ছাড়পত্র
ছাড়পত্র
ছাড়পত্র
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে তার মুখে খবর পেলুম: সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক, নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে। খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উত্তোলিত, উদ্ভাসিত কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়। সে ভাষা বোঝে না কেউ, কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার। আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের— পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে। এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান; জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি— নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার। অবশেষে সব কাজ সেরে আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে করে যাব আশীর্বাদ, তারপর হব ইতিহাস॥
রবীন্দ্রনাথের প্রতি
ছাড়পত্র
ছাড়পত্র
এখনো আমার মনে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি, প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা ছড়ায় যথারীতি, এখনো তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি, নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রূকুটি। এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে, তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে। এখনো স্বগত ভাবাবেগে, মনের গভীর অন্ধকারে তোমার সৃষ্টিরা থাকে জেগে। তবুও ক্ষুধিত দিন ক্রমশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলে, গোপনে লাঞ্ছিত হই হানাদারী মৃত্যুর কবলে; যদিও রক্তাক্ত দিন, তবু দৃপ্ত তোমার সৃষ্টিকে এখনো প্রতিষ্ঠা করি আমার মনের দিকে দিকে। তবুও নিশ্চিত উপবাস আমার মনের প্রান্তে নিয়ত ছড়ায় দীর্ঘশ্বাস— আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি, প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়, আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়, আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাতে, আমার বিস্ময় জাগে নিষ্ঠুর শৃঙ্খল দুই হাতে। তাই আজ আমারো বিশ্বাস, “শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।” তাই আমি চেয়ে দেখি প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে, দানবের সাথে আজ সংগ্রামের তরে॥
একটি মোরগের কাহিনী
ছাড়পত্র
ছাড়পত্র
একটি মোরগ হঠাৎ আশ্রয় পেয়ে গেল বিরাট প্রাসাদের ছোট্ট এক কোণে, ভাঙা প্যাকিং বাক্সের গাদায়— আরো দু’তিনটি মুরগীর সঙ্গে। আশ্রয় যদিও মিলল, উপযুক্ত আহার মিলল না। সুতীক্ষ্ণ চিৎকারে প্রতিবাদ জানিয়ে গলা ফাটাল সেই মোরগ ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত— তবুও সহানুভূতি জানাল না সেই বিরাট শক্ত ইমারত। তারপর শুরু হল তার আঁস্তাকুড়ে আনাগোনা: আশ্চর্য! সেখানে প্রতিদিন মিলতে লাগল ফেলে দেওয়া ভাত-রুটির চমৎকার প্রচুর খাবার! তারপর একসময় আস্তাকুঁড়েও এল অংশীদার— ময়লা ছেড়া ন্যাকড়া পরা দু’তিনটে মানুষ; কাজেই দুর্বলতর মোরগের খাবার গেল বন্ধ হয়ে। খাবার! খাবার! খানিকটা খাবার! অসহায় মোরগ খাবারের সন্ধানে বার বার চেষ্টা ক’রল প্রাসাদে ঢুকতে, প্রত্যেকবারই তাড়া খেল প্রচণ্ড। ছোট্ট মোরগ ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখে— ‘প্রাসাদের ভেতর রাশি রাশি খাবার’! তারপর সত্যিই সে একদিন প্রাসাদে ঢুকতে পেল, একেবারে সোজা চলে এল ধব্ধপে সাদা দামী কাপড়ে ঢাকা খাবর টেবিলে; অবশ্য খাবার খেতে নয়— খাবার হিসেবে॥
সিঁড়ি
ছাড়পত্র
ছাড়পত্র
আমরা সিঁড়ি, তোমরা আমাদের মাড়িয়ে প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও, তারপর ফিরেও তাকাও না পেছনের দিকে; তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন। তোমরাও তা জানো, তাই কার্পেটে মুড়ে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত ঢেকে রাখতে চাও তোমাদের অত্যাচারের চিহ্নকে আর চেপে রাখতে চাও পৃথিবীর কাছে তোমাদের গর্বোদ্ধত, অত্যাচারী পদধ্বনি। তবু আমরা জানি, চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে চাপা থাকবে না আমাদের দেহে তোমাদের এই পদাঘাত। আর সম্রাট হুমায়ুনের মতো একদিন তোমাদেরও হতে পারে পদস্খলন॥
অনুভব
ছাড়পত্র
ছাড়পত্র
১৯৪০ অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। অবাক পৃথিবী! আমরা যে পরাধীন অবাক, কী দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন; অবাক পৃথিবী! অবাক করলে আরো— দেখি এই দেশে অন্ন নেইকো কারো। অবাক পৃথিবী! অবাক যে বারবার দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার। হিসাবের খাতা যখনি নিয়েছি হাতে দেখেছি লিখিত— ‘রক্ত খরচ’ তাতে; এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম, অবাক পৃথিবী! সেলাম, তোমাকে সেলাম! ১৯৪৭ বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে, আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে, এত বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ, দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ; স্বপ্ন-চূড়ার থেকে নেমে এসো সব— শুনেছ? শুনছ উদ্দাম কলরব? নয়া ইতিহাস লিখেছে ধর্মঘট, রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদ-পট। প্রত্যহ যারা ঘৃণিত ও পদানত, দেখ আজ তারা সবেগে সমুদ্যত; তাদেরই দলের পিছনে আমিও আছি, তাদেরই মধ্যে আমিও যে মরি-বাঁচি। তাইতো চলেছি দিন-পঞ্জিকা লিখে— বিদ্রোহ আজ! বিপ্লব চারিদিকে॥
দেশলাই কাঠি
ছাড়পত্র
ছাড়পত্র
আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি না; তবু জেনো মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ— বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস; আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি। মনে আছে সেদিন হুলুস্থুল বেধেছিল? ঘরের কোণে জ্বলে উঠেছিল আগুন— আমাকে অবজ্ঞাভরে না-নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলায়! কত ঘরকে দিয়েছি পুড়িয়ে, কত প্রাসাদকে করেছি ধূলিসাৎ আমি একাই— ছোট্ট একটা দেশলাইয়ের কাঠি। এমনি বহু নগর, বহু রাজ্যকে দিতে পারি ছারখার করে তবুও অবজ্ঞা করবে আমাদের? মনে নেই? এই সেদিন— আমরা সবাই জ্বলে উঠেছিলাম একই বাক্সে; চমকে উঠেছিলে— আমরা শুনেছিলাম তোমাদের বিবর্ণ মুখের আর্তনাদ। আমাদের কী অসীম শক্তি তা তো অনুভব করেছো বারংবার; তবু কেন বোঝো না, আমরা বন্দী থাকবো না তোমাদের পকেটে পকেটে, আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব শহরে, গঞ্জে, গ্রামে— দিগন্ত থেকে দিগন্তে। আমরা বার বার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায়— তা তো তোমরা জানোই! কিন্তু তোমরা তো জানো না: কবে আমরা জ্বলে উঠব— সবাই— শেষবারের মতো!
কনভয়
ছাড়পত্র
ছাড়পত্র
হঠাৎ ধুলো উড়িয়ে ছুটে গেল যুদ্ধফেরত এক কনভয়: ক্ষেপে ওঠা পঙ্গপালের মতো রাজপথ সচকিত ক’রে আগে আগে কামান উঁচিয়ে, পেছনে নিয়ে খাদ্য আর রসদের সম্ভার। ইতিহাসের ছাত্র আমি, জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম ইতিহাসের দিকে। সেখানেও দেখি উন্মত্ত এক কনভয় ছুটে আসছে যুগযুগান্তের রাজপথ বেয়ে সামনে ধূম-উদ্গীরণরত কামান, পেছনে খাদ্যশস্য আঁকড়ে-ধরা জনতা— কামানের ধোঁয়ার আড়ালে আড়ালে দেখলাম, মানুষ। আর দেখলাম ফসলের প্রতি তাদের পুরুষানুক্রমিক মমতা। অনেক যুগ, অনেক অরণ্য, পাহাড়, সমুদ্র পেরিয়ে তারা এগিয়ে আসছে: ঝল্সানো কঠোর মুখে॥
আঠারো বছর বয়স
ছাড়পত্র
ছাড়পত্র
আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি, আঠারো বছর বয়সেই অহরহ বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় উঁকি। আঠারো বছর বয়সের নেই ভয় পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা, এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়— আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা। এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে, প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে। আঠারো বছর বয়স ভয়ঙ্কর তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা, এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা। আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান, দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ। আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে অবিশ্রান্ত; একে একে হয় জড়ো, এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো। তবু আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি, এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে, বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে। এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয় পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে, এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়— এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে॥
হে মহাজীবন
ছাড়পত্র
ছাড়পত্র
হে-মহাজীবন, আর এ কাব্য নয় এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো, পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো! প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা— কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়: পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্সানো রুটি॥