আমাদের এই দেশ চিরদিন বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত। ইহার বাণিজ্য খ্যাতিতে প্রলুব্ধ হইয়া আরবগণ স্মরণাতীত কাল পূর্ব হইতেই ইহার সহিত বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং দলে দলে আসিয়া এদেশে উপনিবিষ্ট হন। বাণিজ্য বিষয়ে তখন ইহার এতদূর শ্রীবৃদ্ধি সাধিত হইয়াছিল যে, ইতিহাস বিখ্যাত তাম্রলিপ্ত ও সপ্তগ্রামের সহিত ইহার ঘোর প্রতিযোগিতা চলিত। ইহার বাণিজ্য-খ্যাতি প্রাচ্যদেশে ছড়াইয়া সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিল। খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগীজেরা আসিয়া এদেশে বাণিজ্য করিতে আরম্ভ করেন। তাঁহারা সপ্তগ্রামকে Porto Piqueno বা ক্ষুদ্র বন্দর এবং চট্টগ্রামকে Porto Grando বা বৃহৎ বন্দর নামে অভিহিত করিতেন। বাণিজ্য বিষয়ে ইহা যে তখন সপ্তগ্রাম অপেক্ষা বেশি উন্নত ছিল, তাহা ইহা হইতেই সহজে অনুমিত হইতে পারে। এই দেশের বাণিজ্য সমৃদ্ধি ইংরেজদিগকে এখানে আকর্ষণ করিয়া আনিয়াছিল। ওলন্দাজ কর্তৃক চুঁচুড়া হইতে বিতাড়িত হওয়ার পর ক্রমাগত হুগলী, বালেশ্বর ও হিজলী বন্দরের উপযোগিতা পরীক্ষার পর ইংরেজ কোম্পানী অবশেষে এই চট্টগ্রামকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বন্দর বলিয়া মনোনীত করিয়াছিলেন। সেকালের মুসলমান নবাব ইংরেজদের তৎকালীন চট্টগ্রাম-বিজয়-বাসনার মূলে কুঠারাঘাত করিতে না পারিলে, সম্ভবত আমাদের এই চট্টগ্রামই ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী হইয়া পড়িত। এখন আমরা বেপারীর বেপারী তস্য বেপারীতে পরিণত হইয়া কোনরূপে কায়ক্লেশে জীবন ধারণ করিয়া আছি মাত্র। যে বাণিজ্য যুগ-যুগান্ত ধরিয়া কেবল মুসলমানেরই একচেটিয়া ব্যাপার ছিল, তাহা এখন ধীরে ধীরে অন্য জাতির হস্তগত হইতেছে; যে দেশে মুসলমান ভিন্ন অন্য জাতীয় ব্যবসায়ী খুব বিরল পরিদৃষ্ট হইত, আজ সে দেশে ক্রমেই ভিন্ন জাতীয় ব্যবসায়ীর দল বৃদ্ধি হইতেছে। ইহা পরিতাপের বিষয় হইলেও উপায় নায়। কারণ চিরদিন কাহারও কখন সমান যায় না এবং ভবিতব্যতার গতিও কেহ রোধ করিতে পারে না।

আমাদের এই ধন্য-দেশ পাহাড়-পর্বত-সঙ্কুল হইলেও একান্ত নদীমাতৃক। এজন্য ইহাতে বাণিজ্যের মত কৃষিরও বিস্তর সুবিধা রহিয়াছে। দক্ষিণে শঙ্খ ও মাতামুহুরি আর কর্ণফুলি নদী পূর্বাশার দূরদিগন্তস্থিত পর্বতমালা হইতে উৎপন্ন হইয়া পশ্চিম মুখে গিয়া অনন্ত বিস্তার বঙ্গোপসাগরের বারিরাশির সহিত কোলাকুলি করিতেছে। এই নদী তিনটি চট্টগ্রামের প্রায় সমগ্র সমতল ভূভাগকে সরসতা ও সজীবতা প্রদান করিয়া উহাকে শস্য-শ্যামল ও সুজল করিয়া রাখিয়াছে। বঙ্গোপসাগর সংগমে মহেষখালি, কুতুবদিয়া প্রভৃতি দ্বীপের উদ্ভব হইতে আমাদের জন্মভূমি কেবল সসাগরা নয়, সদ্বীপা আখ্যা ধারণেরও অধিকারিণী। কর্ণফুলি ও ফেনী নদীর স্রোত প্রবাহিত মৃত্তিকারাজিতে সন্দ্বীপ নামক প্রসিদ্ধ দ্বীপের উৎপত্তি। রাজকীয় বিধানে উহা নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত হইলেও নানা কারণে চট্টগ্রামের ইতিহাসে উহার নাম একটা অবশ্য উল্লেখযোগ্য বিষয়। আরাকানের মগ, ত্রিপুরা, পর্তুগীজ ও মুসলমানের ভাগ্যচক্রের গতি বিনির্ণয়ে উহার কার্যকারিতা কত অধিক, তাহা আপনারা একটু পরেই দেখিতে পাইবেন। খ্রিস্টীয় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে এই সন্দ্বীপের বুকের উপর দিয়া অনেক ভীষণ রণতরঙ্গের অভিনয় হইয়া গিয়াছে। চন্দ্রশেখর পর্বতের শিখরদেশ হইতে দক্ষিণ দিকে নয়ন ফিরাইলে দৃষ্টিচক্রবালে অনন্ত বিস্তার বারিধি-বক্ষে উহাকে ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যানের মত এক ভাসমান উদ্যান বলিয়া প্রতীয়মান হইবে। প্রাগুক্ত বৃহৎ নদীগুলি ছাড়া চট্টগ্রামে অসংখ্য ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী প্রবাহিত রহিয়াছে। এই সকল স্রোতস্বিনী কামদুহা পয়স্বিনীর মত সারা বৎসর আমাদের কৃষিকার্যের জল সরবরাহ করিয়া থাকে। ইহাদের বক্ষের উপর দিয়া আমরা দেশীয় জলযান যোগে যেখানে সেখানে অনায়াসেই যাতায়াত করিতে পারি। অবাধ বহির্বাণিজ্যের স্রোত রুদ্ধ হইলে আমাদের কৃষিজাত ফল-শস্যে আমরা পরের মুখাপেক্ষী না হইয়া স্বচ্ছন্দেই জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতে সক্ষম।

আমাদের প্রত্যন্তবাহী লবণাম্বু সমুদ্র আমাদের সম্বৎসরের লবণ যোগাইতে সর্বদা মুক্তহস্ত। কিন্তু, রাজবিধানে আমরা তাহা ব্যবহার করিতে পারি না। এদেশের সমুদ্র উপকূলে এক সময়ে লবণ প্রস্তুতের বিস্তৃত কারখানা বিদ্যমান ছিল। সেইসব কারখানা তখন অনায়াসে সমগ্র বঙ্গে লবণ যোগাইতে পারিত। এই ব্যবসায় এখন আমাদের একেবারে উঠিয়া গিয়াছে। কেন উঠিয়া গিয়াছে সেকথা বলিতে পারিব না। এখন ব্যবসায়টা উঠিয়া গিয়াছে, লবণের খাতগুলি বালুকাপূর্ণ হইয়া পড়িয়াছে বটে, কিন্তু লবণ পূর্বে যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে। শুনিয়াছি স্থানীয় দুষ্ট লোকেরা গোপনে লবণ তৈয়ার করিয়া পরে ধরা পড়িয়া সরকারের নিকট জরিমানা দেয়; কেহ কেহ সরকারী ডেকের খানা পর্যন্ত খাইয়া যায়। লিবারপুলী লবণই এখন আমাদের অবশ্য ব্যবহার্য। আমাদের কবি নবীনচন্দ্র কত আক্ষেপেই না গাহিয়া গিয়াছেন :

“লবণাম্বুরাশি বেষ্টিত যে স্থল,
জন্মে লিবারপুলে লবণ তাহার।”
    

লবণ ভিন্ন এই দেশে এক সময়ে উৎকৃষ্ট কাগজ তৈয়ার হইত। আমাদের পটীয়ায় - এই অভাজনের বাড়ির পার্শ্বেই সেই কাগজীপাড়া এখন শ্মশানের দগ্ধাবিশিষ্ট কাষ্ঠখণ্ডের মত দাঁড়াইয়া আছে। এই দেশের কাগজে সমস্ত দেশের কাজ চলিত। তখন সরকারী দপ্তরে পর্যন্ত এই কাগজই ব্যবহৃত হইত। ঢেঁকিযন্ত্রে রাত্রে শণ পাট ছেঁচিবার ধুম্‌ধুম্‌ শব্দে পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীদের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটিত ; ইহা বড় বেশি দিনের কথা নহে। এখন এই কারবার একেবারে সমূলে উৎপাটিত হইয়াছে। এরূপ কাগজ সাধারণত ’হরিতালী কাগজ’ নামে পরিচিত। এই হরিতালী কাগজে লিখিত অসংখ্য প্রাচীন পুঁথি আপনারা প্রদর্শনী গৃহে দেখিতে পাইবেন।

আমাদের যোগী-জোলারা আমাদের লজ্জা নিবারণের উপযোগী পরিধেয় প্রস্তুত করিতে এখনও সম্পূর্ণ সমর্থ। আমাদের চতুর্দিগস্থ গভীর অরণ্যানী, গৃহনির্মাণের উপযোগী বাঁশ, বেত ইত্যাদি ইন্ধনোপযোগী কাষ্ঠাদি দ্বারা সতত আমাদের পরিচর্যায় নিরত। আমাদের নিত্য-ব্যবহার্য কোন দ্রব্যের জন্যই আমাদিগকে পরের মুখের দিকে তাকাইতে হয় না। পানীয় জলের জন্য আমাদিগকে অন্য দেশের মত চাতকের ন্যায় হাহাকার করিতে হয় না। আমাদের পুণ্যাত্মা পূর্বপুরুষদের খনিত অসংখ্য দীঘি ও পুষ্করিণীই আমাদের পানীয় জল যোগাইয়া থাকে। আমাদের এই দেশকে দীঘি ও পুষ্করিণীর দেশ বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। বাংলার আর কোন দেশে আমাদের মত এত দীঘি ও পুষ্করিণী আছে কিনা বলিতে পারি না। আমাদের প্রাচীন সুখ-সম্পদ ও এই দীঘি-পুষ্করিণীর কথা বিবেচনা করিতে গেলে আমাদের প্রাচীন কবি শেখ ফয়জুল্লাহর ’গোরক্ষ বিজয়ে’ বর্ণিত কথা কয়টি স্মরণ করিতে হয় :

“নাথে বোলে এই রাজ্য বড় হএ ভালা।
চারি কড়া কড়ি বিকাএ চন্দনের তোলা॥
লোকের পিঁধন দেখে পাটের পাছড়া।
প্রতি ঘর চালে দেখে সোনার কোমড়া॥
কার পখরির পানি কেহ নাহি খাএ।
মণি-মাণিক্য তারা রৌদ্রেতে শুকাএ॥
ধন্য ধন্য রাজনগর করি এ বাখানি।
সুবর্ণের কলসে সর্ব লোকে খাএ পানি॥”
    

এই কথাগুলি আমাদের এই ধন্য দেশকে লক্ষ্য করিয়াই লিখিয়া গিয়াছেন বলিয়া আমাদের মনে হইয়া থাকে। কিন্তু হায় ! আজ শুধু আমাদের সেই দীঘি-পুষ্করিণী অতীতের সাক্ষীস্বরূপ পড়িয়া রহিয়াছে, কোথা হইতে কালের ঝঞ্ঝাবাত আসিয়া সুখ-সম্পদের সঙ্গে আমাদের সেই সোনার কলস ও মণি-মাণিক্যও উড়াইয়া লইয়া গিয়াছে।

আমাদের এই দেশ বাণিজ্যের জন্য – বিশেষত সামুদ্রিক বাণিজ্যে চিরপ্রসিদ্ধ, তাহা আগে একবার বলিয়াছি। এই বাণিজ্যের সর্বপ্রধান সহায় বাণিজ্য-তরণীর জন্য আমাদিগকে পরের উপর নির্ভর করিতে হইত না। এদেশেই সমস্ত জাহাজ নির্মিত হইত। চৈনিক পরিব্রাজক মাহুয়ান্‌ লিখিয়া গিয়াছেন, এই দেশের জাহাজ নির্মাণ প্রণালীর শ্রেষ্ঠতা হৃদয়ংগম করিয়া মহামান্য রোমের সম্রাট আলেকজেন্দ্রিয়ার ডক কারখানা এবং জাহাজ নাপছন্দ করিয়া এই চট্টগ্রাম হইতেই জাহাজ তৈয়ার করাইয়া লইতেন। এই শহরের দক্ষিণ দিকস্থ হালিশহর, পতেঙ্গা প্রভৃতি গ্রামে এদেশীয় শিল্পীর কর্তৃত্বে অনেকগুলি জাহাজ নির্মাণের কারখানা ছিল। এই সকল কারখানা তখন হাতুড়ির ঠক্‌ঠক্‌ শব্দে অহর্নিশি মুখরিত থাকিত। স্থাপত্য বিদ্যায় বর্ণজ্ঞানশূন্য অশিক্ষিত কারিগরেরা স্বীয় অমার্জিত বুদ্ধিবলে কেবল হস্তযন্ত্রের সাহায্যে যে প্রকাণ্ড জাহাজ নির্মাণ করিত এবং এখনও করিয়া থাকে, তাহা দেখিলে বিস্ময়ের সীমা থাকে না। এদেশের সওদাগরেরা তখন এককালে শতাধিক জাহাজের মালিক ছিলেন। হান্টার সাহেব লিখিয়াছেন, এই সকল জাহাজ নির্মাণের কারখানা ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্বীয় প্রভাব অক্ষুন্ন রাখিয়াছিল। বর্তমান ইউরোপীয় মহাসমরের গতিকে বিলাতি আগ্নেয় তরণীর সংখ্যা হ্রাস হওয়ায় সম্প্রতি আমাদের এই গৌরবের শিল্পটি নির্বাণোন্মুখ প্রদীপ-শিখার মত একটু উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিয়াছে। জানি না ইহা জন্মের মত শেষ ঔজ্জ্বল্য কিনা। উক্ত মহাসমরের অবসানে বিলাতি জাহাজ আবার যখন পঙ্গপালের মত দেশ ছাইয়া ফেলিবে, তখন আমাদের এই সাধের শিল্পের পুনর্মুষিকীভবের বিশেষ সম্ভাবনা আছে, তাহা বোধ হয় না বলিলেও চলিবে। তাহা হইলেই ত ইহা একটা অতীত স্মৃতিবাহী কিংবদন্তী ও স্বপ্নকাহিনীতে পরিণত হইয়া যাইবে এবং কিছুকাল পরে আমাদের সন্তানেরাই ইহাকে পরীর গল্পের মত একটা উদ্ভট গল্পকথা বলিয়া মনে করিবে। সম্প্রতি এখানকার দোভাষী আবদুর রহমান সাহেব কয়েকখানি বৃহৎ জাহাজ নির্মাণ করাইয়া আমাদিগকে পালতোলা জাহাজের নির্মাণ-কৌশল দেখিবার সুযোগ দিয়াছেন। পঁচিশ-ত্রিশ বৎসর পূর্বে এই কর্ণফুলী নদীবক্ষে এই সকল জাহাজ শ্রেণীবদ্ধ রাজহংসীর ন্যায় ভাসমান থাকিয়া অপূর্ব শোভা বিস্তার করিত। আমাদের কবি নবীনচন্দ্র মনের আবেগে এক সময়ে গাহিয়াছিলেন :

“পল্লববিহীন একটি কানন
সিন্ধুবক্ষে যেন ভাসিছে, মরি।”
    

আপনারা এখন কর্ণফুলির বক্ষে সেই পল্লববিহীন কানন আর দেখিবেন না, কিন্তু জাহাজ মাস্তুলের দুই চারিটা পল্লববিহীন বৃক্ষমাত্র দেখিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া যাইতে পারেন। বাঙালি মস্তিষ্কের উদ্ভাবনী শক্তি ও বাহুবলের পরিচায়ক অনেক কীর্তিকলাপই দেশ হইতে একে একে লোপ পাইয়াছে। হায় ! আমাদের দেশের এই শেষ কীর্তিটুকুও অচিরে ইউরোপীয় তরণী বাহিয়া একেবারে জন্মের মত অদৃশ্য হইয়া যাইবে।

সমুদ্রাভিযানে এদেশের মুসলমানগণ চিরাভ্যস্ত। আপনারা বোধ হয় জানেন, বিলাতি জাহাজের লস্কর ও খালাসির মধ্যে অধিকাংশ লোকই এই দেশীয়। এদেশে এমন লোক অনেক আছে, যাহারা জলপথে পৃথিবী পরিভ্রমণ করিয়া পৃথিবীর নানা নগর ও বন্দর দর্শন করিয়া আসিয়াছে। ভারত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ, চীনদেশ, ব্রহ্মদেশ, মালদ্বীপ, লাক্ষাদ্বীপ, আন্দামান, জাভা, সুমাত্রা, এমন কি সুদূর মিসর দেশ পর্যন্ত তখন আমাদের অনেকে যাতায়াত করিত। কারণ তখন ঐ সকল দেশের সহিত আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। ভারতবর্ষের সহিত সামুদ্রিক বাণিজ্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য চীন-সম্রাট ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গহো নামক এক রাজদূতকে ভারতে প্রেরণ করেন। তাঁহার ভ্রমণবৃত্তান্ত পাঠে জানা যায় যে, তিনি আমাদের এই নগরেই অবস্থান করিতেন। পূর্বোল্লিখিত ইবনে বতুতা নামক প্রসিদ্ধ আরবীয় পর্যটক ১৪৪৩ খ্রিস্টাব্দে মালাবার উপকুল হইতে মালদ্বীপ হইয়া এই চট্টগ্রামে উপনীত হন এবং এই দেশের জাহাজে চড়িয়া জাভা দ্বীপ হইয়া চীন দেশে গমন করেন। এই সময়ে মাহুয়ান্‌ নামক আর একজন চীন দেশীয় ভ্রমণকারী এদেশে পদার্পণ করিয়াছিলেন। তাঁহার লিখিত বিবরণ হইতে জানা যায়, তখন চট্টগ্রাম তাম্রলিপ্তকে অতিক্রম করিয়া চীন এবং মালয় দ্বীপপুঞ্জের সহিত বাণিজ্য সম্বন্ধ সংস্থাপন করিয়াছিল। এই সকল স্থানের সহিত তখন চট্টগ্রামের একচেটিয়া বাণিজ্য ছিল। নৌবিদ্যাবিশারদ অনেক কাপ্তান, মালুম ও নাবিক এদেশে জন্মিয়াছিলেন। সেই বিদ্যার জোরে তাঁহার মহাসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালা অগ্রাহ্য করিয়া অবলীলাক্রমে তরণী বাহিয়া চলিতেন। কিন্তু হায় ! এখন আমাদের ’তে হি নো দিবসাঃ গতাঃ’। আমাদের সেই পালতোলা বাণিজ্য তরণীও নাই, সেই কাপ্তান মালুমও নাই। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় মাত্র এখন আমাদের সেই পূর্ব খ্যাতি বিরাজিত, – বাস্তব রাজ্যে তাহা নৈশ স্বপ্নবৎ অলীক।