১৭৫
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে, হবে গো এইবার—
আমার এই মলিন অহঙ্কার॥
দিনের কাজে ধুলা লাগি অনেক দাগে হল দাগি,
এমনি তপ্ত হয়ে আছে সহ্য করা ভার
আমার এই মলিন অহঙ্কার॥
এখন তো কাজ সাঙ্গ হল দিনের অবসানে—
হল রে তাঁর আসার সময়, আশা এল প্রাণে।
স্নান ক’রে আয় এখন তবে, প্রেমের বসন পরতে হবে,
সন্ধ্যাবনে কুসুম তুলে গাঁথতে হবে হার।
ওরে আয়, সময় নেই যে আর॥
১৭৬
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা।
মন রে মোর, পাথারে হোস নে দিশেহারা॥
বিষাদে হয়ে ম্রিয়মাণ বন্ধ না করিয়ো গান,
সফল করি তোলো প্রাণ টুটিয়া মোহকারা॥
রাখিয়ো বল জীবনে, রাখিয়ো চির-আশা,
শোভন এই ভুবনে রাখিয়ো ভালোবাসা।
সংসারের সুখে দুখে চলিয়া যেয়ো হাসিমুখে,
ভরিয়া সদা রেখো বুকে তাঁহারি সুধাধারা॥
১৭৭
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
প্রতিদিন তব গাথা গাব আমি সুমধুর—
তুমি দেহো মোরে কথা, তুমি দেহো মোরে সুর—
তুমি থাক যদি মনে বিকচ কমলাসনে,
তুমি কর যদি প্রাণ তব প্রেমে পরিপূর,
প্রতিদিন তব গাথা গাব আমি সুমধুর॥
তুমি শোন যদি গান আমার সমুখে থাকি,
সুধা যদি করে দান তোমার উদার আঁখি,
তুমি যদি দুখ’পরে রাখ কর স্নেহভরে,
তুমি যদি সুখ হতে দম্ভ করহ দূর
প্রতিদিন তব গাথা গাব আমি সুমধুর॥
১৭৮
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
১৭৮
নিশীথশয়নে ভেবে রাখি মনে, ওগো অন্তরযামী,
প্রভাতে প্রথম নয়ন মেলিয়া তোমারে হেরিব আমি
ওগো অন্তরযামী॥
জাগিয়া বসিয়া শুভ্র আলোকে তোমার চরণে নমিয়া পুলকে
মনে ভেবে রাখি দিনের কর্ম তোমারে সঁপিব স্বামী
ওগো অন্তরযামী॥
দিনের কর্ম সাধিতে সাধিতে ভেবে রাখি মনে মনে
কর্ম-অন্তে সন্ধ্যাবেলায় বসিব তোমারি সনে।
দিন-অবসানে ভাবি ব’সে ঘরে তোমার নিশীথবিরামসাগরে
শ্রান্ত প্রাণের ভাবনা বেদনা নীরবে যাইবে নামি
ওগো অন্তরযামী॥ />
১৭৯
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
১৭৯
প্রতিদিন আমি, হে জীবনস্বামী, দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
করি জোড়কর, হে ভুবনেশ্বর, দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে॥
তোমার অপার আকাশের তলে বিজনে বিরলে হে—
নম্র হৃদয়ে নয়নের জলে দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে॥
তোমার বিচিত্র এ ভবসংসারে কর্মপারাবারপারে হে—
নিখিল ভুবনলোকের মাঝারে দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে॥
তোমার এ ভবে মম কর্ম যবে সমাপন হবে হে—
ওগো রাজরাজ, একাকী নীরবে দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে॥/>
১৮০
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
১৮০
জাগিতে হবে রে—
মোহনিদ্রা কভু না রবে চিরদিন,
ত্যজিতে হইবে সুখশয়ন অশনিঘোষণে॥
জাগে তাঁর ন্যায়দণ্ড সর্বভুবনে,
ফিরে তাঁর কালচক্র অসীম গগনে,
জ্বলে তাঁর রুদ্রনেত্র পাপতিমিরে॥/>
১৮১
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
১৮১
আমার যা আছে আমি সকল দিতে পারি নি তোমারে নাথ—
আমার লাজ ভয়, আমার মান অপমান, সুখ দুখ ভাবনা।
মাঝে রয়েছে আবরণ কত শত, কতমতো—
তাই কেঁদে ফিরি, তাই তোমারে না পাই,
মনে থেকে যায় তাই হে মনের বেদনা॥
যাহা রেখেছি তাহে কী সুখ—
তাহে কেঁদে মরি, তাহে ভেবে মরি।
তাই দিয়ে যদি তোমারে পাই কেন তা দিতে পারি না?
আমার জগতের সব তোমারে দেব, দিয়ে তোমারে নেব— বাসনা॥
১৮২
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
১৮২
জড়ায়ে আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই—
ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে।
মুক্তি চাহিবারে তোমার কাছে যাই,
চাহিতে গেলে মরি লাজে॥
জানি হে তুমি মম জীবনে শ্রেয়তম,
এমন ধন আর নাহি যে তোমা-সম,
তবু যা ভাঙাচোরা ঘরেতে আছে পোরা
ফেলিয়া দিতে পারি না যে॥
তোমারে আবরিয়া ধুলাতে ঢাকে হিয়া,
মরণ আনে রাশি রাশি—
আমি যে প্রাণভরি তাদের ঘৃণা করি
তবুও তাই ভালোবাসি।
এতই আছে বাকি, জমেছে এত ফাঁকি,
কত যে বিফলতা, কত যে ঢাকাঢাকি,
আমার ভালো তাই চাহিতে যবে যাই
ভয় যে আসে মনোমাঝে॥ />
১৮৩
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
১৮৩
উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে
ওই-যে তিনি, ওই-যে বাহির পথে॥
আয় রে ছুটে, টানতে হবে রশি—
ঘরের কোণে রইলি কোথায় বসি!
ভিড়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে গিয়ে
ঠাঁই ক’রে তুই নে রে কোনোমতে॥
কোথায় কী তোর আছে ঘরের কাজ
সে-সব কথা ভুলতে হবে আজ।
টান্ রে দিয়ে সকল চিত্তকায়া,
টান্ রে ছেড়ে তুচ্ছ প্রাণের মায়া,
চল্ রে টেনে আলোয় অন্ধকারে
নগর-গ্রামে অরণ্যে পর্বতে॥
ওই-যে চাকা ঘুরছে রে ঝন্ঝনি,
বুকের মাঝে শুনছ কি সেই ধ্বনি?
রক্তে তোমার দুলছে না কি প্রাণ ?
গাইছে না মন মরণজয়ী গান?
আকাঙক্ষা তোর বন্যাবেগের মতো
ছুটছে না কি বিপুল ভবিষ্যতে॥/>
১৮৪
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
১৮৪
আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ আপনারই আবরণ!
খুলে দেখ্ দ্বার, অন্তরে তার আনন্দনিকেতন॥
মুক্তি আজিকে নাই কোনো ধারে, আকাশে সেও যে বাঁধে কারাগারে,
বিষনিশ্বাসে তাই ভরে আসে নিরুদ্ধ সমীরণ॥
ঠেলে দে আড়াল; ঘুচিবে আঁধার— আপনারে ফেল্ দূরে—
সহজে তখনি জীবন তোমার অমৃতে উঠিবে পূরে।
শূন্য করিয়া রাখ্ তোর বাঁশি, বাজাবার যিনি বাজাবেন আসি—
ভিক্ষা না নিবি, তখনি জানিবি ভরা আছে তোর ধন॥/>
১৮৫
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
১৮৫
বাঁধন-ছেঁড়ার সাধন হবে,
ছেড়ে যাব তীর মাভৈ-রবে॥
যাঁহার হাতের বিজয়মালা
রুদ্রদাহের বহ্নিজ্বালা
নমি নমি নমি সে ভৈরবে॥
কালসমুদ্রে আলোর যাত্রী
শূন্যে যে ধায় দিবস-রাত্রি।
ডাক এল তার তরঙ্গেরই,
বাজুক বক্ষে বজ্রভেরী
অকূল প্রাণের সে উৎসবে॥/>
১৮৬
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
১৮৬
আমায় মুক্তি যদি দাও বাঁধন খুলে
আমি তোমার বাঁধন নেব তুলে॥
যে পথে ধাই নিরবধি সে পথ আমার ঘোচে যদি
যাব তোমার মাঝে পথের ভুলে॥
যদি নেবাও ঘরের আলো
তোমার কালো আঁধার বাসব ভালো।
তীর যদি আর না যায় দেখা তোমার আমি হব একা
দিশাহারা সেই অকূলে॥ />
১৮৭
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
১৮৭
বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ, কেমনে দিই ফাঁকি!
আধেক ধরা পড়েছি গো, আধেক আছে বাকি॥
কেন জানি আপনা ভুলে বারেক হৃদয় যায় যে খুলে,
বারেক তারে ঢাকি॥
বাহির আমার শুক্তি যেন কঠিন আবরণ—
অন্তরে মোর তোমার লাগি একটি কান্না-ধন।
হৃদয় বলে তোমার দিকে রইবে চেয়ে অনিমিখে,
চায় না কেন আঁখি ?।/>
১৮৮
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
১৮৮
এ আবরণ ক্ষয় হবে গো ক্ষয় হবে,
এ দেহমন ভূমানন্দময় হবে॥
চক্ষে আমার মায়ার ছায়া টুটবে গো,
বিশ্বকমল প্রাণে আমার ফুটবে গো,
এ জীবনে তোমারি, নাথ, জয় হবে॥
রক্ত আমার বিশ্বতালে নাচবে যে,
হৃদয় আমার বিপুল প্রাণে বাঁচবে যে।
কাঁপবে তোমার আলো-বীণার তারে সে,
দুলবে তোমার তারামণির হারে সে,
বাসনা তার ছড়িয়ে গিয়ে লয় হবে॥/>
১৮৯
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
১৮৯
সহজ হবি, সহজ হবি, ওরে মন, সহজ হবি—
কাছের জিনিস দূরে রাখে তার থেকে তুই দূরে র’বি॥
কেন রে তোর দু হাত পাতা— দান তো না চাই, চাই যে দাতা—
সহজে তুই দিবি যখন সহজে তুই সকল লবি॥
সহজ হবি, সহজ হবি, ওরে মন, সহজ হবি—
আপন বচন-রচন হতে বাহির হয়ে আয় রে কবি।
সকল কথার বাহিরেতে ভুবন আছে হৃদয় পেতে,
নীরব ফুলের নয়ন-পানে চেয়ে আছে প্রভাত-রবি॥/>
১৯০
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
১৯০
এই কথাটা ধরে রাখিস— মুক্তি তোরে পেতেই হবে।
যে পথ গেছে পারের পানে সে পথে তোর যেতেই হবে॥
অভয় মনে কণ্ঠ ছাড়ি গান গেয়ে তুই দিবি পাড়ি,
খুশি হয়ে ঝড়ের হাওয়ায় ঢেউ যে তোরে খেতেই হবে॥
পাকের ঘোরে ঘোরায় যদি, ছুটি তোরে পেতেই হবে।
চলার পথে কাঁটা থাকে, দ’লে তোমায় যেতেই হবে।
সুখের আশা আঁকড়ে লয়ে মরিস নে তুই ভয়ে ভয়ে,
জীবনকে তোর ভ’রে নিতে মরণ-আঘাত খেতেই হবে॥/>
১৯১
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
পূজা - সাধনা ও সংকল্প
১৯১
সেই তো আমি চাই—
সাধনা যে শেষ হবে মোর সে ভাবনা তো নাই॥
ফলের তরে নয় তো খোঁজা, কে বইবে সেই বিষম বোঝা—
যেই ফলে ফল ধুলায় ফেলে আবার ফুল ফুটাই॥
এমনি ক’রে মোর জীবনে অসীম ব্যাকুলতা,
নিত্য নূতন সাধনাতে নিত্যনূতন ব্যথা!
পেলেই সে তো ফুরিয়ে ফেলি, আবার আমি দু হাত মেলি—
নিত্য দেওয়া ফুরায় না যে, নিত্য নেওয়া তাই॥/>