Generated on: Fri Dec 19 2014

Home

::

Show All

::

Show Current

::

Scroll TOC Up| Down

Send a Comment

রসমঞ্জরী গ্রন্থারম্ভ
রসমঞ্জরী
ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর
জয় জয় রাধা শ্যাম         নিত্য নব রসধাম
        নিরুপম নায়িকা নায়ক।
সর্ব্বসুলক্ষণধারী            সর্ব্ব রস বশকারী
        সর্ব্ব প্রতি প্রণয় কারক॥
বীণা বেণু যন্ত্র গানে         রাগ রাগিণী তানে
        বৃন্দাবনে নাটিকা নাটক।
গোপ গোপীগণ সঙ্গে          সদা রাস রসরঙ্গে
        ভারতের ভক্তিপ্রদায়ক॥
রাঢ়ীয় কেশরী গ্রামী        গেষ্ঠীপতি দ্বিজ স্বামী
        তপস্বী  শাণ্ডিল্য শুদ্ধাচার।
রাজ ঋষি গুণযুত           রাজা রঘুরামসুত
        কলিকালে কৃষ্ণ অবতার॥
কৃষ্ণচন্দ্র মহারাজ           সুরেন্দ্র ধরণী মাঝ
        কৃষ্ণনগরেতে রাজধানী।
সিন্ধু অগ্নি রাহু মুখে        শশী ঝাঁপ দেয় দুখে
        যার যশে হয়ে অভিমানী॥
তাঁর পরিজন নিজ          ফুলের মুখটি দ্বিজ
        ভরদ্বাজ ভারত ব্রাহ্মণ।
ভূরিশ্রেষ্ট রাজ্যবাসী        নানা কাব্য অভিলাষী
        যে বংশে প্রতাপনারায়ণ॥
রাজবল্লভের কার্য্য         কীর্ত্তিচন্দ্র নিল রাজ্য
        মহারাজা রাখিলা স্থাপিয়া।
রসমঞ্জরীর রস            ভাষায় করিতে বশ
        আজ্ঞা দিলা রসে মিশাইয়া॥
সেই আজ্ঞা অনুসরি         গ্রন্থারম্ভে ভয় করি
        ছল ধরে পাছে খল জন।
রসিক পণ্ডিত যত          যদি দেখ দুষ্টমত
        সারি দিবা এই নিবেদন॥
    
নায়িকা প্রকরণ
রসমঞ্জরী
ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর
      শৃঙ্গার বীভৎস হাস্য রৌদ্র বীর ভয়।
      করুণা অদ্ভুত শান্তি এই রস নয়॥
      আদ্য রস সকল রসের মধ্যে সার॥
      নায়িকা বর্ণিব অগ্রে তাহার আধার॥
    

নায়িকার স্বীয়াদি ভেদ

      স্বীয়া পরকীয়া আর সামান্য বনিতা।
      অগ্রে এই তিন ভেদ পণ্ডিতবর্ণিতা॥
    

স্বীয়া নায়িকা

      কেবল আপন নাথে অনুরাগ যার।
      স্বকীয়া তাহার নাম নায়িকার সার॥
নয়ন অমৃত নদী             সর্ব্বদা চঞ্চল যদি
      নিজপতি বিনা কভু অন্য জনে চায় না।
হাস্য অমৃতের সিন্ধু            তূলায় বিদ্যুৎ ইন্দু
      কদাচ অধর বিনা অন্য দিগে ধায় না॥
অমৃতের ধারা ভাষা          পতির শ্রবণে আশা
      প্রিয়সখী বিনা কভু অন্য কানে যায় না।
নতি রতি গতি মতি          কেবল পতির প্রতি
      ক্রোধ হইলে মৌন ভাব কেহ টের পায় না॥
    

মুগ্ধাদি ভেদ

      মুগ্ধা মধ্যা প্রগল্‌ভা তাহার ভেদ তিন।
      তিনেতে এ তিন ভেদ বুঝহ প্রবীণ॥
    

মুগ্ধা

      মুগ্ধা বলি তারে যার অঙ্কুর যৌবন।
      বয়ঃসন্ধি সেই কালে বুঝ বিচক্ষণ॥
   দেখিনু নাগরী             রূপের সাগরী
            বয়স্‌সন্ধি সময়।
   শিশুগণ মেলে            রাঁধাবাড়া খেলে
           পুরুষে কিঞ্চিৎ ভয়॥
   হংস খঞ্জরীটে           দেখি পদে দিটে
           কবে হইল বিনিময়।
   হৃদয় সরোজ             পূজিতে মনোজ
           পণ্ডিতে হয় সংশয়॥
    

নবোঢ়া

      এ যদি রমণে লাজে ভয়ে হয় স্তব্ধ।
      নবোঢ়া তাহাকে বলি প্রশ্রয় বিশ্রব্ধ॥
    

স্বকীয়া নবোঢ়া

হস্তেতে ধরিয়া            শয্যায় আনিয়া
        যদ্যপি কোলে বসায়।
নানা বাক্য ছলে          যত্নে কলে বলে
        বাহিরে যাইতে চায়॥
নবোঢ়াকে বশ             করণ কর্কশ
        সে রস কহিব কায়।
যেই পারা করে           স্থির করে ধরে
        সে জন ব্যামোহ পায়॥
    

পরকীয়া নবোঢ়া

আপনার পতি আছে        ভয়েতে না শুই কাছে
   গায় হাত দেয় পাছে এই ডরে ডরি হে।
প্রীতের বিষম কাজ         সে ভয়ে পড়িল বাজ
   লাজে পলাইল লাজ আশা বাসা হরে হে॥
মুখের বাড়াও প্রীতি           হৃদয়ের হর ভীতি
   তার পরে যেবা রীতি রাখ ক্ষমা করে হে।
যৌবন কমলাঙ্কুর           লোভে না করিও চুর
   হিয়া কাঁপে দুর দুর পাছে যাই মরে হে॥
    

সামান্য নবোঢ়া

কি ছার ধনের আশে         আইনু তোমার পাশে
    আগে জানিতাম নাহি এত দায় হবে হে॥
মুখ দেখি শোষে মুখ         বুক দেখি কাঁপে বুক
    মনে হতে মনে পড়ে কিসে প্রাণ রবে হে॥
কেবা ইহা সহিবেক           আমা হতে নহিবেক
    ক্রুদ্ধ হও যদি নিজ ধন ফিরে লবে হে
যেবা তীর্থে নাইলাম           তারি পুণ্য পাইলাম
    অতঃপর ক্ষমা দেহ আমারে না সবে হে॥
    

বিশ্রব্ধ নবোঢ়া

স্তন দুটি করে ছেঁদে           উরু দুটি ভুজে বেঁধে
        লাজে ভয়ে  মুদিল নয়ন।
প্রথমেতে নিরুত্তর             না না না তাহার পর
        টালটোল এখন তখন॥
যদি খেয়ে লাজ ভয়             কিঞ্চিৎ সঞ্চয় হয় 
        তবে আর না যায় ধরণ।
নবীন ভূষণ বসে              নব সুধা হাস ভাষে
        নব রস কে করে গণন॥
    

মুগ্ধার ভেদ

      মুগ্ধার প্রভেদ দুই করিব বর্ণনা।
      অজ্ঞাতযৌবনা আর বিজ্ঞাতযৌবনা॥
    

অজ্ঞাতযৌবনা

     হয়েছে যৌবন যার নহে অনুভব।
     অজ্ঞাতযৌবনা তারে বলে কবি সব॥
সখী সখী মেলি            ধাওয়া ধাই খেলি
        হারি কহে যেন চোর।
অন্য দিনে ধাই             সবা আগে যাই
        আজি কেন হারি মোর॥
নিতম্ব হৃদয়                ভারি হেন লয়
        চক্ষু কর্ণে পড়ে জোর।
কটি দেখি ক্ষীণ              খসে পড়ে চীন
        বাড়ে ঘাগরার ডোর॥
    

বিজ্ঞাতযৌবনা

    নিজ নব যৌবন যে ব্যক্ত করে ছলে।
    বিজ্ঞাতযৌবনা তাকে কবিবর বলে॥
দেখিলাম ঘরে ঘরে         সকলে কাঁচুলি পরে
        নানা বর্ণে উড়ায় উড়ানি।
পরিহাস্য জন যত           নানা ছলে কহে কত
        বারি হয়ে হইল পোড়ানি॥
দেহের কি কব কথা          সকল শরীরে ব্যথা
        কত শত বিছার জ্বলনি।
তোরে বলি প্রিয়সই       লাজে কারে নাহি কই
        পাছে জানে জনক জননী॥
    

মধ্যা

      লজ্জা আর রতি আশা সমান যাহার।
      রসিক পণ্ডিতে কয় মধ্যা নাম তার॥
রতিরসে কৃতি পতি          মোরে ভালবাসে অতি
        দেয় নিজাঙ্গুরী কণ্ঠমালা।
আঁখি আড়ে নাহি রাখে     সদা কাছে কাছে থাকে
        সুখ বটে কিন্তু এক জ্বালা॥
নখাঘাত দেখি বুকে              দন্তচিহ্ন দেখি মুখে
        সখী হাসে কর্ণে লাগে তালা।
শুলে ঠেকি এই দোষে       না শুইলে পতি রোষে
        শরীর হইল ঝালাপালা॥
    

প্রগল্‌ভা

    প্রগল্‌ভা সে রতিরসে পূর্ণ আশা যার।
    রতি প্রীতি আনন্দেতে মোহ হয় তার॥
শুন শুন প্রিয় সই              রাত্রির কৌতুক কই
    শুয়েছিনু পতিসঙ্গে নানা সুখ তাকে লো।
প্রকৃত কর্ম্মের বেলা            মোহে দোঁহে হৈল মেলা
    এ কর্ম্মেতে কত সুখ বুঝিবার পাকে লো॥
কিন্তু হৈল কোন্ কর্ম্ম          বুঝিতে নারিনু মর্ম্ম
    অবশেষে ভেবে মরি হাত দিয়া নাকে লো।
উঠিয়া পরিনু বাস             বান্ধিলাম কেশপাশ
    তোর দিব্য যদি আর কিছু মনে থাকে লো॥
    

মধ্যা প্রগল্‌ভার ধীরাদি ভেদ

      মানকালে মধ্যা প্রগলভার তিন ভেদ।
      ধীরা অধীরা ধীরাধীরা পরিচ্ছেদ॥
      মুগ্ধার এ ভেদ নাহি ভয় তার মূল।
      ক্রোধ হৈলে এক ভাব ক্রন্দন আকুল॥
      প্রকারে প্রকাশে ক্রোধ যে জন সে ধীরা।
      সোজাসুজি যার ক্রোধ সে জন অধীরা॥
      কিছু সোজা কিছু বাঁকা যার হয় ক্রোধ।
      ধীরাধীরা বলে তারে পণ্ডিত সুবোধ॥
    

মধ্যা ধীরা

আজি প্রভু দড় দড়           বেশ বনায়েছ বড়
      শ্বেত রক্ত চন্দনের চাঁদ ভালে ধরেছ।
মন দেখি ভাঙ্গা ভাঙ্গা          নয়ন হয়েছে রাঙ্গা
      বুঝি কোন দোষ দেখি মোরে রোষ করেছ॥
তোমা বিনা প্রভু নাই           যাইবার নাহি ঠাঁই
      কুমুদের চাঁদ যেন তেন মন হরেছ।
অপরাধ ক্ষমা কর              নূতন চন্দন পর
      এই লও নবমালা বাসীমালা পরেছ॥
    

মধ্যা অধীরা

সোহাগ করিয়া নিত্য            বসহ আমার ভৃত্য
      আজি দেখি এ কি কৃত্য দর্পণেতে চাও হে।
অধরে কজ্জলদাগ                নয়নে তাম্বুলরাগ
      অলক্তাক্ত ভাল ভাগ কার কাছে পাও হে॥
মোরে প্রাণ বলে ডাক          অন্যের নিকটে থাক
      বুঝিলাম মনে রাখ মনকলা খাও হে।
তোমা দেখি হয় ভীতি          কঠিন তোমার রীতি
      বুঝিনু তোমার প্রীতি যাও যাও যাও হে॥
    

মধ্যা ধীরাধীরা

তুমি মোর প্রাণপতি             কখন ধরিলা রতি
      বুঝি সুখে ভুলেছিনু তেঁই নাই মনে হে।
বুকে দেখি নখচিহ্ন              অধর দর্শনে ভিন্ন
      ভালে আলতার দাগ রক্তিমা নয়নে হে॥
শ্রমযাক মুখ ধোও             ক্ষণেক শয্যায় শোও
      ছুঁয়ে শুদ্ধ কর মালা তাম্বুল চন্দন হে।
কত জান ভারি ভুরি           দেখিতে দেখিতে চুরি
      পরিহার নমস্কার তোমা হেন জনে হে॥
    

প্রগল্‌ভা ধীরাধীরা

কাজের সময়        যত কথা হয়        এবে কোথা রয়
                মনে না থাকে।
কেমন ধরম           কেমন রকম        কেমন মরম
                কহিব কাকে॥
ধিক্ বিধাতায়        এ হেন আমায়        দিয়াছে তোমায়
                ইহারি পাকে।
দেখি হে চঞ্চল        ছোঁবে কি অঞ্চল        এ কাজে কি ফল
                কে তোমা ডাকে॥
    

প্রগল্‌ভা অধীরা

কোন ফুলে বঁধু       পান কর মধু        হয়ে এলে যদু
               পোড়াতে মোরে।
আল্‌তা কজ্জল        সিন্দুর উজ্জ্বল        জাগিয়া বিকল
               নয়ন ঘোরে॥
এতেক বলিয়া        ক্রোধেতে জ্বলিয়া       কমল ফেলিয়া
               মারিল জোরে।
কাঁদিয়ে নাগর        গুণের সাগর         কোথায় আদর
               থাকয়ে চোরে॥
    

প্রগল্‌ভা ধীরাধীরা

জাগিয়া নয়ন        তোমার যেমন          আমার তেমন
               সকল বটে।
সব কাজে মম       ফলে তরতম         কিসে আমি কম
               বুঝিলে ঘটে॥
বিধি কৈল নারী       লাজ দিল ভারী       তেঁই সে না পারি
               তোমার হঠে।
বৃক্ষমূলে হানি        শিরে ঢাল পানি        চরণ দুখানি
               নৌকায় তটে॥
    

জ্যেষ্ঠাদি ভেদ

      এই ধীরা এ অধীরা এই ধীরাধীরা।
      জ্যেষ্ঠা আর কনিষ্ঠা দ্বিভেদ হয় ফিরা॥
      পতির অধিক স্নেহ যারে সেই জ্যেষ্ঠা।
      অল্প স্নেহ যারে তারে বলয়ে কনিষ্ঠা॥
    

ধীরা জ্যেষ্ঠা

স্ত্রীর বুঝি ধীর ক্রোধ     দূরে গেল শোধ বোধ
   বন্ধু করে উপরোধ ধীরে ধীরে কহিছে।
যদি পেয়ে থাক দোষ      তবু যুক্ত নহে রোষ
   হাস্য কর পরিতোষ কামানলে দহিছে॥
রক্তপদ্ম দুটি পায়           ভ্রমর নূপুর তায়
   নিত্য নানা রস খায় আজি তাহি রহিছে।
আকুল আমার প্রাণ         তবু নহে সমাধান
   কঠিন তোমার মান পরিণাম নহিছে॥
    

ধীরা কনিষ্ঠা

স্ত্রীর দেখে স্থির মাস      করিবারে সমাধান
   বন্ধু করে অপমান ক্রোধে ক্রোধ হরিব।
কিসে মোর পেয়ে দোষ    কেন কর এত রোষ
   কিসে হবে পরিতোষ বল তাই করিব॥
কেহ বুঝি কহিয়াছে      গিয়াছিনু কারো কাছে
   অঙ্গে বুঝি চিহ্ন আছে তবে কিসে তরিব।
আরম্ভিয়া ছিল ক্রোধ      তা করিল উপরোধ
   এত দূরে শোধবোধ কত সেধে মরিব॥
    

অধীরা জ্যেষ্ঠা

যদ্যপি অধীরা হয়ে      গালি দিলা কটু করে
   তবু থাকিলাম সয়ে না সয়ে কি করিব।
তুমি প্রাণ তুমি ধন     তোমা বিনা অন্য জন
   যদি জানে মোর মন পরীক্ষা আচরিব॥
রুষ্ট হলে কটু কও      তুষ্ট হলে কোলে লও
   আমা বিনা কারো নও এই গুণে তরিব।
ছলছুতা মিছা সাঁচা      না জানি বিস্তর প্যাঁচা
   প্রাণেশ্বরী প্রাণ বাঁচা নহে আজ মরিব॥
    

অধীরা কনিষ্ঠা

বিনা দোষে দেহ গালি      মাথে কলঙ্কের ডালি
   মুখে যেন চুণ কালি কিসে মুখ চাহিব।
হয়েছি তোমার প্রভু       কত দোষ পাই তবু
   গালি নাহি দিয়া কভু কত গালি খাইব॥
বিনয়ে না মানি রোধ      যদি নাহি ছাড় ক্রোধ
   এত দূরে শোধ বোধ দেশ ছেড়ে যাইব।
তোমার যেমন মর্ম্ম         আমার তেমন কর্ম্ম 
   ইসাদ থাকিও ধর্ম্ম কার্য্যকালে পাইব॥
    

ধীরাধীরা জ্যেষ্ঠা

এক বাক্যে বুঝি রাগ       আর বাক্যে অনুরাগ
   হৃদয়ে হইল দাগ বুঝিতে না পারিয়া।
কি করিলে হও তুষ্ট      কি কহিলে হও রুষ্ট 
   অদৃষ্ট হইল দুষ্ট কিসে যাবে সরিয়া॥
যদি অপরাধী হই         নিতান্ত করিয়া কই
   তোমা বিনা কারো নই দুখে লও তরিয়া।
তুমি ধ্যান তুমি জ্ঞান       তুমি মান অপমান
   তোমা বিনা নাহি আন দেখিনু বিচারিয়া॥
    

ধীরাধীরা কনিষ্ঠা

এক বাক্যে দেখি রোষ     আর বাক্যে বুঝি তোষ
   না বুঝিনু গুণ দোষ বড় দায় পড়িল।
কি করিলে ভাল হবে       বল তাই করি তবে
   নহে ঘর লয়ে রবে আমার কি বহিল॥
পদ্মিনী ভ্রমরপ্রিয়া          ভ্রমরে খেদায়ে দিয়া
   তাহারি বিদরে হিয়া বুঝি তাই ফলিল।
রতির সময় নউক        আমার যে হয় হউক
   ক্রোধটি তোমার রউক যে হবার হইল॥
    

পরকীয়া নায়িকা

অপ্রকাশে যার মতি পরপতি সনে। 
পরকীয়া তাহারে বলয়ে কবিগণে॥
    

পরকীয়া ভেদ

অনূঢ়া

শুন শুন প্রাণবঁধু            পিয়াইয়া মুখমধু 
   এমত করিলে বশ কত গুণ কব হে।
অন্য সঙ্গে যদি পিতা      করে মোরে বিবাহিতা 
   কেমনে তাহার সঙ্গে তোমা ছাড়ি রব হে॥
এমত করিবা কর্ম্ম        নহে যেন স্ত্রীর ধর্ম্ম 
   বুকে মুখে হলে দাগ কলঙ্কিনী হব হে।
যাবৎ না বিয়া হয়          তাবৎ এমন হয় 
   তাবতি এমন পীড়া দু জনাতে সব হে॥
    

উঢ়া

আপনার পতি আছে     সদা তারে পাই কাছে
   তথাপি দারুণ মন পর লাগি মরে গো।
সঙ্কেত তরুর মূলে        সঙ্কেত নদীর কূলে
   ঘাটে ভাঙ্গামঠে মাঠে অন্ধকার ঘরে গো॥
কিঙ্কিণী-কঙ্কণ-রোল       লুকায়ে চুম্বন কোল
   রমণে নাহিক সুখ কোটালের ডরে গো।
পরপতি-রতি আশ          ঘর ছাড়ি পরবাস
   সুখ যদি নহে লোক তবে কেন করে গো॥
    

পরকীয়ার অন্য ভেদ

বিদগ্ধা লক্ষিতা গুপ্তা কুলটা মুদিতা
পরকীয়া নানাভেদ প্রাচীন লিখিতা॥
    

বিদগ্ধা

বিদগ্ধ দ্বিমত হয় বাক্য আর কাজে। 
কথা শুনি কার্য্য দেখি বুঝি বা অব্যাজে॥
    

বাগ্বিদগ্ধা

চির পরবাসী স্বামী       বিরহে কাতরা আমি
   বসন্তে মাতিল কাম কেমনে বা থাকিব।
প্রভুর কুসুমোদ্যান         বড় মনোহর স্থান
   মনুষ্যের গম্য নহে সেই স্থানে যাইব॥
ডাকে পিক অলিকুল      ফুটে নানাজাতি ফুল
   গাইয়া প্রভুর গুণ রজনী পোহাইব।
করিতে আমার তত্ত্ব        হইবে যাহার সত্ত্ব
   সেই বঁধু তারে দেখা সেইখানে পাইব॥
    

ক্রিয়াবিদগ্ধা

সুখে শুয়ে পতি আছে      রামা বসে তার কাছে
   ইসারায় উপপতি পিকডাকে ডাকিল।
রামা বলে হৈল দায়        পাছে পতি টের পায়
   না দেখি উপায় ভেবে স্তব্ধ হয়ে রহিল॥
কোকিল ডাকিছে হোর      কাম ভয়ে পাছে ঘোর
   শ্রান্ত আছ নিদ্রা যাও বলে চক্ষু ঢাকিল।
জাগ্রত আমার প্রিয়          কেন ডাক বনপ্রিয়
   আর কি তোমারে ভয় বলে দুই রাখিল॥
    

লক্ষিতা

     পরপতি রতিচিহ্ন ঢাকিতে যে নারে। 
     লক্ষিতা করিয়া কবিগণ বলে তারে॥
আজি প্রভু দেশে এলে      রতিচিহ্ন কিসে পেলে
   সোহাগ পড়ুক মরে সতিপনা হরিলে।
তুমি এলে বার্ত্তা পেয়ে      দেখিতে আইনু ধেয়ে
   আছাড় খাইনু পথে সে তত্ত্ব না করিলে॥
মুখে বল দন্তচিহ্ন           বুকে বল নখভিন্ন
   আলুথালু বেশ দেখে বুঝি লতা ধরিলে।
নষ্ট হই দুষ্ট হই      তোমা বিনা কারো নই
   কলঙ্ক এড়াবে নাহি সে জন না মরিলে॥
    

গুপ্তা

     হয়েছে হতেছে হবে পর সঙ্গে রতি।
     গুপ্ত করে যে জন সে জন গুপ্তমতি॥
মুখে বুকে দেখি দাগ         শাশুড়ী করুন রাগ
   একে তো বিরহে মরি আর এই ভয় লো।
কান্দিয়া পোহাই নিশা       আবেশে হারাই দিশা
   কেমন কেমন করে অধর হৃদয় লো॥
স্তন নিজ নখাঘাতে         অধর পীড়িয়া দাঁতে
   কোনমতে নিবারণ করি এ সময় লো।
এইরূপে দিবা রাতি         রাখিয়াছি কুল জাতি
   চক্ষু খেয়ে তবু লোক কত কথা কয় লো॥
    

কুলটা

    পতিকোলে থাকি যার অনেকেতে কাজ। 
    কুলটা তাহারে বলে পণ্ডিতসমাজ॥
আরে বিধি নিদারুণ       কি তোর স্মরিব গুণ
   কুলটার আশা পূর্ণ করিতে না পারিলি।
হস্ত পদ চক্ষু কান        দিলি দুই দুইখান
   উড়িবারে দুইখানি পাখা দিতে নারিলি॥
চৌদ্দ ভুবনে যত           পুরুষ বিবিধ মত
   সবার বুঝি ত বল তাই বুঝি সারিলি।
এ দুঃখ বা কত সব      অন্যের কি কথা কব
   চতুর্ম্মুখ রজোগুণ তবু তুই নারিলি॥
    

মুদিতা

    পরসঙ্গে রতিআশে উল্লসিতা যেই।
    বিঘ্নহীন দেখিয়া মুদিতা হয় সেই॥
প্রবাসে রয়েছে পতি        ননদী প্রসূতবতী
   বিধবা শাশুড়ী ঐ দৃষ্টিহীন রয় লো।
দেবর বিলাস রায়        শ্বশুর ভবনে যায়
   মন্দ মন্দ গন্ধবহ বিদরে হৃদয় লো॥
অস্ত গেছে দিনমণি       যতেক রসিক ধনি
   ওই শুন বংশীধ্বনি করয়ে ললিত লো।
রোমাঞ্চ হতেছে মোর    খসিছে কাঁচালী ডোর
   কেন সই ওষ্ঠাধর হতেছে কম্পিত লো॥
পরকীয় সুখ যত        ঘরে ঘরে শুনি কত
   অভাগীর ধর্ম্মভয় এত করে মরি লো।
পরপুরুষের মুখ         দেখিয়া যে হয় সুখ
   এ কি জ্বালা সদা জ্বলি হরি হরি হরি লো॥
    

সামান্য বনিতা

    ধনলোভে ভজে যেই পুরুষ সকলে। 
    সামান্য বনিতা তারে কবিগণে বলে॥
স্বকীয়া ধর্ম্মের বশে      পরকীয়া প্রীতিরসে
   অমূল্য যৌবন ধন পুরুষেরে দেই লো।
আমার যৌবন ধন      ভোগ করে যেই জন
   মান বুঝি মূল্য করে দিতে পারে যেই লো॥
যখন যে ধন চাই      সেই ক্ষণে যদি পাই
   আমার মনের মত বন্ধু হবে সেই লো।
ধনিক রসিক জানি      নাগর মিলাবা আনি
   আপনার মর্ম্মকথা কয়ে দিনু এই লো॥
    

সামান্য বনিতার ভেদ

অন্য ভোগ দুঃখিতা আর বক্রোক্তি গর্ব্বিতা। 
মানবতী আদি ভেদে সামান্য বনিতা॥
    

বক্রোক্তিগর্ব্বিতা

গর্ব্বিতা দ্বিমত হয় রূপে আর প্রেমে। 
দুইটি একত্র হৈলে হীরা যেন হেমে॥
    

রূপগর্ব্বিতা

মুখ দেখি যদি আরশী ধরে। 
বড় বলে ছায়া সে লয় হরে॥
মদনে জানিত অধিক করে। 
দেখিতাম কিন্তু গিয়াছে মরে॥
    

প্রেমগর্ব্বিতা

অনিমিষ আঁখি স্থির চরিত্র। 
আপনার বঁধু করিয়া চিত্র॥
আমারে দেখয়ে এ কি বিচিত্র। 
কেহ বঁধু সখী শত্রু কি মিত্র॥
    

অন্যসম্ভোগ দুঃখিতা

কহ দূতি গিয়াছিলে কোন্ বনে। 
বড় শোভয় অঙ্গ ফুলাভরণে॥
নিজ বেশ করে দড় আইলি লো। 
কই গেলি নরাধম সন্নিধি লো॥
ভুলিয়াছিলি আর ভুলাইলি রে। 
মধু গূঢ় বনে কত পাইলি রে॥
    

মানবতী

এস পরাণ পুত্তলি এস      মরে যাই দেখি কিবা বেশ
   আলোতে রহ হে রূপ ভাল করে হেরি হে।
আলতা কজ্জল দাগ ভালে      অরুণ প্রকাশ রাহু গালে
   তবে আছ ভাল জান ভারি ভুরি ঢেরি রে॥
    

নায়িকা সকলের অবস্থা ভেদ

এ সব নায়িকা পুন অষ্টমত হয়। 
বিপ্রলম্ভ সম্ভোগ তাহার পরিচয়॥
বাসসজ্জা উৎকণ্ঠিতা ও অভিসারিকা। 
বিপ্রলব্ধা তার পর স্বাধীনভর্ত্তৃকা॥
খণ্ডিতা তাহার পর কলহান্তরিতা। 
প্রোষিতভর্ত্তৃকা এই অষ্ট পরিমিতা॥
    

বাসসজ্জা

   পতি হেতু বাসঘরে যেই করে সাজ। 
   বাসসজ্জা বলে তারে পণ্ডিতসমাজ॥
আঁচড়িয়া কেশপাশ       পরিয়া উত্তম বাস
   সখী সঙ্গে পরিহাস গীত বাদ্য রটনা।
চামর চন্দন চুয়া       ফুলমালা পানে গুয়া
   হাতে লয়ে শারী শুয়া কামরস পঠনা॥
কিঙ্কিনী কঙ্কণ হার      বাজুবন্ধ সিঁতি তাড়
   নূপুরাদি অলঙ্কার নিত্য নব পর না।
যোগী যেন যোগাসনে      বসিয়া ভাবয়ে মনে
   কত ক্ষণে বন্ধু সনে হইবেক ঘটনা॥
    

উৎকণ্ঠিতা

   স্বামীর বিলম্ব যেই ভাবে অনুক্ষণ। 
   উৎকণ্ঠিতা তাহারে বলয়ে কবিগণ॥
হইল বহু নিশি       প্রকাশ হয় না দিশি
    আইল কেন নাহি কালিয়া।
পিকের কলরব        ডাকিছে অলি সব
    অনল দেই দেহে জ্বালিয়া॥
তিমির ঘনতরে           সভয় বনচরে
    ফিরয়ে কিবা পথ ভালিয়া।
অপর সখীরসে           রহিল পরবশে
    মদনে মোরে দিল জ্বালিয়া॥
    

অভিসারিকা

      স্বামীর সঙ্কেতস্থলে যে করে গমন। 
      তারে অভিসারিকা বলয়ে কবিগণ॥
নিকট সঙ্কেতসময় আইল        শুনি রসময়ী মূরলী গাইল
  ধরি ধনুঃশর মদন ধাইল চলে নিধুবনে কামিনী।
পিক কলকলি শারীশুক ধ্বনি     ফুটে বনফুল ভ্রমর গুনগুনি
  তাহাতে মিলিত নূপুর রুণরুণী শীঘ্র চলে মৃদুগামিনী॥
বাছিয়া পরিলেক নীল অম্বর       মদন হেমগৃহে মেঘাড়ম্বর
  পথিক জন ডর করিতে সম্বর ঝাঁপিল তাহে তনুদামিনী।
বদন সরসিজ গন্ধযুত মন      মোহিত সহচরী ভ্রমর শিশুগণ
   তথি মলয়াচলগতি মন্দ পবন বাওল দ্রুত সখী যামিনী॥
    

বিপ্রলব্ধা

  সঙ্কেতস্থানেতে গিয়া নাহি পায় পতি। 
  বিপ্রলব্ধা তারে বলে পণ্ডিত সুমতি॥
তিল পরিমাণ মান      সদা করি অনুমান
     গুরুভয় লঘুভয় গেলা।
গৃহ ছাড়ি ঘন বন      করিলাম আরোহণ
     সাগর তরিনু ধরি ভেলা॥
হরি হরি মরি মরি      উহু উহু হরি হরি
     তব নহে হরি সনে মেলা।
পরদুঃখ পরশ্রম       পর জনে জানে কম
     অপরূপ খলজনে খেলা॥
    

স্বাধীনভর্ত্তৃকা

    কোলে বসে যার পতি আজ্ঞার অধীন। 
    স্বাধীনভর্ত্তৃকা তারে বলে সুপ্রবীণ॥
শুন শুন প্রাণনাথ           নিবেদি হে যোড়হাত
    পূরিল সকল সাধ কিছু শেষ রয় হে।
বেঁধে দেহ মুক্তকেশ           বনাইয়া দেহ বেশ
    তুমি মোরে ভালবাস লোকে যেন কয় হে॥
দেখিয়া তোমার মুখ            অতুল হইল সুখ
    পাসরিনু যত দুখ আছিল যে ভয় হে।
যত কাল জীয়ে রই         তোমা ছাড়া যেন নই
    নিতান্ত করিয়া কই মনে যেন রয় হে॥
    

খণ্ডিতা

    অন্য ভোগচিহ্ন অঙ্গে আসে যার পতি। 
    খণ্ডিতা তাহার নাম বলে শুদ্ধমতি॥
এস বঁধু দ্রুত হয়ে         কেন এস রয়ে রয়ে
   মরি রে বালাই লয়ে কিবা শোভা পেয়েছে।
কপালে সিন্দূরবিন্দু           মলিন বদন ইন্দু
   নয়ন রক্তের সিন্ধু মোর দিগে ধেয়েছে॥
অধরে কজ্জলদাগ            নয়নে তাম্বুলরাগ
   বুঝি কেবা পেয়ে লাগ মোর মাথা খেয়েছে॥
তোমার কি দোষ দিব       বাপ মায়ে কি বলিব
   হরি হরি শিব শিব যম মোরে ভুলেছে॥
    

কলহান্তরিতা

    কলহে খেদয়ে পতি পশ্চাৎ তাপিতা। 
    কবিগণে বলে তারে কলহান্তরিতা॥
ক্রোধে হয়ে হতজ্ঞান      কৈনু তারে অপমান
   এখন আকুল প্রাণ দেখিতে না পাইয়া।
ফুটিছে বিবিধ ফুল       ডাকে ভৃঙ্গ অলিকুল
   সামালিব এই শূল কার পানে চাহিয়া॥
কাতর হইয়া অতি        বিস্তর করিয়া নতি
   চরণে ধরিল পতি না চাহিনু ফিরিয়া।
করিনু যেমন কর্ম্ম        ফলিল তাহার ধর্ম্ম
   মরুক এমত মর্ম্ম দুঃখে যাই মরিয়া॥
    

প্রোষিতভর্ত্তৃকা

   পরবাসে পতি যার মলিনা বিরহে। 
   প্রোষিতভর্ত্তৃকা তারে কবিগণ কহে॥
অনল চন্দন চুয়া        গরল তাম্বুল গুয়া
    কোকিল বিকল করে অতি।
বিধবার মত বেশ        অস্থিচর্ম্ম অবশেষ
    তাপে কাম পোড়ায় বসতি॥
মনোজ তনুজ মত      কোদণ্ড করিয়া হত
    হাতে লয় পিণ্ডের পদ্ধতি।
সখীমুখে মান শুনে     পতি এলো হেন গুণে
    দেখিতে শ্বাসের গতাগতি॥
    

প্রোষ্যৎভর্ত্তৃকা

   যার কাছে আসে পতি প্রবাস গমন। 
   প্রোষিতভর্ত্তৃকা মধ্যে তাহারো গণন॥
   এ আট লক্ষণে তার না মিলে লক্ষণ। 
   নবমী নায়িকা হৈতে পারে কেহ কন॥
   কিন্তু অষ্ট নায়িকা সকল গ্রন্থে কয়। 
   নবমী কহিতে গেলে গণ্ডগোল হয়॥
   অতএব দ্বিধা বলি প্রোষিতভর্ত্তৃকা। 
   প্রোষিতভর্ত্তৃকা আর প্রোষ্যৎপতিকা॥

শুন শুন ওরে প্রাণ         পতি পরবাসে যান
   তুমি কি করিবে এবে সত্য করে কহিবে।
এবে জানিলাম দড়       তোমা হৈতে পতি বড়
   নহে কেন আগে যান তুমি পাছে রহিবে॥
যদি বড় হৈতে চাও      তবে আগে আগে যাও
   নহে তুমি লঘু হবে আমার কি বহিবে।
এবে সুখ দেয় যারা      পিছে দুঃখ দিবে তারা
   কয়ে অবসর আমি কত জ্বালা সহিবে॥

   ইত্যাদি কহিয়া দিনু নায়িকা যতেক। 
   পতির গমনকালে সবার প্রত্যেক॥
   পুথি বাড়ে সকলের করিতে কবিতা। 
   অনুভবে বুঝে লবে লক্ষণ মিলিতা॥
    

নায়িকার উত্তমাদি ভেদ

উত্তমা মধ্যমা আর অধমা নিয়মে। 
এ সব নায়িকা তিন মত হয় ক্রমে॥
    

উত্তমা

অহিত করিলে পতি যেবা করে হিত। 
উত্তমা তাহার নাম বলয়ে পণ্ডিত॥
    

মধ্যমা

হিত কৈলে হিত করে অহিতে অহিত। 
মধ্যমা তাহার নাম মধ্যম চরিত॥
    

অধমা

হিত কৈলে অহিত করয়ে যেই জন। 
অধমা তাহার নাম বলে কবিগণ॥
    

চণ্ডী নায়িকা

পতি প্রতি করে যেই অকারণ ক্রোধ। 
চণ্ডী তার নাম বলে পণ্ডিত সুবোধ॥
    
নায়িকা সহায়
রসমঞ্জরী
ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর

সহচরী

বেশভূষা করে দেয় পরিহাস। 
কথা কৈতে খেতে শুনে শিখায় বিলাস॥
যার কাছে বিশ্রাম বিশ্বাস কথা কয়। 
সহচরী সখী সেই পঞ্চ মত হয়॥
সখী নিত্যসখী প্রিয়সখী প্রাণসখী। 
অতিপ্রিয়সখী এই পঞ্চমত সখী॥
    

সখী

আমার নিকটে রয়ে      মরম আমারে কয়ে
   এমত শিখাব কথা সুধাবৃষ্টি করিবে।
আঁচড়িয়া দিব কেশ      বানাইয়া দিব বেশ
   থাকুক পতির মন মুনিমন ভুলিবে॥
হাবভাব লীলা হেলা      শিখাইব নানা খেলা
   আসিতে আমার কাছে কাহারে না ডরিবে।
দোষ যত লুকাইব      গুণ যত প্রকাশিব
   বড় দায়ে ঠেক যদি আমা হতে তরিবে॥
    

দূতী

নায়ক নায়িকা যেই করয়ে ঘটন। 
বিরহ যাপন করে দূতী সেই জন॥
স্বয়ং দূতী আদ্যদূতী এই সে প্রকার। 
আদ্যদূতী তিন মত শুন ভেদ তার॥
অমিতার্থ নিশ্চয়ার্থ আর পত্রহারী। 
বিশেষ বিশেষ শুন করিয়া বিচারি॥
ইঙ্গিতে যে কর্ম্ম করে অমিতার্থ সেই। 
নিশ্চয়ার্থ আজ্ঞা পায়ে কর্ম্ম করে যেই॥
পত্র লয়ে কর্ম্ম করে পত্রহারী সেই। 
বিশেষিয়া বুঝ সবে কয়ে দিনু এই॥
    

আদ্যদূতী

সিন্দূর চন্দন চুয়া      ফুলমালা পান গুয়া
   পড়ে দিতে পারি যদি ভুলে চন্দ্রবদনী।
কুমন্ত্র এমত জানি      বিষ দেখে রাজা রাণী
   অপ্রীতি করিতে পারি কাম কামকরণী॥
যে নারী না নর জানে      যে নর না নারী মানে
   তাহারে মিলাতে পারি দিনে করে যামিনী।
নাগর নাগরী যত      হও মোর অনুগত
   সিদ্ধি করে মনোরথ যাই দ্রুতগামিনী॥
    
নায়ক প্রকরণ
রসমঞ্জরী
ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর
নায়ক নায়িকা দুই শৃঙ্গারে প্রধান। 
নায়িকা বর্ণিনু শুন নায়ক সন্ধান॥
পতি উপপতি আর বৈশিক নাগর। 
স্বীয়া পরকীয়া আর সামান্যার ঘর॥
বেদমত বিভা করে যে জন সে পতি। 
উপপতি সেই যার পিরীতে বসতি॥
কোনরূপে ধনলোভে হয় সংঘটন। 
বৈষয়িক বৈশিক নাগর সেই জন॥
    

পতিভেদ

অনুকূল দক্ষিণ ধৃষ্ট শঠ চারি মত। 
পতিভেদ কেহ বলে তিনে কেহ রত॥
একে অনুরাগ যার সেই অনুকূল। 
দক্ষিণে সে যার ঘরে পরে হয় তুল॥
ধৃষ্ট সেই দোষ করে পুনঃ করে হঠ। 
কপট বচনে পটু সেই জন শঠ॥
    

অনুকূল

ওলো ধনি প্রাণধন      শুন মোর নিবেদন
   সরোবরে স্নান হেতু যেয়ো না লো যেয়ো না।
যদ্যপি বা যাও ভুলে      অঙ্গুলে ঘোমটা তুলে
   কমলকানন পানে চেয়ো না লো চেয়ো না॥
মরাল মৃণাল লোভে      ভ্রমর কমল ক্ষোভে
   নিকটে আইলে ভয় পেয়ো না লো পেয়ো না।
তোমা বিনা নাহি কেহ      ঘামে পাছে গলে দেহ
   যায় পাছে ভেঙ্গে কটি ধেয়ো না লো ধেয়ো না॥
    

দক্ষিণ

তোমার নিকটে যত      দিব্য করি কহি কত
   বাহির হইবামাত্র পর দেখি ভুলে লো।
তোমার যেমন প্রীতি      পরসঙ্গে সেই রীতি
   কহিলাম আপনার দোষগুণগুলি॥
কি করে ধর্ম্মের ভয়      লোকলাজে কিবা হয়
   দেখিতে পরের মুখ ফিরি কুলি কুলি লো।
তুমি যদি হও রুষ্ট      অন্যে করিবেক তুষ্ট
   ইহা বুঝি মোর সঙ্গে ছেড়ে দেহ ঠুলি লো॥
    

ধৃষ্ট

দোষ দেখে একবার      কৈল নানা তিরস্কার
   লাজ পেয়ে আনু ফিরে তবু দয়া হল না।
ভুজপাশে বান্ধ্যা ধর      নিতম্ব প্রহার কর
   দশনেতে কর ক্ষত অভিমানে গলো না॥
দূর কৈলে দূর হব      গাল দিলে সয়ে রব
   আমারে সহিল সব তোমারে তো সলো না।
পুরুষ পরশমণি      যারে ছোঁয় সেই ধনী
   ইহা বুঝে অনুক্ষণ দূর দূর বলো না॥
    

শঠ

   কালি করেছিনু       আনিতে ভুলিনু 
        ক্ষম সেই অপরাধ।
   যে বল করিব       যাহা চাহ দিব  
        পূরাহ সকল সাধ॥
   অঙ্গেতে যে দাগ    তোমারি সোহাগ
       মিথ্যা দেহ অপবাদ।
   আমার পরাণ        হরিণী সমান
       তোমার চক্ষু নিষাদ॥
    

উপপতি

নিজ নারী আছে ঘরে    যাহা বলি তাহা করে
   নানা রূপ গুণ ধরে তাহে মন রয় না।
করিতে অন্যের সঙ্গ        সদাই সরস অঙ্গ
   এ বড় অপূর্ব্ব রঙ্গ ধর্ম্মভয় হয় না॥
যাইতে সঙ্কেতস্থান        সতত আকুল প্রাণ
   জ্ঞান মান অপমান কিছু মনে লয় না।
ব্যক্ত হৈলে কালামুখ       শয়নে নাহিক সুখ
   রমণেতে নানা দুখ তবু ক্ষমা হয় না॥
    

বৈশিক নাগর

গিয়াছিনু সরোবরে       স্নান করিবার তরে
   দেখিয়াছি এক জন অপরূপ কামিনী।
চক্ষু মুখ পদ্মছন্দ      কিবা ছন্দ কিবা বন্ধ
   নীলাম্বরে ঝাঁপে তনু মেঘে যেন দামিনী॥
ঈশ্বর সদয় হন       দূতী মিলে এক জন
   এই ক্ষণে তার কাছে যায় দ্রুতগামিনী।
যত চাহে দিব ধন      দিব নানা আভরণ
   কোন মতে মোর সঙ্গে বঞ্চে এক যামিনী॥
    

নায়কদিগের উত্তমাদি ভেদ

উত্তম মধ্যম আর অধম নিয়মে।
নায়িকার যেই ক্রম নায়ক সে ক্রমে॥
বাসসজ্জা আদি নায়িকার ভেদ যত।
নায়কে সে ভেদ হয় লক্ষণসম্মত॥

উপপতি বৈশিকেতে সকলি বিদিত।
পতি প্রতি রসাভাস কেবল খণ্ডিত॥

স্বকীয়ার রসাভাস জান অভিসার।
পতির খণ্ডিত ভাব তেমতি প্রকার॥

সর্ব্বজন সুসম্মত আর ভাব সব।
উদাহরণেতে দেখ করে অনুভব॥
    

বাসকসজ্জা

 শয়ন সময়           বন্ধু রসময়
    করে রমণীয় মোহন সাজ।
 অন্য কার্য্য ছলে      শয্যাঘরে চলে 
    সাধিতে আপন গোপন কাজ॥
 হাতে লয়ে যন্ত্র       গান কামতন্ত্র 
    মনে পেয়ে লাজ পায় এ লাজ।
 ভাবে খাটে বসি      প্রাণের প্রেয়সী 
    আসিতে না জানি কতেক ব্যাজ॥
    

উৎকণ্ঠিত নায়ক

কেন নাহি আইসো প্রিয়া        বিরহে বিদরে হিয়া
   স্থির হব কি করিয়া ধৈর্য্য আর রহে না।
কিবা কোন কার্য্যপাকে      ভীতা কিবা দেখে কাকে
   নহে এতক্ষণ থাকে কামে কিবা দহে না॥
পান গুয়া গন্ধমালা          অগ্নি সম দেয় জ্বালা
   করিলেক ঝালাপালা তনু প্রাণ রহে না।
আসিবেক কতক্ষণে          তবে সুখ পাব মনে
   বিনা তার দরশনে আর তাপ সহে না॥
    

অভিসারক নায়ক

দ্বিতীয় প্রহর রেতে           মোরে কহিয়াছে যেতে
      সময় হইল প্রায় স্থির মন টলিল।
সুখের কে জানে লেখা         গেলে মাত্র পাব দেখা
      অনেক দিনের পর আজি আশা ফলিল॥
অন্ধকারে দেখে আলো       গৌর লোক দেখে কালো
      শত্রুজনে মিত্রভাব জলে স্থল হইল।
রজনীতে দিবা মত              তিমির হইল হত
      কুপথে সুপথ জ্ঞান তাহে মন মোহিল॥
    

বিপ্রলব্ধ নায়ক

সুখের শয়নঘরে             স্বীয়া নানা রস করে
     তাহা ছেড়ে আইলাম পরআশা করিয়া।
গুরু ভার লঘু করে           অন্ধকারে নাহি ডরে
     ছাড়িয়া আপন বেশ পরবেশ ধরিয়া॥
সঙ্কেত স্মরণ করে            এসেছিল বেশ ধরে
     আমার বিলম্বে বুঝি ঘরে গেল ফিরিয়া।
আসিয়া সঙ্কেত ঠাঁই           দেখিতে পাইল নাই
     আহা মরি অন্য কেবা লয়ে গেল হরিয়া॥
    

স্বাধীনভার্য্যা নায়ক

তুমি প্রাণ তুমি ধন          তুমি মন তুমি পণ
     হৃদয়ে যে ক্ষণ থাক সেই ক্ষণ ভাল লো।
যত জন আর আছে       তুচ্ছ করি তোমা কাছে
     ত্রিভুবনে তুমি ভাল আর সব কালো লো॥
তোমার বদনচাঁদ             আঁচল চঞ্চল চাঁদ
     আমার মোহন ফাঁদ অন্ধকারে আলো লো।
করেছি বিস্তর সেবা        আজি মোরে সাজাইবা
     আমার মাথার কিরা যদি মোরে টালো লো॥
    

খণ্ডিত নায়ক

আসিব বলিয়া গেলা         অন্য সঙ্গে হৈল মেলা
     শরীরেতে চিহ্ন আছে লুকাবে কি বলিয়া।
মোর সঙ্গে কথা কয়ে         বঞ্চিলা অন্যেরে লয়ে
     কতেক করিলা ভাব এ কান্তেরে ছলিয়া॥
ছিন্ন ভিন্ন দেখি বেশ         আলুথালু দেখি কেশ
     দেখিয়া তোমার ভাব দেহ যায় জ্বলিয়া।
কি সাধিলে মনোরথ           খণ্ডিয়া পিরীতি পথ
     নিজ স্থানে যাও তুমি আমি যাই চলিয়া॥
    

কলহান্তরিত নায়ক

অল্প অপরাধ পেয়ে          কেন দিনু খেদাইয়ে
     এবে কার মুখ চেয়ে কামজ্বালা সারিব।
বিবেচনা নাহি করি          এখন ঝুরিয়া মরি
     অনুমানে হেন বুঝি রহিতে না পারিব॥
পুন দূতী পাঠাইব          প্রীতি করি আনাইব
     সবে এক দোষ তাহে পতি হয়ে হারিব।
হারি মানি দ্বন্দ্ব যাক        তার অভিমান থাক
     তাহা বিনা এ সঙ্কটে তরিবারে নাহিব॥
    

প্রোষিতভার্য্যা নায়ক

কোথায় রহিল রামা          বিরহে দহিয়া আমা
     নিরন্তর কামজ্বালা কত আর বহিব।
পিক ডাকে কুহু কুহু          ভ্রমর গুঞ্জরে মুহু
     সাপে খেকো বায়ু জ্বালা কত আর বহিব॥
চন্দন কমল দল             পোড়ে যেন দাবানল
       সুধাকর বিষধর কত সয়ে রহিব।
আলো দেখি অন্ধকার            পুরস্কার তিরস্কার
       হেন বুঝি অবশেষে উদাসীন হইব॥
    

প্রোষ্যৎপত্নীক নায়ক

যদি যাবে আমা ছেড়ে       প্রাণ কেন লও কেড়ে
     আপন উদ্বেগ হেতু অগ্নি লয়ে যাবে লো।
তোমা সঙ্গে যাবে তাপ        আমি এড়াইব পাপ
     খেতে শুতে অনুক্ষণ মনস্তাপ পাবে লো॥
প্রবোধ করিয়া তায়          ঠেকিবে দারুণ দায়
     এমত হইবে ব্যক্ত সম্বিৎ হারাবে লো।
কয়ে দিনু শেষ মর্ম্ম          বুঝিয়া করহ কর্ম্ম
     পদে পদে পাবে জ্বালা ক-পদ এড়াবে লো॥
     
     ইত্যাদি বুঝিবা নায়কের অষ্ট মত।
     উদাহরণেতে অনুভবে পাবে যত॥
    
নায়ক সহায় কথন
রসমঞ্জরী
ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর
     পীঠমর্দ্দ বিট বলি চেট বিদূষক।
     এই সব ভেদ হয় বিস্তর নায়ক॥
    

পীঠমর্দ্দ

     রমণী করিলে ক্রোধ যে করে সান্ত্বনা।
     মর্ম্মধী সচিব পীঠমর্দ্দ সেই জনা॥

  রমণী রত্ন সহে না আঁচ       টুটয়ে অগ্নি পরশে কাচ
      করিতে মান দিবে না স্থান দিবে না স্থান।
কি করে ক্ষোভ সহে রামার      অবলা জাতি মৃদু আকার
      জ্বলয়ে অগ্নি নহে সে মান নহে সে মান॥
রস তাপোহি বিনাশে পায়       তপনে তাপ শুকায়ে যায়
      বসিয়ে মান রবে কোথায় রবে কোথায়।
প্রমদা বন্ধন সংসারেরি          প্রমাদ আকর আহ্লাদেরি
      সতত রাখহ সযত্নে তায় সুরত্ন প্রায়॥
    

বিট

    কামশাস্ত্রে যেই জন পরম নিপুণ।
    বিট বলি তার নাম ধরে নানা গুণ॥

চুম্ব আলিঙ্গন           কামের দীপন
       মন্ত্র তন্ত্র আদি যত।
যাহে নারী বশ         যাহে বাড়ে রস
       এমত জানি বা কত॥
বেশ ভূষা বাস         সন্দেশ সম্ভাষ
       নৃত্য গীত নানা মত।
ফিরি নানা ঠাঁই         আর কর্ম্ম নাই
       আমার এই সতত॥
    

চেটক

      সন্ধান চতুর যেই সময় ঘটক।
      কবিগণ তার নাম বলয়ে চেটক॥

যখন বিরলে পাব          তখনি নিকটে যাব
    যদি ক্রোধে গালি দেয় তবু সয়ে রহিব।
নয়নের ভঙ্গী করি         ফল কিম্বা ফুল ধরি
    চারি চক্ষে এক হলে ইশারায় কহিব॥
স্নানেতে যখন যায়          ধরিতে বসন তায়
    কৌতুকে কুম্ভীর হয়ে জলে ডুবে রহিব।
দুঃখ বিনা নহে সুখ         দেখিতে সে চাঁদ মুখ
    গ্রীষ্ম হিম বৃষ্টি বাতে পরাঙ্মুখ নহিব॥
    

বিদূষক

    কিবা রোষে কিবা তোষে যার পরিহাস।
    বিদূষক তার নাম হাস্যের বিলাস॥

চন্দন কজ্জলরাগ           বদনে যে দেখ দাগ
   অপমান এই দেখ মুখে কালি চূণ লো।
দেখ দেখ শোভা কিবা     চাঁদে আলো যেন দিবা
   দোহাই দোহাই তোর কামে করে খুন লো॥
করিয়া পরীক্ষা যদি           রসের তরঙ্গ নদী
   দুই জনে ডুবি এস কে হয় নুপুণ লো।
আপনি দোষের ঘর          পরীক্ষা করিতে ডর
   আমার মাথায় দোষ এত বড় গুণ লো॥
    
শৃঙ্গার নিরূপণ
রসমঞ্জরী
ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর
শৃঙ্গারের দুই ভেদ শুনহ প্রয়োগ।
প্রথমত বিপ্রলম্ভ দ্বিতীয় সম্ভোগ॥
    

বিপ্রলম্ভ

বিপ্রলম্ভ চারি মত শুনহ প্রকাশ।
পূর্ব্বরাগ মান প্রেমবৈচিত্র্য প্রবাস॥
    

পূর্ব্বরাগ

অঙ্গসঙ্গ হওনের পূর্ব্ব যে লালস।
তারে বলি পূর্ব্বরাগ তাহে দশা দশ॥
লালস উদ্বেগ জড় কৃশ জাগরণ।
ব্যগ্র রোগ বায়ু মোহ নিদানে মরণ॥
প্রত্যেক বর্ণিতে হয় কবিতা বিস্তর।
অনুভবে বুঝে লবে নাগরী নাগর॥ 
    

মান

যেই ক্রোধ দম্পতির রসের বিচ্ছেদ।
সেই মান অহেতু সহেতু দুই ভেদ॥
অহেতু যে মান সেই অনায়াসে বধ্য।
সহেতুর তিন ভেদ গুরু লঘু মধ্য॥
অন্যের সহিত পতি যদি কথা কয়।
তাহে জন্মে লঘু মান বাক্যে দূর হয়॥
অন্য নাম গুণ পতি যদি কাছে কয়।
তাহে জন্মে মধ্য মান পরীক্ষায় ক্ষয়॥
অন্য ভোগচিহ্ন যদি দেখে পতি গায়।
তাহে জন্মে গুরু মান প্রণামেতে যায়॥
সাম ভেদ ক্রিয়া দান নতি ত্যাগ রোষ।
এই সাতে মান ভাঙ্গে হয় পরিতোষ॥
প্রিয় বাক্যে স্তব করে তারে বলি সাম।
আত্মগুণ তার দোষ ভেদ তার নাম॥
সখী দ্বারা ভয় প্রদর্শন সেই ক্রিয়া।
দান যাহে বস্ত্র মাল্য ভূষণাদি দিয়া॥
নতি সেই যাহে পায় ধরে নমস্কার।
ঔদাস্য প্রকাশ সেই ত্যাগ নাম যার॥
রোষ সেই যাহে ভয় কষ্টের বিস্তার।
মান শান্তি চিহ্ন অশ্রু লোমাঞ্চ শীৎকার॥
অবশ্য এ সব রূপে মানের বিনাশ।
অসাধ্য হইলে তারে বলি রসাভাস॥
প্রত্যেকে বর্ণিত হয় কবিতা বিস্তর।
অনুভবে বুঝে লবে নাগরী নাগর॥
    

প্রেমবৈচিত্ত্য

নিকটে শয়ন অনুরাগের নিমিত্ত।
ছলায় বিরহ হয় সে প্রেমবৈচিত্ত্য॥
    

প্রবাস

প্রবাস দ্বিমত হয় নিকট ও দূর।
দশ দশা হয় তাহে বিষাদ প্রচুর॥
প্রথমেতে চিন্তা দ্বিতীয়েতে জাগরণ।
তৃতীয়েতে উদ্বেগ চতুর্থে ক্ষীণতন॥
পঞ্চমে মলিন ষষ্ঠে প্রলাপ বিষাদ।
সপ্তমেতে ব্যাধি হয় অষ্টমে উন্মাদ॥
নবমেতে মোহ হয় দশমে মরণ।
অনুভবে বুঝে লবে দেখিয়া লক্ষণ॥
    

সম্ভোগ

সম্ভোগের চারি ভেদ করিয়া বাখান।
সঙ্খিপ্ত সঙ্কীর্ণ সম্পূর্ণ সমৃদ্ধিমান্॥
পূর্ব্বরাগ পরে অল্প চুম্ব অল্প কোল।
সঙ্খিপ্ত সে রতি তাহে চিত্ত হয় লোল॥
মানভঙ্গে পুরুষ সঙ্গে মিলন যে হয়।
সঙ্কীর্ণ তাহার নাম কবিগণ কয়॥
কিঞ্চিৎ প্রবাস পরে হয় যে মিলন।
সম্পূর্ণ তাহার নাম কহে কবিগণ॥
সুদীর প্রবাস পরে মিলন যে রস।
সে রস সমৃদ্ধিমান্ দম্পতী অবশ॥
    

সম্ভোগের প্রকার

দর্শন স্পর্শন কথা পথরোধ বাস।
বনখেলা জলখেলা গীত বাদ্য হাস॥
লুক্কায়ন মধুপান আদি নানা মত।
অনন্ত অনন্ত ভাব বিরচিব কত॥
    

দর্শন

দরশন তিন মত নাগরী নাগরে।
সাক্ষাৎ স্বপন আর পটে চিত্র ধরে॥
    

সাক্ষাৎ দর্শন

নয়নে নয়ন    বদনে বদন    চরণে চরণ
        আদেশি রহ।
হৃদয়ে হৃদয়   প্রাণ সমুদয়   পরাণে আলয়
        ভাঙ্গিয়া লহ॥
গমনে গমন    রমণে রমণ    বচনে বচন
        বিনয় কহ।
পেয়ে দরশ    পরম পরশ    সকলে সরস
        হইয়া রহ॥
    

স্বপ্ন দর্শন

নিদ্রার আবেশে        রজনীর শেষে
     মনোহর বেশে বঁধু আসিয়া।
প্রেম পারাবার         করিল বিস্তার
     নাহি পাই পার যাই ভাসিয়া॥
যে রস হইল         মনেতে রহিল
     যে কথা কহিল মৃদু হাসিয়া।
ধরম করম           সরম ভরম
     নরম মরম গেল নাশিয়া॥
    

চিত্র দর্শন

দেখিবারে চিত্র        করিলাম চিত্র
     এ বড় বিচিত্র হইল তাই।
দেখিতে বদন         মাতিল মদন
     ছাড়িয়া সদন চেতন যায়॥
না পানু দেখিতে      নারিনু রাখিতে
     লিখিতে লিখিতে হইল দায়।
চিত্রের পুতুল         করিল আকুল
     হারানু দুকুল চিত্রের প্রায়॥
    
আলম্বনাদি কথন
রসমঞ্জরী
ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর
আলম্বন বিভাবন আর উদ্দীপন।
এই তিন ভাবের শুনহ বিবরণ॥
আলম্বন সেই যাহে রসের আশ্রয়।
নায়ক নায়িকা দুই তার বিনিময়॥
নানাবিধ অনুভাবে বলি বিভাবন।
যাহে রস বাড়ে তাহে বলি উদ্দীপন॥
    

উদ্দীপন

গুণ স্মরা নাম লওয়া নিত্য রূপ দেখা।
গীত বাদ্য শুনা আর কর্ম্ম রেখা লেখা॥
সুগন্ধি ভূষণ মেঘ পিক ভৃঙ্গরব।
চন্দ্র আদি নানা মত উদ্দীপন সব॥
    

বিভাবন

ভাব হাব হেলা হাস শোভা দীপ্তি কান্তি।
মধুরতা উদারতা প্রগল্‌ভতা ক্লান্তি॥
ধৈর্য্য লীলা বিলাস বিচ্ছিত্তি মৌগ্ধ্য ভ্রম।
কিলকিঞ্চিৎ মোট্টায়িত কুট্টুমিত শ্রম॥
বিব্বোক লালিত্য মদ চকিত বিকার।
নানামত অনুভব কত কব আর॥
    

ভাবহাবাদির পরিচয়

চিত্তের প্রথম যেই বিকার সে ভাব।
গলা চক্ষু ভুরূ আদি বিকারেতে হাব॥
বক্ষ কাঁপে বস্ত্র খসে তারে বলি হেলা।
প্রিয়কৃত কর্ম্মচেষ্টা তারে বলি লীলা॥
হাস সেই হাস্যে বলি বৃথা হয় যেই।
পরিচ্ছদ বিনা শোভা মধুরতা সেই॥
শোভা কান্তি দীপ্তি শ্রম ব্যক্ত আছে এই।
শ্রমে অঙ্গ শ্লথ যেই ক্লান্তি হয় সেই॥
রতি বিপরীত আদি সেই সেই প্রগল্‌ভতা।
ক্রোধেও বিনয়বাক্য সেই উদারতা॥
ধৈর্য্য সেই দুঃখেতে প্রেমের নহে হ্রাস।
সাক্ষাতে প্রফুল্ল অঙ্গ সেই সে বিলাস॥
অল্প আভরণে শোভা বিচ্ছিত্তি সে হয়।
বিভ্রম সে ব্যক্ত হৈলে বেশবিপর্য্যয়॥
ক্রন্দনেতে হাস্য আর অভয়েতে ভয়।
অক্রোধেতে ক্রোধ কিলকিঞ্চিৎ সে হয়॥
প্রসঙ্গেতে অঙ্গভঙ্গ সেই মোট্টায়িত।
অঙ্গ ছুলে সুখে ক্রোধ সেই কুট্টমিত॥
বিব্বোক বাঞ্ছিত বস্তু পেয়ে অনাদর।
অঙ্গভঙ্গ ঝনৎকার লালিত্যে সুন্দর॥
লজ্জায় না কহি কার্য্য চেষ্টায় জানায়।
বিকার তাহারে বলে বুঝ অভিপ্রায়॥
জ্ঞানেতে অজ্ঞান সম মৌগ্ধ্য সেই হয়।
চকিত সে ভ্রমরাদি দর্শনেতে ভয়॥
যৌবনাদি অভিমান জন্য মদ হয়।
কেলি তাপ আদি যত কবিগণ কয়॥
কেশ বাস খসে অঙ্গ মোড়া হাই উঠে।
লোমাঞ্চ প্রফুল্ল গদগদি ঘর্ম্ম ছুটে॥
    

সাত্ত্বিক ভাব

  স্তম্ভ হয় ঘর্ম্ম বয় রোমাঞ্চ প্রকাশ।
  বিবর্ণ কম্পন অশ্রু গদগদ ত্রাস॥
  প্রিয় বিনা সুখ যত দুঃখ সে তো হয়।
  প্রিয় পেলে দুঃখে সুখ রাগ তারে কয়॥
    
যৌবন কথন
রসমঞ্জরী
ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর
  যৌবনের চারি ভেদ শুন বিবরণ।
  আগে বয়ঃসন্ধি পরে নবীন যৌবন॥
  সুব্যক্ত যৌবন আর সম্পূর্ণ যৌবন।
  তার পরে বৃদ্ধ ভাব বুঝ বিচক্ষণ॥
  যৌবনের সন্ধিকাল দ্বাদশ বৎসর।
  দশম নিয়মে কন ব্যাস মুনিবর॥


যৌবন পরম ধন          স্ববশ ইন্দ্রিয়গণ
  শিশু বৃদ্ধ দেখি লোক রসকথা কহে না।
বালকের নাহি শুদ্ধি        বৃদ্ধ হৈলে হতবুদ্ধি
  যুবা বিনা রস আর কোনখানে রহে না॥
যুবা সূর্য্য বলবান্         যুবা চন্দ্র দ্যুতিমান্
  যুবা বিনা সংসারের ভার অন্যে বহে না।
কিবা নর কিবা অন্য      যৌবনে সকলে ধন্য
  যৌবন হইলে নষ্ট দেখি দেহ রহে না॥


      নারীর যৌবন বড় দুরন্ত।
      শরীরের মাঝে পোষে বসন্ত॥
      বিনোদ বিনানে বিনায়ে বেণী।
      পুরুষে দংশিতে পোষে সাপিনী॥
      কত কত অলি নয়নে ঘোরে।
      মধুবাক্যে কত কোকিল ঝোরে॥
      মলয় বাতাস শ্বাসেতে বহে।
      সৌরভে সুরভি গৌরব নহে॥
      কমল কানন আননে থাকে।
      বান্ধুলি মধুর অধরে রাখে॥
      দুখানি বিষাণ নিশান রেখে।
      হৃদয়ে মলয় রেখেছে ঢেকে॥
      লোহিত কমল মৃণাল সাথে।
      অভরণে ঢেকে রেখেছে হাতে।
      ত্রিবলী ডোরেতে বেন্ধে অনঙ্গ।
      কটিতটে থুয়ে দেখয়ে রঙ্গ॥
      সম্বরে অম্বর দিয়া কান্তার।
      মদন সদন রস ভাণ্ডার॥
      কিশলয় করি করের ভয়।
      চরণের তলে শরণ লয়॥
      যৌবন মরম না জানে যেবা।
      পণ্ডিত তাহারে বলয়ে কেবা॥
      তপ জপ জ্ঞান দান যে কিছু।
      সকলি যৌবন ধনের পিছু॥
      যৌবন এ তিন অক্ষর লেখ।
      যে জানে মরম উত্তম দেখ॥
      যৌবন মরম যে জানে নাই।
      প্রথম ছাড়িয়া তাহারি ঠাঁই॥
      যদ্যপি যৌবন উদ্যম করে।
      প্রথমের মত গালিয়া মরে॥
      ভারতচন্দ্রের ভারতী যোগ।
      যৌবনেতে কর যৌবন ভোগ॥
    
স্ত্রীজাতি কথন
রসমঞ্জরী
ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর
অতঃপর চারি জাতি বর্ণিব কামিনী।
পদ্মিনী চিত্রিণী আর শঙ্খিনী হস্তিনী॥

পদ্মিনী

  নয়ন কমল    কুঞ্চিত কুন্তল       ঘন কুচস্থল
           মৃদু হাসিনী।
ক্ষুদ্র রন্ধ্র নাসা     মৃদু মন্দ ভাষা  নৃত্য গীতে আশা
           সত্যবাদিনী॥
দেবদ্বিজে ভক্তি    পতি আনুরক্তি      অল্প রতিশক্তি
           নিদ্রা ভোগিনী।
মদন আলয়      লোম নাহি হয়      পদ্মগন্ধ কয়
           সেই পদ্মিনী॥
    

চিত্রিণী

প্রমাণ শরীর      সর্ব্ব কর্ম্মে স্থির      নাভি সুগভীর
            মৃদু হাসিনী।
সুকঠিন স্তন      চিকুর চিকন        শয়ন ভোজন
            মধ্য চারিণী॥
তিন রেখা যুত    কণ্ঠ বিভুষিত       হাস্য অবিরত
            মন্দ গামিনী।
মদন আলয়      অল্প লোম হয়       ক্ষারগন্ধ কয়
            সেই চিত্রিণী॥
    

শঙ্খিনী

দীঘল শ্রবণ       দীঘল নয়ন        দীঘল চরণ
            দীঘল পাণি।
মদন আলয়      অল্প লোম হয়       মীনগন্ধ কয়
            শঙ্খিনী জানি॥
    

হস্তিনী

স্থূল কলেবর       স্থূল পয়োধর       স্থূল পদ কর
             ঘোর নাদিনী।
আহার বিস্তর       নিদ্রা ঘোরতর       রমণে প্রখর
             পর গামিনী॥
ধর্ম্মে নাহি ডর      দম্ভ নিরন্তর      কর্ম্মেতে তৎপর
             মিথ্যাবাদিনী।
মদন আলয়       বহু লোম হয়       মদ গন্ধ কয়
             সে হস্তিনী॥
    
পুরুষ জাতি কথন
রসমঞ্জরী
ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর
চারি জাতি নায়িকার শুনহ নায়ক।
শশ মৃগ বৃষ অশ্ব সন্তোষদায়ক॥
পদ্মিনীর শশ পতি মৃগ চিত্রিণীর।
বৃষে শঙ্খিনীর তুষ্টি অশ্বে হস্তিনীর॥
রূপ গুণ দোষ সব নায়িকার মত।
চারি জাতি নায়কেতে লক্ষণ সম্মত॥
রসভাণ্ড মত রসদণ্ড ভেদ হয়।
ছয় আট দশ বার পরিমাণ কয়॥
নর নারী স্বভাবেতে বিশেষ সে হয়।
কহিতে কবিতা বাড়ে ক্ষোভ এই রয়॥