১৫৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আকাশ হতে খসল তারা   আঁধার রাতে পথহারা॥
   প্রভাত তারে খুঁজতে যাবে— ধরার ধুলায় খুঁজে পাবে
                তৃণে তৃণে শিশিরধারা॥
দুখের পথে গেল চলে—   নিবল আলো মরল জ্বলে।
   রবির আলো নেমে এসে   মিলিয়ে নেবে ভালোবেসে,
               দুঃখ তখন হবে সারা॥
    
১৫৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
       হৃদয়ে   ছিলে জেগে,
       দেখি আজ   শরত-মেঘে॥
কেমনে  আজকে ভোরে  গেল গো  গেল সরে
তোমার ওই  আঁচলখানি  শিশিরের  ছোঁওয়া লেগে॥
       কী-যে গান   গাহিতে চাই,
       বাণী মোর   খুঁজে না পাই।
সে যে ওই   শিউলিদলে   ছড়ালো   কাননতলে,
সে যে ওই   ক্ষণিক ধারায়   উড়ে যায়   বায়ুবেগে॥
    
১৫৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
         সারা নিশি ছিলেম শুয়ে    বিজন ভুঁয়ে
আমার   মেঠো ফুলের পশাপাশি,
তখন    শুনেছিলেম তারার বাঁশি॥
এখন    সকালবেলা খুঁজে দেখি   স্বপ্নে-শোনা সে সুর একি
আমার   মেঠো ফুলের চোখের জলে উঠে ভাসি॥
       এ সুর আমি খুঁজেছ্লেম রাজার ঘরে,
       শেষে ধরা দিল ধরার ধূলির ’পরে।
এ যে   ঘাসের কোলে আলোর ভাষা   আকাশ-হতে-ভেসে-আসা—
এ যে   মাটির কোলে মানিক-খসা হাসিরাশি॥
    
১৫৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দেখো   দেখো, দেখো,  শুকতারা আঁখি মেলি চায়
           প্রভাতের কিনারায়।
ডাক  দিয়েছে রে   শিউলি ফুলেরে—
           আয়  আয়  আয়॥
ও যে  কার লাগি জ্বালে দীপ,
           কার  ললাটে পরায় টিপ,
   ও যে  কার আগমনী গায়— আয়  আয়  আয়॥
জা গো  জা গো  সখী,
কাহার আশায়  আকাশ উঠিল  পুলকি।
মালতীর বনে বনে   ওই শোনো ক্ষণে ক্ষণে
কহিছে শিশিরবায়— আয়  আয়  আয়॥
    
১৬০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
       ওলো শেফালি,  ওলো শেফালি,
আমার   সবুজ ছায়ার প্রদোষে তুই জ্বালিস দীপালি॥
       তারার বাণী আকাশ থেকে   তোমার রূপে দিল এঁকে
       শ্যামল পাতার থরে থরে আখর রুপালি॥
তোমার  বুকের খসা গন্ধ-আঁচল রইল পাতা সে
       আমার গোপন কাননবীথির বিবশ বাতাসে।
       সারাটা দিন বাটে বাটে   নানা কাজে দিবস কাটে,
       আমার সাঁঝে বাজে তোমার করুণ ভূপালি॥
    
১৬১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এসো শরতের অমল মহিমা, এসো হে ধীরে।
       চিত্ত বিকাশিবে চরণ ঘিরে॥
বিরহতরঙ্গে অকূলে সে দোলে
       দিবাযামিনী আকুল সমীরে॥
    
১৬২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এবার    অবগুণ্ঠন খোলো।
গহন মেঘমায়ায়   বিজন বন ছায়ায়
তোমার   আলসে অবলুণ্ঠন সারা হল॥
        শিউলিসুরভি রাতে    বিকশিত জ্যোৎস্নাতে
        মৃদু মর্মরগানে  তব    মর্মের বাণী বোলো॥
বিষাদ-অশ্রুজলে   মিলুক শরমহাসি—
মালতীবিতানতলে    বাজুক বঁধুর বাঁশি।
        শিশিরসিক্ত বায়ে   বিজড়িত আলোছায়ে
        বিরহ-মিলনে-গাঁথা   নব   প্রণয়দোলায় দোলো॥
    
১৬৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
         তোমার   নাম জানি নে, সুর জানি।
         তুমি   শরৎ-প্রাতের আলোর বাণী॥
    সারা বেলা শিউলিবনে   আছি মগন আপন-মনে,
কিসের ভুলে রেখে গেলে   আমার   বুকে ব্যথার বাঁশিখানি॥
         আমি   যা বলিতে চাই হল বলা
             ওই শিশিরে শিশিরে অশ্রু-গলা।
         আমি যা দেখিতে চাই প্রাণের মাঝে
               সেই মুরতি এই বিরাজে—
         ছায়াতে-আলোতে-আঁচল-গাঁথা
              আমার   অকারণ বেদনার বীণাপাণি॥
    
১৬৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মরি লো)   কার বাঁশি নিশিভোরে বাজিল মোর প্রাণে।
        ফুটে দিগন্তে অরুণকিরণকলিকা॥
  শরতের আলোতে সুন্দর আসে,
          ধরণীর আঁখি যে শিশিরে ভাসে,
      হৃদয়কুঞ্জবনে মুঞ্জরিল মধুর শেফালিকা॥
    
১৬৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার   রাত পোহালো শারদ প্রাতে।
বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে॥
   তোমার বুকে বাজল ধ্বনি
   বিদায়গাথা   আগমনী   কত যে—
                ফাল্গুনে শ্রাবণে কত প্রভাতে রাতে॥
যে কথা রয় প্রাণের ভিতর অগোচরে
গানে গানে নিয়েছিলে চুরি করে।
   সময় যে তার হল গত
   নিশিশেষের তারার মতো,
               শেষ দাও শিউলিফুলের মরণ-সাথে॥
    
১৬৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নির্মল কান্ত, নমো হে নমো, নমো হে, নমো হে।
      স্নিগ্ধ সুশান্ত, নমো হে নমো, নমো হে, নমো হে।
                  বন-অঙ্গন-ময় রবিকররেখা
                           লেপিল আলিম্পনলিপি-লেখা,
            আঁকিব তাহে প্রণতি মম।
নমো হে নমো, নমো হে নমো, নমো হে নমো॥
    
১৬৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আলোর অমল কমলখানি কে ফুটালে,
নীল আকাশের ঘুম ছুটালে॥
     আমার মনের ভাব্‌নাগুলি   বাহির হল পাখা তুলি,
                           ওই কমলের পথে তাদের সেই জুটালে॥
শরতবাণীর বীণা বাজে কমলদলে।
ললিত রাগের সুর ঝরে তাই শিউলিতলে।
     তাই তো বাতাস বেড়ায় মেতে   কচি ধানের সবুজ ক্ষেতে,
                           বনের প্রাণে মর‌্মরানির ঢেউ উঠালে॥
    
১৬৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        সেই তো তোমার পথের বঁধু সেই তো।
দূর কুসুমের গন্ধ এনে খোঁজায় মধু এই তো॥
        সেই তো তোমার পথের বঁধু সেই তো।
এই আলো তার এই তো আঁধার, এই আছে এই নেই তো॥
    
১৬৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
       পোহালো পোহালো বিভাবরী,
             পূর্বতোরণে শুনি বাঁশরি॥
   নাচে তরঙ্গ, তরী অতি চঞ্চল,   কম্পিত অংশুককেতন-অঞ্চল,
        পল্লবে পল্লবে পাগল জাগল   আলসলালস পাসরি॥
উদয়-অচলতল সাজিল নন্দন,   গগনে গগনে বনে জাগিল বন্দন,
   কনককিরণঘন শোভন স্যন্দন—নামিছে শারদসুন্দরী।
দশদিক-অঙ্গনে দিগঙ্গনাদল ধ্বনিল শূন্য ভরি শঙ্খ সুমঙ্গল—
   চলো রে চলো চলো তরুণযাত্রীদল   তুলি নব মালতীমঞ্জরী॥
    
১৭০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    নবকুন্দধবলদলসুশীতলা,
         অতি সুনির্মলা, সুখসমুজ্জলা,
               শুভ সুবর্ণ-আসনে অচঞ্চলা॥
         স্মিত-উদয়ারুণ-কিরণ-বিলাসিনী
            পূর্ণসিতাংশুবিভাসবিকাশিনী
              নন্দনলক্ষ্মী সুমঙ্গলা॥
    
১৭১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে
হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে॥
ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো— ‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।’
শূন্য এখন ফুলের বাগান,   দোয়েল কোকিল গাহে না গান,
কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে।
যাক অবসাদ বিষাদ কালো,   দীপালিকায় জ্বালাও আলো—
জ্বালাও আলো,আপন আলো, শুনাও আলোর জয়বাণীরে॥
দেবতারা আজ আছে চেয়ে— জাগো ধরার ছেলে মেয়ে,
আলোয় জাগাও যামিনীরে।
এল আঁধার, দিন ফুরালো,   দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, জয় করো এই তামসীরে॥
    
১৭২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা—
হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা॥
     সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে   মলিন হেরি কুয়াশাতে,
     কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা॥
ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।
     আপন দানের আড়ালেতে   রইলে কেন আসন পেতে,
     আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন করে রাখা॥
    
১৭৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হেমন্তে কোন্‌ বসন্তেরই বাণী   পূর্ণশশী ওই-যে দিল আনি॥
বকুল ডালের আগায়   জ্যোৎস্না যেন ফুলের স্বপন লাগায়।
কোন্‌   গোপন কানাকানি   পূর্ণশশী  ওই-যে দিল আনি॥
আবেশ লাগে বনে   শ্বেতকরবীর অকাল জাগরণে।
ডাকছে থাকি থাকি  ঘুমহারা কোন্‌ নাম-না-জানা পাখি।
কার   মধুর স্মরণখানি   পূর্ণশশী ওই-যে দিল আনি॥
    
১৭৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সে দিন আমায় বলেছিলে আমার সময় হয় নাই—
ফিরে ফিরে চলে গেলে তাই॥
       তখনো খেলার বেলা—   বনে মল্লিকার মেলা,
       পল্লবে পল্লবে বায়ু উতলা সদাই॥
আজি এল হেমন্তের দিন
কুহেলিবিলীন, ভূষণবিহীন।
       বেলা আর নাই বাকি,   সময় হয়েছে নাকি—
       দিনশেষে দ্বারে বসে পথপানে চাই॥
    
১৭৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নমো, নমো, নমো।
     নমো, নমো, নমো।   
        তুমি ক্ষুধার্তজনশরণ্য,
            অমৃত-অন্ন-ভোগধন্য করো অন্তর মম॥
    
১৭৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আম্‌লকির এই ডালে ডালে।
পাতাগুলি শির‌্‍শিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে॥
      উড়িয়ে দেবার মাতন এসেকাঙাল তারে করল শেষে,
      তখন তাহার ফলের বাহার রইল না আর অন্তরালে॥
                  শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা
                  তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা।
শীতের পরশ থেকে থেকে          যায় বুঝি ওই ডেকে ডেকে,
সব খোওয়াবার সময় আমার হবে কখন কোন্‌ সকালে॥
    
১৭৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিউলি-ফোটা ফুরোল যেই ফুরোল        শীতের বনে
            এলে যে—
আমার  শীতের বনে এলে যে সেই শূন্যক্ষণে॥
তাই গোপনে সাজিয়ে ডালা   দুখের সুরে বরণমালা
                  গাঁথি মনে মনে  শূন্যক্ষণে॥
                     দিনের কোলাহলে
    ঢাকা সে যে রইবে হৃদয়তলে—
আমার  বরণমালা রইবে হৃদয়তলে॥
রাতের তারা উঠবে যবে সুরের মালা বদল হবে
   তখন তোমার সনে মনে মনে॥
    
১৭৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এল যে শীতের বেলা বরষ-পরে।
এবার ফসল কাটো, লও গো ঘরে॥
     করো ত্বরা, করো ত্বরা,    কাজ আছে মাঠ-ভরা—
           দেখিতে দেখিতে দিন আঁধার করে॥
বাহিরে কাজের পালা হইবে সারা
আকাশে উঠিবে যবে সন্ধ্যাতারা—
     আসন আপন হাতে   পেতে রেখো আঙিনাতে
           যে সাথি আসিবে রাতে তাহারি তরে॥
    
১৭৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আ য়   আ য়   আ য়।
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে,  মরি     হা য়   হা য়   হা য়॥
        হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে      দিগ্‌বধূরা ধানের ক্ষেতে—
রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে, মরি     হা য়   হা য়   হা য়॥
        মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হল।
        ঘরেতে আজ কে রবে গো,   খোলো   খোলো দুয়ার খোলো।
        আলোর হাসি উঠল জেগে    ধানের শিষে শিশির লেগে—
ধরার খুশি ধরে না গো, ওই-যে উথলে,   মরি     হা য়   হা য়   হা য়॥
    
১৮০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
             ছাড়্‌ গো তোরা ছাড়্‌ গো,
             আমি   চলব সাগর-পার গো॥
        বিদায়বেলায় একি হাসি,   ধরলি আগমনীর বাঁশি—
        যাবার সুরে আসার সুরে করলি একাকার গো॥
    সবাই আপন-পানে আমায়আবার কেন টানে।
        পুরানো শীত পাতা-ঝরা,   তারে এমন নূতন করা!
        মাঘ মরিল ফাগুন হয়ে খেয়ে ফুলের মার গো॥
    রঙের খেলার ভাই রে,    আমার    সময় হাতে নাই রে।
        তোমাদের ওই সবুজ ফাগে   চক্ষে আমার ধাঁদা লাগে—
    আমায় তোদের প্রাণের দাগে      দাগিস নে, ভাই, আর গো॥
    
১৮১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
            আমরা    নূতন প্রাণের চর      হা হা।
      আমরা থাকি পথে ঘাটে,    নাই আমাদের ঘর   হা হা॥
 নিয়ে পক্ক পাতার পুঁজি     পালাবে শীত, ভাবছ বুঝি গো?
ও-সব  কেড়ে নেব,   উড়িয়ে দেব  দখিন-হাওয়ার ’পর  হা হা॥
        তোমায়    বাঁধব নূতন ফুলের মালায়
              বসন্তের এই বন্দীশালায়।
   জীর্ণ জরার ছদ্মরূপে   এড়িয়ে যাবে চুপে চুপে?
তোমারসকল ভূষণ ঢাকা আছে,    নাই যে অগোচর  হা হা॥
    
১৮২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আর   নাই যে দেরি, নাই যে দেরি।
     সামনে সবার পড়ল ধরা  তুমি যে, ভাই, আমাদেরই॥
       হিমের বাহু-বাঁধন টুটিপাগলাঝোরা পাবে ছুটি,
       উত্তরে এই হাওয়া তোমার     বইবে উজান কুঞ্জ ঘেরি॥
     নাই যে দেরি, নাই যে দেরি।
     শুনছ না কি জলে স্থলে  জাদুকরের বাজল ভেরী।
        দেখছ নাকি এই আলোকে   খেলছে হাসি রবির চোখে—
        সাদা তোমার শ্যামল হবে,    ফিরব মোর তাই যে হেরি॥
    
১৮৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     একি মায়া,    লুকাও কায়াজীর্ণ শীতের সাজে।
আমার  সয় না,  সয় না,  সয় না প্রাণে, কিছুতে সয় না যে॥
     কৃপণ হয়ে হে মহারাজ,   রইবে কি আজ
                  আপন ভুবন-মাঝে॥
   বুঝতে নারি বনের বীণা   তোমার প্রসাদ পাবে কিনা,
   হিমের হাওয়ায় গগন-ভরা ব্যাকুল রোদন বাজে॥
   কেন    মরুর পারে কাটাও বেলা রসের কাণ্ডারী।
        লুকিয়ে আছে কোথায় তোমার রূপের ভাণ্ডারী।
   রিক্তপাতা শুষ্ক শাখে,  কোকিল তোমার কই গো ডাকে—
        শূন্য সভা, মৌন বাণী, আমরা মরি লাজে॥
    
১৮৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     মোরা   ভাঙব তাপস, ভাঙব তোমার কঠিন তপের বাঁধন—
                  এবার    এই আমাদের সাধন॥
  চল্‌ কবি, চল্‌ সঙ্গে জুটে,           কাজ ফেলে তুই আ য় আ য় আয় রে ছুটে,
                  গানে গানে উদাস প্রাণে
             জাগা রে উন্‌মাদন, এবার   জাগা রে উন্‌মাদন॥
                             বকুলবনের মুগ্ধ হৃদয় উঠুক-না উচ্ছ্বাসি,
      নীলাম্বরের মর্ম-মাঝে বাজাও তোমার সোনার বাঁশি   বাজাও।
          পলাশরেণুর রঙ মাখিয়ে   নবীন বসন এনেছি এ,
                  সবাই মিলে দিই ঘুচিয়ে
                         পুরানো আচ্ছাদন, তোমার   পুরানো আচ্ছাদন॥
    
১৮৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শীতের বনে কোন্‌ সে কঠিন আসবে ব’লে
শিউলিগুলি ভয়ে মলিন বনের কোলে॥
আম্‌লকি-ডাল সাজল কাঙাল,   খসিয়ে দিল পল্লবজাল,
কাশের হাসি হাওয়ায় ভাসি যায় যে চলে॥
সইবে না সে পাতায় ঘাসে পাণ্ডুরতা,
তাই তো আপন রঙ ঘুচলো ঝুম্‌‍কোলতা।
উত্তরবায় জানায় শাসন,  পাতল তপের শুষ্ক আসন,
সাজ-খসাবার এই লীলা কার অট্টরোলে॥
    
১৮৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        নমো, নমো। নমো, নমো। নমো, নমো।
নির্দয় অতি করুণা তোমার—   বন্ধু, তুমি হে নির্মম॥
            যা-কিছু জীর্ণ করিবে দীর্ণ
                  দণ্ড তোমার দুর্দম॥
    
১৮৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হে সন্ন্যাসী,
       হিমগিরি ফেলে  নীচে নেমে এলে  কিসের জন্য।
       কুন্দমালতী  করিছে মিনতি,  হও প্রসন্ন॥
             যাহা-কিছু ম্লান বিরস জীর্ণ  দিকে দিকে দিলে করি বিকীর্ণ।
             বিচ্ছেদভারে  বনচ্ছায়ারে   করে বিষণ্ণ— হও প্রসন্ন॥
    ‍   সাজাবে কি ডালা, গাঁথিবে কি মালা  মরণসত্রে!
       তাই উত্তরী,    নিলে ভরি ভরি,    শুকানো পত্রে?
             ধরণী যে তব তাণ্ডবে সাথি  প্রলয়বেদনা নিল বুকে পাতি।
             রুদ্র, এবারে বরবেশে তারে   করো গো ধন্য— হও প্রসন্ন॥
    
১৮৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    নব বসন্তের দানের ডালি
            এনেছি তোদেরই দ্বারে,
                   আ য়  আ য়  আ য়
                           পরিবি গলার হারে॥
   লতার বাঁধন হারায়ে মাধবী মরিছে কেঁদে,
           বেণীর বাঁধনে রাখিবি, বেঁধে—
                  অলকদোলায় দোলাবি তারে
                              আ য়  আ য়  আ য়॥
   বনমধুরি করিবি চুরি   আপন নবীন মাধুরিতে—
  সোহিনী রাগিণী    জাগাবে সে তোদের
        দেহের বীণার তারে তারে,
            আ য়  আ য়  আ য়॥
    
১৮৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এস’  এস’ বসন্ত, ধরাতলে।
আন’ মুহু মুহু নব তান, আন’  নব প্রাণ  নব গান।
আন’            গন্ধমদভরে অলস সমীরণ।
আন’            বিশ্বের অন্তরে অন্তরে নিবিড় চেতনা।
আন’            নব উল্লাসহিল্লোল।
আন’ আন’     আনন্দছন্দের হিন্দোলা ধরাতলে।
ভাঙ’ ভাঙ’     বন্ধনশৃঙ্খল।
আন’ আন’     উদ্দীপ্ত প্রাণের বেদনা ধরাতলে।
এস’  থরথরকম্পিত  মর্মরমুখরিত  নবপল্লবপুলকিত
ফুল-  আকূল মালতীবল্লিবিতানে—  সুখছায়ে, মধুবায়ে।
এস’  বিকশিত উন্মুখ,  এস’ চির-উৎসুক  নন্দনপথচিরযাত্রী।
এস’  স্পন্দিত নন্দিত চিত্তনিলয়ে  গানে গানে, প্রাণে প্রাণে।
এস’  অরুণচরণ কমলবরন তরুণ উষার কোলে।
এস’  জ্যোৎস্নাবিবশ নিশীথে,  কলকল্লোল তটিনী-তীরে,
সুখ-  সুপ্ত সরসী-নীরে।  এস’ এস’।
এস’  তড়িৎ-শিখা-সম ঝঞ্ঝাচরণে  সিন্ধুতরঙ্গদোলে।
এস’  জাগর মুখর প্রভাতে।
এস’  নগরে প্রান্তরে বনে।
এস’  কর্মে বচনে মনে। এস’ এস’।
এস’  মঞ্জীরগুঞ্জর চরণে।
এস’  গীতমুখর কলকণ্ঠে।
এস’  মঞ্জুল মল্লিকামাল্যে।
এস’  কোমল কিশলয়বসনে।
এস’  সুন্দর, যৌবনবেগে।
এস’  দৃপ্ত বীর, নবতেজে।
ওহে    দুর্মদ, কর জয়যাত্রা,
চল’  জরাপরাভব সমরে
        পবনে কেশররেণু ছড়ায়ে,
        চঞ্চল কুন্তল উড়ায়ে॥
    
১৯০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                           আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
                  তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে
                           কোরো না বিড়ম্বিত তারে॥
                  আজি    খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,
                  আজি    ভুলিয়ো আপন পর ভুলিয়ো,
                  এই      সঙ্গীতমুখরিত গগনে
                  তব      গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো।
                  এই      বাহির-ভুবনে দিশা হারায়ে
                  দিয়ো    ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে॥
                  একি     নিবিড় বেদনা বনমাঝে
                  আজি    পল্লবে পল্লবে বাজে—
                  দূরে     গগনে কাহার পথ চাহিয়া
                  আজি    ব্যাকুল বসুন্ধরা সাজে।
                  মোর     পরানে দখিনবায়ু লাগিছে,
                  কারে    দ্বারে দ্বারে কর হানি মাগিছে—
                  এই      সৌরভবিহ্বল রজনী
                  কার     চরণে ধরণীতলে জাগিছে।
                  ওহে     সুন্দর, বল্লভ, কান্ত,
                  তব      গম্ভীর আহবান কারে॥
    
১৯১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এনেছ ওই শিরীষ বকুল আমের মুকুল সাজিখানি হাতে করে।
        কবে যে সব ফুরিয়ে দেবে, চলে যাবে দিগন্তরে॥
   পথিক, তোমায় আছে জানা,    করব না গো তোমায় মানা—
    যাবার বেলায় যেয়ো যেয়ো বিজয়মালা মাথায় প’রে॥
তবু তুমি আছ যতক্ষণ
অসীম হয়ে ওঠে হিয়ায় তোমারি মিলন।
        যখন যাবে তখন প্রাণে     বিরহ মোর ভরবে গানে—
        দূরের কথা সুরে বাজে সকল বেলা ব্যথায় ভ’রে॥
    
১৯২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                   ও মঞ্জরী, ও মঞ্জরী আমের মঞ্জরী,
        আজ     হৃদয় তোমার উদাস হয়ে পড়ছে কি ঝরি॥
        আমার   গান যে তোমার গন্ধে মিশে          দিশে দিশে
                           ফিরে ফিরে ফেরে গুঞ্জরি॥
                  পূর্ণিমাচাঁদ তোমার শাখায় শাখায়
        তোমার           গন্ধ-সাথে আপন আলো মাখায়।
                  ওই      দখিন-বাতাস গন্ধে পাগল  ভাঙল আগল,
                           ঘিরে ঘিরে ফিরে সঞ্চরি॥
    
১৯৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কার যেন এই মনের বেদন চৈত্রমাসের উতল হাওয়ায়,
ঝুমকোলতার চিকন পাতা কাঁপে রে কার চম্‌‍কে-চাওয়ায়॥
        হারিয়ে-যাওয়া কার সে বাণী         কার সোহাগের স্মরণখানি
                  আমের বোলের গন্ধে মিশে
                           কাননকে আজ কান্না পাওয়ায়॥
কাঁকন-দুটির রিনিঝিনি কার বা এখন মনে আছে।
সেই কাঁকনের ঝিকিমিকি পিয়ালবনের শাখায় নাচে।
        যার চোখের ওই আভাস দোলে      নদী-ঢেউয়ের কোলে কোলে
                  তার সাথে মোর দেখা ছিল
                           সেই সেকালের তরী-বাওয়ায়॥
    
১৯৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দোলে  দোলে   দোলে প্রেমের দোলন-চাঁপা হৃদয়-আকাশে,
দোল-ফাগুনের চাঁদের আলোর সুধায় মাখা সে॥
    কৃষ্ণরাতের অন্ধকারে  বচনহারা ধ্যানের পারে
         কোন্‌ স্বপনের পর্ণপুটে ছিল ঢাকা সে॥
দখিন-হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল গোপন রেণুকা।
গন্ধে তারি ছন্দে মাতে কবির বেণুকা।
    কোমল প্রাণের পাতে পাতে    লাগল যে রঙ পূর্ণিমাতে
        আমার গানের সুরে সুরে রইল আঁকা সে॥
    
১৯৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অনন্তের বাণী তুমি, বসন্তের মাধুরী-উৎসবে
আনন্দের মধুপাত্র পরিপূর্ণ করি দিবে কবে॥
        বঞ্জুলনিকুঞ্জতলে   সঞ্চরিবে লীলাচ্ছলে,
        চঞ্চল অঞ্চলগন্ধে বনচ্ছায়া রোমাঞ্চিত হবে॥
মন্থর মঞ্জুল ছন্দে মঞ্জীরের গুঞ্জনকল্লোল
আন্দোলিবে ক্ষণে ক্ষণে অরণ্যের হৃদয়হিন্দোল।
    নয়নপল্লবে হাসি  হিল্লোলি উঠিবে ভাসি,
    মিলনমল্লিকামাল্য পরাইবে পরানবল্লভে॥
    
১৯৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এবার এল সময় রে তোর শুক্‌‍নো-পাতা-ঝরা—
যায় বেলা যায়, রৌদ্র হল খরা॥
      অলস ভ্রমর ক্লান্তপাখা মলিন ফুলের দলে
      অকারণে দোল দিয়ে যায় কোন্‌ খেয়ালের ছলে।
               স্তব্ধ বিজন ছায়াবীথি
                            বনের-ব্যথা-ভরা॥
মনের মাঝে গান থেমেছে, সুর নাহি আর লাগে-
শ্রান্ত বাঁশি আর তো নাহি জাগে।
      যে গেঁথেছে মালাখানি সে গিয়েছে ভুলে,
      কোন্‌কালে সে পারে গেল সুদূর নদীকূলে।
                রইল রে তোর অসীম আকাশ,
                           অবাধপ্রসার ধরা॥
    
১৯৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওরে গৃহবাসী খোল্‌, দ্বার খোল্‌,  লাগল যে দোল।
      স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
            দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌॥
    রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে,
    রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে,
         নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।
                  দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌॥
বেণুবন মর্মরে দখিন বাতাসে,
প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে।
      মউমাছি ফিরে যাচি ফুলের দখিনা,
      পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা,
          মাধবীবিতানে বায়ুগন্ধে বিভোল।
               দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌॥
    
১৯৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একটুকু ছোঁওয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি—
তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী॥
     কিছু পলাশের নেশা,   কিছু বা চাঁপায় মেশা,
     তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি॥
যেটুকু কাছেতে আসে ক্ষণিকের ফাঁকে ফাঁকে
চকিত মনের কোণে স্বপনের ছবি আঁকে।
     যেটুকু যায় রে দূরে    ভাবনা কাঁপায় সুরে,
     তাই নিয়ে যায় বেলা নূপুরের তাল গুনি॥
    
১৯৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
           ওগো বধূ সুন্দরী,    তুমি মধুমঞ্জরী,
           পুলকিত চম্পার    লহো অভিনন্দন—
পর্ণের পাত্রে  ফাল্গুনরাত্রে  মুকুলিত মল্লিকা-মাল্যের বন্ধন।
           এনেছি বসন্তের   অঞ্জলি গন্ধের,
           পলাশের কুঙ্কুম  চাঁদিনির চন্দন—
পারুলের হিল্লোল,  শিরীষের হিন্দোল,  মঞ্জুল বল্লীর বঙ্কিম কঙ্কণ—
           উল্লাস-উতরোল বেণুবনকল্লোল,
           কম্পিত কিশলয়ে  মলয়ের চুম্বন।
                  তব আঁখিপল্লবে  দিয়ো আঁকি বল্লভে
                           গগনের নবনীল  স্বপ্নের অঞ্জন॥
    
২০০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার বনে বনে ধরল মুকুল,
            বহে   মনে মনে দক্ষিণহাওয়া।
    মৌমাছিদের ডানায় ডানায়
            যেন   উড়ে মোর উৎসুক চাওয়া॥
    গোপন স্বপনকুসুমে কে   এমন   সুগভীর রঙ দিল এঁকে—
নব কিশলয়শিহরনে     ভাবনা আমার হল ছাওয়া॥
                       ফাল্গুনপূর্ণিমাতে
                  এই দিশাহারা রাতে
নিদ্রাবিহীন গানে    কোন্‌     নিরুদ্দেশের পানে
     উদ্‌‍বেল গন্ধের জোয়ারতরঙ্গে  হবে মোর তরণী বাওয়া॥
    
২০১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
‘আমি    পথভোলা এক পথিক এসেছি।
      সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো, সকাল বেলার মল্লিকা,
                  আমায় চেন কি।’
      ‘চিনি তোমায় চিনি, নবীন পান্থ—
 বনে বনে ওড়ে তোমার রঙিন বসনপ্রান্ত।
ফাগুন প্রাতের উতলা গো, চৈত্র রাতের উদাসী,
         তোমার পথে আমরা ভেসেছি।’
‘ঘরছাড়া এই পাগলটাকে    এমন ক’রে কে গো ডাকে
                করুণ গুঞ্জরি
    যখন   বাজিয়ে বীণা বনের পথে বেড়াই সঞ্চরি।’
 ‘আমি তোমায় ডাক দিয়েছি ওগো উদাসী,
          আমি    আমের মঞ্জরী।
তোমায় চোখে দেখার আগে   তোমার স্বপন চোখে লাগে,
           বেদন জাগে গো—
       না চিনিতেই ভালো বেসেছি।’
 ‘যখন   ফুরিয়ে বেলা   চুকিয়ে খেলা   তপ্ত ধুলার পথে
        যাব   ঝরা ফুলের রথে—
           তখন    সঙ্গ কে লবি।’
        ‘লব    আমি মাধবী।’
‘যখন   বিদায়-বাঁশির সুরে সুরে   শুক্‌‍নো পাতা যাবে উড়ে
            সঙ্গে কে র’বি।’
   ‘আমি রব, উদাস হব ওগো উদাসী,
         আমি    তরুণ করবী।’
‘বসন্তের এই ললিত রাগে   বিদায়-ব্যথা লুকিয়ে জাগে—
           ফাগুন দিনে গো
      কাঁদন-ভরা হাসি হেসেছি।’
    
২০২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        আজি    দখিন-দুয়ার খোলা—
এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো।
        দিব    হৃদয়দোলায় দোলা,
এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো॥
        নব    শ্যামল শোভন রথে   এসো   বকুলবিছানো পথে,
এসো   বাজায়ে ব্যাকুল বেণু   মেখে   পিয়ালফুলের রেণু।
        এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো॥
এসো     ঘনপল্লবপুঞ্জে     এসো হে, এসো হে, এসো হে।
এসো     বনমল্লিকাকুঞ্জে     এসো হে, এসো হে, এসো হে।
মৃদু   মধুর মদির হেসে   এসো   পাগল হাওয়ার দেশে,
তোমার   উতলা উত্তরীয়   তুমি   আকাশে উড়ায়ে দিয়ো—
          এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো॥
    
২০৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বসন্তে কি শুধু কেবল ফোটা ফুলের মেলা রে।
দেখিস নে কি শুক্‌‍নো-পাতা ঝরা-ফুলের খেলা রে॥
       যে ঢেউ উঠে তারি সুরে   বাজে কি গান সাগর জুড়ে।
       যে ঢেউ পড়ে তাহারও সুর  জাগছে সারা বেলা রে।
       বসন্তে আজ দেখ্‌ রে তোরা ঝরা ফুলের খেলা রে॥
আমার প্রভুর পায়ের তলে   শুধুই কি রে মানিক জ্বলে।
চরণে তাঁর লুটিয়ে কাঁদে লক্ষ মাটির ঢেলা রে॥
       আমার গুরুর আসন-কাছে   সুবোধ ছেলে ক জন আছে।
       অবোধ জনে কোল দিয়েছেন, তাই আমি তাঁর চেলা রে।
       উৎসবরাজ দেখেন চেয়ে ঝরা-ফুলের খেলা রে॥
    
২০৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওগো   দখিন হাওয়া,   ও   পথিক হাওয়া,   দোদুল  দোলায়  দাও  দুলিয়ে।
    নূতন-পাতার-পুলক-ছাওয়া পরশখানি দাও বুলিয়ে॥
আমি   পথের ধারের ব্যাকুল বেণু   হঠাৎ তোমার সাড়া পেনু গো—
   আহা,   এসো আমার শাখায় শাখায় প্রাণের গানের ঢেউ তুলিয়ে॥
ওগো   দখিন হাওয়া,   ও   পথিক হাওয়া   পথের ধারে আমার বাসা।
   জানি তোমার আসা-যাওয়া, শুনি তোমার পায়ের ভাষা।
আমায়   তোমার ছোঁওয়া লাগলে পরে   একটুকুতেই কাঁপন ধরে গো —
   আহা,   কানে কানে একটি কথায় সকল কথা নেয় ভুলিয়ে॥
    
২০৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আকাশ আমায় ভরল আলোয়,   আকাশ আমি ভরব গানে।
সুরের  আবীর  হানব হাওয়ায়,   নাচের আবীর হাওয়ায় হানে॥
                  ওরে পলাশ, ওরে পলাশ,
        রাঙা রঙের শিখায় শিখায় দিকে দিকে আগুন জ্বলাস—
        আমার মনের রাগ রাগিণী রাঙা হল রঙিন তানে॥
দখিন-হাওয়ায় কুসুমবনের বুকের কাঁপন থামে না যে।
নীল আকাশে সোনার আলোয় কচি পাতার নূপুর বাজে।
                           ওরে শিরীষ, ওরে শিরীষ,
        মৃদু হাসির অন্তরালে গন্ধজালে শূন্য ঘিরিস—
        তোমার গন্ধ আমার কণ্ঠে আমার হৃদয় টেনে আনে॥
    
২০৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মোর   বীণা ওঠে কোন্‌ সুরে বাজি   কোন নব চঞ্চল ছন্দে।
মম    অন্তর কম্পিত আজি   নিখিলের হৃদয়স্পন্দে॥
       আসে কোন্‌ তরুণ অশান্ত,   উড়ে বসনাঞ্চলপ্রান্ত—
       আলোকের নৃত্যে বনান্ত   মুখরিত অধীর আনন্দে॥
       অম্বরপ্রাঙ্গণমাঝে   নিঃস্বর মঞ্জীর গুঞ্জে।
       অশ্রুত সেই তালে বাজে   করতালি পল্লবপুঞ্জে।
       কার পদপরশন-আশা   তৃণে তৃণে অর্পিল ভাষা—
       সমীরণ বন্ধনহারা   উন্‌মন কোন্‌ বনগন্ধে॥
    
২০৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওরে ভাই,   ফাগুন লেগেছে বনে বনে—
ডালে ডালে ফুলে ফলে   পাতায় পাতায় রে,
      আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে॥
      রঙে রঙে রঙিল আকাশ,   গানে গানে নিখিল উদাস—
      যেন চলচঞ্চল   নব পল্লবদল   মর্মরে মোর মনে মনে॥
                  হেরো হেরো অবনীর রঙ্গ,
                  গগনের করে তপোভঙ্গ।
হাসির আঘাতে তার   মৌন রহে না আর,
কেঁপে কেঁপে ওঠে খনে খনে।
      বাতাস ছুটিছে বনময় রে,   ফুলের না জানে পরিচয় রে।
      তাই বুঝি বারে বারে   কুঞ্জের দ্বারে দ্বারে
                  শুধায়ে ফিরিছে জনে জনে॥
    
২০৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এত দিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে
            দেখা পেলেম ফাল্গুনে॥
   বালক বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়—
            একি গো বিস্ময়।
   অবাক্‌ আমি তরুণ গলার গান শুনে॥
গন্ধে উদাস হাওয়ার মতো উড়ে তোমর উত্তরী,
   কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী।
তরুণ হাসির আড়ালে কোন্‌ আগুন ঢাকা রয়—
           এ কি গো বিস্ময়।
   অস্ত্র তোমার গোপন রাখো কোন্‌ তূণে॥
    
২০৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা।
বইল প্রাণে দখিন-হাওয়া আগুন-জ্বালা॥
  পিছের বাঁশি কোণের ঘরে   মিছে রে ওই কেঁদে মরে—
     মরণ এবার আনল আমার বরণডালা॥
যৌবনেরই ঝড় উঠেছে আকাশ-পাতালে।
নাচের তালের ঝঙ্কারে তার আমায় মাতালে।
  কুড়িয়ে নেবার ঘুচল পেশা,   উড়িয়ে দেবার লাগল নেশা—
     আরাম বলে ‘এল আমার যাবার পালা’॥
    
২১০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওরে   আয় রে তবে, মাৎ রে সবে আনন্দে
আজ             নবীন প্রাণের বসন্তে॥
     পিছন-পানের বাঁধন হতে   চল্‌ ছুটে আজ বন্যাস্রোতে,
     আপনাকে আজ দখিন-হাওয়ায় ছড়িয়ে দে রে দিগন্তে॥
বাঁধন যত ছিন্ন করো আনন্দে
আজ     নবীন প্রাণের বসন্তে।
     অকূল প্রাণের সাগর-তীরে   ভয় কী রে তোর ক্ষয়-ক্ষতিরে।
     যা আছে রে সব নিয়ে তোর ঝাঁপ দিয়ে পড়্‌ অনন্তে॥
    
২১১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বসন্ত, তোর শেষ করে দে, শেষ করে দে, শেষ করে দে রঙ্গ—
ফুল ফোটাবার খ্যাপামি, তোর উদ্দামতরঙ্গ॥
     উড়িয়ে দেবার ছড়িয়ে দেবার   মাতন তোমার থামুক এবার,
          নীড়ে ফিরে আসুক তোমার পথহারা বিহঙ্গ॥
তোমার   সাধের মুকুল কতই পড়ল ঝরে—
তারা    ধুলা হল,   তারা   ধুলা দিল ভরে।
     প্রখর তাপে জরোজরো   ফল ফলাবার সাধন ধরো,
          হেলাফেলার পালা তোমার এই বেলা হোক ভঙ্গ॥
    
২১২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   দিনশেষে বসন্ত যা প্রাণে গেল বলে
   তাই নিয়ে বসে আছি, বীণাখানি কোলে॥
      তারি সুর নেব ধরে
      আমারি গানেতে ভরে,
      ঝরা মাধবীর সাথে যায় সে যে চলে॥
         থামো থামো দখিনপবন,
         কী বারতা   এনেছ তা   কোরো না গোপন।
       যে দিনেরে নাই মনে   তুমি তারি উপবনে
       কী ফুল পেয়েছ খুঁজে— গন্ধে প্রাণ ভোলে॥
    
২১৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   সব দিবি কে সব দিবি পায়,   আয় আয় আয়।
   ডাক পড়েছে ওই শোনা যায়   ‘আয় আয় আয়’॥
         আসবে যে সে স্বর্ণরথে—  জাগবি কারা রিক্ত পথে
         পৌষ-রজনী তাহার আশায়,   আয় আয় আয়।
   ক্ষণেক কেবল তাহার খেলা,   হায় হায় হায়।
   তার পরে তার যাবার বেলা,   হায় হায় হায়।
         চলে গেলে জাগবি যবে   ধনরতন বোঝা হবে—
         বহন করা হবে যে দায়,   আয় আয় আয়॥
    
২১৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
               বাকি আমি রাখব না কিছুই—
         তোমার   চলার পথে পথে   ছেয়ে দেব ভুঁই॥
ওগো     মোহন, তোমার উত্তরীয়   গন্ধে তোমার ভরে নিয়ো,
          উজাড় করে দেব পায়ে   বকুল বেলা জুঁই॥
          দখিন-সাগর পার হয়ে যে   এলে পথিক তুমি,
আমার    সকল দেব অতিথিরে   আমি বনভূমি।
আমার    কুলায়-ভরা রয়েছে গান,   সব তোমারে করেছি দান—
          দেবার কাঙাল করে আমায় চরণ যখন ছুঁই॥
    
২১৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ফল ফলাবার আশা আমি মনে রাখি নি রে।
আজ আমি তাই মুকুল ঝরাই দক্ষিণসমীরে॥
      বসন্ত গান পাখিরা গায়,   বাতাসে তার সুর ঝরে যায়—
      মুকুল-ঝরার ব্যাকুল খেলা   আমারি সেই রাগিণীরে॥
জানি নে ভাই, ভাবি নে তাই কী হবে মোর দশা
যখন আমার সারা হবে সকল ঝরা খসা।
      এই কথা মোর শূন্য ডালে   বাজবে সে দিন তালে তালে—
      ‘চরম দেওয়ায় সব দিয়েছি   মধুর মধুযামিনীরে’॥
    
২১৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   যদি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে
   এই নব ফাল্গুনের দিনে— জানি নে, জানি নে॥
   সে কি আমার কুঁড়ির কানে   কবে কথা গানে গানে,
   পরান তাহার নেবে কিনে   এই নব ফাল্গুনের দিনে—
             জানি নে, জানি নে॥
       সে কি   আপন রঙে ফুল রাঙাবে।
       সে কি   মর্মে এসে ঘুম ভাঙাবে।
   ঘোমটা আমার নতুন পাতার   হঠাৎ দোলা পাবে কি তার,
   গোপন কথা নেবে জিনে   এই নব ফাল্গুনের দিনে—
              জানি নে, জানি নে॥
    
২১৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        ধীরে ধীরে ধীরে বও ওগো উতল হাওয়া,
        নিশীথরাতের বাঁশি বাজে— শান্ত হও গো শান্ত হও॥
আমি     প্রদীপশিখা তোমার লাগি   ভয়ে ভয়ে একা জাগি,
        মনের কথা কানে কানে মৃদু মৃদু কও॥
তোমার    দূরের গাথা     তোমার     বনের বাণী
        ঘরের কোণে দেহো আনি।
আমার কিছু কথা আছে   ভোরের বেলার তারার কাছে,
        সেই কথাটি তোমার কানে চুপিচুপি লও॥
    
২১৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   দখিন-হাওয়া জাগো জাগো,   জাগাও আমার সুপ্ত এ প্রাণ।
   আমি বেণু, আমার শাখায়  নীরব যে হায় কত-না গান।  জাগো জাগো॥
       পথের ধারে আমার কারা    ওগো পথিক বাঁধন-হারা,
   নৃত্য তোমার চিত্তে আমার   মুক্তি-দোলা করে যে দান।  জাগো জাগো॥
   গানের পাখা যখন খুলি     বাধা-বেদন তখন ভুলি।
       যখন আমার বুকের মাঝে   তোমার পথের বাঁশি বাজে
   বন্ধ ভাঙার ছন্দে আমার     মৌন-কাঁদন হয় অবসান।  জাগো জাগো॥
    
২১৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   সহসা     ডালপালা তোর উতলা যে   ও চাঁপা,   ও করবী!
     কারে তুই   দেখতে পেলি আকাশ-মাঝে জানি না যে॥
কোন্‌   সুরের মাতন হাওয়ায় এসে বেড়ায় ভেসে   ও চাঁপা,   ও করবী!
      কার নাচনের নূপুর বাজে   জানি না যে॥
               তোরে   ক্ষণে ক্ষণে চমক লাগে।
            কোন্‌ অজানার ধেয়ান তোমার মনে জাগে।
কোন্‌    রঙের মাতন উঠল দুলে   ফুলে ফুলে   ও চাঁপা,   ও করবী!
             কে সাজালে রঙিন সাজে   জানি না যে॥
    
২২০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   সে কি ভাবে গোপন রবে লুকিয়ে হৃদয় কাড়া।
   তাহার আসা হাওয়ায় ঢাকা, সে যে সৃষ্টিছাড়া॥
        হিয়ায় হিয়ায় জাগল বাণী,   পাতায় পাতায় কানাকানি—
        ‘ওই এল যে’ ‘ওই এল যে’ পরান দিল সাড়া॥
   এই তো আমার আপ্‌নারই এই ফুল-ফোটানোর মাঝে
   তারে দেখি নয়ন ভরে নানা রঙের সাজে।
        এই-যে পাখির গানে গানে   চরণধ্বনি বয়ে আনে,
        বিশ্ববীণার তারে তারে এই তো দিল নাড়া॥
    
২২১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওই)    ভাঙল হাসির বাঁধ।
অধীর হয়ে মতল কেন পূর্ণিমার ওই চাঁদ॥
       উতল হাওয়া ক্ষণে ক্ষণে   মুকুল-ছাওয়া বকুলবনে
       দোল দিয়ে যায় পাতায় পাতায়, ঘটায় পরমাদ॥
ঘুমের আঁচল আকুল হল কী উল্লাসের ভরে।
স্বপন যত ছড়িয়ে প’ল দিকে দিগন্তরে।
       আজ রাতের ওই পাগলামিরে   বাঁধবে বলে কে ওই ফিরে,
       শালবীথিকায় ছায়া গেঁথে তাই পেতেছে ফাঁদ॥
    
২২২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   ও আমার   চাঁদের আলো,   আজ ফাগুনের সন্ধ্যাকালে
   ধরা দিয়েছ যে আমার   পাতায় পাতায় ডালে ডালে॥
              যে গান তোমার সুরের ধারায়   বন্যা জাগায় তারায় তারায়
   মোর আঙিনায় বাজল সে সুর  আমার প্রাণের তালে তালে॥
   সব কুঁড়ি মোর ফুটে ওঠে তোমার হাসির ইশারাতে।
   দখিন-হাওয়া দিশাহারা আমার ফুলের গন্ধে মাতে।
      শুভ্র তুমি করলে বিলোল   আমার প্রাণে রঙের হিলোল—
                  মর্মরিত মর্ম গো,
                     মর্ম আমার জড়ায় তোমার হাসির জালে॥
    
২২৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        ও চাঁদ, তোমায় দোলা দেবে কে!       
              ও চাঁদ, তোমায় দোলা—
                    কে দেবে কে দেবে তোমায় দোলা—
    আপন আলোর স্বপন-মাঝে বিভোল ভোলা॥
কেবল তোমার চোখের চাওয়ায়   দোলা দিলে হাওয়ায় হাওয়ায়,
    বনে বনে দোল জাগালো ওই চাহনি তুফান-তোলা॥
          আজ মানসের সরোবরে
  কোন্‌ মাধুরীর কমলকানন দোলাও তুমি ঢেউয়ের ’পরে।
    তোমার হাসির আভাস লেগে    বিশ্ব-দোলন দোলার বেগে
        উঠল জেগে আমার গানের কল্লোলিনী কলরোলা॥
    
২২৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শুক্‌‍নো পাতা কে যে ছড়ায় ওই দূরে         উদাস-করা কোন্‌ সুরে॥
ঘর-ছাড়া ওই কে বৈরাগী     জানি না যে কাহার লাগি,
          ক্ষণে ক্ষণে শূন্য বনে যায় ঘুরে॥
             চিনি চিনি যেন ওরে হয় মনে,
                ফিরে ফিরে যেন দেখা ওর সনে।
ছদ্মবেশে কেন খেল,     জীর্ণ এ বাস ফেলো ফেলো—
          প্রকাশ করো চিরনূতন বন্ধুরে॥
    
২২৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমার   বাস কোথা যে পথিক ওগো, দেশে কি বিদেশে।
        তুমি হৃদয়-পূর্ণ-করা ওগো, তুমিই সর্বনেশে॥
‘আমার   বাস কোথা যে জান না কি,
        শুধাতে হয় সে কথা কি
            ও মাধবী, ও মালতী!’
হয়তো জানি, হয়তো জানি, হয়তো জানি নে,
        মোদের  বলে দেবে কে সে॥
মনে করি, আমার তুমি, বুঝি নও আমার।
    বলো বলো, বলো পথিক, বলো তুমি কার।
‘আমি তারি যে আমারে   যেমনি দেখে চিনতে পারে,
                  ও মাধবী, ও মালতী!’
            হয়তো চিনি, হয়তো চিনি, হয়তো চিনি নে,
                  মোদের     বলে দেবে কে সে॥
    
২২৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                  আজ  দখিন-বাতাসে
নাম-না-জানা কোন্‌ বনফুল ফুটল বনের ঘাসে।
‘ও মোর  পথের সাথি পথে পথে গোপনে যায় আসে।’
কৃষ্ণচূড়া চূড়ায় সাজে,   বকুল তোমার মালার মাঝে,
শিরীষ তোমার ভরবে সাজি ফুটেছে সেই আশে।
‘এ মোর   পথের বাঁশির সুরে সুরে লুকিয়ে কাঁদে হাসে।’
ওরে  দেখ বা নাই দেখ, ওরে    যাও বা না যাও ভুলে।
ওরে   নাই বা দিলে দোলা, ওরে   নাই বা নিলে তুলে।
সভায় তোমার ও কেহ নয়,   ওর সাথে নেই ঘরের প্রণয়,
যাওয়া-আসার আভাস নিয়ে রয়েছে এক পাশে।
‘ওগো  ওর সাথে মোর প্রাণের কথা নিশ্বাসে নিশ্বাসে।’
    
২২৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিদায় যখন চাইবে তুমি দক্ষিণসমীরে
       তোমায়   ডাকবা না ফিরে ফিরে॥
     করব তোমায় কী সম্ভাষণ,  কোথায় তোমার পাতব আসন
       পাতা-ঝরা কুসুম-ঝরা নিকুঞ্জকুটিরে॥
তুমি  আপনি যখন আস তখন  আপনি কর ঠাঁই—
       আপনি কুসুম ফোটাও, মোরা  তাই দিয়ে সাজাই।
     তুমি যখন যাও চলে যাও  সব আয়োজন হয় যে উধাও—
         গান ঘুহে যায়, রঙ মুছে যায়, তাকাই অশ্রুনীরে॥
    
২২৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                এবেলা   ডাক পড়েছে কোন্‌খানে
                ফাগুনের  ক্লান্ত ক্ষণের শেষ গানে॥
সেখানে স্তব্ধ বীণার তারে তারে  সুরের খেলা ডুব সাঁতারে—
                সেখানে   চোখ মেলে যার পাই নে দেখা
                তাহারে   মন জানে গো মন জানে॥
                এ বেলা   মন যেতে চায় কোন্‌খানে
                নিরালায়   লুপ্ত পথের সন্ধানে।
সেখানে  মিলনদিনের ভোলা হাসি  লুকিয়ে বাজায় করুণ-বাঁশি,
সেখানে  যে কথাটি হয় নি বলা  সে কথা  রয় কানে গো রয় কানে॥
    
২২৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
          না,   যেয়ো না, যেয়ো নাকো।
   মিলনপিয়াসী মোরা—  কথা রাখো, কথা রাখো॥
আজো বকুল আপনহারা  হায় রে,   ফুল-ফোটানো হয় নি সারা,
                         সাজি ভরে নি—
                   পথিক ওগ, থাকো থাকো॥
              চাঁদের চোখে জাগে নেশা,
          তার    আলো গানে গন্ধে মেশা।
দেখো চেয়ে কোন্‌ বেদনায়    হায় রে    মল্লিকা ওই যায় চলে যায়
                  অভিমানিনী—
          পথিক, তারে ডাকো ডাকো॥
    
২৩০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এবার  বিদায়বেলার সুর ধরো ধরো  ও চাঁপা, ও করবী!
            তোমার  শেষ ফুলে আজ সাজি ভরো॥
যাবার পথে আকাশতলে   মেঘ   রাঙা হল চোখের জলে,
                      ঝরে পাতা ঝরোঝরো॥
               হেরো হেরো ওই রুদ্র রবি
                      স্বপ্ন ভাঙায় রক্তছবি।
খেয়াতরীর রাঙা পালে    আজ    লাগল হাওয়া ঝড়ের তালে,
        বেণুবনের ব্যাকুল শাখা থরোথরো॥
    
২৩১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ             খেলা ভাঙার খেলা খেলবি আয়,
         সুখের বাসা ভেঙে ফেলবি আয়।
                      মিলনমালার আজ বাঁধন তো টুটবে,
               ফাগুন-দিনের আজ স্বপন তো ছুটবে—
                  উধাও মনের পাখা মেলবি আয়॥
       অস্তগিরির ওই শিখরচূড়ে
         ঝড়ের মেঘের আজ ধবজা উড়ে।
           কালবৈশাখীর হবে যে নাচন,
             সাথে নাচুক তোর মরণ বাঁচন—
                হাসি কাঁদন পায়ে ঠেলবি আয়॥
    
২৩২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ কি তাহার বারতা পেল রে কিশলয়।
        ওরা     কার কথা কয় রে    বনময়॥
আকাশে আকাশে দূরে দূরে      সুরে সুরে
        কোন্‌ পথিকের গাহে জয়॥
যেথা  চাঁপা-কোরকের শিখা জ্বলে
        ঝিল্লিমুখর ঘন বনতলে,
এসো কবি, এসো, মালা পরো,   বাঁশি ধরো—
        হোক গানে গানে বিনিময়॥
    
২৩৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  চরণরেখা তব যে পথে দিলে লেখি
  চিহ্ন আজি তারি আপনি ঘুচালে কি।
       অশোকরেণুগুলি  রাঙালো যার ধূলি
       তারে যে তৃণতলে  আজিকে লীন দেখি॥
  ফুরায় ফুল-ফোটা,   পাখিও গান ভোলে,
  দখিনবায়ু সেও  উদাসী যায় চলে।
       তবু কি ভরি তারে  অমৃত ছিল না রে—
       স্মরণ তারো কি গো  মরণে যাবে ঠেকি!
    
২৩৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নমো নমো, নমো নমো, নমো নমো,  তুমি সুন্দরতম।
                  নমো নমো নমো।
      দূর হইল দৈন্যদ্বন্দ্ব,  ছিন্ন হইল দুঃখবন্ধ—
            উৎসবপতি মহানন্দ  তুমি সুন্দরতম॥
    
২৩৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
            তোমার আসন পাতব কোথায় হে অতিথি।
       ছেয়ে গেছে শুকনো পাতায় কাননবীথি॥
 ছিল ফুটে মালতীফুল কুন্দকলি,
       উত্তরবায় লুঠ করে তায় গেল চলি—
                   হিমে বিবশ বনস্থলী বিরলগীতি
                               হে অতিথি॥
       সুর-ভোলা ওই ধরার বাঁশি লুটায় ভুঁয়ে,
 মর্মে তাহার তোমার হাসি দাও না ছুঁয়ে।
       মাতবে আকাশ নবীন রঙের তানে তানে,
                   পলাশ বকুল ব্যাকুল হবে আত্মদানে—
                         জাগবে বনের মুগ্ধ মনে মধুর স্মৃতি
                               হে অতিথি॥
    
২৩৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        কে)   রঙ লাগালে বনে বনে!
               ঢেউ জাগালে সমীরণে॥
আজ ভুবনের দুয়ার খোলা  দোল দিয়েছে বনের দোলা—
            দে দোল! দে দোল! দে দোল!
    কোন্‌ ভোলা সে ভাবে-ভোলা  খেলায় প্রাঙ্গণে॥
আন্‌ বাঁশি— আন্‌ রে তোর আন্‌ রে বাঁশি,
                উঠল সুর উচ্ছ্বাসি  ফাগুন-বাতাসে।
    আজ  দে ছড়িয়ে ছড়িয়ে  শেষ বেলাকার কান্না হাসি—
সন্ধ্যাকাশের বুক-ফাটা সুর  বিদায়-রাতি করবে মধুর,
    মাতল আজি অস্তসাগর সুরের প্লাবনে॥
    
২৩৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মন যে বলে চিনি চিনি যে গন্ধ বয় এই সমীরে।
কে ওরে কয় বিদেশিনী চৈত্ররাতের চামেলিরে॥
রক্তে রেখে গেছে ভাষা,
স্বপ্নে ছিল যাওয়া-আসা—
কোন্‌ যুগে কোন্‌ হাওয়ার পথে, কোন্‌ বনে, কোন্‌ সিন্ধুতীরে।
এই সুদূরে পরবাসে
ওর বাঁশি আজ প্রাণে আসে।
মোর পুরাতন দিনের পাখি
ডাক শুনে তার উঠল ডাকি,
চিত্ততলে জাগিয়ে তোলে অশ্রুজলের ভৈরবীরে॥
    
২৩৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বকুলগন্ধে বন্যা এল দখিন-হাওয়ার স্রোতে।
পুষ্পধনু, ভাসাও তরী নন্দনতীর হতে॥
পলাশকলি দিকে দিকে  তোমার আখর দিল লিখে,
চঞ্চলতা জাগিয়ে দিল অরণ্যে পর্বতে॥
আকাশ-পারে পেতে আছে একলা আসনখানি—
নিত্যকালের সেই বিরহীর জাগল আশার বাণী॥
পাতায় পাতায় ঘাসে ঘাসে  নবীন প্রাণের পত্র আসে,
পলাশ-জবায় কনক-চাঁপায় অশোকে অশ্বত্থে॥
    
২৩৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাসন্তী, হে ভূবনমোহিনী,
দিকপ্রান্তে, বনবনান্তে,
শ্যাম প্রান্তরে, আম্রছায়ে,
সরোবরতীরে, নদীনীরে,
নীল আকাশে, মলয়বাতাসে,
ব্যাপিল অনন্ত তব মাধুরী॥
নগরে গ্রামে কাননে, দিনে নিশীথে,
পিকসঙ্গীতে, নৃত্যগীতকলনে, বিশ্ব আনন্দিত।
ভবনে ভবনে  বীণাতান রণ-রণ ঝঙ্কৃত।
মধুমোদিত হৃদয়ে হৃদয়ে রে
নবপ্রাণ উচ্ছ্বসিল আজি,
বিচলিত চিত উচ্ছ্বলি উন্মাদনা
ঝন-ঝন ঝনিল মঞ্জীরে মঞ্জীরে॥
    
২৪০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আন্‌ গো তোরা কার কী আছে,
দেবার হাওয়া বইল দিকে দিগন্তরে—
        এই সুসময় ফুরায় পাছে॥
কুঞ্জবনের অঞ্জলি যে ছপিয়ে পড়ে,
পলাশকানন ধৈর্য হারায় রঙের ঝড়ে,
         বেণুর শাখা তালে মাতাল পাতার নাচে॥
প্রজাপতি রঙ ভাসালো নীলাম্বরে,
মৌমাছিরা ধ্বনি উড়ায় বাতাস-’পরে।
    দখিন-হাওয়া হেঁকে বেড়ায় ‘জাগো জাগো’,
    দোয়েল কোয়েল গানের বিরাম জানে না গো—
      রক্ত রঙের জাগল প্রলাপ অশোক-গাছে॥
    
২৪১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ফাগুন,   হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান—
    তোমার  হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান—
আমার  আপনহারা প্রাণ  আমার  বাঁধন-ছেঁড়া প্রাণ॥
    তোমার  অশোকে কিংশুকে
    অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে,
    তোমার  ঝাউয়ের দোলে
    মর্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান॥
পূর্ণিমাসন্ধ্যায়  তোমার  রজনীগন্ধায়
রূপসাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়।
     তোমার  প্রজাপতির পাখা
     আমার  আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙিন-স্বপন-মাখা।
     তোমার  চাঁদের আলোয়
     মিলায় আমার সুখদুঃখের সকল অবসান॥
    
২৪২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নিবিড় অমা-তিমির হতে  বাহির হল জোয়ার-স্রোতে
    শুক্লরাতে চাঁদের তরণী।
       ভরিল ভরা অরূপ ফুলে, সাজালো ডালা অমরাকূলে
            আলোর মালা চামেলি-বরনী॥
তিথির পরে তিথির ঘাটে  আসিছে তরি দোলের নাটে,
    নীরবে হাসে স্বপনে ধরণী।
        উৎসবের পসরা নিয়ে  পূর্ণিমার কূলেতে কি এ
            ভিড়িল শেষে তন্দ্রাহরণী॥
    
২৪৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     হে মাধবী, দ্বিধা কেন, আসিবে কি ফিরিবে কি—
     আঙিনাতে বাহিরিতে মন কেন গেল ঠেকি॥
     বাতাসে লুকায়ে থেকে   কে যে তোরে গেছে ডেকে,
     পাতায় পাতায় তোরে পত্র সে যে গেছে লেখি॥
     কখন্‌ দখিন হতে কে দিল দুয়ার ঠেলি,
     চমকি উঠিল জাগি চামেলি নয়ন মেলি।
     বকুল পেয়েছে ছাড়া,     করবী দিয়েছে সাড়া,
     শিরীষ শিহরি উঠে দূর হতে কারে দেখি॥
    
২৪৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
             ওরা     অকারণে চঞ্চল।
     ডালে ডালে   দোলে বায়ুহিল্লোলে   নব পল্লবদল॥
 ছড়ায়ে ছড়ায়ে ঝিকিমিকি আলো
            দিকে দিকে ওরা কী খেলা খেলালো,
    মর্মরতানে প্রাণে ওরা আনে কৈশোরকোলাহল॥
 ওরা   কান পেতে শোনে     গগনে গগনে
         নীরবের কানাকানি,
             নীলিমার কোন্‌ বাণী।
 ওরা   প্রাণঝরনার উচ্ছল ধার,   ঝরিয়া ঝরিয়া বহে অনিবার,
     চির তাপসিনী ধরণীর ওরা শ্যামশিখা হোমানল॥
    
২৪৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     ফাগুনের নবীন আনন্দে
     গানখানি গাঁথিলাম ছন্দে॥
         দিল তারে বনবীথি   কোকিলের কলগীতি,
               ভরি দিল বকুলের গন্ধে॥
     মাধবীর মধুময় মন্ত্র
     রঙে রঙে রাঙালো দিগন্ত।
         বাণী মম নিল তুলি     পলাশের কলিগুলি,
               বেঁধে দিল তব মণিবন্ধে॥
    
২৪৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    বেদনা কী ভাষায় রে
           মর্মে মর্মরি গুঞ্জরি বাজে॥
    সে বেদনা সমীরে সমীরে সঞ্চারে,
      চঞ্চল বেগে বিশ্বে দিল দোলা॥
           দিবানিশা  আছি  নিদ্রাহরা  বিরহে
      তব নন্দনবন-অঙ্গনদ্বারে,
          মনোমোহন বন্ধু—
              আকুল প্রাণে
          পারিজাতমালা সুগন্ধ হানে॥
    
২৪৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      চলে যায় মরি হায় বসন্তের দিন।
      দূর শাখে পিক ডাকে বিরামবিহীন॥
         অধীর সমীর-ভরে   উচ্ছসি বকুল ঝরে,
         গন্ধ-সনে হল মন সুদূরে বিলীন॥
      পুলকিত আম্রবীথি ফাল্গুনেরই তাপে,
      মধুকরগুঞ্জরণে ছায়াতল কাঁপে।
         কেন আজি অকারণে   সারা বেলা আনমনে
         পরানে বাজায় বীণা কে গো উদাসীন॥
    
২৪৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      বসন্তে বসন্তে তোমার কবিরে দাও ডাক—
             যায় যদি সে যাক॥
  রইল তাহার বাণী   রইল ভরা সুরে,   রইবে না সে দূরে—
     হৃদয় তাহার কুঞ্জে তোমার রইবে না নির্বাক্‌॥
            ছন্দ তাহার রইবে বেঁচে
        কিশলয়ের নবীন নাচে নেচে নেচে॥
  তারে   তোমার বীণা যায় না যেন ভুলে,
             তোমার ফুলে ফুলে
                মধুকরের গুঞ্জরণে বেদনা তার থাক্‌॥
    
২৪৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   যখন     মল্লিকাবনে প্রথম ধরেছে কলি
   তোমার লাগিয়া তখনি, বন্ধু, বেঁধেছিনু অঞ্জলি॥
           তখনো কুহেলিজালে,
           সখা,     তরুণী ঊষার ভালে
   শিশিরে শিশিরে অরুণমালিকা উঠিতেছে ছলোছলি॥
   এখনো বনের গান   বন্ধু,   হয় নি তো অবসান—
      তবু   এখনি যাবে কি চলি।
      ও মোর   করুণ বল্লিকা,
      ও তোর   শ্রান্ত মল্লিকা
   ঝরো-ঝরো হল, এই বেলা তোর শেষ কথা দিস বলি॥
    
২৫০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  ক্লান্ত যখন আম্রকলির কাল,     মাধবী ঝরিল ভূমিতলে অবসন্ন,
  সৌরভধনে তখন তুমি হে শালমঞ্জরী     বসন্তে কর ধন্য॥
  সান্ত্বনা মাগি দাঁড়ায় কুঞ্জভূমি     রিক্ত বেলায় অঞ্চল যবে শূন্য—
  বনসভাতলে সবার ঊধের্ব তুমি,     সব-অবসানে তোমার দানের পুণ্য॥
    
২৫১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তুমি কিছু দিয়ে যাও    মোর প্রাণে গোপনে গো—
ফুলের গন্ধে বাঁশির গানে,   মর্মরমুখরিত পবনে॥
   তুমি কিছু নিয়ে যাও   বেদনা হতে বেদনে—
   যে মোর অশ্রু হাসিতে লীন,   যে বাণী নীরব নয়নে॥
    
২৫২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজি এই   গন্ধবিধুর সমীরণে
কার   সন্ধানে ফিরি বনে বনে॥
আজি ক্ষুব্ধ নীলাম্বরমাঝে  একি  চঞ্চল ত্রন্দন বাজে।
সুদূর দিগন্তের সকরুণ সঙ্গীত   লাগে মোর চিন্তায় কাজে—
আমি   খুঁজি কারে অন্তরে মনে   গন্ধবিধুর সমীরণে॥
ওগো,  জানি না কী নন্দনরাগে
সুখে   উৎসুক যৌবন জাগে।
আজি   আম্রমুকুলসৌগন্ধে,  নব  পল্লবমর্মরছন্দে,
      চন্দ্রকিরণসুধাসিঞ্চিত অম্বরে  অশ্রুসরস মহানন্দে,
আমি   পুলকিত কার পরশনে  গন্ধবিধুর সমীরণে॥
    
২৫৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এবার   ভাসিয়ে দিতে হবে আমার এই তরী—
         তীরে ব’সে যায় যে বেলা, মরি গো মরি॥
      ফুল-ফোটানো সারা ক’রে   বসন্ত যে গেল সরে,
    নিয়ে ঝরা ফুলের ডালা বলো কী করি॥
জল উঠেছে ছল্‌ছলিয়ে, ঢেউ উঠেছে দুলে,
    মর্মরিয়ে ঝরে পাতা বিজন তরুমূলে।
      শূন্যমনে কোথায় তাকাস।
   ওরে,   সকল বাতাস সকল আকাশ
আজি   ওই পারের ওই বাঁশির সুরে উঠে শিহরি॥
    
২৫৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   বসন্তে আজ ধরার চিত্ত হল উতলা,
বুকের ’পরে দোলে  দোলে দোলে  দোলে রে তার পরানপুতলা॥
       আনন্দেরই ছবি দোলে  দিগন্তেরই কোলে কোলে,
গান দুলিছে  দোলে দোলে  গান দুলিছে নীল-আকাশের হৃদয়-উতলা॥
   আমার দুটি মুগ্ধ নয়ন নিদ্রা ভুলেছে।
   আজি আমার হৃদয়দোলায় কে গো দুলিছে।
       দুলিয়ে দিল সুখের রাশি   লুকিয়ে ছিল যতেক হাসি—
দুলিয়ে দিল  দোলে দোলে  দুলিয়ে দিল জনম-ভরা ব্যথা অতলা॥
    
২৫৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    অনেক দিনের মনের মানুষ   যেন এলে কে
    কোন্‌   ভুলে-যাওয়া বসন্ত থেকে॥
        যা-কিছু সব গেছ ফেলে   খুঁজতে এলে হৃদয়ে,
        পথ চিনেছ চেনা ফুলের চিহ্ন দেখে॥
বুঝি      মনে তোমার আছে আশা—
আমার    ব্যথায় তোমার মিলবে বাসা।
        দেখতে এলে সেই-যে বীণা   বাজে কিনা  হৃদয়ে,
        তারগুলি তার ধুলায় ধুলায়    গেছে কি ঢেকে॥
    
২৫৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     পুরাতনকে বিদায় দিলে না যে   ওগো নবীন রাজা।
শুধু বাঁশি তোমার বাজালে তার পরান-মাঝে   ওগো নবীন রাজা॥
মন্ত্র যে তার লাগল প্রাণে   মোহন গানে  হায়,
বিকশিয়া উঠল হিয়া নবীন সাজে   ওগো নবীন রাজা॥
তোমার রঙে দিলে তুমি রাঙিয়া   ও তার আঙিয়া   ওগো নবীন রাজা।
তোমার মালা দিলে গলে   খেলার ছলে   হায়—
তোমার  সুরে সুরে তাহার বীণা বাজে   ওগো নবীন রাজা॥
    
২৫৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      ঝরো-ঝরো ঝরো-ঝরো ঝরে রঙের ঝর‌্না।
   আ য়  আ য়  আ য়  আয় সে রসের সুধায় হৃদয় ভর্-না॥
সেই  মুক্ত বন্যাধারায় ধারায়   চিত্ত মৃত্যু-আবেশ হারায়,
      ও সেই  রসের পরশ পেয়ে ধরা নিত্যনবীনবর্ণা॥
তার কলধ্বনি দখিন-হাওয়ায় ছড়ায় গগনময়,
      মর্মরিয়া আসে ছুটে নবীন কিশলয়।
বনের  বীণায় বীণায় ছন্দ জাগে   বসন্তপঞ্চমের রাগে—
ও সেই   সুরে সুরে সুর মিলিয়ে আনন্দগান ধর্-না॥
    
২৫৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পূর্বাচলের পানে তাকাই অস্তাচলের ধারে আসি।
ডাক দিয়ে যার সাড়া না পাই তার লাগি আজ বাজাই বাঁশি॥
    যখন এ কূল যাব ছাড়ি   পারের খেয়ায় দেব পাড়ি,
    মোর ফাগুনের গানের বোঝা বাঁশির সাথে যাবে ভাসি॥
সেই-যে আমার বনের গলি রঙিন ফুলে ছিল আঁকা
সেই ফুলেরই ছিন্ন দলে চিহ্ন যে তার পড়ল ঢাকা।
    মাঝে মাঝে কোন্‌ বাতাসে   চেনা দিনের গন্ধ আসে,
হঠাৎ বুকে চমক লাগায় আধ-ভোলা সেই কান্নাহাসি॥
    
২৬০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীল আকাশের কোণে কোণে ওই বুঝি আজ শিহর লাগে  আহা।
শাল-পিয়ালের বনে বনে কেমন যেন কাঁপন জাগে  আহা॥
       সুদূরে কার পায়ের ধ্বনি   গণি গণি দিন-রজনী
            ধরণী তার চরণ মাগে  আহা॥
দখিন-হাওয়া ক্ষণে ক্ষণে কেন ডাকিস  জাগো জাগো’।
ফিরিস মেতে শিরীষবনে, শোনাস কানে কোন্‌ কথা গো।
        শূন্যে তোমার ওগো প্রিয়  উত্তরীয় উড়ল কি ও
             রবির আলো রঙিন রাগে  আহা॥
    
২৬১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মাধবী   হঠাৎ কোথা হতে   এল   ফাগুন-দিনের স্রোতে।
      এসে   হেসেই বলে, ‘যা ই   যা ই   যাই।’
পাতারা             ঘিরে দলে দলে   তারে   কানে কানে বলে,
            ‘না   না   না।’
        নাচে   তা ই   তা ই   তাই॥
আকাশের   তারা বলে তারে,     ‘তুমি    এসো গগন-পারে,
         তোমায়   চা ই   চা ই   চাই।’
পাতারা    ঘিরে দলে দলে   তারে   কানে কানে বলে,
           ‘না   না   না।’
        নাচে   তা ই   তা ই   তাই॥
বাতাস    দখিন হতে আসে,   ফেরে   তারি পাশে পাশে,
          বলে,   ‘আ য়   আয়   আয়।’
বলে,     ‘নীল অতলের কূলে   সুদূরে   অস্তাচলের মূলে
          বেলা   যা য়   যা য়   যায়।’
বলে,   পূর্ণশশীর রাতি   ত্রমে   হবে মলিন-ভাতি,
          সময়  না ই   নাই   নাই।’
পাতারা  ঘিরে দলে দলে   তারে   কানে কানে বলে,
            ‘না   না   না।’
         নাচে   তা ই   তা ই   তাই॥
    
২৬২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
       নীল   দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল।
            বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল॥
আকাশের   লাগে ধাঁধা     রবির আলো ওই কি বাঁধা॥
      বুঝি   ধরার কাছে আপনাকে সে মাগল।
           সর্ষেক্ষেতে ফুল হয়ে তাই জাগল॥
      নীল   দিগন্তে মোর বেদনখানি লাগল।
           অনেক কালের মনের কথা জাগল।
এল আমার হারিয়ে-যাওয়া   কোন্‌ ফাগুনের পাগল হাওয়া।
      বুঝি   এই ফাগুনে আপনাকে সে মাগল।
            সর্ষেক্ষেতে ঢেউ হয়ে তাই জাগল॥
    
২৬৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বসন্ত তার গান লিখে যায় ধূলির ’পরে   কী আদরে॥
তাই সে ধুলা ওঠে হেসে   বারে বারে নবীন বেশে,
বারে বারে রূপের সাজি আপনি ভরে   কী আদরে॥
তেমনি পরশ লেগেছে মোর হৃদয়তলে,
সে যে তাই   ধন্য হল মন্ত্রবলে।
তাই প্রাণে কোন্‌ মায়া জাগে,   বারে বারে পুলক লাগে,
বারে বারে গানের মুকুল আপনি ধরে   কী আদরে॥
    
২৬৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        ফাগুনের   শুরু হতেই শুকনো পাতা ঝরল যত
    তারা আজ   কেঁদে শুধায়,   ‘সেই ডালে ফুল ফুটল কি গো,
              ওগো কও   ফুটল কত।’
         তারা কয়,   ‘হঠাৎ হাওয়ায় এল ভাসি  
                           মধুরের সুদূর হাসি,   হায়।
         খ্যাপা হাওয়ায় আকুল হয়ে ঝরে গেলেম শত শত।’
তারা কয়,   ‘আজ কি তবে এসেছে সে   নবীন বেশে।
    আজ কি তবে এত ক্ষণে   জাগল বনে   যে গান ছিল মনে মনে।
        সেই বারতা কানে নিয়ে
             যাই চলে এই বারের মতো।’
    
২৬৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
         ফাগুনের পূর্ণিমা   এল কার লিপি হাতে।
         বাণী তার বুঝি না রে,   ভরে মন বেদনাতে॥
            উদয়শৈলমূলে   জীবনের কোন্‌ কূলে
            এই বাণী জেগেছিল   কবে কোন্‌ মধুরাতে॥
         মাধবীর মঞ্জরী   মনে আনে বারে বারে
         বরণের মালা গাঁথা   স্মরণের পরপারে।
            সমীরণে কোন্‌ মায়া   ফিরিছে স্বপনকায়া,
            বেণুবনে কাঁপে ছায়া   অলখ-চরণ-পাতে॥
    
২৬৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এক ফাগুনের গান সে আমার    আর ফাগুনের কূলে কূলে
কার খোঁজে আজ পথ হারালো    নতুন কালের ফুলে ফুলে॥
শুধায় তারে বকুল-হেনা,   ‘কেউ আছে কি তোমার চেনা।’
        সে বলে, ‘হায়, আছে কি নাই  
                   না বুঝে তাই বেড়াই ভুলে
                   নতুন কালের ফুলে ফুলে।’
এক ফাগুনের মনের কথা    আর ফাগুনের কানে কানে
গুঞ্জরিয়া কেঁদে শুধায়,    ‘মোর ভাষা আজ কেই বা জানে।’
আকাশ বলে, ‘কে জানে সে   কোন্‌ ভাষা যে বেড়ায় ভেসে।’
        ‘হয়তো জানি’ ‘হয়তো জানি’  
                   বাতাস বলে দুলে দুলে
                   নতুন কালের ফুলে ফুলে॥
    
২৬৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                নিশীথরাতের প্রাণ
   কোন্‌ সুধা যে চাঁদের আলোয় আজ করেছে পান॥
        মনের সুখে তাই   আজ   গোপন কিছু নাই,
   আঁধার-ঢাকা ভেঙে ফেলে সব করেছে দান॥
   দখিন-হাওয়ায় তার   সব খুলেছে দ্বার।
        তারি নিমন্ত্রণে   আজি   ফিরি বনে বনে
              সঙ্গে করে এনেছি এই
                     রাত-জাগা মোর গান॥
    
২৬৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   চেনা ফুলের গন্ধস্রোতে ফাগুন-রাতের অন্ধকারে
   চিত্তে আমার ভাসিয়ে আনে নিত্যকালের অচেনারে॥
       একদা কোন্‌ কিশোর-বেলায়   চেনা চোখের মিলন-মেলায়
       সেই তো খেলা করেছিল কান্নাহাসির ধারে ধারে॥
   তারি ভাষার বাণী নিয়ে প্রিয়া আমার গেছে ডেকে,
   তারি বাঁশির ধ্বনি সে যে বিরহে মোর গেছে রেখে।
      পরিচিত নামের ডাকে   তার পরিচয় গোপন থাকে,
      পেয়ে যারে পাই নে তারি পরশ পাই যে বারে বারে॥
    
২৭০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
        মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে,
        মধুর মলয়সমীরে মধুর মিলন রটাতে॥
              কুহকলেখনী ছুটায়ে   কুসুম তুলিছে ফুটায়ে,
              লিখিছে প্রণয়কাহিনী বিবিধ বরনছটাতে॥
        হেরো   পুরানো প্রাচীন ধরণী   হয়েছে শ্যামলবরনী,
        যেন যৌবনপ্রবাহ ছুটেছে কালের শাসন টুটাতে।
              পুরানো বিরহ হানিছে,   নবীন মিলন আনিছে,
              নবীন বসন্ত আইল নবীন জীবন ফুটাতে।
    
২৭১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার   মালার ফুলের দলে আছে লেখা   বসন্তের মন্ত্রলিপি।
      এর মাধুর্যে আছে যৌবনের আমন্ত্রণ।
             সাহানা রাগিনী এর রাঙা রঙে রঞ্জিত,
                   মধুকরের ক্ষুধা অশ্রুত ছন্দে গন্ধে তার গুঞ্জরে॥
        আন্‌ গো ডালা,     গাঁথ্‌ গো মালা,
আন্‌     মাধবী মালতী অশোকমঞ্জরী,   আয় তোরা আয়।
                         আন্‌   করবী রঙ্গণ কাঞ্চন রজনীগন্ধা প্রফুল্লমল্লিকা,   আয় তোরা আয়।
         মালা পর গো মালা পর্ সুন্দরী—
                     ত্বরা কর্ গো ত্বরা কর্।
         আজি পূর্ণিমারাতে জাগিছে চন্দ্রমা,
              বকুলকুঞ্জ দক্ষিণবাতাসে দুলিছে কাঁপিছে
                        থরোথরো মৃদু মর্মরি।
         নৃত্যপরা বনাঙ্গনা বনাঙ্গনে সঞ্চরে,
         চঞ্চলিত চরণ ঘেরি মঞ্জীর তার গুঞ্জরে   আহা।
         দিস নে মধুরাতি বৃথা বহিয়ে উদাসিনী হায় রে।
         শুভলগন গেলে চলে ফিরে দেবে না ধরা—
         সুধাপসরা ধুলায় দেবে শূন্য করি,   শুকাবে বঞ্জুলমঞ্জরী।
         চন্দ্রকরে অভিষিক্ত নিশীথে ঝিল্লিমুখর বনছায়ে
         তন্দ্রাহারা-পিক-বিরহকাকলী-কূজিত দক্ষিণবায়ে
         মালঞ্চ মোর ভরল ফুলে ফুলে ফুলে গো,
         কিংশুকশাখা চঞ্চল হল দুলে দুলে দুলে গো॥
    
২৭২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   আজি   কমলমুকুলদল খুলিল,   দুলিল রে দুলিল—
      মানসসরসে রসপুলকে   পলকে পলকে ঢেউ তুলিল॥
         গগন মগন হল গন্ধে,   সমীরণ মূর্ছে আনন্দে,
           গুন্‌গুন্‌ গুঞ্জনছন্দে   মধুকর ঘিরি ঘিরি বন্দে—
              নিখিলভুবনমন ভুলিল—
                 মন ভুলিল রে মন ভুলিল॥
    
২৭৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
              পুষ্প ফুটে কোন্‌ কুঞ্জবনে,
          কোন্‌ নিভৃতে ওরে, কোন্‌ গহনে।
   মাতিল আকুল দক্ষিণবায়ু সৌরভচঞ্চল সঞ্চরণে॥
   বন্ধুহারা মম অন্ধ ঘরে   আছি বসে অবসন্ন মনে,
   উৎসবরাজ কোথায় বিরাজে,   কে লয়ে যাবে সে ভবনে॥  
    
২৭৪
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
   এই     মৌমাছিদের ঘরছাড়া কে করেছে রে
           তোরা আমায় ব’লে দে ভাই, ব’লে দে রে॥
           ফুলের গোপন পরান-মাঝে   নীরব সুরে বাঁশি বাজে—
   ওদের  সেই সুরেতে কেমনে মন হরেছে রে॥
           যে মধুটি লুকিয়ে আছে,   দেয় না ধরা কারো কাছে,
           সেই মধুতে কেমনে মন ভরেছে রে॥
    
২৭৫
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
            বিদায় নিয়ে গিয়েছিলেম বারে বারে।
                 ভেবেছিলেম ফিরব না রে॥
            এই তো আবার নবীন বেশে
                 এলেম তোমার হৃদয়দ্বারে॥
            কে গো তুমি।— ‘আমি বকুল।’
                  কে গো তুমি।— ‘আমি পারুল।’
            তোমরা কে বা।— ‘আমরা আমের মুকুল গো
                  এলেম আবার আলোর পারে।’
            ‘এবার যখন ঝরব মোরা ধরার বুকে
                  ঝরব তখন হাসিমুখে,
             অফুরানের আঁচল ভরে
                  মরব মোরা প্রাণের সুখে।’
             তুমি কে গো।— ‘আমি শিমুল।’
                  তুমি কে গো।— ‘কামিনী ফুল।’
             তোমরা কে বা।— ‘আমরা নবীন পাতা গো
                   শালের বনে ভারে ভারে।’
    
২৭৬
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
             এই কথাটাই ছিলেম ভুলে—
    মিলব আবার সবার সাথে   ফাল্গুনের এই ফুলে ফুলে॥
    অশোকবনে আমার হিয়া   নতুন পাতায় উঠবে জিয়া,
    বুকের মাতন টুটবে বাঁধন   যৌবনেরই কূলে কূলে
             ফাল্গুনের এই ফুলে ফুলে॥
             বাঁশিতে গান উঠবে পূরে
    নবীন-রবির-বাণী-ভরা   আকাশবীণার সোনার সুরে।
    আমার মনের সকল কোণে   ভরবে গগন আলোক-ধনে,
    কান্নাহাসির বন্যারই নীর   উঠবে আবার দুলে দুলে
             ফাল্গুনের এই ফুলে ফুলে॥
    
২৭৭
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
         এবার তো যৌবনের কাছে মেনেছ হার মেনেছ?
                    ‘মেনেছি’।
            আপন-মাঝে নূতনকে আজ জেনেছ?
                   ‘জেনেছি’॥
         আবরণকে বরণ করে   ছিলে কাহার জীর্ণ ঘরে?
            আপনাকে আজ বাহির করে এনেছ?
                    ‘এনেছি’॥
         এবার আপন প্রাণের কাছে মেনেছ হার মেনেছ?
                    ‘মেনেছি’।
            মরণ-মাঝে অমৃতকে জেনেছ?
                    ‘জেনেছি’।
         লুকিয়ে তোমার অমরপুরী   ধুলা-অসুর করে চুরি,
            তাহারে আজ মরণ-আঘাত হেনেছ?
                    ‘হেনেছি’॥
    
২৭৮
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     সেই তো বসন্ত ফিরে এল,   হৃদয়ের বসন্ত কোথায়   হায় রে।
 সব মরুময়,   মলয়-অনিল এসে   কেঁদে শেষে   ফিরে চলে যায়   হায় রে॥
      কত শত ফুল ছিল হৃদয়ে,   ঝরে গেল,   আশালতা শুকালো,
              পাখিগুলি দিকে দিকে চলে যায়।
          শুকানো পাতায় ঢাকাবসন্তের মৃতকায়,
              প্রাণ করে হায়-হায়   হায় রে॥
                  ফুরাইল সকলই।
      প্রভাতের মৃদু হাসি,   ফুলের রূপরাশি,   ফিরিবে কি আর।
          কিবা জোছনা ফুটিত রে   কিবা যামিনী—
 সকলই হারালো,   সকলই গেল রে চলিয়া,   প্রাণ করে হায় হায়   হায় রে॥
    
২৭৯
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
             নিবিড় অন্তরতর বসন্ত এল প্রাণে।
             জগতজনহৃদয়ধন, চাহি তৰ পানে।
             হরষরস বরষি যত তৃষিত ফুলপাতে
             কুঞ্জকাননপবন পরশ তব আনে॥
             মুগ্ধ কোকিল মুখর রাত্রি দিন যাপে,
             মর্মরিত পল্লবিত সকল বন কাঁপে।
             দশ দিশি সুরম্য সুন্দর মধুর হেরি,
             দুংখ হল দূর সব-দৈন্য-অবসানে॥
    
২৮০
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                    নব নব পল্লবরাজি
               সব বন উপবনে উঠে বিকশিয়া,
            দখিনপবনে সঙ্গীত উঠে বাজি॥
      মধুর সুগন্ধে আকুল ভুবন,   হাহা করিছে মম জীবন।
      এসো এসো সাধনধন,  মম মন করো পূর্ণ আজি॥
    
২৮১
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      মম অন্তর উদাসে
      পল্লবমর্মরে কোন্‌   চঞ্চল বাতাসে॥
             জ্যোৎস্নাজড়িত নিশা   ঘুমে-জাগরণে-মিশা
             বিহবল আকুল কার   অঞ্চলসুবাসে॥
      থাকিতে না দেয় ঘরে,   কোথায় বাহির করে
      সুন্দর সুদূরে কোন্‌ নন্দন-আকাশে।
           অতীত দিনের পারে   স্মরণসাগর-ধারে
           বেদনা লুকায়ে কোন্‌   ত্রন্দন-আভাসে॥
    
২৮২
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      ফাগুন-হাওয়ায় রঙে রঙে পাগল ঝোরা লুকিয়ে ঝরে
      গোলাপ জবা পারুল পলাশ পারিজাতের বুকের ’পরে॥
          সেইখানে মোর পরানখানি   যখন পারি বহে আনি,
          নিলাজ-রাঙা পাগল রঙে রঙিয়ে নিতে থরে থরে॥
      বাহির হলেম ব্যাকুল হাওয়ার উতল পথের চিহ্ন ধরে—
      ওগো তুমি রঙের পাগল, ধরব তোমায় কেমন করে।
          কোন্‌ আড়ালে লুকিয়ে রবে,   তোমায় যদি না পাই তবে
          রক্তে আমার তোমার পায়ের রঙ লেগেছে কিসের তরে॥
    
২৮৩
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
          ঝরা পাতা গো, আমি তোমারি দলে।
              অনেক হাসি অনেক অশ্রুজলে
          ফাগুন দিল বিদায়মন্ত্র     আমার হিয়াতলে॥
              ঝরা পাতা গো, বসন্তী রঙ দিয়ে
                  শেষের বেশে সেজেছ তুমি কি এ।
              খেলিলে হোলি ধুলায় ঘাসে ঘাসে
                  বসন্তের এই চরম ইতিহাসে।
          তোমারি মতো আমারো উত্তরী
              আগুন-রঙে দিয়ো রঙিন করি—
                  অস্তরবি লাগাক পরশমণি
                      প্রাণের মম শেষের সম্বলে॥