আবার আসিব ফিরে
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে— এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়— হয়তো বা শাঁখচিল শালিকের বেশে, হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়। হয়তো বা হাঁস কোনো— কিশোরীর— ঘুঙুর রহিবে লাল পায় সারাদিন কেটে যাবে কল্মীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে। আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে জলঙ্গীর ঢেউএ ভেজা বাঙ্লারই সবুজ করুণ ডাঙ্গায়। হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে। হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে। হয়তো খৈয়ের ধান সরাতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে। রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে দেখিবে ধবল বক; আমারে পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।
অদ্ভুত আঁধার এক
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা; যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই- প্রীতি নাই- করুণার আলোড়ন নেই পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া। যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয় মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
বনলতা সেন
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে সিংহল সমুদ্র থেকে আরো দূর অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি। বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি। আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য। অতিদূর সমুদ্রের’পর হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা, সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর, তেমনই দেখেছি তারে অন্ধকারে। বলেছে সে"এতোদিন কোথায় ছিলেন?" পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে চাওয়া নাটোরের বনলতা সেন। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে। ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল। পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন, তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল। সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী। ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন। থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
অমলকান্তি
অমলকান্তি আমার বন্ধু, ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম। রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারতো না, শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের। আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল। অমলকান্তি সে সব কিছু হতে চায়নি। সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল! ক্ষান্তবর্ষণে কাক ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর, জাম আর জামফলের পাতায় যা নাকি অল্প একটু হাসির মতন লেগে থাকে। আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে। মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, চা খায়, এটা ওটা গল্প করে, তারপর বলে, ‘উঠি তাহলে’। আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে, অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত, যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল, উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না। অথচ সকলেরি ইচ্ছাপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। সেই অমলকান্তি, রোদ্দুরের কথা ভাবতে ভাবতে যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।।
যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব
ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভাল এত কালো মেখেছি দু হাতে এত কাল ধরে। কখনো তোমার করে, তোমাকে ভাবিনি। এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে চাঁদ্ ডাকে আয়, আয়, আয়। এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে চিতা কাঠ ডাকে আয়, আয়, আয়। যেতে পারি, যেকোনো দিকেই আমি চলে যেতে পারি কিন্তু, কেন যাবো? সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো যাবো কিন্তু, এখনি যাবো না তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবো একাকী যাবো না অসময়ে।