একটা পূর্ণাঙ্গ, সুন্দর দুর্জেয় প্রেমময় মহাশক্তি সৃষ্টির প্রতিস্তরে কাজ করছে। এ শক্তি থেকে মানবচিত্ত প্রেরণা ও শক্তি লাভ করে। ঐ শক্তি মনুষ্যজ্ঞানের উৎস।

উপাসনা এই উন্নত মহাশক্তির কাছে চিত্তের প্রণতি, ভক্তি ও বশ্যতা!

উপাসনাহীন জীবন অপবিত্র। যে জীবন দিবা-রাত্রির কোন সময় প্রভুর অনন্ত প্রেমের কথা স্মরণ করে না – সে জীবন এক অফুরন্ত সম্পদ থেকে বঞ্চিত থাকে। কিন্তু যেভাবে মুসলমান জাতি বর্তমানে উপাসনার অভিনয় করে থাকেন – তা নিরর্থক। আত্মার সঙ্গে যে উপাসনার যোগ নেই তাকে কোনমতে উপাসনা বলা চলে না। প্রভুর সম্মুখে আত্মার পরম নির্ভরতা, পরম অনুতাপের অবস্থা, হৃদয়ের বিগলিত অবস্থার নাম উপাসনা। আবৃত্তি কখনও উপাসনা নয়।

প্রভুর পথে অন্যান্য জাতির তুলনায় মুসলমান জাতি হিসাবে প্রত্যহ পঞ্চাশ মাইল পিছিয়ে পড়ছে। তার আধ্যাত্মিক অগ্রগতি নেই। এ ক্ষতি কোনকালে পূরণ হবে না। কেউ কি প্রাণকে ফেলে দেহের পূজা করে? প্রাণহীন দেহের মূল্য কি? অথচ মোহবশত অনেকে দেহের পূজা করে। তোমাদেরও মোহ জন্মেছে। বোঝ না। ভাষার অর্থের প্রতি লক্ষ্য কর না – শুধু আরবী ভাষাকে সম্মান কর। অক্ষর কি ভক্তির যোগ্য? অমন যে পূজিত রাজার শরীর, যা জীবনে কত যত্নে, কত সুখে পালিত হচ্ছে, প্রাণহীন হলে তাও দুর্গন্ধ এবং ঘৃণিত হয়ে ওঠে – সে শরীর কেউ ঘরে রাখে না। যখন অর্থবোধ হয় না – তখন আরবী ভাষায় কোন মূল্য নেই। তোমরা শুধু মোহবশত ভাষাকে ভালবাস – এ তো পৌত্তলিকতা। তোমরা তো পৌত্তলিক। অন্তরে যদি ভাব না থাকে, অনুভূতি না থাকে, তবে আল্লাহ্‌ তোমাদের প্রার্থনা গ্রহণ করতে পারেন না – কারণ অন্তরে তোমার কোন ভাব বা অনুভূতি নেই। ভাষা তো মানুষের তৈরি – ভাব মানবচিত্তে প্রথম জাগে, মানুষ নিজেদের প্রস্তুত ভাষায় তাই প্রকাশ করে। যে চিত্তে ভাব নেই, অনুভূতি নেই, তার ওষ্ঠের ভাষা আল্লাহ্‌ বোঝেন না। আল্লাহ্‌র কাছে তা পৌঁছে না। কি তুমি চাও তা নিজেই জান না – আল্লাহ্‌ তোমায় কি দেবেন?

না বুঝে প্রার্থনার ভঙ্গি করা, কোরান পড়া মহাপাপ। এই মহাপাপে মুসলমান জাতের সর্বনাশ হয়েছে, তার সমস্ত উন্নতির পথ বন্ধ হয়ে গেছে। মুসলমান নরনারী ধর্মহীন, আল্লাহ্‌হীন, শক্তিহীন জীবনের সর্বকল্যাণ আর্শীবাদ হতে সে বঞ্চিত। তার জীবন ভয়াবহ অন্ধকারে ভরা, ঘোর অশান্তিতে পূর্ণ, আগুনে সে পুড়ে মরে।

আল্লাহই মানুষের শক্তি ও প্রেরণার উৎস। মুসলিম জীবনে শক্তি ও প্রেরণা নেই – তার জীবনে কোন পরম ভরসা ও নির্ভরতা নেই। একটি মৌখিক বিশ্বাস সে করে মাত্র। জাতি হিসেবে তার যে সর্বনাশকর ক্ষতি হচ্ছে, তার মীমাংসা কোনকালে হবে না।

প্রার্থনা সব সময় স্বরচিত ও মাতৃভাষায় হওয়া উচিৎ। দু-একটি মাত্র আল্লাহ্‌র কালাম সমাজে ঐক্য রক্ষার জন্য প্রার্থনায় ব্যবহার কর, বাকি সমস্তই আপন আত্মার রচিত কথা হওয়া উচিৎ। আল্লাহ্‌র কালাম অর্থাৎ কোরান পুনঃ পুনঃ বুঝে পাঠ করলেই আত্মার প্রার্থনাকালে ভাষা আপনা থেকেই আসবে। আল্লাহ্‌র গ্রন্থের রস গ্রহণ করে নিজের রক্তমাংসের অংশ করে ফেল।

Bengal Education Conference. The All India Muslim League-এর মত অবিলম্বে (তোমাদের যখন কোন আমীর নেই তখন জাতিকেই আমীরের আসন গ্রহণ করতে হবে) ধর্ম সম্বন্ধে কি আমাদের কর্তব্য তা নির্ধারণের জন্য সমস্ত পণ্ডিতমণ্ডলীকে নিয়ে একটা Bengal Religious Conference নামে সভা গঠিত হওয়া উচিৎ। দীর্ঘ লম্বাচওড়া বিশ-তিরিশ রাকাত (দুই প্রণতিতে এক রাকাত) নামাজ বাদ দিয়ে ইমামের (Priest) ধর্মভাব-উদ্দীপক, প্রেম ও ভক্তিধারবর্ধক দীর্ঘ বক্তৃতা (Sermon) হওয়া অতি আবশ্যক। প্রার্থনায় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হওয়া কোনমতে অন্যায় নয়। প্রচলিত প্রার্থনার ভাষা গান ছাড়া আর কি? সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর বিশিষ্ট ব্যক্তিকেই ইমাম বলা হয়।

প্রত্যেক মহাজীবনের অন্তরালে প্রার্থনা আছে। মোস্তফা কামাল পাশা নিজের বলে জাতীয় জীবনে একটা পরিবর্তন এনেছেন এরূপ মনে করা বড়ই ভুল, অথচ একটা মূল্যহীন বাঙ্গালী মুসলমান তাকে অধার্মিক বলতে একটুও দ্বিধাবোধ করে না। প্রার্থনা প্রত্যেক মহাজীবনের পশ্চাতে থেকে তার জীবনের সমস্ত শক্তির রস গোপনে সরবরাহ করে। বাইরের লোক তা অনুভব না করতে পারলেও একথা মিথ্যা নয়।

শুক্রবার আমাদের সাপ্তাহিক উপাসনার দিন, প্রত্যেক মসজিদে অধীনস্থ অধিবাসীদের চাঁদার দ্বারা প্রতিপালিত সুশিক্ষিত একজন গ্র্যাজুয়েট ইমাম সমবেত ব্যক্তিগণকে যাতে ধর্মভাবে মুগ্ধ এবং প্রতি সপ্তাহে সকলের আত্মাকে উন্নততর করে গড়ে তুলতে পারেন, তার চেষ্টা করা একান্ত আবশ্যক। কেউ যেন উপাসনায় এসে না বলে – ’তাড়াতাড়ি সেরে ফেলুন’। তার নাম কি উপাসনা? ছি!