১
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
গিয়াছে সে দিন যে দিন হৃদয় রূপেরই মোহনে আছিল মাতি, প্রাণের স্বপন আছিল যখন— ‘প্রেম’ ‘প্রেম’ শুধু দিবস-রাতি। শান্তিময়ী আশা ফুটেছে এখন হৃদয়-আকাশপটে, জীবন আমার কোমল বিভায় বিমল হয়েছে বটে, বালককালের প্রেমের স্বপন মধুর যেমন উজল যেমন তেমন কিছুই আসিবে না— তেমন কিছুই আসিবে না॥ সে দেবীপ্রতিমা নারিব ভুলিতে প্রথম প্রণয় আঁকিল যাহা, স্মৃতিমরু মোর শ্যামল করিয়া এখনো হৃদয়ে বিরাজে তাহা। সে প্রতিমা সেই পরিমলসম পলকে যা লয় পায়, প্রভাতকালের স্বপন যেমন পলকে মিশায়ে যায়। অলসপ্রবাহ জীবনে আমার সে কিরণ কভু ভাসিবে না আর— সে কিরণ কভু ভাসিবে না— সে কিরণ কভু ভাসিবে না॥
২
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
মন হতে প্রেম যেতেছে শুকায়ে, জীবন হতেছে শেষ। শিথিল কপোল, মলিন নয়ন, তুষারধবল কেশ। পাশেতে আমার নীরবে পড়িয়া অযতনে বীণাখানি— বাজাবার বল নাহিক এ হাতে, জড়িমাজড়িত বাণী। গীতিময়ী মোর সহচরী বীণা, হইল বিদায় নিতে। আর কি পারিবি ঢালিবারে তুই অমৃত আমার চিতে। তবু একবার, আর-একবার, ত্যজিবার আগে প্রাণ মরিতে মরিতে গাইয়া লইব সাধের সে-সব গান। দুলিবে আমার সমাধি-উপরে তরুগণ শাখা তুলি— বনদেবতারা গাহিবে তখন মরণের গানগুলি॥
৩
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
কেন গো সে মোরে যেন করে না বিশ্বাস। কেন গো বিষণ্ণ আঁখি আমি যবে কাছে থাকি, কেন উঠে মাঝে মাঝে আকুল নিশ্বাস। আদর করিতে মোরে চায় কতবার, সহসা কী ভেবে যেন ফেরে সে আবার। নত করি দু নয়নে কী যেন বুঝায় মনে, মন সে কিছুতে যেন পায় না আশ্বাস। আমি যবে ব্যগ্র হয়ে ধরি তার পাণি সে কেন চমকি উঠি লয় তাহা টানি। আমি কাছে গেলে হায় সে কেন গো সরে যায়— মলিন হইয়া আসে অধর সহাস॥
৪
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
তোরা বসে গাঁথিস মালা, তারা গলায় পরে। কখন যে শুকায়ে যায়, ফেলে দেয় রে অনাদরে॥ তোরা সুধা করিস দান, তারা শুধু করে পান, সুধায় অরুচি হলে ফিরেও তো নাহি চায়— হৃদয়ের পাত্রখানি ভেঙে দিয়ে চলে যায়॥ তোরা কেবল হাসি দিবি, তারা কেবল বসে আছে— চোখের জল দেখিলে তারা আর তো রবে না কাছে। প্রাণের ব্যথা প্রাণে রেখে প্রাণের আগুন প্রাণে ঢেকে পরান ভেঙে মধু দিবি অশ্রুছাঁকা হাসি হেসে— বুক ফেটে, কথা না ব’লে, শুকায়ে পড়িবি শেষে॥
৫
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
বলি, ও আমার গোলাপ-বালা, বলি, ও আমার গোলাপ-বালা— তোলো মুখানি, তোলো মুখানি— কুসুমকুঞ্জ করো আলা। বলি, কিসের শরম এত! সখী, কিসের শরম এত! সখী, পাতার মাঝারে লুকায়ে মুখানি কিসের শরম এত। বালা, ঘুমায়ে পড়েছে ধরা। সখী, ঘুমায় চন্দ্রতারা। প্রিয়ে, ঘুমায় দিক্বালারা সবে— ঘুমায় জগৎ যত। বলিতে মনের কথা, সখী, এমন সময় কোথা। প্রিয়ে, তোলো মুখানি, আছে গো আমার প্রাণের কথা কত। আমি এমন সুধীর স্বরে, সখী, কহিব তোমার কানে— প্রিয়ে, স্বপনের মতো সে কথা আসিয়ে পশিবে তোমার প্রাণে। তবে মুখানি তুলিয়ে চাও, সুধীরে মুখানি তুলিয়ে চাও। সখী, একটি চুম্বন দাও— গোপনে একটি চুম্বন চাও॥
৬
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
গোলাপ ফুল ফুটিয়ে আছে, মধুপ, হোথা যাস নে— ফুলের মধু লুটিতে গিয়ে কাঁটার ঘা খাস নে॥ হেথায় বেলা, হোথায় চাঁপা শেফালি হোথা ফুটিয়ে— ওদের কাছে মনের ব্যথা বল্ রে মুখ ফুটিয়ে॥ ভ্রমর কহে, ‘হোথায় বেলা হোথায় আছে নলিনী— ওদের কাছে বলিব নাকো আজিও যাহা বলি নি। মরমে যাহা গোপন আছে গোলাপে তাহা বলিব— বলিতে যদি জ্বলিতে হয় কাঁটারই ঘায়ে জ্বলিব।’
৭
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
পাগলিনী, তোর লাগি কী আমি করিব বল্। কোথায় রাখিব তোরে খুঁজে না পাই ভূমণ্ডল। আদরের ধন তুমি, আদরে রাখিব আমি— আদরিনী, তোর লাগি পেতেছি এ বক্ষস্থল। আয় তোরে বুকে রাখি— তুমি দেখো, আমি দেখি— শ্বাসে শ্বাস মিশাইব, আঁখিজলে আঁখিজল॥
৮
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
ওই কথা বলো সখী, বলো আর বার— ভালোবাস মোরে তাহা বলো বার বার। কতবার শুনিয়াছি, তবুও আবার যাচি— ভালোবাস মোরে তাহা বলো গো আবার॥
৯
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
শুন নলিনী, খোলো গো আঁখি— ঘুম এখনো ভাঙিল না কি! দেখো, তোমারি দুয়ার-’পরে সখী, এসেছে তোমারি রবি॥ শুনি প্রভাতের গাথা মোর দেখো ভেঙেছে ঘুমের ঘোর, জগত উঠেছে নয়ন মেলিয়া নূতন জীবন লভি। তবে তুমি কি সজনী জাগিবে নাকো, আমি যে তোমারি কবি॥ প্রতিদিন আসি, প্রতিদিন হাসি, প্রতিদিন গান গাহি— প্রতিদিন প্রাতে শুনিয়া সে গান ধীরে ধীরে উঠ চাহি। আজিও এসেছি, চেয়ে দেখো দেখি আর তো রজনী নাহি। আজিও এসেছি, উঠ উঠ সখী, আর তো রজনী নাহি। সখী, শিশিরে মুখানি মাজি সখী, লোহিত বসনে সাজি দেখো বিমল সরসী-আরশির ’পরে অপরূপ রূপরাশি। থেকে থেকে ধীরে হেলিয়া পড়িয়া নিজ মুখছায়া আধেক হেরিয়া ললিত অধরে উঠিবে ফুটিয়া শরমের মৃদু হাসি॥
১০
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
ও কথা বোলো না তারে, কভু সে কপট না রে— আমার কপাল-দোষে চপল সেজন। অধীরহৃদয় বুঝি শান্তি নাহি পায় খুঁজি, সদাই মনের মতো করে অন্বেষণ। ভালো সে বাসিত যবে করে নি ছলনা। মনে মনে জানিত সে সত্য বুঝি ভালোবাসে— বুঝিতে পারে নি তাহা যৌবনকল্পনা। হরষে হাসিত যবে হেরিয়া আমায়, সে হাসি কি সত্য নয়। সে যদি কপট হয় তবে সত্য বলে কিছু নাহি এ ধরায়। ও কথা বোলো না তারে— কভু সে কপট না রে, আমার কপাল-দোষে চপল সেজন। প্রেমমরীচিকা হেরি ধায় সত্য মনে করি, চিনিতে পারে নি সে যে আপনার মন॥
১১
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
সোনার পিঞ্জর ভাঙিয়ে আমার প্রাণের পাখিটি উড়িয়ে যাক। সে যে হেথা গান গাহে না! সে যে মোরে আর চাহে না! সুদূর কানন হইতে সে যে শুনেছে কাহার ডাক— পাখিটি উড়িয়ে যাক॥ মুদিত নয়ন খুলিয়ে আমার সাধের স্বপন যায় রে যায়। হাসিতে অশ্রুতে গাঁথিয়া গাঁথিয়া দিয়েছিনু তার বাহুতে বাঁধিয়া আপনার মনে কাঁদিয়া কাঁদিয়া ছিঁড়িয়া ফেলেছে হায় রে হায়, সাধের স্বপন যায় রে যায়॥ যে যায় সে যায়, ফিরিয়ে না চায়, যে থাকে সে শুধু করে হায় হায়— নয়নের জল নয়নে শুকায়— মরমে লুকায় আশা। বাঁধিতে পারে না আদরে সোহাগে— রজনী পোহায়, ঘুম হতে জাগে, হাসিয়া কাঁদিয়া বিদায় সে মাগে— আকাশে তাহার বাসা। যায় যদি তবে যাক। একবার তবু ডাক্। কী জানি যদি রে প্রাণ কাঁদে তার তবে থাক্, তবে থাক্॥
১২
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
হৃদয় মোর কোমল অতি, সহিতে নারি রবির জ্যোতি, লাগিলে আলো শরমে ভয়ে মরিয়া যাই মরমে॥ ভ্রমর মোর বসিলে পাশে তরাসে আঁখি মুদিয়া আসে, ভূতলে ঝ’রে পড়িতে চাহি আকুল হয়ে শরমে॥ কোমল দেহে লাগিলে বায় পাপড়ি মোর খসিয়া যায়, পাতার মাঝে ঢাকিয়া দেহ রয়েছি তাই লুকায়ে। আঁধার বনে রূপের হাসি ঢালিব সদা সুরভিরাশি, আঁধার এই বনের কোলে মরিব শেষে শুকায়ে॥
১৩
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
হৃদয়ের মণি আদরিনী মোর, আয় লো কাছে আয়। মিশাবি জোছনাহাসি রাশি রাশি মৃদু মধু জোছনায়। মলয় কপোল চুমে ঢলিয়া পড়িছে ঘুমে, কপোলে নয়নে জোছনা মরিয়া যায়। যমুনালহরীগুলি চরণে কাঁদিতে চায়॥
১৪
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
খুলে দে তরণী, খুলে দে তোরা, স্রোত বহে যায় যে। মন্দ মন্দ অঙ্গভঙ্গে নাচিছে তরঙ্গ রঙ্গে— এই বেলা খুলে দে॥ ভাঙিয়ে ফেলেছি হাল, বাতাসে পুরেছে পাল, স্রোতোমুখে প্রাণ মন যাক ভেসে যাক— যে যাবি আমার সাথে এই বেলা আয় রে॥
১৫
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
এ কী হরষ হেরি কাননে! পরান আকুল, স্বপন বিকশিত মোহমদিরাময় নয়নে॥ ফুলে ফুলে করিছে কোলাকুলি, বনে বনে বহিছে সমীরণ নবপল্লবে হিল্লোল তুলিয়ে— বসন্তপরশে বন শিহরে। কী জানি কোথা পরান মন ধাইছে বসন্তসমীরণে॥ ফুলেতে শুয়ে জোছনা হাসিতে হাসি মিলাইছে। মেঘ ঘুমায়ে ঘুমায়ে ভেসে যায়। ঘুমভারে অলসা বসুন্ধরা— দূরে পাপিয়া পিউ-পিউ রবে ডাকিছে সঘনে॥
১৬
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
আমি স্বপনে রয়েছি ভোর, সখী, আমারে জাগায়ো না। আমার সাধের পাখি যারে নয়নে নয়নে রাখি তারি স্বপনে রয়েছি ভোর, আমার স্বপন ভাঙায়ো না। কাল ফুটিবে রবির হাসি, কাল ছুটিবে তিমিররাশি— কাল আসিবে আমার পাখি, ধীরে বসিবে আমার পাশ। ধীরে গাহিবে সুখের গান, ধীরে ডাকিবে আমার নাম। ধীরে বয়ান তুলিয়া নয়ান খুলিয়া হাসিব সুখের হাস। আমার কপোল ভ’রে শিশির পড়িবে ঝ’রে— নয়নেতে জল, অধরেতে হাসি, মরমে রহিব ম’রে! তাহারি স্বপনে আজি মুদিয়া রেখেছি আঁখি— কখন আসিবে প্রাতে আমার সাধের পাখি, কখন জাগাবে মোরে আমার নামটি ডাকি॥
১৭
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
গেল গেল নিয়ে গেল এ প্রণয়স্রাতে। ‘যাব না’ ‘যাব না’ করি ভাসায়ে দিলাম তরী— উপায় না দেখি আর এ তরঙ্গ হতে॥ দাঁড়াতে পাই নে স্থান, ফিরিতে না পারে প্রাণ— বায়ুবেগে চলিয়াছি সাগরের পথে॥ জানিনু না, শুনিনু না, কিছু না ভাবিনু— অন্ধ হয়ে একেবারে তাহে ঝাঁপ দিনু। এত দূর ভেসে এসে ভ্রম যে বুঝেছি শেষে— এখন ফিরিতে কেন হয় গো বাসনা। আগেভাগে, অভাগিনী, কেন ভাবিলি না। এখন যে দিকে চাই, কূলের উদ্দেশ নাই— সম্মুখে আসিছে রাত্রি, আঁধার করিছে ঘোর। স্রোতপ্রতিকূলে যেতে বল যে নাই এ চিতে, শ্রান্ত ক্লান্ত অবসন্ন হয়েছে হৃদয় মোর॥
১৮
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
হাসি কেন নাই ও নয়নে! ভ্রমিতেছ মলিন-আননে। দেখো, সখী, আঁখি তুলি ফুলগুলি ফুটেছে কাননে॥ তোমারে মলিন দেখি ফুলেরা কাঁদিছে সখী শুধাইছে বনলতা কত কথা আকুল বচনে॥ এসো সখী, এসো হেথা, একটি কহো গো কথা— বলো, সখী, কার লাগি পাইয়াছ মনোব্যথা। বলো, সখী, মন তোর আছে ভোর কাহার স্বপনে॥
১৯
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
একবার বলো, সখী, ভালোবাস মোরে— রেখো না ফেলিয়া আর সন্দেহের ঘোরে। সখী, ছেলেবেলা হতে সংসারের পথে পথে মিথ্যা মরীচিকা লয়ে যেপেছি সময়। পারি নে, পারি নে আর— এসেছি তোমারি দ্বার— একবার বলো, সখী, দিবে কি আশ্রয়। সহেছি ছলনা এত, ভয় হয় তাই সত্যকার সুখ বুঝি এ কপালে নাই। বহুদিন ঘুমঘোরে ডুবায়ে রাখিয়া মোরে অবশেষে জাগায়ো না নিদারুণ ঘায়। ভালোবেসে থাকো যদি লও লও এই হৃদি— ভগ্ন চূর্ণ দগ্ধ এই হৃদয় আমার এ হৃদয় চাও যদি লও উপহার॥
২০
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া। চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি। ভেবেছিনু কোথা তুমি স্বর্গের দেবতা, কেমনে তোমারে কব প্রণয়ের কথা। ভেবেছিনু মনে মনে দূরে দূরে থাকি চিরজন্ম সঙ্গোপনে পূজিব একাকী— কেহ জানিবে না মোর গভীর প্রণয়, কেহ দেখিবে না মোর অশ্রুবারিচয়। আপনি আজিকে যবে শুধাইছ আসি, কেমনে প্রকাশি কব কত ভালোবাসি॥
২১
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
কেমনে শুধিব বলো তোমার এ ঋণ। এ দয়া তোমার, মনে রবে চিরদিন। যবে এ হৃদয়মাঝে ছিল না জীবন, মনে হ’ত ধরা যেন মরুর মতন, সে হৃদে ঢালিয়ে তব প্রেমবারিধার নূতন জীবন যেন করিলে সঞ্চার। একদিন এ হৃদয়ে বাজিত প্রেমের গান, কবিতায় কবিতায় পূর্ণ যেন ছিল প্রাণ— দিনে দিনে সুখগান থেমে গেল এ হৃদয়ে, নিশীথশ্মশানসম আছিল নীরব হয়ে— সহসা উঠেছে বাজি তব করপরশনে, পুরানো সকল ভাব জাগিয়া উঠেছে মনে, বিরাজিছে এ হৃদয়ে যেন নব-ঊষাকাল, শূন্য হৃদয়ের যত ঘুচেছে আঁধারজাল। কেমনে শুধিব বলো তোমার এ ঋণ। এ দয়া তোমার, মনে রবে চিরদিন॥
২২
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
এ ভালোবাসার যদি দিতে প্রতিদান— একবার মুখ তুলে চাহিয়া দেখিতে যদি যখন দুখের জল বর্ষিত নয়ান— শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে যবে ছুটে আসিতাম, সখী, ওই মধুময় কোলে দিতে যদি স্থান— তা হলে, তা হলে, সখী; চিরজীবনের তরে দারুণযাতনাময় হ’ত না পরান। একটি কথায় তব একটু স্নেহের স্বরে যদি যায় জুড়াইয়া হৃদয়ের জ্বালা, তবে সেইটুকু, সখী, কোরো অভাগার তরে— নহিলে হৃদয় যাবে ভেঙেচুরে বালা! একবার মুখ তুলে চেয়ো এ মুখের পানে— মুছায়ে দিয়ো গো, সখী, নয়নের জল— তোমার স্নেহের ছায়ে আশ্রয় দিয়ো গো মোরে, আমার হৃদয় মন বড়োই দুর্বল। সংসারের স্রোতে ভেসে কত দূর যাব চলে— আমি কোথা রব আর তুমি কোথা রবে। কত বর্ষ হবে গত, কত সূর্য হবে অস্ত, আছিল নূতন যাহা পুরাতন হবে। তখন সহসা যদি দেখা হয় দুইজনে— আসি যদি কহিবারে মরমের ব্যথা— তখন সঙ্কোচভরে দূরে কি যাইবে সরে। তখন কি ভালো করে কবে নাকো কথা॥
২৩
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
ওকি সখা, কেন মোরে কর তিরস্কার! একটু বসি বিরলে কাঁদিব যে মন খুলে তাতেও কী আমি বলো করিনু তোমার। মুছাতে এ অশ্রুবারি বলি নি তোমায়, একটু আদরের তরে ধরি নি তো পায়— তবে আর কেন, সখা, এমন বিরাগ-মাখা ভ্রূকুটি এ ভগ্নবুকে হানো বার বার। জানি জানি এ কপাল ভেঙেছে যখন অশ্রুবারি পারিবে না গলাতে ও মন— পথের পথিকও যদি মোরে হেরি যায় কাঁদি তবুও অটল রবে হৃদয় তোমার॥
২৪
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
ওকি সখা, মুছ আঁখি। আমার তরেও কাঁদিবে কি! কে আমি বা! আমি অভাগিনী— আমি মরি তাহে দুখ কিবা॥ পড়ে ছিনু চরণতলে— দলে গেছ, দেখ নি চেয়ে। গেছ গেছ, ভালো ভালো— তাহে দুখ কিবা॥
২৫
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
হা সখী, ও আদরে আরো বাড়ে মনোব্যথা। ভালো যদি নাহি বাসে কেন তবে কহে প্রণয়ের কথা॥ মিছে প্রণয়ের হাসি বোলো তারে ভালো নাহি বাসি। চাই নে মিছে আদর তাহার, ভালোবাসা চাই নে। বোলো বোলো, সজনী লো, তারে— আর যেন সে লো আসে নাকো হেথা॥
২৬
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
ওকে কেন কাঁদালি! ও যে কেঁদে চলে যায়— ওর হাসিমুখ যে আর দেখা যাবে না॥ শূন্যপ্রাণে চলে গেল, নয়নেতে অশ্রুজল— এ জনমে আর ফিরে চাবে না॥ দু দিনের এ বিদেশে কেন এল ভালোবেসে, কেন নিয়ে গেল প্রাণে বেদনা। হাসি খেলা ফুরালো রে, হাসিব আর কেমনে! হাসিতে তার কান্নামুখ পড়ে যে মনে। ডাক্ তারে একবার— কঠিন নহে প্রাণ তার!— আর বুঝি তার সাড়া পাবে না॥
২৭
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
এতদিন পরে, সখী, সত্য সে কি হেথা ফিরে এল। দীনবেশে ম্লানমুখে কেমনে অভাগিনী যাবে তার কাছে সখী রে। শরীর হয়েছে ক্ষীণ, নয়ন জ্যোতিহীন— সবই গেছে কিছু নাই— রূপ নাই, হাসি নাই— সুখ নাই, আশা নাই— সে আমি আর আমি নাই— না যদি চেনে সে মোরে তা হলে কী হবে॥
২৮
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
চরাচর সকলই মিছে মায়া, ছলনা। কিছুতেই ভুলি নে আর— আর না রে— মিছে ধূলিরাশি লয়ে কী হবে। সকলই আমি জেনেছি, সবই শূন্য—শূন্য—শূন্য ছায়া— সবই ছলনা॥ দিনরাত যার লাগি সুখ দুখ না করিনু জ্ঞান, পরান মন সকলই দিয়েছি, তা হতে রে কিবা পেনু। কিছু না—সবই ছলনা॥
২৯
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
তারে দেহো গো আনি। ওই রে ফুরায় বুঝি অন্তিম যামিনী॥ একটি শুনিব কথা, একটি শুনাব ব্যথা— শেষবার দেখে নেব সেই মধুমুখানি॥ ওই কোলে জীবনের শেষ সাধ মিটিবে, ওই কোলে জীবনের শেষ স্বপ্ন ছুটিবে। জনমে পূরে নি যাহা আজ কি পূরিবে তাহা। জীবনের সব সাধ ফুরাবে এখনি?।
৩০
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
সাধের কাননে মোর রোপণ করিয়াছিনু একটি লতিকা, সখী, অতিশয় যতনে। প্রতিদিন দেখিতাম কেমন সুন্দর ফুল ফুটিয়াছে শত শত হাসি-হাসি আননে। প্রতিদিন সযতনে ঢালিয়া দিতাম জল, প্রতিদিন ফুল তুলে গাঁথিতাম মালিকা। সোনার লতাটি আহা বন করেছিল আলো— সে লতা ছিঁড়িতে আছে নিরদয় বালিকা? কেমন বনের মাঝে আছিল মনের সুখে গাঁঠে গাঁঠে শিরে শিরে জড়াইয়া পাদপে। প্রেমের সে আলিঙ্গনে স্নিগ্ধ রেখেছিল তারে কোমল পল্লবদলে নিবারিয়া আতপে। এতদিন ফুলে ফুলে ছিল ঢলোঢলো মুখ, শুকায়ে গিয়াছে আজি সেই মোর লতিকা। ছিন্ন অবশেষটুকু এখনো জড়ানো বুকে— এ লতা ছিঁড়িতে আছে নিরদয় বালিকা?।
৩১
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
সেই যদি সেই যদি ভাঙিল এ পোড়া হৃদি, সেই যদি ছাড়াছাড়ি হল দুজনায়, একবার এসো কাছে— কী তাহাতে দোষ আছে। জন্মশোধ দেখে নিয়ে লইব বিদায়। সেই গান একবার গাও সখী, শুনি— যেই গান একসনে গাইতাম দুইজনে, গাইতে গাইতে শেষে পোহাত যামিনী। চলিনু চলিনু তবে— এ জন্মে কি দেখা হবে। এ জন্মের সুখ তবে হল অবসান॥ তবে, সখী, এসো কাছে। কী তাহাতে দোষ আছে। আরবার গাও, সখী, পুরানো সে গান॥
৩২
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
দুজনে দেখা হল মধুযামিনী রে— কেন কথা কহিল না, চলিয়া গেল ধীরে॥ নিকুঞ্জে দখিনাবায় করিছে হায়-হায়, লতাপাতা দুলে দুলে ডাকিছে ফিরে ফিরে॥ দুজনের আঁখিবারি গোপনে গেল বয়ে, দুজনের প্রাণের কথা প্রাণেতে গেল রয়ে। আর তো হল না দেখা, জগতে দোঁহে একা— চিরদিন ছাড়াছাড়ি যমুনাতীরে॥
৩৩
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
দেখায়ে দে কোথা আছে একটু বিরল। এই ম্রিয়মাণ মুখে তোমাদের এত সুখে বলো দেখি কোন্ প্রাণে ঢালিব গরল। কিনা করিয়াছি তব বাড়াতে আমোদ— কত কষ্টে করেছিনু অশ্রুবারি রোধ। কিন্তু পারি নে যে সখা— যাতনা থাকে না ঢাকা, মর্ম হতে উচ্ছ্বসিয়া উঠে অশ্রুজল। ব্যথায় পাইয়া ব্যথা যদি গো শুধাতে কথা অনেক নিভিত তবু এ হৃদি-অনল। কেবল উপেক্ষা সহি বলো গো কেমনে রহি। কেমনে বাহিরে মুখে হাসিব কেবল॥
৩৪
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়। ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়। আয় আর-একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়। মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়। মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়— বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়। হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়— আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়॥
৩৫
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
গা সখী, গাইলি যদি, আবার সে গান। কতদিন শুনি নাই ও পুরানো তান॥ কখনো কখনো যবে নীরব নিশীথে একেলা রয়েছি বসি চিন্তামগ্ন চিতে— চমকি উঠিত প্রাণ— কে যেন গায় সে গান, দুই-একটি কথা তার পেতেছি শুনিতে। হা হা সখী, সে দিনের সব কথাগুলি প্রাণের ভিতরে যেন উঠিছে আকুলি। যেদিন মরিব, সখী, গাস্ ওই গান— শুনিতে শুনিতে যেন যায় এই প্রাণ॥
৩৬
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
ও গান আর গাস্ নে, গাস্ নে, গাস্ নে। যে দিন গিয়েছে সে আর ফিরিবে না— তবে ও গান গাস্ নে॥ হৃদয়ে যে কথা লুকানো রয়েছে সে আর জাগাস নে॥
৩৭
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
সকলই ফুরাইল। যামিনী পোহাইল। যে যেখানে সবে চলে গেল॥ রজনীতে হাসিখুশি, হরষপ্রমোদরাশি— নিশিশেষে আকুলমনে চোখের জলে সকলে বিদায় হল॥
৩৮
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
ফুলটি ঝরে গেছে রে। বুঝি সে উষার আলো উষার দেশে চলে গেছে॥ শুধু সে পাখিটি মুদিয়া আঁখিটি সারাদিন একলা বসে গান গাহিতেছে॥ প্রতিদিন দেখত যারে আর তো তারে দেখতে না পায়— তবু সে নিত্যি আসে গাছের শাখে, সেইখেনেতেই বসে থাকে, সারা দিন সেই গানটি গায়, সন্ধ্যা হলে কোথায় চলে যায়॥
৩৯
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
সখা হে, কী দিয়ে আমি তুষিব তোমায়। জরজর হৃদয় আমার মর্মবেদনায়, দিবানিশি অশ্রু ঝরিছে সেথায়॥ তোমার মুখে সুখের হাসি আমি ভালোবাসি— অভাগিনীর কাছে পাছে সে হাসি লুকায়॥
৪০
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
বলি গো সজনী, যেয়ো না, যেয়ো না— তার কাছে আর যেয়ো না, যেয়ো না। সুখে সে রয়েছে, সুখে সে থাকুক— মোর কথা তারে বোলো না, বোলো না॥ আমায় যখন ভালো সে না বাসে পায়ে ধরিলেও বাসিবে না সে। কাজ কী, কাজ কী, কাজ কী সজনী— মোর তরে তারে দিয়ো না বেদনা॥
৪১
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
সহে না যাতনা। দিবস গণিয়া গণিয়া বিরলে নিশিদিন বসে আছি শুধু পথপানে চেয়ে— সখা হে, এলে না। সহে না যাতনা॥ দিন যায়, রাত যায়, সব যায়— আমি বসে হায়! দেহে বল নাই, চোখে ঘুম নাই— শুকায়ে গিয়াছে আঁখিজল। একে একে সব আশা ঝ’রে ঝ’রে প’ড়ে যায়— সহে না যাতনা॥
৪২
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
যাই যাই, ছেড়ে দাও— স্রোতের মুখে ভেসে যাই। যা হবার তা হবে আমার, ভেসেছি তো ভেসে যাই॥ ছিল যত সহিবার সহেছি তো অনিবার— এখন কিসের আশা আর। ভেসেছি তো ভেসে যাই॥
৪৩
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
অসীম সংসারে যার কেহ নাহি কাঁদিবার সে কেন গো কাঁদিছে! অশ্রুজল মুছিবার নাহি রে অঞ্চল যার সেও কেন কাঁদিছে! কেহ যার দুঃখগান শুনিতে পাতে না কান, বিমুখ সে হয় যারে শুনাইতে চায়, সে আর কিসের আশে রয়েছে সংসারপাশে— জ্বলন্ত পরান বহে কিসের আশায়॥
৪৪
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
অনন্তসাগরমাঝে দাও তরী ভাসাইয়া। গেছে সুখ, গেছে দুখ, গেছে আশা ফুরাইয়া॥ সম্মুখে অনন্ত রাত্রি, আমরা দুজনে যাত্রী, সম্মুখে শয়ান সিন্ধু দিগ্বিদিক হারাইয়া॥ জলধি রয়েছে স্থির, ধূ-ধূ করে সিন্ধুতীর, প্রশান্ত সুনীল নীর নীল শূন্যে মিশাইয়া। নাহি সাড়া, নাহি শব্দ, মন্ত্রে যেন সব স্তব্ধ, রজনী আসিছে ধীরে দুই বাহু প্রসারিয়া॥
৪৫
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
ফিরায়ো না মুখখানি, ফিরায়ো না মুখখানি রানী ওগো রানী॥ ভ্রূভঙ্গতরঙ্গ কেন আজি সুনয়নী! হাসিরাশি গেছে ভাসি, কোন্ দুখে সুধামুখে নাহি বাণী॥ আমারে মগন করো তোমার মধুর করপরশে সুধাসরসে। প্রাণ মন পুরিয়া দাও নিবিড় হরষে। হেরো শশীসুশোভন, সজনী, সুন্দর রজনী। তৃষিতমধুপসম কাতর হৃদয় মম— কোন্ প্রাণে আজি ফিরাবে তারে পাষাণী॥
৪৬
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
হিয়া কাঁপিছে সুখে কি দুখে সখী, কেন নয়নে আসে বারি। আজি প্রিয়তম আসিবে মোর ঘরে— বলো কী করিব আমি সখী। দেখা হলে সখী, সেই প্রাণবঁধুরে কী বলিব নাহি জানি। সে কি না জানিবে, সখী, রয়েছে যা হৃদয়ে— না বুঝে কি ফিরে যাবে সখী॥
৪৭
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
দাঁড়াও, মাথা খাও, যেয়ো না সখা। শুধু সখা, ফিরে চাও, অধিক কিছু নয়— কতদিন পরে আজি পেয়েছি দেখা॥ আর তো চাহি নে কিছু, কিছু না, কিছু না— শুধু ওই মুখখানি জন্মশোধ দেখিব। তাও কি হবে না গো, সখা গো! শুধু একবার ফিরে চাও॥
৪৮
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
কে যেতেছিস, আয় রে হেথা—হৃদয়খানি যা-না দিয়ে বিম্বাধরের হাসি দেব, সুখ দেব, মধুমাখা দুঃখ দেব, হরিণ-আঁখির অশ্রু দেব অভিমানে মাখাইয়ে॥ অচেতন করব হিয়ে বিষে-মাখা সুধা দিয়ে, নয়নের কালো আলো মরমে বরষিয়ে॥ হাসির ঘায়ে কাঁদাইব, অশ্রু দিয়ে হাসাইব, মৃণালবাহু দিয়ে সাধের বাঁধন বেঁধে দেব। চোখে চোখে রেখে দেব— দেব না হৃদয় শুধু, আর-সকলই যা-না নিয়ে॥
৪৯
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
আবার মোরে পাগল করে দিবে কে। হৃদয় যেন পাষাণ-হেন বিরাগ-ভরা বিবেকে॥ আবার প্রাণে নূতন টানে প্রেমের নদী পাষাণ হতে উছল স্রোতে বহায় যদি — আবার দুটি নয়নে লুটি হৃদয় হ’রে নিবে কে! আবার মোরে পাগল করে দিবে কে॥ আবার কবে ধরণী হবে তরুণা। কাহার প্রেমে আসিবে নেমে স্বরগ হতে করুণা। নিশীথনভে শুনিব কবে গভীর গান, যে দিকে চাব দেখিতে পাব নবীন প্রাণ, নূতন প্রীতি আনিবে নিতি কুমারী উষা অরুণা। আবার কবে ধরণী হবে তরুণা। দিবে সে খুলি এ ঘোর ধূলি- আবরণ। তাহার হাতে আঁখির পাতে জগত-জাগা জাগরণ। সে হাসিখানি আনিবে টানি সবার হাসি। গড়িবে গেহ, জাগাবে স্নেহ— জীবনরাশি। প্রকৃতিবধূ চাহিবে মধু, পরিবে নব আভরণ— সে দিবে খুলি এ ঘোর ধূলি- আবরণ। হৃদয়ে এসে মধুর হেসে প্রাণের গান গাহিয়া পাগল করে দিবে সে মোরে চাহিয়া। আপনা থাকি ভাসিবে আঁখি আকুল নীরে, ঝরনা-সম জগত মম ঝরিবে শিরে— তাহার বাণী দিবে গো আনি সকল বাণী বাহিয়া। পাগল করে দিবে সে মোরে চাহিয়া॥
৫০
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
জীবনে এ কি প্রথম বসন্ত এল, এল! এল রে! নবীন বাসনায় চঞ্চল যৌবন নবীন জীবন পেল। এল, এল। বাহির হতে চায় মন, চায়, চায় রে— করে কাহার অন্বেষণ। ফাগুন-হাওয়ার দোল দিয়ে যায় হিল্লোল— চিতসাগর উদ্বেল। এল, এল। দখিনবায়ু ছুটিয়াছে, বুঝি খোঁজে কোন্ ফুল ফুটিয়াছে— খোঁজে বনে বনে— খোঁজে আমার মনে। নিশিদিন আছে মন জাগি কার পদপরশন-লাগি— তারি তরে মর্মের কাছে শতদলদল মেলিয়াছে আমার মন॥
৫১
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
কাছে ছিলে, দূরে গেলে— দূর হতে এসো কাছে। ভুবন ভ্রমিলে তুমি— সে এখনো বসে আছে॥ ছিল না প্রেমের আলো, চিনিতে পারো নি ভালো— এখন বিরহানলে প্রেমানল জ্বলিয়াছে॥ জটিল হয়েছে জাল, প্রতিকূল হল কাল— উন্মাদ তানে তানে কেটে গেছে তাল। কে জানে তোমার বীণা সুরে ফিরে যাবে কিনা— নিঠুর বিধির টানে তার ছিঁড়ে যায় পাছে॥
৫২
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
যদি ভরিয়া লইবে কুম্ভ এসো ওগো, এসো মোর হৃদয়নীরে। তলতল ছলছল কাঁদিবে গভীর জল ওই দুটি সুকোমল চরণ ঘিরে। আজি বর্ষা গাঢ়তম, নিবিড়কুন্তলসম মেঘ নামিয়াছে মম দুইটি তীরে। ওই-যে শবদ চিনি, নূপুর রিনিকিঝিনি— কে গো তুমি একাকিনী আসিছ ধীরে। যদি ভরিয়া লইবে কুম্ভ এসো ওগো, এসো মোর হৃদয়নীরে॥ যদি মরণ লভিতে চাও এসো তবে ঝাঁপ দাও সলিলমাঝে। স্নিগ্ধ শান্ত সুগভীর— নাহি তল, নাহি তীর, মৃত্যুসম নীল নীর স্থির বিরাজে। নাহি রাত্রিদিনমান— আদি অন্ত পরিমাণ, সে অতলে গীতগান কিছু না বাজে। যাও সব যাও ভুলে, নিখিলবন্ধন খুলে ফেলে দিয়ে এসো কূলে সকল কাজে। যদি ভরিয়া লইবে কুম্ভ এসো ওগো, এসো মোর হৃদয়নীরে॥
৫৩
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে। কোথা হতে এলে তুমি হৃদিমাঝারে॥ ওই মুখ ওই হাসি কেন এত ভালোবাসি, কেন গো নীরবে ভাসি অশ্রুধারে॥ তোমারে হেরিয়া যেন জাগে স্মরণে তুমি চিরপুরাতন চিরজীবনে। তুমি না দাঁড়ালে আসি হৃদয়ে বাজে না বাঁশি— যত আলো যত হাসি ডুবে আঁধারে॥
৫৪
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
আজি মোর দ্বারে কাহার মুখ হেরেছি॥ জাগি উঠে প্রাণে গান কত যে। গাহিবারে সুর ভুলে গেছি রে॥
৫৫
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
বৃথা গেয়েছি বহু গান কোথা সঁপেছি মন প্রাণ! তুমি তো ঘুমে নিমগন, আমি জাগিয়া অনুখন। আলসে তুমি অচেতন, আমারে দহে অপমান।— বৃথা গেয়েছি বহু গান। যাত্রী সবে তরী খুলে গেল সুদূর উপকূলে, মহাসাগরতটমূলে ধূ ধূ করিছে এ শ্মশান।— কাহার পানে চাহ কবি, একাকী বসি ম্লানছবি। অস্তাচলে গেল রবি, হইল দিবা-অবসান।— বৃথা গেয়েছি বহু গান॥
৫৭
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিল সে কি আমারি পানে ভুলে পড়িবে না॥ দুটি অতুল পদতল রাতুল শতদল জানি না কী লাগিয়া পরশে ধরাতল, মাটির ’পরে তার করুণা মাটি হল—সে পদ মোর পথে চলিবে না?। তব কণ্ঠ-’পরে হয়ে দিশাহারা বিধি অনেক ঢেলেছিল মধুধারা। যদি ও মুখ মনোরম শ্রবণে রাখি মম নীরবে অতিধীরে ভ্রমরগীতিসম দু কথা বল যদি ‘প্রিয়’ বা ‘প্রিয়তম’ তাহে তো কণা মধু ফুরাবে না। হাসিতে সুধানদী উছলে নিরবধি, নয়নে ভরি উঠে অমৃতমহোদধি— এত সুধা কেন সৃজিল বিধি, যদি আমারি তৃষাটুকু পূরাবে না॥
৫৮
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
বঁধু, মিছে রাগ কোরো না, কোরো না। মম মন বুঝে দেখো মনে মনে—মনে রেখো, কোরো করুণা॥ পাছে আপনারে রাখিতে না পারি তাই কাছে কাছে থাকি আপনারি— মুখে হেসে যাই, মনে কেঁদে চাই—সে আমার নহে ছলনা॥ দিনেকের দেখা, তিলেকের সুখ, ক্ষণেকের তরে শুধু হাসিমুখ— পলকের পরে থাকে বুক ভ’রে চিরজনমের বেদনা। তারি মাঝে কেন এত সাধাসাধি, অবুঝ আঁধারে কেন মরি কাঁদি— দূর হতে এসে ফিরে যাই শেষে বহিয়া বিফল বাসনা॥
৫৯
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
কার হাতে যে ধরা দেব হায় তাই ভাবতে আমার বেলা যায়। ডান দিকেতে তাকাই যখন বাঁয়ের লাগি কাঁদে রে মন— বাঁয়ের দিকে ফিরলে তখন দখিন ডাকে ‘আয় রে আয়’॥
৬০
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
আমাকে যে বাঁধবে ধরে, এই হবে যার সাধন— সে কি অমনি হবে। আমার কাছে পড়লে বাঁধা সেই হবে মোর বাঁধন— সে কি অমনি হবে॥ কে আমারে ভরসা করে আনতে আপন বশে— সে কি অমনি হবে। আপনাকে সে করুক-না বশ, মজুক প্রেমের রসে— সে কি অমনি হবে। আমাকে যে কাঁদাবে তার ভাগ্যে আছে কাঁদন— সে কি অমনি হবে॥
৬১
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
বুঝি এল, বুঝি এল ওরে প্রাণ। এবার ধর্ এবার ধর্ দেখি তোর গান॥ ঘাসে ঘাসে খবর ছোটে, ধরা বুঝি শিউরে ওঠে— দিগন্তে ওই স্তব্ধ আকাশ পেতে আছে কান॥
৬২
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
আজ বুকের বসন ছিঁড়ে ফেলে দাঁড়িয়েছে এই প্রভাতখানি। আকাশেতে সোনার আলোয় ছড়িয়ে গেল তাহার বাণী। ওরে মন, খুলে দে মন, যা আছে তোর খুলে দে— অন্তরে যা ডুবে আছে আলোক-পানে তুলে দে। আনন্দে সব বাধা টুটে সবার সাথে ওঠ্ রে ফুটে— চোখের ’পরে আলস-ভরে রাখিস নে আর আঁচল টানি॥
৬৩
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
তরুণ প্রাতের অরুণ আকাশ শিশির-ছলোছলো, নদীর ধারের ঝাউগুলি ওই রৌদ্রে ঝলোমলো। এমনি নিবিড় ক’রে এরা দাঁড়ায় হৃদয় ভ’রে— তাই তো আমি জানি বিপুল বিশ্বভুবনখানি অকূল-মানস-সাগর-জলে কমল টলোমলো। তাই তো আমি জানি— আমি বাণীর সাথে বাণী, আমি গানের সাথে গান, আমি প্রাণের সাথে প্রাণ, আমি অন্ধকারের হৃদয়-ফাটা আলোক জ্বলোজ্বলো॥
৬৪
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
জলে-ডোবা চিকন শ্যামল কচি ধানের পাশে পাশে ভরা নদীর ধারে ধারে হাঁসগুলি আজ আজ সারে সারে দুলে দুলে ওই-যে ভাসে। অমনি করেই বনের শিরে মৃদু হাওয়ায় ধীরে ধীরে দিক্রেখাটির তীরে তীরে মেঘ ভেসে যায় নীল আকাশে। অমনি করেই অলস মনে একলা আমার তরীর কোণে মনের কথা সারা সকাল যায় ভেসে আজ অকারণে। অমনি করেই কেন জানি দূর মাধুরীর আভাস আনি ভাসে কাহার ছায়াখানি আমার বুকের দীর্ঘশ্বাসে॥
৬৫
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
স্বপনলোকের বিদেশিনী কে যেন এলে কে কোন্ ভুলে-যাওয়া বসন্ত থেকে॥ যা-কিছু সব গেছ ফেলে খুঁজতে এলে হৃদয়ে, পথ চিনেছ চেনা ফুলের চিহ্ন দেখে॥ বুঝি মনে তোমার আছে আশা কার হৃদয়ব্যথায় মিলবে বাসা। দেখতে এলে করুণ বীণা— বাজে কিনা হৃদয়ে, তারগুলি তার কাঁপে কিনা— যায় কি সে ডেকে॥
৬৬
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর ফাল্গুনী ঢেউ আসে— বেড়া ভাঙার মাতন নামে উদ্দাম উল্লাসে॥ তোমার মোহন এল সোহন বেশে, কুয়াশাভার গেল ভেসে— এল তোমার সাধনধন উদার আশ্বাসে॥ অরণ্যে তোর সুর ছিল না, বাতাস হিমে ভরা— জীর্ণ পাতায় কীর্ণ কানন, পুষ্পবিহীন ধরা। এবার জাগ্ রে হতাশ, আয় রে ছুটে অবসাদের বাঁধন টুটে— বুঝি এল তোমার পথের সাথি উতল উচ্ছ্বাসে॥
৬৭
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
ওরে বকুল পারুল, ওরে শালপিয়ালের বন, কোন্খানে আজ পাই আমার মনের মতন ঠাঁই। যেথায় আমার ফাগুন ভরে দেব দিয়ে আমার মন, দিয়ে আমার সকল মন॥ সারা গগনতলে তুমুল রঙের কোলাহলে তোদের মাতামাতির নেই যে বিরাম কোথাও অনুক্ষণ, নেই একটি বিরল ক্ষণ যেথায় আমার ফাগুন ভরে দেব দিয়ে আমার মন, দিয়ে আমার সকল মন॥ ওরে বকুল পারুল, ওরে শালপিয়ালের বন, আকাশ নিবিড় করে তোরা দাঁড়াস নে ভিড় করে আমি চাই নে, চাই নে, চাই নে এমন গন্ধ রঙের বিপুল আয়োজন। আমি চাই নে। অকূল অবকাশে যেথায় স্বপ্নকমল ভাসে এমন দে আমারে একটি আমার গগন-জোড়া কোণ, আমার একটি অসীম কোণ যেথায় আমার ফাগুন ভরে দেব দিয়ে আমার মন— দিয়ে আমার সকল মন॥
৬৮
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
হিয়ামাঝে গোপনে হেরিয়ে তোমারে ক্ষণে ক্ষণে পুলক যে কাঁপে কিশলয়ে, কুসুমে কুসুমে ব্যথা লাগে॥
৬৯
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
যেন কোন্ ভুলের ঘোরে চাঁদ চলে যায় সরে সরে। পাড়ি দেয় কালো নদী, আয় রজনী, দেখবি যদি— কেমনে তুই রাখবি ধ’রে, দূরের বাঁশি ডাকল ওরে। প্রহরগুলি বিলিয়ে দিয়ে সর্বনাশের সাধন কী এ। মগ্ন হয়ে রইবে বসে মরণ-ফুলের মধুকোষে— নতুন হয়ে আবার তোরে মিলবে বুঝি সুধায় ভ’রে॥
৭০
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
অবেলায় যদি এসেছ আমার বনে দিনের বিদায়ক্ষণে গেয়ো না, গেয়ো না চঞ্চল গান ক্লান্ত এ সমীরণে॥ ঘন বকুলের ম্লান বীথিকায় শীর্ণ যে ফুল ঝ’রে ঝ’রে যায় তাই দিয়ে হার কেন গাঁথ হায়, লাজ বাসি তায় মনে। চেয়ো না, চেয়ো না মোর দীনতায় হেলায় নয়নকোণে॥ এসো এসো কাল রজনীর অবসানে প্রভাত-আলোর দ্বারে। যেয়ো না, যেয়ো না অকালে হানিয়া সকালের কলিকারে। এসো এসো যদি কভু সুসময় নিয়ে আসে তার ভরা সঞ্চয়, চিরনবীনের যদি ঘটে জয়— সাজি ভরা হয় ধনে। নিয়ো না, নিয়ো না মোর পরিচয় এ ছায়ার আবরণে॥
৭১
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
তুমি তো সেই যাবেই চ’লে, কিছু তো না রবে বাকি— আমায় ব্যথা দিয়ে গেলে জেগে রবে সেই কথা কি॥ তুমি পথিক আপন-মনে এলে আমার কুসুমবনে, চরণপাতে যা দাও দ’লে সে-সব আমি দেব ঢাকি॥ বেলা যাবে আঁধার হবে, একা ব’সে হৃদয় ভ’রে আমার বেদনখানি আমি রেখে দেব মধুর ক’রে। বিদায়-বাঁশির করুণ রবে সাঁঝের গগন মগন হবে, চোখের জলে দুখের শোভা নবীন ক’রে দেব রাখি॥
৭২
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
আপনহারা মাতোয়ারা আছি তোমার আশা ধরে— ওগো সাকী, দেবে না কি পেয়ালা মোর ভ’রে ভ’রে॥ রসের ধারা সুধায় ছাঁকা, মৃগনাভির আভাস মাখা গো, বাতাস বেয়ে সুবাস তারি দূরের থেকে মাতায় মোরে॥ মুখ তুলে চাও ওগো প্রিয়ে— তোমার হাতের প্রসাদ দিয়ে এক রজনীর মত এবার দাও-না আমায় অমর ক’রে। নন্দননিকুঞ্জশাখে অনেক কুসুম ফুটে থাকে গো, এমন মোহন রূপ দেখি নাই, গন্ধ এমন কোথায় ওরে॥
৭৩
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
কালো মেঘের ঘটা ঘনায় রে আঁধার গগনে, ঝরে ধারা ঝরোঝরো গহন বনে। এত দিনে বাঁধন টুটে কুঁড়ি তোমার উঠল ফুটে বাদল-বেলার বরিষনে। ওগো, এবার তুমি জাগো জাগো— যেন এই বেলাটি হারায় না গো। অশ্রুভরা কোন্ বাতাসে গন্ধে যে তার ব্যথা আসে— আর কি গো সে রয় গোপনে॥
৭৫
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
সন্ন্যাসী, ধ্যানে নিমগ্ন নগ্ন তোমার চিত্ত। বাহিরে যে তব লীন হল সব বিত্ত॥ রসহীন তরু, নিষ্ঠুর মরু, বাতাসে বাজিছে রুদ্র ডমরু, ধরা-ভাণ্ডার রিক্ত॥ জাগো তপস্বী, বাহিরে নয়ন মেলো হে। জাগো! স্থলে জলে ফুলে ফলে পল্লবে চপল চরণ ফেলো হে। জাগো! জাগো গানে গানে নব নব তানে, জাগাও উদাস হতাশ পরানে উদার তোমার নৃত্য॥ জাগাও॥
৭৬
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
চরণরেখা তব যে পথে দিলে লেখি চিহ্ন আজি তারি আপনি ঘুচালে কি॥ ছিল তো শেফালিকা তোমারি-লিপি-লিখা, তারে যে তৃণতলে আজিকে লীন দেখি॥ কাশের শিখা যত কাঁপিছে থরথরি, মলিন মালতী যে পড়িছে ঝরি ঝরি। তোমার যে আলোকে অমৃত দিত চোখে স্মরণ তারো কি গো মরণে যাবে ঠেকি॥
৭৭
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
গন্ধরেখার পন্থে তোমার শূন্যে গতি, লেখন রে মোর, ছন্দ-ডানার প্রজাপতি— স্বপ্নবনের ছায়ায় আলোয় বেড়াস্ দুলি পরান-কণার বিন্দুসুরার নেশার ঘোরে॥ চৈত্র-হাওয়ায় যে চঞ্চলের ক্ষণিক বাসা পাতায় পাতায় করিস প্রচার তাহার ভাষা— অপ্সরীদের দোলের দিনের আবির-ধূলি কৌতুকে ভোর পাঠায় কে তোর পাখায় ভ’রে॥ তোর মাঝে মন কীর্তি আপন নিষ্কাতরেই করল হেলা। তার সে চিকন রঙের লিখন ক্ষণেকতরেই খেয়াল খেলা। সুর বাঁধে আর সুর সে হারায় দণ্ডে পলে, গান বহে যায় লুপ্ত সুরের ছায়ার তলে, পশ্চাতে আর চায় না তাহার চপল তুলি— রয় না বাঁধা আপন ছবির রাখীর ডোরে॥
৭৮
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
এবার বুঝি ভোলার বেলা হল— ক্ষতি কী তাহে যদি বা তুমি ভোলো॥ যাবার রাতি ভরিল গানে সেই কথাটি রহিল প্রাণে, ক্ষণেক-তরে আমার পানে করুণ আঁখি তোলো॥ সন্ধ্যাতারা এমনি ভরা সাঁঝে উঠিবে দূরে বিরহাকাশমাঝে। এই-যে সুর বাজে বীণাতে যেখানে যাব রহিবে সাথে, আজিকে তবে আপন হাতে বিদায়দ্বার খোলো॥
৭৯
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
কী ধ্বনি বাজে গহনচেতনামাঝে! কী আনন্দে উচ্ছ্বসিল মম তনুবীণা গহনচেতনামাঝে। মনপ্রাণহরা সুধা-ঝরা পরশে ভাবনা উদাসীনা॥
৮০
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
ওরা অকারণে চঞ্চল ডালে ডালে দোলে বায়ুহিল্লোলে নবপল্লবদল॥ বাতাসে বাতাসে প্রাণভরা বাণী শুনিতে পেয়েছে কখন কী জানি, মর্মরতানে দিকে দিকে আনে কৈশোরকোলাহল॥ ওরা কান পেতে শোনে গগনে গগনে মেঘে মেঘে কানাকানি, বনে বনে জানাজানি। ওরা প্রাণঝরনার উচ্ছলধার ঝরিয়া ঝরিয়া বহে অনিবার, চিরতাপসিনী ধরণীর ওরা শ্যামশিখা হোমানল॥
৮১
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
আয় তোরা আয় আয় গো— গাবার বেলা যায় পাছে তোর যায় গো। শিশিরকণা ঘাসে ঘাসে শুকিয়ে আসে, নীড়ের পাখি নীল আকাশে চায় গো। সুর দিয়ে যে সুর ধরা যায়, গান দিয়ে পাই গান, প্রাণ দিয়ে পাই প্রাণ— তোর আপন বাঁশি আন্, তবেই যে তুই শুনতে পাবি কে বাঁশি বাজায় গো। শুকনো দিনের তাপ তোর বসন্তকে দেয় না যেন শাপ। ব্যর্থ কাজে মগ্ন হয়ে লগ্ন যদি যায় গো ব’য়ে, গান-হারানো হাওয়া তখন করবে যে ‘হায় হায়’ গো॥
৮২
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
ও জলের রানী, ঘাটে বাঁধা একশো ডিঙি— জোয়ার আসে থেমে, বাতাস ওঠে দখিন-মুখে। ও জলের রানী, ও তোর ঢেউয়ের নাচন নেচে দে— ঢেউগুলো সব লুটিয়ে পড়ুক বাঁশির সুরে কালো-ফণী॥
৮৩
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
ভয় নেই রে তোদের নেই রে ভয়, যা চলে সব অভয়-মনে— আকাশে ওই উঠেছে শুকতারা। দখিন-হাওয়ায় পাল তুলে দে, পাল তুলে দে— সেই হাওয়াতে উড়ছে আমার মন। ওই শুকতারাতে রেখে দিলেম দৃষ্টি আমার— ভয় কিছু নেই, ভয় কিছু নেই॥
৮৪
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
ঝাঁকড়া চুলের মেয়ের কথা কাউকে বলি নি, কোন্ দেশে যে চলে গেছে সে চঞ্চলিনী। সঙ্গী ছিল কুকুর কালু, বেশ ছিল তার আলুথালু, আপনা-’পরে অনাদরে ধুলায় মলিনী॥ হুটোপাটি ঝগড়াঝাঁটি ছিল নিষ্কারণেই। দিঘির জলে গাছের ডালে গতি ক্ষণে-ক্ষণেই। পাগলামি তার কানায় কানায় খেয়াল দিয়ে খেলা বানায়, উচ্চহাসে কলভাষে কল’কলিনী॥ দেখা হলে যখন-তখন বিনা অপরাধে মুখভঙ্গী করত আমায় অপমানের ছাঁদে। শাসন করতে যেমন ছুটি হঠাৎ দেখি ধুলায় লুটি কাজল আঁখি চোখের জলে ছল’ছলিনী॥ আমার সঙ্গে পঞ্চাশ বার জন্মশোধের আড়ি, কথায় কথায় নিত্যকালের মতন ছাড়াছাড়ি। ডাকলে তারে ‘পুঁট্লি’ ব’লে সাড়া দিত মর্জি হলে, ঝগড়া-দিনের নাম ছিল তার স্বর্ণনলিনী॥
৮৫
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
মনে হল পেরিয়ে এলেম অসীম পথ আসিতে তোমার দ্বারে মরুতীর হতে সুধাশ্যামল পারে। পথ হতে গেঁথে এনেছি সিক্তযূথীর মালা, সকরুণ নিবেদনের গন্ধ ঢালা— লজ্জা দিয়ো না তারে। সজল মেঘের ছায়া ঘনায় বনে বনে, পথহারার বেদন বাজে সমীরণে। দূরের থেকে দেখেছিলেম বাতায়নের তলে তোমার প্রদীপ জ্বলে— আমার আঁখি ব্যাকুল পাখি ঝড়ের অন্ধকারে॥
৮৬
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
জানি জানি এসেছ এ পথে মনের ভুলে। তাই হোক তবে তাই হোক— এসো তুমি, দিনু দ্বার খুলে॥ এসেছ তুমি যে বিনা আভরণে, মুখর নূপুর বাজে না চরণে— তাই হোক ওগো, তাই হোক। মোর আঙিনায় মালতী ঝরিয়া পড়ে যায়— তব শিথিল কবরীতে নিয়ো নিয়ো তুলে॥ কোনো আয়োজন নাই একেবারে, সুর বাঁধা হয় নি যে বীণার তারে— তাই হোক ওগো, তাই হোক। ঝরো ঝরো বারি ঝরে বনমাঝে আমারই মনের সুর ওই বাজে— বেণুশাখা-আন্দোলনে আমারই উতলা মন দুলে॥
৮৭
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
কী বেদনা মোর জানো সে কি তুমি জানো ওগো মিতা, মোর অনেক দূরের মিতা। আজি এ নিবিড়তিমির যামিনী বিদ্যুতসচকিতা॥ বাদল-বাতাস ব্যেপে হৃদয় উঠিছে কেঁপে ওগো সে কি তুমি জানো। উৎসুক এই দুখজাগরণ এ কি হবে হায় বৃথা॥ ওগো মিতা, মোর অনেক দূরের মিতা, আমার ভবনদ্বারে রোপণ করিলে যারে সজল হাওয়ার করুণ পরশে সে মালতী বিকশিতা। ওগো সে কি তুমি জানো। তুমি যার সুর দিয়েছিলে বাঁধি মোর কোলে আজ উঠিছে সে কাঁদি ওগো সে কি জানো— সেই-যে তোমার বীণা সে কি বিস্মৃতা॥
৮৮
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
আমার কী বেদনা সে কি জানো ওগো মিতা, সুদূরের মিতা। বর্ষণনিবিড় তিমিরে যামিনী বিজুলি-সচকিতা॥ বাদল-বাতাস ব্যেপে আমার হৃদয় উঠিছে কেঁপে— সে কি জানো তুমি জানো। উৎসুক এই দুখজাগরণ এ কি হবে বৃথা। ওগো মিতা, সুদূরের মিতা, আমার ভবনদ্বারে বোপিলে যারে সেই মালতী আজি বিকশিতা—সে কি জানো। যারে তুমিই দিয়েছ বাঁধি আমার কোলে সে উঠিছে কাঁদি—সে কি জানো তুমি জানো। সেই তোমার বীণা বিস্মৃতা॥
৮৯
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
চলে যাবি এই যদি তোর মনে থাকে ডাকব না, ফিরে ডাকব না— ডাকি নে তো সকালবেলার শুকতারাকে। হঠাৎ ঘুমের মাঝখানে কি বাজবে মনে স্বপন দেখি ‘হয়তো ফেলে এলেম কাকে’— আপনি চলে আসবি তখন আপন ডাকে॥
৯০
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
আমরা ঝ’রে-পড়া ফুলদল ছেড়ে এসেছি ছায়া-করা বনতল— ভুলায়ে নিয়ে এল মায়াবী সমীরণে। মাধবীবল্লরী করুণ কল্লোলে পিছন-পানে ডাকে কেন ক্ষণে ক্ষণে। মেঘের ছায়া ভেসে চলে চির-উদাসী স্রোতের জলে— দিশাহারা পথিক তারা মিলায় অকূল বিস্মরণে॥
৯২
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
বারে বারে ফিরে ফিরে তোমার পানে দিবারাতি ঢেউয়ের মতো চিত্ত বাহু হানে, মন্দ্রধ্বনি জেগে ওঠে উল্লোল তুফানে। রাগরাগিণী উঠে আবর্তিয়া তরঙ্গে নর্তিয়া গহন হতে উচ্ছলিত স্রোতে। ভৈরবী রামকেলি পুরবী কেদারা উচ্ছ্বসি যায় খেলি, ফেনিয়ে ওঠে জয়জয়ন্তী বাগেশ্রী কানাড়া গানে গানে॥ তোমায় আমায় ভেসে গানের বেগে যাব নিরুদ্দেশে। তালী-তমালী-বনরাজি-নীলা বেলাভূমিতলে ছন্দের লীলা— যাত্রাপথে পালের হাওয়ায় হাওয়ায় তালে তালে তানে তানে॥
৯৩
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
রিমিকি ঝিমিকি ঝরে ভাদরের ধারা— মন যে কেমন করে, হল দিশাহারা॥ যেন কে গিয়েছে ডেকে, রজনীতে সে কে দ্বারে দিল নাড়া— রিমিকি ঝিমিকি ঝরে ভাদরের ধারা॥ বঁধু দয়া করো, আলোখানি ধরো হৃদয়ে। আধো-জাগরিত তন্দ্রার ঘোরে আঁখি জলে আঁখি যায় যে ভ’রে। স্বপনের তলে ছায়াখানি দেখে মনে মনে ভাবি, এসেছিল সে কে— রিমিকি ঝিমিকি ঝরে ভাদরের ধারা॥
৯৪
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
আজি কোন্ সুরে বাঁধিব দিন-অবসান-বেলারে দীর্ঘ ধূসর অবকাশে সঙ্গীজনবিহীন শূন্য ভবনে।— সে কি মূক বিরহস্মৃতিগুঞ্জরণে তন্দ্রাহারা ঝিল্লিরবে। সে কি বিচ্ছেদরজনীর যাত্রী বিহঙ্গের পক্ষধ্বনিতে। সে কি অবগুণ্ঠিত প্রেমের কুণ্ঠিত বেদনায় সম্বৃত দীর্ঘশ্বাসে। সে কি উদ্ধত অভিমানে উদ্যত উপেক্ষায় গর্বিত মঞ্জীরঝঙ্কারে॥
৯৫
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম এসেছিল নিঃশব্দচরণে। তাই স্বপ্ন মনে হল তারে— দিই নি তাহারে আসন। বিদায় নিল যবে, শব্দ পেয়ে গেনু ধেয়ে। সে তখন স্বপ্ন কায়াবিহীন নিশীথতিমিরে বিলীন— দূরপথে দীপশিখা রক্তিম মরীচিকা॥
৯৬
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
নির্জন রাতে নিঃশব্দ চরণপাতে কেন এলে। দুয়ারে মম স্বপ্নের ধন-সম এ যে দেখি— তব কণ্ঠের মালা এ কি গেছ ফেলে। জাগালে না শিয়রে দীপ জ্বেলে— এলে ধীরে ধীরে নিদ্রার তীরে তীরে, চামেলির ইঙ্গিত আসে যে বাতাসে লজ্জিত গন্ধ মেলে। বিদায়ের যাত্রাকালে পুষ্প-ঝরা বকুলের ডালে দক্ষিণপবনের প্রাণে রেখে গেলে বল নি যে কথা কানে কানে— বিরহবারতা অরুণ-আভার আভাসে রাঙায়ে গেলে॥
৯৭
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
এসো এসো ওগো শ্যামছায়াঘন দিন, এসো এসো। আনো আনো তব মল্লারমন্দ্রিত বীন॥ বীণা বাজুক রমকি ঝমকি, বিজুলির অঙ্গুলি নাচুক চমকি চমকি চমকি। নবনীপকুঞ্জনিভৃতে কিশলয়মর্মরগীতে— মঞ্জীর বাজুক রিন্-রিন্ রিন্-রিন্॥ নৃত্যতরঙ্গিত তটিনী বর্ষণনন্দিত নটিনী— আনন্দিত নটিনী, চলো চলো কূল উচ্ছলিয়া কলো-কলো-কলো-কল্লোলিয়া। তীরে তীরে বাজুক অন্ধকারে ঝিল্লির ঝঙ্কার ঝিন্-ঝিন্-ঝিন্-ইন্॥
৯৮
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
শ্রাবণের বারিধারা ঝরিছে বিরামহারা। বিজন শূন্য-পানে চেয়ে থাকি একাকী। দূর দিবসের তটে মনের আঁধার পটে অতীতের অলিখিত লিপিখানি লেখা কি। বিদ্যুত মেঘে মেঘে গোপন বহ্নিবেগে বহি আনে বিস্মৃত বেদনার রেখা কি। যে ফিরে মালতীবনে, সুরভিত সমীরণে অস্তসাগরতীরে পাব তার দেখা কি॥
৯৯
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
যারা বিহান-বেলায় গান এনেছিল আমার মনে সাঁঝের বেলায় ছায়ায় তারা মিলায় ধীরে। একা বসে আছি হেথায় যাতায়াতের পথের তীরে, আজকে তারা এল আমার স্বপ্নলোকের দুয়ার ঘিরে। সুরহারা সব ব্যথা যত একতারা তার খুঁজে ফিরে। প্রহর-পরে প্রহর যে যায়, বসে বসে কেবল গণি নীরব জপের মালার ধ্বনি অন্ধকারের শিরে শিরে॥
১০০
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
পাখি, তোর সুর ভুলিস নে— আমার প্রভাত হবে বৃথা জানিস কি তা। অরুণ-আলোর করুণ পরশ গাছে গাছে লাগে, কাঁপনে তার তোরই যে সুর জাগে— তুই ভোরের আলোর মিতা জানিস কি তা। আমার জাগরণের মাঝে রাগিণী তোর মধুর বাজে জানিস কি তা। আমার রাতের স্বপনতলে প্রভাতী তোর কী যে বলে নবীন প্রাণের গীতা জানিস কি তা॥
১০১
প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেম ও প্রকৃতি
আমার হারিয়ে-যাওয়া দিন আর কি খুঁজে পাব তারে বাদল-দিনের আকাশ-পারে— ছায়ায় হল লীন। কোন্ করুণ মুখের ছবি পুবেন হাওয়ায় মেলে দিল সজল ভৈরবী। এই গহন বনচ্ছায় অনেক কালের স্তব্ধবাণী কাহার অপেক্ষায় আছে বচনহীন॥