১
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
জ্বল্ জ্বল্ চিতা, দ্বিগুণ দ্বিগুণ— পরান সঁপিবে বিধবা বালা। জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন, জুড়াবে এখনি প্রাণের জ্বালা॥ শোন্ রে যবন, শোন্ রে তোরা, যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে সাক্ষী র’লেন দেবতা তার— এর প্রতিফল ভুগিতে হবে॥ দেখ্ রে জগৎ, মেলিয়ে নয়ন, দেখ্ রে চন্দ্রমা, দেখ্ রে গগন, স্বর্গ হতে সব দেখো দেবগণ— জ্বলদ্-অক্ষরে রাখো গো লিখে। স্পর্ধিত যবন, তোরাও দেখ্ রে, সতীত্ব-রতন করিতে রক্ষণ রাজপুত-সতী আজিকে কেমন সঁপিছে পরান অনলশিখে॥
২
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
হৃদয়ে রাখো গো দেবী, চরণ তোমার। এসো মা করুণারানী, ও বিধুবদনখানি হেরি হেরি আঁখি ভরি হেরিব আবার। এসো আদরিনী বাণী, সমুখে আমার॥ মৃদু মৃদু হাসি হাসি বিলাও অমৃতরাশি, আলোয় করেছ আলো, জ্যোতিপ্রতিমা— তুমি গো লাবণ্যলতা, মূর্তি-মধুরিমা। বসন্তের বনবালা অতুল রূপের ডালা, মায়ার মোহিনী মেয়ে ভাবের আধার— ঘুচাও মনের মোর সকল আঁধার॥ অদর্শন হলে তুমি ত্যেজি লোকালয়ভূমি অভাগা বেড়াবে কেঁদে গহনে গহনে। হেরে মোরে তরুলতা বিষাদে কবে না কথা, বিষণ্ণ কুসুমকুল বনফুলবনে। ‘হা দেবী’ ‘হা দেবী’ বলি গুঞ্জরি কাঁদিবে অলি, ঝরিবে ফুলের চোখে শিশির-আসার— হেরিব জগত শুধু আঁধার—আঁধার॥
৩
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
নীরব রজনী দেখো মগ্ন জোছনায়। ধীরে ধীরে, অতি ধীরে, অতি ধীরে গাও গো॥ ঘুমঘোরময় গান বিভাবরী গায়— রজনীর কণ্ঠ-সাথে সুকণ্ঠ মিলাও গো॥ নিশার কুহকবলে নীরবতাসিন্ধুতলে মগ্ন হয়ে ঘুমাইছে বিশ্বচরাচর— প্রশান্ত সাগরে হেন তরঙ্গ না তুলে যেন অধীর উচ্ছ্বাসময় সঙ্গীতের স্বর। তটিনী কী শান্ত আছে— ঘুমাইয়া পড়িয়াছে বাতাসের মৃদুহস্ত-পরশে এমনি ভুলে যদি ঘুমে ঘুমে তটের চরণ চুমে সে চুম্বনধ্বনি শুনে চমকে আপনি। তাই বলি, অতি ধীরে, অতি ধীরে গাও গো— রজনীর কণ্ঠ-সাথে সুকণ্ঠ মিলাও গো॥
৪
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ক্ষমা করো মোরে সখী, শুধায়ো না আর— মরমে লুকানো থাক মরমের ভার॥ যে গোপন কথা, সখী, সতত লুকায়ে রাখি ইষ্টদেবমন্ত্রসম পূজি অনিবার। তাহা মানুষের কানে ঢালিতে যে লাগে প্রাণে— লুকানো থাক তা, সখী, হৃদয়ে আমার॥ ভালোবাসি, শুধায়ো না কারে ভালোবাসি। সে নাম কেমনে, সখী, কহিব প্রকাশি। আমি তুচ্ছ হতে তুচ্ছ— সে নাম যে অতি উচ্চ, সে নাম যে নহে যোগ্য এই রসনার॥ ক্ষুদ্র এই বনফুল পৃথিবীকাননে আকাশের তারকারে পূজে মনে মনে— দিন-দিন পূজা করি শুকায়ে পড়ে সে ঝরি, আজন্ম-নীরবে রহি যায় প্রাণ তার॥
৫
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
সখী, আর কত দিন সুখহীন শান্তিহীন হা হা করে বেড়াইব নিরাশ্রয় মন লয়ে। পারি নে, পারি নে আর— পাষাণ মনের ভার বহিয়া পড়েছি, সখী, অতি শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে। সম্মুখে জীবন মম হেরি মরুভূমিসম, নিরাশা বুকেতে বসি ফেলিতেছে বিষশ্বাস। উঠিতে শকতি নাই যে দিকে ফিরিয়া চাই শূন্য—শূন্য—মহাশূন্য নয়নেতে পরকাশ। কে আছে, কে আছে সখী, এ শ্রান্ত মস্তক মম বুকেতে রাখিবে ঢাকি যতনে জননীসম। মন, যত দিন যায়, মুদিয়া আসিছে হায়— শুকায়ে শুকায়ে শেষে মাটিতে পড়িবে ঝরি॥
৬
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
কত দিন একসাথে ছিনু ঘুমঘোরে, তবু জানিতাম নাকো ভালোবাসি তোরে। মনে আছে ছেলেবেলা কত যে খেলেছি খেলা, কুসুম তুলেছি কত দুইটি আঁচল ভ’রে। ছিনু সুখে যতদিন দুজনে বিরহহীন তখন কি জানিতাম ভালোবাসি তোরে! অবশেষে এ কপাল ভাঙিল যখন, ছেলেবেলাকার যত ফুরালো স্বপন, লইয়া দলিত মন হইনু প্রবাসী— তখন জানিনু, সখী, কত ভালোবাসি॥
৭
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
নাচ্ শ্যামা, তালে তালে॥ রুনু রুনু ঝুনু বাজিছে নূপুর, মৃদু মৃদু মধু উঠে গীতসুর, বলয়ে বলয়ে বাজে ঝিনি ঝিনি, তালে তালে উঠে করতালিধ্বনি— নাচ্ শ্যামা, নাচ্ তবে॥ নিরালয় তোর বনের মাঝে সেথা কি এমন নূপুর বাজে! এমন মধুর গান? এমন মধুর তান? কমলকরের করতালি হেন দেখিতে পেতিস কবে?— নাচ্ শ্যামা, নাচ্ তবে॥
৮
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
বিপাশার তীরে ভ্রমিবারে যাই, প্রতিদিন প্রাতে দেখিবারে পাই লতা-পাতা-ঘেরা জানালা-মাঝারে একটি মধুর মুখ॥ চারি দিকে তার ফুটে আছে ফুল— কেহ বা হেলিয়া পরশিছে চুল, দুয়েকটি শাখা কপাল ছুঁইয়া, দুয়েকটি আছে কপোলে নুইয়া, কেহ বা এলায়ে চেতনা হারায়ে চুমিয়া আছে চিবুক। বসন্তপ্রভাতে লতার মাঝারে মুখানি মধুর অতি— অধর-দুটির শাসন টুটিয়া রাশি রাশি হাসি পড়িছে ফুটিয়া, দুটি আঁখি-’পরে মেলিছে মিশিছে তরল চপল জ্যোতি॥
৯
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
খেলা কর্ খেলা কর্ তোরা কামিনীকুসুমগুলি। দেখ্ সমীরণ লতাকুঞ্জে গিয়া কুসুমগুলির চিবুক ধরিয়া ফিরায়ে এ ধার, ফিরায়ে ও ধার, দুইটি কপোল চুমে বারবার মুখানি উঠায়ে তুলি। তোরা খেলা কর্ তোরা খেলা কর্ কামিনীকুসুমগুলি। কভু পাতা-মাঝে লুকায়ে মুখ, কভু বায়ু-কাছে খুলে দে বুক, মাথা নাড়ি নাড়ি নাচ্ কভু নাচ্ বায়ু-কোলে দুলি দুলি। দু দণ্ড বাঁচিবি, খেলা তবে খেলা— প্রতি নিমিষেই ফুরাইছে বেলা, বসন্তের কোলে খেলাশ্রান্ত প্রাণ ত্যজিবি ভাবনা ভুলি॥
১০
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
আঁধার শাখা উজল করি হরিত-পাতা-ঘোমটা পরি বিজন বনে, মালতীবালা, আছিস কেন ফুটিয়া॥ শোনাতে তোরে মনের ব্যথা শুনিতে তোর মনের কথা পাগল হয়ে মধুপ কভু আসে না হেথা ছুটিয়া॥ মলয় তব প্রণয়-আশে ভ্রমে না হেথা আকুল শ্বাসে, পায় না চাঁদ দেখিতে তোর শরমে-মাখা মুখানি। শিয়রে তোর বসিয়া থাকি মধুর স্বরে বনের পাখি লভিয়া তোর সুরভিশ্বাস যায় না তোরে বাখানি॥
১১
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে। তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’— সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়। সে কি কেবলই চোখের জল? সে কি কেবলই দুখের শ্বাস? লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে এমন দুখের আশ। আমার চোখে তো সকলই শোভন, সকলই নবীন, সকলই বিমল, সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন, বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল— সকলই আমার মতো। তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়, হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়— না জানে বেদন, না জানে রোদন, না জানে সাধের যাতনা যত। ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে, জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়, হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে আকাশের তারা তেয়াগে কায়। আমার মতন সুখী কে আছে। আয় সখী, আয় আমার কাছে— সুখী হৃদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ। প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা— একিদন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা॥
১২
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
কাছে তার যাই যদি কত যেন পায় নিধি, তবু হরষের হাসি ফুটে-ফুটে ফুটে না। কখনো বা মৃদু হেসে আদর করিতে এসে সহসা শরমে বাধে, মন উঠে উঠে না। রোষের ছলনা করি দূরে যাই, চাই ফিরি— চরণ-বারণ-তরে উঠে-উঠে উঠে না। কাতর নিশ্বাস ফেলি আকুল নয়ন মেলি চাহি থাকে, লাজবাঁধ তবু টুটে টুটে না। যখন ঘুমায়ে থাকি মুখপানে মেলি আঁখি চাহি থাকে, দেখি দেখি সাধ যন মিটে না। সহসা উঠিলে জাগি তখন কিসের লাগি শরমেতে ম’রে গিয়ে কথা যেন ফুটে না। লাজময়ী, তোর চেয়ে দেখি নি লাজুক মেয়ে, প্রেমবরিষার স্রোতে লাজ তবু টুটে না॥
১৩
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
যে ভালোবাসুক সে ভালোবাসুক সজনি লো, আমরা কে! দীনহীন এই হৃদয় মোদের কাছেও কি কেহ ডাকে॥ তবে কেন বলো ভেবে মরি মোরা কে কাহারে ভালোবাসে! আমাদের কিবা আসে যায় বলো কেবা কাঁদে কেবা হাসে! আমাদের মন কেহই চাহে না, তবে মনখানি লুকানো থাক্— প্রাণের ভিতরে ঢাকিয়া রাখ্॥ যদি, সখী, কেহ ভুলে মনখানি লয় তুলে, উলটি-পালটি ক্ষণেক ধরিয়া পরখ করিয়া দেখিতে চায়, তখনি ধূলিতে ছুঁড়িয়া ফেলিবে নিদারুণ উপেখায়। কাজ কী লো, মন লুকানো থাক্, প্রাণের ভিতরে ঢাকিয়া রাখ্— হাসিয়া খেলিয়া ভাবনা ভুলিয়া হরষে প্রমোদে মাতিয়া থাক্॥
১৪
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
কে তুমি গো খুলিয়াছ স্বর্গের দুয়ার ঢালিতেছ এত সুখ, ভেঙে গেল— গেল বুক— যেন এত সুখ হৃদে ধরে না গো আর। তোমার চরণে দিনু প্রেম-উপহার— না যদি চাও গো দিতে প্রতিদান তার নাই বা দিলে তা মোরে, থাকো হৃদি আলো করে, হৃদয়ে থাকুক জেগে সৌন্দর্য তোমার॥
১৫
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
কিছুই তো হল না। সেই সব— সেই সব— সেই হাহাকাররব, সেই অশ্রুবারিধারা, হৃদয়বেদনা॥ কিছুতে মনের মাঝে শান্তি নাহি পাই, কিছুই না পাইলাম যাহা কিছু চাই। ভালো তো গো বাসিলাম, ভালোবাসা পাইলাম, এখনো তো ভালোবাসি— তবুও কী নাই॥
১৬
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
কী করিব বলো, সখা, তোমার লাগিয়া। কী করিলে জুড়াইতে পারিব ও হিয়া॥ এই পেতে দিনু বুক, রাখো, সখা, রাখো মুখ— ঘুমাও তুমি গো, আমি রহিনু জাগিয়া। খুলে বলো, বলো সখা, কী দুঃখ তোমার— অশ্রুজলে মিলাইব অশ্রুজলধার! একদিন বলেছিলে মোর ভালোবাসা পাইলে পুরিবে তব হৃদয়ের আশা। কই সখা, প্রাণ মন করেছি তো সমর্পণ— দিয়েছি তো যাহা-কিছু আছিল আমার। তবু কেন শুকালো না অশ্রুজলধার॥
১৭
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
না সখা, মনের ব্যথা কোরো না গোপন। যবে অশ্রুজল হায় উচ্ছ্বসি উঠিতে চায় রুধিয়া রেখো না তাহা আমারি কারণ। চিনি, সখা, চিনি তব ও দারুণ হাসি— ওর চেয়ে কত ভালো অশ্রুজলরাশি। মাথা খাও— অভাগীরে কোরো না বঞ্চনা, ছদ্মবেশে আবরিয়া রেখো না যন্ত্রণা। মমতার অশ্রুজলে নিভাইব সে অনলে, ভালো যদি বাস তবে রাখো এ প্রার্থনা॥
১৮
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
বুঝেছি বুঝেছি সখা, ভেঙেছে প্রণয়! ও মিছে আদর তবে না করিলে নয়?। ও শুধু বাড়ায় ব্যথা— সে-সব পুরানো কথা মনে ক’রে দেয় শুধু, ভাঙে এ হৃদয়॥ প্রতি হাসি প্রতি কথা প্রতি ব্যবহার আমি যত বুঝি তত কে বুঝিবে আর। প্রেম যদি ভুলে থাক সত্য ক’রে বলো-নাকো— করিব না মুহূর্তের তরে তিরস্কার॥ আমি তো ব’লেই ছিনু, ক্ষুদ্র আমি নারী তোমার ও প্রণয়ের নহি অধিকারী। আর-কারে ভালোবেসে সুখী যদি হও শেষে তাই ভালোবেসো নাথ, না করি বারণ। মনে ক’রে মোর কথা মিছে পেয়ো নাকো ব্যথা, পুরানো প্রেমের কথা কোরো না স্মরণ॥
১৯
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
তুই রে বসন্তসমীরণ। তোর নহে সুখের জীবন॥ কিবা দিবা কিবা রাতি পরিমলমদে মাতি কাননে করিস বিচরণ॥ নদীরে জাগায়ে দিস লতারে রাগায়ে দিস চুপিচুপি করিয়া চুম্বন তোর নহে সুখের জীবন॥ শোন্ বলি বসন্তের বায়, হৃদয়ের লতাকুঞ্জে আয়। নিভৃত নিকুঞ্জ ছায় হেলিয়া ফুলের গায় শুনিয়া পাখির মৃদু গান লতার-হৃদয়ে-হারা সুখে-অচেতন-পারা ঘুমায়ে কাটায়ে দিবি প্রাণ। তাই বলি বসন্তের বায়, হৃদয়ের লতাকুঞ্জে আয়॥
২০
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
বসন্তপ্রভাতে এক মালতীর ফুল প্রথম মেলিল আঁখি তার, চাহিয়া দেখিল চারি ধার॥ উষারানী দাঁড়াইয়া শিয়রে তাহার দেখিছে ফুলের ঘুম-ভাঙা। হরষে কপোল তার রাঙা॥ মধুকর গান গেয়ে বলে, ‘মধু কই। মধু দাও দাও।’ হরষে হৃদয় ফেটে গিয়ে ফুল বলে, ‘এই লও লও।’ বায়ু আসি কহে কানে কানে, ‘ফুলবালা, পরিমল দাও।’ আনন্দে কাঁদিয়া কহে ফুল, ‘যাহা আছে সব লয়ে যাও।’ হরষ ধরে না তার চিতে, আপনারে চাহে বিলাইতে, বালিকা আনন্দে কুটি-কুটি পাতায় পাতায় পড়ে লুটি॥
২১
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
তরুতলে ছিন্নবৃন্ত মালতীর ফুল— মুদিয়া আসিছে আঁখি তার, চাহিয়া দেখিল চারি ধার॥ শুষ্ক তৃণরাশি-মাঝে একেলা পড়িয়া, চারি দিকে কেহ নাই আর— নিরদয় অসীম সংসার॥ কে আছে গো দিবে তার তৃষিত অধরে একবিন্দু শিশিরের কণা— কেহ না, কেহ না॥ মধুকর কাছে এসে বলে, ‘মধু কই। মধু চাই, চাই।’ ধীরে ধীরে নিশ্বাস ফেলিয়া ফুল বলে, ‘কিছু নাই, নাই।’ ‘ফুলবালা, পরিমল দাও’ বায়ু আসি কহিতেছে কাছে। মলিন বদন ফিরাইয়া ফুল বলে, ‘আর কী বা আছে।’ মধ্যাহ্নকিরণ চারি দিকে খরদৃষ্টে চেয়ে অনিমিখে— ফুলটির মৃদু প্রাণ হায়, ধীরে ধীরে শুকাইয়া যায়॥
২২
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
যোগী হে, কে তুমি হৃদি-আসনে! বিভূতিভূষিত শুভ্র দেহ, নাচিছ দিক্-বসনে॥ মহা-আনন্দে পুলক কায়, গঙ্গা উথলি উছলি যায়, ভালে শিশুশশী হাসিয়া চায়— জটাজূট ছায় গগনে॥
২৩
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ভিক্ষে দে গো, ভিক্ষে দে। দ্বারে দ্বারে বেড়াই ঘুরে, মুখ তুলে কেউ চাইলি নে। লক্ষ্মী তোদের সদয় হোন, ধনের উপর বাড়ুক ধন— আমি একটি মুঠো অন্ন চাই গো, তাও কেন পাই নে। ওই রে সূর্য উঠল মাথায়, যে যার ঘরে চলেছে। পিপাসাতে ফাটছে ছাতি, চলতে আর যে পারি নে। ওরে তোদের অনেক আছে, আরো অনেক হবে— একটি মুঠো দিবি শুধু আর কিছু চাহি নে॥
২৪
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
আয় রে আয় রে সাঁঝের বা, লতাটিরে দুলিয়ে যা— ফুলের গন্ধ দেব তোরে আঁচলটি তোর ভ’রে ভ’রে॥ আয় রে আয় রে মধুকর, ডানা দিয়ে বাতাস কর্— ভোরের বেলা গুন্গুনিয়ে ফুলের মধু যাবি নিয়ে॥ আয় রে চাঁদের আলো আয়, হাত বুলিয়ে দে রে গায়— পাতার কোলে মাথা থুয়ে ঘুমিয়ে পড়বি শুয়ে শুয়ে। পাখি রে, তুই কোস্ নে কথা— ওই যে ঘুমিয়ে প’ল লতা॥
২৫
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
প্রিয়ে, তোমার ঢেঁকি হলে যেতেম বেঁচে রাঙা চরণতলে নেচে নেচে॥ ঢিপ্ঢিপিয়ে যেতেম মারা, মাথা খুঁড়ে হতেম সারা— কানের কাছে কচ্কচিয়ে মানটি তোমার নিতেম যেচে॥
২৬
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
কথা কোস্ নে লো রাই, শ্যামের বড়াই বড়ো বেড়েছে। কে জানে ও কেমন ক’রে মন কেড়েছে॥ শুধু ধীরে বাজায় বাঁশি, শুধু হাসে মধুর হাসি— গোপিনীদের হৃদয় নিয়ে তবে ছেড়েছে॥
২৭
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ওই জানালার কাছে বসে আছে করতলে রাখি মাথা— তার কোলে ফুল পড়ে রয়েছে, সে যে ভুলে গেছে মালা গাঁথা॥ শুধু ঝুরু ঝুরু বায়ু বহে যায় তার কানে কানে কী যে কহে যায়— তাই আধো শুয়ে আধো বসিয়ে ভাবিতেছে কত কথা॥ চোখের উপরে মেঘ ভেসে যায়, উড়ে উড়ে যায় পাখি— সারা দিন ধ’রে বকুলের ফুল ঝ’রে পড়ে থাকি থাকি। মধুর আলস, মধুর আবেশ, মধুর মুখের হাসিটি— মধুর স্বপনে প্রাণের মাঝারে বাজিছে মধুর বাঁশিটি॥
২৮
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
সাধ ক’রে কেন, সখা, ঘটাবে গেরো। এই বেলা মানে-মানে ফেরো ফেরো। পলক যে নাই আঁখির পাতায়, তোমার মনটা কি খরচের খাতায়— হাসি ফাঁসি দিয়ে প্রাণে বেঁধেছে গেরো। সখা, ফেরো ফেরো॥
২৯
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ধীরে ধীরে প্রাণে আমার এসো হে, মধুর হাসিয়ে ভালোবেসো হে॥ হৃদয়কাননে ফুল ফুটাও। আধো নয়নে, সখী, চাও চাও— পরান কাঁদিয়ে দিয়ে হাসিখানি হেসো হে॥
৩০
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
তুমি আছ কোন্ পাড়া? তোমার পাই নে যে সাড়া। পথের মধ্যে হাঁ ক’রে যে রইলে হে খাড়া॥ রোদে প্রাণ যায় দুপুর বেলা, ধরেছে উদরে জ্বালা— এর কাছে কি হৃদয়জ্বালা। তোমার সকল সৃষ্টিছাড়া॥ রাঙা অধর, নয়ন কালো ভরা পেটেই লাগে ভালো— এখন পেটের মধ্যে নাড়ীগুলো দিয়েছে তাড়া॥
৩১
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
দেখো ওই কে এসেছে।— চাও সখী, চাও। আকুল পরান ওর আঁখিহিল্লোলে নাচাও।— সখী, চাও॥ তৃষিত নয়ানে চাহে মুখ-পানে, হাসিসুধা-দানে বাঁচাও।— সখী, চাও॥
৩২
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ভালো যদি বাস, সখী, কী দিব গো আর— কবির হৃদয় এই দিব উপহার॥ এত ভালোবাসা, সখী, কোন্ হৃদে বলো দেখি— কোন্ হৃদে ফুটে এত ভাবের কুসুমভার॥ তা হলে এ হৃদিধামে তোমারি তোমারি নামে বাজিবে মধুর স্বরে মরমবীণার তার। যা-কিছু গাহিব গান ধ্বনিবে তোমারি নাম— কী আছে কবির বলো, কী তোমারে দিব আর॥
৩৩
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ও কেন ভালোবাসা জানাতে আসে ওলো সজনী। হাসি খেলি রে মনের সুখে, ও কেন সাথে ফেরে আঁধার-মুখে দিনরজনী॥
৩৪
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ভালোবাসিলে যদি সে ভালো না বাসে কেন সে দেখা দিল। মধু অধরের মধুর হাসি প্রাণে কেন বরষিল। দাঁড়িয়ে ছিলেম পথের ধারে, সহসা দেখিলেম তারে— নয়ন দুটি তুলে কেন মুখের পানে চেয়ে গেল॥
৩৫
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
হা, কে বলে দেবে সে ভালোবাসে কি মোরে। কভু বা সে হেসে চায়, কভু মুখ ফিরায়ে লয়, কভু বা সে লাজে সারা, কভু বা বিষাদময়ী— যাব কি কাছে তার। শুধাব চরণ ধ’রে?।
৩৬
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
কেন রে চাস ফিরে ফিরে, চলে আয় রে চলে আয়॥ এরা প্রাণের কথা বোঝে না যে, হৃদয়কুসুম দলে যায়॥ হেসে হেসে গেয়ে গান দিতে এসেছিলি প্রাণ, নয়নের জল সাথে নিয়ে চলে আয় রে চলে আয়॥
৩৭
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন, তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে। চারি দিকে হাসিরাশি, তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে॥ আন্ সখী, বীণা আন্, প্রাণ খুলে কর্ গান, নাচ্ সবে মিলে ঘিরি ঘিরি ঘিরিয়ে— তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে॥ বীণা তবে রেখে দে, গান আর গাস নে— কেমনে যাবে বেদনা। কাননে কাটাই রাতি, তুলি ফুল মালা গাঁথি, জোছনা কেমন ফুটেছে— তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে॥
৩৮
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
সখা, সাধিতে সাধাতে কত সুখ তাহা বুঝিলে না তুমি— মনে রয়ে গেল দুখ॥ অভিমান-আঁখিজল, নয়ন ছলছল— মুছাতে লাগে ভালো কত তাহা বুঝিলে না তুমি— মনে রয়ে গেল দুখ॥
৩৯
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
এত ফুল কে ফোটালে কাননে! লতাপাতায় এত হাসি -তরঙ্গ মরি কে ওঠালে॥ সজনীর বিয়ে হবে ফুলেরা শুনেছে সবে— সে কথা কে রটালে॥
৪০
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
আমাদের সখীরে কে নিয়ে যাবে রে— তারে কেড়ে নেব, ছেড়ে দেব না—না—না। কে জানে কোথা হতে কে এসেছে। কেন সে মোদের সখী নিতে আসে—দেব’ না॥ সখীরা পথে গিয়ে দাঁড়াব, হাতে তার ফুলের বাঁধন জড়াব, বেঁধে তায় রেখে দেব’ কুসুমবনে— সখীরে নিয়ে যেতে দেব’ না॥
৪১
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
কোথা ছিলি সজনী লো, মোরা যে তোরি তরে বসে আছি কাননে। এসো সখী, এসো হেথা বসি বিজনে আঁখি ভরিয়ে হেরি হাসিমুখানি॥ সাজাব সখীরে সাধ মিটায়ে, ঢাকিব তনুখানি কুসুমেরই ভূষণে। গগনে হাসিবে বিধু, গাহিব মৃদু মৃদু— কাটাব প্রমোদে চাঁদিনী যামিনী॥
৪২
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ও কী কথা বল সখী, ছি ছি, ও কথা মনে এনো না॥ আজি সুখের দিনে জগত হাসিছে, হেরো লো দশ দিশি হরষে ভাসিছে— আজি ও ম্লান মুখ প্রাণে যে সহে না। সুখের দিনে, সখী, কেন ও ভাবনা॥
৪৩
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
মধুর মিলন। হাসিতে মিলেছে হাসি, নয়নে নয়ন॥ মরমর মৃদু বাণী মরমর মরমে, কপোলে মিলায় হাসি সুমধুর শরমে— নয়নে স্বপন॥ তারাগুলি চেয়ে আছে, কুসুম গাছে গাছে— বাতাস চুপিচুপি ফিরিছে কাছে কাছে। মালাগুলি গেঁথে নিয়ে, আড়ালে লুকাইয়ে সখীরা নেহারিছে দোঁহার আনন— হেসে আকুল হল বকুলকানন, আ মরি মরি॥
৪৪
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
মা, একবার দাঁড়া গো হেরি চদ্রানন। আঁধার ক’রে কোথায় যাবি শূন্যভবন॥ মধুর মুখ হাসি-হাসি অমিয়া রাশি-রাশি, মা— ও হাসি কোথায় নিয়ে যাস রে। আমরা কী নিয়ে জুড়াব জীবন॥
৪৫
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
মা আমার, কেন তোরে ম্লান নেহারি— আঁখি ছলছল, আহা। ফুলবনে সখী-সনে খেলিতে খেলিতে হাসি হাসি দে রে করতারি॥ আয় রে বাছা, আয় রে কাছে আয়। দু দিন রহিবি, দিন ফুরায়ে যায়— কেমনে বিদায় দেব’ হাসিমুখ না হেরি॥
৪৬
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ওই আঁখি রে! ফিরে ফিরে চেয়ো না, চেয়ো না, ফিরে যাও— কী আর রেখেছ বাকী রে॥ মরমে কেটেছ সিঁধ, নয়নের কেড়েছ নিদ— কী সুখে পরান আর রাখি রে॥
৪৭
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
আজ আসবে শ্যাম গোকুলে ফিরে। আবার বাজবে বাঁশি যমুনাতীরে আমরা কী করব। কী বেশ ধরব। কী মালা পড়ব। বাঁচব কি মরব সুখে। কী তারে বলব! কথা কি রবে মুখে। শুধু তার মুখপানে চেয়ে চেয়ে দাঁড়ায়ে ভাসব নয়ননীরে॥
৪৮
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
রাজ-অধিরাজ, তব ভালে জয়মালা— ত্রিপুরপুরলক্ষ্মী বহে তব বরণডালা॥ ক্ষীণজনভয়তরণ তব অভয় বাণী, দীনজনদুখহরণনিপুণ, তব পাণি, তরুণ তব মুখচন্দ্র করুণরস-ঢালা॥ গুণিরসিকসেবিত উদার তব দ্বারে মঙ্গল বিরাজিত বিচিত্র উপচারে— গুণ-অরুণ-কিরণে তব সব ভুবন আলা॥
৪৯
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ঝর ঝর রক্ত ঝরে কাটা মুণ্ড বেয়ে। ধরণী রাঙা হল রক্তে নেয়ে॥ ডাকিনী নৃত্য করে প্রসাদ -রক্ত-তরে— তৃষিত ভক্ত তোমার আছে চেয়ে॥
৫০
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
উলঙ্গিনী নাচে রণরঙ্গে। আমরা নৃত্য করি সঙ্গে॥ দশ দিক আঁধার ক’রে মাতিল দিক্-বসনা, জ্বলে বহ্নিশিখা রাঙা রসনা— দেখে মরিবারে ধাইছে পতঙ্গে॥ কালো কেশ উড়িল আকাশে, রবি সোম লুকালো তরাসে। রাঙা রক্তধারা ঝরে কালো অঙ্গে— ত্রিভুবন কাঁপে ভুরুভঙ্গে॥
৫১
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
থাকতে আর তো পারলি নে মা, পারলি কই। কোলের সন্তানেরে ছাড়লি কই॥ দোষী আছি অনেক দোষে, ছিলি বসে ক্ষণিক রোষে— মুখ তো ফিরালি শেষে। অভয় চরণ কাড়লি কই॥
৫২
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে, বনের পাখি ছিল বনে। একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে, কী ছিল বিধাতার মনে। বনের পাখি বলে, ‘খাঁচার পাখি ভাই, বনেতে যাই দোঁহে মিলে।’ খাঁচার পাখি বলে, ‘বনের পাখি আয়, খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।’ বনের পাখি বলে, ‘না, আমি শিকলে ধরা নাহি দিব।’ খাঁচার পাখি বলে, ‘হায়, আমি কেমনে বনে বাহিরিব।’ বনের পাখি গাহে বাহিরে বসি বসি বনের গান ছিল যত, খাঁচার পাখি গাহে শিখানো বুলি তার— দোঁহার ভাষা দুইমত। বনের পাখি বলে ‘খাঁচার পাখি ভাই, বনের গান গাও দেখি।’ খাঁচার পাখি বলে, ‘বনের পাখি ভাই, খাঁচার গান লহো শিখি।’ বনের পাখি বলে, ‘না, আমি শিখানো গান নাহি চাই।’ খাঁচার পাখি বলে, ‘হায় আমি কেমনে বনগান গাই।’ বনের পাখি বলে, ‘আকাশ ঘন নীল কোথাও বাধা নাহি তার।’ খাঁচার পাখি বলে, ‘খাঁচাটি পরিপাটি কেমন ঢাকা চারিধার।’ বনের পাখি বলে, ‘আপনা ছাড়ি দাও মেঘের মাঝে একেবারে।’ খাঁচার পাখি বলে, ‘নিরালা কোণে বসে বাঁধিয়া রাখো আপনারে।’ বনের পাখি বলে, ‘না, সেথা কোথায় উড়িবারে পাই!’ খাঁচার পাখি বলে, ‘হায়, মেঘে কোথায় বসিবার ঠাঁই।’ এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালোবাসে, তবুও কাছে নাহি পায়। খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে, নীরবে চোখে চোখে চায়। দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে, বুঝাতে নারে আপনায়। দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা—কাতরে কহে, ‘কাছে আয়!’ বনের পাখি বলে, ‘না, কবে খাঁচায় রুধি দিবে দ্বার!’ খাঁচার পাখি বলে, ‘হায়, মোর শকতি নাহি উড়িবার।’
৫৩
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
একদা প্রাতে কুঞ্জতলে অন্ধ বালিকা পত্রপুটে আনিয়া দিল পুষ্পমালিকা॥ কণ্ঠে পরি অশ্রুজল ভরিল নয়নে, বক্ষে লয়ে চুমিনু তার স্নিগ্ধ বয়নে॥ কহিনু তারে, ‘অন্ধকারে দাঁড়ায়ে রমণী, কী ধন তুমি করিছ দান না জানো আপনি। পুষ্পসম অন্ধ তুমি অন্ধ বালিকা, দেখ নি নিজে মোহন কী যে তোমার মালিকা।’
৫৪
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
কেন নিবে গেল বাতি। আমি অধিক যতনে ঢেকেছিনু তারে জাগিয়া বাসররাতি, তাই নিবে গেল বাতি॥ কেন ঝরে গেল ফুল। আমি বক্ষে চাপিয়া ধরেছিনু তারে চিন্তিত ভয়াকুল, তাই ঝরে গেল ফুল॥ কেন মরে গেল নদী॥ আমি বাঁধ বাঁধি তারে চাহি ধরিবারে পাইবারে নিরবধি, তাই মরে গেল নদী॥ কেন ছিঁড়ে গেল তার। আমি অধিক আবেগে প্রাণপণ বলে দিয়েছিনু ঝঙ্কার, তাই ছিঁড়ে গেল তার॥
৫৫
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
তুমি পড়িতেছ হেসে তরঙ্গের মতো এসে হৃদয়ে আমার। যৌবনসমুদ্রমাঝে কোন্ পূর্ণিমায় আজি এসেছে জোয়ার। উচ্ছল পাগল নীরে তালে তালে ফিরে ফিরে এ মোর নির্জন তীরে কী খেলা তোমার! মোর সর্ব বক্ষ জুড়ে কত নৃত্যে কত সুরে এস কাছে যাও দূরে শতলক্ষবার॥ কুসুমের মতো শ্বসি পড়িতেছ খসি খসি মোর বক্ষ-’পরে গোপন শিহিরছলে বিন্দু বিন্দু অশ্রুজলে প্রাণ সিক্ত ক’রে। নিঃশব্দ সৌরভরাশি পরানে পশিছে আসি সুখস্বপ্ন পরকাশি নিভৃত অন্তরে। পরশপুলকে ভোর চোখে আসে ঘুমঘোর, তোমার চুম্বন মোর সর্বাঙ্গে সঞ্চরে।
৫৬
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
আজি উন্মাদ মধুনিশি ওগো চৈত্রনিশীথশশী। তুমি এ বিপুল ধরণীর পানে কী দেখিছ একা বসি চৈত্রনিশীথশশী॥ কত নদীতীরে কত মন্দিরে কত বাতায়নতলে কত কানাকানি, মন-জানাজানি সাধাসাধি কত ছলে। শাখা-প্রশাখার দ্বার-জানালার আড়ালে আড়ালে পশি কত সুখদুখ কত কৌতুক দেখিতেছ একা বসি চৈত্রনিশীথশশী॥ মোরে দেখো চাহি— কেহ কোথা নাহি, শূন্যভবনছাদে নৈশ পবন কাঁদে। তোমারি মতন একাকী আপনি চাহিয়া রয়েছি বসি চৈত্রনিশীথশশী॥
৫৭
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
সে আসি কহিল, ‘প্রিয়ে, মুখ তুলে চাও।’ দুষিয়া তাহারে রুষিয়া কহিনু, ‘যাও!’ সখী ওলো সখী, সত্য করিয়া বলি, তবু সে গেল না চলি। দাঁড়ালো সমুখে; কহিনু তাহারে, ‘সরো!’ ধরিল দু হাত; কহিনু, ‘আহা, কী কর!’ সখী ওলো সখী, মিছে না কহিব তোরে, তবু ছাড়িল না মোরে। শ্রুতিমূলে মুখ আনিল সে মিছিমিছি। নয়ন বাঁকায়ে কহিনু তাহারে, ‘ছি ছি!’ সখী ওলো সখী, কহি লো শপথ ক’রে তবু সে গেল না স’রে। অধরে কপোল পরশ করিল তবু। কাঁপিয়া কহিনু, ‘এমন দেখি নি কভু।’ সখী ওলো সখী, একি তার বিবেচনা, তবু মুখ ফিরালো না। আপন মালাটি আমারে পরায়ে দিল। কহিনু তাহারে, ‘মালায় কী কাজ ছিল!’ সখী ওলো সখী, নাহি তার লাজ ভয়, মিছে তারে অনুনয়॥ আমার মালাটি চলিল গলায় লয়ে। চাহি তার পানে রহিনু অবাক হয়ে। সখী ওলো সখী, ভাসিতেছি আঁখিনীরে— কেন সে এল না ফিরে॥
৫৮
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
এ কি সত্য সকলই সত্য, হে আমার চিরভক্ত॥ মোর নয়নের বিজুলি-উজল আলো যেন ঈশান কোণের ঝটিকার মতো কালো এ কি সত্য। মোর মধুর অধর বধূর নবীন অনুরাগ-সম রক্ত হে আমার চিরভক্ত, এ কি সত্য॥ অতুল মাধুরী ফুটেছে আমার মাঝে, মোর চরণে চরণে সুধাসঙ্গীত বাজে এ কি সত্য। মোরে না হেরিয়া নিশির শিশির ঝরে, প্রভাত-আলোকে পুলক আমারি তরে এ কি সত্য। মোর তপ্তকপোল-পরশে-অধীর সমীর মদিরমত্ত হে আমার চিরভক্ত, এ কি সত্য॥
৫৯
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
এবার চলিনু তবে॥ সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে। উচ্ছল জল করে ছলছল, জাগিয়া উঠেছে কলকোলাহল, তরণীপতাকা চলচঞ্চল কাঁপিছে অধীর রবে। সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে॥ আমি নিষ্ঠুর কঠিন কঠোর, নির্মম আমি আজি। আর নাই দেরি, ভৈরবভেরী বাহিরে উঠেছে বাজি। তুমি ঘুমাইছ নিমীলনয়নে, কাঁপিয়া উঠিছ বিরহস্বপনে, প্রভাতে জাগিয়া শূন্য শয়নে কাঁদিয়া চাহিয়া রবে। সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে॥ অরুণ তোমার তরুণ অধর করুণ তোমার আঁখি— অমিয়রচন সোহাগবচন অনেক রয়েছে বাকি। পাখি উড়ে যাবে সাগরের পার, সুখময় নীড় পড়ে রবে তার, মহাকাশ হতে ওই বারে-বার আমারে ডাকিছে সবে। সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে॥ বিশ্বজগৎ আমারে মাগিলে কে মোর আত্মপর। আমার বিধাতা আমাতে জাগিলে কোথায় আমার ঘর। কিসেরই বা সুখ, ক’ দিনের প্রাণ। ওই উঠিয়াছে সংগ্রামগান, অমর মরণ রক্তচরণ নাচিছে সগৌরবে। সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে॥
৬০
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
বন্ধু, কিসের তরে অশ্রু ঝরে, কিসের লাগি দীর্ঘশ্বাস। হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস। রিক্ত যারা সর্বহারা সর্বজয়ী বিশ্বে তারা, গর্বময়ী ভাগ্যদেবীর নয়কো তারা ত্রীতদাস। হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস॥ আমরা সুখের স্ফীত বুকের ছায়ার তলে নাহি চরি আমরা দুখের বক্র মুখের চক্র দেখে ভয় না করি। ভগ্ন ঢাকে যথাসাধ্য বাজিয়ে যাব জয়বাদ্য, ছিন্ন আশার ধ্বজা তুলে ভিন্ন করব নীলাকাশ। হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস॥ হে অলক্ষ্মী, রুক্ষকেশী, তুমি দেবী অচঞ্চলা। তোমার রীতি সরল অতি, নাহি জানো ছলাকলা। জ্বালাও পেটে অগ্নিকণা নাইকো তাহে প্রতারণা টানো যখন মরণ-ফাঁসি বল নাকো মিষ্টভাষ। হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস॥ ধরার যারা সেরা সেরা মানুষ তারা তোমার ঘরে। তাদের কঠিন শয্যাখানি তাই পেতেছ মোদের তরে॥ আমরা বরপুত্র তব যাহাই দিবে তাহাই লব, তোমায় দিব ধন্যধ্বনি মাথায় বহি সর্বনাশ। হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস॥ যৌবরাজ্যে বসিয়ে দে মা, লক্ষ্মীছাড়ার সিংহাসনে। ভাঙা কুলোয় করুক পাখা তোমার যত ভৃত্যগণে। দগ্ধ ভালে প্রলয়শিখা দিক্ মা, এঁকে তোমার টিকা, পরাও সজ্জা লজ্জাহারা— জীর্ণকন্থা ছিন্নবাস। হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস॥ লুকোক তোমার ডঙ্কা শুনে কপট সখার শূন্য হাসি। পালাক ছুটে পুচ্ছ তুলে মিথ্যে চাটু মক্কা-কাশী। আত্মপরের-প্রভেদ-ভোলা জীর্ণ দুয়োর নিত্য খোলা, থাকবে তুমি থাকব আমি সমানভাবে বারো মাস। হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস॥ শঙ্কা-তরাস লজ্জা-শরম চুকিয়ে দিলেম স্তুতি-নিন্দে। ধুলো সে তোর পায়ের ধুলো তাই মেখেছি ভক্তবৃন্দে। আশারে কই, ‘ঠাকুরানী, তোমার খেলা অনেক জানি, যাহার ভাগ্যে সকল ফাঁকি তারেও ফাঁকি দিতে চাস।’ হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস॥ মৃত্যু যেদিন বলবে ‘জাগো, প্রভাত হল তোমার রাতি’ নিবিয়ে যাব আমার ঘরের চন্দ্র সূর্য দুটো বাতি। আমরা দোঁহে ঘেঁষাঘেঁষি চিরদিনের প্রতিবেশী, বন্ধুভাবে কণ্ঠে সে মোর জড়িয়ে দেবে বাহুপাশ— বিদায়কালে অদৃষ্টেরে করে যাব পরিহাস॥
৬১
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ভাঙা দেউলের দেবতা, তব বন্দনা রচিতে, ছিন্না বীণার তন্ত্রী বিরতা। সন্ধ্যাগগনে ঘোষে না শঙ্খ তোমার আরতিবারতা। তব মন্দির স্থিরগম্ভীর, ভাঙা দেউলের দেবতা॥ তব জনহীন ভবনে থেকে থেকে আসে ব্যাকুল গন্ধ নববসন্তপবনে। যে ফুলে রচে নি পূজার অর্ঘ্য, রাখে নি ও রাঙা চরণে, সে ফুল ফোটার আসে সমাচার জনহীন ভাঙা ভবনে॥ পূজাহীন তব পূজারি কোথা সারা দিন ফিরে উদাসীন কার প্রসাদের ভিখারি। গোধূলিবেলায় বনের ছায়ায় চির-উপবাস-ভুখারি ভাঙা মন্দিরে আসে ফিরে ফিরে পূজাহীন তব পূজারি। ভাঙা দেউলের দেবতা, কত উৎসব হইল নীরব, কত পূজানিশা বিগতা। কত বিজয়ায় নবীন প্রতিমা কত যায় কত কব তা— শুধু চিরদিন থাকে সেবাহীন ভাঙা দেউলের দেবতা॥
৬২
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
যদি জোটে রোজ এমনি বিনি পয়সার ভোজ। ডিশের পরে ডিশ শুধু মটন কারি ফিশ, সঙ্গে তারি হুইস্কি সোডা দু-চার রয়াল ডোজ। পরের তহবিল চোকায় উইল্সনের বিল— থাকি মনের সুখে হাস্যমুখে, কে কার রাখে খোঁজ॥
৬৩
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
অভয় দাও তো বলি আমার wish কী— একটি ছটাক সোডার জলে পাকী তিন পোয়া হুইস্কি॥
৬৪
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
কত কাল রবে বল’ ভারত রে শুধু ডাল ভাত জল পথ্য ক’রে। দেশে অন্নজলের হল ঘোর অনটন— ধর’ হুইস্কি-সোডা আর মুর্গি-মটন। যাও ঠাকুর চৈতন-চুট্কি নিয়া— এস’ দাড়ি নাড়ি কলিমদ্দি মিয়া।
৬৫
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
কী জানি কী ভেবেছ মনে খুলে বলো ললনে। কী কথা হায় ভেসে যায় ওই ছলোছলো দুটি নয়নে।
৬৬
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
পাছে চেয়ে বসে আমার মন, আমি তাই ভয়ে ভয়ে থাকি। পাছে চোখে চোখে পড়ে বাঁধা, আমি তাই তো তুলি নে আঁখি॥
৬৭
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
বড়ো থাকি কাছাকাছি, তাই ভয়ে ভয়ে আছি। নয়ন বচন কোথায় কখন বাজিলে বাঁচি না-বাঁচি॥
৬৮
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
যারে মরণ-দশায় ধরে সে যে শতবার ক’রে মরে। পোড়া পতঙ্গ যত পোড়ে তত আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে॥
৬৯
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
দেখব কে তোর কাছে আসে— তুই রবি একেশ্বরী, একলা আমি রইব পাশে॥
৭০
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
তুমি আমায় করবে মস্ত লোক— দেবে লিখে রাজার টিকে প্রসন্ন ওই চোখ॥
৭১
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
চির-পুরানো চাঁদ, চিরদিবস এমনি থেকো আমার এই সাধ॥ পুরানো হাসি পুরানো সুধা মিটায় মম পুরানো ক্ষুধা— নূতন কোনো চকোর যেন পায় না পরসাদ॥
৭২
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
স্বর্গে তোমায় নিয়ে যাব উড়িয়ে— পিছে পিছে আমি চলব খুঁড়িয়ে, ইচ্ছা হবে টিকির ডগা ধ’রে বিষ্ণুদূতের মাথাটা দিই গুঁড়িয়ে॥
৭৩
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ভুলে ভুলে আজ ভুলময়। ভুলের লতায় বাতাসের ভুলে ফুলে ফুলে হোক ফুলময়। আনন্দ-ঢেউ ভুলের সাগরে উছলিয়া হোক কূলময়॥
৭৪
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
সকলই ভুলেছে ভোলা মন। ভোলে নি, ভোলে নি শুধু ওই চন্দ্রানন॥
৭৫
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
পোড়া মনে শুধু পোড়া মুখখানি জাগে রে। এত আছে লোক, তবু পোড়া চোখে আর কেহ নাহি লাগে রে॥
৭৬
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
বিরহে মরিব ব’লে ছিল মনে পণ, কে তোরা বাহুতে বাঁধি করিলি বারণ॥ ভেবেছিনু অশ্রুজলে ডুবিব অকূলতলে— কাহার সোনার তরী করিল তারণ॥
৭৭
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
কার হাতে যে ধরা দেব, প্রাণ, তাই ভাবতে বেলা অবসান॥ ডান দিকেতে তাকাই যখন বাঁয়ের লাগি কাঁদে রে মন— বাঁয়ের লাগি ফিরলে তখন দক্ষিণেতে পড়ে টান॥
৭৮
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ওগো হৃদয়বনের শিকারী, মিছে তারে জালে ধরা যে তোমারি ভিখারি॥ সহস্রবার পায়ের কাছে আপনি যে জন ম’রে আছে নয়নবাণের খোঁচা খেতে সে যে অনধিকারী॥
৭৯
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ওগো দয়াময়ী চোর, এত দয়া মনে তোর! বড়ো দয়া ক’রে কণ্ঠে আমার জড়াও মায়ার ডোর। বড়ো দয়া ক’রে চুরি ক’রে লও শূন্য হৃদয় মোর॥
৮০
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
চলেছে ছুটিয়া পলাতকা হিয়া, বেগে বহে শিরাধমনী। হায় হায় হায়, ধরিবারে তায় পিছে পিছে ধায় রমণী॥ বায়ুবেগভরে উড়ে অঞ্চল, লটপট বেণী দুলে চঞ্চল— একি রে রঙ্গ! আকুল-অঙ্গ ছুটে কুরঙ্গগমনী॥
৮১
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
আমি কেবল ফুল জোগাব তোমার দুটি রাঙা হাতে। বুদ্ধি আমার খেলে নাকো পাহারা বা মন্ত্রণাতে॥
৮২
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
মনোমন্দিরসুন্দরী! মণিমঞ্জীর গুঞ্জরি স্খলদঞ্চলা চলচঞ্চলা! অয়ি মঞ্জুলা মুঞ্জরী! রোষারুণরাগরঞ্জিতা! বঙ্কিম-ভুরু-ভঞ্জিতা! গোপনহাস্য-কুটিল-আস্য কপটকলহগঞ্জিতা! সঙ্কোচনত-অঙ্গিনী! ভয়ভঙ্গুরভঙ্গিনী! চকিত চপল নবকুরঙ্গ যৌবনবনরঙ্গিণী! অয়ি খলছলগুণ্ঠিতা! মধুকরভরকুণ্ঠিতা লুব্ধপবন -ক্ষুব্ধ-লোভন মল্লিকা অবলুণ্ঠিতা! চুম্বনধনবঞ্চিনী দুরূহগর্বমঞ্চিনী! রুদ্ধকোরক -সঞ্চিত-মধু কঠিনকনককঞ্জিনী॥
৮৩
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
তোমার কটি-তটের ধটি কে দিল রাঙিয়া — কোমল গায়ে দিল পরায়ে রঙিন আঙিয়া॥ বিহানবেলা আঙিনাতলে এসেছ তুমি কী খেলাছলে— চরণ দুটি চলিতে ছুটি পড়িছে ভাঙিয়া। তোমার কটি-তটের ধটি কে দিল রাঙিয়া॥ কিসের সুখে সহাস মুখে নাচিছ বাছনি— দুয়ার-পাশে জননী হাসে হেরিয়া নাচনি। তাথেই-থেই তালির সাথে কাঁকন বাজে মায়ের হাতে— রাখাল-বেশে ধরেছ হেসে বেণুর পাঁচনি। কিসের সুখে সহাস মুখে নাচিছ বাছনি। নিখিল শোনে আকুল-মনে নূপুর-বাজনা, তপন-শশী হেরিছে বসি তোমার সাজনা। ঘুমাও যবে মায়ের বুকে আকাশ চেয়ে রহে ও মুখে, জাগিলে পরে প্রভাত করে নয়ন-মাজনা। নিখিল শোনে আকুল-মনে নূপুর-বাজনা॥
৮৪
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
রাজরাজেন্দ্র জয় জয়তু জয় হে। ব্যাপ্ত পরতাপ তব বিশ্বময় হে॥ দুষ্টদলন তব দণ্ড ভয়কারী, শত্রুজনদর্পহর দীপ্ত তরবারি— সঙ্কটশরণ্য তুমি দৈন্যদুখহারী মুক্ত-অবরোধ তব অভ্যুদয় হে॥
৮৫
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
আমরা বসব তোমার সনে।— তোমার শরিক হব রাজার রাজা, তোমার আধেক সিংহাসনে॥ তোমার দ্বারী মোদের করেছে শির নত — তারা জানে না যে মোদের গরব কত। তাই বাহির হতে তোমায় ডাকি, তুমি ডেকে লও গো আপন জনে॥
৮৬
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
বঁধুয়া, অসময়ে কেন হে প্রকাশ। সকলই যে স্বপ্ন ব’লে হতেছে বিশ্বাস॥ তুমি গগনেরই তারা মর্তে এলে পথহারা— এলে ভুলে অশ্রুজলে আনন্দেরই হাস॥
৮৭
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
কবরীতে ফুল শুকালো কাননের ফুল ফুটল বনে॥ দিনের আলো প্রকাশিল, মনের সাধ রহিল মনে॥
৮৮
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
মলিন মুখে ফুটুক হাসি, জুড়াক দু নয়ন। মলিন বসন ছাড়ো সখী, পরো আভরণ। অশ্রু-ধোওয়া কাজল-রেখা আবার চোখে দিক-না দেখা, শিথিল বেণী তুলুক বেঁধে কুসুমবন্ধন॥
৮৯
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ওর মানের এ বাঁধ টুটবে না কি টুটবে না। ওর মনের বেদন থাকবে মনে, প্রাণের কথা ফুটবে না?। কঠিন পাষাণ বুকে লয়ে নাই রহিল অটল হয়ে প্রেমেতে ওই পাথর ক্ষ’য়ে চোখের জল কি ছুটবে না?।
৯০
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
আজ আমার আনন্দ দেখে কে! কে জানে বিদেশ হতে কে এসেছে— ঘরে আমার কে এসেছে! আকাশে উঠেছে চাঁদা, সাগর কি থাকে বাঁধা— বসন্তরায়ের প্রাণে ঢেউ উঠেছে॥
৯১
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
আর কি আমি ছাড়ব তোরে। মন দিয়ে মন নাই বা পেলেম, জোর ক’রে রাখিব ধ’রে। শূন্য করে হৃদয়পুরী মন যদি করিলে চুরি তুমিই তবে থাকো সেথায় শূন্য হৃদয় পূর্ণ ক’রে॥
৯২
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
যেখানে রূপের প্রভা নয়ন-লোভা সেখানে তোমার মতন ভোলা কে ঠাকুরদাদা। যেখানে রসিকসভা পরম-শোভা সেখানে এমন রসের ঝোলা কে ঠাকুরদাদা। যেখানে গলাগলি কোলাকুলি তোমারি বেচা-কেনা সেই হাটে, পড়ে না পদধূলি পথ ভুলি যেখানে ঝগড়া করে ঝগ্ড়াটে॥ যেখানে ভোলাভুলি খোলাখুলি সেখানে তোমার মতন খোলা কে ঠাকুরদাদা॥
৯৩
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
এই একলা মোদের হাজার মানুষ দাদাঠাকুর, এই আমাদের মজার মানুষ দাদাঠাকুর॥ এই তো নানা কাজে, এই তো নানা সাজে, এই আমাদের খেলার মানুষ দাদাঠাকুর। সব মিলনে মেলার মানুষ দাদাঠাকুর॥ এই তো হাসির দলে, এই তো চোখের জলে, এই তো সকল ক্ষণের মানুষ দাদাঠকুর। এই তো ঘরে ঘরে, এই তো বাহির করে এই আমাদের কোণের মানুষ দাদাঠাকুর। এই আমাদের মনের মানুষ দাদাঠকুর॥
৯৫
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
মোরা চলব না। মুকুল ঝরে ঝরুক, মোরা ফলব না॥ সূর্যতারা আগুন ভুগে জ্ব’লে মরুক যুগে যুগে— আমরা যতই পাই-না জ্বালা জ্বলব না॥ বনের শাখা কথা বলে, কথা জাগে সাগরজলে— এই ভুবনে আমরা কিছুই বলব না। কোথা হতে লাগে রে টান, জীবন-জলে ডাকে রে বান— আমরা তো এই প্রাণের টলায় টলব না॥
৯৬
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
পথে যেতে তোমার সাথে মিলন হল দিনের শেষে। দেখতে গিয়ে, সাঁঝের আলো মিলিয়ে গেল এক নিমেষে। দেখা তোমায় হোক বা না-হোক তাহার লাগি করব না শোক— ক্ষণেক তুমি দাঁড়াও, তোমার চরণ ঢাকি এলো কেশে॥
৯৭
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
আমার নিকড়িয়া-রসের রসিক কানন ঘুরে ঘুরে নিকড়িয়া বাঁশের বাঁশি বাজায় মোহন সুরে। আমার ঘর বলে, ‘তুই কোথায় যাবি, বাইরে গিয়ে সব খোয়াবি!’ আমার প্রাণ বলে, ‘তোর যা আছে সব যাক্-না উড়ে পুড়ে।’ ওগো, যায় যদি তো যাক্-না চুকে, সব হারাব হাসিমুখে— আমি এই চলেছি মরণসুধা নিতে পরান পূরে। ওগো, আপন যারা কাছে টানে এ রস তারা কেই বা জানে— আমার বাঁকা পথের বাঁকা সে যে ডাক দিয়েছে দূরে। এবার বাঁকার টানে সোজার বোঝা পড়ুক ভেঙে-চুরে॥
৯৮
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
যখন দেখা দাও নি, রাধা, তখন বেজেছিল বাঁশি! এখন চোখে চোখে চেয়ে সুর যে আমার গেল ভাসি! তখন নানা তানের ছলে ডাক ফিরেছে জলে স্থলে, এখন আমার সকল কাঁদা রাধার রূপে উঠল হাসি॥
৯৯
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
বঁধুর লাগি কেশে আমি পরব এমন ফুল স্বর্গে মর্তে তিন ভুবনে নাইকো যাহার মূল। বাঁশির ধ্বনি হাওয়ায় ভাসে, সবার কানে বাজবে না সে— দেখ্ লো চেয়ে যমুনা ওই ভাসিয়ে গেল কূল॥
১০০
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
মধুঋতু নিত্য হয়ে রইল তোমার মধুর দেশে— যাওয়া-আসার কান্নাহাসি হাওয়ায় সেথা বেড়ায় ভেসে। যায় যে জনা সেই শুধু যায়, ফুল ফোটা তো ফুরোয় না হায়— ঝরবে যে ফুল সেই কেবলই ঝরে পড়ে বেলাশেষে॥ যখন আমি ছিলেম কাছে তখন কত দিয়েছি গান— এখন আমার দূরে যাওয়া, এরও কি গো নাই কোনো দান। পুষ্পবনের ছায়ায় ঢেকে এই আশা তাই গেলেম রেখে— আগুন-ভরা ফাগুনকে তোর কাঁদায় যেন আষাঢ় এসে॥
১০১
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ও তো আর ফিরবে না রে, ফিরবে না আর, ফিরবে না রে। ঝড়ের মুখে ভাসল তরী— কূলে ভিড়বে না রে॥ কোন্ পাগলে নিল ডেকে, কাঁদন গেল পিছে রেখে— ওকে তোর বাহুর বাঁধন ঘিরবে না রে॥
১০২
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
বাজে রে বাজে ডমরু বাজে হৃদয়মাঝে, হৃদয়মাঝে। নাচে রে নাচে চরণ নাচে প্রাণের কাছে, প্রাণের কাছে। প্রহর জাগে, প্রহরী জাগে— তারায় তারায় কাঁপন লাগে। মরমে মরমে বেদনা ফুটে— বাঁধন টুটে, বাঁধন টুটে॥
১০৩
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
আমার মনের বাঁধন ঘুচে যাবে যদি ও ভাই রে, থাক্ বাইরে বাঁধন তবে নিরবধি। যদি সাগর যাবার হুকুম থাকে থাক্ তটের বাঁধন বাঁকে বাঁকে, তবে বাঁধে বাঁধে গান গাবে নদী ভাই রে॥
১০৪
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
এতদিন পরে মোরে আপন হাতে বেঁধে দিলে মুক্তিডোরে। সাবধানীদের পিছে পিছে দিন কেটেছে কেবল মিছে, ওদের বাঁধা পথের বাঁধন হতে টেনে নিলে আপন ক’রে॥
১০৫
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
নূতন পথের পথিক হয়ে আসে, পুরাতন সাথি, মিলন-উষায় ঘোমটা খসায় চিরবিরহের রাতি। যারে বারে বারে হারিয়ে মেলে আজ প্রাতে তার দেখা পেলে নূতন করে পায়ের তলে দেব হৃদয় পাতি॥
১০৬
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
কাজ ভোলাবার কে গো তোরা! রঙিন সাজে কে যে পাঠায় কোন্ সে ভুবন-মনো-চোরা! কঠিন পাথর সারে সারে দেয় পাহারা গুহার দ্বারে, হাসির ধারায় ডুবিয়ে তারে ঝরাও রসের সুধা-ঝোরা! স্বপন-তরীর তোরা নেয়ে লাগল প্রাণে নেশার হাওয়া, পাগ্লা পরান চলে গেয়ে। কোন্ উদাসীর উপবনে বাজল বাঁশি ক্ষণে ক্ষণে, ভুলিয়ে দিল ঈশান কোণে ঝঞ্ঝা ঘনায় ঘনঘোরা।
১০৭
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
শেষ ফলনের ফসল এবার কেটে লও, বাঁধো আঁটি। বাকি যা নয় গো নেবার মাটিতে হোক তা মাটি॥
১০৮
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
বাঁধন কেন ভূষণ-বেশে তোরে ভোলায়, হায় অভাগী। মরণ কেন মোহন হেসে তোরে দোলায়, হায় অভাগী॥
১০৯
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
দয়া করো, দয়া করো প্রভু, ফিরে ফিরে শত শত অপরাধে অপরাধিনীরে॥ অন্তরে রয়েছ জাগি, তোমার প্রসাদ-লাগি দুর্বল পরান বাধা ঘটায় বাহিরে॥ শঙ্কা আসে, লজ্জা আসে, মরি অবসাদে। দৈন্যরাশি ফেলে গ্রাসি, ঘেরে পরমাদে। ক্লান্ত দেহে তন্দ্রা লাগে, ধুলায় শয়ন মাগে— অপথে জাগিয়া উঠি ভাসি আঁখিনীরে॥
১১০
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
জয় জয় জয় হে জয় জ্যোতির্ময়— মোহকলুষঘন কর’ ক্ষয়, কর’ ক্ষয়॥ অগ্নিপরশ তব কর’ কর’ দান, কর’ নির্মল মম তনুমন প্রাণ— বন্ধনশৃঙ্খল নাহি সয়, নাহি সয়॥ গূঢ় বিঘ্ন যত কর’ উৎপাটিত। অমৃতদ্বার তব কর’ উদ্ঘাটিত। যাচি যাত্রিদল, হে কর্ণধার, সুপ্তিসাগর কর’ কর’ পার— স্বপ্নের সঞ্চয় হোক লয়, হোক লয়॥
১১১
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
বাজো রে বাঁশরি, বাজো। সুন্দরী, চন্দনমাল্যে মঙ্গলসন্ধ্যায় সাজো॥ বুঝি মধুফাল্গুনমাসে চঞ্চল পান্থ সে আসে— মধুকরপদভরকম্পিত চম্পক অঙ্গনে ফোটে নি কি আজও॥ রক্তিম অংশুক মাথে, কিংশুককঙ্কণ হাতে, মঞ্জীরঝঙ্কৃত পায়ে সৌরভমন্থর বায়ে বন্দনসঙ্গীতগুঞ্জনমুখরিত নন্দনকুঞ্জে বিরাজো॥
১১২
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
তোমায় সাজাব যতনে কুসুমে রতনে কেয়ূরে কঙ্কণে কুঙ্কুমে চন্দনে॥ কুন্তলে বেষ্টিব স্বর্ণজালিকা, কণ্ঠে দোলাইব মুক্তামালিকা, সীমন্তে সিন্দুর অরুণ বিন্দুর— চরণ রঞ্জিব অলক্ত-অঙ্কনে॥ সখীরে সাজাব সখার প্রেমে অলক্ষ্য প্রাণের অমূল্য হেমে। সাজাব সকরুণ বিরহবেদনায়, সাজাব অক্ষয় মিলনসাধনায়— মধুর লজ্জা রচিব সজ্জা যুগল প্রাণের বাণীর বন্ধনে॥
১১৩
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
নমো নমো শচীচিতরঞ্জন, সন্তাপভঞ্জন- নবজলধরকান্তি, ঘননীল-অঞ্জন— নমো হে, নমো নমো॥ নন্দনবীথির ছায়ে তব পদপাতে নব পারিজাতে উড়ে পরিমল মধুরাতে— নমো হে, নমো নমো। তোমার কটাক্ষের ছন্দে মেনকার মঞ্জীরবন্ধে জেগে উঠে গুঞ্জন মধুকরগঞ্জন— নমো হে, নমো নমো॥
১১৪
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী হে নন্দনবাসিনী উর্বশী। গোষ্ঠে যবে নামে সন্ধ্যা শ্রান্ত দেহে স্বর্ণাঞ্চল টানি তুমি কোনো গৃহপ্রান্তে নাহি জ্বালো সন্ধ্যাদীপখানি। দ্বিধায় জড়িত পদে কম্প্রবক্ষে নম্রনেত্রপাতে স্মিতহাস্যে নাহি চল লজ্জিত বাসরশয্যাতে অর্ধরাতে। উষার উদয়-সম অনবগুণ্ঠিতা তুমি অকুণ্ঠিতা॥ সুরসভাতলে যবে নৃত্য করো পুলকে উল্লসি হে বিলোল হিল্লোল উর্বশী, ছন্দে নাচি উঠে সিন্ধুমাঝে তরঙ্গের দল, শস্যশীর্ষে শিহরিয়া কাঁপি উঠে ধরার অঞ্চল, তোমার মদির গন্ধ অন্ধ বায়ু বহে চারি ভিতে, মধুমত্ত ভৃঙ্গ-সম মুগ্ধ কবি ফিরে লুব্ধ চিতে উদ্দাম গীতে। নূপুর গুঞ্জরি চলো আকুল-অঞ্চলা বিদ্যুতচঞ্চলা॥
১১৫
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস— তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ॥ এ সংসারের নিত্য খেলায় প্রতিদিনের প্রাণের মেলায় বাটে ঘাটে হাজার লোকের হাস্য-পরিহাস— মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ॥ আমের বনে দোলা লাগে, মুকুল প’ড়ে ঝ’রে— চিরকালের চেনা গন্ধ হাওয়ায় ওঠে ভ’রে। মঞ্জরিত শাখায় শাখায়, মউমাছিদের পাখায় পাখায়, ক্ষণে ক্ষণে বসন্তদিন ফেলেছে নিশ্বাস— মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ॥
১১৬
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
বলেছিল ‘ধরা দেব না’, শুনেছিল সেই বড়াই। বীরপুরুষের সয় নি গুমোর, বাধিয়ে দিয়েছে লড়াই। তার পরে শেষে কী যে হল কার, কোন্ দশা হল জয়পতাকার।— কেউ বলে জিৎ, কেউ বলে হার, আমরা গুজব ছড়াই॥
১১৭
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
গুরুপদে মন করো অর্পণ, ঢালো ধন তাঁর ঝুলিতে। লঘু হবে ভার, রবে নাকো আর ভবের দোলায় দুলিতে। হিসাবের খাতা নাড়ো ব’সে ব’সে, মহাজনে নেয় সুদ ক’ষে ক’ষে — খাঁটি যেই জন সেই মহাজনে কেন থাকো হায় ভুলিতে। দিন চলে যায় ট্যাঁকে টাকা হায় কেবলই খুলিতে তুলিতে॥
১১৮
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
শোন্ রে শোন্ অবোধ মন,— শোন্ সাধুর উক্তি, কিসে মুক্তি সেই সুযুক্তি কর্ গ্রহণ। ভবের শুক্তি ভেঙে মুক্তিমুক্তা কর্ অন্বেষণ, ওরে ও ভোলা মন॥
১১৯
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
জয় জয় তাসবংশ-অবতংস! ত্রীড়াসরসীনীরে রাজহংস॥ তাম্রকূটঘনধূমবিলাসী! তন্দ্রাতীরনিবাসী! সব-অবকাশ-ধ্বংস! যমরাজেরই অংশ॥
১২০
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
তোলন-নামন পিছন-সামন। বাঁয়ে ডাইনে চাই নে, চাই নে। বোসন-ওঠন ছড়ান-গুটন। উল্টা-পাল্টা ঘূর্ণি চালটা— বাস্! বাস্! বাস্!
১২১
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
আমরা চিত্র অতি বিচিত্র, অতি বিশুদ্ধ, অতি পবিত্র। আমাদের যুদ্ধ নহে কেহ ক্রুদ্ধ। ওই দেখো গোলাম অতিশয় মোলাম। নাহি কোনো অস্ত্র খাকি-রাঙা বস্ত্র। নাহি লোভ, নাহি ক্ষোভ। নাহি লাফ, নাহি ঝাঁপ। যথারীতি জানি, সেই মতো মানি। কে তোমার শত্রু, কে তোমার মিত্র। কে তোমার টক্কা, কে তোমার ফক্কা॥
১২২
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
চিঁড়েতন হর্তন ইস্কাবন অতি সনাতন ছন্দে কর্তেছে নর্তন। কেউ বা ওঠে কেউ পড়ে, কেউ বা একটু নাহি নড়ে, কেউ শুয়ে শুয়ে ভুঁয়ে করে কালকর্তন॥ নাহি কহে কথা কিছু— একটু না হাসে, সামনে যে আসে চলে তারি পিছু পিছু। বাঁধা তার পুরাতন চালটা, নাই কোনো উল্টা-পাল্টা— নাই পরিবর্তন॥
১২৩
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
চলো নিয়ম-মতে। দূরে তাকিয়ো নাকো, ঘাড় বাঁকিয়ো নাকো! চলো সমান পথে। ‘হেরো অরণ্য ওই, হোথা শৃঙ্খলা কই— পাগল ঝর্নাগুলো দক্ষিণপর্বতে।’ ও দিক চেয়ো না, চেয়ো না— যেয়ো না, যেয়ো না। চলো সমান পথে॥
১২৪
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
হা-আ-আ-আই। নাই কাজ নাই। দিন যায়, দিন যায়। আয় আয়, আয় আয়। হাতে কাজ নাই॥
১২৫
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
হাঁচ্ছোঃ! —ভয় কী দেখাচ্ছ। ধরি টিপে টুঁটি, মুখে মারি মুঠি— বলো দেখি কী আরাম পাচ্ছ। হাঁচ্ছো। হাঁচ্ছো॥
১২৬
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
ইচ্ছে! —ইচ্ছে! সেই তো ভাঙছে, সেই তো গড়ছে, সেই তো দিচ্ছে নিচ্ছে॥ সেই তো আঘাত করছে তলায়, সেই তো বাঁধন ছিঁড়ে পালায়— বাঁধন পরতে সেই তো আবার ফিরছে॥
১২৭
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
আমরা দূর আকাশের নেশায় মাতাল ঘরভোলা সব যত— বকুলবনের গন্ধে আকুল মউমাছিদের মতো॥ সূর্য ওঠার আগে মন আমাদের জাগে— বাতাস থেকে ভোর-বেলাকার সুর ধরি সব কত॥ কে দেয় রে হাতছানি নীল পাহাড়ের মেঘে মেঘে, আভাস বুঝি জানি। পথ যে চলে বেঁকে বেঁকে অলখ-পানে ডেকে ডেকে ধরা যারে যায় না তারি ব্যাকুল খোঁজেই রত॥
১২৮
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
বাহির হলেম আমি আপন ভিতর হতে, নীল আকাশে পাড়ি দেব খ্যাপা হাওয়ার স্রোতে॥ আমের মুকুল ফুটে ফুটে যখন পড়ে ঝ’রে ঝ’রে মাটির আঁচল ভ’রে ভ’রে— ঝরাই আমার মনের কথা ভরা ফাগুন-চোতে॥ কোথা তুই প্রাণের দোসর বেড়াস ঘুরি ঘুরি— বনবীথির আলোছায়ায় করিস লুকোচুরি। আমার একলা বাঁশি পাগলামি তার পাঠায় দিগন্তরে তোমার গানের তরে— কবে বসন্তেরে জাগিয়ে দেব আমাতে আর তোতে॥
১২৯
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
শুনি ওই রুনুঝুনু পায়ে পায়ে নূপুরধ্বনি চকিত পথে বনে বনে॥ নির্ঝর ঝরো ঝরো ঝরিছে দূরে, জলতলে বাজে শিলা ঠুনু-ঠুনু ঠুনু-ঠুনু॥ ঝিল্লিঝঙ্কৃত বেণুবনছায়া পল্লবমর্মরে কাঁপে, পাপিয়া ডাকে, পুলকিত শিরীষশাখে দোল দিয়ে যায় দক্ষিণবায় পুন পুন॥
১৩০
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
এই তো ভরা হল ফুলে ফুলে ফুলের ডালা। ভরা হল— কে নিবি কে নিবি গো, গাঁথিবি বরণমালা। চম্পা চামেলি সেঁউতি বেলি দেখে যা সাজি আজি রেখেছি মেলি— নবমালতীগন্ধ-ঢালা॥ বনের মাধুরী হরণ করো তরুণ আপন দেহে। নববধূ, মিলনশুভলগন-রাত্রে লও গো বাসরগেহে— উপবনের সৌরভভাষা, রসতৃষিত মধুপের আশা। রাত্রিজাগর রজনীগন্ধা— করবী রূপসীর অলকানন্দা— গোলাপে গোলাপে মিলিয়া মিলিয়া রচিবে মিলনের পালা॥
১৩১
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
সুরের জালে কে জড়ালে আমার মন, আমি ছাড়াতে পারি নে সে বন্ধন॥ আমায় অজানা গহনে টানিয়া নিয়ে যে যায়, বরন-বরন স্বপনছায়ায় করিল মগন॥ জানি না কোথায় চরণ ফেলি, মরীচিকায় নয়ন মেলি— কী ভুলে ভুলালো দূরের বাঁশি! মন উদাসী আপনারে হারালো, ধ্বনিতে আবৃত চেতন॥
১৩২
নাট্যগীতি
নাট্যগীতি
কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে! মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা মনে মনে। তেপান্তরের পাথার পেরোই রূপ-কথার, পথ ভুলে যাই দূর পারে সেই চুপ্-কথার— পারুলবনের চম্পারে মোর হয় জানা মনে মনে॥ সূর্য যখন অস্তে পড়ে ঢুলি মেঘে মেঘে আকাশ-কুসুম তুলি। সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে আমি যাই ভেসে দূর দিশে— পরীর দেশের বন্ধ দুয়ার দিই হানা মনে মনে॥