মানুষ মানুষকে কত প্রেম করে তা ভাবতে গেলে আশ্চর্য হতে হয়। মহাজীবনের পশ্চাতে কতকগুলো ভক্ত-প্রাণ থাকে, যারা সর্ব অবস্থায় আপন ভক্তির দেবতাকে প্রেম করে ধন্য হন। হয়ত মহাজীবনের চাইতে এইসব ভক্তের মূল্য বেশি। এঁরাই আপন আপন শক্তি ও প্রেমের বলে মহাজীবনকে জয়যুক্ত করেন – যদিও জগৎ তাদের একজনকেও জানে না।

নেপোলিয়ন আপন সৈন্যদলের সম্মুখে বের হলে তাদের হৃদয় যেন এক প্রচণ্ড বিদ্যুৎ শিহরণে জেগে উঠত। প্রভুর পদশব্দের তালে তালে তাদের হৃদয়ে রক্ত তরঙ্গিত হতো। তারা অন্ধ আবেগে, আপন প্রভুর জন্যে প্রেমের মাদকতায় চেতনাশূন্য হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন দিত। এই অন্ধভক্তির প্রভাবে নেপোলিয়ন সারা ইওরোপের রাজা হয়েছিলেন। হুমায়ুন পথের ফকির হলেন – সিংহাসনচ্যূত নিঃস্বার্থ পথের ভিখারী ভারতের সম্রাট হুমায়ুনের পশ্চাতে তার কতিপয় বিশ্বস্ত প্রেমিক ভক্ত ছাড়া আর কেউ ছিল না। এই ভক্তের দল তাকে জয়যুক্ত করেছিল বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছিল, নিরাশার বুকে আশা দিয়েছিল। যখন আরবে পৌত্তলিকেরা প্রভু মুহাম্মদকে হত্যা করার জন্যে তরবারি হস্তে পশ্চাতে পশ্চাতে ছুটেছিল, তখন তার সঙ্গে ছিল দুই ভক্ত, তারা হলেন আলী ও আবুবকর। রসুলকে বাঁচান ছিল যাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ চিন্তা। নিজেদের জীবনের মায়া তাঁদের ছিল না। হলদিঘাটের মহাযুদ্ধে রানাপ্রতাপ মোগল হস্তে সাতটি আঘাত পেয়েছেন – তথাপি উন্নত অধীর আবেগে সমর উত্তেজনায় সম্মুখে অগ্রসর হয়েছে। তার একান্ত ভক্তজনেরা তাকে অনেকবার শত্রুচক্রের ভেতর হতে পশ্চাতে টেনে এনেছেন। তথাপি তিনি শত্রু নিধনে জ্ঞানশূন্য। শেষবারে ঝাঁসীয়া রাজ আপন প্রাণ দিয়ে তাঁকে পতন হতে রক্ষা করলেন। ভক্তের এই জীবনদানের ফলে সেদিন প্রতাপ রক্ষা পেয়েছিলেন, নইলে কিছুতেই রক্ষা পেতেন না।

পূজিত বীরের চাইতে তার রক্তদানের জীবনের মূল্য কোন অংশে কম নয়।

বীরকে জানা এবং তাকে সর্বপ্রকার প্রেম করা মহাজীবনের প্রকৃতি। ’মহামানুষ’ ছাড়া ’মহাজীবন’ কে অনুভব করতে পারে?