প্রাচীনকালে সভ্যতা, সৌন্দর্য ও শিক্ষার বিচিত্র লীলাভূমি ও কীর্তি মন্দির বলিয়া যে সমস্ত মহানগরী খ্যাতিলাভ করিয়াছিল, তন্মধ্যে গৌরবোন্নত, সৌন্দর্য-সমালঙ্কৃত, সমৃদ্ধিসম্পন্ন স্পেনের কর্ডোভা মহানগরী অন্যতম। বোগদাদ ব্যতীত কর্ডোভা মহানগরীর সহিত অপর কোনও নগরীর নামও উল্লেখিত হইবার যোগ্য নহে। স্পেনকে পরী বলিয়া কল্পনা করিলে কর্ডোভাকে তাহার চক্ষু বলিয়া স্থান দিতে হয়। প্রাচীন আরব ঐতিহাসিকগণ কর্ডোভাকে স্পেনের পাত্রী বা কনে (Bride) বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। গৌরবের দিনে কর্ডোভার ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্য, শিক্ষা ও সভ্যতা, শিল্প ও বাণিজ্য, সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য, আমোদ-প্রমোদ ও বিলাস-উল্লাস, একত্র পুঞ্জীভূত হইয়া ইহাকে কবি-চিত্ত-সম্মোহন কল্পনাতীত সুন্দরী ও সুখময়ী করিয়া তুলিয়াছিল। পৃথিবীর নানা দিগদেশের ভ্রমণকারিগণ কৌতূহলাক্রান্তচিত্তে কর্ডোভার বিশ্ব-বিশ্রুত সৌন্দর্য-গরিমায় মুগ্ধ হইয়া তদ্দর্শনার্থে আগমন করিতেন এবং বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে ইহার গঠন-সৌন্দর্য, পরিচ্ছন্নতা, সুখশান্তি এবং বিপুল ঐশ্বর্যচ্ছটায় স্তম্ভিত হইয়া মুক্তকণ্ঠে ইহার প্রশংসা কীর্তনে আপনাদিগকে চরিতার্থ মনে করিতেন।

মুসলমান-স্পেনের কর্ডোভা নগরী হইতে যখন সভ্যতার স্বর্গীয় প্লাবন, জ্ঞান-বিদ্যাশিক্ষার উত্তাল তরঙ্গমালা বক্ষে ধারণ করিয়া কুসংস্কার-জঞ্জাল পরিপূর্ণ ইউরোপকে বিপ্লাবিত এবং বিধৌত করিবার জন্য চতুর্দিকে তীব্রবেগে ছুটিয়া পড়িতেছিল, তখন বর্তমান জ্ঞানগর্বিত সভ্যতা-প্রদীপ্ত ইংরাজ, ফরাসী এবং জার্মান জাতির পূর্বপুরুষগণ পর্বতগহবরে এবং গভীর কাননাবাসে বন্য ফল-মূল এবং আম-মাংসে উদরপূর্তি করিয়া আপনাদের বন্যজীবন অতিবাহিত করিত।

নগরী-কুল-সম্রাজ্ঞী কর্ডোভা সুন্দরীর সৌন্দর্যচ্ছটা ও ঐশ্বর্যঘটা, খলিফাদিগের অজস্র অর্থ ব্যয় ও প্রাণগত চেষ্টা, ভাস্কর, কারু ও স্থপতিগণের আশ্চর্য কারূকৌশল ও গঠননৈপুণ্য এবং নাগরিকদের বিলাস-বিভ্রম-প্রিয়তায় বাসন্তী পূর্ণিমার কৌমুদীজাল বিস্নাত-নিসর্গের উন্মুক্ত সৌন্দর্যের স্বর্গীয় লীলাভঙ্গির বিচিত্র পটের ন্যায় প্রতীয়মান হইত। মহানগরী কর্ডোভার তুষার-ধবল-স্নেহমসৃণ মর্মর প্রস্তর-বিনির্মিত কারুকার্য-শোভিত অসংখ্য প্রাসাদ ও সৌধ, নানাজাতীয় সুস্বাদু, সুদৃশ্য ও সুগন্ধ ফলফুলের তরুলতা শোভিত মাধবী-সুষমাসম্পন্ন চিত্তবিনোদন উদ্যানাবলী, সুপ্রশস্ত পরিচ্ছিন্ন প্রস্তরাস্তরণাবৃত-ঋজুরখ্যাবলী, কমলদল-শোভিত সুপেয় স্বচ্ছ পয়োপুরিত প্রস্তর সরোবর সকল, শ্যামতৃণশস্প-মন্ডিত বিস্তৃত ময়দান নাগরিকগণের উৎকৃষ্ট ক্ষৌম পরিচ্ছদ, সদাচার ও সদালাপ, তাহাদিগের শাস্ত্রজ্ঞান এবং শাস্ত্রপটুতা, দিগ্‌বিজয়ী বীরেন্দ্রবৃন্দের অধ্যবসায় ও রণনৈপুণ্য, অধ্যাপক ও পণ্ডিতবর্গের জ্ঞানগর্ভ সমালোচনা, কলেজ ও পাঠশালার অসংখ্য ছাত্রের সহস্র কোলাহল, খরস্রোতা ওয়াদীঅল-কবীদের (গোয়াডেল কুইভার) মর্মর মণ্ডিত তীরে অধিবাসীদিগের সান্ধ্য ভ্রমণ, ময়দানে অশ্ব-ধাবন ও চৌগন-ক্রীড়া (পলো)। অপরাহ্নে এবং জ্যোৎস্না-স্নাত-প্রফুল্ল-যামিনীতে নদীবক্ষে নানা বর্ণের নানা আকারের তরণীমালার অভিযান,পথিক-ভ্রমণকারীদের আশ্রয়-গৃহ, নানা দেশীয় বিলাস-সামগ্রী-সম্ভারপূর্ণ বাজার ও বিপণিসমূহ, বিবিধ উৎকৃষ্ট, গ্রন্থপূর্ণ লাইব্রেরী, অসংখ্য স্নানাগার, নদী-তীরের হাওয়াখানা এবং বুরুজ, স্বর্ণচূড়া রমনীয় মসজিদসমূহ, অভ্রভেদী সুদৃঢ় দুর্গ, বিস্তৃত পরিখা এবং মনোহর রাজপ্রসাদনিচয় ইত্যাদির মনোরম দৃশ্যে ইহা ভুবনমোহিনী নগরীকুল-নারী বলিয়া বিশ্ব-বিশ্রুত খ্যাতিলাভ করিয়াছিল। ফলত, তৎকালের সুসভ্য ও সমুন্নত জাতির নাগরিক জীবনের যাবতীয় আবশ্যকীয় উপকরণ এবং দ্রব্য একত্র সম্মিলিত ও শৃঙ্খলিত হইয়া কর্ডোভাকে ভূস্বর্গে পরিণত করিয়াছিল। কর্ডোভার নাগরিকগণ সুশিক্ষিত এবং সুমার্জিত রুচিসম্পন্ন ছিলেন। কাব্য ও সঙ্গীতালোচনা, ললিতকলা ও সুকুমার বিদ্যাচর্চা সম্ভ্রান্তবর্গের আদরণীয় ছিল।

কর্ডোভা নগরী স্বীয় গৌরবের দিনে জ্ঞানালোচনা এবং শিক্ষার কোলাহলে যেমন মুখরিত তেমনি আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনার মহিমায় শীর্ষস্থানীয় ছিল। নগরীর সৌন্দর্য,পরিপাট্য,ঐশ্বর্য এবং বৈচিত্র্য আশ্চর্যজনক ছিল, ইহার শিক্ষানুরাগ এবং জ্ঞানচর্চার বিপুল আয়োজন ও উপকরণ তদপেক্ষা কোন অংশে ন্যূন ছিল না। বাস্তবিক পক্ষে জগতের সেই দুর্দিনের উদ্ধারকারী’গৌরবের সন্তান’ মুসলমানগণের মধ্যে তৎকালে যে পৃথিবীগ্রাসিনী বিজয়-বাসনা এবং বিশ্বশোষিকা জ্ঞান-পিপাসা পরিদৃষ্ট হইত,তাহা স্পেন সাম্রাজ্যে সম্যকরুপে স্ফূর্তিলাভ করিয়াছিল, বরং কর্ডোভার বিজয়-বাসনা সংযত হইবার পরে জ্ঞানালোচনার আগ্রহ এবং উদ্যম সম্যকরূপে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছিল। কর্ডোভা সমগ্র ইউরোপের জ্ঞান, বিদ্যা ও সভ্যতার কেন্দ্ররুপে পরিণত হইয়াছিল। ইউরোপের সমস্ত রাজ্য হইতে জ্ঞানপিপাসু সহস্র সহস্র ছাত্র,ধীসমৃদ্ধ বিজ্ঞানবিশারদ অধ্যাপকমন্ডলীর নিকট জ্ঞানাহরণার্থ সমবেত হইত। কর্ডোভার বিরাট বিজ্ঞানাগারে ছাত্রমন্ডলীকে যন্ত্রসংযোগে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং রাসায়নিক বিশ্লেষণ শিক্ষা দেওয়া হইত। সাধারণের পাঠের জন্য সপ্তদশটি বিরাট লাইব্রেরী এবং বহুসংখ্যক পাঠসম্মিলনী (ক্লাব) ছিল।এতদ্ব্যতীত প্রত্যেক স্কুল-কলেজ এবং মস্‌জিদে ছাত্রমন্ডলীর এবং উপাসকদিগের পাঠের জন্য বিবিধ প্রয়োজনীয় গ্রন্থাদি রক্ষিত হইত। গৌরবের মাধ্যাহ্নিক কালে বত্রিশটি কলেজ এবং ৫০০ উচ্চশ্রেণীর সুপরিচালিত বিদ্যালয় কর্ডোভাতে বিদ্যমান ছিল। পাঠক মনে রাখিবেন, স্পেনে প্রত্যেক নগরেই স্ব-স্ব বিদ্যালয় এবং কলেজ ও পাঠশালাসমূহ বিদ্যমান ছিল। স্পেনের মহানগরী গ্রানাডাতেও ২০টি সুপরিচালিত কলেজ এবং বহুসংখ্যক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। স্পেনের প্রত্যেক সোলতান এবং আমীর অল্পাধিক পরিমাণে বিদ্যোৎসাহী ও জ্ঞানচর্চালিপ্সু ছিলেন বলিয়া স্পেন সাম্রাজ্য তখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যাহ্ন মিহির-করে উদ্ভাসিত এবং বিশ্বজগতে প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছিল। প্রত্যেক সোলতানই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতেন। রাজ্যের সম্ভ্রান্তবর্গ এবং আমীরগণ সোলতানদিগের অনুসরণে বিরত ছিলেন না। শিক্ষার জন্য ধনাঢ্য ব্যক্তি হইতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যক্তিগণ পর্যন্ত স্ব-স্ব সম্পত্তির অধিকাংশ’ওয়াক্‌ফ’ করিয়া যাইতেন। তৎকালে যে ব্যক্তি বাটিতে ছাত্র’ জায়গীর’ এবং লাইব্রেরী না রাখিতেন, তিনি নিতান্ত অভদ্র এবং অশিক্ষিত বলিয়া সমাজে লাঞ্ছিত হইতেন। খলিফা হাকামের সময় প্রায় তিন লক্ষ ছাত্র এবং ছাত্রী কর্ডোভাতে অধ্যয়ন করিত। ভূগোল শিক্ষার জন্য গোলক (Globe) এবং মানচিত্র ব্যবহৃত হইত। কর্ডোভার’ রসদখানায়’ (মানমন্দিরে) বহুসংখ্যক নতুন যন্ত্র সংগৃহীত এবং নির্মিত হইয়া রক্ষিত হওয়ায় নানা দিগ্‌দেশ হইতে পন্ডিতমন্ডলী আগমন করিয়া জ্যোতির্বিদ্যার আলোচনা এবং নক্ষত্রাদির গতি নির্ধারণ করিতেন। বিদ্যোৎসাহী খলিফা হাকাম প্রভূত অর্থব্যয় করিয়া পৃথিবীর নানা রাজ্য এবং নানা রাজধানী হইতে বহু যত্নে শত শত লোক নিযুক্তি পূর্বক প্রায় ছয় লক্ষ মূল্যবান এবং দূষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রহ করিয়াছিলেন। ইতিপূর্বে পৃথিবীতে এরুপ বিরাট এবং মূল্যবান লাইব্রেরী আর কখনও স্থাপিত হইয়াছিল না।

ঘটিকা-যন্ত্রের দোলক এবং টেলিগ্রামের উদ্ভাবন এখানেই সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয়। এখানেই সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রসংযোগে ৩২ ফুট উর্ধ্ব পর্যন্ত জলরাশি উত্তোলিত হয়। স্ত্রী-শিক্ষা পৃথিবীর মধ্যে সর্বপ্রথম এখানেই বিস্তৃতি এবং উন্নতি লাভ করে। মুরিস আরবগণ সন্তানের শিক্ষার অগ্রে সন্তানের মাতার শিক্ষার আবশ্যকতা পূর্ণভাবে উপলব্ধি করিয়াছিলেন। বালিকা এবং স্ত্রীলোকদিগের জন্য স্বতন্ত্র স্কুল এবং কলেজ বিদ্যমান ছিল। এখানেই মাতৃজাতির মধ্যে সর্বপ্রথম ইউরোপের বোগদাদের ন্যায় কবি, চিকিৎসক, অধ্যাপিকা, আইন-ব্যাখ্যায়িত্রী, ঐতিহাসিক এবং ধাত্রী পরিদৃষ্ট হইত। এখানেই হামেদা, হাফেজা, রোকেয়া, জয়নব, মোরিয়া, সোফিয়া, ফজল প্রমুখ বিদূষী এবং প্রতিভাশালিনী রমণীরত্ন জন্মগ্রহণ করিয়া স্পেনের জ্ঞানচর্চার গৌরব উন্নত এবং মহান করিয়া তুলিয়াছিল। অতীতের এই গরীয়সী মহানগরী কর্ডোভাতেই সমগ্র ইউরোপের মধ্যে সর্বপ্রথমে রমণীগণ জ্ঞানালোচনায় পুরুষদিগের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। এখানেই একদিন বিজ্ঙানাগার এবং রসায়ন শিক্ষার প্রক্রিয়া (Experiment) এবং বিশ্লেষণ লইয়া মুসলমান ছাত্র ও ছাত্রীগণের মধ্যে বাদানুবাদ হইত। হায়! বর্তমানে এই মুসলমান জগতে এ সকল সম্পূর্ণরুপে অপরিজ্ঞাত এবং অদৃষ্ট। সকালে উঠিয়া কর্ডোভার রাজপথগুলিতে দৃষ্টি করিলে দেখা যাইত যে, দলে দলে বালক-বালিকা বিচিত্র বেশভূষায় সজ্জিত হইয়া স্কুল এবং কলেজের দিকে ছুটিয়াছে, ভ্রাতা এবং ভগিনীগণ হাত ধরাধরি করিয়া হাস্যমুখে পাঠগঠিত নানা প্রকারের প্রশ্নোত্তর এবং তর্ক-বিতর্ক করিতে করিতে পাঠশালায় চলিয়াছে। হায়! এই বিশ্বশোষিকা জ্ঞান-পিপাসার অপূর্ব চিত্র আবার কবে মুসলমান জগতে প্রতিভাসিত হইবে।

কর্ডোভাতে চিকিৎসাবিদ্যা আশাতীত উন্নতি লাভ করে। জালিনুসের (Galen) পরে চিকিৎসা-শাস্ত্রের ভৈষজ্যতত্ত্ব, রোগনিদান এবং শরীর-বিদ্যার বিবিধ অজ্ঞাত এবং দুর্জেয় তত্ত্ব এখানে আবিস্কৃত এবং সৃষ্টিকৃত হয়।

একাদশ শতাব্দীর সুপ্রসিদ্ধ ভিষক আবুল কাশেম (Albacasis) এখানেই তাঁহার অস্ত্র-চিকিৎসা আশ্চর্য নৈপুণ্য দেখাইয়াছিলেন। তাঁহার অস্ত্র-চিকিৎসার প্রণালী আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ছিল। ঐতিহাসিকগণ তাঁহার অস্ত্র-চিকিৎসার অনেক আশ্চর্য কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার কিছুদিন পরে জগদ্বিখ্যাত ভিষকাচার্য এব্‌ন জোহর (Avenzoar) প্রাদুর্ভূত হন। তিনি বিবিধ প্রকারের ঔষধ এবং অস্ত্র প্রয়োগের অস্ত্রাদি আবিষ্কার করিয়া গিয়াছেন। প্রসিদ্ধ উদ্ভিদ্‌তত্ত্ববিদ্‌ এব্‌নে বতহের এখানেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি ঔষধসংক্রান্ত গাছ-গাছড়ার পরীক্ষার জন্য এশিয়া এবং আফ্রিকার বহু দেশ পর্যটন করিয়াছিলেন। তিনি ভৈষজ্য ঔষধি সম্বন্ধীয় বিরাট গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছিলেন। সুপ্রসিদ্ধ ইহুদী বংশাবতংশ চিকিৎসক হাসেদাইও এখানে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। ইনি আশ্চর্য চিকিৎসা-কৌশলে নাভেরীর রাণী থিয়েডারীর অসাধারণ স্থুলত্বের লাঘবতা সাধন করেন। প্রসিদ্ধ পন্ডিত এব্‌নে রোস্‌দ (Avenrose) ইউরোপের গৌরবস্তম্ভ। তাঁহার ন্যায় দর্শনশাস্ত্রে প্রতিভা তৎকালে আর কাহারও পরিলক্ষিত হইত না। ইউরোপের আধুনিক দার্শনিকগণ সকলেই এব্‌নে রোস্‌দের নিকট ঋণী। সক্রেটিস এবং অ্যারিস্টটলের দার্শনিক মতের ইনিই জ্ঞানগর্ভ বিস্তৃত সমালোচনা করিয়াছিলেন। ইনি অনেক অস্ফুট দার্শনিক তত্ত্ব পরিস্ফূট এবং জটিল তত্ত্ব সরল করেন। ইহার দার্শনিক মতের উচ্চতা এবং সূক্ষ্মতার জন্য ধর্মান্ধ গোঁড়াগণের মধ্যে অনেক কোলাহল উপস্থিত হইয়াছিল।

আরবী সাহিত্যে এবং ইতিহাস এখানে চরম উন্নতি লাভ করিয়াছিল। শত শত পন্ডিত জন্মগ্রহণ করিয়া অমৃতনিস্যন্দিনী আরবী ভাষায় সাহিত্য এবং ইতিহাস রচনা করিয়া অমরত্ব লাভ করিয়াছিলেন। আমরা বাহুল্যভয়ে ঐতিহাসিক এবং সাহিত্যবিদ পন্ডিতদিগের আলোচনায় বিরত রহিলাম। মুসলমানগণ সর্বত্রই ইতিহাসের চর্চা এবং সেবা চিরকালই করিয়া আসিয়াছেন। অতি সামান্য সামান্য ঘটনা পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে সমালোচিত এবং লিখিত হইত। স্পেনের একখানি ইতিহাস সুবৃহৎ ৭০ খন্ডে রচিত হইয়াছিল। ভূমন্ডলের একাল পর্যন্ত কোনও দেশে এমন বিরাট ইতিহাস বিরচিত হয় নাই।

সংগীত এবং কবিতা কর্ডোভাতে সম্যকরুপে পুষ্টিলাভ করিয়াছিল। পৃথিবীতে সংগীত এবং কবিতার এমন হুড়াহুড়ি ইতিপূর্বে আর কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় নাই। ভৃত্য এবং ক্রীতদাসগণ পর্যন্ত কবিতার আলোচনা করিত। স্পেনের লোক-চমকিত সৌভাগ্যের‘ সময় মধুবর্ষিণী আরব্য ভাষায় যে কবির তরঙ্গ উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা পর্বত সমুদ্র উল্লঙ্ঘন পুরঃসর ইউরোপের নানাদেশে বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল। কোনও কথা বা কোনও উপদেশ কবিতায় আবৃত্তি ব্যতীত শেষ হইত না। কর্ডোভার সর্বত্রই অপরাহ্নে এবং রাত্রিতে সংগীতের মনোমোহিনী রাগিণী ঝংকার শ্রুত হইত। বাদ্যযন্ত্রের মধুর নিক্কণে এবং সংগীতের সুধাবর্ষণে কর্ডোভা পরীরাজ্য বলিয়া বোধ হইত। স্পেন, ইটালী এবং ফ্রান্সের ব্যালড (Ballads) কঞ্জোনেট (Conzonette) ট্রাবাজেয়র্স পান করিতেন; তিনি কদাপি আর কাহারও সংগীত শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করিতেন না। জেরার বীণাতে পঞ্চম তারের সংযোজনা এবং কাচেঁর পানপাত্রের উদ্ভাবন এবং প্রচলন করেন। জেরার প্রত্যহ নূতন ধরনের বসন-ভূষণে সজ্জিত হইতেন; তৎকালে তাঁহার ন্যায়"ফ্যাসান দোরস্ত" ব্যক্তি সমগ্র স্পেনে আর একজনও পরিলক্ষিত হইত না। তাঁহার অমৃতময় সংগীতাবলী তদানীন্তন জগতে দ্রুত বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছিল। ফলত মহানগরী কর্ডোভার সংগীত এবং কবিতা-চর্চা অবর্ণনীয় এবং অপ্রমেয় ছিল।

স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের বিষয় আলোচনা করা অনাবশ্যক। কর্ডোভার রাজপ্রাসাদ এবং মসজিদমালার দৃঢ়তা এবং কারুকৌশল এখনও জগতের বিস্ময়ের বিষয় লইয়া পড়িয়াছে। সমগ্র স্পেনে মুসলমান স্থাপত্য শিল্পকৌশলের যে অপূর্ব গরিমা প্রদান করিয়াছিলেন, তাহা জগতের ইতিহাসে এক মহারহস্যের বিষয়াভূত হইয়া পড়িয়াছে। ইউরোপীয়গণ এই বিজ্ঞানোন্নত যুগেও তাহার অনুসরণ করিতে অক্ষম রহিয়াছেন।

ব্যবহারিক শিল্পে ইউরোপ এখন অনেক উন্নতি করিলেও, সৌন্দর্য, স্থায়িত্ব এবং দৃঢ়তায় স্পেনের রাসায়নিক শিল্পকে পরাস্ত করিতে পারে নাই। বস্ত্র শিল্প এখানে চরম উন্নতি লাভ করিয়াছিল।রেশম বয়নে আন্দালুসিয়া (স্পেন) পৃথিবীকে বিমুগ্ধ করিয়াছিল। এখানে রেশমের নানা প্রকারের সূক্ষ্ম এবং মসৃণ বস্ত্র প্রস্তুত হইত, ইউরোপের খ্রিস্টান রাজধানীসমূহে তাহার ব্যবহার হইত। পাঠক মনে করেন, এক কর্ডোভাতেই অন্যূন এক লক্ষ ৩০ হাজার তাঁতী কৌষের বয়নে নিযুক্ত ছিল। ভূমন্ডলে রেশমী পরিচ্ছেদের ব্যবহারে কর্ডোভা যাবতীয় নগরীকে পরাস্ত করিয়াছিল। আলমোরিয়া নগরে সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট গালিচা এবং সূক্ষ্ম বস্ত্র প্রস্তুত হইত।

ধাতব এবং মৃন্ময় পাত্রাদি অপূর্ব উন্নতি লাভ করিয়াছিল। তাম্র, কাঁসা, পিতল এবং মৃন্ময় বাসন-শিল্পে স্পেনীয় শিল্পীগণ অপূর্ব কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়াছিল। মেজর্কা দ্বীপের মৃৎপাত্রগুলি ইউরোপ এবং আফ্রিকার যাবতীয় বন্দরে এবং নগরে সাদরে বিক্রয় হইত। পরবর্তী সময়ে এই মেজর্কা দ্বীপে মৃন্মীয় বাসন-শিল্প ইটালীতে গৃহিত এবং বিস্তৃত হইয়া’মেজলিকা’ নামে খ্যাতিলাভ করে। মৃৎপাত্রগুলি স্বর্ণ এবং রৌপ্যরঞ্জিত হইয়া সৌন্দর্য ও ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ করিত। আলমোরিয়াতে লৌহ, কাংস এবং কাচেঁর অসংখ্য প্রকারের বিচিত্র পাত্রাদি নির্মিত হইত। আলমোরিয়াতে কাঁচের একটি বিরাট কারখানা ছিল, এই কারখানায় উৎকৃষ্ট শ্রেণীর বিবিধ প্রকারের ঝাড়, ফানুস, লন্টন এবং জলপাত্রাদি প্রস্তুত হইত। হস্তিদন্তের খোদাই-শিল্প চমৎকার সৌন্দর্য এবং সূক্ষ্মতা লাভ করিয়াছিল। হস্তিদন্ত-নির্মিত মণিমুক্তা খচিত আধারসমূহ ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের নিকট নিতান্ত প্রিয় বস্তু ছিল। খলিফা দ্বিতীয় হাকামের নামে উৎসর্গীকৃত একটি অতীব মনোজ্ঞ হস্তিদন্তরচিত পেটিকা জেরোনা নগরের খ্রিস্টীয় ভজনাগারে সযত্নে রক্ষিত হইয়া দর্শকের মনাকর্ষণ করিতেছে। স্পেনের সোলতান এবং আমীরদিগের অত্যদ্ভূত শিল্পকৌশলসম্পন্ন তরবারির বাঁটসমূহ এখনও ইউরোপীয় বিভিন্ন যাদুঘরে রক্ষিত রহিয়াছে। ধাতুশিল্পে কর্ডোভার শিল্পীগণ আশ্চর্য নৈপুণ্য প্রকাশ করিতেন। সামান্য সামান্য চাবি এবং তালাগুলি পর্যন্ত কারুকার্যে শোভিত হইত। আলমোরিয়া, সেভিল, টলেডো, মর্সিয়া এবং গ্রানাডা যুদ্ধের অস্ত্র-শস্ত্রাদির জন্য বিখ্যাত ছিল। টলেডোর তরবারি এবং ছুরিকা বহুমূল্যে বিক্রয় হইত। কাংসের চালাই কার্যে যথেষ্ট নৈপুণ্য পরিলক্ষিত হইত। বৃহৎ বৃহৎ কাংস-কপাটসমূহ যাহা এখনও খ্রিস্টানদিগের ভজনাগারের শোভা সম্পাদন করিতেছে, দর্শন করিলে বিস্মিত হইতে হয়। উজ্জ্বল কাংসনির্মিত ফানুস এবং ঝাড়সমূহে আশ্চর্যরুপে খোদাই কৌশল এবং চিত্রাঙ্কন পরিব্যক্ত হইয়াছে। গ্রানাডার সোলতান তৃতীয় মুহাম্মদের জন্য নির্মিত একটি মসজিদের বিচিত্র দর্শন আলোকাধার এখনও মাদ্রিদের মিউজিয়ামের রক্ষিত আছে। অলঙ্কার এবং জরীর কার্যের পারিপাট্য কায়রো এবং দামেস্ক অপেক্ষা কোনও অংশেই ন্যূন ছিল না। বস্তুত কর্ডোভা মহানগরী যেমন জ্ঞানচর্চায় এবং ঐশ্বর্যে, তেমনি শিল্প ও বাণিজ্যে পৃথিবীর মুকুটমণি স্বরুপ ছিল। যাবতীয় ঐতিহাসিকগণ কর্ডোভার লোক-চমকিত সৌভাগ্য এবং প্রতাপের বিশদ বর্ণনায় স্ব-স্ব ইতিবৃত্ত অলঙ্কৃত করিয়াছেন। হায় স্পেন, তোমার সেই গৌরব-কাহিনী অতীত কাহিনী, অধঃপতিত মুসলমানের প্রাণে কবে উন্নতি আকাঙ্ক্ষা পুনঃপ্রজ্বলিত করিবে?