৫৪৬
পূজা - বাউল
পূজা - বাউল
৫৪৬
আমি কান পেতে রই ও আমার আপন হৃদয়গহন-দ্বারে বারে বারে
কোন্ গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে— বারে বারে॥
ভ্রমর সেথা হয় বিবাগী নিভৃত নীল পদ্ম লাগি রে,
কোন্ রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে বারে বারে॥
কে সে মোর কেই বা জানে, কিছু তার দেখি আভা।
কিছু পাই অনুমানে, কিছু তার বুঝি না বা।
মাঝে মাঝে তার বারতা আমার ভাষায় পায় কি কথা রে,
ও সে আমায় জানি পাঠায় বাণী গানের তানে লুকিয়ে তারে বারে বারে॥
৫৪৭
পূজা - বাউল
পূজা - বাউল
৫৪৭
আমি তারেই খুঁজে বেড়াই যে রয় মনে আমার মনে।
সে আছে ব’লে
আমার আকাশ জুড়ে ফোটে তারা রাতে,
প্রাতে ফুল ফুটে রয় বনে আমার বনে॥
সে আছে ব’লে চোখের তারার আলোয়
এত রূপের খেলা রঙের মেলা অসীম সাদায় কালোয়।
সে মোর সঙ্গে থাকে ব’লে
আমার অঙ্গে অঙ্গে হরষ জাগায় দখিন-সমীরণে॥
তারি বাণী হঠাৎ উঠে পূরে
আন্মনা কোন্ তানের মাঝে আমার গানের সুরে।
দুখের দোলে হঠাৎ মোরে দোলায়,
কাজের মাঝে লুকিয়ে থেকে আমারে কাজ ভোলায়।
সে মোর চিরদিনের ব’লে
তারি পুলকে মোর পলকগুলি ভরে ক্ষণে ক্ষণে॥
৫৪৮
পূজা - বাউল
পূজা - বাউল
৫৪৮
সে যে মনের মানুষ, কেন তারে বসিয়ে রাখিস নয়নদ্বারে?
ডাক্-না রে তোর বুকের ভিতর, নয়ন ভাসুক নয়নধারে॥
যখন নিভবে আলো, আসবে রাতি, হৃদয়ে দিস আসন পাতি—
আসবে সে যে সঙ্গোপনে বিচ্ছেদেরই অন্ধকারে॥
তার আসা-যাওয়ার গোপন পথে
সে আসবে যাবে আপন মতে।
তারে বাঁধবে ব’লে যেই করো পণ সে থাকে না, থাকে বাঁধন—
সেই বাঁধনে মনে মনে বাঁধিস কেবল আপনারে॥
৫৪৯
পূজা - বাউল
পূজা - বাউল
৫৪৯
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে,
তাই হেরি তায় সকল খানে॥
আছে সে নয়নতারায় আলোক-ধারায়, তাই না হারায়—
ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়
তাকাই আমি যে দিক-পানে॥
আমি তার মুখের কথা শুনব ব’লে গেলাম কোথা,
শোনা হল না, হল না—
আজ ফিরে এসে নিজের দেশে এই-যে শুনি
শুনি তাহার বাণী আপন গানে॥
কে তোরা খুঁজিস তারে কাঙাল বেশে দ্বারে দ্বারে,
দেখা মেলে না, মেলে না—
তোরা আয় রে ধেয়ে, দেখ্ রে চেয়ে আমার বুকে—
ওরে দেখ্ রে আমার দুই নয়ানে॥
৫৫০
পূজা - বাউল
পূজা - বাউল
৫৫০
আমার মন, যখন জাগলি না রে
ও তোর মনের মানুষ এল দ্বারে।
তার চলে যাওয়ার শব্দ শুনে ভাঙল রে ঘুম—
ও তোর ভাঙল রে ঘুম অন্ধকারে॥
মাটির ’পরে আঁচল পাতি একলা কাটে নিশীথরাতি।
তার বাঁশি বাজে আঁধার-মাঝে, দেখি না যে চক্ষে তারে॥
ওরে, তুই যাহারে দিলি ফাঁকি খুঁজে তারে পায় কি আঁখি?
এখন পথে ফিরে পাবি কি রে ঘরের বাহির করলি যারে॥
৫৫১
পূজা - বাউল
পূজা - বাউল
৫৫১
আমি তারেই জানি তারেই জানি আমায় যে জন আপন জানে—
তারি দানে দাবি আমার যার অধিকার আমার দানে॥
যে আমারে চিনতে পারে সেই চেনাতে চিনি তারে গো—
একই আলো চেনার পথে তার প্রাণে আর আমার প্রাণে॥
আপন মনের অন্ধকারে ঢাকল যারা
আমি তাদের মধ্যে আপনহারা।
ছুঁইয়ে দিল সোনার কাঠি, ঘুমের ঢাকা গেল কাটি গো—
নয়ন আমার ছুটেছে তার আলো-করা মুখের পানে॥
৫৫২
পূজা - বাউল
পূজা - বাউল
৫৫২
জানি জানি তোমার প্রেমে সকল প্রেমের বাণী মেশে,
আমি সেইখানেতেই মুক্তি খুঁজি দিনের শেষে॥
সেথায় প্রেমের চরম সাধন, যায় খসে তার সকল বাঁধন—
মোর হৃদয়পাখির গগন তোমার হৃদয়দেশে॥
ওগো, জানি আমার শ্রান্ত দিনের সকল ধারা
তোমার গভীর রাতের শান্তিমাঝে ক্লান্তিহারা।
আমার দেহে ধরার পরশ তোমার সুধায় হল সরস—
আমার ধুলারই ধন তোমার মাঝে নূতন বেশে॥
৫৫৩
পূজা - বাউল
পূজা - বাউল
৫৫৩
তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি
আমি ডুবতে রাজি আছি আমি ডুবতে রাজি আছি॥
সকাল আমার গেল মিছে, বিকেল যে যায় তারি পিছে গো—
রেখো না আর, বেঁধো না আর কূলের কাছাকাছি॥
মাঝির লাগি আছি জাগি সকল রাত্রিবেলা,
ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা।
ঝড়কে আমি করব মিতে, ডরব না তার ভ্রূকুটিতে—
দাও ছেড়ে দাও, ওগো, আমি তুফান পেলে বাঁচি।
৫৫৪
পূজা - বাউল
পূজা - বাউল
৫৫৪
আমি যখন ছিলেম অন্ধ
সুখের খেলায় বেলা গেছে, পাই নি তো আনন্দ॥
খেলাঘরের দেয়াল গেঁথে খেয়াল নিয়ে ছিলেম মেতে,
ভিত ভেঙে যেই এল ঘরে ঘুচল আমার বন্ধ।
সুখের খেলা আর রোচে না, পেয়েছি আনন্দ॥
ভীষণ আমার, রুদ্র আমার, নিদ্রা গেল ক্ষুদ্র আমার—
উগ্র ব্যথায় নূতন ক’রে বাঁধলে আমার ছন্দ।
যে দিন তুমি অগ্নিবেশে সব-কিছু মোর নিলে এসে
সে দিন আমি পূর্ণ হলেম ঘুচল আমার দ্বন্দ্ব।
দুঃখসুখের পারে তোমায় পেয়েছি আনন্দ॥
৫৫৫
পূজা - বাউল
পূজা - বাউল
৫৫৫
আমারে পাড়ায় পাড়ায় খেপিয়ে বেড়ায় কোন্ খ্যাপা সে!
ওরে, আকাশ জুড়ে মোহন সুরে কী যে বাজে কোন্ বাতাসে॥
গেল রে, গেল বেলা, পাগলের কেমন খেলা—
ডেকে সে আকুল করে, দেয় না ধরা।
তারে কানন গিরি খুঁজে ফিরি, কেঁদে মরি কোন্ হুতাশে॥
৫৫৬
পূজা - বাউল
পূজা - বাউল
৫৫৬
মন রে ওরে মন, তুমি কোন্ সাধনার ধন!
পাই নে তোমায় পাই নে, শুধু খুঁজি সারাক্ষণ॥
রাতের তারা চোখ না বোজে— অন্ধকারে তোমায় খোঁজে,
দিকে দিকে বেড়ায় ডেকে দখিন-সমীরণ॥
সাগর যেমন জাগায় ধ্বনি, খোঁজে নিজের রতনমণি,
তেমনি করে আকাশ ছেয়ে অরুণ আলো যায় যে চেয়ে—
নাম ধরে তোর বাজায় বাঁশি কোন্ অজানা জন॥
৫৫৭
পূজা - বাউল
পূজা - বাউল
৫৫৭
কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস—
সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো,
পাগল ওগো, ধরায় আস॥
এই অকূল সংসারে
দুঃখ আঘাত তোমার প্রাণে বীণা ঝঙ্কারে।
ঘোর বিপদ-মাঝে
কোন্ জননীর মুখের হাসি দেখিয়া হাসো॥
তুমি কাহার সন্ধানে
সকল সুখে আগুন জ্বেলে বেড়াও কে জানে!
এমন ব্যাকুল ক’রে
কে তোমারে কাঁদায় যারে ভালোবাস॥
তোমার ভাবনা কিছু নাই—
কে যে তোমার সাথের সাথি ভাবি মনে তাই।
তুমি মরণ ভুলে
কোন্ অনন্ত প্রাণসাগরে আনন্দে ভাস॥
৫৫৮
পূজা - বাউল
পূজা - বাউল
আমারে কে নিবি ভাই, সঁপিতে চাই আপনারে।
আমার এই মন গলিয়ে কাজ ভুলিয়ে সঙ্গে তোদের নিয়ে যা রে॥
তোরা কোন্ রুপের হাটে চলেছিস ভবের বাটে,
পিছিয়ে আছি আমি আপন ভারে—
তোদের ওই হাসিখুশি দিবানিশি দেখে মন কেমন করে॥
আমার এই বাঁধা টুটে নিয়ে যা লুটেপুটে—
পড়ে থাক্ মনের বোঝা ঘরের দ্বারে—
যেমন ওই এক নিমেষে বন্যা এসে
ভাসিয়ে নে যায় পারাবারে॥
এত যে আনাগোনা কে আছে জানাশোনা,
কে আছে নাম ধ’রে মোর ডাকতে পারে?
যদি সে বারেক এসে দাঁড়ায় হেসে
চিনতে পারি দেখে তারে॥