যাদের হৃদয় অনুন্নত, তারা কি পথের ভিখারী রানাপ্রতাপ এবং সর্বহারা ইমাম হোসেনের জীবনের মূল্য বুঝতে পারে? আজ তের শত বছর ধরে মুসলিম জগতে কারবালা প্রান্তরের যুদ্ধে (?) মহররম উৎসব নামে সুসম্পন্ন হচ্ছে। বাঙালী মুসলমান সমাজ সেই মুসলিম জগতের একটি অংশ। তাঁরা সবাই নবীর ভক্ত, নবীর নামে দরুদ পড়েন, ইমাম হোসেনের জন্য শোকাশ্রু ফেলেন, মহররমের রোজা করেন – কিন্তু সত্যি কি তারা মহামান্য প্রিয়তম ইমাম হোসেনের মূল্য অনুভব করেছেন? কিছু না, কিছু না। যদি করতেন, তাহলে তারা স্বাধীনতার মূল্য বুঝতেন। রানা প্রতাপের ভাই মানসিংহ সম্রাট আকবরের মন্ত্রী হয়ে কত সুখেই না জীবন কাটাচ্ছিলেন। অন্যদিকে মহামান্য প্রতাপ পাহাড়ে পাহাড়ে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ঘাসের রুটি খেয়ে স্বাধীনতার গৌরব রক্ষা করেছেন। এই মহাপুরুষদ্বয়ের জীবনের মূল্য মুসলমান বোঝেন কি? বাঙ্গালী মুসলমানের কাছে একটা সাবডেপুটির পদ কত আকাঙ্ক্ষিত বস্তু। একটা দারোগার কাজ পাওয়া তার পক্ষে কত বড় ভাগ্যের কথা - মন্ত্রিত্ব পাওয়া তো দূরের কথা।

এজিদ বললেন – হোসেন একটুখানি বশ্যতা স্বীকার করলেই আমি তাকে মহা সম্মানে, সুখ ও সম্মানের আসনে বসাব। একটুখানি সে নত হোক।

ইমাম ঃ নবী দৌহিত্র ইমাম হোসেন সত্য ও ন্যায়ের মর্যাদা অস্বীকার করে জীবন, সম্পদ ও সম্মান চাননি। আপন জীবনের, আপন বংশের এবং আপন ভক্ত আত্মীয়-বন্ধুগণের হৃদয়-রক্ত দিয়ে মরুভূমির প্রতি বালুকণাকে স্বর্গের পুষ্পগন্ধে সুরভিত করে তুলেছিলেন – জেনেশুনে মৃত্যুর হলাহল অমৃত বোধে আকণ্ঠ পান করলেন। এই জীবন বলি, এই কোরবাণীই তাঁর কাছে গৌরবের মৃত্যু। হায় মুসলমান জাতি, তোমরা কারবালার মহামৃত্যুর মূল্য বুঝবে কি? কারবালার যুদ্ধে শুধু পুরুষ নয় নারীও আপন হৃদয়-রক্ত দিয়ে ইমামের স্বাধীনতাবোধের পূজা করেছিলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শোণিতপণ অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পূজা শুধু পুরুষকে দিয়ে হবে না, নারীও চাই। পতনের সুগভীর গুহায় পড়ে মুসলিম নারী সমাজের শক্তি না হয়ে তাকে টেনে অন্ধকারের অতল তলে নামাচ্ছে। স্বাধীনতার মহাপূজারী মহাবীর রানার পত্নী স্বামীর পশ্চাতে পথে পথে ঘুরেছেন। মহাজীবনের পরম ভক্ত এই মহিয়সী নারীর সম্মান জগতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। দেবশিশুগুলো রুটি খেয়ে স্বাধীনতার উপাসক পিতার পশ্চাৎ পশ্চাৎ হাসিমুখে ছুটেছেন। এসব জীবনের গৌরব সাধারণ মানুষ কি আত্মায় অনুভব করতে পারে? ঈশ্বরের চরম স্পর্শ যারা আত্মার বেদিতে পেয়েছেন, তারাই জানেন স্বাধীনতার পূজা কেমন করে করতে হয় – ঈশ্বরের পথে প্রকৃত কোরবানি কাকে বলে। বছর বছর মাংসের কাবাব খাওয়ার নাম কোরবানি নয়। ন্যায় ও বিজয়ের পথে জীবনের পরিপূর্ণ বিনোদনের নাম কোরবানি। জীবনের প্রতি কাজে, প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে সর্বদুঃখ জয় করে সত্যের পূজা করা – এটাই মহামানুষের জীবনের চরম ও পরম উপাসনা।

রানাকে এবং ইমামকে সে সময় অনেকেই বাতুল বলে উপহাস করেছিলেন – আল্লাহর মহা-দরবারে কিন্তু তাঁদের নাম সর্বোচ্চ স্তরে লিখিত হচ্ছিল। তাঁদের জীবনের দুঃখ বরণের এবং স্বীকারের মূল্য প্রকৃত মানুষ ছাড়া কে আত্মায় অনুভব করতে পারে? উত্তর – কেউই না।

হোসেন মরণ বরণ করেও সর্বত্র পূজিত। পৃথিবীর কোন জাতির মধ্যে ইতিহাসের কোন পৃষ্ঠায় অতীতে এবং বর্তমানে সত্য ও ন্যায়ের জন্য এমন স্বর্গীয় মরণ বরণের মহাদৃষ্টান্ত দেখা যায় না। আমরা কি এ মহাজনের অনুরাগী? রানা প্রতাপ পরাজিত হয়েও অনেক বিজয়ী সেনাপতির চাইতে শ্রেষ্ঠ, প্রতাপের মহাত্যাগের দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত বিরল। স্বাধীনতার পূজারী জগতের আর কে? যে জাতির মধ্যে এমন মানুষ জন্মেছেন, সে জাতি মানুষের সম্মান ও আত্মীয়তার যোগ্য।