কোন অজ্ঞাত বিষয়কে জানবার ও পাবার জন্য আত্মার আন্তরিক সাধনার নাম তপস্যা।

জগতের সমস্ত সুখ-সুবিধা ও সৃষ্টির পশ্চাতে মানুষের আন্তরিক বহুকালব্যাপী তপস্যা আছে! তপস্যা ছাড়া, সত্য উদ্ধারের সুকঠিন ব্রত ছাড়া জগতের কোন কল্যাণ-সাধন সম্ভব নয়। তপস্যার আন্তরিকতা, তন্ময়তা, আত্মার সুগভীর সুকঠিন বেদনা ব্যাকুলতা চাই। নইলে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। হয়ত এক জীবনে কিছু হয় না। জীবনের পর জীবনে অসীম ত্যাগ, দুঃখ ও সহিষ্ণু অন্বেষণ শেষে জয়যুক্ত হয়। চিকিৎসাশাস্ত্র মানুষের বহুযুগের তপস্যার ফল। বিনা তপস্যায় কোন কিছু লাভ হয় না। বহুকাল বিদ্যালাভের চেষ্টা ব্যতীত কেউ বিদ্বান হয় না। কোন একটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্র তৈরি একদিনে হয়নি! রেলগাড়ি, তার, উড়োজাহাজ, গ্রামোফোন সৃষ্টি, এ কি দুই-একদিনে হয়েছে?

সুখময়, চিন্তাভাবনাহীন, অন্বেষণহীন ব্যাকুলতা ও চেষ্টাহীন জীবনে কোন কল্যাণ লাভ হয়? মুসলমানদের মধ্যে বর্তমানে কোন তপস্যা আছে কি? মুসলিম জাতির পক্ষে এশিয়ায় ও ইউরোপে রাজত্ব স্থাপন কি সহজে সম্ভব হয়েছিল? নানা শাস্ত্রে তাদের কৃতিত্ব কি বহু তপস্যার ফল নয়? সে তপস্যা কই আমাদের এখন? আত্মার দিক দিয়ে যেন আমরা মরে গেছি। জীবনের চিহ্ন মাত্র নেই। ধর্ম ব্যাপারটা যা নাকি একেবারেই আত্মার বিষয়, তা তো এখন হয়েছে শরীরের ও ওষ্ঠের ব্যায়াম মাত্র। আল্লাহকে পাবার তপস্যাই বা আমাদের কৈ? মিথ্যা, মাদকতা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, লোভ প্রভৃতি পশুভাবকে জয় করবার তপস্যা এসব জীবনের বড় কথা – তা তো আমাদের নেই। স্রোতের মুখে কাণ্ডারীহীন ভেলার মত চলেছি ভেসে।

জীবনহীনতার এই যে লক্ষণ – এ বড় সহজ বিষয় নয়। এই অহিফেন অবসাদ হয়ত তাকে একেবারেই ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। তার আস্ফালন ও গর্বের কোন মূল্য নেই। জাতি হিসাবে জগতে তার অস্তিত্ব থাকবে না – থাকবে তার স্মৃতি, যেমন অতীতকালের ল্যাটিন ও গ্রীক জাতি কিংবা মুসলমান জাতি হবে জগতের গোলাম। দাসের জাতি; কিংবা ইহুদীদের মত – দেশহীন, জাতীয় সংঘবদ্ধতা বর্জিত, জাতীয়তাবোধহীন – জগতের পৃষ্ঠা হতে বিতাড়িত।

আল্লাহর শক্তি মানুষের ভিতর দিয়েই প্রকাশিত হয়। সেই ভাবময় জীবনময় সর্বশক্তির আধার, সর্বকল্যাণের উৎস, আদিশক্তির তপস্যা কই? তার জীবন-মন্দিরে প্রবেশের পথ মুসলমানদের জন্য রুদ্ধ হয়েছে। এ খুব নিরাশার কথা, কিন্তু খুব সত্য।

জীবনের কোন কল্যাণকর বিষয়ে আমাদের তপস্যা নেই – তপস্যা আছে একটি জিনিসের – দাসত্বের, পরপদলেহনের, জাতিকে, সমাজকে, গ্রামকে, মানুষকে ভুলে আত্মসুখসর্বস্ব, পত্নী ও সন্তানসর্বস্ব, জীবনের অনন্ত সম্ভাবনা বিস্তৃত চাকুরে জীবনের। ধিক্‌ আমাদিগকে। বড়লোক হবার, ব্যবসায়ে কৃতিত্ব লাভের, জাতির ভিতর মহাকাজ করবার, পৃথিবী-বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হবার, কবি ও দার্শনিক হবার, বুজর্গ ফকির হবার কোন তপস্যা আমাদের নেই।

অতৃপ্তির হলাহল আকণ্ঠ পান না করলে কি মনুষ্য জীবনের মঙ্গলযাত্রা শুরু হয়? কোন অসন্তোষ, কোন অতৃপ্তি আমাদের নেই। যা আছি ভালই আছি, আল্লাহ ভালই রেখেছেন, এই হচ্ছে প্রভুর কাছে আমাদের সুতৃপ্তির উপাসনা।

কত নর-নারী হায়! জীবনে এদের কারো তীর্থযাত্রা নেই। যে যেখানে আছে, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।