Generated on: Fri Dec 19 2014

Home

::

Show All

::

Show Current

::

Scroll TOC Up| Down

Send a Comment

বিস্তৃত স্মৃতি
কায়কোবাদ
        কৃষ্ণার সৈকতে ক্ষুদ্র শ্যামল প্রান্তরে
        বসি বৃদ্ধ বালানাথ কঁাদিছে নীরবে;
        কত যে বিস্তৃত স্মৃতি হৃদয়ের তলে
        উঠিছে জাগিয়া, ক্রমে মানস নয়নে
        ভাসিছে নৈরাশ্যপূর্ণ বিগত জীবন।
        দূরে রাখালের গান ধেনু রব সনে
        মিশিয়াছে কি সুন্দর ঢালিয়া যতনে
        ভাবময়ী প্রকৃতির অতৃপ্ত মরমে
        অনন্ত কবিত্বপূর্ণ শান্তি-পরিমল।
        অস্তোন্মুখে দিনমণি, বসুধার বুকে
        পড়েছে সায়াহ্ন ছায়া, প্রকৃতি সুন্দরী
        দুই বেশে সুসজ্জিত— চারু ভয়ঙ্কর।
      — একদিকে স্বর্ণকান্তি, অন্য দিকে ঘোর
        কৃষ্ণ বেশ প্রলয়ের পূর্ব নিদর্শন।
        পশ্চিমে অতুল শোভা, সিন্দুরে মন্ডিত
        নভঃস্থল পূর্ব দিক গ্রাসিছে তিমির
        ধূম্রবর্ণ— একাকৃতি গগন ভুতল।
        তাহে কৃষ্ণা ভয়ঙ্করী অতি দীর্ঘকায়
        মিশিয়াছে সেই সনে, আরো ভয়ঙ্কর।
        বালানাথ ক্ষুণ্ণ প্রাণে বসিয়া নীরবে
        কত যে কঁাদিলা স্মরি অতীত জীবন
        কাতরে করুণ কন্ঠে কহিলা কঁাদিয়া,
      "দয়াময়, অভাগারে কেন নিরদয়?
        যে নাম স্মরিয়া নাথ কত যে পতিত
        লভিল উদ্ধার, হায় সে নাম স্মরিয়া
        ভাসিবে কি এ অভাগা নয়নের জলে?
        তুমি ত সকলি জান ওহে দয়াময়,
        এ জীবনে ভ্রমেও যে করিনি কখন
        পাপ পথে বিচরণ, তবু কেন নাথ,
        অভাগার শিরে হেন অশনি সম্পাত?
        জীবনের ধ্রুবতারা, নয়নের মণি
        স্নেহের দুহিতা সেই হিরণ আমার
        শৈশবেই মাতৃহীনা, কত যে যন্ত্রণা
        ভুগিয়াছে অভাগিনী শৈশব জীবনে
        মাতৃ অনুরোধে তার মারাঠা গুরুর
        যোগাশ্রমে, শৈশবেই দিয়াছিনু সঁপে
        ভৈরবীর হাতে তারে, ভ্মব্রহ্মচর্য ব্রত
        দিতে শিক্ষা, সেই হতে আছে সে সেখানে।
        স্নেহের লবঙ্গলতা ভগিনেয়ী মম
        ত্যাজিয়াছে প্রাণ এই তটিনীর জলে?
        দুঃখিনী জননী তার প্রতি অত্যাচারে
        রোষে ক্ষোভে আত্মহত্যা করিয়াছে হায়
        কঁাদাইতে বৃদ্ধ কালে এই অভাগারে। 
        কি কুক্ষণে অলকারে দেখিয়া রঘুজী
        ভুলেছিল রূপে তার, পতঙ্গের মৎ
        ঝম্প দিয়া রাক্ষসীর গুপ্ত প্রেমানলে
        মজিল আপনি, হায় মজাল সংসার।
        হতভাগ্য না মজিলে অলকার প্রেমে
        মরিত কি ভার্যা তার? তটিনীর জলে
        মরিত কি মাতৃহীনা লবঙ্গ আমার?
        এত জ্বালা দয়াময় সহিব কেমনে?
        নিরুদ্দেশ এক মাত্র জ্যেষ্ঠ সহোদর
        শান্তজী, কে জানে আজ মৃত কি জীবিত?
        দীনা হীনা ভার্যা তার পুত্রকন্যা সনে
        স্বামীর বিচ্ছেদে, গেলা তীর্থ পর্যটনে
        ভগ্ন হৃদে, এ জনমে ফিরিল না আর।



        অভাগার একমাত্র পুত্র প্রিয়তম
        শম্ভুজী, অদৃষ্ট দোষে সেও নিরুদ্দেশ
        সেই সনে, বঁেচে আর আছে কি জীবনে?
        কত দেশ, কত তীর্থ কাননে প্রান্তরে
        কত লোক পাঠাইনু, এ জীবনে হায়,
        কোন স্থান কোন তত্ত্ব মিলিল না আর
        রোগে শোকে ক্লিষ্ট আমি, এ ভুজ দুর্বল
        কেমনে ধরিব অসি এ মহা সমরে?
        পুত্র ভার্যা শোকে আমি উন্মাদের প্রায়,
        কে বোঝে তা? সকলেই সমর উল্লাসে
        উল্লসিত, সুসজ্জিত সংগ্রামের তরে।
        শান্তি যে কি, মহারত্ন মানব জীবন
        কেমনে বুঝিবে তাহা মোস্লেম বর্বর?
        তাহারাই এ ভারতে অনর্থের মূল
        সসৈন্যে প্রেরিত দত্ত মোস্লেম সংগ্রামে
        কে জানে কি আছে ভাগ্যে জয় পরাজয়?"
        বৃদ্ধের হৃদয়ে জল বুদ্বুদের মত
        কত কথা কত ভাব উঠিছে মিশিছে
        পলে, পলে, হৃদয়ে অশান্তি বশতঃ
        জাগিয়াও বৃদ্ধ যেন দেখিছে স্বপন;—
        একটি সুবর্ণ রথে করি আরোহণ
        বহু দূর, শূন্য পথে ত্রিদিবের দ্বারে
        উপনীত, পাপপূর্ণ সংসারের মত
        নাহি সেথা কোলাহল যন্ত্রণা ভীষণ?
        হেন কালে মাঝি এক বসিয়া আনন্দে
        অদূরে সৈকত পার্শ্বে তরণীর’পরে
        গাইল সংগীত এক অতি সুমধুর—


        দে জল দে জল বলি, কেনরে কঁাদিস তুই
                ওরে বোকা পাখি।
        কে তোরে দিবেরে জল এ যে মহামরু-স্থল,
                এখানে সকলি হায় ফঁাকি।


        ভাঙ্গিল বৃদ্ধের মোহ শুনিলা নীরবে
        সে সুধা-সঙ্গীত সুরে করিয়া কম্পিত
        নৈশ প্রকৃতিরে, মাঝি গাইছে উল্লাসে।


        দে জল দে জল বলি, কেনরে কঁাদিস তুই
                ওরে বোকা পাখি।
        কে তোরে দিবেরে জল, এ যে মহামরু-স্থল,
                এখানে সকলি হায় ফঁাকি।
                ওরে বোকা পাখি।



        কি সুধা ঢালিস্‌ তুই ও করুণ স্বরে।
        কি যেন হারানো কথা, প্রাণের লুকানো ব্যথা,
                জেগে উঠে আমার অন্তরে।
                পাখিরে!—



        শুনিলে সে শোকগাথা, প্রাণে উঠে কত কথা,
                তুই কি বুঝিবি পাখি
                এ হৃদি যা করে?
                পাখিরে!
        বনের বিহগ তুই,
                থাকিস্‌ সতত ঘোর বনে।
        তুই কি বুঝিবি পাখি, কত দুঃখ কত ব্যথা
        আমার এ মনে?
        পাখিরে!—
        আমারি মতই তুই আশাভগ্নে, অর্ধমৃত প্রায়।
        আমারি মতন তুই, গৃহত্যাগী বনবাসী হায়!
        আমারি মতন তোর, কেঁদে কেঁদে গেল দুটি আঁখি,
        তাই কি আকুল প্রাণে, লুকায়ে বিজন বনে,
                কঁাদিস্‌ সতত তুই পাখি।
                পাখিরে!—
        আপন বলিতে তোর, বুঝি এ ধরণী তলে,
                নাই আর কেহ!
        ভিজিলে বৃষ্টির জলে, সূের্যর কিরণ তলে,
                মাথাটি রাখিতে নাহি গেহ!
        দে জল দে জল বলি, তাই কঁাদিস তুই
                আকুল পরাণে!
        কে তোরে দিবেরে জল, এ যে মহামরু-স্থল,
                জল তুই পাইবি কেমনে?
        সঙ্গীতের প্রতি শব্দে, প্রত্যেক উচ্ছ্বাসে
        ঝরিতে লাগিল যেন মুক্তা রাশি রাশি
        আঁধার তটিনী গর্ভে সৈকত প্রান্তরে,
        নৈশ প্রকৃতির মুগ্ধ অতৃপ্ত হৃদয়ে।
        নীরবে সে বালানাথ বসিয়া সৈকতে
        দেখিলা কৃষ্ণার জলে নৈশ অন্ধকারে
        নিস্তব্ধ তরণী’পরে অসংখ্য প্রদীপ
        জ্বলিতেছে, প্রতিবিম্ব সলিল দর্পণে
        শোভিছে কি মনোহর স্বর্ণ-রেখা প্রায়
        সারি সারি, কেঁপে কেঁপে হিল্লোলে হিল্লোলে।
    
বঙ্গবাণী
আবদুল হাকিম
        কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস।
        সে সবে কহিল মোতে মনে হবিলাষ॥
        তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।
        নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন॥
        আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।
        দেশী ভাষা বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ॥
        আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত।
        যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত॥
        যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ।
        সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন॥
        সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
        বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী॥
        মারফত ভেদে যার নাহিক গমন।
        হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ॥
        যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
        সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি॥
        দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
        নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়॥
        মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
        দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি॥
    

Footnotes:

ছিফত: গুণ

নিরঞ্জন: নির্মল (তবে এখানে স্রষ্টা, আল্লাহ)

মারফত: মরমী সাধনা, আল্লাহকে সম্যকভাবে জানার জন্য সাধনা

জুয়ায়: যোগায়

ছন্দ হিল্লোল
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
        মেঘলা থম্‌ থম্‌ সূর্য-ইন্দু
        ডুবল বাদ্‌লায় দুল্‌ল সিন্ধু!
        হেম-কদম্বে তৃণ-স্তম্বে
        ফুট্‌ল হর্ষের অশ্রু বিন্দু!

                    মৌন নৃত্যে মগ্ন খঞ্জন,
                    মেঘ-সমুদ্রে চল্‌ছে মন্থন!
                    দগ্ধ-দৃষ্টি বিশ্ব-সৃষ্টির
                    মুগ্ধ নেত্রে স্নিগ্ধ অঞ্জন!

        গ্রীষ্ম নিঃশেষ! জাগছে আশ্বাস।
        লাগছে গায় কার গৈরী নিঃশাস!
        চিত্ত-নন্দন দৈবী চন্দন
        ঝরছে, বিশ্বের ভাস্‌ছে দিশ্‌পাশ।

                    ভাস্‌ছে বিলখাল ভাস্‌ছে বিলকুল্‌!
                    ঝাপ্‌সা ঝাপ্‌টায় হাস্‌ছে জুঁই ফুল!
                    ধান্য শীষ্‌ তার কর্‌ছে বিস্তার—
                    তলিয়ে বন্যায় জাগ্‌ছে জুল্‌জুল!

        সান্দ্র বর্ষণ হর্ষ কল্লোল!
        ঝিল্লী-গুঞ্জন মঞ্জু হিল্লোল!
        মূর্চ্ছে বীণ্‌ আর মূর্চ্ছে বীণ্‌কার—
        মূর্চ্ছে বর্ষার ছন্দ-হিল্লোল!
   
হায় আমি কি করিলাম
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
        হায়, আমি কি করিলাম এত দিন।
        দিন যত গত তত, দিন দিন দিন॥
বৃথায় হইল জনু,         বৃথায় হয়েছি মনু,
        অতনু-শাসনে তনু তনু অনুদিন।
ভাবে নাহি ভাবি ভাবি,   কার ভাবে মিছা ভাবি,
       না ভাবিয়া ভবভাবী, ভেবে হই ক্ষীণ॥
আমার ভাবিয়া সার,      হারাইয়া সর্বসার,
       কত বা গণিব আর এই দুই তিন।
সহজ আমার ভাই,        সহজে না দেখা পাই,
       জলে থেকে পিপাসায় মরে যথা মীন॥

সহজে যেরূপ কই,       সহজে সেরূপ নই,
       মিছা করি হইহই হয়ে বোধহীন।
নাহি হয় অনুভব,        এ দেহ হইলে শব,
       কোথা ভব, কোথা রব, কোথা হব লীন॥
প্রবৃত্তির অনুরোধ,	       মাতিয়া বিষম ক্রোধে,
       এখন আপন বোধে হতেছি প্রবীণ।
কাল-করী-হরি, হরি,      হরিনাম পরিহরি,
       বৃথা কেন কাল হরি হয়ে পরাধীন।
ডাকে প্রভাকর—কর,      কোথা প্রভাকর—কর,
       প্রকাশিয়া প্রভাকর শুভদিন দিন॥
    
জন্মভূমি
গোবিন্দচন্দ্র দাস
        জননী গো জন্মভূমি তোমারি পবন
        দিতেছে জীবন মোরে নিশ্বাসে নিশ্বাসে!
        সুন্দর শশাঙ্কমুখ, উজ্জ্বল তপন,
        হেরেছি প্রথমে আমি তোমারি আকাশে।
        ত্যাজিয়ে মায়ের কোল, তোমারি কোলেতে
        শিখিয়াছি ধূলি-খেলা, তোমারি ধূলিতে।

        তোমারি শ্যামল ক্ষেত্র অন্ন করি দান
        শৈশবের দেহ মোর করেছে বর্ধিত।
        তোমারি তড়াগ মোর রাখিয়াছে প্রাণ,
        দিয়ে বারি, জননীর স্তন্যের সহিত।
        জননীর করাঙ্গুলি করিয়া ধারণ,
        শিখেছি তোমারি বক্ষে বাড়াতে চরণ। 

        তোমারি তরুর তলে কুড়ায়েছি ফল,
        তোমারি লতার ফুলে গাঁথিয়াছি মালা।
        সঙ্গীদের সঙ্গে সুখে করি কোলাহল,
        তোমারি প্রান্তরে আসি করিয়াছি খেলা।
        তোমারি মাটিতে ধরি জনকের কর,
        শিখেছি লিখিতে আমি প্রথম অক্ষর।

        ত্যাজিয়া তোমার কোল যৌবনে এখন,
        হেরিলাম কত দেশ কত সৌধমালা।
        কিন্তু তৃপ্ত না হইল এ দগ্ধ নয়ন,
        ফিরিয়া দেখিতে চাহে তব পর্ণশালা।
        তোমার প্রান্তর নদী, পথ, সরোবর,
        অন্তরে উদিয়া মোর জুড়ায় অন্তর।

        তোমাতে আমার পিতা পিতামহগণ,
        জন্মেছিল একদিন আমারই মতন।
        তোমারি এ বায়ু তাপে তাঁহাদের দেহ
        পুষেছিলে, পুষিতেছ আমায় যেমন।
        জন্মভূমি জননী আমার যথা তুমি,
        তাঁহাদেরও সেইরূপ তুমি—মাতৃভূমি।  

        তোমারি ক্রোড়েতে মোর পিতামহগণ
        নিদ্রিত আছেন সুখে জীবলীলা-শেষে
        তাঁদের শোণিত, অস্থি সকলি এখন
        তোমার দেহের সঙ্গে গিয়েছে মা মিশে। 
        তোমার ধূলিতে গড়া এ দেহ আমার
        তোমার ধূলিতে কালে মিশাবে আবার।
    
মেঘনা
নবীনচন্দ্র সেন
অমন করিয়া কেন বহিয়া না যায় রে 
                      মানব জীবন?
অমনি চাঁদনি তলে, অমনি নীলাভ জলে,
অমনি মধুর স্রোতে সংগীত মতন,
বহিয়া না যায় কেন মানব জীবন?
বাসন্তী চন্দ্রিমা মাখা চারু নীলাম্বর
                       মধুরে কেমন
মিশিয়াছ অন্য তীরে, মিশিয়াছ নীল নীরে
বঙ্কিম রেখায়; কেন মিশে না তেমন
অনন্তের সহ এই মানব জীবন?
                        মানব জীবনে
এত আশা ভালবাসা, এতই নিরাশা
                      এত দুঃখ কেন?
প্রেমের প্রবাহ হায়! কেন না বহিয়া যায়
এমন মধুরে, কেন আকাঙ্ক্ষা স্বপন,
নাহি হায় হায়! শান্ত মধুর এমন!
    
রসূলের অন্তিম শয্যা
সৈয়দ সুলতান
        আজ্রাইল মহামতি                আইল বায়ুর গতি
                        রসূলের পুরীর দুয়ারে।
        রসূলের নাম ধরি                ডাকি কহে ভক্তি করি
                        আজ্ঞা মাগে যাইতে অন্তঃপুরে॥
        পএগাম্বরে ফাতেমারে                কহিলেন্ত দেখিবারে
                        দ্বারেতে আসিছে কোন জন।
        কি কারণে অন্তঃপুরে                ডাকি কহে আসিবারে
                        বুঝ গিয়া তার বিবরণ॥
        রসূলের আজ্ঞা পাই                ফাতেমা গেলেন্ত ধাই
                        দেখিলা আরব একজন।
        বিবি ফাতেমারে দেখি                সততার চরিত্র লখি
                        সালাম করিলা সেইক্ষণ॥
        আরবের দেখি মুখ                জন্মিল অধিক দুখ
                        ভএ ভীত মনে বাসি ডর।
        হৈয়া অতি কম্পমান                বিচলিত হৈল জ্ঞান
                        সালামের দিলা প্রত্যুত্তর॥
        বোলে আজ্ঞা দেও মোরে                দেখিবারে রসূলেরে
                        পুরী-মধ্যে করিতে প্রবেশ।
        বলিলেন্ত ফাতিমাএ                যাইতে তুমি না জুয়াএ
                        রসূলের অসুখ বিশেষ॥
        তবে ফাতেমাএ যাই                কহিল বাপের ঠাঁই
                        আরব আসিছে একজন।
        আজ্ঞা মাগে আসিবারে                তোমা দেখা করিবারে
                        কহিতে ত তোমাতে বচন॥ 
        শুনি দুহিতার বাণী                নিজ মনে অনুমানি
                        রসূল কহিল ফাতেমারে।
        সদাএ তোমার প্রতি                মোহর গৌরব অতি
                        তোমার যে গৌরব মোহরে॥
        মোহর যে প্রাণের প্রাণ                তুমি বিনে নাহি আন
                        তুমি মোর আঁখির পুতলি।
        মোর চিত্ত বৃক্ষফল                তুমি গন্ধ সুশীতল
                        হৃদয় লতার তুমি কলি॥
        যে জন আসিছে দ্বারে                আরব না বল তারে
                        এহি জন মৃত্যু অধিপতি।
        বাপ রাখি পুত্র নিব                বাপের সন্তাপ দিব
                        পুত্র থুইয়া বাপ নিব হরি॥
        তোমার বাপের জীব                যে জনে হরিয়া নিব
                        হত পিতা করিব তোমারে।
        আসব্বা সভানেরে                রাখি অনাথ পএগাম্বরে
                        বিধবা করিব আয়শারে॥
        হাছন হোছেন দুই                অন-মাতামহ হই
                        রহিবেন্ত যাহার কারণ।
        সেই জন আসিয়াছে                আসিব মোহর কাছে
                        হরি নিব মোহর জীবন।
        বাপ মাএ ত থুই                পুত্র কৈন্যা লৈয়া যাএ
                        বাপেরে মাএরে দিয়া শোক।
        যে হস্তে ভাইরে ভিন্ন                যে করএ অনুদিন
                        যে হরি লৈ যাএ উপভোগ॥
        নারীকে বিধবা করি                পতিক লৈ যাএ হরি
                        পতি রাখি লৈ যাএ যুবতী।
        মিত্র হন্তে মিত্র নিয়া                মিত্রেরে সন্তাপ দিয়া
                        গৌরব না রাখে কনে প্রতি॥
        শুনহ ফাতেমা সুতা                যে জনে কহিল কথা
                        তোমা সনে আরবের ভেস।
        যারে দেখি পাইলা ভয়                সে লোক আরব নয়
                        সেই মৃত্যুপতি সর্ব দেশ॥
        এহি আজ্রাইল নাম                আসিয়াছে মোর ধাম
                        জীব মোর হরিতে কারণ।
        তুমি তথা যাও চলি                দ্বারে গিয়া দেও মেলি
                        বোল গিয়া আসিতে কারণ॥
        ফাতেমা দ্বারেতে গেলা                কপাট মেলিয়া দিলা
                        প্রবেশ করিলা আজ্রাইল।
        রসূলের আগে আসি                মনেত গৌরব বাসি
                        ভক্তিভাবে সালাম করিল॥
        রসূলে বলিল ভাই                কহ দেখি মোর ঠঁাই
                        কি কারণে করিছ পএয়ান।
        ভোলাইতে তুমি মোরে                আসিয়াছ মোর ঘরে
                        নয়তু কিবা কাড়িতে জীবন॥
        রসূলের বাক্য শুনি                কহিলা আজ্রাইল পুনি
                        আজ্ঞা দিছে প্রভু করতার।
        যদি আজ্ঞা কর তুমি                প্রাণ কাড়িবারে আমি
                        আসিয়াছি গোচরে তোমার॥
        এত শুনি পএগাম্বর                লাগিলেন্ত কহিবার
                        শোন আজ্রাইল মহাশএ।
        যদি মোরে কৃপা কর                মোর এক বোল ধর
                        মোর প্রতি হইয়া সদএ॥
        জিজ্ঞাসিল দূতবরে                কি আজ্ঞা করিবা মোরে
                        কহ যে রসূল মহামতি।
        ধরিমু তোমার বোল                হইমু দাসের তুল
                        আজ্ঞা না লঙঘিমু জান অতি॥
        রসূলে বলিয়া ভাই                কহি যে তোমার ঠঁাই
                        জিবরিল যাবৎ আইসএ।
        তাবৎ পরাণ মোর                দেহতে না কর দূর
                        আইলে প্রাণ কাড়িএ নিশ্চএ॥
        ভাই জিবরিলের মুখ                দেখিয়া খন্ডিএ দুখ
                        অন্য ২ সালাম করিমু।
        দোহান নির্জনে বসি                এক দুই কথা কহি
                        অবিনাশ পুরেত যাইমু॥
    
পলাশীর যুদ্ধ
নবীনচন্দ্র সেন
                    ১
        বৃটিশের রণবাদ্য বাজিল অমনি
                কাঁপাইয়া রণস্থল,
                কাঁপাইয়া গঙ্গাজল,
        ঝাঁপাইয়া আম্রবন উঠিল সে ধ্বনি।


                    ২
        নাচিল, সৈনিক-রক্ত ধমনী-ভিতরে,
                মাতৃক্রোড়ে শিশুগণ,
                করিলেক আস্ফালন,
        উৎসাহে বসিল রোগী শয্যার উপরে।
  

                    ৩
        নিনাদে সমর-রঙ্গে নবাবের ঢোল,
                ভীম রবে দিগঙ্গন
                কাঁপাইয়া ঘন ঘন,
        উঠিল অম্বর-পথে করি ঘোর রোল।
      
    

                    ৪
        ভীষণ মিশ্রিত ধ্বনি করিয়া শ্রবণ,
                কৃষক লাঙ্গল ধরে
                দ্বিজ কোষাকুষি করে
        দাঁড়াইয়া বজ্রাহত পথিক যেমন॥
      
    

                    ৫
        অর্ধ-নিষ্কোষিত করি যোদ্ধৃগণ,
                বারেক গগন প্রতি,
                বারেক মা বসুমতি
        নিরখিল, যেন এই জন্মের মতন।
      

                    ৬
        বেগমতী স্রোতস্বতী ভৈরব গর্জনে,
                সলিল সঞ্চয় করি,
                যায় ভীম বেগ ধরি,
        প্রতিকূল শৈল প্রতি তড়িত-গমনে।
      
    
                    ৭
        অথবা ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্র, কুরঙ্গ কাননে
                করে যদি দরশন,
                দলি গুল্ম-লতা-বন,
        তীরবৎ ছুটে বেগে মৃগ-আক্রমণে।
      

                    ৮
        তেমনি নবাব-সৈন্য বীর অনুপম,
                আম্রবন লক্ষ্য করি,
                এক স্রোতে অস্ত্র ধরি,
        ছুটিল সকলে যেন কালান্তক যম।
      

                    ৯
        অকস্মাৎ একেবারে শতেক কামান
                করিল অনলবৃষ্টি
                ভীষণ সংহার দৃষ্টি।
        কত শ্বেত যোদ্ধা তাহে হল তিরোধান।
      

                    ১০
        অস্ত্রাঘাতে সুপ্তোথিত শার্দুলের প্রায়
                ক্লাইভ নির্দয়-মন,
                করি রশ্মি আক্রষণ,
        আসিল তুরঙ্গোপরে রক্ষিতে সেনায়।
      

                    ১১
      "সম্মুখে-সম্মুখে"!—বলি সরোষে গর্জিয়া
                করে অসি তীক্ষ্ন-ধার,
                বৃটিশের পুনর্বার,
        নির্বাপিত-প্রায় বীর্য উঠিল জ্বলিয়া।
      

                    ১২
        ইংরাজের বজ্রনাদী কামানসকল,
                গম্ভীর গর্জন করি,
                নাশিতে সম্মুখ অরি,
        মুহূর্তেকে উগরিল কালান্ত-অনল।
      

                    ১৩
        বিনা মেঘে বজ্রপাতে চাষা মনে গণি,
                ভয়ে সশঙ্কিত প্রাণে,
                চাহিল আকাশ পানে;
        ঝরিল কামিনী-কক্ষ-কলসী অমনি।
      

                    ১৪
        পাখিগণ সশঙ্কিত করি কলরব,
                পলিশ কুলায়ে ডরে।
                গাভীগণ ছুটে ডরে;
        বেগে গৃহদ্বারে গিয়ে হাঁফাল নীরবে।
      
    
                    ১৫
        আবার, আবার, সেই কামান-গর্জন।
                উগরিল ধুমরাশি
                আঁধারিল দশ দিশি!
        বাজিল বৃটিশ-বাদ্য জলদ-নিস্বন।
      

                    ১৬
        আবার, আবার, সেই কামান গর্জন
                কাঁপাইয়া ধরাতল,
                বিদারিয়া রণস্থল,
        উঠিল যে ভীম রব, ফাটিল গগন।
  

                    ১৭
        সেই ভীম রবে মাতি ক্লাইভের সেনা,
                ধূমে আবরিত দেহ,
                কেহ অশ্বে, পদে কেহ,
        গেল শত্রু-মাঝে, অস্ত্রে বাজিল ঝঞ্জনা।
      

                    ১৮
        খেলিছে বিদ্যুৎ একি ধাঁধিয়া নয়ন
                শতে শতে তরবার
                ঘুরিতেছে অনিবার
        রবিকরে প্রতিবিম্ব করি প্রদর্শন।
      

                    ১৯
        ছুটিল একটি গোলা রক্তিম বরণ
                বিষম বাজিল পায়ে,
                সেই সাংঘাতিক ঘায়ে
        ভূতলে হইল মিরমদন পতন।
      

                    ২০
      "হুর্‌রে হুর্‌রে"—করি গর্জিল ইংরাজ
                নবাবের সৈন্যগণ
                ভয়ে ভঙ্গ দিল রণ,
        পলাতে লাগিল সবে, নাহি সহে ব্যাজ।
      

                    ২১
      "দাঁড়া রে! দাঁড়া রে ফিরে! দাঁড়া এইক্ষণ
                দাঁড়াও ক্ষত্রিয়গণ!
                যদি ভঙ্গ দেও রণ,"—
        গর্জিলা মোহনলাল,—"নিকটে শমন"। 
      

                    ২২
      "আজি এই রণে যদি কর পলায়ন,
                মনেতে জানিও স্থির,
                কারো না থাকিবে শির,
        সবান্ধবে যাবে সবে শমন-ভবন।"
      
    
                    ২৩
      "সেনাপতি! ছিঃ ছিঃ এ কি! হা ধিক্‌ তোমারে
                কেমনে বল না হায়!
                কাষ্ঠের পুতুল-প্রায়,
        সসজ্জিত দাঁড়াইয়া আছে এক ধারে?"
  

                    ২৪
      "ওই দেখ, ওই যেন চিত্রিত প্রাচীর।
                ওই তব সৈন্যগণ
                দাঁড়াইয়া অকারণ।
        গণিতেছে লহরী কি রণ-পয়োধির?"
      

                    ২৫
      "দেখিছ না সর্বনাশ সম্মুখে তোমার?
                যায় বঙ্গ-সিংহাসন,
                যায় স্বাধীনতা-ধন
        যেতেছে ভাসিয়া সব, কি দেখিছ আর?"
      

                    ২৬
      "মূর্খ তুমি!—মাই কাটি লভি কোহিনুর,
                ফেলিয়ে সে রত্ন হায়!
                কে ঘরে ফিরিয়া যায়,
        বিনিময়ে অঙ্গে মাটি মাখিয়া প্রচুর?"
      

                    ২৭
        সামান্য বণিক এই শত্রুগণ নয়।
                দেখিবে তাদের হায়!
                রাজা রাজ্য ব্যবসায়;
        বিপণি সমর-ক্ষেত্র, অস্ত্র বিনিময়।
  

                    ২৮
      "নিশ্চয় জানিও রণে হলে পরাজয়,
                দাসত্ব-শৃংখল-ভার
                ঘুচিবে না জন্মে আর,
        অধীনতা-বিষে হবে জীবন সংশয়।"
  

                    ২৯
      "অধীনতা, অপমান সহি অনিবার,
                কেমনে রাখিব প্রাণ,
                নাহি পাবে পরিত্রাণ,
        জ্বলিবে জ্বলিবে বুক, হইবে অঙ্গার।"
  

                    ৩০
      "সহস্র গৃধিনী যদি শতেক বৎসর,
                হৃৎপিণ্ড বিদারিত
                করে অনিবার, প্রীত,
        বরঞ্চ হইব তাহে, তবু হা ঈশ্বর।"
    
তপসে মাছ
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
কষিত-কনককান্তি কমনীয় কায়।
গালভরা গোঁফ-দাড়ি তপস্বীর প্রায়॥
মানুষের দৃশ্য নও বাস কর নীরে।
মোহন মণির প্রভা ননীর শরীরে॥
পাখি নও কিন্তু ধর মনোহর পাখা।
সমধুর মিষ্ট রস সব-অঙ্গে মাখা॥
একবার রসনায় যে পেয়েছে তার।
আর কিছু মুখে নাহি ভাল লাগে তার॥
দৃশ্য মাত্র সর্বগাত্র প্রফুল্লিত হয়।
সৌরভে আমোদ করে ত্রিভুবনময়॥
প্রাণে নাহি দেরি সয় কাঁটা আঁশ বাছা।
ইচ্ছা করে একেবারে গালে দিই কাঁচা॥
অপরূপ হেরে রূপ পুত্রশোক হরে।
মুখে দেওয়া দূরে থাক গন্ধে পেট ভরে॥
কুড়ি দরে কিনে লই দেখে তাজা তাজা।
টপাটপ খেয়ে ফেলি ছাঁকাতেলে ভাজা॥
না করে উদর যেই তোমায় গ্রহণ।
বৃথায় জীবন তার বৃথায় জীবন॥
নগরের লোক সব এই কয় মাস।
তোমার কৃপায় করে মহা সুখে বাস॥