বিবিধ
সমুদ্রে চলিতে চলিতে প্রতি বৎসরই কত জাহাজ ডুবিয়া মরে। কেহ মরে ঝড় তুফানে, কেহ মরে ঢেউয়ের ঝাপ্টায়, কেহ মরে পাহাড়ের গুঁতায়, আর কেহ মরে অন্য জাহাজের ধাক্কা লাগিয়া— যুদ্ধের কথা না হয় ছাড়িয়াই দিলাম। এইরকম কত উপায়ে জাহাজ ডুবিতেছে তাহার ঠিকানাই নাই। এইসকল জাহাজের মধ্যে কত সময় কত লাখ লাখ টাকার জিনিস থাকে, সেগুলি সমুদ্রের তলায় পড়িয়া নষ্ট হইবে— ইহা কি মানুষের সহ্য হয়? বিলাতে বড় বড় ব্যবসাদার কোম্পানি আছে, তাহারা ডোবা-জাহাজ হইতে মাল উদ্ধার করে। এই কাজকে Salvage বলে! ইহাতে তাহারা এক-একসময় অনেক টাকা লাভ করিয়া থাকে। গভীর সমুদ্রে জাহাজ ডুবিলে তাহাকে আর বাঁচাইবার উপায় থাকে না; কিন্তু জল যদি খুব বেশি না হয় তবে অনেক সময় একেবারে জাহাজকে-জাহাজ উঠাইয়া ফেলা যায়।
জাহাজ উঠাইবার নানারকম উপায় আছে। এক উপায়, তাহার সঙ্গে বাতাস-পোরা বড় বড় বাক্স বাঁধিয়া তাহাকে হালকা করিয়া ভাসাইয়া তোলা। আর এক উপায়, তাহার চারিদিকে দেয়াল ঘিরিয়া সেই দেয়ালের ভিতরকার সমুদ্রকে ‘পাম্প্’ দিয়া শুকাইয়া ফেলা। রুশ-জাপান যুদ্ধের সময় জাপানীরা যখন পোর্ট আর্থার দখল করে তখন সেখানকার বন্দরে রুশেরা কতগুলা জাহাজ ডুবাইয়া দিয়াছিল। জাপানীরা দেয়াল তুলিয়া সমস্ত বন্দরের মুখ আঁটিয়া দেয়; তার পর বড়ো বড়ো কল দিয়া বন্দরের জল সেঁচিয়া ফেলিতেই জাহাজগুলা বাহির হইয়া পড়িল। জাপানীরা সেই জাহাজ আবার মেরামত করাইয়া কাজে লাগাইয়াছে।
একবার স্পেন হইতে কিছু দূরে একটি জাহাজ জখম হইয়া ডুবিতে আরম্ভ করে। জাহাজের কাপ্তান দেখিল স্পেন পর্যন্ত পৌঁছিবার আগেই জাহাজ ডুবিয়া যাইবে। জাহাজের নীচেকার খোলে হাজার মণ লবণ বোঝাই রহিয়াছে— সকলে মিলিয়া সারাদিন লবণ ফেলিলেও তাহার কিছুই কম্তি হইবে না। তাই তিনি হুকুম দিলেন, “জাহাজ ছাড়িতে হইবে, নৌকা নামাও।” এমন সময় এক সালভেজ কোম্পানির জাহাজ আসিয়া হাজির— তাহারা আসিয়াই ব্যাপার দেখিয়া জাহাজ ডুবিবার আগেই তাহা কিনিতে চাহিল। লবণ-জাহাজের কাপ্তান বলিল, “মাঝ সমুদ্রে জাহাজ ডুবিলে কিনিয়া লাভ কি?” সালভেজ কাপ্তান বলিল, “জাহাজ ডুবিতে দিব না।” শুনিয়া লবণের কাপ্তান হাসিয়া বলিল, “আমি ত জাহাজ ছাড়িয়াই দিব — তুমি কিনিতে চাও আমার আপত্তি কি?” জাহাজ কিনিয়াই নূতন কাপ্তান তাহাতে জল বোঝাই করিতে লাগিল— পুরাতন নাবিকেরা বলিল, “আহা কর কি? একেই জাহাজ ডুবিতেছে, আবার জল চাপাইতেছ? তুমি পাগল নাকি?” কাপ্তান কোন কথা না বলিয়া লবণের মধ্যে ক্রমাগতই জল ঢালিতে লাগিল। তারপর সমস্ত লবণ জলে গুলিয়া সেই লবণ-গোলা জলে পাম্প বসাইয়া হুড়্হুড়্ করিয়া জল সেঁচিয়া ফেলিল। জাহাজ হালকা হইয়া ভাসিয়া উঠিল। পুরাতন কাপ্তান ব্যাপার দেখিয়া আহাম্মক বনিয়া মাথা চুলকাইতে লাগিল।
বিবিধ
শৌখিন ধনীদের জন্য আর বড়ো-বড়ো ব্যবসায়ীদের জন্য যে সমস্ত জাহাজ অতলান্তিক মহাসাগরের খেয়া পারাপার করে, তেমন বড়ো জাহাজ পৃথিবীর আর কোথাও নাই। কি করে খুব তাড়াতাড়ি সাগর পার করা যায় আর আরামে পার করা যায়, আর একসঙ্গে অনেক লোককে বিনা কষ্টে পার করা যায়, তার জন্য বড় বড় জাহাজ কোম্পানিদের মধ্যে রেষারেষি চলে। এক-একটা জাহাজ নয়, যেন এক-একটা শহর, রাজারাজড়ার থাকবার মতো শহর। তারই খুব বড়ো দু-একটির নমুনা দেওয়া হয়েছে।
জাহাজের সাঁতার-ঘরটি দেখা যাক। মধ্যেকার চৌবাচ্চাটি হচ্ছে ২২ গজ লম্বা আর ১৮ গজ চওড়া। এ ছাড়া নানারকম স্নানের ঘর, তুর্কী হামাম, ফোয়ারা-স্নান প্রভৃতির আলাদা বন্দোবস্ত আছে। ১২ তলা জাহাজ, তার মাঝিমাল্লা যাত্রী সব নিয়ে লোকসংখ্যা ৫০০০ হবে। পাঁচটি জাহাজ লম্বালম্বি সার বেঁধে দাঁড়ালে, এক মাইল পথ জুড়ে বসবে।
একটি জাহাজের এক সপ্তাহের খোরাক হল ২২টা ট্রেন বোঝাই কয়লা— এক-একটা ট্রেনে সাড়ে আট হাজার মণ। জাহাজের মানুষগুলোর খোরাকের হিসাবও বড়ো কম নয়। এক-এক যাত্রায় পশুমাংস ৭০০ মণ, পাখির মাংস ১৫০ মণ, মাছ ১২৫ মণ, ডিম ৪৮,০০০, আলু ১,৬০০ মণ, তরিতরকারি ৪০০ মণ, টিনের সবজি ৬,০০০ টিন আর কফি ও চা ৯০ মণ লাগে। তাছাড়া ফল দুধ কোকো চকোলেট ইত্যাদিও সেইরকম পরিমাণে।
জাহাজের মধ্যে বড়ো বড়ো খানাঘর চা-ঘর ইত্যাদি তো আছেই, তা ছাড়া নানারকম হোটেল সরাই-এর অভাব নেই। ধোপা, নাপিত, ফুলের দোকান, ছবির দোকান, মিঠাই-এর দোকান, প্রকাণ্ড থিয়েটার ও নাচঘর এসবও জাহাজের মধ্যেই পাবে। উঠবার জন্য লিফ্ট্ বা চলতিঘর। ইচ্ছা করলে আর টাকা থাকলে, সেখানে আল্গা বাড়ি ভাড়ার মতো করে থাকা যায়— একবারের (অর্থাৎ ৫ দিনের) বাড়িভাড়া ধর ১৫,০০০ টাকা। এক-একটি জাহাজ করতে খরচ হয় প্রায় দু-তিন কোটি টাকা।